|| ১ ||
আঘাতটা একেবারে আকস্মিক। আর লোকটাও খুব রোগা। প্রথম ধাক্কাতেই তাই লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আবার মার। এবার পা দিয়ে। জুতোটা খুবই ভারি ছিল। পাঁজরগুলো গুঁড়িয়ে গেল যেন। দ্বিতীয় আঘাতটার পর উঠে দাঁড়ানো আরও কঠিন হয়ে পড়লো লোকটার পক্ষে। ততক্ষণে এপাশ থেকে, ওপাশ থেকে, সামনে, পিছনে আরও কয়েকজন। না, ওকে বাঁচাতে কেউ নয়। যে মারতে এসেছিল, একা ছিলনা। ও শুয়ে পড়তে ব্যাপারটা ওদের কাছে আরও সহজ হয়ে গেল। একবারই শুধু পা চালিয়ে পাল্টা দিতে পেরেছিল কোমর থেকে শরীরটা একটু তুলে। হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বাঁ দিক থেকে তেড়ে আসা লোকটা। ও প্রথমেই শুয়ে পড়াতে লোকগুলো একটু কি ঝিমিয়ে পড়েছিল? দলের লোকটা পড়ে যেতে এলোপাথাড়ি কিল ঘুঁষি থাপ্পড় আর অশ্রাব্য গালাগালের বন্যা বইয়ে দিল। ততক্ষণে ওর বাঁ চোখটা ফুলে শীতের টমেটো আর জমাট বাঁধা রক্তে, কালশিটেয় মুখটা বীভৎস। দুঃখে, অপমানে, যন্ত্রণায় বেসামাল হয়ে আর্তনাদের মতো একটা কিছু বেরোল যখন ওর গলা চিরে দলটা থমকালো একটু তখন। দু চারজন পাশ কাটিয়ে যাওয়া লোকের মুখে - উফ এখানেও এরা এই সব ঝুট ঝামেলা…, কি হচ্ছে কি, পুলিশ টুলিশ... ধরনের হাল্কা কথায় দল ভেঙে ওরাও পালালো মারাত্মক সব শাসানি দিয়ে। ওকে আধমরা ফেলে রেখে।
দিনটা আর সময়টা বেছেছিল ওরা ভাবনা-চিন্তা করেই। রোগা লোকটা ফেঁসে গিয়েছিল পান ওয়ালার জন্যে। মুখচেনা বড়জোর। দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে মাঝে মাঝে পান-টান, বউ বলে দিত কখনও সকালে বেরোনোর সময়ে হয়তো - মেলায় স্টল দিয়েছিল। শেষ দিন তিন-চারটে বড় বড় ব্যাগ নিয়ে হিমশিম। ও-ই যেচে গিয়ে, একই দিকে তো, এক সঙ্গেই বেরোব না হয়। দু একটা ব্যাগ টেনে দেব। পানওয়ালা হেসে বলেছিল, নটার মধ্যেই তাহলে গুছিয়ে নেব। যা হয়, সব গুটিয়ে বেরোতে সাড়ে নয়, পৌনে দশ। শেষপ্রহরে ভাঙা মেলা ততক্ষণে নির্জন। উল্টো দিকেই তো ওদের স্টলটা। নজর রাখছিল।
ও উঠতে পারছিলনা। ছোট বাড়িটা, টুনি, বাবলুর মুখ দুটো তীব্র টানছিল ওকে। প্রাণপণ চেষ্টাতেও শরীরটা নড়াতে পারছিলনা একচুল। কোমর থেকে পায়ের পাতা, মাথার পেছনটা জমাট বাঁধা ভারি একটা পাথরের মতো। পানওয়ালা উশখুশ করছিল। ও-ই বললো, এগিয়ে পড়ো তুমি, আমি চোখেমুখে একটু জল-টল দিয়ে দেখি। ন্যাকড়া জড়ানো বেড়ে যাওয়া দু এক টুকরো বরফ, পান পাতায় মুড়ে খানিকটা চূণ ওকে দিয়ে পালিয়েছিল পানওয়ালা লোকটা। আশপাশ থেকে দু একটা কথা, যেমন হয় - ডাক্তার, পুলিশ কি থানা। কর্তা গোছের দু একজন মোটাসোটা লোকের কানেও কি করে যেন। --কেন যে আসে এরা, যত উটকো ঝামেলা। পরের বার এসব যেন একদম না ঢোকে। না, ঐ মারকুটে স্টলের ছেলেদের কথা বলেনি, মার খাওয়া রোগা লোকটাকেই বলেছে। চেনে কিন্তু ওকে, কাজটাজও করিয়ে নেয় । আজ বলে নয়, বেশ ক'বছর । কখনও সামান্য পয়সা দিয়েছে, পরে দেব বলে ভুলে গেছে কখনও। লোকগুলো মোটাসোটা বলেই হোক, কি ও বড্ড রোগা বলেই,পাওনা টাকার কথা তোলেনি কোনদিনই।
|| ২ ||
শুরুটা অন্যরকম ছিল। যেমন হয় আর কি, মসৃণ একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, যেন বন্ধুর মতো। পাঁচ ছ বছর অগের কথা। ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করতো সমুদা । দেখা হয়ে যেত প্রায়ই। বড় বই নেয়নি কোনদিনই। টুকটাক পাঁজি কি ১০০ সেরা জোকস। কদাচিৎ গল্পের বই নিলেও ফেরৎ দিয়ে দিয়েছে তিন চার দিন পরেই । --এসব সিরিয়াস কাঁদুনিমার্কা বই লেখে যে কারা। শালা, ঝামেলা যেন কম পড়েছে লাইফে। চোখ টিপে বলেছে সেরকম মাল তুললে দিস, ক্যাশ দিয়ে নিয়ে নেব। কলেজে পড়ায় সমুদা। অবসরে পত্রিকা একটা বন্ধুরা মিলে। ডাক্তার, প্রফেসর, ব্যাঙ্কের লোক সব। ডেলি প্যাসেঞ্জারির বন্ধুদের দল। নোংরা ঠাট্টা ইয়ার্কি যত। লোকটা রোগা বলে দল বেঁধে পেছনে লাগা। --এই যে বিদ্যাসাগর এলেন যত গোপাল ভাঁড় আর ব্রতকথা নিয়ে। শালা ভণ্ডামি বের করবো একদিন। ভীড়ে ঠাসা ট্রেনের কামরায় বিনি পয়সার আমোদ। নিজের থেকেই হঠাৎ একদিন --কিরে দেখিনি যে কদিন, ভাবলাম টেঁসে গেলি নাকি। খ্যা খ্যা করে হেসেছে। যাক বেঁচে থাকিস যদি কাল পর্শু এই সময়ে স্টেশনে থাকিস। একটা কাজের কথা আছে। বউ শুনে বলেছে, কাজ মানে তো মাগনা খাটিয়ে নেওয়া। তোমারও শিক্ষা হয়না। দু দিন তিন দিন ফালতু অপেক্ষা করেছে কাজের সময়ে। পরে কথা হয়েছে ট্রেনেই। ওদের পত্রিকা বিক্রি করে দিতে হবে। প্রেসে কি বাঁধাই-এর ঘরে ছোটাছুটি দরকার পড়লে। পয়সা-টয়সার ব্যাপার কিছু নেই । --আরে তোকে আমাদের টীমেই তো নিয়ে নিলাম। নিজেদের কাগজ, নিজেরাই খাটছি--সবাই যেমন। নামটাও দিয়ে দেব তোর আমাদের সঙ্গে। লোকটা শরীরে রোগা আর মাথায় মোটা । বাড় খেয়ে গেল। নাম টাম কিছুই ছিলনা। ও-ই বোকার মতো বলতে গিয়েছিল - সমুদা আমার ভালো নামটা, পদবী জানো তো? জানি বলে চার অক্ষরের দুটো শব্দ বলেছিল। বিক্রি কম হলেও মুখ খারাপ করেছে। হুমকি দিয়েছে এই বিনি মাইনের চাকরি থেকে নাকি পেছনে লাথ মেরে বের করে দেবে। লোকটা যত রোগা, ওর চামড়া যেন তত মোটা। ফের ওদের পত্রিকা হকারি করে বেড়িয়েছে ট্রেনে ট্রেনে।
মেলাতে খেটেছে ওদের স্টলে প্রত্যেক বছর তার পর থেকে। পয়সা-টয়সার বালাই নেই ,তাও কাজ করে গেছে। নিজের কাজ কামাই দিয়ে, ধার দেনা করে কোনমতে চালিয়ে নিয়েছে কটা দিন। বই মেলার স্টল, নতুন বই-এর গন্ধ, লোকজনের সঙ্গে কথার পিঠে কথা বলে বই, ম্যাগাজিন বিক্রি, নতুন গ্রাহক... অদ্ভুত নেশা একটা। কাটিয়ে উঠতে পারেনা। প্রত্যেক বছর বউয়ের সঙ্গে এ নিয়ে চূড়ান্ত অশান্তি। সমুদা, ডাক্তারদার অপমান - প্রত্যেকবার দিব্যি গালে নিজের কাছে, এই শেষ, তবু... । –মেয়েছেলে-টেলে থাকলেও না হয় বুঝতাম এত খিস্তি খেয়েও কিসের টান । সে বালাইও তো নেই। কেন যে যায় নিজেই বোঝেনা তো বউকে বোঝাবে কি করে। জামায় সাবান ঘষতে ঘষতে বলে এই শেষবার, কথা দিয়ে দিয়েছি। না গেলে যে কটা বই-টই বিক্রি হয়, তাও হবেনা। আর এবার একদম পাকা কথা হয়ে গেছে। সমুদা, তনু ডাক্তার সকলে ছিল। ডেলি পেমেন্ট হবে, গ্রাহক করলে শতকরা হিসেবে কমিশন। না হলে দশ বারো দিন কাজ কামাই দিলে আমার ঘরে হাঁড়ি চড়বে কি করে। জিভের ডগায় আসা ছোটবড় কথাগুলো বলতে গিয়েও গিলে নেয় সুলতা। ভাঁজকরা কটা নোট ওর হাতে দিয়ে বলে বলে দু একটা বাচ্চাদের বই-টই পেলে এনো, আর খালি পেটে থেকোনা। নিজের ওপর এক রাশ ঘেন্না নিয়ে ব্যাগ পিঠে বেরিয়ে পড়ে।
কবে থেকে এই পিঠে ব্যাগ, ব্যাগে বই, হাতেও দুটো-একটা আর এ ট্রেন,ও ট্রেন। দুটো ট্রেনের মাঝের সময়টুকু স্টেশনের বেঞ্চে বসে পাতা ওল্টানো। সমুদা কি ঐ ডাক্তারদা যেরকম হ্যাটা মেরে বলে শুধু পাঁচালি কি পাঁজি, তা নয়। ভালো ভালো বই-ই বেশি ওর ব্যাগে। ভালো খদ্দের আছে কিছু অল্প হলেও। অর্ডার থাকে নানা বিষয়ের। সহজে না পাওয়া বই হোক কি পত্রিকা - ঢুঁড়ে এনে দেবেই। ভালোবাসে কাজটাকে অভাব সত্ত্বেও। অসম্মান সত্ত্বেও। নিজেও খুঁজে ফেরে নতুন বই, নতুন বিষয়। কলেজস্ট্রীট, প্রকাশকের ঘর, পুরোন বইয়ের ঠেক ঘুরে তুলে আনে দুষ্প্রাপণীয় জহরের মতো এক একটা বই। ব্যাগ থেকে বার করে হাতে ধরিয়ে দেয় বইটা যখন সত্যি বইপোকা কোন মানুষের হাতে, কিছু একটা হয় মনের মধ্যে। যত চিরুনিওয়ালা, দাদের মলমওয়ালা, কি ডিম টোস্ট-ওয়ালার থেকে আলাদা করে নিতে পারে নিজেকে। সেইসব দিনগুলোতে বিকেলে আর হকারিতে বেরোয় না। ট্রেন বাস ধরে চলে আসে কোন সাহিত্যসভায় কি বক্তৃতামঞ্চে। একদম পিছনের সারিতেই বসে হয়তো, তবু... । সুলতা মুখঝামটা দেয়। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছে ঐ দিনগুলোতে একটা পাটভাঙা শাড়ি। টুনি, বাবলুকেও বিকেলে আরেকবার স্নান করিয়ে একটা তোলা জামা, রান্নায় একটা বাড়তি পদ আর খাবার পর দুটো জর্দা পান মুখে দুজন। এই চাওয়াটুকুও যেন বড্ড বেশি হয়ে যায় হকারের জীবনে।
এরকম দিন সত্যি আসে কিনা ধাঁধাঁ লেগে যায়। খেয়ে উঠতেই দীপক, সমুদা ডাক দেয় রাস্তা থেকে। বাইন্ডারের কাছে যাবার কথা ছিল, যায়নি। --আজ একটু অন্য কাজে আটকে পড়েছিলাম। কাল ফেরার পথে তাড়া মেরে আসবো। --শালা অন্য কাজটা তো বিছানায় বউ এর সঙ্গে। পেছন থেকে ডাক্তারদার একটা বন্ধু, বিদেশ থেকে এসেছে, বলে রিয়েলি, একটু টেস্ট করা যায় না? বিলিতিতে মুখ মেরে গেছে মাইরি। খাঁটি দিশিতে একটু মুখ বদলালে মন্দ হয়না। লোকটার মাথাটা যত গরম হয় রক্ত যেন তত ঠান্ডা মেরে যায়। মিনমিন করে বলে অনেকগুলো টাকা আটকে ছিল ... বাবলুর টিউশনের ফী বাকি পড়ে। টাকাটা আনতেই হত আজ। নোংরা একটা ইঙ্গিত করে চলে গেল ওরা। আর শব্দ করে এক দলা থুতু রাস্তায় ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ে লোকটা। আন্দাজ করতে চায় ওর কথাগুলো আর প্রতিক্রিয়াহীনতা বউ শুনেছে কিনা। পাথরের মতো মুখে বউ বললো, একটা রান্নার কাজ পেয়েছি। নিয়ে নেব ঠিক করেছি। বাবলু আর টুনি স্কুল থেকে ফেরার আগেই সেরে আসবো। মাসকাবারি চাল, ডাল আর তেলের খরচটা উঠে আসবে। সকালে কাজে বেরোনোর পথে দেখে কাল রাতের ঐ থুতুর দলা ঘিরে থিকথিকে রোগা পিঁপড়ের দল।
তখনই ঠিক করে নেয় আর যাবেনা ঐ স্টলে। সারা দিন মুখে রক্ত তুলে বই বিক্রি করেছে। তিন দিনের টাকা ধরিয়েছে, তাও ভিক্ষের মতো চেয়ে চিন্তে। তারপর থেকে আর পয়সার কথাই নেই। উল্টে এখন কাজে ভুল ধরে পাওনা মেরে দেওয়ার ধান্দা, বাড়ি বয়ে এসে নোংরা কথা। দু দিন ধরে বাজারের টাকাও দিতে পারেনি। ঠিক যেভাবে সমুদা-রা ওকে খেদিয়ে দিয়ে বলে, বিক্রি বাটা নেই, মেজাজ এমনিতেই খিঁচড়ে আর তার মধ্যে এই শালা পয়সা পয়সা করে চিবিয়ে খাচ্ছে, অবিকল সেই কথা আর মেজাজটাই উগরে দেয় বউটাকে। কিন্তু ভুলে গিয়েছিল বউটা আর আগের মতো রোগা নেই। ওর দুটো কান জ্বালিয়ে দিয়ে সুলতা বলেছিল স্টেশনের পেছনের খারাপ পাড়ার মাগীগুলো পর্যন্ত খদ্দেরের কাছে বাকি রাখেনা। পয়সা না দিলে কি হাল করে শিখে এসো গিয়ে। এর পরেও যাচ্ছিল মাগনা খাটতে। পকেট থেকে ফোনটা বার করে সমুদাকে সুলতার কথাগুলো বলে দিয়ে লাইন কেটে দিয়েছিল।
|| ৩ ||
রাত গভীরে ফিরতি পথ ধরেছিল মার খাওয়া লোকটা। কোনক্রমে। চেনাশোনা মোটাসোটা লোক ছিল কজন মেলায়। আহা-উহু অব্দি। গাড়িতে একটু স্টেশন অব্দি পৌঁছে দেবার কথাটুকুও কেউ বলেনি। বাস ফাঁকা পেয়েছিল। শেষ ট্রেনে ফিরেছিল। রাত বাড়ুক চাইছিল ও। টুনি বাবলু ঘুমিয়ে পড়ুক। ভাঙাচোরা লোকটাকে দেখে ওর বউ আঁতকে উঠেছিল। শুধু জিগ্যেস করলো, কারা ? ঐ যে শুয়োরের বাচ্চাগুলো পর্শু এসে নোংরা কথা বলছিল,তাই না? ঘাড় নেড়ে, একটা ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। সুলতাই জোর করে পরদিন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বললেন, এক চুলের জন্যে বেঁচে গেছেন। চোখটা চিরদিনের মতো নষ্ট হতে পারতো। ঘাড়ের আঘাতটাও মারাত্মক। হাসপাতালের ঐ ডাক্তারবাবুই অন্য ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করালেন। বউ বলছিল থানায় যেতে। ও ভয় পেল। নিজের জন্যে যতটা না, বউ এর জন্যে আর টুনি, বাবলুর জন্যে। ঐ লোকগুলো যে কি করতে পারে জানে ও, তাই ভয়ে শিউরে উঠলো।
ভয়টা এর পর থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে সর্বাঙ্গে, সমস্ত চেতনায়। ঘুরে ফিরে ডাক্তারবাবুর কথাটা--এক চুলের জন্যে। যদি অন্ধ হয়ে যেত। বউ মোবাইলে শালীর সঙ্গে কথা বলছিল, ও শুনে ফেলেছে - এক চুলের জন্যে বেঁচে গেছে। সর্বনাশ হয়ে যেতে পারত। রোগা মানুষটাকে কীভাবে পিটিয়েছে। সর্বনাশ হয়ে যেতে পারতো? মানে মরে যেতে পারতো? ট্রেনে হকারি করতে গিয়ে নয়, গাড়ি চাপা পড়ে নয়, ভাঙা মেলার নির্জন মাঠে বেধড়ক মার খেয়ে মরে যেতে পারতো। কত লোক এসেছিল। কত বই আর কত বক্তৃতা, কত কবিতা, গল্প .... আর তার মাঝে একটা লোক একদম ফিনিশ। কেন মার খেলো? টাকা চুরি নয়, বই চুরি নয়, ভীড়ের সুযোগে মেয়েছেলের গায়ে হাত নয়, মাগনা খাটতে রাজি হয়নি বলে। একটানা যুক্তি সাজিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে পারেনা রোগা লোকটা। তবু চোরা আত্মপ্রসাদের মতো কিছু একটা। ওর কাজটার দাম আছে। একটা পয়সা না দিয়ে, পয়সা চাইতে গেলে চা মুড়ির দামের কথা তুলে, গালি দিয়ে ভাগিয়ে দিল যারা বরাবর, ওর অভাবটা এতটাই ক্ষিপ্ত করে দিল তাদের। এতটা স্পষ্ট ভাবতে পারেনি। আবছা ভাবনাটা ছুঁয়ে গেছে। আর সেটাই ওর অগোছালো ভঙ্গিতে বউকে বলতে গেলে বউ পাথরের মতো মুখে বলেছিল বাবুদের বাড়িতে রাণাদা এল আই সি করে। আমাকেও বলছিল, কখন কি বিপদ আসে - সামনের মাসে একটা পলিসি খুলিয়ে দেব তোমার নামে। আমার মাসমাইনে থেকেই টাকা কেটে জমা পড়ে যাবে। অনেক দিন পর যেন সুলতাকে ভালো করে দেখছে রোগা লোকটা। আগের মতো আর অত রোগা নেই। ধমক দিয়ে থামাতে পারলোনা। ও এখন বউয়ের থেকে রোগা। বউ বললো কেঁদোনা তো। ব্যাটাছেলেদের চোখে জল দেখলে টক ঢেঁকুর ওঠে আমার।
এর পর এই ছোটলোকের গল্পের শেষটা একটা বাঁক নেবার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। শেষটা অন্যরকম হবার সম্ভাবনায় সকলে টান টান। ব্যাপারটা পুরো পাঁচ কান না হলেও একটু ছড়িয়েছিল। বউ কাউকে বলেছে, এক জন থেকে আরেকজন। দশ দিন পর কালশিটের দাগ নিয়ে ফের যেদিন ট্রেনে, কয়েকজনকে সুযোগ মতো বলেছে ও-ও। বহু বছর ধরে বেচা কেনা করতে করতে একটা সম্পর্কের মতো কিছু। বউকে খবরটা দেবার জন্যে ছটফট করছিল। একটা ট্রেন ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে বসে ছিল সুলতার কাজ সেরে ফেরার অপেক্ষায়। অনেক দিন পর দুটো পান নিয়ে ফিরেছিল। --দাঁড়াও ভাতটা বসিয়ে এসে শুনছি। --কাগজে চিঠি বেরোবে, জানো? বউ বলে, তোমার মার খাওয়ার কথা? --যতটা দুচ্ছাই করো তোমার বরের দাম তার চেয়ে একটু বেশি। --নাম দেবে ঐ সমু, কি তনু ডাক্তারের? তোমার নাম? --কি জানি। কাল থেকে কাগজগুলো দেখতে হবে খুঁটিয়ে। কাগজে বেরোলে ওদের পত্রিকা পটল তুলবে। এক কাপ চা এনে দিয়ে বউ বলে, এত বার বললাম থানায় যেতে। চিরটা কাল ভয়ে ভয়েই রইলে। --সবেতে অত হুটপাট করে কাজ হয়না। অনমিত্রদা-রা পরের শনিবার ওদের পত্রিকা উদ্বোধনের দিন আমাকে দিয়ে বলাবে। চিঠি করে, সই নিয়ে মেলার অপিসে জমা দেবে। সুলতার পাথরের মতো মুখটা নরম হয় কত দিন পর। --শনিবার তাহলে আমিও যাবো। ছুটি নিয়ে আসবো কাজের বাড়ি থেকে। দেরাজ খুলে শাড়ি, জামা বাছতে বসে ওর রোগা বউটা, যে নাকি এখন অত রোগা আর নেই।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু বাঁকের মুখে এসে আটকে গেল এই ছোটলোকের গল্পটা।
ব্যাপারটা এরকম হল, সভায় যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা সকলেই বেশ মোটাসোটা। মঞ্চে একের পর এক বক্তৃতা। রোগা লোকটা বউকে নিয়ে শেষের সারিতে। সভা এগিয়ে যাচ্ছিল। কত ভালো কথা যে উড়ে বেড়াচ্ছিল ঘরটায়। বউটা উশখুশ করছিল। --ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে তো। কেউ তো থাকছেই না; নিজের কথা বলা হয়ে যেতেই কোন বাহানায় চলে যাচ্ছে। বউকে কি বলবে বুঝতে পারছিল না, অস্বস্তি বেড়ে চলছিল। একটা কথাও আর কানে ঢুকছিল না ওর। শুধু ঘড়ির কাঁটাটার দিকে নিষ্পলক।
অনমিত্রদা কখন এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে খেয়াল করেনি। বউয়ের কনুইয়ের খোঁচায় চমকে ওঠে। - আসলে আজকের সভার সুরটা যে তারে বাঁধা হয়ে গেল, বুঝলি কিনা, যে আর এই সব মারামারি আর ছোটলোকোমির কথা তুললে একদম তাল কেটে যত। তুই চলে আসিস না একদিন সময় করে আমাদের পত্রিকার অপিসে। আমরা ক-জন বসবো। তোকে আমাদের টিমেই নিয়ে নেব, বুঝলি। একটু হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে দিস, তোর মতো লোক একটা অ্যাসেট। ঐ শালারা সম্মান দিতে পারলোনা। চা খেয়ে যাস কিন্তু। বিস্কুট শেষ হয়ে গেছে বোধহয়, চা আছে। লেবু চা’টা এরা ফাটাফাটি করে।
শেষ ট্রেন ধরে ফিরছিল ওরা। ফাঁকাই ছিল। সীট পেয়েছিল পাশাপাশি। কথা বলেনি কেউ-ই। স্টেশনে নেমে দেখে পানওয়ালাও গুমটি বন্ধ করে ফিরে গেছে।