The Great Indian Railway Atlas; Samit Roychoudhury (Author & Publisher), 3rd edition. ISBN: 978-81-901457-3-2
মোগল বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের দরবারে ইংলন্ডেশ্বর প্রথম জেমস রাজদূত হিসেবে পাঠিয়েছেন এক অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েটকে, খৃঃ ১৬১৫। স্যর টমাস রো (যিনি পরে সম্রাটের একপাত্তরের দোস্ৎ হয়ে উঠবেন)। তা, বাদশাহ্কে দেওয়া হস্তীদন্তের কাসকেট থেকে জেডপাথর-মুক্তো থেকে আইরিশ হাউন্ড হেন নানাপ্রকার উপঢৌকনের মধ্যে ছিলো এক মানচিত্রও, যেটা জাহাঙ্গীর তাঁর সভাপণ্ডিতদের দিলেন ‘বুঝতে’। মাসখানিক পরে সে-বস্তু ওয়াপস করা হৈল, কারণ তা ‘পড়তে পারে’ এমন পণ্ডিত ভূভারতে নেই! এর কয়েক দশক পূর্বে তাঁর পিতৃদেব সম্রাট আকবরের অনুসন্ধিৎসু মন এক অভিযাত্রীদল পাঠিয়েছিল ‘মহাদেবের জটা’র সন্ধানে। ছয়মাসে পায়ে হেঁটে গোমুখ ঘুরে এসে তাঁরা গঙ্গানদীর উৎসের ভ্রমণকাহিনী গপ্প করে শোনালেন রাজদরবারে, কিন্তু সে যাত্রাপথের মানচিত্র এঁকে রাখার কোনো বালাই নেই, কারণ যে ভারতভূমিতে ‘শূন্য’ থেকে ‘ক্যালকুলাসে’র মত যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছিল সেখানে মানচিত্রবিদ্যা ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।
*
কার্টোগ্রাফি! মানচিত্রবিদ্যা! ইউরোপে যার শুরুয়াৎ খৃষ্টজন্মেরও বহু পূর্বে, ভারতে কি তার কোনো চিহ্নই ছিল না? ছিল, হয়েছিল বহু পরে ল্যামটন-এভরেস্টের হাত ধরে ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভে’-র ছত্রছায়ায়, যখন আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ারও জরিপকার্য শুরু হয়নি। আর আজকের ভারতে National Atlas & Thematic Mapping Organisation (NATMO; প্র. ১৯৫৪ খৃ.) বিশ্বমানের কাজ করে চলেছে, যে-সংস্থার জন্মও এক বঙ্গসন্তানের হাত ধরেঃ ‘Father of Modern Indian Geography’ অধ্যা. শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯০৩ - ৮৯; পদ্মভূষণ ১৯৮৫)। এ’হেন পুরোধাপুরুষের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমান লেখক নবীন এই কলকেতাবাসী কার্টোগ্রাফার শ্রীমান সমিত রায়চৌধুরী হয়তো কুণ্ঠিত হবেন, কিন্তু মেয়ো কলেজ--এনাইডি, আহ্মেদাবাদের এই প্রাক্তনী আজকের পৃথিবীর প্রথম সারির একজন মানচিত্রকার, এবং রেল-মানচিত্রকার হিসেবে এক্কেবারে এক নং, সে-বিষয়ে তো সন্দেহ নেই কোনো। আর্থার রবিনসন বা জোসেফ ব্রিউএর মানের শিল্পী যে ভারতেও একজন আছেন, এবং আরডি/ন্যাটজিও-র মানের মানচিত্র যে ভারতে তৈরী হচ্ছে, এ’ এটলাসের পৃষ্ঠা না উল্টালে প্রতীত হতো না সেটা।
*
শিবের গীত থেকে এবার বইয়ের পাতায় আসি।
প্রচ্ছদে একে ‘Definitive Atlas of the Indian Railway Network’ বলা হয়েছে, এবং তার আগে রয়েছে ‘The’, ‘A’ নয়। এবং সেটা সত্যিই। Indian Rail Fan Club এর সদস্য হিসেবে রেলম্যাপ কম দেখিনি, কিন্তু এ’খানির সঙ্গে সুদূর তুলনীয় এক এটলাসও অদ্যাবধি চোখে পড়েনি। এ’গ্রন্থের Preface লিখতে নালেঝোলে হয়েছেন মার্ক তুলি; রয়স্টন এলিস-করণ দেশাই-নাইজেল প্রেন্টারের মতো ভ্রমণপিপাসুরা বাক্যহারা, এই অধম কলমচির মতই। এ’ এটলাস সমিত প্রথম প্রকাশ করেন সন ২০০৫-এ, ২০১০-এ পরবর্তী সংস্করণ, ২০১৫-তে তৃতীয় মুদ্রণ। গ্রন্থটির অত্যুচ্চ প্রাইসট্যাগ যে মানচিত্রপ্রেমীদের দমিয়ে রাখতে পারেনি এটা তারই প্রমাণ। পুঙ্খানুপুঙ্খ ম্যাপিং কাকে বলে একশত একখানি প্লেটজুড়ে তার মনমোহন প্রদর্শন, সিম্পল একটি দুটি তিনটি রঙের বিন্দি এবং রেখায়! যেমন, ১১ পৃষ্ঠায় ঐ যে দেখি হৃষিকেশ থেকে কর্ণপ্রয়াগ লালচে ডটেড লাইন! রেলপথ বসে গেল নাকি সেথায়? না, শেষের লেজেন্ডসে দেখি ও’ হলো broad-gauge survey for new line. তেমনি, কর্ণাটকে আরবসাগরের তীরের কারওয়ার থেকে হুবলী broad-gauge line under constructionও একটু পৃথক ডটেড রেখায় দেখানো হয়েছে। এমনকী, আমাদের ঘরের পাশের যে শিয়াখালা স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে (পূর্বতন মার্টিন রেলওয়ে), সেটিকেও ভুলে যাওয়া হয়নি, অন্যতর বিন্দিতে ভূষিতা। নেহাৎ রঙের নানান খেলা ও ব্যবহার (মাত্র দু’তিনটি যদিও), নৈলে বলতে ইচ্ছে করতো অন্ধেও বুঝতে পারে এতো সাদামাটায় এতো জরুরি তথ্যের পরিবেশনা। শেষে তেইশ পৃষ্ঠাব্যাপী এক পরিশিষ্টে বারোহাজার স্টেশনের এক তালিকাতেও তিনটি রঙের ব্যবহারঃ হল্ট স্টেশন, ক্লোজড স্টেশন ও অবাণিজ্যিক স্টেশনের দীর্ঘ তালিকা। কত তন্নিষ্ঠতা কত যত্ন করে কতটা নিবেদিতপ্রাণতা দিয়ে এ’ এটলাস নির্মাণ করা হয়েছে, ভাবলে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে মাথা।
*
মানচিত্রপ্রেম, বস্তুত, ধ্রুপদী সঙ্গীতপ্রেমের মতো। সকলেই যে পাতার পর পাতা ম্যাপ উল্টে আনন্দ পাবেন তা নয়, কিন্তু যাঁরা পান তাঁরা বুঁদ হয়ে থাকেন। তাঁদের কাছে ও-ই হলো বিশ্বভ্রমণ। আর তার ইতিহাসটা, তার কল্পনার পক্ষ ওড়ানোটা? জনাই - ডোমজুড় হারানো স্টেশনের নামোল্লেখে শৈশবের স্মৃতি জেগে ওঠে, তো গোরক্ষপুর-নৌতনবা স্টেশনের নাম দেখে ফেলে আসা কর্মজীবনের কথা, বা পুরী-চিল্কার নাম দেখে বুদ্ধদেব বসুর ‘চিল্কায় সকাল’ ঝিলমিলিয়ে ওঠে মধুচন্দ্রিমার স্মৃতিতে।
কল্পনারও পরিমিতি চাই হে! সাধে কি আর টোলকিন সাহেব ‘লর্ড অব দ রিংস’ এর মতো মহা-ফ্যান্টাসি লিখতেও ম্যাপ নিয়ে বসতেন, আর, এক দিনে যতটা-যাওয়া-সম্ভব কল্পনার পাখাকে ততটাই ওড়াতেন?
ঘুড়ির কথা; রথীন পাল; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১২;
ISBN: 978-93-5040-107-1
হ্যাঁ, উপরে এটা একটা বইয়ের ছবি, ঘুড়ির নয়।
বাঙলাভাষায় decorative books বা pop-up books/cards দেখাই যায় না প্রায়, নামী/প্রতিষ্ঠিত হাউজের তো নয়ই। সেই মর্মে এ’খানি এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন, সন্দেহ নেই। আর, পাতা উল্টিয়ে অন্দরে প্রবেশ করলে মুগ্ধতা অগাধ, অগাধ! বাঙলাভাষায় যে প্রায়-নগণ্য/উপেক্ষিত এক গণক্রীড়া নিয়ে এই মানের গ্রন্থ লেখা হয়েছে, হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পুরোটা পড়ে ফেলে তবে প্রতীতি হইল! সাধু, সাধু!
*
এর পরেই ঘুড়ি কী, কী তার স্থানকালের ইতিহাস ওয়গরহ্ ওয়গরহ্ লইয়া গ্রন্থ-সমালোচক মহোদয় এখানে নাতিদীর্ঘ এক ভাষণ, থুড়ি লিখন দিয়া হালকাভাবে আপন পাণ্ডিত্য ফলাইবেন, এমনটাই দস্তুর। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, প্রিয় পাঠক, এ’গ্রন্থের আপাদমস্তক পড়ে ও কিছু নেটপণ্ডিতি ফলিয়ে বা দুটো রেফারেন্স কেতাব হাঁটকে এমন কোনো বিষয় খুঁজে পেলুম না রথীনবাবু যাকে স্পর্শ করেননি। অতএব, এ’স্থলে রিভিউআরের জ্ঞানপরিবেশন বাতুলতা মাত্র; যেটা করণীয় সেটাই করছিঃ পাঠককে আহ্বান জানাই এ বই পাঠের আনন্দটি নিতে। আনন্দর বইয়ের শেষে লেখকের সচিত্র-পরিচিতি দেবার চল আছে একটা। বর্তমানেরটিতে তা নেই দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হলেম, আরও জানতে পারলাম না লেখক সম্বন্ধে।
*
ময়দানী ফুচকা বা জনাইয়ের মনোহরার তার যেমন জিভে না দিয়ে শুধু বর্ণনা করে যাওয়া বে-রহমি, দশপৃষ্ঠা লিখে যেমন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার বা কুরোসাওয়ার ছবির রসাস্বাদন করানো যায় না, তেমনি ছেলেবেলার ঘুড়ি-ওড়ানোর আনন্দ, তা নিয়ে লড়ালড়ি, তার রকমসকম কি কোনো এক বই পড়ে পাওয়া যায়, সম্ভব? সম্ভব, সম্ভব, হে পাঠক। একটি শ’-ডেড়েক পাতার বই অসাধারণ তথ্যবহুল হবার পাশাপাশি উপস্থাপনার জোরে কতখানি মনোলোভা হয়ে উঠতে পারে বর্তমান কেতাবখানি তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ, চমৎকার প্রচ্ছদটি থেকে যার শুরু।
চৌদ্দটি অধ্যায়েরই এক পূর্ণ তালিকা দিতে ইচ্ছে করছে এখানে; অতটা না করে দুই-একখানি নমুনা দেইঃ ঘুড়ির বিজ্ঞান ও অন্যান্য; কলকাতার ঘুড়ি/ লক্ষৌ এর ঘুড়ি; ... লড়াইয়ের আইনকানুন; ... সেরা কয়েকজন; উৎসব; ... সংগ্রহশালা; ... ডাকটিকিটে--কী নেই, পাঠক? ঘুড়ি-সংক্রান্ত কিছু ভাবুন... না, রথীন পাল তা ছুঁয়ে যান নি এ’গ্রন্থে, তেমনটি পাওয়া গেল না। ইনি নিজেই মস্ত এক ঘুড়িয়াল হবেন, সন্দেহ নেই।
*
ঘুড়ির মতো এক অতি স্বল্প খরচের ক্রীড়া বিগত দেড়শত বৎসরব্যাপী কলকাতা ও বাঙালিকুলকে মাতিয়ে এসেছে, যার শুরুয়াৎ সম্ভবতঃ লক্ষ্মৌ-আগত ওয়াজিদ আলি শাহের হাত ধরে, এবং যে ক্রীড়ায় ইদানীং ভাটা, বেশ ভাটা (কারণ জানিনা)। ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যে দিয়ে ঘুড়িয়ালের কেরামতি, আকাশভরা নানান নানান রঙের ও আকৃতির উড়ন্ত ঘুড়ির সৌন্দর্য চাখন, কাঁচের গুঁড়ো থেকে পচাডিমের কুসুম থেকে বারুদ না কী সব যেন ঘেঁটেঘুঁটে মাঞ্জা বানানো (তৎসহ জ্যেঠিমার কাছে কানমলা খাওয়া), পাড়ার দুব্লা নোটুদার শীর্ণ বাহুতে বন্বন্ বন্বন্ লাটাই ঘোরানোর অমিত শক্তি... এ’সবের মধ্যে দিয়ে কৈশোরে ফিরে যাবেন না এমন পাঠক পাওয়া ভার হবে। হ্যাঁ, সে জাদু রয়েছে এই বইয়ে। ঘুড়ি ওড়ানো এখন আর অবিশ্যি গরীবের ক্রীড়াবিলাস নেই--দেখে আসুন না মকরসংক্রান্তির দিনে (১৪ই জানুয়ারি, প্রতি বৎসর) আহ্মেদাবাদের International Kite Festival, মনে হবে অলিম্পিকে এসেছেন! প্রথমেই সারা বিশ্ব থেকে আসা বিশ-ত্রিশখানি দলের নিজ নিজ নামফলক নিয়ে মার্চপাষ্ট। তাদের রঙবাহার, ঘুড়ির সাইজ ও ঘুড়িয়ালিনীদিগের রঙচঙে লাল দোপাট্টা মলমল দেখে...! আর, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি? সে কেবল শহর কলকাতাতেই, কারণটা এই বই ঢুঁড়েও পাইনি। বঙ্গদেশের অন্যত্র, এমনকি চট্টগ্রামেও ঘুড়ি-মহোৎসব মকর সংক্রান্তির দিনেই হয়ে থাকে, ভারতের অধিকাংশ স্থানের মতো।
লেখক চমৎকার একটি অধ্যায় রেখেছেন ওস্তাদ ঘুড়িয়ালদের ওপর--বেরিলির ‘বাবা সাহেব’ নাসির মিঞা থেকে গুজরাটের ভানুভাই শাহ্ থেকে নেবুতলা পার্কের অজিতদা। আশা, অবশ্য, করিনি, পাইওনি, ‘বাঙলাক্রিকেটের দ্রোণাচার্য’ কার্তিক বসুর নাম দেখতে। অনেকেই জানেন না, যে কোটিপতি পিতার এই সন্তান (কুন্তলীনের হেমেন বসুর কনিষ্ঠ পুত্র) আমহার্স্ট স্ট্রিটের প্রাসাদোপম আবাসে থাকতেন কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদন তাঁর চলত এক ঘুড়ির দোকান থেকে, নিজেও তুখোড় ঘুড়িয়াল ছিলেন। বস্তুত, আদি কলকেতায় পাখিপোষা, পায়রা ওড়ানোর মতো ঘুড়ি ওড়ানোও একটি প্রতিষ্ঠিত ও মান্য বিলাস ছিল। ছেলে ভালো ক্যারাম খেলতে পারে বা ঘুড়ি ওড়াতে পারে--এ’গুণখানি সেকালে বিয়ের বাজারেও পাড়া হত।
*
আর্টপ্লেটে ছাপা বহু বহু রঙিন চিত্র রয়েছে, তাতে যেমন ময়ূরপঙ্খি, মুখপোড়া, তুক্কল, চাক্কু প্রভৃতি নানান কিসিমের পতঙ্ স্থান পেয়েছে, তেমনই নানান দেশের নানান আকারের ঘুড়ি-লাটাই, তার পিছনের বিজ্ঞানের গ্রাফিকাল পেশকাশ থেকে বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেটে ঘুড়ির ছবি। এমনকি পেজমার্কের সুতোটিও মাঞ্জার এবং তাতে একটি ছোট্ট কাগুজে লাটাই! বড়ই মন ঢেলে নির্মাণ করা হয়েছে পুস্তকখানি। মন মাতানো ও মন ভরানো। বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের ঘুড়ি-উৎসবের পাশাপাশি কতই ছুট্কাহানি (anecdote) … বম্বেতে মহম্মদ রফি সাহেবের সঙ্গে আমাদের আদত উত্তর কলকাত্তাইয়া মান্না দে-র ঘুড়ির প্যাঁচ লড়ারটি অবশ্য পেলুম না। ঘুড়ি খুইয়ে রফি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে মান্নাবাবুকে ফোন করতেন, ‘কোত্থেকে এই প্যাঁচ লড়া শিখেছেন দাদা?’
*
যুগে যুগে বিনোদনের ধারা বদলে যায়, ক্রীড়াও। আজকের এই গোগ্রাসী বাণিজ্যায়নের যুগে কত কত মন মাতানো খেলা যে লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায়... গাদি, ডাঙ্গুলি, গুলি, লাট্টু, দারিয়াবান্ধা, এক্কাদোক্কা, লাফানদড়ি, কুমীরডাঙা থেকে ইন্ডোর গেম বাঘবন্দি, পাশা... যেগুলি বহু বহু যুগ ধরে শিশু থেকে বুড়োদের আনন্দ দিয়ে এসেছে।
একেক জন রথীন পাল চাই আমাদের সেই সব লুপ্ত ক্রীড়ার গপ্প শোনাতে।
এই বইটির মতো।
বিপরীত পরাগ সংযোগ; ডঃ সিদ্ধার্থ মজুমদার; ধানসিড়ি প্রকাশন; কলকাতা-৫০; প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০১৪; ISBN: 978-93-84396-09-1
‘প্রকৃতি ও মননের উচ্চতর প্রত্যাশার তুলনায় তাঁর রেখাচিত্র ও সূত্রগুলি যে কতটা অপ্রতুল, তা যিনি যত নিখুঁতভাবে বোঝাতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ্!’--এ’ বক্তব্য যাঁর, তিনি চল্লিশ বছর বয়সে Metamorphosis of Plants-এর মতো বটানির এক যুগান্তকারী গ্রন্থ রচেছিলেন, আর তারও প্রায় বিশ বছর পরে কাব্যনাট্য ‘ফাউস্ট’ রচনা করে অমর হবেন তিনি, যদিও পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়স থেকেই তাঁর কবি-পরিচিতি ছিল দেশজোড়া। হ্যাঁ, তিনিই ‘জার্মানির জাতীয় কবি’ যোহান উলফগাং ফন গ্যোটে! তবে, উপরের ঐ উদ্ধৃতিতে বিজ্ঞানচর্চার প্রতি তাঁর যে প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য ধরা পড়ে যায়, তা তাঁর মতো পলিম্যাথ কবি-বিজ্ঞানীরই করা সাজে। নৈলে, সেই যে মহাকবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখেছিলেন, “Sweet is the lore which Nature brings;/ Our meddling intellect/ Mis-shapes the beauteous forms of things:— / We murder to dissect"--তা-ই আমাদের ধরে বসে থাকতে হয়।
*
অর্থাৎ, কাব্য ও বিজ্ঞান... বিজ্ঞান ও কাব্য... শুধু কাব্যই বা কেন, সঙ্গীত সাহিত্য নাট্যকলার মতো আরও আরও সুকুমার প্রকাশনাগুলির সহিত ‘কেঠো’ বিজ্ঞানচর্চার যে অবধারিত বিরোধ তা যেন সর্ববিদিত ও সর্বমান্য। যদিও এমনটি তো হবার কথা ছিল না।
‘আবোলতাবোল’-এর কবি সুকুমার রায় যখন হাঁসজারু বা বকচ্ছপের কল্পনা করেন তাতে অদূরে যেন জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিঙের ছায়া এসে পড়ে, মনে পড়ে যায় তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানেরই ছাত্র ছিলেন--যে গপ্প লেখক ডঃ মজুমদার চমৎকার করেছেন এ’ বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে। এটিকেই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠটি মানি। শুরুটি এই বইয়ের বেশ চমৎকার করেছেন ওমর খৈয়াম, লিওনার্দো-দ-ভিঞ্চি বা লর্ড বায়রনের মতো বিজ্ঞানী-কবি/শিল্পীদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে। প্রখ্যাত চেক জীববিজ্ঞানী মিরোস্লাভ হোলুবের কবিতার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না, জানলাম ইনি বহুভাষায় অনূদিত, এই বাঙলা ব্লগে তা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি http://www.somewhereinblog.net/blog/rothorafi/29302722
রসায়নে নোবেলজয়ী ইহুদি রোয়াল্ড হফম্যান এমন আরেকজন খ্যাতকীর্তি কবি যাঁর লেখায় নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বেদনা ফুটে উঠেছে। আমাদের দেশেও জগদীশচন্দ্রের হাতে বাঙলা সাই-ফির জন্ম বা সত্যেন্দ্রনাথের এস্রাজবাদন ভুললে চলবে কী করে?
বিট জেনারেশনের প্রখ্যাত কবি মাইকেল ম্যাক্কলুরের উপর অধ্যায়টি অবশ্য একটু অন্য রকম। ম্যাক্কলুর বিজ্ঞানীও ছিলেন, কৈ, জানতুম না তো? না, এখানে কবির প্রতি ডি এন এর স্ট্রাকচার আবিষ্কারক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিকের মুগ্ধতাই প্রধান উপজীব্য। এক কবি কীভাবে এক বিজ্ঞানীকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারেন, এ’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
*
যদিও কাব্য ও বিজ্ঞানের এই বিরোধ যেন অনেকটাই পশ্চিমি এবং আধুনিক। নৈলে, পুবের কবি ওমর খৈয়ামের জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা, বহুবিদ্যাজ্ঞ আল বিরুনি, চিকিৎসাশাস্ত্রের এক আদিগুরু আবু সিনার কবিতা, জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাজা সওয়াই জয়সিংহের অনুবাদকার্য ... এ’সব তো গল্পকথা নয়। তবু, বর্তমান লেখক তাঁর নানা রচনার মাধ্যমে, এমনকি যে কাব্যপত্রিকার তিনি সম্পাদক সেখানেও , এই দুই আপাত বিপরীত সৃজনক্ষেত্রের মেলবন্ধনে প্রয়াসী হয়েছেন। এটাই তাঁর ব্রত।
নতুন এক প্রকাশনালয় ধানসিড়ির কাজ ছিমছাম। সেঁজুতি দাশগুপ্তকৃত প্রচ্ছদও বেশ।
সীমান্তের অন্তরালে; সমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী; জয়ঢাক প্রকাশন; কলকাতা-১২৩; প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর ২০১৭; ISBN: নেই
‘কর্নেল’ সুরেশ বিশ্বাস, ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী।
তৃতীয়জনের নাম ‘বাঙালি চরিতাভিধানে’ খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা, কারণ নবীন এই প্রকাশনালয় লাহিড়ীমশায়কে কোত্থেকে ঢুঁড়ে এনে পাঠককরে তুলে না দিলে এ’ অমূল্য গ্রন্থ হারিয়ে যেত, সম্পূর্ণ হারিয়ে যেত! যদিও ধাঁচেধরনে বর্তমান লেখকের সঙ্গে এডভেঞ্চারী বাঙালির প্রথম দুই নায়কের মিল বহু। জেদি-একরোখা-স্বাধীনচেতা বালক, বাল্যেই ঘর-কাটা, জীবন থেকে পথ থেকে শিক্ষা, এবং ‘স্থবির’-এর মতো মোহময় লেখনী! আর তফাৎ? সেই বঙ্গভঙ্গের কাল থেকে গুরুপূজক বাঙালির মনঃকুঞ্জেকুঞ্জে কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের ছবি ঝুলত, আর এ’লেখা পড়ার আগে পর্যন্ত সমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী (১৯০৯-৮৫) মশায়ের নামও শুনিনি।
*
লখনৌজাত প্রবাসী বঙ্গসন্তান। মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা-অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়ে ইংরিজি স্কুল পরিত্যাগ। স্কুলমুখো অতঃপর আর হন নি বটে, কিন্তু স্কুল তাঁকে পরিত্যাগ করেনি, পথে পথেই তাঁর স্কুল। নৈলে, কোন্ জোরে এই স্কুল-ড্রপআউট আসীন হতে পারলেন বৃটিশ মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের উচ্চপদে? মাতৃভাষা বা ইংরিজির পাশাপাশি কুমায়ুনি পুশ্তুর মতো অ-চিরাচরিত ভাষাতেও পারঙ্গম ছিলেন সমরেন্দ্রনাথ, যার শিক্ষাও ঐ পথে পথেই। ইংরিজি তিনি কেমন লিখতেন জানিনা, পড়িনি, তবে, ঊনিশশ’ পঞ্চাশের দশকে আয়ান স্টিফেনের মতো সম্পাদকদের কালে তাঁর Pakhtoonistan রচনা কলকাতার উন্নাসিক The Statesman পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল, এইটেই তো মস্ত সার্টিফিকেট, না? তারই লেখককৃত বঙ্গানুবাদ বর্তমান এই গ্রন্থখানি। সাগ্রহে পাঠ করি....
“...আফগানিস্তান দেশটা শুধু পাহাড় আর পাহাড়! সামুদ্রিক তুফানের বিশালাকার ঢেউ-এর মতই একের পর এক পাহাড় চলেছে যতদূর দৃষ্টি যায়। ...কুহকিনীর মত কোন অলৌকিক আকর্ষণে পাহাড় টানে বিদেশীদের। হয়ত অগণিত মৃতের আত্মা তাদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের কাহিনী শোনাবার জন্য...”
কী অনায়াস চুম্বকে গল্পের দিকে টেনে নেন পাঠককে, অনর্গল ভাষায়! তেমনই ঝরঝরে ভাষায় দেড়শ’ পৃষ্ঠার কেতাবখানি পড়িয়ে নিয়ে যান পাঠককে ওয়াজিরিস্তান-পাখতুনিস্তানের ইতিহাস-সংস্কৃতি-বদলার লড়াই মিশে আছে যার পরতে পরতে। জীগরি-দোস্ত রশিদ খাঁর জীবনালেখ্য যেভাবে টেনে নিয়ে গিয়ে গিয়ে শেষচমক দেন...(পৃ. ১৩8), কোনো ডিটেকটিভ কাহানির চেয়ে কম নয় তা। গল্প আরও কতো আছে...সাদিক আর চমন গুলের খানদানি দুশমনির গল্প, বৃটিশ আক্রমণ যে দু’জনকে মিলিয়ে দেয় গলাগলি। মারিও পুজোর সেই সিসিলিও ঘরানার বংশানুক্রমিক শত্রুতার কথা মনে পড়াবেই। আর, বারবার মনে পড়ে যাবে তরুণ ভাদুড়ী মশায়ের চম্বলের বাগী-কাহিনী ‘বেহড়-বাগী-বন্দুক’! কিন্তু দুঃখু একটাই, এই সকল গ্রন্থের কতই না প্রচার-কদর, বর্তমানেরটি অন্তরালেই... যদি না নতুন হাউজ ভালো বিপণন করতে পারে এর। না, এর চেয়ে বেশি বলে দিলে আর গ্র.স. থাকবে না এটা, কথকতা হয়ে যাবে।
*
তবু, বেণীটি না-ভিজিয়েও দু-কথা না-বলেও যে থাকা যাচ্ছে না।
অবিভক্ত ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিমের অধিবাসীগণ চিরকালই স্বাধীনচেতা। স্বয়ং মহাবীর সিকান্দার-ও তাঁদের বশ করতে পারেন নি চতুর্থ খৃষ্টপূর্বাব্দে। এর বহু পরে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পলাশীর প্রান্তর থেকে যে বৃটিশশক্তির দবদবা শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষে-বর্মায়-নেপালে, তা ঠোক্কর খেয়েছিল একমাত্র এই উঃপশ্চিমে এসেই। সেইখানকার অধিবাসীগণই এক নিখাদ বঙ্গসন্তানকে ‘দোস্ত্’ বলে আপন করে নিলেন তাতে তাঁদের চরিত্রের আরেকটা দিক উন্মোচিত হয়, সেটা সারল্য, সেটা মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস। আর, লেখকেরও কী গভীর নিমজ্জন তাঁদের জীবনে, কৃষ্টিতে, যাপনে! কেবল ঐ প্রদেশেই যে জাকাখেল-কুকিখেল-ওয়াজিরি এত এত সম্প্রদায় হয় তা-ই কী জানতুম নাকি? হরেক তাদের রহনসহন, খানাপীনা... কিন্তু একটা জায়গায় এক! আশ্রয়প্রার্থী, সে যদি দুশমনও হয়, তাকে বুক দিয়ে আগলাতে হবে, প্রয়োজনে জান দিতে হবে তার জন্যে! একটাই বড় রুটি ভাগ করে খেতে হবে সকলের সঙ্গে একত্রে বসে। মহান ইসলামের মূল শিক্ষাটাকে আর কে বা কারা এতো সহজে আত্মস্থ করতে পেরেছে কে জানে, তবু দুঃখ এটাই যে আজ সেই দেশেই মৌলবাদের রমরমা, সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। এটা স্বাভাবিক যে এমন সরল মানুষেরা প্যাঁচপয়জার বুঝবে না। দ্বিতীয় আফঘান যুদ্ধে এক মোহমান্দ যুবক প্রবল বিক্রমে বৃটিশের সঙ্গে লড়ে, পরে ঘটনাচক্রে তাদের ফৌজেই যোগ দিল সে। বৃটিশ পার্লামেন্ট এরপর যখন গ্যালন্ট্রি মেডেল ঘোষণা করল, সে গিয়ে জেনারেল সাহেবের কাছে নালিশ করলে, সে কেন একটা মেডেল পেল না?
‘তুমি তো বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিলে হে!’
‘তাতে কী হয়েছ? এ’তো বাহাদুরির মেডেল, তাতে আবার এপক্ষ ওপক্ষ থাকবে কেন? আমিও তো জানকবুল লড়েছিলাম!’ তার সরল নিবেদন।
এ’হেন মণিমুক্তো ছড়ানো এ’বইয়ের পাতায় পাতায়।
*
নতুন প্রকাশনালয়ের কাজ ভালো। প্রচ্ছদের ওটি, অনুমান, খাইবারের মুখের ‘জামরুদ দুর্গ’ (লেখা নেই কোথাও), যদিও ছবির মুডটা ধরা হয়েছে বেশ। ছাপাই-বাঁধাই-টাইপসেটিং মনকাড়া, যদিও বানান নিয়ে দু’কথা না বললেই নয়। বহু বহু ‘ভুল’ বা, অপ্রচলিত বানান চোখে পড়েছে, সেগুলি কি লেখককৃত/অবিকৃত? ফুটনোটের দরকার ছিল এখানে।
শেষে আক্ষেপ, এই লেখকের দ্বিতীয় রচনা আর পড়তে পাব না, যদিও গ্রন্থশেষে লেখককন্যার ছোট্ট ‘পরিশিষ্ট’ রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ মনে পড়িয়ে দিয়ে গেল প্রায়! এঁর জন্ম পাখতুনিস্তানে, এঁর মা বন্দুক ও মোটরকার চালানো শিখেছিলেন সংসার প্রতিপালনের খাতিরে এবং ছোটবোনের নাম চিনার, জন্ম যার কাশ্মীরে!