তবে শনি আর রবিবার ও বইমেলায় যাবেই । শনিবার ইস্কুল থাকে না আর রবিবার তো এমনিতেই ছুটি । ও কিন্তু বইমেলায় ঘুরতে যায়না, যায় অন্য একটা আকর্ষণে । ও ছোটদের মাসিক পত্রিকা ফুলঝুরির গ্রাহক, সেই ক্লাস ফাইভ থেকেই । ওর মা বাবাও চেয়েছিলেন ছেলে ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভাষাও ভালোভাবে জানুক, শিখুক । যে কোনো ভাষায় গল্পের বইয়ের সঙ্গে নিবিড় যোগ মানেই সে ভাষায় জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি, এ কথা কে না জানে ! ওদের বাংলার টিচার বলেন মাতৃভাষা হল মাতৃদুগ্ধের মতোই পবিত্র, তাকে কখনো অবহেলা করতে নেই
। ছোটদের মাসিক পত্রিকা ফুলঝুরির খুব নাম আর গ্রাহক সংখ্যাও ঈর্ষণীয় । তার একটাই কারণ । সেটা হল ফুলঝুরির সম্পাদক আদিত্য চৌধুরী একজন সত্যিকার সাহিত্যপ্রেমী এবং সেই সঙ্গে সাহিত্যবোদ্ধা । এই পত্রিকাটা তাঁর যেন প্রাণ । যেমন ঝকঝকে ছাপা তেমন গুণগত মানে সমৃদ্ধ । আদিত্য চৌধুরী কখনো লেখকের নাম দেখে লেখা ছাপেন না, ফলে পত্রিকার পূজা সংখ্যাতেও অখ্যাত অজানা লেখকদের চমত্কার চমত্কার গল্প ছাপা হয়েছে, এখনও হয় । এই পত্রিকাতেই এমন সুযোগ পেয়ে বেশ কিছু অনামী লেখক ছোটদের সাহিত্যে দাঁড়িয়ে গেছেন, এখন তাঁদের বেশ নাম । এ ব্যাপারটা জানেন বলেই নামী লেখকরা এ পত্রিকায় হেলা-ফেলা করে লেখা লেখা দেন না । আদিত্য চৌধুরী তেমন লেখা ছাপবেন না এটা কারও অজানা নয় ।
আদিত্য চৌধুরীর কলেজ স্ট্রীটে একটা বইয়ের দোকানও আছে, মানে তিনি একজন প্রকাশকও বটে । তবে তাঁর দোকানে ছোটদের বইয়ের সম্ভারই বেশি । তাঁর প্রকাশনার নাম-ডাকও কম নয় । ষাট পেরিয়েও তিনি যুবার মতো কর্মঠ ।
আদিত্য চৌধুরী বিয়ে থা করেননি । হেদোর কাছে তাঁর পৈতৃক বাড়ি । তেতলা বাড়ির অনেকটাই ভাড়া, নিজে দোতলায় দুখানা ঘর নিয়ে থাকেন । আর একতলায় একটা বড় ঘরে পত্রিকার আপিস, সেখানে কয়েকজন কর্মচারী কাজ করেন । তা ছাড়াও ব্যাঙ্কে আর পোস্টাপিসে মোটা টাকা আমানত করা আছে, তা থেকে মাসিক সুদ কম হয় না । তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত এক কবিরাজ, লোকে বলত সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি । তিনি এক হাত দিয়ে রোগীর নাড়ি দেখতেন না, দু'হাত দিয়ে রোগীর দু'হাতের নাড়ি দেখতেন । তাঁর চিকিত্সার পদ্ধতিও ছিল অভিনব । তিনি কখনো রোগীকে পারিশ্রমিকের জন্য চাপ দিতেন না, তবু তাঁর রোজগারে ভাঁটা ছিল না ।
ছোটবেলা থেকেই আদিত্য চৌধুরী ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী, বাবা বেঁচে থাকতেই তিনি প্রকাশনায় নেমে পড়েছিলেন, পরে মাসিক কিশোর পত্রিকা ফুলঝুরির আত্মপ্রকাশ ।
বইমেলার প্রথম বছর থেকেই আদিত্য চৌধুরী মেলায় স্টল দিয়ে আসছেন । সেখানে ছোটদের গল্পের বই ছাড়াও এক বছরের বাঁধানো ফুলঝুরি বিক্রি হয়, তা ছাড়া মেলায় গ্রাহকও করা হয় । এখানেই আদিত্য চৌধুরী একটা চমত্কার ব্যবস্থা করেছিলেন । পত্রিকার মাধ্যমে তিনি গ্রাহক গ্রাহিকাদের কাছে আবেদন করেছিলেন তারা মেলায় এসে তাঁর স্টল সামলাবে, অর্থাৎ ভলান্টারি সার্ভিস দেবে । তারাই খদ্দেরদের বই দেখাবে, রসিদ কাটবে, পত্রিকা সম্বন্ধেও যা বলার বলবে । এর ফলে গ্রাহক গ্রাহিকাদের মধ্যে এমন উত্সাহ আর হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল যে সেটাও হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক সমস্যা । ফলে ভলান্টিয়ার বাছতে হয় এবং পালা করে তাদের ডিউটির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল । সে ব্যবস্থা এখনও চলে আসছে । আদিত্য চৌধুরী তাদের ওপর সব ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন । অবিশ্যি স্টল খোলা, বন্ধ করা এ সবের জন্য দোকানের কর্মচারিদের থাকতে হতো । চৌধুরী নিজে আসেন বেলা করে, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন সবার জন্য টিফিন, সে এক এলাহি কাণ্ড । এ ব্যাপারে তিনি কখনো কার্পণ্য করতেন না । তা ছাড়া কফির ব্যবস্থাও আছে ।
ক্লাস সিস্ক থেকেই চন্দন ভলান্টিয়ার, তাই বইমেলার জন্য ও মুখিয়ে থাকে । আগে অন্যান্য দিনেও স্টলে দেখা যেত, এ বছরই পড়ার চাপের জন্য মা বলেছেন শনি আর রবিবার ডিউটি নিতে । ওখানে আরও কত গ্রাহক গ্রাহিকার সঙ্গে দেখা হয়, তারপর যারা বই দেখতে আসে, বিশেষ করে ছোটরা, তাদের ভালো বই সম্বন্ধে বলতে হয়, ফুলঝুরির গ্রাহক করার জন্য পত্রিকার গুণাগুন ব্যাখ্যা করতে হয় । একটা বই বিক্রি কিংবা একজনকে ফুলঝুরির গ্রাহক করতে পারলে মনে হয় যেন রাজ্য জিতে ফেললাম । সে আনন্দ বলে বোঝানো যায় না । ফুলঝুরির গ্রাহক গ্রাহিকারা যেন এক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, এক সূত্রে গাঁথা । প্রত্যেক মাসের প্রথম রবিবারের বিকেলে পত্রিকার দপ্তরে গ্রাহক গ্রাহিকাদের একটা মজলিশ বসে, সেখানে ওরা নিজেদের লেখা গল্প, কবিতা পড়ে । সম্পাদক নিজে হাজির থাকেন । ভালো লেখাগুলো পত্রিকার ছোটদের পাতায় ছাপা হয় ।
দেখতে দেখতে বইমেলা এসে গেল । চন্দনের মনেও ছটফটানি শুরু হয়ে গেছে । বইমেলায় ফুলঝুরির স্টলে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, নতুনদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হবে । মাঝে মাঝে পালা করে ওরা স্টল থেকে বেরিয়ে অন্যান্য স্টলেও ঢুঁ মারে, বই উল্টে পাল্টে দেখতে ভালো লাগে, মনের মতো বই পেলে কিনেও ফেলে ।
বই মেলার প্রথম শনিবার চন্দনের যেন আর তর সয়না, বেলা বারোটার আগে থেকেই মাকে তাড়া দিতে থাকে ভাত দেবার জন্য । গত বছর পর্যন্ত মা-ই ওকে মেলায় নিয়ে যেতেন আর বাবা আপিস থেকে ফেরার পথে মেলায় ঢুকে স্টলের বাইরে অপেক্ষা করতেন, ওকে নিয়ে ফিরতেন । চন্দনের মতো আরও কিশোর কিশোরীদের স্টলের মধ্যে ব্যস্ততা, দায়িত্ববোধ আর কর্মকাণ্ড দেখে তিনি নিজেও উত্সাহিত হতেন । তাঁর মনে হত এই রকম কাজের মধ্যে দিয়ে ছেলে-মেয়েরা আত্মনির্ভর হয়ে উঠছে । ফুলঝুরির প্রবীণ সম্পাদক তাঁর পত্রিকার গ্রাহক গ্রাহিকাদের আত্মবিশ্বাসী হবার চমত্কার সুযোগ করে দিয়েছেন । বলতে ভুল হয়ে গেছে, মেলা শেষ হবার পর ভলান্টিয়ারদের একদিন ভুরিভোজন করান সম্পাদক মশাই, তাঁর বাড়িতেই আয়োজন হয় । মোগলাই খানা ।
এ বছর থেকে চন্দন বলেছে ও একাই যাবে আসবে । ও বড় হয়েছে না, ক্লাস নাইনে পড়ে । ওর মা একটু গাঁই গুঁই করলেও, বাবা তাতে সম্মতি দিয়েছেন ।
যথারীতি মেলায় ফুলঝুরির স্টলে পুরোনো বন্ধুদের দেখে সবাই হই হই করে উঠল । শনি রবিবার আর ছুটির দিনেই ভলান্টিয়ার হয় বেশি, ভেতরে ভিড় হয়ে যাবে বলে ওরা অনেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁকতে থাকে `এখানে ছোটদের বইয়ের স্বর্গরাজ্য, একবার এসে দেখে যান ।' ওদের ডাকে অনেক মা-বাবাই ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে স্টলে ঢোকেন । আর একবার ঢুকলে খালি হাতে কেউ ফেরেন না । নাছোড়বান্দা ছেলেমেয়েগুলো তাঁদের বই গছাবেই, সেই সঙ্গে পত্রিকার গ্রাহক করা তো আছেই । সমপাদক মশাই এক কোণায় বসে মিটিমিটি হাসেন, তিনি ওদের ব্যাপারে একেবারেই হস্তক্ষেপ করেন না, ওদের অবাধ স্বাধীনতা দেন । সেটাও একটা মস্ত আকর্ষণ চন্দনদের কাছে ।
শুধু ওরাই নয়, কয়েকজন অত্যুত্সাহী বাবাও স্টলের ভেতরে আর বাইরে ছোটদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাঁক মারতে থাকেন, `আসুন, এখানে ছোটদের বইয়ের স্বর্গরাজ্য ।'
দেখতে দেখতে কয়েকদিন হই হই করে কেটে গেল । এ বছর ফুলঝুরি স্টলের বিক্রি গত সব বছরকে ছাপিয়ে গেছে রের্কড বিক্রি । সবাই খুব খুশি । মাঝখানে আবার একদিন সরস্বতী পুজো পড়ায় চন্দন বাড়তি একদিন স্টলে এসেছে । এল শেষ শনিবার । পরের দিন অর্থাৎ রবিবার হয়েই এ বছরের মতো মেলার সমাপ্তি ।
আজ একটা থেকে গেট খুলেছে । সঙ্গে সঙ্গে জলস্রোতের মতো মানুষ ঢুকছে মেলায়, যাকে বলে জনস্রোত । ফুলঝুরি স্টলের বইয়ের র্যাকগুলো দেখতে দেখতে ফাঁকা । আজ আদিত্য চৌধুরী প্রথম থেকেই আছেন । তিনি তাঁর কর্মচারীদের স্লিপ দিয়ে অন্যান্য বইয়ের দোকানে ঘন ঘন পাঠাতে লাগলেন বইয়ের জন্য । সব প্রকাশকরাই এতদিনে জেনে গেছেন ফুলঝুরি স্টলে ছোটদের বই কিনতে প্রচুর ভিড় হয়, আর চৌধুরী মশাইও টাকা ফেলে রাখেন না, মেলার শেষের দিনই রাত্তিরে সকলের পাওনা মিটিয়ে দেন । লাভের মধ্যে অন্য প্রকাশকদের যে সব বইতে ধূলো জমছিল সেগুলোও হু হু করে বিক্রি হয়ে যায় ।
সন্ধ্যার পর এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা স্টলে ঢুকলেন । তাঁর চেহারা আর পোশাক দেখে বুঝতে কষ্ট হয়না যে, তিনি বিদুষী এবং কোনো অভিজাত ঘরের বউ । তাঁর সঙ্গে রয়েছে চোদ্দ পনেরো বছরের একটি মেয়ে । ফর্সা এবং দেখতে পরীর মতন । তার মা পরেছেন দামি তাঁতের শাড়ি আর ওর পোশাক হল কারুকার্য করা শালোয়ার কামিজ, গাঢ় নীল রঙ ।
চন্দন তখন এক ভদ্রলোককে তাঁর মেয়ের জন্য বই দেখাচ্ছিল । ভদ্রমহিলা চন্দনকে দেখে একটু ইতস্তত করলেন, যেন যে জন্য এসেছেন বা যা বলতে চাইছেন, এক কিশোরকে দেখে তা ভরসা করতে পারছেন না । চন্দন হাসিমুখে বলল, `মাসিমা, আমাদের এখানে ছোটদের অনেক বই আছে, সব রকমের বই ।'
ভদ্রমহিলা একটু কেশে মৃদু কন্ঠে বললেন, `এ আমার মেয়ে, ইংলিশ মিডিয়ম স্কুলে পড়ে, ইংরেজি গল্পের বই ছাড়া বাংলা বইয়ে হাতই দেবে না । হ্যারি পটার পেলে নাওয়া খাওয়া ভুলে যাবে কিন্তু ঠাকুরমার ঝুলি পড়ে না, চাঁদের পাহাড় পড়ে না । আমার এটা ভাল লাগে না । আমরা ছোটবেলা শিখেছিলাম মা আর মাতৃভাষাকে একই সম্মান দিতে হয় । আমাকে এমন কোনো বই দিতে পার যা পড়ে বাংলা বইয়ের ওপর ওর আগ্রহ জন্মায় ।
চন্দন একটু ফাঁপরে পড়ল । ওর দু'জন পরেই বসেছিলেন আদিত্য চৌধুরী । ভদ্রমহিলার সব কথাই তাঁর কানে গিয়েছিল । চন্দন তাঁর মুখের দিকে তাকালো, যদি তিনি কোনো বইয়ের নাম বলেন । কিন্তু তিনি নির্বিকার, অর্থাৎ যা সিদ্ধান্ত তা চন্দনকেই নিতে হবে, তিনি নাক গলাবেন না ।
চন্দন একটু ভাবল, তারপরই একটা বইয়ের কথা ওর মনে পড়ল । ফুলঝুরিতে দু'বছর আগে ধারাবাহিক ভাবে একটা কিশোর উপন্যাস বেরিয়েছিল, মানবিক আবেদনের ওপর একটা মিষ্টি কাহিনী । খুব ভাল লেগেছিল ওর । পরে আদিত্য চৌধুরীর প্রকাশনা থেকে বই ছাপা হয়েছিল । নীল রঙের সুন্দর মলাট, এই মেয়েটির পোশাকের মতই নীল ।
ও র্যাক থেকে বইটা বের করে ভদ্রমহিলার হাতে দিল । তিনি বইটা উল্টে পাল্টে দেখে বললেন, "এই লেখকের নাম শুনেছি বলে মনে পড়ছে না তো ।"
`নতুন লেখক', চন্দন বলল, কিন্তু চমত্কার লিখেছেন । এটা তাঁর প্রথম বই, আর প্রথম বইটাই এক নামী সংস্থা থেকে গত বছরের সেরা কিশোর উপন্যাস হিসাবে পুরস্কার পেয়েছে ।
ভদ্রমহিলা তখনও ইতস্তত করছিলেন । এবার কিন্তু মুখ খুললেন আদিত্য চৌধুরী । তিনি বললেন, "ও আপনাকে ভাল বই-ই দিয়েছে, নিশ্চিন্ত মনে নিয়ে যান । যদি আপনার মেয়ের ভাল না লাগে কাল নিয়ে আসবেন, দাম ফেরৎ দিয়ে দেব । তবে একটু যত্ন করে রাখবেন যাতে ড্যামেজ না হয় আর মেয়েকে বলবেন যত্ন করে পড়তে, এতো আর হ্যারি পটারের মতো আজগুবি কাহিনী নয় ।" ভদ্রমহিলা আর কথা না বাড়িয়ে বইটার দাম মিটিয়ে দিলেন ।
ওরা চলে যাবার পর এক বদ্রলোক বললেন, "মেয়ে বোধহয় বইটা খুলেও দেখবে না, মা অত আশা করে নিয়ে গেলেন । এই হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়মে পড়ার খারাপ দিকটা, গর্ব করে এরা বলে বাংলা পড়তে জানিনা । পৃথিবীর আর কোনো দেশে মাতৃভাষার এমন অবহেলা বরদাস্ত করা হয় না ।"
পরদিন মেলা শেষ । বেলা বারোটা থেকেই সব গেট খুলে গেছে, পিল পিল করে লোক ঢুকছে । ফুলঝুরির স্টলে আজ সব ভলান্টিয়ারই হাজির । সবাই মিলে স্টলের ভিড় সামাল দেবার চেষ্টা করছে । চন্দনদের মন আজ ভারাক্রান্ত । আবার একবছর পরে দেখা হবে মেলায় । যেন প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে ।
শেষ দিনে অনেক নতুন গ্রাহক গ্রাহিকা করা হল । এক বছরের বাঁধানো ফুলঝুরিও বিক্রি হল খুব, প্রায় শেষ ।
সন্ধ্যে সাতটার পর ওরা একটু হাঁফ ছেড়েছে । ঠিক সেই সময়টা স্টলে ভিড় একটু কম । আদিত্য চৌধুরীই প্রথমে দেখলেন । গতকালের সেই ভদ্রমহিলা মেয়েকে নিয়ে এ দিকেই আসছেন । মেয়ের হাতে বইটা, আর আজ তার পরিধানে শালোয়ার কামিজ নয়, মার মতো শাড়ি ।
আদিত্য চৌধুরী মনে মনে দু:খ পেলেন, মেয়েটির শেষ পর্যন্ত ভালো লাগল না বইটা, হয়তো পড়েইনি । দাম ফেরত দিতে হবে ।
তিনি চন্দনের দিকে তাকালেন । চন্দন ততক্ষণে তাদের দেখেছে । ওর মুখটা একটু বিবর্ণ, যেন বেশ হতাশই হয়েছে । ভদ্রমহিলা সোজা চন্দনের সামনে এসে দাঁড়ালেন, হাসি হাসি মুখে বললেন, "বইটা নিয়ে এলাম ।"
"আপনার মেয়ের ভালো লাগল না !" মিন মিন করে বলল চন্দন ।
ভদ্রমহিলা মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন । তার ফর্সা মুখ একটু লাল হল, হয় লজ্জা নয় অপ্রতিভ অবস্থা লাল ছোপ এঁকে দিয়েছে ওর মুখে ।
`একদম উলটো', ভদ্রমহিলা হাসি মুখেই বললেন, "খুব ভালো লেগেছে, এখান থেকে গিয়েই আমি ওর হাতে বইটা ধরিয়ে দিয়েছিলাম । একঘন্টা পরে এসে দেখি তখনও বইটা পড়ছে, একবারও ওঠেনি । আমি তো অবাক । বই শেষ করে বলল, মা খুব ভালো বই, এমন বই আগে কখনও আমি পড়িনি ।"
"আমার কেমন কৌতূহল হল, আমিও বইটা পড়লাম । কলকাতার এক নামী ইস্কুলের ছাত্র সুজন মা-বাবার সঙ্গে বাংলা-বিহার সীমান্তে এক সাঁওতাল পল্লীর কাছে ছুটিতে বেড়াতে গেছে । সেখানে শাল, মহুয়া, সেগুন কত রকমের গাছ আর কত সুন্দর সুন্দর পাখি, শিল্পী যেন তাদের গায়ে রঙের তুলি বুলিয়েছে, লেখক তাদের এমন বর্ণনা দিয়েছেন যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে । সেখানেই সাঁওতাল ছেলে বুধনের সঙ্গে দেখা । ছেলেটা বোধহয় সুজনের চাইতে ছোটই হবে । উদলা গা, হাঁটুর ওপর ধূতি মালকোছা মেরে পরা, খালি পা । সেই ছেলেটাই একটা গরুর গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, মহিষের পিঠে চড়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে মেঠোপথ ধরে চলেছে । শহুরে ছেলের বিস্ময়ের শেষ নেই । তারপর একসময় দুজনের ভাব হয়ে গেল অথচ তাদের মধ্যে কোনো মিল নেই । সেই সাঁওতাল ছেলেটা শহুরে ছেলেকে ঝর্ণা দেখাতে নিয়ে গেল, খেজুর গাছ থেকে কলসি নামিয়ে খেজুরের রস খাওয়ালো, আর ওরা ফিরে যাবার দুদিন আগে সাঁওতাল ছেলে বুধন নিজের জীবন বিপন্ন করে তার শহুরে বন্ধুকে এক পাগলা হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচালো । অতটুকুন ছেলের কি সাহস, কি উপস্থিত বুদ্ধি !
সুজনের মা সাঁওতাল ছেলেকে পেট ভরে ভাত মাংস আর মিঠাই খাওয়ালেন । সুজন ওর একটা নতুন জামা ওকে দিল । ওটা পেয়ে ছেলেটার কি আনন্দ, ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দিল । চোখে জল এসে যায় ।
ওদের চলে যাবার সময় সাঁওতাল ছেলেটা ছুটতে ছুটতে এসে একটা পাখির পালক ওকে উপহার দিল । গাঢ় নীল রঙের সুন্দর একটা পালক । সুজন হাত বাড়িয়ে পালকটা নিল । ওর সাঁওতাল বন্ধুর ভালোবাসার দান - ওখানকার মধুর স্মৃতি । বইটা শেষ করার পর মনে হল যেন আমার বুকের ভেতরটাও মিষ্টি হয়ে গেছে ।
ভদ্রমহিলা থামলেন, যেন একটু বেশি আবেগ প্রকাশ করে ফেলেছেন ভেবে লজ্জা পেলেন । তারপর বললেন, "আজ আমি এসেছি আরও বই নিতে । আমার মেয়ে বলেছে এবার থেকে বাংলা গল্পের বই পড়বে, তুমিই বই বেছে দাও । আর এই বইটারও কয়েকটা কপি চাই, আমি কয়েকজনকে উপহার দেব ।"
চন্দনের মুখ হাসিতে ভরে গেল । এবারের বই মেলা সব দিক দিয়ে ওর কাছে সার্থক । আদিত্য চৌধুরীর মুখের দিকে ও তাকালো । তাঁর মুখেও প্রসন্ন হাসি । ও তাড়াতাড়ি বই বাছতে শুরু করল ।
(পরবাস - ৪৭, জানুয়ারী, ২০১১ )