• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৭ | জুন ২০১৭ | উপন্যাস
    Share
  • আয়নার ভিতরে : কৌশিক সেন


    ‘এইরকম বাজার আমার বেশ লাগে। অনেক মানুষের মধ্যে নিজের কথাটা একটু ভুলে থাকা যায়।’ রবিন কয়েকটা জামা কিনেছে। ওরা এখন দোকানের বাইরে একটা কফির দোকানের সামনে।

    ‘তুমি জাভেদের কথা আর আরেকটু বলো। হয়তো হালকা লাগবে।’ কফির কাপটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বিতান বললো।

    রবিন এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে যে বিতান খুব ভালো স্রোতা, চুপচাপ অথচ অভিনিবিষ্ট, কথা শোনার সময় বক্তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে থাকে, মুখের সামান্য পরিবর্তন দিয়েই বুঝিয়ে দেয় অনেক কিছু।

    ‘আমরা দুজনেই বলিউড ফিল্ম দেখতে যেতাম, ওখানেই আলাপ হয়েছিল। আমাদের বাড়ি বেশ গোঁড়া, ওদিকে জাভেদরা পুরো সেকুলার, নাস্তিক বললেও হয়। ওই নিয়ে আমাদের ঝগড়া হতো, আবার ওটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। জন্ম থেকে একটাই কথা নানাভাবে শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছি যে সবার আগে ভাল মুসলমান হতে হবে। নাইন ইলেভেনের পর বাইরে থেকে আমাদের চাপ বাড়ছিল, ভিতর থেকে আমরাও হয়ে উঠছিলাম তেমনই ডিফেন্সিভ, কেমন যেন একটা অদৃশ্য ট্রেঞ্চের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলাম সবাই। জাভেদের সঙ্গে ভাব হবার পর বুঝলাম এই লাগাতার অসহিষ্ণুতার একটা বিকল্প থাকতে পারে। খোলামেলা একটা পৃথিবী, যেখানে ওইরকম চোয়াল শক্ত, আস্তিন গুটানো মনোভাব ছাড়া যে যার নিজের মতন বাঁচা যায়। জানো এই হিজাব নিয়েই আমার সাথে ওর কত তর্কাতর্কি হয়েছে, ও নানা বইপত্র ঘেঁটে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে মাথা ঢাকা একটা আঞ্চলিক প্রথা ছাড়া কিছু নয়, মধ্যপ্রাচ্যে সব ধর্মের লোকেরাই মাথা ঢেকে রাখে। তবুও জন্ম থেকে যেসব নিয়মে অভ্যস্ত, চট করে সেগুলো ছেড়ে হিজাব পরা ছাড়বো, এয়ারপোর্টে আমায় দেখে ও অবাক হয়ে যাবে।’

    রবিন নিঃশব্দে কাঁদছে, বিতান খুব আলতো করে হাতটা রেখেছে ওর পিঠের ওপর এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে এল ওদের। মিমির গলা।

    ‘বাবা। ওই তো বাবা, রনি গেট আপ।’

    এক দৌড়ে বেঞ্চিটার কাছে পৌঁছে গেল ওরা। মিমি লোকজন ঠেলে সামনে একটা দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, পিছু পিছু রন। মিনিট পাঁচেক বাদে মিমি হতাশ মুখে বেরিয়ে এল, ওর চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্তের মতন এদিক ওদিক ঘুরছে। তিনজনে মিলে ওকে শান্ত করতে আরো কিছুটা সময় গেলো।

    আই স্যুয়ার দাদা, আমি বাবাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সাইড প্রোফাইল, কিন্তু ডেফিনেটলি ড্যাড, সঙ্গে একজন মহিলাও ছিলো, এই দোকানটার মধ্যে ঢুকে গেল দুজনে। হয়ত দোকানের মধ্য দিয়ে উলটোদিকের প্যাসেজে চলে গেছে, এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না।’

    ‘তোর মাথা খারাপ হয়েছে মিমি। বাবা এখানে আসবে কেমন করে। আর আসলেও এয়ারলাইন আমাদের খবর দেবে না, বাকি সবাই জানতে পারবে না, এমন হয় নাকি? তুই ভুল দেখেছিস।'

    ‘কিন্তু আমি যে স্পষ্ট দেখলাম। রনি তুমি দেখোনি?’ মিমির গলাটা অসহায়।

    ‘আমি ঠিক বুঝতে পারিনি জানো। আমি বোধহয় অন্যদিকে তাকিয়েছিলাম, তাছাড়া তোমার বাবাকে আমি তো অত ভালো চিনি না যে এই ভিড়ের মধ্যে--’ রন আমতা আমতা করছে।

    ‘দাদা আমি বুঝতে পারছি এটা অসম্ভব তাও চলো আমরা একটু খুঁজে দেখি।’ মিমি এখনও চারদিকে তাকাচ্ছে। ওকে শান্ত করতেই ওরা খানিক খুঁজলো এদিক ওদিকে। বিভাসের নাম ধরে ডাকা হল কয়েকবার। তারপর মিমিও আস্তে আস্তে মেনে নিল যে ও ভুল দেখেছে। উত্তেজনা নেমে গিয়ে ওর মুখে ফুটে উঠলো একটা অস্বস্তি মেশানো ক্লান্তির ছাপ।

    ‘মিমি চলো আমরা বাড়ি যাই। আমারো দু একবার মনে হয়েছে আমি জাভেদের গলার আওয়াজ পাচ্ছি। এটা বোধ হয় হ্যালুসিনেশন, আমাদের মাথার ভেতর চিন্তাভাবনাগুলোই এর জন্য দায়ী।’ রবিন এসে ওর হাত ধরেছে এবার।

    নিউমার্কেটের চারদিকে এখন একটা অস্পষ্ট ধোঁয়াশা। রনের মনে পড়ে গেল এখানে আসার আগে কলকাতা নিয়ে একটা গুগল রিসার্চ করেছিল। কিপলিঙের সেই অদ্ভুত কবিতাটার লাইনগুলো মনে আসছে--অ্যাবাভ দি প্যাকড অ্যান্ড পেস্টিলেনশিয়াল টাউন। ডেথ লুকড ডাউন। সত্যি ভূত বলে কিছু থাকলে এই শহরেই আছে। মানুষের ভিড়ে লুকিয়ে থাকতে তাদের একটুও অসুবিধা হবে না।

    পরের দিন দুপুরে লাঞ্চের পর ওরা চারজনে বেশ ঘন ঘন বসে মুম্বাই যাবার প্ল্যান করছে। আন্দামান সী তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছুই পাওয়া যায়নি। এয়ারলাইনের সঙ্গে কথাবার্তা হয়ে গেছে, জাভেদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে ওদের। রবিনরা চেয়েছিল ক্ষতিপূরণের পুরো টাকাটাই ওদের কাছে যাক, বিতান ওকে বুঝিয়েসুঝিয়ে সেটার আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। দুদিনের মধ্যে এই বিদেশি ছেলেমেয়েদুটোর ওপরে কী যে মায়া পড়ে গেছে ওঁর।

    ‘শোনো রবিন, টাকাটা নিতে যে তোমার কুন্ঠা হচ্ছে এটা খুবই স্বাভাবিক। ও চলে যাবার পর লাইফ ইনসিওরেন্সের টাকাটা যখন এলো, আমার একবার মনে হয়েছিল ওটা রামকৃষ্ণ মিশনে দান করে দিই। বিরাট অঙ্কের টাকা, মনে হয়েছিল যেন ওর জীবনের বদলে আমি বড়লোক হচ্ছি। এখন জানি টাকাটা আমি যেভাবে ব্যবহার করেছি ও থাকলে ওর চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হতো না।’ মিঠু নরম গলায় বললেন।

    ‘থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি। আমার সৌভাগ্য যে সেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছিল বিতান। আমি যেন একটা দুঃস্বপ্নের চোরাবালির মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম তোমরা আমাকে টেনে তুলছো। এখন মনে হচ্ছে ঝড়টা থেমে গেছে, আমি এবার ভাঙা টুকরোগুলোকে কুড়িয়ে নিতে পারি।'

    ‘আমরা সবাই আমাদের জীবনের টুকরোগুলোকে কুড়িয়ে নেবো রবিন। সবাইকে আবার সামনের দিকে তাকাতে হবে। দুর্ঘটনা আমাদের জীবনের সংজ্ঞা হবে না, আমরা নিজেরাই সেই সংজ্ঞাটা তৈরি করবো।’ রনি আর বিতান কোনো কথা বলেনি কিন্তু মিঠু চৌধুরি তাঁর অভিজ্ঞ চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ওদের চোখের মধ্যে হতাশার মেঘ ফুটিয়ে উঁকি মারছে যৌবনের আশাবাদী রোদ্দুর।

    ********

    সান হোসে শহরে নভেম্বর খুব সুন্দর একটা মাস। পাকা কমলালেবু আর আঙুর বাগিচার গন্ধ মেশানো বাতাস, পাহাড়ের ওপর শিরশিরে কুয়াশা, আবার কিছু মাইল দূরেই বেলাভূমির ওপর ঝকঝকে রোদ্দুর। কিছুটা উত্তরদিকে ছবির মতো সুন্দর শহর সানফ্রান্সিসকো, সমুদ্রটা সেখানে যেন মাতালের মতন জোর করে পাহাড়গুলোকে ঠেলে সরিয়ে উপকূলের বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, তারপর আর ফেরৎ যেতে পারেনি। সেখানে তৈরি হয়েছে এক জোড়া উপসাগর, তাদের নাম সানফ্রান্সিসকো আর সান পাবলো বে। এই সান পাবলো বে’র চারপাশটার বোধকরি সমুদ্রের মাতলামির জন্যই হবে, পাহাড়ের ঢালে ফাটাফাটি আঙুরের চাষ হয়, সে তল্লাটের নাম ন্যাপা ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত ওয়াইন উপত্যকা। সান হোসে থেকে অনেকগুলো হাইওয়ে শহর থেকে উত্তরদিকে উপসাগরের দুপাশ দিয়ে ন্যাপা ভ্যালির দিকে চলে গেছে, সপ্তাহান্তে তল্লাটের রসিক জনেরা সেখানে ভিড় করেন। বে এলাকা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের মক্কা, এখানকার কোম্পানিগুলো মিটিং করার জন্য প্রায়ই সেসব আঙুর বাগিচা এবং ওয়াইন চোলাইয়ের আড্ডায় হাজির হন। ইচ্ছে হলে একটা ছিমছাম টয় ট্রেনে চেপে ছুঁয়ে আসা যায় সবকটা ওয়াইনারি, যেখানে মনোরম পরিবেশ আর টাটকা রোদ বাতাসের সঙ্গে হরেক কিসিমের ওয়াইন চেখে দেখার ব্যবস্থা আছে। যদিও চাখার জন্য গেলাসে অল্প করে ঢালাই দস্তুর, তবে ওইভাবে কয়েক ডজন চাখাচাখির পরে বেহেড মাতাল হওয়া খুব একটা শক্ত কাজ নয়।

    এই ন্যাপা ভ্যালির মধ্যে আছে দ্বাদশ শতাব্দীর এক স্প্যানিশ দূর্গ, তার নাম কাস্টিলো ডি অ্যামরোসা। দ্বাদশ শতাব্দীতে যদিও এই এলাকায় জঙ্গল আর বুনো জন্তু ছাড়া কিছু ছিলো না, কিছু রেড ইন্ডিয়ান শিকারীর দেখা মিললেও মিলতে পারতো। হাল আমলের এক কোটিপতি ওয়াইনরসিক স্পেন দেশ থেকে আদত মালমশলা আনিয়ে হুবহু এক মধ্যযুগীয় দূর্গ বানিয়ে ফেলেছেন। সেখানে স্পেনীয় ঘরানার ওয়াইন চোলাই হয়। আজ সকালে লিপিকা আর অভিরাজ সেই দূর্গের অতিথি হতে চলেছেন ওখানে। আজ থেকে ওঁদের কোম্পানির রিট্রিট শুরু হবে, চলবে পুরো উইকএন্ড জুড়ে। আসবো না, আসবো না করেও শেষ অবধি রাজি হয়েছেন লিপিকা। এখন ওরা হাইওয়ের ওপরে, অভিরাজ ড্রাইভ করছেন, বাইরে ছুটির আমেজ মাখা চমৎকার একটা দিন।

    ‘তুমি এতো চিন্তা করছো কেন? ওরা তো দুদিন বাদেই ফিরে আসবে।’

    লিপিকা অন্যমনস্কভাবে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন। হাইওয়ের ওপর সুশৃঙ্খল গতিশীলতা, প্রতিটি গাড়ি নিখুঁতভাবে ছুটে চলেছে অথচ কি ঠুনকো এই সুস্থিতি। এই মুহূর্তে যদি সামনের ট্রাকটা বেমক্কা লেন বদলায়, বাঁদিকে পোর্সা কনভার্টিবল গাড়িটা সোজা ওর পিছনে ধাক্কা মারবে। লিপিকা দেখে নিয়েছেন ওই গাড়িতে রয়েছে সোনালি চুলের এক তরুণী আর তার নওজোয়ান প্রেমিক। গাড়ি চালানোর মধ্যেই ওদের হাত আর চোখ পরস্পরের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। ওরা অসতর্ক তাই সামলাতে পারবে না, প্রচণ্ড আঘাতে খান খান হয়ে ভেঙে যাবে উইন্ডশিলড, স্টিয়ারিঙের ওপরে থেঁতলে যাবে সুন্দর মুখ। সেই মুহূর্তে পিছনের গাড়িগুলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জড়িয়ে যাবে, বাতাসে উঠবে আর্তনাদ, বাচ্চাদের কান্না। তারপর সব গাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে, সাইরেন বাজিয়ে ছুটে আসবে পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স। শিশির মাখানো সকালবেলাটা এক লহমায় নরক হয়ে উঠবে।

    ‘লিপি কি ভাবছো?’

    ‘না কিছু না। আচ্ছা অভি দুর্ঘটনা তো যে কোনো সময়েই ঘটতে পারে, কিন্তু সাধারণত: ঘটে না। আবার কখনো কখনো পর পর অনেকগুলো ঘটে যায়। তাই না?’

    ‘ঠিক। লাস ভেগাসের স্লট মেশিনও ওই একই নিয়মে চলে। কিন্তু তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো বলো দেখি।’

    ‘কিছু না। তোমার বাঁদিকে ওই কাপলটাকে দেখো কেমন রেকলেসলি গাড়ি চালাচ্ছে। সীট বেলট লাগিয়েছে কিনা কে জানে। সিলিকন ভ্যালির এই হঠাৎ নবাবদের দেখলে গা জ্বালা করে আমার। স্পোর্টস-কার আর ব্লন্ড নিয়ে বাবু ফুর্তি করতে বেরিয়েছেন।’ লিপিকা বেশ রেগেই গেছেন।

    ‘আহা অল্পবয়েসে ওরকম আমরাও করেছি। চিন্তা কোরো না, ওরা দিব্যি থাকবে। তোমার পুত্রকন্যারা তো কলকাতার পাট চুকিয়ে বম্বে গেল। খুব আপসেট না কি?’ কথাবার্তা ঘোরাতে চেষ্টা করলেন অভিরাজ।

    ‘এটা তো জানাই ছিল যে কিছুই পাওয়া যাবে না। শুধু শুধু এতটা ঘোরাঘুরি করলো। এখন আবার ওই মেয়েটার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। পাকিস্তানি মেয়ে, রাবিয়া না কি যেন নাম। ওর হাজব্যান্ড ছিল মুম্বাইয়ের লোক, ওরা সবাই এখন খুঁজে খুঁজে ছেলেটির বাড়িতে যাবে, তার বাবা মা’র সঙ্গে দেখা করতে। ব্যাপারটা ভেবে দেখো একবার।’

    ‘হার্টব্রেকিং।’ অভিরাজ আর কিছু বলতে পারলেন না। পুরো রাস্তাটা আর বিশেষ কিছু কথাবার্তা হলো না ওদের। প্লেনটা খুব সম্ভবত: ভারত মহাসাগরে ভেঙে পড়েছে, জলের তলায় রেকেজ হয়তো আছে কিন্তু জায়গাটা এত গভীর যে তার হদিশ পাওয়া খুবই কঠিন। প্লেনটা হয়তো জলে পড়ার আগেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছিল তাই যাত্রীদের কারো বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মোটামুটি শূন্য। এয়ারলাইন নিজেদের দায়িত্ব স্বীকার করে সবরকম ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে, দেশবিদেশ থেকে যেসব দলগুলো সরেজমিনে তদন্ত করতে ওদিকে গেছিল, তারাও একে একে ফেরৎ আসছে। কদিন বাদেই এটা বাসি খবর হয়ে যাবে।

    ওরা যখন কাস্টিলো ডি অ্যামরোসার পাথরবাঁধানো চত্বর বা গ্র্যান্ড কোর্টইয়ার্ডে পৌঁছলেন তখন দুপুর হয়ে গেছে। বিরাট রিট্রিট, এবছর কোম্পানির ভালো লাভ হয়েছে ম্যানেজমেন্ট তাই উপুড়হস্ত। চারদিকে নানারকম মজা আর ফুর্তির আয়োজন, সাদা, লাল, গোলাপি, সবরকম ওয়াইনের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। অভিরাজ এখন বেশ কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকবেন, কোম্পানির ওপরমহলে ওঁর দহরম মহরম। লিপিকা একে ওকে হাই বলতে বলতে টানা পুলের ওপর দিয়ে বাগানে চলে এলেন। ভিড় ভালো লাগছে না এখন, ওয়াইনটাও যেমন মিষ্টি তেমনি ওষুধ ওষুধ গন্ধ। ছোটবেলা কাশি হলে বৈকুণ্ঠ কম্পাউন্ডার এইরকম একটা সিরাপ বানিয়ে দিত, সেটাই এখন সত্তর ডলার দিয়ে কিনছে সবাই। এই পৃথিবীতে কেউ কেউ মদ চোলাই করার জন্য একটা আস্ত ক্যাসল স্পেন থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় তুলে আনতে পারে, অথচ এখানে প্রতিদিন হাজার রকমের অভাব অভিযোগ নিয়ে হাবুডুবু খায় অসংখ্য লোক। কোথাও মরুভূমির মধ্যে গঙ্গামাটি ফেলে সবুজ ঘাসের গলফ কোর্স বানানো হচ্ছে, কিন্তু সে দেশের কাছাকাছিই চলছে গৃহযুদ্ধ সেখানে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ষাট মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এমন আজব দুনিয়ায় অশান্তি হবে না তো কোথায় হবে?

    এখান থেকে নীল আর সবুজ আকাশরেখায় হলুদ পাথরের দূর্গটা বেশ দেখায় কিন্তু। একটা আরামদায়ক কাঠের বেঞ্চিতে বসে রোদ ঝলসানো বুরুজগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন লিপিকা। গত সপ্তাহটা সত্যিই অভূতপূর্ব, জীবনে কোনদিন এতখানি সময় উনি একলা নিজের সঙ্গে কাটাননি। গত দুদিন ধরে ফোনও ধরেননি, ফোনটাকে সাইলেন্ট করে টেবিলে রেখে দিয়েছিলেন, ছেলেমেয়েরা টেক্সট করে যোগাযোগ করেছে। লোকের সঙ্গে কথা বলতে প্রায় অ্যালার্জি হয়ে গেছিল লিপিকার, সেই এক কথার পুনরাবৃত্তি আর তোতাপাখির মতন দুঃখপ্রকাশ আর কতদিন সহ্য করা যায়। লিপিকা টের পেয়েছেন যে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার মধ্যে একটা অদ্ভুত নিরাময়ী ক্ষমতা রয়েছে, সাধুসন্ন্যাসীরা বোধহয় ওইটারই খোঁজে থাকেন।

    আচ্ছা প্লেনটা যখন পড়ে যাচ্ছিল বিভাস কি ভয় পেয়েছিল খুব? বিভাসকে ভয় পেতে বা নার্ভাস হতে কোনদিন দেখেননি লিপিকা। সকলে বলতো ওর নার্ভগুলো লোহা দিয়ে তৈরি, রাতের পর রাত জেগে কাজ করতে পারত, মাথা আর হাত কোনোটাই এক ফোঁটা ক্লান্ত হতো না। আট হাজার স্কোয়্যার ফুট জোড়া অখন্ড একাকীত্বের মধ্যে সেই রেসিডেনসির দিনগুলোয় আর ব্যস্ততায় ভরা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাচ্ছিলেন লিপিকা।

    ‘কি সুন্দর দিনটা তাই না ম্যাডাম?’

    সামনে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে সে নিঃসন্দেহে ওঁদের আফিস পার্টির কেউ নয়। ঝুঁটি বাঁধা চুল, পরনে একটা তাপ্পি লাগানো জ্যাকেট আর জিনস, পিঠে বাঁধা গীটার, দাড়িওয়ালা মুখে একগাল হাসি, মূর্তিমান সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ার হিপস্টার।

    ‘বিরক্ত করার জন্য মাপ চাইছি, আমি জনাথন, ফোক সিঙ্গার, সং রাইটার। আপনি গুনগুন করে একটা ভারি সুন্দর টিউন গাইছিলেন। জানতে ইচ্ছে হল কোন দেশের টিউন যদিও আই ক্যান গ্যাস।'

    লিপিকা বেশ আশ্চর্য হলেন। এতো আস্তে গুনগুন করা সুরটা যে কারো কানে গেছে সেজন্য নয়। আসলে উনি যে কখন গান গাইতে শুরু করেছেন সেটা নিজেই খেয়াল করেননি। নিজের মনে গান গাওয়া ব্যাপারটাই মোটামুটি ভুলে গেছিলেন বহুদিন হলো।

    ‘থ্যাঙ্ক ইউ। এটা একটা পপুলার বেঙ্গলি টিউন।’

    ‘টেগোর সং। রাবিন্ডা সাংগিট, রাইট?’

    ‘ইয়াপ। আপনি কলকাতায় গেছিলেন বুঝি?’ লিপিকা খুব একটা অবাক হননি। এই ভদ্রলোক নির্ঘাৎ এককালে হিপিদের দলে ছিলেন বা হয়ত মায়াপুরে যাতায়াত আছে। এ-তল্লাটে এই জাতীয় লোক বিরল নয়।

    ‘নো বাট মাই ফিয়াঁসে ইজ বেঙ্গলি। দেয়ার শী ইজ।’

    বলতে বলতে আরেক মূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে জিনস আর সবুজ রঙের কুর্তি, নাকে, কানে ভুরুতে, অনেকগুলো নানা ধরনের আংটা লাগানো, কোমর অবধি খোলা চুলের অর্ধেকটা সবুজ রঙ করা।

    ‘দিস ইজ জিনি। এই দেখুন আপনার নামটাও জানা হয়নি।’ জনাথন বললো।

    ‘হাই জিনি আর জনাথন, আমি লিপি। আলাপ হয়ে ভালো লাগলো।’

    ‘আমার নাম শিঞ্জিনী।’ পরিষ্কার বাংলায় বললো মেয়েটি। ওর সারা মুখে একটা ছেলেমানুষি হসির স্রোত বইছে।


    অভিরাজ বেশ কয়েকবার খুঁজেও লিপিকাকে সারা পার্টিতে কোথাও দেখতে পেলেন না। আস্তে আস্তে রোদ্দুরের রং বদলে গেল, ছায়ারা এলিয়ে পড়লো আঙুরবাগিচায়। দূর্গের দরজা বন্ধ হয়ে গেল, নেশায় টলমল পায়েরা একে একে রওনা দিলো হোটেলের দিকে। শুধু ওয়াইনারির গেটের কাছে ঘন গাছপালায় ছাওয়া একটা আধো অন্ধকার কোণায় কয়েকজনের কথাবার্তা আর শেষ হতেই চাইছে না, মাঝে মধ্যে হাওয়ায় ভাসছে চেনা-অচেনা সুর আর গীটারের টুং টাং। ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।

    অভিরাজ যখন লিপিকাকে খুঁজে পেলেন তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। হোটেলের পিছনে সুইমিং পুলের ধারে একটা ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন।

    ‘সরি অভি, তোমায় ফোন করা উচিত ছিলো। আসলে খুব ইন্টারেস্টিং একটা কাপলের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেলো। দুজনে গান গায়, হিপি টাইপের কিন্তু অবাক কাণ্ড কি জানো? মেয়েটা না বাঙালি, ওরা বাইকে ঘুরে নাপা ভ্যালি ঘুরছে।’

    ‘ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। তুমি পুরো সময়টা গ্রুপের বাইরে রইলে, ডিনারেও এলে না, ফোন করলে ধরছো না, ইট ইজ সো আনলাইক অফ ইউ লিপি। আমি সবাইকে বলেছি তোমার শরীরটা ভালো লাগছে না বলে তুমি হোটেলে ফিরে গেছো।’ খুব চেষ্টা করে বিরক্তিটা লুকিয়ে রাখলেন অভিরাজ।

    ‘প্লীজ রাগ কোরো না। আসলে ওদের সঙ্গে বাংলা গান নিয়ে কথা হলো। মেয়েটা সেকেন্ড জেনারেশন কিন্তু মায়ের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিল, সেগুলো এখনও বাজায়। বার্কলেতে পড়তো, এখন ঠিক করেছে কয়েক বছর শুধু দুজনে মিলে ঘুরে বেড়াবে। কি মজা বলো তো?'

    ‘দাঁড়ান দাঁড়ান আগে বলুন আপনি কে আর আমার বান্ধবীকে আপনি কি করেছেন।’ এক মিনিট হাঁ করে থেকে বললেন অভিরাজ। বিস্ময়ে সত্যিই ওঁর চোখ কপালে উঠে গেছে। এদিকে লিপিকা শব্দ করে হেসে উঠেছেন আজ অনেক দিন পরে।

    ‘তুমি ভাবছো লিপিকা দাশগুপ্তের হলোটা কি? অফিসের কাজে যে পারলে দিনের চব্বিশটা ঘন্টাই দিয়ে দিত সে কিনা রিট্রিটের দিনটা নেটওয়ার্কিং না করে কোথাকার এক হিপি কাপলের সঙ্গে আড্ডা মেরে কাটাল। সত্যি কথা বলতে কি আমি নিজেই বেশ অবাক। অভি আমাকে একটা ড্রিঙ্ক এনে দেবে প্লীজ।’ লিপিকা তখনো হাসছেন।

    এখন ওরা দুটো পাশাপাশি চেয়ারে। সুইমিং পুলের জলে হালকা নীল আলো কাঁপছে, ওধারে গরম জলের টবে গা ডুবিয়ে বসে কয়েকটি তরুণ-তরুণী, মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে তাদের হাসির শব্দ। একসময় ওরাও উঠে চলে গেল। অভিরাজ কিছু খাবারের অর্ডার দিয়েছেন, সেগুলো টেবিলের ওপর ঠাণ্ডা হচ্ছে।

    ‘আমি তাহলে উঠি। কাল সকালে দেখা হবে। মনে হচ্ছে তোমার খিদে বা গল্প করার মুড, কোনটাই আপাতত: নেই।’ অভিরাজ উঠে দাঁড়িয়েছেন, ওঁর শারীরিক ভঙ্গিমায় স্পষ্ট অসন্তোষ। সকালে থেকে অনেকটা অ্যালকোহল পেটে পড়েছে, ধৈর্য জিনিসটা এই মুহূর্তে সুলভ নয়।

    ‘না আরেকটু বসো প্লীজ। আমি খেয়ে নিচ্ছি।’ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন লিপিকা।

    ‘লিপি আমি বুঝতে পারছি যে তোমার মন ভালো নেই। ওই প্লেনে যে বেঁচে থাকতে পারে না সেটা প্রথম থেকেই জানা ছিল তাও কনফার্মড খবরটা পেয়ে একটা শক লাগতে বাধ্য। কিন্তু তুমি আমাকে কেন এড়িয়ে চলছো বুঝতে পারছি না। আমি তো কোনরকম অ্যাডভান্টেজ নেবার চেষ্টা করিনি? আমি শুধু তোমার পাশে দাঁড়াতেই চেয়েছিলাম যেমনটা তুমি দাঁড়িয়েছিলে ক্যারলের সঙ্গে আমার ডিভোর্সের সময়।’

    ‘জানি অভি, বিশ্বাস করো তার জন্য আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আসলে আমার মনে কতগুলো খুব মৌলিক প্রশ্ন জেগেছে--এক্সিস্টেনশিয়াল প্রশ্ন বলতে পারো। আমি তো তোমার কাছে যাবার জন্য পা বাড়িয়েই ছিলাম অভি। বিভাসের সঙ্গে আমার জীবনটা হয়ে উঠেছিল ঠিক একটা ক্রনিক অসুখের মতন যা অসহ্য না হলেও ক্লান্তিকর। তাকে ওষুধবিষুধ দিয়ে চেপে রাখা যায় কিন্তু সারিয়ে তোলা যায় না, স্বাভাবিক স্বাস্থ্য আর তৃপ্তির সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়েই চলে প্রতিদিন। পাশাপাশি তোমার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল ডাইনামিক, তার মধ্যে আমার নিজেরও আইডেনটিটি জড়িয়ে ছিল। আমাদের পরস্পরের প্রতি মুগ্ধতা ছিল কিন্তু রোজকার অভ্যাসের বোঝা ছিল না। যতদিন তুমি আমার বস ছিলে, শিক্ষক ছিলে, বিবাহিত ছিলে, আমরাও সেই সম্মানের জায়গাটা থেকে এক চুল সরিনি। সবকিছু বদলে দিলে একটা ক্রাইসিস - তোমার ডিভোর্স। তাই না?’

    ‘এদেশে শিক্ষিত হলেও আমি ভারতীয়। স্রেফ বোরিং লাগছে বলে, মুখ বদলানোর জন্য কিংবা সম্পর্কটা যথেষ্ট উত্তেজক নেই বলে একজন মা বিয়ে ভেঙে, সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করে সোজা হেঁটে চলে যেতে পারে, এটা আমি নিতে পারিনি। তখন তুমি না থাকলে হয়তো পাগল হয়ে যেতাম।’

    ‘মজার ব্যাপারটা কি জানো? ক্যারল যে কারণে তোমাকে ছেড়ে গেছিল, আমি বিভাসকে ঠিক সেই কারণে ছাড়তে চেয়েছিলাম। সেটা তখন বুঝতে পারিনি, এখন বিভাস চলে যাবার পর পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি। ব্যাপারটা সহজ হবার বদলে কঠিন হয়ে গেছে।’

    ‘তার মানে? আমি তো ভেবেছিলাম--’

    ‘আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। না অভি, প্রেমে পড়েছে ওই হিপি ছেলেমেয়েদুটো যাদের সঙ্গে আজ এতক্ষণ কাটালাম। তাই বাকি দুনিয়ার কাজকারবার ওদের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে, ওরা হতে পেরেছে খেয়ালরসের রসিক। তাই এখন ওরা যা ছোঁবে তাই সোনা হয়ে যাবে। আমাদের সে সাধ্য নেই।’ লিপিকা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো বললেন, যেন ওগুলো খুবই গোপনীয় তথ্য।

    ‘তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না লিপি। আমাদের বয়সে কি নাক কান ফুঁড়িয়ে, গায়ে উল্কি এঁকে রাস্তায় নেমে পড়া সম্ভব!’

    ‘তা না হলে প্রেম করাও সম্ভব নয় কিন্তু একটা অ্যাফেয়ার করা অবশ্যই সম্ভব। সেই অ্যাফেয়ার কথাটার ঠিকঠাক বাংলা হয় না জানো। এর মানে একটা বেআইনি বা অবৈধ সম্পর্কও, যার সঙ্গে আর্থিক আর সামাজিক নিয়ম জড়িয়ে আছে, যা নিয়ে গসিপ হয়, ডিভোর্স হয়, সম্পত্তি ভাগ হয়, ভোটে হারজিত হয়, মিথ্যা বলা হয়। প্রেম যে শুরু থেকেই কোনো নিয়ম আর বৈধতার ধার ধারে না, ঈশ্বরের মতো উলঙ্গও, ঈশ্বরের মতো দ্বিধাহীন ও সর্বেসর্বা। সে যখন আছে তখন সবকিছুর ওপরে জড়িয়ে আছে রোদ্দুর, তাই বাতির আলো সেখানে অনাবশ্যক। যখন সে নেই তখন সবকিছু আসলে অন্ধকার, যতই সেখানে হাজার বাতির রোশনাই জ্বলুক। একটা সুইচ টিপলেই সেই আলো দপ করে নিভে যাবে।’

    ‘তুমি কি ওই হিপিদের কাছ থেকে গাঁজা বা ওইরকম কিছু খেয়ে এসেছো নাকি?’ এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেছেন অভিরাজ। এই মহিলা গত কয়েক দিন ধরে হাতে গুনে পাঁচটি বাক্য বলেছে কিনা সন্দেহ, আর এখন মাঝরাতে হঠাৎ এই অদ্ভুত হেঁয়ালি ভাষণ শুরু করেছে। অভিরাজ আশা করেছিলেন যে লিপি খবরটা পেয়ে রিট্রিটে আসতে রাজি হয়েছেন তার মানে এটা সবুজ সংকেত। মনে হয়েছিল এই রোম্যান্টিক পরিবেশে কাঁধে মাথা রেখে কান্নাকাটি হবে কিছুটা, তারপর এক ঘরে রাত কাটিয়ে নতুন জীবনের শুরুটা সেলিব্রেট করা যাবে। তার বদলে এ সব কি মিস্টিক ন্যাকামি রে বাবা! এমন কেতাদুরস্ত রিসর্টের মধ্যে ওই ব্যাটাচ্ছেলে বাঙালি হিপিই বা হাজির হলো কিভাবে?

    ‘তোমাকে খুব হতাশ করছি তাই না অভি। না, আমি নেশা করিনি, এইসব কথাবার্তাও বেশিদিনের জন্য নয়। তোমাকে যে ক্রনিক অসুস্থতার কথা বলছিলাম না, ওটার নাম কি জান? ওকে বলে ইনস্টিটিউশন, প্রতিষ্ঠান। এই অসুখটা আমাদের শিরায় শিরায় স্বার্থপরতা ছড়িয়ে দেয়, আমাদের শেখায় খালি নিজেকে ভালোবাসোতে আর অন্যকে ভয় পেতে। সংসার এই অসুখের একটা ওষুধও বার করেছে, তার নাম ওনারশিপ, বস্তু আর ব্যক্তির মালিকানা। কড়া ডোজে এই দাওয়াই নিলে অসুখটা সহ্য হয়ে যায়। আমরাও তখন চারদিকে জিনিসের গুদাম বানিয়ে তাকে ঘর বলি, চোরের ভয়ে সেই ঘরের দরজা এঁটে বন্ধ করে রাখি, আর খাজনা ভরার জন্য দিনরাত ভূতের মতো ওই প্রতিষ্ঠানের ঘানি ঘোরাই। প্রেম আমাদের প্রতিষ্ঠানের খবরদারি থেকে মুক্ত করতে পারে অভি, কিন্তু তার জন্য অনেক অভ্যাস ভাঙতে হয়। আমরা বোধহয় পেরে উঠবো না, আমাদের শিকড় অনেক গভীরে নেমেছে। যাকগে ওসব কথা, অনেক রাত হল, চলো যে যার ঘরে যাই এবার।’ লিপিকা উঠে দাঁড়িয়ে অভিরাজের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন এবার।

    ‘তার মানে?’ কথাবার্তা শুনে নেশাটাই ছুটে গেছে অভিরাজের।

    ‘তার মানে আরো কিছুদিন বন্ধু হয়েই থাকা যাক। আমার ভেতরটা খুব হালকা হয়ে গেছে অভি। তুমি খুব ভালো মানুষ, আমরা পরস্পরের ভালো বন্ধু কিন্তু বিভাসের মতন আমরাও এই প্রতিষ্ঠানের নাটবলটু, এই দুনিয়াজোড়া প্যানডেমিকের রোগী। যা পাচ্ছো তার থেকে খুব বেশি কিছু আশা কোরো না যেন। তাহলে কিন্তু আবার হতাশ হবে।'

    *********

    ‘পাপু, আমি আর তোমার মা ছোটবেলাকার বন্ধু, আমরা দুজনে ভাবছি এখন থেকে একসাথে, এক বাড়িতে থাকবো, তুমিও আমাদের সাথে থাকবে। তোমার বাবার তাতে কোনো আপত্তিই নেই। কিন্তু এই বিষয়ে তুমি কি মনে করছো। সেটা জানা আমাদের পক্ষে সবচেয়ে জরুরী।’

    রবিবার সকালবেলায় বিভাসের বাড়ির ব্রেকফাস্ট টেবিলে পারিবারিক সভা বসেছে। বিভাস বেশ খাতির করে পাপুকে টেবিলের মাথায় বসিয়েছেন, ওর সামনে দুধ, কর্নফ্লেক্স, ডিম আর কেক। ডানদিকের চেয়ারে গম্ভীর মুখে বিভাস, ওঁর ভাব দেখে মনে হচ্ছে কোনো কনফারেনসে গিয়ে বেশ কঠিন একটা কেস প্রেজেন্ট করছেন। চোখেমুখে একরাশ কুন্ঠা আর অস্বস্তি মেখে সমাদৃতা বাঁদিকের চেয়ারে।

    পাপু একদম সেরে উঠেছে এখন। ডাক্তারজেঠু ওর অপারেশন করেছেন, পাপু হাসপাতালে থাকার সময় ওঁকে বেশ ভয় পেতো, কিন্তু সেরে ওঠার পরে ভালো লাগতে শুরু করেছে। পাপু জানে মা ডাক্তারজেঠুকে খুব পছন্দ করে, প্রায় রোজই অনেকটা সময় কাটায় ওর সঙ্গে। মাকে এত খুশি কখনো দেখেনি পাপু। গত এক বছর ধরে খালি ঝগড়া আর মনখারাপ, মা হাসতে প্রায় ভুলেই গেছিল। জেঠু মানুষটা গম্ভীর কিন্তু একদম রাগী না, মুখে সবসময় একটা হাসি লেগে আছে খুব আস্তে কথা বলে। পাপুর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে যে মনে হয় ঠিক যেন একজন বড়ো মানুষের সাথেই কথা বলছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মা বাবাকে একদম তাড়িয়ে দিয়ে জেঠুর সঙ্গে থাকবে এটাও ভাবতে কষ্ট হচ্ছে ওর। কেন জানি একটু একটু রাগও হচ্ছে, বাবার ওপরে তো বটেই, মা আর ডাক্তারজেঠুর ওপরেও। পাপু এটাও জানে যে বাবা অন্য একটা মাসির সঙ্গে থাকতে চায়, তাকে কয়েকবার বাড়িতে আসতে দেখেছে ও। সেই নিয়ে মা আর দিদার মধ্যে অনেক কথাবার্তা আর কান্নাকাটি হয়েছে, পাপু মটকা মারতে মারতে শুনে নিয়েছে সব। ও ভেবেছিল এখন থেকে মা আর দিদার কাছে থাকবে, রোজ রোজ ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি হবে না, মা সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরবে, দাদু বেড়াতে নিয়ে যাবে রোজ বিকেলে। বাবাকে ও খুব একটা মিস করে না, দাদু আর দিদা মিলে সারাদিন ওকে বেশ ভুলিয়ে রাখে। তাও কেন জানি পাপুর ধারণা ছিল যে কিছুদিন বাদেই বাবা গুটি গুটি পায়ে ফিরে আসবে। দামী কিছু একটা জিনিস ভেঙে ফেলার পর ধরা পড়লে পাপু যেরকম মুখটা করে, মা যাকে বলে পাপ্পি ফেস, ঠিক সেইরকম একটা মুখ করে দরজা দিয়ে ঢুকবে বাবা। মা প্রথমটা কথা বলতে চাইবে না, তারপর খুব বকবে। অনেকক্ষণ পরে ঝগড়াটা কেমন অদ্ভুত হয়ে যাবে, তারপর একসময় কি একটা কথায় হঠাৎ করেই হেসে উঠবে দুজনে। ওই সময়টা পাপু কাছাকাছি থাকতে চাইতো কেননা দুজনেই খুব করে পাপুকে আদর করতো তখন। কিন্তু এবার ও অসুস্থ হয়ে পড়লো তাও বাবা এলো না, বরং বলেছে কিনা তাও জানে না পাপু। এই নিয়ে দাদু-দিদার সঙ্গে খুব তর্কাতর্কি হয়েছিল এতদিন, পাপু শুনেছিল মা বলছে, ‘কাস্টডি যখন আমার তখন আমি একাই ডিসিশনটা নিতে পারবো। তাই যদি হয় তো এখন এইসব কথা জিজ্ঞাসা করার মানে কি?’

    ‘পাপুসোনা সত্যি করে বল না কি ভাবছিস?’ সমাদৃতা বেশ আকুল হয়ে উঠেছেন।

    ‘পাপু, তুমি আর তোমার মা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তোমাদের দুজনকে আমি আলাদা করতে চাই না। প্রতি বছর কিছুটা সময় তুমি তোমার বাবার কাছে কাটাবে কিন্তু তোমার পড়াশুনো, চিকিৎসা আর অন্যান্য সব দায়িত্ব আমরাই নিতে চাই।’

    ‘ডাক্তারজেঠু তুমি মা’কে বিয়ে করবে?’ পাপুর গলাটা প্রাপ্তবয়স্ক শোনাল। ওরা দুজনে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিলেন। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির প্রতি ওঁরা দুজনেই শ্রদ্ধা হারিয়েছেন, বন্ধনহীন স্বাধীনতার প্রতি দুজনেরই প্রবল আকর্ষণ। এর মধ্যে পাপুর দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারটা কেমন যেন পরস্পরবিরোধী শোনাচ্ছে।

    ‘আমরা কিছুদিন পরে সেটা ঠিক করবো পাপু।’ বিভাস বললেন, ‘ডিভোর্সের ঝঞ্ঝাট মিটে গেলে তারপর। তাছাড়া বিয়ে না করলেও কিছু যায় আসে না। আমরা যে একে অপরের মনের কথাগুলো বুঝতে পারি, আমাদের একসাথে থাকতে ভালো লাগে সেটাই তো আসল, তাই না?’

    ‘আই গেস। আমার খাওয়া হয়ে গেছে, এখন দাদুর কাছে যেতে পারি? দাদু একটা বই পড়ে শোনাচ্ছিল, খুব ভালো বই। বাই ডাক্তারজেঠু। মা আই ট্রাস্ট ইউ, তুমি যা ঠিক করবে আই অ্যাম ওকে উইথ ইট।’

    ব্রেকফাস্ট ঠিকমতো না খেয়েই উঠে গেল পাপু। সমাদৃতা একটা নিঃশ্বাস চাপলেন। অস্বস্তিকর প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে কিভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়, আজ সেটা শিখে গেল ছেলেটা। কাউকে বুঝিয়ে দিতে হলো না, আপনা থেকেই দিব্যি শিখে গেল জীবনের পাঠশালায়।



    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments