![]() |
খুব বড় কোনো হাউজ নয়, জ্যাল্জেলে পৃষ্ঠা, স্বল্পনামী লেখিকা, কিছু মুদ্রণপ্রমাদও চোখে পড়ল, তবু যে কৃশকায় কেতাবখানি চমত্কার উত্রে গেলো, সে কেবল তার মনোজ্ঞ বিষয়-নির্বাচনের জন্যই নয়, তার সামগ্রিক সৌকুমার্যে । এইটিই কোনো বইয়ের শেষ কথা হওয়া উচিত্-------বইখানি হাতে নিয়ে, পড়ে, "ভালো" লাগল তো ? লেগেছে ? ব্যস্ । তাহলেই পাশ, নতুবা নয় ।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও তত্সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এতাবৎ শুধু বাংলা ভাষাতেই কত বই বেরিয়েছে, তার এক নির্দিষ্ট তালিকা হওয়া উচিত (এমনকি "ঠাকুর বাড়ির রান্নাবান্না" নিয়েও) । কিন্তু কেবল গুরুদেবের ঠাট্টা-তামাশা-মজা নিয়েই একটা গোটা বই, কই, আগে তো চোখে পড়েনি । সেদিক থেকে শ্রীমতী শ্রীমানী কলম্বাসি-ভূমিকা নিয়েছেন বটে । বধাঈ !
সূর্য সমান রবি-ঠাকুরকে তো আমরা কবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, চিত্রী, শিক্ষাশাস্ত্রী-------কত রূপেই না জানি । কিন্তু সেই ঋষি যে কেবল ভারিভুরি বিষয়েই ভরা ছিলেন না, অন্তরে এক অনি:শ্বেস রসধারাও যে সদা বহমান ছিল, সে-পরিচয় বয়ে আনে এই তন্বী কেতাব । নইলে, বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ অবনঠাকুরের সঙ্গে মিলে লুকিয়ে-লুকিয়ে সাহানা দেবীর নাচ দেখছেন, ধরা পড়ে গিয়ে বলছেন, "দেখো ঝুনু, তুমি যদি কথা দাও যে তুমি নাচবে তাহলে আমি আবার একটা বিয়ে করি !"-------ভাবা যায় ?
এ'বইয়ে ঠাঁই পাওয়া আরও আরও অনেক রবীন্দ্র-রসিকতাই অনবদ্য । যেমন, সাহিত্যিক বনফুলের ঘর থেকে বানিয়ে আনা উপাদেয় সন্দেশ খেয়ে কবির কপট বিস্ময় , "এ' যে বড় চিন্তার কারণ হল হে বলাই । এদ্দিন তো জানতাম বাঙলাদেশে মাত্র দুটিই রসস্রষ্টা আছে : এক দ্বারিক ঘোষ আরেক রবীন্দ্রনাথ । তোমার গৃহিণী যে তৃতীয় আরেক জন হয়ে পড়লেন !"
বৃদ্ধ বয়সে "একাকী" রবীন্দ্রনাথের রসিকতার ভাণ্ডার মংপুর আধা-পাহাড়ি জংলি আবহাওয়ায় ও মৈত্রেয়ী দেবীর সাহচর্যে যেন উছলে উঠেছিল । এই বইয়ের অধিকাংশ কাহিনির (
anecdote ) পটভূমিকাই তাই মংপু । এখানেই কবির সাহচর্য পেতে একে একে এসে উঠেছেন অতুলপ্রসাদ, দিলীপকুমার রায়ের মত ব্যক্তিত্ব (দিলীপকুমারকে গুরুদেব "বান্ধবী-বত্সল" বলে মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলেন !) । বোন চিত্রিতার জন্য এক ভালো পাত্র খঁংউজে দেবার অনুরোধের প্রত্যুত্তরে কবি মৈত্রেয়ীকে বললেন, "বাঙলাদেশের শ্রেষ্ঠ পাত্র ,… তো মানে….তোমাদের সামনেই, মানে ,….. তবে কিনা তোমাদের মতে তার বয়সটা একটু বেশি হয়ে গেছে । তাকে চলবে না !" মৈত্রেয়ী হাসেন না কাঁদেন !আর, কবির সেই লাল-জল পানের গপ্পটা তো অনেকেই শুনেছেন : শান্তিনিকেতনে প্রতি প্রাতে: কবিকে আয়েশ করে এক গেলাস লালজলে চুমুক দিতে দেখেন ছাত্র প্রমথনাথ বিশী আর ভাবেন কবি কি তবে মদ্যপায়ী ? লোভী চোখে ঘুর ঘুর করতে দেখে কবি তাকে একদিন আমন্ত্রণ জানালেন, "কী রে ? খাবি ? আয় ।" অবাক প্রমথনাথ ! কবি তাঁকে মদ্যপানে আহ্বান জানাচ্ছেন ! মুখে দিয়ে তো আর ওয়াক্ করার উপায় নেই ! নিমপাতা ফোটানো জল ! কবি স্বাস্থ্যের কারণে রোজ পীতেন ।
কিছু কিছু রসিকতা তো "-------"-এর গা-ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে ! যেমন, কালিম্পং-এ একবার চিত্রিতা, নাতনি নন্দিনী সকলে মিলে কবির জন্মদিনে অনেক ফুল দিয়ে বিছানা সাজিয়ে ডেকে আনলেন তাঁকে । নাটকীয়ভাবে কাঁদো কাঁদো গলায় কবি বলে উঠলেন, "এই দ্যাখো কাণ্ড । এ'সব দেখলে যে মন খারাপ হয়ে যায় ! সঙ্গিনীহীন ফুল শয্যা !!"
অসুস্থ কবির শয্যাপার্শ্বে এসে দাঁড়ালেন বধূমাতা প্রতিমা দেবী । "বাঁদরটা বড্ড জ্বালাচ্ছে", বললেন কবি । বাঁদর ? এখানে আবার বাঁদর এলো কোথা থেকে ?-------এদিক-ওদিক তাকান প্রতিমা । "না, তা নয় । দেখছ না, বাঁ-দিকের দোর মানে দরজাটা দিয়ে রোদ্দুর এসে মুখে পড়ছে । বন্ধ করে দাও !!"
বা মংপুর আড্ডার আসরে হঠাৎ দু'-হাত তুলে কান চাপা দিয়ে কবির জিজ্ঞাসা, "এটা কোন্ পোষাক বল তো ?" পোষাক ? এখানে আবার নতুন কী পোষাক এলো ? কবি তো পরে আছেন এক বেনিয়ান ।" “বলতে পারলে না তো ?", কবির নির্বিকার ঘোষণা, "এ' হল চাপকান !" বোঝো !
বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারিক প্রভাতকুমারকে একদিন "ও হে বৈবাহিক, ও হে বৈবাহিক" বলেই ডেকে ফেলেন কবি । থতমত প্রভাতকুমার ! কবি কি তাঁকে "শালা" বললেন ? না, তা নয়, কবি প্রাঞ্জল করেন, "রোজ রোজ অত বই বয়ে বয়ে নিয়ে যাও কিনা, তাই ওই নাম !!" ভাবি, কোন্ মন্ত্রবলে এই সূর্যসম মানুষটির মনে নানা দু:খ-বেদনা-দায়িত্ব সত্ত্বেও এ' হেন সরসতা বজায় ছিল ?! হয়তো এই হাস্যরসটুকু বজায় ছিল বলেই কোনো দু:খ কোনো দায়িত্বই তাঁর কাছে অসহ বলে বোধ হয়নি । নইলে নিজেকে নিয়েও মানুষ অমন ঠাট্টা করতে পারে ? সাহিত্যিক বনফুল তাঁর শান্তিনিকেতন ভ্রমণকালে বৃদ্ধ কবিকে স্বাস্থ্যের কারণে অত ঝঁংউকে কঁংউজো হয়ে বসে না লিখতে অনুরোধ করলেন । কবির সপাট জবাব, "কঁংউজোর জল ফুরিয়ে এসেছে গো, কাৎ না করলে বেরোচ্ছে না !" ভাবা যায়, যে ইনিই ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ কবি ? শেক্সপিয়র বা গ্যেটেকে নিয়ে এমন কোনো গপ্প থাকলে ইংরেজ-জর্মানরা………..
স্বল্পমূল্যের পুস্তকখানি পাঠকের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করবে । গুণেন শীল-কৃত প্রচ্ছদখানি চমত্কার হয়েছে, সুন্দর পরিমিতিবোধের ছাপ রয়েছে ।
লেখিকার উত্তোরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি ॥
![]() |
সেদিন রাতে কি সাহিলের ঘুম হয়েছিল ? ভালো ? ফাহমিদার মত দু:স্বপ্ন দেখার বাতিক তো নেই তার । তবে ? তবে সেইদিনই কেন ভিখারিনির সাথে তার আলাপ ? আলাপ ? আলাপ কই ? সাক্ষাৎ ছাড়া আলাপ হয় নাকি ? কেন, মনে মনে আলাপ আলাপ নয় ? বিশেষ, সে যখন বেহুঁশ সাহিলের অধরে এঁকেছে এক চুরি-চুম্বন ! আর তাই না সারা আখ্যানের গা বেয়ে বেয়ে সাহিলের অশেষযাত্রা সেই সুন্দরীশ্রেষ্ঠা ভিখারিনির খোঁজে, উলিডুলি শাড়িতে যার বাঁধা থাকে এক হীরক খণ্ড !
এই দুই নারীর মাঝে সেতু বেঁধে আছে আকর্ষণীয়া শ্যালিকা জাসমিন । পৃথুলা স্ত্রী ফাহমিদা তো চায়ই যে সাহিল জাসমিনকে নিকাহ্ করে সুখী হোক্ । কিন্তু ফকিরপাড়ার কিরে যে আস্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে কোটিপতি ধনী সাহিলসাহেবকে : এক স্ত্রী তে খুশ্ থাকতে হবে, দ্বিতীয়া বিবি নৈব নৈব চ । স্খলনের ক্ষমা নেই । তাহলেই সেই ফকিরসাহেবের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হবে ও সৌভাগ্য থেকে পতন ! এ' এক অদ্ভুত জড়ান !
সাহিল কি সত্যিই সৌভাগ্যের আকাঙ্খী, না ভীরু, না আদতে এক প্রেমিক ? নইলে সে কোটি টাকার ব্যবসা ফেলে রেখে কেন রোজ রোজ নদী পেরিয়ে ছুটে চলে যায় রিজি ভিখারিনির সন্ধানে, দৈন্যই যার অহঙ্কার ? আর আভিজাত্য ? কেন, মনুষ্যত্ব কি নেই রিজির ?! ফকির বিদ্রোহের সেই ঐতিহাসিক চরিত্রের বংশজ যে সে ! "ফকিরের অভাব থাকে, কিন্তু অভাববোধ থাকে না ।" তাই রিজি-ভিখারিনি সমাজের কাছ থেকে লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছে তার দেহের রূপ, প্রকাশ থাক দেহাতীত রূপ ।
সাহিলসাহেব কিন্তু খুব দূরে থাকেন না, থাকেন আমাদের ঘরের কাছেই বাগনানে (এই বাগনান অবশ্য হাওড়া জেলায় না হয়ে পেনসিলভেনিয়ার এক মহল্লাও হতে পারত বা বাভেরিয়ার পাহাড়ে কোনে একগ্রাম) । এইটুকু দূরত্বও `দূর' যাঁর কাছে, তিনি নিজবক্ষে করতল রেখে `সাহিল'-কে অনুভব করে নিতে পারেন । সাহিল মানে যে `নেতা' । আমাদের সকলের মধ্যেই একজন নেতা রয়েছেন, যে-নেতা আমাদের চালিয়ে নিয়ে যান । সত্যদ্রষ্টা কবি সেই কবে বলে গেছেন, "অর্থ" "কীর্তি" "স্বচ্ছলতা" কিস্যু নয় । তবে ? তবে "কী" "কিছু" ? সেই উত্তর ঢঁংউড়তেই না আফসার আমেদসাহেবের লেখা এই কাহিনিখানি পড়তে পড়তে শেষ পৃষ্ঠায় চলে গিয়েছিলুম । আফসারের "বিধি ও কিস্সা" সিরিজের উপন্যাসগুলি বারেবার মুগ্ধ করেছে, করে চলেছে, কিন্তু এই হিরে ও ভিখারিনি সুন্দরী রমণী কিস্সা সকলকে ছাপিয়ে গেছে । কী, "দ এলকেমিস্ট" মনে পড়ছে ? এ'কাহিনি পাওলো সেলো লিখলে ওয়ার্ল্ডে বেস্ট সেলার হত ।
হায়, মোরা ভেতো বাঙালি মাত্র !
সারা আখ্যান জুড়ে কানের কাছে অদ্ভুত এক মায়াপালক বুলিয়ে গেছেন আফসার । এখানে সেই অষ্টাদশ শতকের ফকির বিদ্রোহের নায়কের অশ্বক্ষুরধ্বনির ফাঁকে ফাঁকে টুং টাং মোবাইল ফোন বেজে উঠে জানান দেয়, ওটা নয়, এটাই বাস্তব । বারে বারে প্রচ্ছদের ভিখারিনির চিত্রটি দেখে নিই, না, বাস্তবেই আছি । এ'হেন জুত্সই প্রচ্ছদ বেশি চোখে পড়ে না (হ্যাট্স্ অফ্, দেবাশিস) । কিন্তু বহু বানান ভুল বড্ড পীড়া দিয়েছে । তৃতীয়ে শুরু হয়ে দ্বিতীয় প্রচ্ছদে "লেখক-পরিচিতি" চলে গিয়ে ধন্ধ বাড়িয়েছে ।
কিন্তু না, সমালোচনা আর নয় । বহুদিন বাংলায় এরকম চমত্কার নোতুন গল্প পড়িনি ("উপন্যাস" বললুম না )। রূপকধর্মী উপন্যাস বাংলায় আদৌ লেখা হয়েছে কি ? হলেও বেশি নয় । এ'খানি পাক্কা ঠাঁই নেবে, সন্দেহ নেই । সালাম জানাই ।
![]() |
তিনি জন্ম নিয়েছিলেন বাঙলার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের ঘরে-------বিষ্ণুপুর ! রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদের তালিম ছিল বিষ্ণুপুরের রাধিকা গোঁসাইয়ের কাছে । লেখকের পিতা সত্যকিঙ্কর কোনোদিন গলায় বিষ্ণুপুর ছাড়া আর কিছু তোলেননি, এতই নিবেদিতপ্রাণ । দাদু গোপেশ্বর যখন বিষ্ণুপুরের রাজসভায় গাইতে ডাক পেলেন বয়স তাঁর দেড়কুড়িও পুরোয়নি । বিশের দশকে প্রিন্স এডওয়ার্ড যখন ভারত-ভ্রমণে এলেন তাঁকে ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত করাতে যাঁদের ডাক পড়েছিল গোপেশ্বর-সত্যকিঙ্কর তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন । অমিয়রঞ্জন কিন্তু অবাধে "ঘর" থেকে "ঘর"-এ' বিচরণ করে গেছেন-------গোয়ালিয়রের নারায়ণ রাও ব্যাস থেকে বাংলার তারাপদ চক্রবর্তীতে আনন্দ পেয়েছেন, তা ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন ছাত্রকুলে ।
আসলে, "বড় ঘর"-এর ছেলে কিনা, অমিয়রঞ্জনের `কান'-টা তাই তৈরি হয়ে ছিল ছোটবেলা থেকেই । নইলে গোঁড়া পিতার শিষ্য হয়েও বিশবছর বয়সেই তাঁর অনুভব হয়, যে "বিষ্ণুপুরের গানের ঢঙ এ'যুগে সাড়া জাগাতে পারে না ।" ভাগ্যিস এ' অনুভূতি হয়েছিল, তাই না আমরা এই মধুমক্ষীসম রসগ্রাহী সঙ্গীতজ্ঞ ও আচার্যকে পেয়েছি । আর পেলাম এই পেলব আত্মজীবনীখানি ।
করিম খাঁ সাহেবের ছেলেবেলা কেমন ছিল ? ওঁকারনাথ বা কেসরবাঈ কি ছেলেবেলা স্কুলে পড়াশুনো করতেন ? না, এ'সব আর আজ আমাদের জানবার উপায় নেই । কিন্তু বাংলার শ্রেষ্ঠ (বস্তুত:, একমাত্র) সঙ্গীত ঘরানার ছেলেমেয়েরা কী ভাবে বড় হত, তাদের জীবনে সঙ্গীতশিক্ষা ও চিরাচরিত স্কুল-কলেজের পাঠ কী ভাবে জড়িয়ে থাকত-------সে-সবের হদিশ পাওয়া যাবে অমিয়বাবুর এ' সহজ কথনে । শুধু এ-ই নয়, হিটলারের পোল্যাণ্ড আক্রমণ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল-------তা-ও এই আদ্যন্ত সাঙ্গীতিক পরিবারকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়-------সে হদিশ রয়েছে । তাই বড় সুখপাঠ্য, বড় সরল, অনায়াস অমিয়রঞ্জনের এই আত্মকথন খানি : লালাবাবুর অল ইণ্ডিয়া সঙ্গীত সম্মেলন থেকে, সেকালের ধুতি পরার ধাঁচ থেকে, `ডিরেক্ট একশন ডে' থেকে, কাননবালা ও বন্ধু নচিকেতা ঘোষ-------কে আসেননি এই আত্মকথায় ? মহা মহা হস্তী ভীষ্মদেব-কুমার গন্ধর্ব-গোলাম আলি তো আছেনই, বিস্মৃতপ্রায় পাখোয়াজি/তবলিয়া দুর্লভ ভট্টাচার্য-সুবোধ নন্দীদের প্রসঙ্গ ও ছবি মন কাড়ে । চল্লিশের মধ্যপাদে বুড়ো দুর্লভচন্দ্র কীভাবে মশ্হুর বেনারসী-ধ্রুপদী শিবা-পশুপতি মিশ্র ভাইদের গুমর ভেঙে কলকাতার মান রেখেছিলেন-------সে-গল্প অতি উপাদেয় ।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতপ্রধান অমিয়রঞ্জনকে তো আমরা এক সঙ্গীতশাস্ত্রী ও আচার্য বলেই জানি । তাঁর যুবাকালের এক অসমাপ্ত প্রেমকাহিনি উনি বলতে গিয়েও শেষমেষ রুখে গেছেন, ও সে-সামাজিক সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকারও করে নিয়েছেন । নিপাট ভদ্রমানুষ কিনা । পাঠকরা বঞ্চিত হলেন এক সুখপাঠ থেকে । এমন কিছুই হয়ত ছিল না । সেই মেয়েটিও কি আজ এই কাহিনি পড়ছে ?
হিংসে তো হবেই-------কত কত মহাজনকে শুনেছেন অমিয়রঞ্জন-------য়ুনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে ফৈয়াজ খাঁ সাহেব থেকে জ্ঞানপ্রকাশজীর উঠোনে আমীর খাঁ সাহেব পর্যন্ত । বড় অনায়াস সে-সব বর্ণনা-------ব্যাকরণের কচকচি নেই । ছিমছাম । বইটির মতই নির্মেদ, সুঠাম । মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি-------"সুবর্ণরেখা"-র কাজ কিনা । জুতসই বাঁধাই । মানানসই প্রচ্ছদ ।
অমিয়রঞ্জনের মত গুণী মানুষকে ক'জন চেনেন ? কেন এ' গোত্রের শিক্ষকগণ তেমন `নাম' করতে পারেন না ? এ'-বিতর্ক সহজে শেষ হবার নয় । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে "নাম" অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, "কাজ" থেকে যায় । অমিয়রঞ্জনের ক্ষেত্রেও থেকে গেছে, ওঁনার হাজারো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে দিয়ে । তিনটে প্রজন্মকে সঙ্গীতশিক্ষা দিয়ে গেছেন অমিয়রঞ্জন । থেকে যায় সেই সুখস্মৃতিই । নীর ভরে নিয়ে উনি চলে গেছেন, লিখেছেন ; কিন্তু না, নিয়ে চলে তিনি যাননি । সে-আনন্দবারি ছিটিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের মধ্যে । আর তাঁর যুবাবয়সের সেই কন্দর্পসম রূপ !! সেই মেয়েটিকে দোষ দেওয়া যায় না ।
![]() |
পৌনে শ' বছর পূর্বের কোনো আন্তর্জাতিক ত্রক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসর । হোক্ না সে-এক ওলিম্পিক-------ওলিম্পিক তো প্রতি চার বছর বছর একবার হয়েই থাকে । সেই আসর নিয়ে লেখা হচ্ছে এক প্রায় চারশ' পৃষ্ঠার বই । আর কী সে বই ! রুদ্ধশ্বাসে, কোনো এক গোয়েন্দা কাহিনির গতিতে, তা পড়ে ফেলতে হয় । হবে না ? সে যে ১৯৩৬-র বার্লিন ওলিম্পিক গেমসের ইতিহাস, যার ঠিক পরের ওলিম্পিকের আসরটি বসতে চার নয় আট নয়, পাক্কা বারোটি বছর লেগেছিল (লণ্ডন, ১৯৪৮) । আর ১৯৮০-র মস্কো গেমসের আগে এ'হেন এক ওলিম্পিক বসার আগেই সারা বিশ্বে উত্তেজনার পারদ কখনও তুঙ্গে ওঠেনি । মানে, গেমস নিয়ে বয়কট-রাজনীতি '৮০-র ও চুয়াল্লিশ বছর আগে চুড়ান্ত করে দেখিয়েছিল নাত্সিরা । আর তাই আজও এ'নিয়ে এক প্রমুখ ইতিহাস লেখার সুযোগ রয়ে গেছে ।
১৯৩৩-এ সামান্য বহুমত পেয়ে ভাগ্যবলে ক্ষমতায় এসে গিয়ে থেকে হিটলারের নাত্সি দল একদিকে যেমন তাদের কদর্য সংখ্যালঘু নীতি এগিয়ে নিয়ে গেছে (উদা: নুরেমবার্গ কোড, ১৯৩৫) তেমনি বিশ্বকে ন্যাশনাল সোশালিজমের চাকচিক্য দেখাতে তাদের এক মঞ্চের দরকার হয়ে পড়েছিল । হিটলার ও গোয়েবলস প্রথমে ওলিম্পিক গেমসকে আদৌ পাত্তা না দিলেও ("ও'তো ইহুদি ও ফ্রি-ম্যাসনদের এক তামাশা") পরে তারা এর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বুঝতে পারে । তখন উদগাতা কুবার্তোঁ কে "কিছু খরচপাতি করে"-ও স্বপক্ষে টানতে এদের বাধেনি । তার পরেরটুকু তো ইতিহাস ! "দ গ্রেটেস্ট শো অন দ আর্থ" । আর তাই তো এই ইতিহাস লেখার প্রয়োজন পড়েছে ।
থার্ড রাইখের এক আকর গ্রন্থ
The Rise & Fall of Third Reich -এ শাইরার স্বল্পকথায় ১৯৩৬-ওলিম্পিকের বর্ণনা সেরেছেন । তাঁর লক্ষ্য বৃহত্তর ছিল কিনা । এ’থেকেই আগে বেড়ে গাই ওয়াল্টার্স লিখেছেন এই অসাধারণ ত্রক্রীড়া-ইতিহাস । ত্রক্রীড়া ইতিহাস কী ভাবে লিখতে হয়, কত গবেষণা, কত পরিশ্রম কত অনুসন্ধিত্সা লাগে একে এক শিল্পের স্তরে উন্নীত করতে-------তার এক উদাহরণ বর্তমান বইখানি । তাঁর সে-অভিজ্ঞতার কথা ওয়াল্টার্স লিখেওছেন শেষের এক অধ্যায়ে ।বার্লিন ওলিম্পিক তো জেসি ওয়েন্সের ওলিম্পিক বলেই প্রসিদ্ধ-------যেখানে সেই কালো মানিক নাত্সি
superior race -এর তত্ত্বের নাকে ঝামা ঘষে চার-চার টি সোনা জেতেন । এ'গ্রন্থে ওয়েন্সের বাল্য থেকে শুরু করে "ওয়েন্স" হয়ে ওঠার কাহিনি চমত্কার বিধৃত রয়েছে । রয়েছে রূপোজয়ী জার্মান লুজ লঙ-এর কথাও, যাঁর টিপ্সেই ওয়েন্স লং জাম্পের সোনাটি জেতেন । লুজকে তাই সর্বকালের সেরা স্পোর্টস্-ম্যানের শিরোপা দেওয়া হয় । না, সব জার্মানই হিটলার-হিমলার ছিলেন না, লুজ-সিলেনবাইণ্ডাররাও ছিলেন । উঠে এসেছে সেই ইহুদি ফেন্সার হেলেন মেয়ারের কথা, ভিক্ট্রি স্ট্যাণ্ডে যার নাত্সি স্যালুট আজও ইহুদিগণ বেইমানির এক চূড়ান্ত নিদর্শন বলে মনে করেন । আর আছে ১৫০০ মিটারের সেই ফাইনাল দৌড়ের কাহিনি, যাকে "শতাব্দীর স্বপ্নের দৌড়" আখ্যা দেওয়া হয় (যেখানে এক নয় দুই নয় প্রথম পাঁচজনই বিশ্ব/ওলিম্পিক রেকর্ড ভাঙেন) । জয়ী কিউয়ি কিংবদন্তী ডা: লাভলকের মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মর্মান্তিক মৃত্যুর উপাখ্যান (অধ্যায় : ১২) চোখ ভেজায় । বস্তুত:, শেষের দিকে এই দ্বাদশ অধ্যায়টি অসাধারণ, যেখানে বিশ-তিরিশ-চল্লিশ বছর পরের সে-গেমসের নায়কদের শেষ জীবনের গল্প বলা হয়েছে !পরিশিষ্টে এক "ফাইনাল মেডেল ট্যালি" দেওয়া নেই দেখে হতাশ হয়েছি, যদিও প্রথম জার্মানি দ্বিতীয় ইউ এস এ বলে আলোচনা করা হয়েছে । আমেরিকান টিমের ম্যানেজার আভেরি ব্রাণ্ডেজের প্রতি লেখক একটু বেশিই কড়া হয়ে পড়েছেন, যদিও তার কারণও কম ছিল না । তখনও বৃটিশ শাসনাধীন থাকলেও "ভারত" নিজ নামেই বার্লিনে অংশ নেয় ও ধ্যানচাঁদের নেতৃত্বে সোনা জেতে । ভারতীয় হকি-যাদুকরদের মুন্সীয়ানা যথেষ্ট ইজ্জত দিয়েই লিখেছেন ওয়াল্টার্স । প্রকাশক জন মারে -------প্রথম প্রকাশের পর থেকে এতাবৎ বেশ কয়েকবারই এ' বইয়ের প্রচ্ছদ বদলেছে । বর্তমানখানিই সবচেয়ে নিরেস হয়েছে । বেশ কয়েকটি মুদ্রণপ্রমাদও চোখে পড়ল ।
যাই হোক্ ত্রক্রীড়া ও ইতিহাসপ্রেমীর বুকশেল্ফে
Guy Walters -এর Berlin Games: How Hitler stole the Olympic Dream সসম্মান ঠাঁই পাবে । তবু বইখানি ২০০৬-এর William Hill Sports Book of the Year পুরস্কারখানি জিততে জিততেও শেষপর্যন্ত জিততে পারলো না, এই আক্ষেপ । সে-বছর আবেবে বিকিলা ও জ্যাক জনসনের বই দু'খানিও দৌড়ে ছিল কিনা ।পুন: : কোনো পদক না জিতেও বার্লিন গেমসের আসল নায়ক ছিলেন জার্মান কম্যুনিস্ট মল্লবীর ওয়ার্নার সিলেনবাইণ্ডার,
SS -এর অকথ্য অত্যাচার সয়ে যাঁকে আক্ষরিক অর্থেই নাত্সি যূপকাষ্ঠে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় । প্রচ্ছদে তাই হিটলার-লিওয়াল্ডের নয়, সিলেনবাইণ্ডারের ছবি থাকলে সেই মহান আত্মার শান্তি মিলত ।(পরবাস-৪৭, জানুয়ারি, ২০১১)