• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’: আত্মজৈবনিক অথবা কঠোর ভাবে রাজনৈতিক : সায়ন্তন সেন


    ১.

    সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাল্য ও কৈশোর তাঁর একাধিক আত্মকথায় ছড়িয়ে আছে— ‘ঢোল গোবিন্দর মনে ছিল এই’ তেমনই এক আত্মকথন। লেখক সেখানে জানাচ্ছেন, জনৈক শ্রীশবাবু (পরে জানা যাবে, ইনি ব্রিটিশ আমলে সরকার পক্ষের উকিল) আর তাঁর বাবার ঘরোয়া বৈঠকে পর্দার আড়াল থেকে কান পাতার বদঅভ্যেস ছিল তাঁর, কিশোরবেলায়। কী শোনা যেত তখন? শোনা যেত, গুটিকয়েক ব্যক্তিগত চিঠি আর ডায়েরির অংশ-বিশেষ। সে সব হয়তো লিখেছেন কোনো কারাবন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামী। কেউ তখন ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখছেন সহযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কথা। অন্য কেউ আবার, চিঠির মারফত প্যয়গাম পাঠাচ্ছেন কোনো আত্মজনকে। প্রবোধ দিচ্ছেন মাকে, বৌদিকে, আর সেই দূরগত উষ্ণ আলিঙ্গনের ফাঁকে-ফাঁকে, বলছেন আদর্শের কথা, দেশপ্রেমের কথা— যার স্পর্শে মৃত্যুকে উপেক্ষা করা নেহাতই ছেলেখেলা মনে হতে পারে। আমরা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কিংবা তারকেশ্বর দস্তিদারের কথা বলছি, তাঁদের দিনলিপির সূত্রে কল্পনা দত্ত, নির্মল সেনের কথাও। বলছি, তাঁদের যুদ্ধকালীন, কারাবাসকালীন শুশ্রূষা আর রক্তপাতের কথা। কিন্তু ঐ বৈঠক থেকে চোখ সরিয়ে যদি তাকাই পর্দার পিছনে, নিশ্চিত দেখতে পাবো, এক শীর্ণ কিশোর কতটা রোমাঞ্চিত হচ্ছে, কোন গভীর জীবন-উৎসের সবটুকু রস সে শুষে নিচ্ছে। তার নাম রাখা হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুর কথা মনে রেখে। পরে, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামই তাঁর যথার্থ উপাধি হয়ে উঠবে, কেবল কাকতালে নয়, ঐতিহাসিক কার্যকারণতার সূত্র মেনে।

    স্মৃতিকথার যিনি কথক, তাঁর ঐতিহাসিকের মতো যান্ত্রিক ত্রুটিহীনতার, অভ্রান্তির দায় থাকে না। এমনকী, সময়ের নিখুঁত পারম্পর্যও মেনে চলতে হয় না সর্বত্র। তাই, ছেলেবেলার সেই বৈঠকের স্মৃতি থেকে প্রৌঢ় সুভাষ চলকে পড়েন তাঁর যৌবনে— যখন তিনি চট্টগ্রামে গিয়ে পার্টির কমিউনে উঠেছেন। “এক লোকনাথ বল ছাড়া সূর্য সেনের সব জীবিত সহকর্মীই তখন কমিউনিস্ট।” প্রীতিলতার ডায়েরি-তে যে কল্পনা দত্তের কথা ছিল, তিনি সম্ভবত, তখন ‘কল্পনাদি’। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি থেকে উঠে আসা জালালাবাদ পাহাড়ে ঘুরছেন সুভাষ। চষে বেড়াচ্ছেন পটিয়া, ধলঘাট, কালারপোল, কধুরখিল, রাঙানিয়া, রাউজান। চিত্তপ্রসাদের তুলির ক্ষিপ্র আঁচড়ে, আর তাঁর ঋজু অথচ মরমী গদ্যে ‘আমার বাংলা’ নাম্নী যে বইটি ক্রমশ হয়ে উঠবে, তার প্রেক্ষাপটেও তো সেই বিক্ষুব্ধ চারের দশক।


    ২.


    তিন এবং চারের দশক। ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত অনেকে কারাভ্যন্তরেই দীক্ষিত হচ্ছিলেন মার্ক্সবাদে। আজ অন্তত তর্কাতীত যে, সত্যিই যাঁরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির পদানত দেখতে চাননি ভারতবর্ষকে, সমান্তরালে, একটা সামগ্রিক সমাজ-বদলের রূপকল্পে তাঁদের আকৃষ্ট হওয়াই বাস্তবসম্মত ছিল। কল্পনা দত্ত যখন তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘কেমন ক’রে কমিউনিস্ট হলাম’, হিজলী স্পেশ্যাল জেলে বসে তিনি পড়েছিলেন রমাঁ রল্যার ‘আই উইল নট রেস্ট’— এই তথ্য জানতে পারি আমরা। আর কল্পনার নবীন চোখে মাস্টারদার পাশাপাশি আরও একটা দৃপ্ত মুখের অবয়ব পূজনীয় হয়ে উঠেছিল তখন— সোভিয়েত দেশের লেনিনের মুখ। এ তো গেল যোদ্ধাদের কথা। কিন্তু যুদ্ধ কেবল সম্মুখসমর নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই সমাজ-ব্যবস্থার অসঙ্গতি আর উৎকট অসাম্যকে উপেক্ষা করতে পারেননি তামাম বাঙালি-সন্তান, অন্তত তাঁদের অনেকেই। দেওয়ালে যার পিঠ ঠেকে যায়, সে তো ঘুরে দাঁড়ায় নিতান্ত প্রবৃত্তির তাড়নায়। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির অভিশাপ এই: একবার অসঙ্গতি চোখে পড়লে অমোঘ আত্মগ্লানি টেনে নিয়ে যায় লড়াই-এর পথে। ইতিহাস সাক্ষী আছে— সঙ্গীতে, চিত্রকলায়, কবিতায়, কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায়, একটা নতুন উজ্জীবন পাচ্ছিল তখন বাংলাদেশ। গোপাল হালদার, সুশোভন সরকার, সোমনাথ হোর, চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিন থেকে বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়— এই নামগুলি পরপর মনে করা যাক। কেবল কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, চিত্রকর পরিচয়ের খোপে আঁটানো যাবে না কাউকে, সকলেই তাঁরা বৃহত্তর লড়াই-এ পরস্পরের সহযোদ্ধা, রাজনৈতিক কর্মী। সোমনাথ হোরের ‘তেভাগার ডায়েরি’ দেখুন, কিংবা আমাদের আলোচ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’। সোমনাথ হোর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে ফিরে যান জন্মস্থান, চট্টগ্রামে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও প্রথমে অনার্স এবং পরে এম. এ. পরীক্ষা দিতে পারেননি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। হতদরিদ্র, বুভুক্ষু গ্রামজীবন, মহাজনী কারবারে রুগ্ন ও রক্তশূন্য গ্রামজীবন ডেকেছে তাঁদের। আরও অনেকের গল্প, সেদিন, এরকমই ছিল। অগণিত যোদ্ধার এই সংঘবদ্ধতা, আত্মীয়তার ইতিহাস থেকে আমরা যখন ব্যক্তি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আলাদা করে বেছে নেবো— যেন মনে রাখি তাঁদের এই যৌথ-যাপন। অন্যথায় নিবন্ধের এই অংশটি অতিকথন বলে মনে হতে পারে।


    ৩.


    ‘আমার বাংলা’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গদ্যের বই, রিপোর্টাজধর্মী। উনিশশো একান্ন-তে ‘আমার বাংলা’ প্রথম প্রকাশ পায় ‘ঈগল পাবলিশার্স’ থেকে। তথাকথিত স্বাধীনতা এবং অনিবার্য (নাকি নিবার্য ছিল তাও?) দেশভাগের পর। যদিও এ রিপোর্টাজ লেখা হয়েছে স্বাধীনতার আগে, চারের দশকে, যদি প্রথম নিউ এজ-সংস্করণের ভূমিকা লক্ষ করেন, এই মেদুর আক্ষেপ চোখ এড়িয়ে যাবে না:

    বেশ ছিল।

    শেয়ালদায় যাও। টিকিট কাটো। তারপর বেরিয়ে পড়ো উত্তরে কি পুবে— যখন যেখানে মন চায়। ভেড়ামারা পার হয়ে সাড়ার পুল। নীচে তাকিয়ে মনে হবে পদ্মার ঢেউগুলো গিলতে আসছে। কিংবা যাও গোয়ালন্দে। ভাজা ইলিশের গন্ধ স্টিমারঘাট অব্দি পেছনে ডাকতে ডাকতে যাবে।

    আজ জলেস্থলে গন্ডি আঁকা। সে গন্ডি পার হবার হুকুম নেই।

    আপাত ভাবে মনে হওয়ার কথা, এই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা আগাগোড়া সুখকর। কিন্তু তারপরেই লেখা আছে:

    শালগাছের ছায়ায় আজ আর গোরা পল্টনের তাঁবু নেই। খালের দুপাশে চিকচিক করে না মানুষের হাড়।

    ‘মানুষের হাড়’— এই বাক্যাংশে কিছুক্ষণ থমকে থাকতে হয়। সকলেই জানবেন, বন্ধু দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে এবং প্ররোচনায় ‘রংমশাল’ পত্রিকায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন এই গদ্যগুলি। কিন্তু সে তাঁর বিলম্বিত অবলোকন, তাই একাধিকবার তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে, “দিন বদলেছে” কিংবা “সেদিন আর নেই”। প্রত্যয়ী উচ্চারণে বলতে হয়েছে, “স্বাধীন দেশে মানুষ এখন নতুন করে দল বাঁধছে, নতুন করে শপথ নিচ্ছে, নতুন করে স্বপ্ন দেখছে সুখশান্তির।” কিন্তু, প্রেক্ষাপটে সেই সময়, যখন মৈমনসিং-এর গরিব চাষিকে এক ফোঁটা দুধের জন্য হাত পাততে হতো জোতদারের কাছে। আবার, নওয়াপাড়া আর দুমনাকুড়া, ঘোষপাড়া আর ভুবনকুড়ার তল্লাটে চাষিরা লড়াই করতেন জমিদারের খামারে ধান তুলতে অস্বীকার করে। এই হলো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাংলাদেশ। জীবনী অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তাঁকে সাংবাদিক করে তুলেছিলেন পূরণচাঁদ যোশি। আর সোমনাথ লাহিড়ীর ‘কড়া শাসন’-এ সুভাষ আয়ত্ত করেছিলেন বলিষ্ঠ গদ্যরীতি। এ দুই-এর মিশেলেই তাঁর রিপোর্টাজ, যার প্রথম পর্বের আধার অবশ্যই ‘স্বাধীনতা’ আর ‘জনযুদ্ধ’। কিন্তু এখানে একটা প্রয়োজনীয় মন্তব্য করে রাখা যাক। ‘আমার বাংলা’ কেবল এইটুকুই নয়। জানি না, গদ্যে এ তাঁর কবিস্পর্শের ফলশ্রুতি কিনা, ‘আমার বাংলা’-য় সুভাষ অর্জন করলেন কতকটা ফ্ল্যানেঅর (এর যথাযথ বাংলা তর্জমা পাইনি)-এর দৃষ্টি। এমন তো নয় যে গারো পাহাড়ের কোলে তেজারতি-বন্ধকির কারবারে সর্বস্বান্ত চেংমান-চাষির ইতিবৃত্তে তিনি ক্রুদ্ধ হননি, কাতর হননি। অথবা, লড়াকু কবিয়াল রমেশ শীলের গান বাঁধার কথা, কবির লড়াই-এর বর্ণনা তাঁকে উত্তেজিত করেনি। অথচ সহজ করে, আলতো করে, কাছে-টেনে-নিয়ে গল্প শোনাবার যে ভঙ্গিটি আমাদের লোকজীবনের চিরায়ত ঐতিহ্য, তার ছাপ ‘আমার বাংলা’-য় অস্বীকার করবে কে? সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর পক্ষপাত সঞ্চারিত করেছেন সূক্ষ্ম, মেদুর কারুতে:

    যারা এত কষ্ট করে আমাদের মুখে অন্ন যোগায়— ইচ্ছে করে, জমিদারের হাত থেকে বাংলার সমস্ত জমি তাদের হাতে দিই, মহাজনের নিষ্ঠুর ঋণের বোঝা থেকে তাদের মুক্তি দিই। তোমাদের কি ইচ্ছে হয় না?

    এই কথনের সূত্রেই তাঁর লেখায় উঠে এসেছে হাজং উপজাতির লোকজ ছড়া ও গান, কিংবা সাঁওতালি ঝুমুর।


    ৪.


    স্বদেশী হাওয়ার জোয়ারে সুভাষের প্রথম কাব্য-রচনা। যে অগ্নিগর্ভ সময়ে সুভাষ বেড়ে উঠছিলেন, তখন দেশব্যাপী সংগঠিত ছাত্র আন্দোলন সেভাবে গড়ে না উঠলেও, ছাত্ররা জোট বাঁধছিল। উনিশশো বত্রিশ-তেত্রিশে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যুক্ত হলেন ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল’-এ। অতঃপর, সমর সেনের সাথে আলাপ থেকে প্রথমে লেবার পার্টি এবং পরে, উনিশশো ঊনচল্লিশে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান পর্যন্ত তাঁর জীবন-বৃত্তান্ত সুলভ্য। বিয়াল্লিশে সুভাষ পার্টির সদস্যপদ পান, আর সাপ্তাহিক ‘জনযুদ্ধ’-এ শুরু করেন রিপোর্টাজ লিখতে মাসিক পনেরো টাকা ভাতায়। ‘আমার বাংলা’-কে আমরা বস্তুত সুভাষের আত্মজীবনীর অংশ হিসেবেই পড়তে চাইবো। লেখা মাত্রেই আত্মজৈবনিক— এমন মনে করেন অনেকে। কথাটা ঠিক, কিন্তু ‘আত্ম’ তো কোনো নিরালম্ব বায়ুভূত পদার্থ নয়, আরও অনেক মানুষের সাথে, সময় ও পরিপার্শ্বের সাথে মিলনে-সংঘাতে তার হয়ে ওঠা। ‘আত্ম’, অতএব, একটা দ্বান্দ্বিক সত্তা এবং কঠোর ভাবে রাজনৈতিক-ও বটে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ পৌরোহিত্যে বাংলার গ্রামজীবনকে যখন লিপিবদ্ধ করেছেন সুভাষ, একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান তাঁর নিশ্চয়ই ছিল। সেই অবস্থান প্রভাবিত করেছে তাঁর দেখা-কে, আর সেই দেখা থেকে তৈরি হয়েছে আরও গভীর, ব্যাপক আত্ম-অনুসন্ধানের খতিয়ান। তেমনই দস্তুর। কী দেখেছেন তিনি?

    উনিশশো তেতাল্লিশে চাটগাঁয়ের পথে ভিড় করে থাকে বুভুক্ষু নরনারী, কঙ্কালসার। দুর্ভিক্ষ, বন্যা এবং মহামারী। মৃতের সংখ্যা দুই লক্ষের কিছু কম-বেশি। এই সমগ্র থেকেই খণ্ডদৃশ্যের কোলাজ তৈরি করছেন পদাতিক সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কতকটা তাঁর চোখে-দেখা, বাকিটা শোনা, ফলত অ্যানেকডোটাল।

    ‘রানিনগর এতিমখানা’ থেকে হয়তো ফিরে যাচ্ছেন মাধবের মা, মাধবকে একটিবার ছুঁতে না পেয়েই। মাধবকেও ছুটে যেতে দিচ্ছেন না রহমান মাস্টার, মায়ের সারা গায়ে বিষাক্ত ঘা, শরীর পচে যাচ্ছে। বিক্রমপুর পরগনা থেকে এ কাহিনি শুনে স্টিমারে ফেরার পথে সুভাষ লিখবেন:

    জলের মধ্যে ছলাত্ করে উঠল কী ওটা? মাধবের মা নয় তো?

    আবার, লৌহজঙ্গ বন্দরের ব্যাপারীরা স্তূপাকার শবদেহের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে মাইনে-করা ডোম এনে খাল থেকে সরিয়ে ফেলছেন পচাগলা দেহগুলি, লাশ-প্রতি ‘আট আনা কি এক টাকা’য়। গ্রামের-পরে-গ্রাম, কারও লজ্জা নিবারণের কাপড়টুকু নেই। প্রসঙ্গত মনে পড়বে, আবারও, কল্পনা দত্তর স্মৃতিকথা থেকে, প্রসন্নবালা চাষীর কথা। অন্নের দুর্ভিক্ষের পর কাপড়ের দুর্ভিক্ষ। রাউজান থানার স্থানীয় সার্কেল অফিসারের মুখের উপর কাপড় ছুঁড়ে ফেলে যে প্রসন্নবালা বলেছিলেন, “আমাকে কাপড় দিলে আমাদের সকলের লজ্জা নিবারণ হবে না”, তাঁর পরিচিকীর্ষাই তো পথ দেখিয়েছে সে কালে বামপন্থী আন্দোলনকে।

    বামপন্থী আন্দোলনের চরিত্র এমনই ছিল সেদিন। ‘বন্যার সাথে যুদ্ধ’-তেও সুভাষ লিখেছেন সেই অসামান্য অভিজ্ঞতার কথা। বন্যা-কবলিত বর্ধমানে বাঁধ বাঁধার কাজ চলছে সমস্ত দিন। মুষলধারে বৃষ্টি— তাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে আসছে লাল ঝাণ্ডার মিছিল, ছ-সাত হাজার মানুষ। চাষিদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাটি কোপাচ্ছেন কৃষক সমিতির লোক— হায়াত সাহেব, সঈদুদ্দীন সাহেব। সন্ধেয় বসছে গানের জলসা, চাষিরা অবাক হয়ে দেখছেন, ‘গাইয়ে বাবু’-রাও জানে তাঁদের যন্ত্রণার ভাষা। গণনাট্য সংঘের লোক যে তারা, বিজন ভট্টাচার্য আর শম্ভু মিত্র।

    এমনই সব টুকরো স্মৃতির, অভিজ্ঞতার রোমন্থনে— গল্প থেকে গল্পান্তরে— আস্ত একটা বাংলাদেশের ছবি একটু-একটু করে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। জ্যান্ত হয়ে ওঠে খনি-শ্রমিকদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই, আর সেই লড়াই থেকে ওম্‌ নেওয়ার আগে যে কিশোর কলকাতার পথে-ঘাটে খুঁজে ফিরেছিল তার মাটিমাখা গ্রাম্য-শৈশব— বেদনাপ্রহৃত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই ছেলেটিকেও একবার হয়তো ছুঁয়ে দেখতে চান। কী দেখছে ও, ‘কলের কলকাতা’য়? দেখছে, আন্দামানের জেলে বন্দিদের অনশন ইস্কুল-কলেজ থেকে ছেলেমেয়েদের টেনে আনছে রাজপথে। ক্ষোভ প্রশমিত হয়, তবু আগুন নিভে যায় না: “রাস্তায় ঝিলিক দিয়ে যায় নতুন নিশান— লাল শালুর তৈরি।” মিছিলের উপর গুলি চলছে কার্জন পার্কে— দেখছেন সুভাষ। মিলিটারি ট্রাকের তোয়াক্কা না করে কীভাবে জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে দিচ্ছে বাচ্চা ছেলেটি ফিরিঙ্গিদের হোটেলে আর তার পিঠে আরও লাল হয়ে উঠছে রক্তবর্ণ ফুল, প্রতিশোধের অভ্যস্ত স্মারক। এ সবই তাঁর আত্ম-কে গড়েপিটে নেওয়ার পশ্চাৎপট। ইতিহাসের মজা এই, সে সমান্তরাল তৈরি করে নিতে পারে, মানচিত্রকে উপেক্ষা করেই। আঠারোশো চুয়াল্লিশে, ম্যানচেস্টারের রাস্তায় শ্রমজীবী মানুষের বিক্ষোভ মনে পড়ে যাচ্ছে কি, যার প্রস্থচ্ছেদ করেছিলেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস্?


    থাক। বরং, আমরা দেখে নিই আরও একটু দূর। কৈশোর পার করে, যৌবন পার করে, ঐ যে, এখনও সুভাষ মুখোপাধ্যায় হাঁটছেন। জাপপুষ্পকে ঝরে ফুলঝুরি, সুভাষ তখনও হাঁটেন। কবির নশ্বর দেহ হাইজ্যাক করা যায়, কবিতাকে তো নয়— এই আমাদের অক্ষয় সান্ত্বনা।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments