• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • এ কালী লাভার’স জার্নি : জয়ন্ত নাগ


    Absent Mother God of the West: A Kali Lover's Journey in to Christianity and Judaism; Neela Bhattacharya Saxena; প্রথম প্রকাশ: ২০১৬; লেক্সিংটন বুকস, মেরিল্যান্ড, ইউএসএ; ISBN:978-1-4985-0805-6

    ম্প্রতি ধর্ম বিষয়ে একটি কৌতুহলোদ্দীপক বই পড়ার সুযোগ হল। তবে বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে অথবা ধর্মের নামে যে তাণ্ডব চলছে তাই ধর্ম বিষয়ে কিছু কথা বলার সংকট এবং জটিলতা অনেক। অথচ ধর্মকে পৃথিবীর প্রাচীনতম দর্শন হিসেবে অথবা মানব ইতিহাসের আদি কথন হিসেবে ধরে নিলে এটা নিয়ে আলোচনা বা এর উপর খোলামেলা মতামত প্রকাশ করা যেতেই পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই সময়ে তা হবার নয়। কেননা ধর্মকে এখন দর্শনের জায়গা থেকে সরিয়ে এনে খুব সুচারুভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের অত্যন্ত কার্যকরী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে অথবা তা করার চেষ্টা হচ্ছে দেশে দেশে। তা যেমন ভয়ংকর তেমনি দু:খজনক। তবে গোড়াতেই একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল যে এই বইটি হল ধর্মকে নিয়ে একজন ইতিহাস-সচেতন অধ্যাপকের অনুসন্ধানমূলক ব্যক্তিগত নিরীক্ষা। সেখানে আবেগের চেয়ে ঐতিহাসিক তথ্যের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। যা লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ভাসিত, সম্পৃক্ত ও পরিপূর্ণ। বইটি খুব যত্নসহকারে লিখেছেন অধ্যাপক নীলা ভট্টাচার্য সাক্সেনা। ইংরেজি ভাষায় রচিত এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালে। প্রকাশ করেছেন — লেক্সিংটন বুকস, মেরিল্যান্ড, ইউএসএ।

    নীলা শুরুতেই বলেছেন যে তিনি ২০০৪ সালে ওঁর ‘ইন দ্যা বিগিনিং ইজ ডিজায়ার: ট্রেসিং কালী’স ফুটপ্রিন্ট ইন ইন্ডিয়ান লিটারেচার’ বইয়ের মাধ্যমে মা-কালী চেতনার জগতে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন এই বইটি তারই ধারাবাহিকতায় রচিত। লেখক বলেছেন প্রথম বইতে ভারতের ইতিহাসে ‘বৌদ্ধ চিন্তা’-র জগৎকে একটু ছুঁতে চেষ্টা করেছিলেন, বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। আর এই বইতে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তান্ত্রিক বৌদ্ধ দর্শন বা বজ্রতন্ত্র বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। যে দর্শনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাক্ত পথ বা শক্তির উপাসনা। যার প্রধান দেবী মা-কালী। এবং কালী দর্শনের সঙ্গে বৌদ্ধ দর্শনের যোগসূত্র খুঁজে বের করার অন্বেষণ এই বইয়ের একটা প্রধান দিক। লেখক খুব সহজভাবে নিজস্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে দর্শন, বিজ্ঞান, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ও এই সময়ের জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে জীবনের এক ইতিবাচক বিকল্প অধ্যায় উন্মোচিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন যে পৃথিবীর নানা মরমী বা অতীন্দ্রিয় সাধনার পথ ধর্ম নিরপেক্ষ, বদ্ধমূল ধারণামুক্ত ও নিরীশ্বরবাদের পথ এবং লেখকের মতে তা গভীরভাবে মাতৃতান্ত্রিক বা নারীতান্ত্রিকও বটে। এই বইয়ের মাধ্যমে জানা যায় যে তন্ত্র সাধনার ধারা এসেছে মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে অর্থাৎ এই অনার্য ধারা চলছে আর্যদের ভারতে আগমনের অনেক আগে থেকেই। এখন যেভাবে গুরুভক্তি বা ধর্মগুরুদের প্রভাব-প্রতিপত্তি চলছে সমাজের সর্বস্তরে, তার মূল সূত্র অনেকেরই জানা নেই। কিন্তু এরকম গুরু পূজার অনুমোদন মূল ব্রাহ্মণ্যবাদ বা বৈদিক দর্শনে ছিল না। এটা শুরু হয়েছে তান্ত্রিক বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবে বা বৌদ্ধ ধর্ম থেকেই তা যে এসেছে সেটা বলাই বাহুল্য। এরকম অনেক অভিনিবিষ্ট তথ্যে ভরা এই বই। তবে এই বইয়ের একটা বড় দিক হল কোথাও পাণ্ডিত্য ফলানোর কোন চেষ্টা নেই, যত্রতত্র উদ্ধৃতির ভারে ভারাক্রান্ত নয়। বরং লেখক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে বৌদ্ধ দর্শন বিষয়ক সেমিনারে লেখক বা উপস্থাপক হিসেবে যোগ দিতে গিয়ে কীভাবে বৌদ্ধ দর্শন-এর সঙ্গে ওঁর প্রথম পরিচয় ঘটে এবং সেখানেই অপ্রত্যাশিত ভাবে পেয়ে যান ওঁর শিক্ষককে (কুলাবধূত সৎপুরানন্দ, বৌদ্ধ দর্শন বিশারদ অতীশ দীপংকরের বংশধর)। ধীরে ধীরে এই বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে ওঠেন এবং ওঁর শিক্ষকের একজন তন্নিষ্ঠ অনুসারী হয়ে ওঠেন। এছাড়া তিনি বলেছেন যে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য নানা বৌদ্ধবিহার নিজে চোখে দেখার সুবাদে কী ভাবে তাঁর জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটে। বৌদ্ধবিহারগুলো দেখার অভিজ্ঞতা দর্শনের মতো আপাত নীরস বিষয়েও তাঁকে আগ্রহী করে তোলে, তাঁর ভিতরে অন্যধরনের প্রাণ সঞ্চার করে। নীলার ঝরঝরে গদ্য এবং গতিময় সহজ প্রবাহ বইটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বইয়ের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে জীবনের কথা, জীবনের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার নিবিড় সম্পর্কের কথা। বলা যেতে পারে কালী বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ দর্শনের আলোকে এটি নীলার নিজের জীবনের গল্প। তাই এই বইটি পড়বার জন্যে বৌদ্ধ দর্শন বিষয়ে গভীর জ্ঞান পূর্বশর্ত হয়। সব ধরনের মনোযোগী ও মননশীল পাঠকই এর স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। এবং এই বিষয়ে একজন আগ্রহী পাঠক হয়ে উঠলেও আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না।

    তন্ত্রশাস্ত্র বা তান্ত্রিক সাধনা বিষয়ে সাধারণভাবে আমরা বুঝি — ওঝাগিরি, তুক, জাদুমন্ত্র, ইত্যাদি। আমাদের সাহিত্যে বা অন্য শিল্প মাধ্যমে সেভাবেই বোঝানো হয়েছে বা উল্লেখ করা হয়েছে। তা যে কতটা বিভ্রান্তিমূলক বা ভুল এই বইটা না পড়লে তা জানার সুযোগ হত না। সেই অর্থে এবং আরও অনেক কারণেই বইটি একটি জরুরী পাঠ। তন্ত্রশাস্ত্র যে কতটা গভীরভাবে বৌদ্ধ দর্শন বা বজ্রতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত তা স্পষ্ট করেছেন লেখক। এছাড়া কালী বা তান্ত্রিক দর্শনের অভিজ্ঞতা লেখককে ক্রিস্টিয়ানিটি এবং জুডেইজম বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে। সেই সূত্রে সরাসরি পাশ্চাত্ত্য জগতের বিভিন্ন ধর্ম প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখে সেই সব ধর্মগুলোর মধ্যে মাতৃদেবীর উপস্থিতি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। সনাতন ধর্মে যেখানে মাতৃদেবীর সর্বোচ্চ সম্মান বা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেই আলোকে খ্রীস্টীয় ধর্মের মধ্যে মাতৃদেবীকে প্রাধান্য না দেওয়ার বা পুরোপুরি মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত না-করার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করার প্রচেষ্টা এই বইয়ের আরেকটি বিশেষ দিক। খ্রীস্টীয় ধর্মে কী ভাবে ও কেন মাতৃদেবীর উপস্থিতি বা তাদের প্রভাবকে উপেক্ষা করা হয়েছে সেই কারণগুলো বিশ্লেষণ করার সৎ প্রচেষ্টার জন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই। তবে এই পর্বের আলোচনায় মূল বিষয়ের গভীরতা এবং উপযুক্ত তথ্যের বিস্তারের অভাব কিছুটা লক্ষণীয়। এবং এই আলোচনায় অনেক সময়ই মূল বিষয় থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। যা পরবর্তী সংস্করণে যুক্তিযুক্ত তথ্যে বিশদভাবে আলোচনা করার কথা ভাবা যেতে পারে। সব মিলিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ এবং গবেষণাধর্মী এই বইটি ধর্ম বিষয়ে একটা আলাদা জগৎ উন্মোচিত করেছে। এই বিষয়ে উৎসাহী এবং মনোযোগী পাঠকরা ভেবে দেখার মতো অনেক উপাদান যে খুঁজে পাবেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বইটি অনেক পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক এবং বইটি অনেকের আলোচনার বিষয় হোক সেই প্রত্যাশায় শেষ করছি।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments