• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • বাঘের ছানা আর হাতির ছানার গল্প : কৌশিক ভট্টাচার্য


    বাঘের ছানার মন খুব খারাপ। দোষের মধ্যে সে একটু মোটা আর সেজন্য বেশি লাফালাফি করতে পারে না। ওর দুই দাদারা ওর চেয়ে মাত্র দশ আর কুড়ি মিনিটের বড়। তাদের সাথে মারপিট করতে গেলে ও সবসময় হেরে যায়। ওর দাদারা এক ধাক্কায় ওকে মাটিতে ফেলে দিয়ে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে আর ওকে “হাতি” বলে ডাকে। পেট ভরে মাংস খাবার আগেই মা থালা সরিয়ে দিয়ে বলে, “থাক, আর খেতে হবে না! যা গিয়ে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ওজন কমা আগে!”

    দৌড়-ঝাঁপ করতে বা খেলতে যেতে একটু-ও ভালো লাগে না বাঘের ছানার। আগে জঙ্গলে ওদের ব্যাঘ্রনিবাস পাড়ার বাচ্চারা সবাই মিলে একসাথে যখন খেলতো তখন বাঘের ছানাও সেখানে যেতো। কিন্তু এক দলের সাথে আর এক দলের খেলা হলে কেউ ওকে দলে নিতে চাইতো না। বলতো, “তুই তো মোটা হাতি, তোকে আমাদের দলে নিলে আমরা নির্ঘাত হারবো।” কেউ কেউ আবার বলে উঠতো, “এই হাতি, হাঁটু মুড়ে বোস, আমরা তোর পিঠে চেপে ঘুরবো।” রেগে গিয়ে বাঘের ছানা এখন তাই আর পাড়াতে খেলতে বেরোয় না। আর একা একা কি খেলা যায়?

    স্কুলে পড়াশোনায় (অর্থাৎ কিনা মারামারিতে) বাঘের ছানা সবার পিছনে। ওদের টিচার ব্যাঘ্রাচার্য ওর উপর এতটাই বিরক্ত যে ওকে বলে দিয়েছেন যে এর পরের পরীক্ষাতে অন্তত দশ ফুট লাফাতে না পারলে ওকে ধরে কামড়ে দেবেন। এই নিয়ে বাবার কাছে দুঃখের কথা বলতে গেছিলো বাঘের ছানা, কিন্তু বাবা দাঁত মুখ খেঁচিয়ে ওকে বলে দিলেন, “ব্যাঘ্রাচার্য ঠিক-ই তো বলেছেন। তুই বাঘ না গোরু যে দশ ফুট লাফাতে পারবি না?”

    বিকেল বেলা বাড়ির পাশে প্রাণপণে লাফানো প্র্যাকটিস করছিলো বাঘের ছানা। হঠাৎ করে ওর দুই দাদা সেখানে এসে ওর লাফানো দেখে হো হো করে হাসি জুড়ে দিলো। বিরক্ত হয়ে বাঘের ছানা ঠিক করলো এদের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো।


    ***

    বাড়ির থেকে অনেক দূরে চলে এলো বাঘের ছানা। জঙ্গলের এদিকটাতে আগে কখনো সে আসে নি। জঙ্গল এখানে একটু হালকা, ওরা যেখানে থাকে সেখানকার মত ঘন নয়।

    সামনে একটু ফাঁকা ঘাসজমি। সেদিকে তাকিয়ে বাঘের ছানা দেখে কি একটা হাতির ছানা একটা বড় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে। দেখে হাসি পেলো বাঘের ছানার, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজের কথা মনে হওয়ায় হাসি চেপে ওকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি রে, এত লাফাচ্ছিস কেন?”. হাতির ছানা বিরক্ত হয়ে বললো, “কেন, দেখছিস না বল-টা দু ডালের ফাঁকে আটকে গেছে, নামাতে পারছি না!” বাঘের ছানা হেসে বললো, “ও, এই ব্যাপার, তা ওটা তো মাত্র আট ফুট উঁচুতে! দাঁড়া!” বলে এক লাফে বাঘের ছানা আট ফুট লাফিয়ে বল-টা পেড়ে আনলো।”

    হাতির ছানা হাঁ করে ওকে দেখে বললো, “আরে, তুই তো দারুন লাফাস! আমাকে শিখিয়ে দিবি?”

    এবারে বাঘের ছানার অবাক হবার পালা -- “আমি? আমি তো লাফাতেই পারি না!”

    হাতির ছানা কিন্তু কিছুতেই তা মানতে রাজি নয়, বলে, “বাজে বকলেই হলো, কই আমি তো আমার চেনাজানার মধ্যে আর কাউকে এরকম লাফাতে দেখি নি। নে নে চল, তাড়াতাড়ি লাফানো-ঝাঁপানো যা যা জানিস সব শিখিয়ে দে আমাকে।”

    হাতির ছানার সাথে সেই থেকে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো বাঘের ছানার। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরার সময় ওর মনে হলো এত খুশি এর আগে ও কখনো হয় নি।


    ***

    সেই থেকে বাঘের ছানা রোজ বিকেলে বন্ধুকে দৌড়োনো, লাফানো আর শক্ত শক্ত আরো সব কসরত শেখাতে যায়। আগে এসব করতে ওর ইচ্ছে করতো না। কিন্তু এখন ও রোজ কখন বিকেল হবে তার জন্য মুখিয়ে থাকে।

    হাতির ছানার সব কিছু শেখার ভীষণ আগ্রহ। আর সব সময় বন্ধুকে ও তোল্লাই দিয়ে যায় আর বলে, “দারুন করছিস, দারুন করছিস!” বন্ধুকে সব শেখাতে তাই বাঘের ছানার-ও সত্যি সত্যি-ই দারুন লাগে। আর এই করতে করতে ও বুঝতে পারে ও নিজেও আগের থেকে আরো অনেক ভালো দৌড়-ঝাঁপ করতে পারে।


    ***

    একদিন সেই ঘাসজমিতে পৌঁছে বাঘের ছানা দেখে বন্ধু বসে আছে।

    উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে হাতির ছানা। বললো, “জানিস, আমাদের স্কুলে টিচার আজ আমার লাফানোর খুব প্রশংসা করেছেন!”

    বন্ধুর জন্য খুশি হলেও নিজের কথা ভেবে একটু খারাপ লাগে বাঘের ছানার। আর দু’মাস পরে পরীক্ষা, কি যে হবে সে দিন!

    হাতি-র ছানা বোঝে বন্ধুর মন খারাপ। বলে, “কিছু হয়েছে? স্কুলে বকেছে?”

    বন্ধুকে সব খুলে বলে বাঘের ছানা।

    সব শুনে হাতির ছানা গম্ভীর হয়ে যায়, বলে, “দৌড়-ঝাঁপ, লাফানো-ঝাঁপানো তো তোকে শেখাতে পারবো না, সে সব তুই আমার চেয়ে আরও অনেক ভালো জানিস, তবে গায়ের জোর কি করে বাড়ানো যায় সেটা কিন্তু তোকে শিখিয়ে দিতে পারি!”

    -- তাই?

    তখন বাঘের ছানা আর হাতির ছানা দু-জন্যে মিলে ঠিক করলো, এবার থেকে শেখানো-টা আর এক তরফা হবে না! দুজনেই নিজেরা যা যা অন্যের চেয়ে ভালো জানে, তা একে অন্যকে শেখাবে। দুজনে মিলে আরও ঠিক করলো, দুই বাড়ির আর কাউকে কিচ্ছু বলবে না ওরা কি করছে। ঠিক সময় আসুক, তখন বলবে।


    ***

    তারপর থেকে রোজ বিকেলে ওরা দুজনে মিলে নানা রকম কসরত করে আর খেলে। অন্য সব খেলায় বাঘের ছানা বন্ধুর চেয়ে ভালো হলেও, ওজন তোলা বা কুস্তিতে কিছুতেই বন্ধুর সাথে এঁটে উঠতে পারে না। তবে মজার ব্যাপার হলো বেশ কিছু দিন ধরে চেষ্টা করে করে এখন দেখে যে আগের চেয়ে অনেক বেশি ওজন ও তুলতে পারছে। এসব দেখে ওর আরো ভালো করার আগ্রহটাও অনেক বেড়ে যায়।

    বাড়িতে বা স্কুলে কেউ এখনো কিচ্ছু জানে না। বাড়িতে বাঘের ছানা দাদারা যা যা বলে সব চোখ-কান বুঁজে সহ্য করে যায়, আর স্কুলে সারাটা সময় ব্যাঘ্রাচার্যর মুখের দিকে ভ্যাবলার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।


    ***

    একদিন খেলতে খেলতে ওদের বল-টা আবার সেই প্রথম দিনের মতো গাছের ডালে আটকে গেলো। এবার আরো অনেক উঁচু ডালে।

    বাঘের ছানা খুব মুষড়ে পড়লো, “যা:, গেলো এবার! একেবারে নতুন বলটা!”

    হাতির ছানাও হাঁ করে দেখছিলো বলটাকে, বললো, “একবার লাফিয়ে দেখবি?”

    বাঘের ছানা ঘাড় নাড়লো, “না রে, দেখছিস না ওটা অন্তত বারো ফুট উঁচুতে। মই লাগবে।”

    হাতির ছানা বললো, “একবার চেষ্টা করেই দেখ না, কোনো ক্ষতি তো নেই!”

    প্রথম লাফে না পারলেও, দ্বিতীয় লাফে বলটাকে পেড়ে আনতে পারলো বাঘের ছানা। কিন্তু তারপরে যা হলো তা বলার নয়। আনন্দে ডিগবাজি খেতে খেতে চেঁচাতে লাগলো বাঘের ছানা, “বারো ফুট! বারো ফুট! যাক বাবা, আর কাউকে পরোয়া করি না।”


    ***

    স্কুলের পরীক্ষাতে কি হলো তাও কি আর বলে দিতে হবে?

    বাঘের ছানার লাফানোর পালা এলে বাকি সকলের কি হাসি, মজা জমবে এবারে। কিন্তু প্রথম চেষ্টাতেই বাঘের ছানা যখন বারো ফুট পেরিয়ে গেলো, তখন সবাই হাঁ। স্কুলের বাকি সবাই, এমনকি ওর দুই দাদাও বললো, “নিশ্চয় তুই চোট্টামি করেছিস, আবার লাফা!”

    চোট্টামি? মাথা গরম হয়ে গেলো বাঘের ছানার। হাতের কাছে যে ছিলো তাকেই লাগিয়ে দিলো এক ঘুষি।

    দেখতে দেখতে ধুন্ধুমার মারামারি লেগে গেলো। কে কাকে মারছে, কেন মারছে তার কোনো ঠিক নেই, কিন্তু মারছে। ছাত্ররা মন দিয়ে মারামারি করছে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে ওদের টিচার ব্যাঘ্রাচার্য-ও হাতের কাছে যাকে পেলেন তাকে ধরে পেটানো শুরু করলেন।এমন তো করতেই হবে, এটা তো মিনমিনে মানুষদের স্কুল নয়, বাঘেদের স্কুল। ছাত্ররা প্রাণভরে মারামারি না করলে শিখবে কি? জঙ্গলে বাকি সবাই তাদের বাঘ বলে মানবেই বা কেন?

    যুদ্ধ অবশ্য বেশিক্ষণ চললো না, মার সইতে না পেরে অর্ধেক গেলো পালিয়ে। আর বাকি অর্ধেক তো ভয়ে গাছেই উঠে পড়লো। যুদ্ধর শেষে দেখা গেলো আমাদের বাঘের ছানা ব্যাঘ্রাচার্যকে মাটিতে পেড়ে ফেলে তাঁর গোঁফ ওপড়াচ্ছে আর ওর দুই দাদা একটা বড় গাছের মগডালে বসে তা হাঁ করে দেখছে।

    লড়াই শেষে ব্যাঘ্রাচার্য খুব খুশি হয়ে বাঘের ছানার পিঠ চাপড়ে দিলেন, তারপর উপড়োনো গোঁফের জায়গাটাতে থাবা বোলাতে বোলাতে বললেন, “কাল থেকে আর তোকে স্কুলে আসতে হবে না, ছোট ছানাগুলো তোকে দেখে ভয় পাবে।”


    ***


    সব-ই হলো।

    দাদারা এখন বাঘের ছানাকে বেশ তেলিয়ে চলে, রোজ এক্সারসাইজ করে বলে মা ওকে আরও বেশি বেশি করে মাংস খেতে দেয় আর সেদিন স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে মাথায় একটা গাঁট্টা দেওয়ার পর থেকে ওর বাবা আর ওর ধারেকাছে খুব একটা ঘেঁষে না।

    কিন্তু বাঘের ছানার একটা দুঃখ রয়েই গেলো। বাঘ-বন্ধুদের মধ্যে ওর “হাতি” নাম-টা আর ঘুচলো না। এই নিয়ে হাতি-বন্ধুর কাছে একটু দুঃখ করতেই হাতির ছানা চোখ পাকিয়ে বললো, “কেন? হাতি হওয়া কি খারাপ?” তারপরই বন্ধুর দিকে চোখ টিপে ফিসফিস করে বললো “জানিস আমাকেও না এখন স্কুলে সক্কলে বাঘের বাচ্চা বলছে!”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments