• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৭ | জানুয়ারি ২০১১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • কূর্মাচলে ক-দিন : রাহুল মজুমদার

    ২০.১০.২০১০ রাত সাড়ে দশটা -

    চরকিবাজ চরকি মারতে ভালোবাসে, ঘোরার আনন্দে ঘোরে । সে না জানে ইতিহাস, না বোঝে ভূগোল; পুরাণ তো দূরের কথা ! তাই, কুমাঊঁ যে পুরাণের কূর্মাচল - মহাপ্লাবনের যুগে ভগবান বিষ্ণু কূর্মের (কচ্ছপের) রূপ ধারণ করে, নিজের পিঠে আশ্রয় দিয়ে জীবকূলকে রক্ষা করেছিলেন । সেই কূর্মাবতারের পিঠই কূর্মাচল, আজকের কুমাঊঁ - এখবর তার জানা নেই । জানা নেই কাত্যুরি রাজবংশ বা চাঁদরাজাদের কথা । শুধু সুন্দর জায়গা দেখার খুশিতে সস্ত্রীক ঢুকে বসেছে বাঘের পেটে । দুলকি চালে বাঘ চলেছে আমাদের নিয়ে কাঠগোদামের দিকে ।

    ২১.১০.১০ বেলা পাঁচটা -

    C1 থুড়ি সীওয়ান, নাকি See One ! স্টেশন পেরোতেই নদী নামক সোঁতা । তার এপারে মা দুগ্গা শ-খানেক ভকত নিয়ে হাজির হয়েছেন জলপথে হিমালয়ে শিবালয়ে ফিরবেন বলে । আর ও-পারে হাফ ডজন কবর ঘেঁষে ডজন দুয়েক রঙীন ফুলের মতো বাচ্চা অবাক চোখে মায়ের যাওয়া দেখছে ।

    ২২.১০.১০ সকাল ছ-টা দশ -

    ভোর হলো, চোখ খোলো, ধেড়েখোকা ওঠো রে - আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমা । আজ নৈনিতাল । আজ নয়নাদেবীর সরোবরতীরে রাত্রিবাস !

    সকাল দশটা চল্লিশ -

    অবশেষে কাঠগোদাম । রেললাইন পাহাড়ের গায়ে পৌঁছে থমকে গেছে । বাতাসে ঠাণ্ডার ছোঁয়া । বাঘের পেট থেকে মুক্তি । পবননন্দনে সওয়ার ।

    ঠিক দুক্কুরবেলা -

    নৈনিতাল, ৬৯৩০ ফুট । পুরাণে এর নাম নাকি ত্রিরিখি (ত্রিঋষি) সরোবর । অত্রি, পুলস্ত্য আর পুলহ ঋষি মানসসরোবর তীর্থযাত্রার পথে এখানে এসে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন । মানসসরোবরের অগাধ জলরাশির কথা স্মরণ করতেই সেই সরোবরের অংশে মুহূর্তে সৃষ্ট হয় সরোবর । তৃষ্ণা নিবারণ করেন ঋষিরা । দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর শিবের প্রলয়নাচনের সময় বিষ্ণুর চক্রে খণ্ডবিখণ্ড সতীর নয়ন দুটি এই সরোবরে পড়ে আর তার রং সবুজাভ নীল রংয়ের হয়ে যায় । সরোবরের নাম হয় নৈনিতাল ।

    বেলা বারোটা দশ -




    নৈনিতাল, হোটেল ওয়েলকাম পার্কের ব্যালকনি থেকে


    নৈনিতালকে বাঁয়ে রেখে তল্লিতালে ডাইনে মোচড় মেরে চড়চড়িয়ে চড়াই চড়ে ওয়েলকাম পার্কে পার্ক হলো গাড়ি । ঘরের ব্যালকনি থেকে দেখা যাচ্ছে নিচে তালের জলে ছোটো ছোটো নৌকোগুলো হাঁসের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে । দূরে ওপারে নৈনি দেবীর মন্দির; পাশে গুরদোয়ারা, মসজিদ, চার্চ - একেবারে সর্বধর্ম মহাসম্মেলন । লেককে ঘিরে সবুজ সোয়েটার পরা পাহাড়েরা আকাশে মাথা তুলেছে । মেঘের দল তালের জলে মুখ দেখছে । সব মিলিয়ে শান্ত জলরংয়ের ছবি ।

    প্রিপেড রিকশার শহরে

    দুপুর দুটো -




    নৈনিতাল মল রোড, কাফে ডিমল থেকে


    হোটেলের গাড়িতে মল রোড । লেকের ধার ঘেঁষে লোয়ার মল রোড - কয়েক ফুট উঁচুতে আপার মল রোড । স্বাধীনতার আগে নাকি ভারতীয়দের আপার মল রোডে পা রাখার অনুমতি ছিল না । ওটা ছিল খাঁটি সায়েবি রাস্তা । লোয়ার মল রোড তল্লিতাল থেকে মল্লিতাল, আর আপার মল রোড মল্লিতাল থেকে তল্লিতাল । এই জোড়া-মল রোড ধরে রিকশা চলে - সাইকেল রিকশা । তালের দুই প্রান্তে রিকশা স্ট্যাণ্ড, সেখানে প্রিপেড রিকশা বুথ । নৈনিতাল বোধহয় দুনিয়ার একমাত্র শহর, যেখানে রিকশার প্রিপেড বুথ আছে ।

    নেমে এলাম লেকের কিনারায় । সার বেঁধে সব বিহারের নৌকো, নৌকোবিহারের জন্য । কেউ শিকারা, কেউ হাস্যবদন ড্রাগন, কেউ রঙীন হাঁস, জলের বুকে ভাসছে । তাদের ঘিরে আসল রাজহাঁসের দল ঘুরঘুর করছে । চড়ে বসলাম এক শিকারায়, শুরু হলো নৌকাবিলাস । গহীন জলের বুকে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ । তল্লিতাল ছুঁয়ে নানান মন্দিরের দর্শন করতে করতে মাঝপথ থেকে মল্লিতালকে সেলাম জানিয়ে আবার তীরের বাছারা তীরে ।

    তিনটে বত্রিশ -




    তল্লিতাল


    রিকশাবাহিত হয়ে মল্লিতালে পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থের পদতলে । নৈনিতালকে দু-ধারে রক্ষা করছেন দুই মহান নেতা - মল্লিতালকে গোবিন্দবল্লভ, তল্লিতালে মহাত্মা গান্ধী । তল্লিতালে বাসস্ট্যাণ্ড হলেও ভিড় কম । মল্লিতালে গাড়ির ভিড়, মানুষের অরণ্য । তালের তীর ঘেঁষে মাছকে খাওয়ানোর হিড়িক আর মানবকুলের হুল্লোড় ।

    পৌনে ছ-টা -

    নৈনিতালে সপরিবারে ব্যোমকেশ `বক্শি দর্শন' সেরে রিকশাস্ট্যাণ্ডে ।

    ছ-টা দশ -

    লাইনে দাঁড়িয়ে প্রিপেড রিকশাবাহিত হয়ে হোটেলের গাড়ি - হোটেলের গাড়িতে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন ।

    `রাত' সাড়ে সাতটা -

    আলোর মালায় সেজে নৈনিতাল নৈনিতালে মুখ দেখছে । আকাশ থেকে মেঘের ফাঁকে পূর্ণচন্দ্র আর তারার দল সেই আলোর সাজ দেখছে । মাঝে মধ্যে বাজির আলো তারা হবার চেষ্টা চালাচ্ছে ।

    তালে তালে

    ২৩.১০.১০ সকাল সাতটা -

    নৈনিতাল সবে আড়মোড়া ভাঙছে । পাখিরা ওড়াউড়ি শুরু করেছে । বাচ্চারা স্কুলে যেতে শুরু করেছে । আরও ভোরে মসজিদের আজানের সুর ভাসছিল নৈনিতালের আকাশে । তারই আহ্বানে, নাকি নৈনি দেবীর মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শুনে জানি না, আকাশে ভিড় করেছে কালো মেঘেরা । পুব আকাশে অবশ্য তাদের দৌরাত্ম্য তেমন নেই । পূষণের পুণ্যকিরণের ছোঁয়া এখনও না পেলেও, তাঁর আলোকে উদ্ভাসিত চরাচর । পবনদেবের শীতল চামর ব্যজনের হাত থেকে বাঁচতে ব্যালকনি থেকে ঘরে প্রত্যাবর্তন । এখন বক্ষজুড়ে তৃষ্ণা - গরম চায়ের তরে ।

    সন্ধ্যা সাড়ে ছ-টা -




    ভীমতাল


    সান্ত্রোর সওয়ারি হয়ে দিনটা জব্বর কাটল । সকাল দশটায় বেরিয়ে আলোছায়ামাখা পথ বেয়ে ভোওয়ালি হয়ে প্রথমে ভীমতাল । নৈনিতালের থেকে শতগুণে নির্জন । শান্তির আনন্দ বিছিয়ে রয়েছে সর্বত্র । ভীমতালের পাড় ধরে পদচারণা, অবলোকন, চা-পান । সময় সমাপ্ত হলো অতি সত্বর । অতএব, চল মুসাফির বাঁধ গাঠরিয়া - এসে পড়লাম বজরংবলির পদতলে । হনুমানগঢ়ীতে ভীমকায় গেরুয়া মহাবলী হনুমান । একা হনুমানে রক্ষা নেই, বৈষ্ণোদেবী দোসর । হোক না নকল, তোর তাতে কী ? আমাদের চিরসঙ্গী প্রিয়সঙ্গী বসার টুল বাবাজীর বোধহয় ভক্তিভাব প্রবল; তাই আমাদের সঙ্গে না গিয়ে রয়ে গেল এখানেই ।




    নওকুচিয়াতাল, বোট থেকে


    আমরা এসে পড়লাম নওকুচিয়াতালে । যার নাকি ন-টা কোণা । নৌকাবিহারের সময় কোণা গোনায় নয় ছাড়িয়ে গেল । বনমাঝে ন-কোণা হীরা । ফিরতিপথে হনুমান-ভক্ত টুল উদ্ধার ।




    সাততাল


    এর পর সাততাল । আসলে কিন্তু ইনি একজনই - রামায়ণের মতো সপ্তকাণ্ড জুড়ে সম্পূর্ণ - রাম, সীতা, হনুমান, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন - আর সপ্তমজন - বিভীষণ, না রাবণ ? কে জানে ! ভিড়ে ভিড়াক্কার, মানুষের ধুন্ধুমার । কাঁই কাঁই করছে কাঁড়ি কাঁড়ি লোকজন, দোকানদার - যেন কিষ্কিন্ধ্যায় সুগ্রীবের বানরসেনা । মুগ্ধ হওয়ার কোনো উপায়ই নেই । বরং তার গা ঘেঁষা বিজন গরুড়তাল ভালো । ভালো ফেরার পথে পাখির চোখে দেখা খুরপাতালও । তবে খুরপা নাকি খুবখারাপ, দুষ্টু - ঘূর্ণির আখড়া !

    এর পর সারথি মোহিতের দৌলতে মোহিত হয়ে দেখলাম নির্জন চড়াইপথে গাড়ির নৈনিতালের টংয়ে চড়া । সে কী পথ ! পিলে চমকে দেয় । ঘাড় তুলে আর ঘাড় গুঁজড়ে গাড়ির গতায়াত । তবে, উপর থেকে দৃশ্যাবলী অপরূপ । নৈনিতাল যেন পাকা আমটি ! নৈনিতালের বিখ্যাত প্রাচীন সব বাড়িঘর, স্কুল কলেজ, গির্জার দূরবীন-দর্শন হলো ।

    শেষমেশ পূণ্যার্জন । নয়না দেবীর মন্দির দেখে নয়ন সার্থক হলো । ঢোকার মুখে এক ঘন্টা - যে আসছে, বাজিয়ে যাচ্ছে । আমরাও বাজালাম - ঢং ঢং । আমাদের ঢং দেখে হনুমানজী হতবাক ।

    তাঁকে ওই অবস্থায় ছেড়ে আমরা ফিরলাম হোটেলে ।

    রাত দশটা -

    ঘুম আয়, ঘুম আয়, আয় ঘুম .........

    কাল মুক্তেশ্বর ।

    (ক্রমশ:)



    (পরবাস ৪৭, জানুয়ারি, ২০১১)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments