• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৭ | জানুয়ারি ২০১১ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থপরিচয় : নিরুপম চক্রবর্তী


    ॥ কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ :
    অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের অগ্নিপুরুষ


    অগ্নিপুরুষ , অশোককুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, দ্বিতীয় সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০৬, ISBN: 81-7756-425-0


    বৃটিশ অধিকৃত বঙ্গভূমির ইতিহাসে যে কালক্রমটি অগ্নিযুগ বলিয়া চিহ্নিত হইয়া থাকে বাবু শ্রী অশোককুমার মুখোপাধ্যায় রচিত `অগ্নিপুরুষ' উপন্যাসটি তাহারই প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জীবনালেখ্য । ঐতিহাসিক উপন্যাসে বঙ্গসাহিত্যের কতিপয় শতাব্দীর উত্তরাধিকার ; প্রথম বাঙ্গালা উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী বিশুদ্ধ ইতিহাস না হইলেও স্বীয় যোগ্যতায় `ঐতিহাসিক' । বিস্ময় অতএব যে অগ্নিযুগের বঙ্গইতিহাস তাহার অজস্র ঘাতপ্রতিঘাত তথা উপন্যাসের সহস্র উপাদানে ঋদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, অদ্যাপি যথেষ্ট সংখ্যক কালোত্তীর্ণ উপন্যাসের আধার হইয়া উঠে নাই । অশোককুমার মুখোপাধ্যায় সুদক্ষ হাতে আমাদিগের একটি বহুদিনগত প্রত্যাশার পরিপূরণ করিলেন ।

    উল্লাসকর দত্ত সুবিদিত আলিপুর মামলার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত । তাঁহার মৃত্যুদণ্ডাদেশ মহাদয়াময় রাজশক্তি পরিশেষে কালাপানি দ্বীপান্তরে রূপান্তরিত করেন । তাঁহার জীবনকথা অতীব বিচিত্র : উল্লাসকর প্রতিভাবান, জন্মরোমান্টিক, তাঁহার বিপ্লবচিন্তা নিহিলিস্ট নৈরাজ্যের উত্তরাধিকার, তিনি স্বশিক্ষিত বোমারু অ্যালকেমিস্ট, তিনি অপ্রকৃতিস্থ, তিনি অয়স্কঠিন সততায় প্রতিষ্ঠান বিরোধী । ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাতো ঝড় । ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে, গুলি বন্দুক বোমার আগুনে আজও রোমাঞ্চকর (জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুতবাণী : সুকান্ত ভট্টাচার্য) । অশোককুমার মুখোপাধ্যায় এই উল্লাসকর দত্তকে তাঁহার সমকালীন পটভূমিতে অন্বিত করিলেন একাদিক্রমে ঐতিহাসিকের সততায় ও ঔপন্যাসিকের অর্ন্তদৃষ্টি লইয়া । এ গ্রন্থ তাই অতীব সুখপাঠ্য । দুই বত্সরের কম সময়ে ইহার দ্বিতীয় সংস্করণের দ্বিতীয় মুদ্রণ নি:শেষ করিয়া যে সমস্ত বঙ্গভাষী পাঠক ইহার `ইমপ্রেসিভ' সংবর্ধনা দিয়াছেন, তাঁহাদিগকে সাধুবাদ জানাই ।

    বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যে জটিল প্রেক্ষাপটে লেখক উল্লাসকরকে স্থাপন করিয়াছেন তাহা অতীব মহত্বপূর্ণ । অশোককুমার সৃষ্ট এই পটচিত্রে অজস্র চরিত্রের সমাহার : উল্লাসকরের বিপ্লব সখ্যবৃন্দ, হেমচন্দ্র দাস, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ প্রমুখ ও অন্যান্য অগ্নিবালকের তথা শান্তি-সুনীতি সদৃশ অগ্নিবালিকা, বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল ও তাঁহার কন্যা লীলা যিনি আজীবন উল্লাসকরের প্রাণ লাবণ্যে পরিপূর্ণ রাখেন ও প্রায় জীবনসায়াহ্নে বন্ধুর বৈপ্লবিক পথপরিক্রমা শেষে উল্লাসকর যাঁহার পাণিগ্রহণ করেন, বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ : অবিরত ঈশ্বর দর্শন যাঁহাকে পরিশেষে ঋষিত্ব প্রাপ্ত করায় (আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এই বিবর্তন কাফ্কার চক্ষে আকর্ষণীয় ঠেকিত !), অবিরাম ধর্মান্তরিত ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় যিনি বৃটিশ বিরোধীতার `ধর্মে' আমরণ অচঞ্চল থাকেন । রবিবাবুর গানে বঙ্গভূমি রোমাঞ্চিত হয় ।

    ফাঁসির আদেশ শুনিয়া উল্লাসকর গাহিয়া উঠেন `সার্থক জনম' । অশোককুমারের বর্ণনা পড়িয়া আমার মনে ভাসে `কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস - সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো, ধরায় আস ॥' এই আবেগমথিত মহাকথনে অশোককুমার অবশ্য একবারও তাঁহার ইতিহাস বর্ণনার নির্মম দায়িত্ব বিস্মৃত হন না । তিনি আমাদিগকে জানাইতে ভোলেন না যে আলিপুর মামলায় স্রেফ অরবিন্দ ঘোষকে সমর্থন করিতে ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ মোট অষ্টাদশ সহস্র ভারতীয় মুদ্রা পকেটস্থ করিতে চাহেন (পরবাস পাঠককুলে যদি অর্থনীতিবিদ কেহ থাকিয়া থাকেন, তিনি অনুগ্রহ করিয়া ইনফ্লেশান উত্তীর্ণ বর্তমান টাকায় ইহার প্রায় নৈস্বর্গিক পরিমাণটি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করিয়া কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করুন !) ; অশোককুমার জানাইয়াছেন ইহা বেশ কিছু নিম্নবিত্ত অভিযুক্তের অসীম ক্লেশের কারণ হইয়া উঠে । অনুমান করিতে পারি বাল্যকালে বিদ্যালয় পাঠক্রমে অশোককুমার আমারই মতো শিখিয়াছিলেন যে আলিপুর মামলার আসামীপক্ষ সমর্থন দেশবন্ধুর দেশভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন । হয়ত তাহাই সত্য ; তথাপি এই চন্দ্রমার অনালোকিত বৈষয়িক প্রদেশটিতে অকস্মাৎ আলোকপাত করিয়া অশোককুমার আমাদিগকে অতীব বিচলিত করেন । পরন্তু অশোককুমার জানেন যে গণযোগাযোগবিহীন এই নির্মম ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি, অজস্র স্বার্থত্যাগ শেষে একটি ভ্রান্ত আলোকবর্তিকার বাহক ব্যতীত কিছু নয় । অশোককুমার দেশমাতৃকার চরণে প্রণাম করিয়া তেলেভাজার দোকান খোলেন না : সহিংস স্বদেশী নৈরাজ্যবাদ যে একদা নি:সহায় বিধবার সর্বস্ব লুন্ঠনের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডেও লিপ্ত ছিল, নিষ্ঠাবান ঐতিহাসিকের সততায় অশোককুমার আমাদের এই তথ্য হইতে বঞ্চিত করেন না ।

    যাহাই হউক, অবশেষে স্বাধীনতা আসে । সবাই যখন রাজবাড়ীতে বেচতে গেল দাঁতের মাজন, আমি একা পথের মোড়ে গাইবো খালি শিবের গাজন ! (স্মৃতি ও বিস্মৃতির আধো অন্ধকার হইতে উদ্ধৃত এই অনন্যসাধারণ পঙ্ক্তিগুলির বিশুদ্ধি তথা সঠিক কবিপরিচিতি সম্পর্কে আমি সংশয়গ্রস্ত । বিদগ্ধ পরবাস পাঠক সাহায্য করিবেন, আশা রাখি ।) এই বিচিত্র অড্‌ ম্যান্‌ আউটটির নাম শ্রী উল্লাসকর দত্ত । পরিচিত সহযোদ্ধাদের মধ্যে কেহ মন্ত্রী, কেহ বা ষড়যন্ত্রী-------উন্মাদ উল্লাসকর এই অতীব লাভদায়ক ভগ্ন স্বাধীনতায় অবিশ্বাস করে, এমন কি পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের অর্থসাহায্যের আন্তরিক প্রতিশ্রুতি পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে । উল্লাসকর দিবাস্বপ্ন দেখে, অজস্র বসন্ত শেষে, পরিশেষে বিবাহ করে আবাল্যসঙ্গিনী, অধুনা বিধবা ও পঙ্গু, বিপিন পাল দুহিতা লীলাকে । এই অবিস্মরণীয় প্রেমগাথা অশোককুমার অতীব নিপুণ হস্তে বিন্যস্ত করিয়াছেন ।

    প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে এই গ্রন্থটি প্রথিতযশা লেখক বাবু শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আশীর্বাদধন্য ও শ্রী অশোককুমারের রচনাশৈলীতে গঙ্গোপাধ্যায় মহোদয় প্রবর্তিত গদ্যরীতির সচেতন প্রভাব । এই অতি প্রাকৃত ও ক্ষেত্রবিশেষে অতিতরল রচনাবিধি সর্বজনগ্রাহ্য হইতে পারে, তথাপি অক্ষম হস্তে ইহার অপুট প্রয়োগ যে রক্তাল্পতা উত্পন্ন করে, তাহা, নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত বিচারে, মহৎ সাহিত্য নির্মাণের প্রতিবন্ধ হইয়া উঠে । সুখের কথা এই যে ভাষা ব্যবহারের সুকঠিন পরীক্ষায় অশোককুমার সসম্মানে উত্তীর্ণ । তাঁহার গদ্যরীতি সুসংহত, সুখপাঠ্য ও যথাস্থানে অসামান্য সুললিত । যিনি লিখিতে পারেন "লীলা এখনও সুকন্ঠী । কিছু মানুষ থাকে যারা হেলাফেলায় বেড়ে ওঠা সুগন্ধী ফুলের মতো নির্জনে সুবাস ছড়ায়, তারপরে ঝরে যায় । লীলাও সেই রকম", তাঁহাকে অন্তত: আমি ঐতিহাসিক রচনা নির্মাণের নিমিত্ত `রাজসিংহ' পাঠের উপদেশ দিব না ।

    পরিশেষে বলি প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক তাঁহাদের কার্য যত্নসহকারে নিষ্পন্ন করিয়াছেন - যদিও প্রচ্ছদটিতে কল্পনার অভাব পরিলক্ষিত হয় । `সারাজেভো', `ওরেগন' ইত্যাদি বানানগুলি পরবর্তী সংস্করণে সংশোধিত হইবে আশা রাখি । এই গ্রন্থের প্রভূত কল্যাণ কামনা করি ! যদিও কোনো গ্রন্থের কল্যাণ কামনা বিধিগত অথবা সম্ভবপর কিনা, অথবা তাহা সমালোচকের কর্তব্যকর্ম কিনা, এই প্রসঙ্গে কোনো ধুন্ধুমার তর্কের অবকাশ ঘটিলে আমাকে নিরুত্তর থাকিতে হইবে ।



    (পরবাস-৪৭, জানুয়ারি, ২০১১)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments