এতদিন বাদে মা কে পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছিল রবির।
সেই কবে ছোটবেলায় একবার মা কিছুদিনের জন্য তাকে বাবার কাছে রেখে মামার বাড়ি গেছিল। প্রথম দিন সকাল থেকে দুপুর ইশকুল, তারপর খালপাড়ের মাঠে হুটোপাটি করে ঘরে ফিরে দেখে সাদা থান পরা ঠাকুমা পাকঘরে, টেমির আলোয় ডালে সম্বরা দিচ্ছে। তাকে দেখে বলল, হাত পাও ধুইয়া আয় দাদা, ভাত দেই। অমনি মার গায়ের মিষ্টি গন্ধটা মনে পড়ে গেছিল, খেতে বসে ভাতের দলা গলায় আটকে যাচ্ছিল তার।
রাতে বাবার পাশে শুয়ে পড়লেও তার ঘুম আসছিল না কিছুতে সেদিন। শেষে অনেক রাতে প্যাঁচার খ্যা খ্যা করা ডাক শুনে তড়াক করে উঠে বসে কান্না জুড়ে দিয়েছিল। তাকে থামানো যাচ্ছিলো না কিছুতে। কান্নার তাড়সে ভোরবেলা জ্বর এসে গিয়েছিল।
বাবা চিন্তিত মুখে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তবে কি ...। ঠাকুমা রবিকে বুকে চেপে ধরে বলেছিল, র দাদা। কান্দে না। আর দুইডা দিন, তর মায় আইসা পড়বো।
দিনের বেলাটা কেটে যেত কোনোমতে। সন্ধ্যাবেলা বাবা চানাচুর-লজেন্স, ছবির বই নিয়ে আসত, সেটাও ভাল লাগত খুব। কিন্তু রাত হলেই বালিশে মুখ গুঁজে রবি একটু কেঁদে নিত। তারপর একদিন সকালে ঠাকুমার উলু দেওয়ার শব্দ শুনে জেগে ওঠে রবি, বাইরে উঠানে এসে দেখে, তার মা একটা পিঁড়িতে বসে আছে। কোলে কাপড়জড়ানো লালমত একটা খুদে জীব ছোট ছোট হাত নাড়ছে, আর বিড়ালছানার মত মিউ মিউ করছে। নাপিত-বৌ এসে হাতপায়ের নখে ক্ষুর ছুঁইয়ে , পায়ে আলতা পরিয়ে সিধে নিয়ে চলে গেলে, ঠাকুমা তাকে ডাকলো, আয় দাদা, মায়ের কোলে গিয়া বস।
মাকে দেখতে ভারি অন্যরকম লাগছিল। সুন্দর। আর এতদিন পরে তার একটু লজ্জা-লজ্জাও করছিল। মা বারবার ডাকার পর সে আস্তে আস্তে মার কোল ঘেঁষে বসেছিল। ইস, বাবার যদি তখন একটা ক্যামেরা থাকতো!
আজকে মাকে সামনে পেয়ে রবির সেদিনেরই মত আনন্দ, বিস্ময় আর একটু একটু লজ্জা করছিল। তাও ডান হাতটা বাড়িয়ে মার শাড়ির খুঁটটা ধরতে চাইল। মা সেইদিন একপাশে রবি আরেক পাশ ভাইকে নিয়ে শুয়ে গুনগুন করে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু ঘুম এলে তো। আজকে কিন্ত ঘুম পাচ্ছে খুব।
ঠিক এইসময় মার ঠোঁট নড়ে উঠলো, রবু, ঘুমোবি না?
--তুমি এখন কোথায় যাবে?
--আমি আর কোথাও যাবো না।
--মা, এখন আমি জানি বাচ্চারা কেন ঘুমোনোর আগে কাঁদে, বায়না করে, খিটখিট করে!
--কেন রবু?
--ওরা ভাবে শুয়ে পড়লে বুঝি আর উঠতে পারবে না। আর বল, বন্দুক কিচ্ছু নিয়ে খেলা হবে না। যত চোখ জড়িয়ে আসে ওরা তত ভয় পেয়ে যায়।
--ঠিক!
--বারবার এরকম ঘুমিয়ে পড়া, আবার জেগে ওঠা দেখে তবেই ওরা ভরসা পায়, ঘুমোনোর আগে আর কাঁদে না, বলো?
--আচ্ছা বাবা, তাই। এবার ঘুমো। আমি আছি।
রবির চোখ দুটো জড়িয়ে আসে। দূরে কোথাও কি গান চলছে কোথাও। যাক গে।
সুপ্রতীকের হাতে খোলা বই, কিন্ত চোখ বোধহয় লেগে এসেছিল। ববিতা, স্টাফ নার্স ইন চার্জ, ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল তাকে, সতেরো নম্বরে প্রেসার ড্রপ করছে। পালস পাচ্ছি না। বাড়ির লোককে কি খবর দেব ডাঃ রায়?
সুপ্রতীক বই ফেলে দৌড়তে দৌড়তে বলে, আটাত্তর বছর, তাও সিপিআর করতে হবে। কষ্ট দিতেই হবে। আপনি আসুন, বাড়ির লোককে খবর রিসেপশন না হয় দেবে। কি নাম যেন, রবিশংকর না রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
(এই সংখ্যায় অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়-র আরো একটি গল্পঃ 'আরশীনগরের পড়শী')