• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গল্প
    Share
  • ইমতিয়াজ মিয়াঁর ফ্যাশন : অতনু দে


    চার কুড়ি পার করলেও ইমতিয়াজ মিয়াঁর জিন্দেগীতে রঙের অভাব নেই। চুলেতে রং আর দাড়িতে মেহেন্দি লাগিয়ে, তিন নম্বর বউয়ের হাতের জর্দার কৌটো থেকে এক চিমটে উমদা বেনারসী জর্দা মুখে ফেলে, গোলাপীর ওপর আগাগোড়া সোনালী সুতোয় ঠাসা-কাজ করা মিহি পাঞ্জাবী পরে দোকানে এসে বসেন রোজ বিকেলবেলায়। তখন তাঁর দাড়িতে আর কানের পিছনে থাকে এক ফোঁটা করে ফিরদৌস ইত্বর, যার খুশবু একেবারে বড়োরাস্তা অব্দি পৌঁছে যায়। মল্লিকবাজার অঞ্চলের লোকেরা যাবার পথে সেলাম বাজিয়ে যায়। পুরনো খদ্দেররাও জানে যে এই সময়ই মিয়াঁসাহেব দোকানে থাকবেন, তাই তারাও বেছে বেছে এই সময়টাতেই এসে পড়েন।

    মল্লিকবাজারের বড়ো রাস্তা থেকে ডানদিকে ঢুকে আসা দু-নম্বর গলির মুখেই “সুলেমান আলি অ্যান্ড সন্স”-এর প্রাচীন দরজির দোকান। একশো বছরের বেশি পুরনো। ইমতিয়াজের ঠাকুরদা সুলেমানের হাতে এর জন্ম হয়েছিলো। এখন ইমতিয়াজের হাতে। অবশ্য ইমতিয়াজের মেজো আর ছোট ছেলে অনেকটাই দেখে দেয়। কিন্তু সূক্ষ্ম কাজ এলে ইমতিয়াজকে হাত লাগাতেই হয়। চোখে দেখে না ভালো, তাই সোনার দোকানের স্যাকরাদের মতো চোখে একটা ‘আই-পীস” লাগিয়ে সেলাই করে। আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া বাঁ-হাতে কাঁচি চালায় স্রেফ আন্দাজেই। কিন্তু ওই ছানি-পড়া চোখের আর আড়ষ্ট আঙ্গুলে যে অসম্ভব সূক্ষ্ম কাজ তোলে ইমতিয়াজ, তার জন্যেই দেশ-বিদেশ থেকে ওর পুরনো খদ্দেররা ফিরে ফিরে আসে।

    সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে ইমতিয়াজ। হাল আমলের ফ্যাশন সম্পর্কে সে রীতিমত ওয়াকিবহাল, নতুন সব ডিজাইন তার নখদর্পণে। বড়ো ছেলে মুনাব্বর এই ব্যাপারে বেশ সাহায্য করেছে। মুনাব্বর দরজি হয় নি, সে একটা বিউটি পার্লার খুলেছে পাশেই। নতুন ফ্যাশনের সব বই, পত্রিকা, বিজ্ঞাপনের ছবি - এসব নিয়ে আসে বাবার জন্যে। সেইসব সুন্দরীদের ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাদের জামাকাপড়ের স্টাইল মনে তুলে নেয় ইমতিয়াজ।

    বিদীপ্তা – মানে আমাদের বীথি – তো কলকাতায় এসেই প্রথম দৌড়য় সুলেমান অ্যান্ড সন্স-এর দোকানে। আমেরিকা থেকে প্রতিবছর বা প্রতি দু-বছরে একবার আসেই। তখন একরাশ ব্লাউজ করিয়ে নিয়ে যায়। সে ব্লাউজ যে-সে করলে হবে না, খোদ মিয়াঁসাহেবকে নিজের হাতেই করতে হবে। সে যতো খরচাই হোক না কেন। সুলেমান অ্যান্ড সন্স-এর খ্যাতি আছে – এরা দেরী করে না, আর কথার নড়চড় হয় না। যে ডেট দেয়, সেই দিনে ব্লাউজ রেডি থাকবেই। ইমতিয়াজ আলির “জুবানের কীমত” অনেক, সকলেই জানে।

    বীথির মা-ও সঙ্গে এসেছেন। প্রতিবারেই আসেন। এই মল্লিকবাজার অঞ্চলে মেয়েকে একা ছাড়তে ওনার ঠিক সাহস হয় না – তা সে মেয়ে বিলেত গিয়ে যতই তালেবর হোক না কেন। তাছাড়া বীথির মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস এই ইমতিয়াজ ওঁর মেয়েকে নির্ঘাত ঠকিয়ে দেবে। বিলেতে থাকে তো, এখানকার দরাদরি ও কখনো পারে? তায় আবার এ ব্যাটা “মোসলা”। বীথির মা মোটে পছন্দ করেন না এই ইমতিয়াজটাকে। কিন্তু বীথিকে বললে শুনবে নাকি? তাই আপন মনেই গজগজ করেন উনি।

    বীথির সঙ্গে ইমতিয়াজের কথা চলছে। বীথি বেশ অনেকগুলো কাপড় এনেছে, ইমতিয়াজ তার ওপর কি ধরনের সেলাইয়ের কাজ হবে, সেগুলো নিয়ে কথা বলছিলো। কথা শেষ হবার পর বললো, “লেকিন দিদি, সুতোর কাম তো ঠিক আছে, একটু নায়া ডিজাইন আজমাকে দেখুন। এখন তো পিঠ কাটা ডিজাইনই চলে - একটা করবো নাকি?”

    এটা পুরনো আলোচনা। আমেরিকায় অনেক বছর থাকলেও বীথির পোশাকের পছন্দ ভীষণভাবে সাবেকী। তার ব্লাউজ আজো লম্বা, গলা বন্ধ। তার ওপর সুতোর কাজ নানারকম হতে পারে, কিন্তু পিঠ-কাটা ব্লাইজের কথা সে ভাবতেই পারে না। কাজেই এড়িয়ে গেলো বীথি।

    নিঃশ্বাস ফেললো ইমতিয়াজ। “কি আর বলবো দিদি তোমাকে। তুমি তো শুনবেই না আমার কথা।" বলে বীথির মায়ের দিকে তাকালো। “মাসীমা, আপনি একটু সামঝান এঁকে। এতো ওল্ড-ফ্যাশান হলে চলে এই জামানাতে?”

    বলেই ইমতিয়াজ গলা নামিয়ে ফেললো। বীথির মায়ের কানের কাছে মুখ এনে প্রায় ফিসফিস করে বললো, “আপনার জন্যে একটা ব্যাকলেস চোলি বানিয়ে দিই? ট্যাসেল দিয়ে? কুছু ভাববেন না, আমার বেটা একদম মুনাসির দামে আপনার ব্যাকাসিয়াল করে দিবে। উসব কালা-উলা কি সব বলে – ব্লেকহেড না কি, সারা নিকাল দেবে। ওর নয়া ডায়মন্ড-মেশিন আর হারবাল প্যাক দিয়ে। কি বোলেন? করবো?"

    ***

    ইমতিয়াজ মিয়াঁ আজকাল দোকানে আসেন না। বয়েস হয়েছে, তাছাড়া বাঁ কানে একদম শুনতে পায় না এখন।

    সেবারের সপাটে মারা থাপ্পড়টা একদম কানের ওপরই পড়েছিলো কিনা!


    (এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'বসন্ত সন্ধ্যা')




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments