• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • চেনা অচেনা : অনন্যা দাশ


    ন্টুকে আমি দাদা বলি না, ঝন্টু বলেই ডাকি। ও যদিও আমার চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়, তাও না! আমি আমার দাদু দিদার কাছে থাকি সেই ছোটবেলা থেকেই। আমার মা-বাবা দুবাইতে থাকেন। মাঝে মাঝে আসেন। তাদের নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। দাদু দিদাকেই আমি বেশি ভালবাসি।

    যাই হোক, যা বলছিলাম, আমার দাদুর খুব নরম মন। কারো দুঃখের কথা শুনলেই গলে জল হয়ে গিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে চলে আসেন! যেমন আলপনামাসি, যে আমাদের বাড়িতে রান্নাবান্নাতে দিদাকে সাহায্য করে তাকেও দাদুই নিয়ে এসেছিলেন। তখন মাসির বয়স বারো। মাসির বাবা নাকি দাদুর কাছে এসে কেঁদে পড়েছিলেন যে মেয়েগুলোকে খাওয়াতে পারছেন না। দুঃখে দাদুর মন ভিজে গেল আর আলপনামাসি আর তার বোন কল্পনামাসিকে দাদু নিজের বাড়িতে রেখে আমার মার সঙ্গে নিজের মেয়ের মতনই বড় কর তুললেন। কল্পনামাসি বিয়ে হয়ে আসানসোল চলে গেছে কিন্তু আলপনামাসির বিয়ে কাছেই হয়েছে তাই সে রোজ সকালে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আমাদের এখানে চলে আসে দিদাকে সাহায্য করতে।

    এমনি করে বিভুদা, শঙ্করদা, পরিতোষদা সবাই কোন না কোন সময় আমাদের বাড়িতে ছিল। আর এখন এসেছে ঝন্টু। আগের তিনজন দাদুর সঙ্গে দোকানে কাজ করত তাই দাদু তাদের আমাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন। বিভুদা আর শঙ্করদাকে এমন তেমন চিনতাম না কারণ ওরা যখন এখানে ছিল তখন আমি খুব ছোট কিন্তু পরিতোষদা মানে পিটিদাকে আমি খুব ভালবাসতাম। ভারি মজার লোক ছিল সে। আমার সঙ্গে কত খেলত। আর কত রকমারি উপহার দিত সে আমাকে। না, বড় কিছু না, ছোট ছোটই কিন্তু সব আমার পছন্দের জিনিস। চকোলেট, বা টেডি বিয়ার বা নেল পালিশ এই সব। বেড়াতেও নিয়ে যেত আমাকে। ইকো পার্ক, ওয়াক্স মিউজিয়াম, নিকো পার্ক – খুব মজা হত। আমার প্রাণের বন্ধু অ্যানি মানে অন্বেষাও আমাদের সঙ্গে যেত মাঝে মাঝে। অ্যানি প্রায়ই বলত, “তুই কী লাকি রে! আমার যদি তোর পিটিদার মতন একজন দাদা থাকত!”

    আমাদের অত আনন্দের মধ্যে পিটিদা হঠাৎ দুম করে কোথায় চলে গেল আর ফিরে এল না। আমি খুব কাঁদলাম কাটলাম। দাদু দিদার ওপর অনেক চিৎকার করলাম, বললাম, “কী করেছো তোমরা? তোমাদের জন্যেই পিটিদা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে!” ইত্যাদি।

    ওনারা অবশ্য তার উত্তরে কিছুই বললেন না। মুখ কালো করে বসে রইলেন। প্রচুর চিৎকার চেঁচামেচি করেও কোন ফল হল না। পিটিদা আর ফিরে এল না। উলটে মাস ছয়েক বাদে একদিন দাদু ঝন্টুকে নিয়ে এলেন। ব্যাটার যেমন নামের ছিরি তেমনি চেহারা। পিটিদাকে কী সুন্দর দেখতে ছিল আর ঝন্টু থপথপে মোটা! কোন একটা ফ্ল্যাটে না মলে লিফট বয়ের কাজ করে! সেই রকমই কিছু একটা দাদু বলেছিলেন। আমি ঠিক জানি না, জানতে চাইও না!

    দাদু বলেছিলেন, “অসম্ভব মেধাবী ছেলে, সুযোগের অভাবে...”

    আমি কান বন্ধ করে চিৎকার করেছিলাম, “আমি শুনতে চাই না! দূর করে দাও ওকে এখান থেকে!”

    দাদু তখনকার মতন চুপ করে গিয়েছিলেন কিন্তু ঝন্টু আমাদের বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। যত দিন যাচ্ছিল আমার ঝন্টুর প্রতি রাগ ততটাই বাড়ছিল। দিদা ওকে দ্বিতীয়বার ভাত নিতে বলাতে সেদিন আমি মুখ বেঁকিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, আরো ঠেসে ঠেসে ভাত খাওয়াও ওকে! ও এবার একদিন ওর ওই লিফটে আটকে যাবে! আর বেরতে পারবে না!”

    আমার কথা শুনে ঝন্টুর মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। সে দিদাকে বলল, “আর ভাত নেব না মাসিমা। বেশি খেলে আবার ঘুম পেয়ে যায়।”

    ও বেরিয়ে যেতে দিদা রণমূর্তি ধরেছিলেন। দিদাকে এত রাগতে আমি খুব কমই দেখেছি। আমাকে বলেছিলেন, “তুমি বাপু দুবাই গিয়েই থাকো। এখানে আর থাকতে হবে না!”

    তারপর থেকে আমি ঝন্টুকে আর তেমন ঘাঁটাই না। যুদ্ধের পর জোর করে ডেকে আনা শান্তির মতন। শুধু মাঝে মাঝে পিটিদার প্রচুর গুণগান করি ওর সামনে, ওকে লজ্জা দেওয়ার জন্যে। দিদা-দাদু অবশ্য কটমট করে আমার দিকে তাকান তখন।

    একদিন দেখি ঝন্টু দাদুর খবরের কাগজটা নিয়ে পড়ছে! তখনও কিছু বলিনি কিন্তু যখন দেখলাম সে কাচের আলমারি খুলে বাবার কেমিস্ট্রি বই বার করে পড়ছে তখন আর থাকতে না পেরে বললাম, “বাবা তুমি তো টেন পাশ না করেই এম.এস.সির বই পড়ছ দেখছি!”

    ঝন্টু লাজুক হেসে বলল, “হ্যাঁ, স্কুল নাইন পর্যন্তই করেছি তবে নাইট ক্লাস করে করে বি কম পর্যন্ত টেনেছি। আসলে গ্রামের বাড়িতে বড্ড টাকার দরকার তাই ওই লিফট চালানোর চাকরিটা করি। ওটা সহজ কাজ, কোন চাপ নেই। দাদু বলেছেন দোকানে কাজ করব সামনের মাস থেকে।”

    ওই ঝন্টু পিটিদার জায়গা নেবে শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেল। বি কম পাশ করে যেন মাথা কিনে নিয়েছে!

    দাদুকে সেই কথা বলতে বললেন, “ও সত্যিই হিরের টুকরো ছেলে। সব রকমের বই পড়তে ভালবাসে। নাইট ক্লাসে এম কমটাও করছে কিন্তু এতই লাজুক যে কাউকে কিছু বলে না। আমার বয়স হচ্ছে দোকান সামলানোর জন্যে একজন কাউকে চাই।”

    আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম, “তা বলে ঝন্টু!”

    “কেন ঝন্টু কী দোষ করল? ওর মতন পড়াশোনা জানা ছেলে যে দোকানে বসতে রাজি হয়েছে তাতেই আমি খুশি!”

    আমার ভয়ঙ্কর রাগ হচ্ছিল। ওই হোঁদল কুতকুত ঝন্টুটা কিনা পিটিদার জায়গা নেবে!

    আমি বললাম, “ওই লিফটম্যান ঝন্টু তোমার দোকান সামলাবে? ও দোকানের লোকসান করিয়ে ছাড়বে, তুমি দেখে নিও!”

    দাদু কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও না নড়ে বললেন, “সে আমি বুঝব!” বলে টিভিটা এমন জোরে করে দিলেন যে আমার আর কোন কথা বলার সুযোগ হল না।

    এইভাবেই ঝন্টু লিফটম্যান থেকে দাদুর দোকানে গিয়ে বসল আমার প্রবল অমত থাকা সত্ত্বেও।

    এর পর যা ঘটল তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। দাদুর দোকানে একদিন ডাকাত পড়ল। একজন লোক একটা বন্দুক নিয়ে ঢুকে এল দোকানে। ক্যাশবাক্সের চাবিটা চাইল দাদুর কাছে। দাদু বরাবরই জেদি, বললেন, “একি মগের মুলুক নাকি! দেব না চাবি-টাবি!”

    ওমা, লোকটা আর কোন কথা না বলে বা সময় না দিয়ে দুম করে বন্দুকটা চালিয়ে দিল! ওই গুলি দাদুর গায়ে লাগলে দাদু হয়তো মরেই যেতেন কিন্তু ঝন্টু তার ওই মোটা শরীর নিয়ে আশ্চর্য দক্ষতা দেখিয়ে ঝাঁপ দিয়ে গুলি আর দাদুর ঠিক মাঝখানে গিয়ে পড়ল। ফলে গুলিটা ওর কাঁধে লাগল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। গুলির শব্দে আরো লোক জড় হয়ে যেতে ডাকাত বাবাজি পগার পার। অ্যাম্বুলেন্স এসে আহত ঝন্টুকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ক্ষত সারতে বেশ কিছুদিন লেগে গেল।

    আমার স্কুলের পেরেন্ট টিচার মিটিংয়ে এবার আবার দাদু যেতে চাইলেন না। কখনই যেতে চান না। বলেন নাকি দিদিমণিদের ইংরেজিতে বলা কথা বুঝতে অসুবিধা হয়! উফফ কী জ্বালা। এবার বললেন ঝন্টু যাবে। আমি বললাম, “দিদিমণিদের কথা তুমি বোঝো না আর ঝন্টু বুঝবে?” দাদুর হয়ে গুলি খাওয়ার পর ঝন্টুর প্রতি আমি কিছুটা সদয় হয়েছি কিন্তু আমার পেরেন্ট টিচার মিটিংয়ে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি হবে সেটা জানিয়ে দিলাম। দাদু এবার রেগে গেলেন। বললেন, “তোমার ব্যবহারে আমি খুবই দুঃখিত বেশ কয়েকদিন ধরে। তবে একটা কথা জেনে রাখো, তুমি যে পরিতোষ পরিতোষ পিটিদা পিটিদা করে পাগল হও সে কিন্তু অত্যন্ত বাজে লোক ছিল। তুমি এখন ছোট, কথাটা শুনে আঘাত পাবে বলে তোমাকে আগে কিছু বলিনি। সে আমার দোকানের সমস্ত টাকা চুরি করে পালিয়েছিল। পুলিশ মনে করছে যে লোকটা ডাকাতি করতে এসেছিল তাকেও পরিতোষই পাঠিয়েছিল। তাই বুঝতেই পারছ, মানুষ চেনা তোমার কর্ম নয়!”

    দাদুর কথা শুনে আমি এতটাই অবাক হলাম যে আর কিছু বলতে পারলাম না। পিটিদা চোর অথচ এরা এতদিন আমাকে কিছু বলেনি! সেদিন সারাটা রাত ঘুমোতে পারলাম না আমি।

    মিটিঙয়ের দিন সকালবেলা বিমর্ষভাবে ঝন্টুর সঙ্গেই স্কুলে গেলাম। আমাকে ভীষণভাবে চমকে দিয়ে ঝন্টু আমার টিচারদের সঙ্গে পরিষ্কার ইংরেজিতে কথা বলল! আমার তো ভির্মি লাগার জোগাড়!

    স্কুল থেকে বেরিয়ে আমি বললাম, “সামনের পার্কটার বেঞ্চিতে একটু বসবে ঝন্টুদা? তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল!”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments