• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৭ | জানুয়ারি ২০১১ | গল্প
    Share
  • কবরখানার চাবি : কৌশিক সেন



    আদ্যিকালের পুরোনো ওক কাঠের টেবিলটা নড়াতেই দুজন লেগে গেল । টিনা পরামর্শ দিয়েছিল টেবিলের উপরে ঢাকা দেওয়া ডেস্কটা খুলে ফেলা যাক । রব রাজি হয়নি, `মা যতদিন নড়াচড়া করতে পারতো, ওই ডেস্কেই গুটগুট করে এসে বসতো, ওটা আস্তই থাকুক না ।'

    ড্রয়ারগুলো খালি করার সময় ঠকাস করে কি যেন একটা পড়লো কাঠের মেঝেতে । রব সেটা তুলে নিয়ে দেখছে তো দেখছেই এদিকে আমরা যে ওই জগদ্দল টেবিল টানতে হিমসিম খেয়ে গেলাম । শেষকালে হাল ছেড়ে দিয়ে টিনা বসে পড়লো । আমি দাঁত খিঁচিয়ে একটা চোস্ত গালাগালি দিতে যাবো কিন্তু রবের হাতের জিনিসটা দেখে চেপে গেলাম । পিতলের একটা বড় চাবি, তার মাথাটা কারুকার্য করা, বেশ ইন্টারেস্টিং দেখতে । গুপ্তধনের সিন্দুক আমি কখনো দেখিনি তবে এইরকম চাবি সেখানে দিব্যি মানিয়ে যেত ।

    `আরে এতো বড় চাবি কিসের । বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে তো । তোমার মায়ের তো অ্যান্টিক জমানোর শখ ছিল না' - টিনাও এসে দাঁড়িয়েছে ।

    রব যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলো, `না না এটা মায়ের নয় আমার জিনিস, হারিয়ে গিয়েছিল । কিন্তু ভারি অবাক কাণ্ড, এতদিন বাদে । তাই তো ভারি আশ্চর্য ব্যাপার ।'

    আশ্চর্য ব্যাপারটা যে কি সেটা সেদিন ওর কাছ থেকে বার করতে পারলাম না । ও মালপত্র টানতে হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো । খানিকক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে আমরাও হাল ছেড়ে দিলাম । ওরা অন্য শহরে থাকে, রবের মা কয়েকদিন আগে দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছেন । ফিউনেরাল সেরে, জিনিসপত্রের বিলিবন্দোবস্ত করে ওদের ফিরতে হবে দুদিন বাদেই । এদেশে শোকও বেশ রুটিনমাফিক, কেতা মেনে করতে হয়, পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলে চলে না ।

    রব আর টিনা এই শহরেই বড় হয়েছে । দুজনেই আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু, আমরা কজন ক্যাম্পাসে একসঙ্গে ঝুলে থাকতুম, এদেশের ভাষায় যাকে বলে হ্যাং আউট । রব ব্যাটা বঁড়শি গিলে বিয়ে করে ফেললো, তারপর ভালো চাকরি নিয়ে চলে গেল শিকাগোয় । আমি এখানেই রয়ে গেলাম, মাঝে মাঝে ওর ফ্যামিলির খবরাখবর নিই, ওরা এলে আমাদের বাড়িতে হইচই করে একরাত্রি কাটায় । মনে মনে ঠিক করে রাখলাম যাবার আগে ব্যাটাকে ধরবো, চাবির গপ্পো শুনতে হবে ।

    ওদের যাওয়ার কথা সোমবার রাত্রে, সেদিন কাজ থেকে ফিরে দেখি টিনা একা মুখ ভার করে বসে আছে, রব উধাও । ওর নাকি কিসব সাংঘাতিক দরকারি কাজ পড়ে গেছে, এক্ষুনি ইউরোপ যেতে হবে । বাড়ি ফেরারও সময় নেই, চাকরি নিয়ে টানাটানি । রব বিগ আইটেম সেলসম্যান, এরোপ্লেনের এঞ্জিন না টায়ার কি যেন একটা বেচে । আগেও এরকম অল্প নোটিশে ওকে ট্যুরে যেতে হয়েছে, কিন্তু এবারেরটা আমাদেরও বাড়াবাড়ি ঠেকল । টিনা তো রীতিমতন ঘাবড়ে গেছে । ও নাকি গত দুদিন যাবৎ মাঝরাত অবধি দুর্বোধ্য ভাষায় কার কার সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিল, তারপর আজ সকাল হতে না হতে প্যাক করে রেডি ।

    তা আমাদের রব যাকে বলে মাল্টিলিঙ্গুয়াল, ছোটোবেলা কেটেছে জার্মানি আর ফ্রান্সে । ওর বাবা নেভির লোক, ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময় ইউরোপে স্টেশনড ছিলেন প্রায় দশ বছর । রবের মতে সব কথা সব ভাষায় ঠিক করে বলা যায় না । এক এক ভাষায় এক এক রকম আলাপ যুত্সই হয় । ত আর প-বর্গের সঙ্গে একটুখানি চন্দ্রবিন্দু মিশিয়ে কথা বললেই নাকি মেয়েদের রোমাঞ্চ লাগে । তাই ইটালিয়ান আর ফ্রেঞ্চে প্রেমালাপ যেমন জমে, খটমটে জার্মান, ডাচ বা রাশিয়ানে তার ধারেকাছেও নয় । ওদিকে আবার ভদ্রভাষায় চিবিয়ে চিবিয়ে কারো মুণ্ডপাত করতে হলে ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট আদর্শ । রব মাল বেচতে দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়, এসব ওর জানা দরকার । কিন্তু তাই বলে এইরকম পারিবারিক শোকের সময় হঠাৎ করে প্ল্যান চেঞ্জ করাটা কিরকম । এই সময়টা সাবধানে থাকতে হয় ।

    টিনাকে বুঝিয়ে বললাম - বাবা-মা মারা গেলে ছেলেরা কেমন একটা হয়ে যায় তখন ওদের কটা দিন একটু লাগাম আলগা দেওয়া ভালো । যাবে আর কোথায় মোল্লার দৌড় মসজিদ অবধি । তারপর দুজনে মিলে ফোন-কম্পিউটার নিয়ে ডিটেকটিভগিরি করতে বসলাম, রবের অফিস থেকে শুরু করে ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি । একটু পরেই বোঝা গেল যে রব বিবাগী হয়নি, কাউকে নিয়ে ভাগেওনি । ও এখন প্যারিসে, অফিসের দরকারি কাজেই আছে, উইকএণ্ডের আগেই শিকাগো ফিরবে । ওর বস ধরে নিয়েছিল যে ও পরের হপ্তায় যাচ্ছে । তবে কিনা সবাই জানে ও ওয়ার্কহলিক, হয়তো অফিসের কাজটাকে টাঙিয়ে রাখতে চায়নি । কেউ খুব একটা চিন্তিত নয় দেখা গেল ।

    টিনা একাই ফিরে গেল সেবার ।

    তারপর বছরকয়েক কেটেছে, ওরা ভালোই আছে, সংসার বেড়েছে দুজনেরই, যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি । মাঝে মাঝে ইমেইল চালাচালি হয়েছে, কিন্তু দেখাসাক্ষাৎ আর হয়ে ওঠেনি ।


    পাক্কা পাঁচবছর পর এক গণ্ডগোলের বিকেলে রবের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে গেল একেবারে গপ্পের বইয়ের মতন ।

    `বন্ধুরা দয়া করে আমার কথাগুলো হালকাভাবে নেবেন না । আজকে ফ্রান্সে যা শুরু হয়েছে কাল সারা পশ্চিম গোলার্ধে তা ছড়িয়ে পড়বে । রক্ষণশীল সারকোজি সরকার আজকে জিপসিদের ফ্রান্স থেকে তাড়াচ্ছে, কালকে আলজেরিয়ানদের তাড়াবে । পরশু জার্মানি তাড়াবে টার্কিশদের, তারপরে ইংল্যাণ্ডে বাংলাদেশিদের পালা আসবে । সারা ইউরোপে নব-ফ্যাসিবাদের ছায়া নেমে এলে হয়তো আপনারা নড়েচড়ে বসবেন কিন্তু বন্ধুরা তখন দেরি হয়ে যাবে অনেক । যুদ্ধের পরে আমরা সস্তা শ্রমিক হিসাবে যাদের আমদানি করেছি, তারাই এখন আমাদের সামাজিক আপদ, তাদের ছেঁটে ফেলতে পারলে আমরা বাঁচি । এইভাবে বিশুদ্ধতা বাঁচানোর চেষ্টা সংক্রামক, এর ফল মহাযুদ্ধ, ইতিহাস সেই শিক্ষাই দেয় । আমাদের আসল শত্রু অকারণ দারিদ্র, সামাজিক অন্যায়, বিবেকহীন ফাটকাবাজি, কিন্তু সেদিক থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখা হয়েছে । এই ফাঁকে সরকার আপনাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার কেড়ে নিতে উদ্যত । বন্ধুরা দলে দলে এর প্রতিবাদে সামিল হোন । ফ্রান্স কখনো আমেরিকার মতো হৃদয়হীন, বাজারের দালাল আর কর্পোরেশনের ঘানি পেষা চাকরদের দলে সামিল হবে না ।'

    বক্তা গলার শির ফুলিয়ে চেঁচাচ্ছে । কলকাতা নয়, প্যারিসের রাস্তা, কিন্তু কথাবার্তার ঝাঁঝ আর পাবলিকের ভাবভঙ্গি একই রকমের । কাফেতে বসে দেখতে বেশ লাগে কিন্তু মারামারি শুরু হয়ে গেলেই মুশকিল । মানে মানে হোটেলের দিকে রওনা হচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি মিছিলে চেনামুখ । একেবারে সুভাষ মুখুজ্জের কবিতার মতো আমাদের রব প্যারিসের মিছিলে হাঁটছে ।

    `এখানে কি করছিস ?'

    `কনফারেন্স । তুই এখানে কি করছিস ?'

    `লণ্ডনে কাজে ছিলাম । এইসব কাণ্ড শুরু হতে প্যারিসে এসেছি মজা দেখতে ।'

    `বেশ করেছিস । আমেরিকান বলে ধরে প্যাঁদায় যদি ।'

    `আরে না না । চল হোটেলে আড্ডা মারবো । অনেক কিছু ক্যাচ আপ করার আছে ।'

    হোটেলে ফেরাও এক ঝামেলা কারণ হরতালে সারা শহর প্রায় অচল । সারকোজি সাহেব সরকারি চাকরি থেকে দেদার লোক ছাঁটাই করছেন, রিটায়রমেন্টের বয়স বাড়িয়েছেন, তাই নিয়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলো প্রায় লাগাতার ধর্মঘটে নেমে পড়েছে । গত কয়েক দশকে ইউরোপের লোকে হাল্কা খাটুনি, ঘন ঘন ছুটিছাটা আর `ক্রেডল টু গ্রেভ' সরকারি সুযোগসুবিধায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, অনেকটা আমাদের দেশে রেলকর্মীদের মতন । দুনিয়াজোড়া রিসেশনের বাজার এখন আটশো পাউণ্ড গোরিলার মতো তাদের বুকের উপর চেপে বসেছে । গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতন রয়েছে সন্ত্রাসবাদী হামলার ভয়, পূর্ব ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অজস্র ইমিগ্র্যান্ট, এখানে ওখানে গজানো তাদের সব আস্তানা, যেগুলোকে বস্তি বলাই ভালো । সব মিলিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা ।

    এইসব কথা বলতে বলতে দুই বন্ধু পথ চলছিলাম । প্যারিস এক অদ্ভুত শহর, এই আলো এই অন্ধকার । আধুনিক প্লাজার গা ঘেঁষে আদ্যিকালের হানাবাড়িও দিব্যি টিঁকে রয়েছে । ওরকমই এক অন্ধকার গলির মুখে রব আমাকে এনে ফেলল । ওটা নাকি শর্টকাট ।

    `তোর সেই মায়ের ডেস্কের চাবিটার কথা মনে আছে ? ওটা এই পাড়ার সম্পত্তি, আমি চুরি করেছিলাম, তাও এক জিপসি মেয়ের কাছ থেকে ।' রব হঠাৎ বললো, `আয় ওই শুঁড়িখানায় বসে দুপাত্তর খেতে খেতে গপ্পোটা তোকে শোনাই । এখন অবধি কাউকে বলিনি ।'

    আমি আঁতকে উঠলাম । এমনিতেই গলিটা ছমছমে, ফুটপাথে সন্দেহজনক চেহারার লোকজন, তার মধ্যে রবের রহস্যময় কথাবার্তা । আমি ভেতো বাঙালি আমাকে এসব কনফেশনের মধ্যে জড়ানো কেন বাপু । রব কথা শোনার পাত্র নয়, ওকে যেন ভূতে পেয়েছে, আমাকে জোর করে একটা বারে নিয়ে বসাল । সেখানে লোকজন সব ব্র্যাণ্ডি আর সবুজ রঙের আবসাঁৎ নিয়ে টং হয়ে আছে ।

    `আমার বাবা মেরিন কোরে ছিলেন তুই তো জানিস । উনিশশো চুয়াত্তর সাল, ঠাণ্ডা লড়াই তখন পুরোদমে । বাবা প্যারিসে পোস্টেড, মা আর বছর বারোর আমিও সেখানে । আর্মি বেসের ছেলেপুলেরা প্রায়ই লোকাল পাবলিকের সঙ্গে মেশে না কিন্তু মা লুইসিয়ানার মেয়ে ফ্রেঞ্চ কালচারের দারুণ ভক্ত । আমি ফ্রেঞ্চ স্কুলে যেতাম, সেখানেই আমার মারিয়ানার সঙ্গে আলাপ । ক্লাসে আমরা দুজনে বাকি সবার থেকে আলাদা, আমি আমেরিকান কিন্তু ষোলোআনা সাদা নই, মারিয়ানা জিপসি, এখানে ওদের বলে রোমা । জিপসিরা আসলে তোদের দেশের লোক, জেনেটিক দিক থেকে জাঠ আর রাজপুতদের সাথে ওদের প্রচুর মিল আছে । কেউ কেউ বলে ইসলামিক যুগের প্রথম দিকে এই ধর ১১০০ সাল নাগাদ ওরা ভারত ছাড়ে । তারপর নোম্যাডিক হয়ে ঘুরতে ঘুরতে, ইজিপ্ট হয়ে বলকান আর পূর্ব ইউরোপে পৌঁছে যায় । গত পাঁচশো বছর ধরে ওরা ইউরোপে নানা জায়গায় তাড়া খেয়ে বেড়িয়েছে । বাইজান্টাইন আমলে ইহুদিদের মতো পুরো জাতটাকেই ত্রক্রীতদাস বানানো হয়েছিল, অটোমান আমলেও তাই । তারপর ইউরোপীয় সমাজ থেকে আলাদা করে রাখতে কোথাও ওদের মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও কান কেটে দেওয়া হয়েছে । ইহুদিদের সঙ্গে তফাৎ এই যে ওদের না আছে কোনো জবরদস্ত ধর্মবিশ্বাস, না আছে ব্যবসাবাণিজ্যে মাথা । নাত্সিরা ওদের পাইকারিভাবে খুন করার জন্য মোবাইল কিলিং ইউনিট বানিয়েছিল, লাখ দুয়েক ওই সময় মারা গেছে । সোভিয়েট পূর্ব ইউরোপেও ওদের ছেড়ে কথা বলা হয়নি । এতদিন পরে এই একবিংশ শতকে সুসভ্য ফ্রান্স ওদের আরো একবার দেশছাড়া করতে চাইছে । আমরা যেমন কোনো কিছু পছন্দ না হলেই সেখানে আন-আমেরিকান লেবেল মেরে দিই ওরাও তেমন বলছে হয় ফ্রেঞ্চ হও নয় ফ্রান্স থেকে ভাগো । অবাক হবার কিছুই নেই ।'

    আমার নেশা ধরে গেছে কিন্তু কথা কোনদিকে চলেছে মালুম হচ্ছে না - জিপসি, চাবি, জেনোসাইড । রব কিন্তু বলেই চলেছে ।

    `মারিয়ানা ওইটুকু মেয়ে কিন্তু অদ্ভুত সব গল্প বলতে ওস্তাদ । স্কুল আমাদের ভালো লাগতো না, সুযোগ পেলেই এখানে ওখানে ঘুরতে যেতাম । মারিয়ানার চাপা রং, ঝকঝকে কালো চোখ, আর একঢাল চুল আমাকে চুম্বকের মতো টানতো । আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের চৌহদ্দি খুব একটা বড়ো ছিল না, দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে বেশি দূরে গেলে পুলিশে ধরার ভয় ছিল । কিন্তু মারিয়ানা থাকতে সেটা কোনো সমস্যাই নয়, ও তারই মধ্যে নানারকম গায়ে কাঁটা লাগানো আবিষ্কার করে ফেলতো । কোথায় যুদ্ধের সময় ইহুদিরা লুকিয়ে ছিল, কোন ফুটপাথে সিনেমার শুটিং হয়, সব নাকি আমাদের স্কুলের চারপাশে । ওর গল্পের দুনিয়ায় মানুষ আর ভূতপ্রেতরা বেশ স্বাভাবিকভাবেই পাশাপাশি থাকতো, বাস্তবের সঙ্গে ফ্যানটাসির বিশেষ কোনো ফারাক ছিল না । পরে বুঝেছিলাম ছিন্নমূল, অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর গল্পে এইরকমটাই স্বাভাবিক, এরা সবাই মার্কেজের সেই একশো বছরের নি:সঙ্গতার শাস্তি ভোগ করছে । বাস্তব দুনিয়ার কাছে এদের বিশেষ কিছু পাওয়ার আশা নেই ।

    আমাদের মহল্লার ঠিক পাশেই একটা বিশাল কবরখানা ছিল, কত সেঞ্চুরির কে জানে । সেখানেই আমাদের স্কুল পালানো দুপুরবেলাগুলো কেটে যেত । কবরখানার যেদিকটা বড়রাস্তার উপর চার্চের গায়ে লাগানো সেখানে লোকজনের আসাযাওয়া ছিল, আমরা ওখানটা এড়িয়ে চলতাম । কেয়ারটেকার একবার ধরে ফেলে স্কুলে খবর দিয়েছিল । আমরা যেতাম পিছনদিকে একটা পাঁচিলঘেরা পোড়ো জমিতে, সেখানে কয়েকটা ভাঙা, শ্যাওলাধরা হেডস্টোন এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে, মাঝখানে একটা পুকুর । একধারে পাইন আর ইউক্যালিপটাসের সারি, অন্যদিকে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঘাসের উপর বার্চ গাছের শুকনো পাতারা ইচ্ছামত নেচে বেড়াচ্ছে সারাদিন । ওইখানে ছিল আমাদের অভিযানগুলোর হেডকোয়ার্টার । কিন্তু জিপসি ক্যাম্পের নানান রোমহর্ষক গল্প জানা থাকলেও মোক্ষম একটা খবর মারিয়ানা জানতো না । আমাদের রাঁদেভুর প্রিয় জায়গাটি আসলে একটা বোনইয়ার্ড, ওই ঘাসের তলায় অনেক কঙ্কাল শুয়ে আছে ।

    বোনইয়ার্ড বস্তুটা কি বুঝিয়ে বলা দরকার । পুরোনো আমলে, এই ধর কয়েকশো বছর আগে অবধি ফ্রান্সের গরীবগুর্বো লোক যাদের কফিন কেনার পয়সা নেই, তাদের কবর দেওয়ার এক সস্তা পদ্ধতি চালু ছিল । চার্চের পেছনে একটা পাঁচিলঘেরা জায়গায় ওদের কফিন ছাড়াই সোজাসুজি পুঁতে দেওয়া হত । গোঁড়া ক্যাথলিকদের কাছে মরার পরেও চার্চের চৌহদ্দির মধ্যে থাকা জরুরী, তাই পাড়ার পাদ্রীসাহেব কিছু দক্ষিণার বদলে এই সুবিধাটুকুর ব্যবস্থা করতেন । পরে রোগ ছড়াবার ভয়ে সরকার ওটা নিষিদ্ধ করে দেয় । আজকাল তো কথাই নেই, পটল তোলার অনেক আগেই লোকে সদগতির বন্দোবস্ত করে রাখে । সত্যি বলতে কি কবরের বদলে ভারতীয় স্টাইলে ক্রিমেশনের কদর বাড়ছে । কিন্তু ওই পাঁচিলঘেরা মাঠগুলো একটা অস্বস্তিকর নাম সমেত এখনও চার্চের জিম্মায় রয়ে গেছে - বোনইয়ার্ড বা হাডিডখানা । ভদ্রলোকেরা যেমন পরিবারের কবরগুলোর দেখাশোনা করে, ফুল চড়ায়, তেমনটা এদিকে কেউ করেনা । আস্তে আস্তে ওগুলোর কথা সবাই ভুলে যাবে প্রমোটাররা সেই আশায় রয়েছেন ।

    এই প্যারিসে কত বিখ্যাত সেমেটারি আছে, নামজাদা সব কবি, শিল্পী, সেনাপতিরা সেখানে শুয়ে আছেন । দিবারাত্রি সেখানে ট্যুরিস্টদের ভিড়, গণ্যমান্য লোকেদের আনাগোনা । এদিকে বেওয়ারিশ মড়াদের সেই হাডিডখানায় আমরা জুটেছিলাম দুই আউটসাইডার, স্কুল পালানো ছেলেমেয়ে - একজন জিপসি অন্যজন ব্রাউন আমেরিকান । দুজনেরই রক্তে বঞ্চনা আর অত্যাচারের ইতিহাস, তাই বুঝি ওইখানেই এমন করে জমে উঠেছিল আমাদের খেলাঘর । আমরা মাটির ঢিবিতে কেল্লা গড়তাম, পুকুরের আটলান্টিকে তিমিমারা জাহাজ ভাসাতাম । মাঝে মাঝে গুলিটুলি চালিয়ে রেড-ইণ্ডিয়ানদের হাত থেকে মারিয়ানাকে উদ্ধার করতে হত । আবার মাথামোটা কাউবয়ের যখন কাউন্ট ড্রাকুলার হাতে যায় যায় অবস্থা, মারিয়ানা ঠিক সেই সময়ে মন্ত্রপড়া জল আর লোহার শিক নিয়ে তৈরি ।

    রব নেশাধরা আরক্ত চোখে আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে । আস্তে আস্তে বললো, `খাঁটি আনন্দ, আনমিক্সড ব্লেসিং জীবনে ওই ক'মাস পেয়েছিলাম । তারপর দুনিয়া ঘুরে কত কি পেয়েছি - প্রেম, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সেক্স, সংসার, বাচ্চাদের হাসি, সামাজিক প্রতিষ্ঠার আরামকেদারা, দুনিয়াদারির এই বিরাট সার্কাস, নানান দেশের আকাশে, ময়দানে, সরাইখানায় । সব জল মেশানো কোথাও সেই ম্যাজিক, সেই রোমাঞ্চ নেই - কোথাও নেই ।

    আমি মনে মনে ভাবলাম - হুঁ হুঁ বাবা ব্যাদে সব আছে কিনা জানিনা, কিন্তু বাঙালি কবিরা সব গুছিয়ে বলে গিয়েছেন বটে । নারীর হৃদয়, প্রেম, শিশু, গৃহ নয় সবখানি । অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয় ।

    রব বলে চলল - সে যাকগে, যেজন্য এতো ভূমিকা সেই চাবি চুরির গপ্পোটা শেষ করি । ওইরকম মাটির ঢিবি খুঁড়তে গিয়ে একদিন জব্বর গুপ্তধন বেরিয়ে এলো - একটা বাচ্চার মাথার খুলি আর ওই চাবিটা । সে যে কি ভয়, আনন্দ আর উত্তেজনা মেশানো অবস্থা আমাদের - আসল গুপ্তধন পাওয়ার আর বাকি কি ? অক্ষরে অক্ষরে সব যেখানে মিলে যাচ্ছে । এই তো সেই জলদস্যুর মাথার খুলি আর সিন্দুকের চাবি ।

    রব লক্ষ করল না কিন্তু আমি দেখলাম আরো দুতিনজন নড়েচড়ে বসল । প্যারিসে এই এক বিপদ- কে যে ইংরেজি বোঝে, কে নয় তা ঘুণাক্ষরে টের পাবার জো নেই ।

    `ওই যে দাড়িওয়ালা লোকটা বলেছিল না, সম্পত্তিই হলো সব নষ্টের গোড়া', রব বলে চলল, `এযাদ্দিন ঝুটো গুপ্তধন ভাগ করার সময় কোনো হাঙ্গামা হয়নি । কিন্তু এবার আমাদের মাথায় চিন্তা ঢুকলো - এদুটো মহামূল্যবান বস্তু নিয়ে কি করা যায় । এখানে রেখে গেলে অন্য কোনো অভিযাত্রীদল এসে গায়েব করে দিতে পারে । আবার সঙ্গে নিয়ে গেলে আগে ঠিক করতে হয় যে কোনটা কার ভাগে পড়বে । মারিয়ানা বোঝালো যে আপাতত চাবিটা কাছে রাখলেই যথেষ্ট । খুলির গায়ে আঁকিবুঁকি কেটে নক্সা করা আছে, সেটার মর্মভেদ করতে পারলেই সিন্দুকে পৌঁছনো যাবে । তারপর চাবি তো হাতে আছেই । দেখা গেল আমরা দুজনেই কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা রাখতে চাইছি । আমাদের স্বর্গবাসের সেটাই শেষ দিন ।

    `পরদিন তিতো মন নিয়ে স্কুলে গেলাম । খানিকটা নিমরাজি হয়েই চাবিটা মারিয়ানার কাছে রাখতে দিয়েছি কিন্তু ঠিক স্বস্তি হচ্ছে না । এরা জিপসিদের চোর বলে, ও ভালো হলেও ওর বাবা-মা কেমন লোক কে জানে । দুপুরের মধ্যে আমি মনস্থির করে ফেললাম - চাবিটা সরিয়ে সেখানে ব্রাউন পেপারে জড়ানো খুলিটা রেখে দিলাম । তারপর সময় বুঝে স্কুল থেকে হাওয়া । সারা বিকেল সন্ধ্যা বসে রইলাম কিন্তু মারিয়ানার পাত্তা নেই । পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখি মারিয়ানা আসেনি । স্কুলসুদ্ধ সবাই বলাবলি করছে, কেমন করে জিপসি মেয়েটার ব্যাগ থেকে তুকতাকের সরঞ্জাম, হাড়গোড়, মাথার খুলি এইসব পাওয়া গেছে । বাচ্চাদের কাছে এ একটা জঘন্য উদাহরণ, এইজন্যই জিপসিদের সরকারি স্কুলে পড়তে দেওয়া উচিত নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি । ভাগ্যিস ক্লাসটিচার সন্দেহ করে মেয়েটার ব্যাগ সার্চ করেছিলেন নাহলে কার কি হত কে জানে । সবাই রেগে টং, মেয়েটাকে পত্রপাঠ স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে । ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে যে খবরের কাগজ অবধি হাজির । অতি সুশীল ফরাসী সমাজের সাদা দস্তানা ফাটিয়ে মধ্যযুগের থাবা বেরি.য়ে এসেছে । না: আমার নামও কেউ জানে না, আমার সঙ্গে পুরো ব্যাপারটার যেন কোনো সম্পর্কই নেই । সবাই বরং আশ্বস্ত যে সঙ্গদোষে আমার কিছু একটা ক্ষতি হয়ে যায়নি ।

    `পরের কয়েকটা দিন আমার স্কুলে যাওয়া হয়নি পাগলের মতো মারিয়ানার খোঁজ করেছি । রাত্রে মা দেখেছে আমি বালিশচাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি । কি বুদ্ধিতে আমি খুলিটা ওর ব্যাগে রাখতে গেলাম । কি করে ওকে খুঁজে পাবো, কি করে বোঝাবো যে চাবিটা চেয়েছিলাম বটে কিন্তু ওকে ফাঁসাতে তো চাইনি । শুধু একটা প্র্যাঙ্ক, একটা চমক দিতে, খাঁটি জলদস্যুর মতো লুটের মাল বদলাবদলি করতে চেয়েছিলাম । আমি তো জানতাম না জিপসি বাচ্চাদের চোর সন্দেহ করে চোখে চোখে রাখা হয়, ক্লাসে কারো কিছু হারালেই ওর ব্যাগ প্রথম সার্চ হবে । জিপসি মেয়ের ব্যাগ থেকে বেমক্কা মড়ার খুলি বেরোলে তার ফলাফল কি রকম দাঁড়াবে তাও আমার চিন্তার বাইরে ছিল । কিন্তু এসব কথা বোঝাবো কাকে - ওদিকে তো জিপসি ক্যাম্প ভ্যানিশেস ইনটু দি ব্লু । আমার ওইরকম ছন্ন অবস্থা দেখে বাবা চিন্তিত হয়ে উঠলেন । বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমরা ফ্রান্সের পাট চুকিয়ে মেরিল্যাণ্ডে ফেরত ।'

    `জিপসিরা এই রকমটাই হাঁদা' পাশ থেকে একজন মুখ খুললো, `মামলা করেনা, অপবাদ দিলেও মেনে নেয়, কারো ঘাড়ে দোষ চাপায় না । বেগতিক দেখলে তাঁবু তুলে সরে পড়ে । আরে বাবা চুরি-জোচ্চুরিই করবি তো ওয়াল স্ট্রিটের ওস্তাদদের কাছে নাড়া বাঁধ, বেইমানিটা ভালো করে শেখ । তা নয় পাঁচশো বছর ধরে বেকার বদনাম কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে ।'

    বক্তা ঢ্যাঙামতন, দাড়িওয়ালা, লম্বা চুলে পনিটেল, প্যারিসের পানশালার এরকম চেহারা হামেশাই দেখা যায় । এগিয়ে এসে আলাপ করলো ।

    `আমি ভিক্তর, আপনার গল্পের শ্রোতা, সাত পুরুষের প্যারিসিয়ান । আশা করি দু-একটা খেই ধরিয়ে দিলে কিছু মনে করবেন না । চাবিটা কি এখনো আপনার কাছে আছে ?'

    রব জানালো যে চাবিটা খুঁজে পাবার পর ও সোজা প্যারিসে এসে অনেক খোঁজখবর নিয়েছিল । ওর পুরোনো পাড়ার স্কুল উঠে গেছে, সেই হাডিডখানা এখনও আছে বটে কিন্তু মারিয়ানা বলে কোনো জিপসি মেয়ের খোঁজ পাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা । ফ্রান্সে এলে ওর স্যুটকেসে চাবিটাও থাকে । `জিপসিরা রাগ পুষে রাখে না, ক্যাম্প তোলার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে ক্ষমা করে হিসেব চুকিয়ে ফেলে । ওরা আমাদের মতো ভিণ্ডিক্টিভ হতে শেখেনি, জিনিসপত্র জমিয়ে রাখতেও জানেনা । আমি নিশ্চিন্ত যে আপনার বান্ধবী আপনাকে মাপ করে দিয়েছেন । তবে ওই কবরখানার চাবিটা যথাস্থানে ফিরিয়ে দিলে, আপনারও প্রায়শ্চিত্ত হয় আর ওখানকার প্রেতাত্মাদের কিছু সুবিধে হতে পারে । বেচারারা এত বছর ধরে ওই জমিতে আটকা পড়ে আছে কিনা ।'

    `তার মানে ?' আমরা ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলাম । ভদ্রলোক বলে চলেছেন ।

    `পুরোনো ফ্রান্সে নানারকম উদ্ভট প্রথা ছিল জানেন তো । কবরখানার ভিতরে চাবি রেখে দেওয়া তার মধ্যে একটা । কবরখানার দরজা তালা মারা হত ভিতর থেকে । তারপর কেয়ারটেকার চার্চের মধ্য দিয়ে বাইরে এসে সদর দরজায় তালা মেরে নিজের কোয়ার্টারে যেত । এবার ভুতেরা যদি বেরুতে চায়, তাদের তো তালাটা খুলতে হবে । ওদের সুবিধের জন্য একটা চাবি রেখে দেওয়া হত । সেই আধিভৌতিক চাবি আপনি ঝেঁপে দিয়েছেন । যাদের শরীরই নেই তাদের তালা খুলে বেরুতে হবে কোন দু:খে ওসব প্রশ্ন করে লাভ নেই । ভূতেরা কোথায় যাবে সেটাও স্পষ্ট করে জানা যায়না কিন্তু চার্চের দিকে যে ভুলেও যাবেনা এটা নিশ্চিন্ত । তাই বাইরের দরজাটা খুলে ভাগতে পারলেই সুবিধা । আর আপনাদের ওই হাডিডখানা তো বাইরের দিকেই ছিল তাই না । ভাবুন দেখি দরজা খোলা পেলে ওখানকার প্রেতাত্মাদের রাতবিরেতে পার্টি করার কত সুবিধে, না আছে কফিন, না আছে পেরেক । বরং চার্চের পাশে ভদ্রলোকদেরই করুণ অবস্থা, একে কফিনে পেরেকমারা, তার উপর চাঁইকে চাঁই গ্র্যানাইট বসানো । আপনি মাঝখান থেকে চাবি হাপিস করে দিয়ে মহা মুশকিলে করেছেন । যান কালকেই গিয়ে ভূতের চাবি ভূতেদের ফেরত দিয়ে আসুন ।'

    মাঝরাতে টলতে টলতে হোটেলে ফেরা হল । নিউইয়র্ক হলে ঠিক পুলিশে ধরতো ।

    পরের দিন শহর একরকম শান্ত । হ্যাংওভার কাটিয়ে, রবের সেই পুরোনো মহল্লার হাডিডখানায় যখন হাজির হলাম, ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল । সেই পাঁচিল নেই সেই তালাও নেই, আমরা এদিকওদিক দেখে চাবিটা এককোণায় রেখে দিলাম, ভূতেরা আশাকরি খুঁজে নেবে । তারপর দুই বন্ধুতে ঘাসের ওপর বসে খুব একচোট হাসলাম । পুরোনো দিনের প্রাণখোলা হাসি । আমাদের মনে হল চারপাশে আরো অনেকেই সেই হাসিতে যোগ দিচ্ছে । রবের চোখ দেখে মনে হচ্ছে ও শেষ অবধি ফিরতে পেরেছে ওর যাদুবাস্তবের দুনিয়ায় । সেখানে কালো চুলের ঢেউ খেলিয়ে এক্ষুনি ছুটে আসবে ওর সেই জিপসি কিশোরী । তারই আসার অপেক্ষায় যেন সব দরজাগুলো দুহাট করে খোলা, সূর্য্যের আলো সেখানে লুটোপুটি খাচ্ছে ।




    (পরবাস-৪৭; জানুয়ারি, ২০১১)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments