মনে পড়ছে ১২ জুলাই, ১৯৮৫ সালের কথা। তখন থাকি চেতলায়। তাই ব্রিজ পার হয়েই কেওড়াতলা শ্মশান। হাঁটছি। চোখে পড়ল রাসবিহারীর দিক থেকে একটি ব্যতিক্রমী শোক মিছিল আসছে। সামনে, সবার সামনে বীরদর্পে হাত তুলে গান করতে করতে আসছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা—প্রতুল কর্তৃক সুরারোপিত—সেই গান। প্রতুলের স্বর, তার সঙ্গে শ’খানেক তরুণের কন্ঠস্বর, মিলে মিশে তৈরি হচ্ছিল এক ভিন্নধর্মী ঐকতান। বীরেন্দ্র ভক্তবৃন্দ, তাঁর কবিতার সুরারোপ, ব্যতিক্রমী শোক মিছিল—সে কথা আজও ভুলিনি। ইতিপূর্বে তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতার সুরারোপ শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু এমন সদৃশ উদাহরণ আমার কাছে নেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর মিছিলও দেখেছি, গান স্যালুট ছিল কিন্তু তাতে এই সম্মেলক ভিন্ন সমাজমনস্কতার দৃষ্টান্ত ছিল না। দিন বদলের পালা বুঝি শুরু হল—মনে হচ্ছিল। হায়, ভ্রান্তি। বীরেনদাকে দেখতাম এখানে ওখানে সেখানে তাঁর নিজের লেখা ছোট ছোট কবিতা পুস্তিকা বিক্রি করতে, তরুণ কবিদের ভিড় থাকত চারপাশে, তাদের কবিতার বইও বিক্রি করতেন, পড়তেন, পড়াতেন। মঙ্গলাচরণের সহকর্মী ছিলাম বলে ওঁদের বামপন্থী ঘরানার কবিদের সঙ্গে লেখাসূত্রে একটু আধটু পরিচয় হচ্ছিল সেই সময়। তবে কবিতা নয়, গল্পের সঙ্গেই আমার সখ্য ছিল বেশি।
সম্ভবত: ৬৭তেই এক বছর শিক্ষকতাসূত্রে হাওড়ার একটি গ্রামে বেড়াতে যাই। আশ্চর্য কবিতা-প্রাণিত গ্রাম। কবি সম্মেলন। এমন এমন লোক কবিতা বলে ওঠেন যে চমকে চমকে উঠি। দুজন কবিকে আবিষ্কার করি। একজন লেদ মেশিনের সামান্য বেতনের কর্মী, আর একজন পানের বরজে চাষ করেন। আশ্চর্য সব কবিতা লিখতেন। টাটকা কবিতা, বরজের পাশে বসে লিখছেন, শোনাচ্ছেন আমাদের। শহরে ফিরলাম মুগ্ধতার ঘোর নিয়ে। ঠিক করলাম একটা ছোট্ট পত্রিকা বার করতে হবে। এই দুই কবির চারটে করে কবিতা বাছলাম। মঙ্গলাবাবু কবিতা দিলেন। মঙ্গলাবাবুর সূত্রেই পেলাম বীরেনদার একটি কবিতা। উত্তরপাড়া কলেজে গুলি চলেছিল। রক্তাক্ত কলেজ, বুলেট বিদ্ধ ছাত্র, সেই মর্মান্তিকতা নিয়ে। পরে এ কবিতাটি বিখ্যাত হয়। আমাদের তিনি অগ্রাহ্য করেননি, পেয়েছিলাম এক প্রতিবাদী কবিতা। (উত্তরপাড়া কলেজ: হাসপাতাল) আমাদের বন্ধু সুমিতা চক্রবর্তী বীরেন্দ্র স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেটির নাম ছিল—'বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা—প্রত্যক্ষের রূপ'। সে লেখা বীরেন্দ্রকে ধারাবাহিক ভাবে চিনতে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। তারপর আরও অনেকে লিখেছেন। কিছু পড়েছি, কিছু পড়ার সুযোগ ঘটেনি। আর পড়া শুরু করেছি বীরেন্দ্রের কবিতার পর কবিতা, শুনেছি তাঁর কবিতা নিয়ে গান—অনেকের গান। বুঝতে শুরু করেছিলাম এই কবির স্বতন্ত্র ভূমিকার কথা। এ বোধ করি আর এক আরম্ভের প্রস্তাবনা।
দেখতে দেখতে আমাদের কালের এক বিশিষ্ট কবি যে শতবর্ষে পা দিয়েছেন তা বুঝতে পারিনি। যাঁরা ভালোলাগার মানুষ বোধহয় তাঁদের বয়স বাড়ার কথা খেয়াল থাকে না। এই শতবর্ষ উদযাপনে অনেক অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়, সমধর্মী কবিদের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা যায়। একজন কবির আদি পর্বের ও পরিণত পর্বের বিবর্তন নিয়ে কথা তোলা যায়। কবিতার শৈলী, ছন্দ, চিত্রকল্প নিয়ে কথা বলা যায়। আবার পাঠক প্রতিক্রিয়া—সে কথাও আলোচ্য হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্যের পাঠক মাত্রই জানেন কোনো একজন লেখকের বই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে পারে না। রুচির ভিন্নতা, জীবনধর্মের প্রিয়তা অপ্রিয়তা কোনো কবিকে গ্রাহ্য বা সমালোচ্য করে তুলতে পারে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা সম্পর্কেও এই সবকটি দিকই প্রযোজ্য। কিন্তু আপাতত একটি প্রসঙ্গ আমরা বেছে নিচ্ছি। কবি ও কবিত্বের কোন ধরন বীরেন্দ্রর প্রিয় ছিল, কাদের, কোন কবিতা তিনি বর্জনে আগ্রহী—এসবই হয়ে উঠতে পারে একটি লেখার বিষয়।
কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। এটুকু বলা চলে কবিতা মাত্রেই পদ্য, যদিও সব পদ্যই কবিতা নয়। পদ্যে থাকে একটা যান্ত্রিকতা কিন্তু কবিতা সেই যান্ত্রিকতা উর্ত্তীর্ণ হয়ে অগ্রসর হয় এক implicit value judgement-এর দিকে। ভাষাবাহিত কল্পনা কবিতার ক্ষেত্রে তৈরি করতে চেষ্টা করে একটা মূর্ত বিমূর্ত পরিমণ্ডল—যা কালে কালোত্তরে ক্রমান্বয়ে আবিষ্কৃত হতে থাকে।
মনীন্দ্র রায়, সম্ভবত বীরেন্দ্রের সমসাময়িক, বলেছেন—‘বাংলা কবিতা প্রথম থেকেই দুটি প্রধান ঝোঁক নিয়ে চলতে শুরু করেছে। একটির লক্ষ্য হয় হৃদয়, অন্যটির বুদ্ধিবৃত্তি।’ (আমার কালের কবি ও কবিতা) মনীন্দ্র সঙ্গত ভাবেই বলেন—তাঁর কালে নাগরিকতাই মুখ্য সুর এবং কবিতা চলে আসে গদ্যের কাছাকাছি। তবে হৃদয় বা বুদ্ধিবৃত্তি কবিতার লিখনে বেশি, কম হতে থাকে। ত্রিশে বা চল্লিশে।
মনীন্দ্র বীরেন্দ্র বিষয়ে বলেন—‘বীরেন্দ্র প্রগতিশীল কবি, তাঁর সমস্ত কবিতাই মানুষের জন্যে। যন্ত্রণার জ্বালা তীব্র হয়ে বাজে তাঁর কবিতায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা কবিতার ভিতর দিয়ে ফোটে, শ্লোগানে পর্যবসিত হয় না।’ মন্তব্য অনেকটাই গ্রহণযোগ্য। যদিও শেষ কথাটা মানা যাবে না। বীরেন্দ্র সত্যিই ‘বড় অস্থির মানুষ, বেশ একটু রগচটাও।’ কথাটা মনীন্দ্র বলেছেন, শঙ্খ ঘোষও এক জায়গায় এমন বলেছেন। হয়ত ‘রগচটা’ বলেই বীরেন্দ্রর কবিতা ক্ষিপ্তমূর্তি পেয়েছে সত্তর দশকে, মাঝে মাঝে তাতে শ্লোগানের উষ্ণতাও চলে এসেছে।
সি. এম. বাওরা বলেছিলেন যাকে বলে public themes তা কবিতায় চলে আসছে শত শত শতাব্দী জুড়ে। এই জন বিষয়ের কবিতার আশ্রয়ে যে-সব ঘটনা পরম্পরা তা স্পর্শ করে বহুমানুষকে, তা গৃহীত হয় তাৎক্ষণিক বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে নয়, কখনও সহজ ভাবে, কখনও বিমূর্ততায়। বাওরা বলেন রাজনৈতিক কবিতার নির্মাণ সাধারণত হয় না কল্পনাসজ্ঞাত অতীত নিয়ে, কবি আত্মস্থ করেন, ব্যাখ্যা করেন বিপুল বর্তমানকে। কখনও আগ্রহী কবি গ্রহণ করতে চান বহির্জাগতিকতাকে অনেকটাই যদিও স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না, আবার বড়ো ঘটনাকে কবিতা করে তুলতে চান, তবে private angle-এ, যা পাঠক সমাজে ঢেউ তোলে না। বড়ো ঘটনা, ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ, কল্পনা প্রসার—রাজনৈতিক কবিতা oscillates between these extremes. তবে রাজনৈতিক কবিতার শিরদাঁড়া শক্ত-সমর্থ হয় কবির এই সংহত ধারণায় যে এ কবিতার উচ্চারণে সামিল হবে হাজারো মানুষ। তাহলে current event এবং impressive conviction, এই দুটিই সার কথা। (Poetry and Politics—C. M. Bowra, প্রথম অধ্যায়) বীরেন্দ্রর পরিণত মনের কবিতা, সত্তর ও আশির দশকের কবিতা পড়তে গেলে, বুঝতে গেলে, পাঠককে এ পথেই যাচাইয়ে নামতে হবে।
বীরেন্দ্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন—‘যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমি টেররিস্ট পার্টির হুকুমে ওঠবোস করেছি। যখন আরেকটু বড় হয়েছি তখন আমি চেষ্টা করেছি একজন ক্ষুদে কমিউনিস্ট হতে।’ (নান্দীমুখ ১৯৮০) এবং ‘মার্ক্সবাদে আমার অঙ্গীকার কোনোদিনই সুভাষ বা সুকান্তর সঙ্গে সমান্তরাল রেখা ধরে চলেনি।’ তাঁর প্রথম কবিতার বই—গ্রহচ্যুত (১৩৫০), 'কথার মৃত্যু', 'নিরাশা', 'রুদ্ধগৃহ', 'আশা', 'পুনর্জন্ম'—এই পাঁচটি শিরোনামে বিভক্ত মোট ৩৫টি কবিতার প্রায় সবগুলিতেই প্রেমের সহজ সরল উচ্ছ্বাস ধরা পড়েছে। বারংবার ঘুরে ফিরে এসেছে প্রিয় নারীকে কাছে পাওয়ার আকুলতা এবং না পাওয়ার বিরহ ব্যকুলতা। নায়িকা প্রায়শ প্রণয়ভঙ্গকারী বিবাহিতা। তাই পুনর্মিলনের সম্ভাবনা নেই। নাগরিক জীবনের জটিলতা নেই, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ নেই। নামকরণগুলি লক্ষণীয়—‘তোমার বিয়ের আগে’, ‘তোমার সিঁথিতে চিহ্ন’, ‘তুমি তো চলেই গেলে’, ‘তোমার সিঁথির সিঁদুর’ ইত্যাদি। কিশোর জীবনে প্রেম, প্রেমের কথা থেকে গেছে অব্যক্ত। জীবনানন্দ দাশের প্রভাব অস্বীকার করেন নি। বলেছেন ‘চল্লিশের প্রগতি সাহিত্য প্রথম থেকেই আমার কাছে খণ্ডিত এবং যান্ত্রিক বলে মনে হয়েছে।’ তাঁদের বেশ কিছু ফ্যাসিবিরোধী কবিতা ওই সময় আমার কাছে যান্ত্রিক ও নিষ্প্রাণ বলে মনে হয়েছে। প্রশ্ন তুলেছেন—‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ বা ‘জাপ পুষ্পকে ঝরে ফুলঝুরি, জ্বলে হ্যাঙকাও’ এইসব হাততালি কুড়োনো কবিতা কি সত্যিকারের ফ্যাসীবিরোধী কবিতা? ‘চল্লিশের একজন পুরোধা কবিও দেশভাগের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন না’, জীবনানন্দ ছটফট করছেন রূপসী বাংলার কবিতাগুলি নিয়ে। তারপর শ্লেষে বলেন চল্লিশ পার হতেই আমাদের ‘প্রগতিশীল কবিরা দলবেঁধে কবিতার আকাশে বিশ্বশান্তির পায়রা উড়িয়ে দিলেন।’ তবে স্বীকার্য সুকান্ত, বিমল ঘোষ, অরুণ মিত্র, সুভাষ, সমর, মনীন্দ্র, মঙ্গলা ‘বেশকিছু স্মরণীয় কবিতা’ লিখেছেন ‘যা আজও আমাদের টানে, পিপাসায় জল দেয়।’ বীরেন্দ্র প্রথম জীবনের ব্যক্তিগত প্রেমের কবিতাগুলি থেকে কোনওদিনই মুখ ফিরিয়ে নিতে চান নি। আর সত্তরের রক্তস্নাত কবিদের কাছে শিক্ষা নিতে চান। একদিকে তিনি বলেন আমি কোনো রাজনৈতিক কর্মী বা যোদ্ধা নই আবার বলেন যুধিষ্ঠিরের মতো চারপাশের পৃথিবীকে নানাভাবে দেখতে চাই। আজ মনে হয় এসব উপলব্ধির সড়কে জটিলতা আছে। কারণ সত্তরে বীরেন্দ্র স্পষ্টত কবি-যোদ্ধা আর তখন তাঁর মধ্যে যুধিষ্ঠিরের সুস্থিরতা থাকা সম্ভব ছিল না।
চল্লিশের কবিতা, সুমিতা চক্রবর্তীর মতে—সমকাল সচেতন এবং ইতিহাস মনস্ক। এ সময়ের কবিতা শিল্প সাহিত্যকে সমকালের দর্পণ করে তুলতে চেয়েছে। সুমিতা এটাও বলেন চল্লিশের সাম্যবাদী কবিদের মধ্যে বীরেন্দ্রর স্থান একটু স্বতন্ত্র। জাতীয়তাবাদী অনুশীলন দলের সঙ্গে সামান্য সংযোগ স্কুলে থাকতেই কেটে যায়, ফ্যাসিবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডে, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কিছুটা যোগাযোগ ঘটে। তবে যেহেতু পার্টি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ তাই বীরেন্দ্রও দ্বিধান্বিত। তাছাড়া বিষয় ও আঙ্গিকে নিয়মনিষ্ঠ না থেকে নিজের মতো থাকার পক্ষপাতী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছর থেকে বিশ্বব্যপ্ত বিপর্যয় এবং উৎপীড়ক ও উৎপীড়িত সম্পর্ক বিষয়ে ক্রুদ্ধ। ('বাঁকুড়া ১৩৫২' কবিতা দ্রষ্টব্য) তাঁর নতুন মাস (১৯৪৬) সংকলনেও প্রেমের কবিতা, আত্ম উপলব্ধির কবিতা, আবার উৎপীড়িত মানুষের জন্য আগ্রহ।
দুজন মান্য কবির অভিমত এখানে তুলে ধরা যাক। সতীর্থ সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন—চল্লিশে বীরেন্দ্র ব্যক্তিমনস্কতার কবি। তার দশ বছর পর দেখা দিল ‘একক সংগ্রামী মানবতা।’ (উলুখড়ের কবিতা, ১৯৫৪) তার পর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল ‘নির্বিশেষ মানবতাবাদ।’ এবং ‘মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিদের সম্পর্কে মোহমুক্তি’। সরোজলালের মতে বীরেন্দ্রে আছে—‘বেদনাময় মানবতায় উত্তরণ’ এবং সত্তরে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধিতা’। এ পর্যায়ে স্পষ্টতর হয় ‘শ্রেণীচেতনা’। (চল্লিশের তিন কবি) প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ দিয়ে গেছেন।
অপর অভিমত শঙ্খ ঘোষের। তিনি যা বলেন তার সংক্ষিপ্তসার হল—১৯৪৬ সালে যে কবিতার বইটি বীরেন্দ্র ছাপেন তার মলাটে পরাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা এবং সুভাষচন্দ্রকে উৎসর্গ করা। বীরেন্দ্রের কবিতা—‘জন্মভূমির মাটিকে ছুঁয়ে থাকার কবিতা।’ এ কবিতা জেগে ওঠে ‘জীবনযাপনের নিজস্ব সত্য থেকে।’ ‘সমস্ত অর্থেই বাংলার সবচেয়ে প্রতিবাদী এই কবি।’ সত্তরে ক্রমান্বয়ে জেগে উঠতে থাকে তাঁর ‘ক্রদ্ধ মুখচ্ছবি সমস্ত ভণ্ডতা আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের বিবেক হিসেবে।’ শেষপর্যন্ত শঙ্খবাবু বলেন বীরেন্দ্রের 'বিদ্রোহের উচ্চারণ, ক্রুদ্ধ মুখ আর প্রেমিক মুখচ্ছবির কথা।’ (মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম/ সময়ের জলছবি)
বেশ কিছু ধারণা করা গেল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর কবিতা সম্পর্কে। আমরা এই প্রবন্ধে তাঁর প্রতিবাদী সত্তারও কিছু উদাহরণ তুলে ধরব।
একটি পাঁচ লাইনের কবিতা; শুরুতে বলছেন—
‘মুখে যদি রক্ত ওঠেপরিস্থিতির বিরূপতা, যাতে সত্য ঘোষণার বিপদ আছে।
সেকথা এখন বলা পাপ ...’
রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেন—
‘দুঃস্বপ্নেও এমন সর্বনাশ/ স্বাধীন জন্মভূমিকে নিয়ে ভাবনি তুমি কবি/ মানবতার স্বপ্নে তাই অটল ছিলে।
প্রতিবাদী ও প্রত্যাঘাতী কবি বলেন—
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়েক্ষুব্ধ কবি বলেন—
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো ধ্বংস করো তারে
সামনে থেকে হটো, বেইমান, কুকুরগুলো সামনে থেকে হটাওজনৈক নিহত কবির উদ্দেশে তাঁর শ্রদ্ধার্পণ—
তুমি কাদের ভয় দেখাও?
যারা এই শতাব্দীর রক্ত আর ক্লেদ নিয়ে খেলা করে(নিহত কবির উদ্দেশে) এ কবিতাতেই তিনি ‘পোশাকী কবিতা’র সমালোচনা করছেন। একদিকে কালের জল্লাদদের সমালোচনা, অন্য দিকে পোশাকী কবিতার প্রতি ঘৃণা। এ সময়েই লেখা একটি কবিতায় তিনি বলেন—
সেইসব কালের জল্লাদ
তোমাকে পশুর মত বধ ক’রে আহ্লাদিত?’
‘একেই বলে গণতন্ত্র; এরই জন্য কবিতার সর্দার সাহিত্যের মোড়লেরা কেঁদে ভাসান’
এ গণতন্ত্র ভাত, মিছিল সবেতেই শাসকরা গুলি চালিয়ে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করে। চারদিকে যখন ক্রমান্বয় নরমেধ যজ্ঞ তখন—‘কবিরা কবিতা লেখে, দেশপ্রেম, ক্রমে গাঢ়তর হয় গর্ভের ভিতর রক্তপাত’ আর 'মহান নেতারা বাজারে ফেরি করে মার্কস লেনিন স্ট্যালিন গান্ধী এক এক পয়সায়।’ আক্রান্ত-শাসক, দেশপ্রেমী সৌখিন কবি, দেশনেতাদের বাজারি প্রেম। এই জাগর কবি জানেন—‘বাংলার নেতা, কবি, সাংবাদিক, রাত গভীর হলে/ গোপনে নিজের সন্তানের ছিন্ন শির ভেট দেয়’ দিল্লীতে। এখন স্বদেশ—ভিতরে বাহিরে নিষ্প্রদীপ।
১৯৭২-এ লেখা হয় এক বিস্ফোরক কবিতা—যার প্রথম অংশে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্কতা, বোদলেয়র আচ্ছন্নতা (বুদ্ধদেব ও বাংলা কবিকুল), নাজিম হিকমত এবং নেরুদা অনুবাদপ্রিয়তা (সুভাষ ও অনুগামীরা) দেশ ভেসে যায় হাজার শিশুর রক্তে—
‘যা লেখ যা ইচ্ছে লেখ কিন্তু খবরদার, দিওনা সাপের লেজে পা,
যা লেখ কবিতা লেখ কিন্তু কে তোমার মাথায় দিয়েছে দিব্যি, যা কদাচ প্রকাশ্য নয়, এ ভর-সন্ধ্যায়, এই কালবেলায় করতে হবে উচ্চারণ?
বদলেয়ার ভেঙে খাও, স্বপ্নে দেখ নাজিম হিকমত
অনুবাদ করো পাবলো নেরুদা
তোমার স্বদেশ বধ্যভূমি ....
(যা লেখ কবিতা লেখ)
নিকানর পাররার (চিলি) একটি কবিতা মনে পড়ে —
|| তরুণ কবিরা ||যথার্থ কবিতা ও শৌখিন কবিতা ও নিশ্চুপ দেশপ্রীত গণতন্ত্রপ্রীত কবিতার পার্থক্য আজ তিনি জেনে নিয়েছেন রক্তাক্ত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে —লেখো যা তোমাদের ইচ্ছে
লেখো যে ধাঁচে লিখতে পছন্দ করো
প্রচুর রক্ত কিন্তু বয়ে গেছে সেতুর তলা দিয়ে
এটাই বিশ্বাস করতে হবে
মাত্র একটি রাস্তাই কিন্তু সাচ্চা
কবিতায় তো সব কিছুই চলবে
তবে একটি শর্ত আছে, অবশ্য :
সাদা কাগজে নিজেকে করে তুলতে আরো উন্নত
‘জানেনা, কবিতা শুধু কথা নয়, অন্য অনুভব অন্য গভীরতা,প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কবির ক্রমান্বয় ক্রোধ ও দুঃখ। অরবিন্দ পোদ্দারকে সম্বোধন করে (উক্ত নাম প্রতিনিধি মাত্র) কবি জানান—
তার ভিতর বাহির পরিপূর্ণ ভালবেসে;’
‘মাথা উঁচু রাখতে হয় ঝড়ে, জলেদেশ যখন ভেসে যায় রক্তে, কবি তখন দেখেন ক্লীবতা, দৈন্য বজায় রেখেই ‘সোনার মেডেল’ লুব্ধতা (আকাদেমী পুরস্কার ইত্যাদি)। অপর একটি কবিতায় আক্রান্ত সমবয়সি নীরেন চক্রবর্তী এবং তাঁর বিখ্যাত কবিতা—‘কলকাতার যীশু’। শেষ কটি পঙ্ক্তি এরকম—
কুয়াশায় ....
তবু মাথা উঁচু রাখতে হয়, নরকেও।’
‘পোশাক ছাড়া নীরেন, আমরাসতীর্থ বন্ধু কবি গোলাম কুদ্দুসকে সমালোচনা করে বীরেন্দ্র লেখেন—একদা তুমি ‘ইলা মিত্র’ কবিতা লিখে চরম অসম্মানে প্রতিবাদ জানিয়েছিলে। আজ সেই ‘অগ্নিশুদ্ধ কবি’ গাণ্ডীব ছুঁড়ে দিয়েছে, কলমে আর জ্বলে না তুষের আগুন। ‘ছেলে গেছে বনে’র কবি সুভাষকেও ধিক্কার দেন এই কবিতায়। আজ এই দুজনেই, ইলা মিত্র ও সুভাষ হেটমুণ্ডে দুঃশাসনের জন্য (কংগ্রেস সমর্থক সি. পি. আই প্রার্থীর জন্য) ভোট কুড়ান। মহাভারতের প্রসঙ্গ এনে বীরেন্দ্র ধিক্কার দিয়ে বলেন—‘কবিরা কোথায় আজ? উত্তরার জলসাঘরে এখনো কি নাচ শেখায় তারা?’ তারা সবাই দুর্যোধনের কেনা কিংবা ‘বিরাট রাজার ক্রীতদাস’ বনে গেছে। বীরেন্দ্র জানিয়ে দেন সেটাই যথার্থ কবিতা যা, যে ভাষা, আমাদের সবার চৈতন্যকে করে বাঙ্ময়, অবচেতনকে জ্যোতির্ময়, মন্ত্রে পরিণত করে মানবিক প্রত্যয় ও শপথ। কেননা আজ, বিবেকী কবির অনুভব—‘শীতের মতই রক্ত মিশে আছে কবিতায়/ মৃত্যুর মতই রক্ত মিশে আছে কবিতায়।’ কবি চারণ হিসেবে উচ্চারণ করেন—‘মানুষ রে, তুই সমস্ত রাত জেগে/ নতুন করে পড়,/ জন্মভূমির বর্ণ পরিচয়।’ এখানে ‘রাত’ এবং ‘নতুন করে পড়া’ তাৎপর্যপূর্ণ। চিৎকার করে ওঠেন—‘কোথায় পাব আমি/ কঠিন সত্য চেঁচিয়ে বলার সাহস?’ এই কঠিন সত্য, অপ্রিয় সত্য যুগে যুগে কেউ কেউ উচ্চারণ করেছে, জাগিয়েছে মনুষ্যত্বকে। একজন সক্রিয় জনসামীপ্য ঘেরা কবি আজ কবিত্বের প্রথাবদ্ধ ধ্যান সজোরে সরিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন—
সবাই যে ন্যাংটো ....
কিন্তু তুমি বুঝবে কি আর
তোমার যে ভাই, মাইনে বেড়েছে।’
‘লিখতে হয় লিখবি কবিতাকোনো কোনো জনযোদ্ধা, কবিতাপ্রেমী হয়েও কবিতা চর্চার নিমগ্নতা অপেক্ষা মানুষের জন্য দরকার কাপড় ও রুটি, তারপরই কবিতা এমন মনে করেন। অর্গানিক বুদ্ধিজীবিসুলভ কথাবার্তা। কবি প্রত্যক্ষ করেন চতুর্দিকে আঁধার, কিন্তু কবিরা কবিতা বুনে চলে, কবিতার সারাৎসার নিয়ে ভাবে না, এদিকে মন্ত্রী বদল হয়, সরকার বদল হয়, কবিত্বের বদল হয় না। কলম আস্ত রাখতে চান প্রৌঢ়ত্বেও, প্রেমের কবিতা লিখতে চান, যদি সে কবিতা হাঁটতে গিয়ে পড়ে পড়ে যায়, তবুও। চারপাশে গভীর শূন্যতা, তবু চাই কাঙ্ক্ষিত বাতাস, যা প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে লড়াইয়ের ডাক দেয়। এইভাবে প্রেমিক কবির প্রেমের গোত্রান্তর হয়, কবিতা হয়ে উঠতে চায় লড়াইয়ের কবিতা।
কিন্তু যদি সত্যি সত্যিকারের ভালবাসিস জন্মভূমির মানুষ
তাহলে তার জন্য আগে কাপড় বোন, আগুনে সেঁক রুটি।’
দেখা যাচ্ছে কবি যতই ক্রমপরিণতির দিকে এগিয়ে গেছেন ততই উৎপীড়ক, অত্যাচারী এবং উৎপীড়িত ও অত্যাচারিত এই দুয়ের শ্রেণীবিভেদ স্পষ্টত শনাক্ত করছেন। দ্বিতীয়ত: সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর সহমর্মিত্ব দৃষ্টান্ত-স্বরূপ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণেও দেখা যাবে তিনি অভাবী মানুষকে অনেক কিছুই বিলিয়ে দিতেন। তৃতীয়ত: মনুষ্যত্ব ছিল তাঁর কাছে একটা ক্রাইটেরিয়ন। ম্যাক্সিম গোর্কি বলতেন—মানুষ এই কথাটি ছিল আমার কাছে মন্ত্রের মতো। কেন তিনি লিখতে শুরু করেছেন এর উত্তরে জানান oppressively drab life তাঁর মনের ওপর রীতিমত চাপ সৃষ্টি করত, তখন না লিখে থাকা যেত না। মনে পড়বে রোলাঁর ব্যাকুল উচ্চারণ—‘মনুষ্যত্ব, মনুষ্যত্ব আমি তোমার দ্বারে ভিখারী।’ বীরেন্দ্রের কবিতা তাই এককথায় বলা যেতে পারে মনুষ্যত্বের কবিতা।
একটি গদ্য লেখায় (কবিতার নিজস্ব পৃথিবী) বীরেন্দ্র বলেছিলেন—তিনি শুদ্ধ কবিতার প্রতি আর আস্থাশীল নন। ‘কবিতার খাতিরে কবিতা লেখার দিন ফুরিয়েছে; আজকের দিনে কবির আনুগত্য কবিতার চেয়ে ঢের বেশি নীরস বাস্তব পৃথিবীর প্রতি।’ বীরেন্দ্র সম্পর্কে কিছু স্মৃতিকথা পড়ে, তাঁর গদ্যলেখা পড়ে মনে হয়—তিনি অস্থির কবি। তরুণ কবিদের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক বলে সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে মান্য করতেন। পূর্বাশার কবি নীরেন্দ্র, অরুণ ভট্টাচার্য, চিত্ত ঘোষ এঁদের পছন্দ করতেন। অতীন্দ্র মজুমদারের মতে—‘নীরেন এবং বীরেন দুজনেই আমার মতে পুষ্টিলাভ করেছিলেন জীবনানন্দের কাব্যসুধা থেকে।’ পরে নীরেনের সঙ্গে তাঁর আত্যন্তিক আদর্শগত বিরোধ হয়। অতীনের লেখা থেকে, বীরেন্দ্রর কবিতা থেকে সুভাষ সম্পর্কে স্পষ্ট বিরূপতা (‘ডিগবাজি’ খাওয়া কবি—অতীন্দ্র কথিত) জানা যায়। বিষ্ণু দে সম্পর্কে প্রশংসা করলেও তা কথার কথা। মৃত্যুর আগে শেষ বিশ বছরে ক্রমান্বয় আশাভঙ্গ এবং ক্রোধ জমে কবির মধ্যে। অ্যান্টি পোয়েট্রির প্রতি পক্ষপাতের কথা বলেন। পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি লেখায় (মহাপৃথিবীর কবিতা) আফ্রিকার প্রাচীন লোকগাথা, মধ্যপ্রাচ্যের উপকথা, জাপানী ভবঘুরেদের কবিতা, চীনের কবিতা, জার্মানী ও পোলান্ডের ভিয়েতনামী কিছু কবিতায় আগ্রহ দেখান। অনুবাদগুলিতে একটু চোখ বুলোলে বোঝা অসম্ভব হবে না যে মননমুখ্য, অতি অন্বেষণ তৎপর কবিতায় আগ্রহ বীরেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ষাটসত্তরে ছিল না। কবিতা মাধ্যম করে তিনি দুটো কাজ করে গিয়েছেন—ক) ছোট ছোট কবিতা মাধ্যমে এই সব দশকের নানা সামাজিক রাজনৈতিক জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গকে কবিতাকায়ায় ধরে রাখতে চেয়েছেন। খ) কবিতা মাধ্যমে জনবিরোধী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, শাসক সম্পর্কে তাঁর তীব্র বীতরাগ এবং অবহেলিত, বিপন্ন মানুষের প্রতি আন্তরিক অনুরাগ ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। হয়ত এই কারণেই শঙ্খ ঘোষ বলতে চেয়েছেন—আমাদের কালের তিনি সবচেয়ে প্রতিবাদী কবি। কোনো কোনো তরুণ একথাও বলেছেন—তিনি প্রগতিশীল কবিকন্ঠকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এই সূত্রে তৃতীয় আর একটি বিষয় এখানে বলা ভালো। তা হল—বন্দী মুক্তি আন্দোলনে, জেলে অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তাঁর এগিয়ে আসা।
সত্তরের দশকের বসন্তের বজ্রনির্ঘোষে দুজন বাঙালি লেখকের সাহিত্যজীবনে ব্যাপক বদল ঘটে যায়। এঁরা হলেন—মহাশ্বেতা দেবী ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্য—কোনটা কাঙ্ক্ষিত আর কোনটা সমালোচ্য—এ সম্পর্কে দুজনের ধারণাই বদলাতে থাকে।
গত কয়েক দশকে দেশ ও বিদেশের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কবিতার কোনো নির্দিষ্ট আঙ্গিক হয় না। তা পদ্য বা গদ্যকে ছুঁয়ে যেতে পারে, তা প্রত্যক্ষ থেকে অপ্রত্যক্ষে, বাচ্যার্থ থেকে ব্যঙ্গার্থে, লক্ষার্থে ছোটাছুটি করতে পারে। কখনো কবিতা সোচ্চার, কখনো তা নীরব, নীরবতাই মাঝে মাঝে ভয়ঙ্করভাবে সোচ্চার। গোত্রান্তরিত বীরেন্দ্রর কবিতার কবিত্ব নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। গোত্রান্তরিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তর কালের গল্প সম্পর্কে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য মনে পড়ে—‘একথা অবশ্য স্বীকার্য যে এই পর্বে (উত্তরকালে) তাঁর (মানিকের) ছোট গল্পের যে পরিমাণে প্রাচুর্য পাওয়া যায় সে পরিমাণে সমৃদ্ধি মেলে না।’ (বাংলা গল্প বিচিত্রা-- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, পৃ. ১৭২) বীরেন্দ্রর উত্তরকালের (১৯৫৪, উলুখড়ের কবিতা থেকে ১৯৮৫) কবিতায় যে পরিমাণ প্রাচুর্য সে পরিমাণ ‘সমৃদ্ধি’ নেই। মানিকবাবুর ক্ষেত্রে কারণ— ‘তেভাগা আন্দোলন, রসিদ আলী দিবস ইত্যাদি "স্নায়ুচঞ্চল" ঘটনা।' বীরেনবাবুর ক্ষেত্রে—কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভ, কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত বিভিন্ন গণ সংগঠনকে বেআইনী ঘোষণা (১৯৫০), নানাস্থানে জনতার ওপর পুলিশের গুলি, বাস্তুহারা আগমন, অস্তিস্ব সংকট, বেকার সমস্যা, চীন-ভারত সংঘাত, ভারত-পাক সংঘাত, নানান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বামপন্থী দলের বিভাজন ও সংঘাত, খাদ্য আন্দোলন, ভোট রাজনীতি ও নতুন প্রশ্ন, ট্রাম বাস ভাড়া বৃদ্ধি ও আন্দোলন, কালোবাজার, রেল ধর্মঘট, সত্তর দশকে কৃষক আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও আমেরিকা বিরোধী বিক্ষোভ, শ্রমিক অসন্তোষ, জরুরী অবস্থা, রাজনৈতিক বন্দী ও মুক্তি আন্দোলন ইত্যাদি।
বীরেন্দ্রর শেষ তিন দশকের কবিতায়, সাহিত্যে মতাদর্শগত সংঘাত, শাসকশ্রেণীর উদ্যত জল্লাদপনা সহ অনেক কিছুই ধৃত হয়েছে। পুনরায় নারায়ণবাবুর মানিক সম্পর্কিত মন্তব্যের দ্বারস্থ হই। মানিকবাবুর উত্তরকালের গল্পের মতো বীরেন্দ্রবাবুর শেষ তিন দশকের কবিতা পড়তে গেলে অনুভব করা যাবে—‘এরা যেন বিচ্ছিন্ন কয়েকটি রচনা নয়, খণ্ডিতভাবে লিখিত হয়েও এরা এক অখণ্ডতার রস বহন করছে। কবিতাগুলি এককভাবে খণ্ডিত—সামগ্রিকভাবে সমকালীন বাংলা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক মহাসংহিতা।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৪) বীরেন্দ্রর সমৃদ্ধিহারা কবিতা কয়েক দশকের সামাজিক ও রাজনৈতিক মহাসংহিতা।
বন্ধু অতীন্দ্র মজুমদার জানান হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির এক মিছিলে বীরেনকে দেখে তাঁর খুব আনন্দ হল। অবশ্য তখনও সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নয়। এর পর অনুশীলন সমিতি থেকে আর.এস.পি. হয়ে তাদের গণবার্তা, ক্রান্তি প্রভৃতিতে অতি সামান্য উপার্জনে ওতপ্রোত জড়িয়ে পড়া। একদিকে পারিবারিক বন্ধন অন্যাদিকে ত্যাগ ও সততা। এর পর নীরেন ও বীরেনের বিরোধ আদর্শগত। তার পর চীন ভারত সংঘাতে ‘সস্তা দেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়া।’ এর পর আশাভঙ্গের তিক্ততায়, ক্রোধে, বিদ্রূপে, শ্লেষে, সোচ্চার মানবতাবাদী কবিকন্ঠ। ১৯৮২ নাগাদ দীর্ঘ তিনচার বছর বীরেন প্রায় এককভাবে বন্দীমুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যায়। মানবতার প্রেরণা থেকে পূর্ববাংলা ও কলকাতার দাঙ্গার প্রতিবাদ জানান, ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতার বিরুদ্ধে সরব হন। বামপন্থী আন্দোলনের বিচ্যুতিতে তাঁর ক্ষোভ পুঞ্জিভূত। সময়ের দাবী মেনে সামাজিক আন্দোলনে সামিল হন। সামাজিক আন্দোলনে তাঁর ছিল ‘অ-দলীয় ব্যক্তি অবস্থান।’ আজীবন জনগণের স্বপক্ষে বিবেককে রেখেছেন জাগ্রত। সি.পি.আই (এম.এল)-এর ইংরেজি মুখপত্র লিবারেশন-এর সম্পাদক নিমাই ঘোষ তাঁকে অভিনন্দিত করেন, আর.এস.পি. কর্মী দেবব্রত ঘোষ জলপাইগুড়ি থেকে চিঠি লেখেন পরম আত্মীয়তায়, চতুর্থ ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন বন্দীরা প্রেসিডেন্সি জেলে আটক থাকা অবস্থায় চিঠিতে জানান তাঁর কবিতাপাঠে অনুপ্রাণিত বোধ করছেন। মনোজ বসু চিঠিতে লেখেন—‘নামে বীর। কলমে তোমার নির্ভীক বলিষ্ঠ সৌন্দর্য। আত্মমর্যাদাও তীক্ষ্ণ এবং অনমনীয়।’ রাজনৈতিক নেতা তারাপদ লাহিড়ী লেখেন—‘যেখানে দুর্বলের ওপর পীড়ন, যেখানে বঞ্চনা, যেখানে মনুষ্যত্ব লাঞ্ছিত, যেখানে অন্যায়ের দাম্ভিকতা, যেখানে কপট জনহিতৈষণার আড়ালে পঙ্কিল স্বার্থের বক্রদৃষ্টি উঁকি মারে, সেখানেই আপনি বলিষ্ঠ হস্তে বেত্রাঘাত করে চলেছেন। ... কল্পনার রামধনুকে দু হাতে ঠেলে ফেলে সত্যের প্রখর ও তপ্ত কিরণ বিকীর্ণ করছে আপনার কবিতা। আপনি বেত্রধারী কবি।’
ওঁর ছেলে বুদ্ধদেব লিখছে—‘নকশালপন্থীদের বহু কাজকে বাবা সমর্থন করতেন না। কিন্তু নকশালবাড়ি ঘটবার মূল যে উদ্দেশ্য তাকে বাবা সবসময়ে সমর্থন করতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। ....
'কংগ্রেসীদের বিরুদ্ধতা করার জন্য আমাদের ঘর ছিল সব সময়েই চিহ্নিত। ... কবিতার পর কবিতা লিখে কীভাবে এর প্রতিবাদ করা যায়, কীভাবে অত্যাচারীদের মুখোশ খোলা যায় তার চেষ্টা করেছেন। ... বাবা কিন্তু এই সময়ে শুধু কবিতাই লেখেন নি, অনেক সময়ে রাস্তায় নেমেছেন, অনেক সময়ে এমন অনেক কাজ করেছেন যা ছিল মারাত্মক। আশু মজুমদার, সরোজ দত্ত, প্রবীর দত্ত হত্যায় ঝুঁকি নিয়েও প্রতিবাদ করেছেন, থানায় যান। ভিয়েৎনাম দিবস উপলক্ষে মিছিলে এবং সভায় যান। কাগজে বিবৃতি দিয়ে প্রবীর দত্তকে নৃশংস লাঠিচার্জে হত্যার কথা বলেছেন। ...জরুরী অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে একটা মিছিল যাবে, বীরেন ও তার সমবয়সী ২/৩ জন ছিলেন। বিনা বিচারে আটক ও হত্যার প্রতিবাদে হয়ে পড়লেন "অন্যতম সক্রিয় কর্মী"। শুরু হল তাঁর জেলখানায় যাওয়া, বন্দীদের সাথে দেখা করা। তাঁর শেষ সভা কলেজ স্কোয়ারে জুনিয়ার ডাক্তারদের ওপর বামফ্রন্টের পুলিশ ও সি.পি.আই (এম.) বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে। তখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। অতএব বলা চলে তিনি কবি ও সক্রিয় প্রতিবাদী। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের উচ্চারণ।'
রাজনীতিমুক্ত কবিতা আর রাজনীতিযুক্ত কবিতার ভালোমন্দ নিয়ে তর্ক বহু কালাবধি চলে আসছে। মানবতার জন্য কবিতা বললেই দায় এসে পড়ে সর্ব মানবতার। কিন্তু যদি বঞ্চিতের উন্নয়নের প্রশ্ন ওঠে তবে কবিপ্রয়াস সংখ্যালঘুর জন্যই। এখানে একটা কথা। কবিতায় রাজনৈতিক আগ্রহ থাকলেই ব্যক্তিত্ব থীম সম্পর্কে সংবেদন বাতিল করতে হবে কথাটা ঠিক নয়। বলা চলে রাজনৈতিকতা ওই ব্যক্তি সংবেদনকে রূপায়ণে করে তুলতে পারে more intense and more authentic. (Alan Bold, The Penguin Book of Socialist Verse) বোল্ড অবশ্য বলেন—নিগ্রহের ব্যাপারে সহানুভূতি আর অন্যদের প্রত্যাশা যথেষ্ট নয়, কবিকে শৈল্পিক সমস্যা বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। এ প্রবন্ধে অবশ্য বোল্ডের এই মতের বিপক্ষেই বলা হয়েছে।
শৌখিন বামপন্থী কবিতা সম্পর্কে বীরেন্দ্রর পরাঙ্মুখতা স্পষ্ট হচ্ছিল সত্তর ও আশির দশকে। হিউ ম্যাকডিয়ার মিড (স্কটিশ)-এর একটি কবিতা (epitaph বা কবরলিপি) উদ্ধৃত করা যাক।
বৃটিশ বামপন্থী কবিতা ১৯৩০-১৯৪০বাংলা বামপন্থী যান্ত্রিকতা প্রসঙ্গে এই তীক্ষ্ণ শ্লেষ অপ্রযোজ্য হবে না।অডেন, ম্যাকনীস, ডে লিউয়িস, আমি তো এদের সব্বার কবিতা পড়েছি
আশাভঙ্গের দিনেও আশা শুনেছি সাচ্চা ডাক....
জেনেছি এর ব্যাখ্যা, তবে একথা জানান দিই
ভেঙে পড়তে থাকা দেওয়ালের পাশে দেশলাই জ্বালানো যায় না।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শতবার্ষিকীতে আর একবার স্মরণ করা যাক বীরেন্দ্রর কবিত্ব বিকাশের কথা আর বাংলা বামপন্থী কবিতার প্রথাবদ্ধ সীমাবদ্ধতা ও যান্ত্রিকতাকে। কবিতার কোন দিক বর্জনীয়, কবিতার কোন দিক অর্জনীয়—এই দুই মতের পরিচয় বীরেন্দ্রর কবিতা ও গদ্য পড়লে বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়।