প্রেসিন্ডেন্সি কলেজ, কলকাতার প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্রীঅমলকুমার মুখোপাধ্যায়ের পরিচয় নতুন করে দেবার কোনো অবকাশ নেই। ১৯৬১ থেকে ১৯৯৭—চারদশকব্যাপী তাঁর অধ্যাপনার জীবন প্রেসিডেন্সিতে, শেষের পাঁচ বৎসর অধ্যক্ষ হিসেবে। এর পরের দুই দশকও শিক্ষা-সাংবাদিকতা-গ্রন্থরচনার কাজে নিরবচ্ছিন্ন যুক্ত এই ছাত্র-অন্ত-প্রাণ মানুষটি। অত্যন্ত ছাত্রপ্রিয় এই অধ্যাপক-প্রণীত পাঠ্যপুস্তক পড়েননি, তিন প্রজন্মব্যাপী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমন ছাত্রছাত্রী খুঁজে পাওয়া ভার হবে। সম্প্রতি ওঁর সাউথ সিঁথির ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে গিয়ে হাজির রাজীব চক্রবর্তী ও দুই প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীঃ গার্গী চৌধুরী ও দীপঙ্কর চৌধুরী। ক্লাসেও যেমন ওঁর ভাষণ শোনা ছিল এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা, এখানেও তাই...
পরবাস : প্রণাম, স্যর। কেমন আছেন?
যেহেতু আমরা এক সাহিত্যপত্রিকার তরফ থেকে আজ এসেছি আপনার কাছে, তাই আজকের কথাবার্তা পাঠ্য-রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চাইতে সাহিত্যঘেঁষা হয়তো কিছুটা বেশিই হয়ে পড়বে।
আপনি ক্লাসে বলতেন, যতই কাজের চাপ, পড়াশুনো থাকুক, আপনি প্রতিদিন রাত্রে শোবার সময় কিছু শিশুসাহিত্য অবশ্যই পাঠ করে থাকেন, সেটাই মনের জানলা প্রাণের আরাম।
অভ্যাসটা এখনও আছে? এখনও পড়েন শিশুসাহিত্য?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : ‘শুকতারা’ পত্রিকার তো আমি নিয়মিত পাঠক বহু বৎসর ধরেই। শুকতারাটা এখনও নিয়মিত পড়ি। শুধু তা-ই নয়, ছোটদের জন্যে আমি মাঝে মাঝে কিছু কিছু লিখিও, যেমন গত বছর একটা হাসির গল্প লিখেছি।
তবে, এখন যে কেবলমাত্র শিশুসাহিত্যই পড়ি তা নয়। কারণ নানান কাজের চাপে এখন নিজের মনের মতো পড়ার জন্যে সময় এসে দাঁড়িয়েছে ঐ রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে বারোটা পর্যন্ত। এখন হেমিংওয়ের এক কালেকশন পড়ছি। উনি আমার অতি প্রিয় লেখক। এতো সুপাঠ্য গদ্য ইংরিজিতে আর কেউ লিখেছেন কিনা সন্দেহ।
পরবাস : নবনীতাদি, প্রেসিডেন্সিতে আপনার ব্যাচমেট কবি নবনীতা দেবসেন, একবার বলেছিলেন, বীরভূমের গ্রাম থেকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে আসা লাজুক ছাত্রটির কাঁধঝোলা থেকে হেগেল-মার্কসের বইয়ের পাশাপাশি বেরোতো কবিতার খাতা...!
আপনার কবিতা আমরা পড়তে পেলুম না কেন, স্যর? এখন যদি দু’-একটি...
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : (স্মিতহাস্য) কবিতা লিখছি চোদ্দ বছর বয়স থেকে। আমার বাল্যবন্ধু অকালপ্রয়াত হাবিব আলি ছিল আমার দোসর। দু’জনে আমরা কবিতা লিখতুম। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছি, অনেক পত্রপত্রিকাতেও বেরিয়েছে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে। তেমন এক কাব্যপ্রতিযোগিতার বিচারক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় আমার পুরস্কারের গ্রন্থে লিখে দিয়েছিলেন, ‘আগামীদিনের কবি, তোমাকে আমার আশীর্বাদ জানাই।’
কলেজে এসে থেকে কবিতা লেখাটা অনেক বেড়ে গেল। কিন্তু একটা ঘটনার পরে অভিমান করে আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিই। সেটা হলো এই যে বিএ পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট ক্লাস পেতে পারিনি, সেকেন্ড ক্লাস পাই। মনে হলো, মাথায় ঐ কবিতার ভূত চাপাটাই এর কারণ। ছেড়ে দিলুম কবিতা লেখা। কলেজের বন্ধুবান্ধবীরা, যেমন ঐ নবনীতা, যশোধরা (সেনগুপ্ত/বাগচী), বারবার জানতে চাইতো, কেন আমি আর কবিতা লিখছি না। পড়াশুনোয় পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার সুফল অচিরেই পেলুম এম.এ. ও ল পরীক্ষা দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে। এর পরের ছাব্বিশ বছর আমি বাঙলায় কিছু লিখিনি। আবার লেখা শুরু করি ১৯৮৪তে, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-তে টানা তিন বছর লিখি।
এর পরে, যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল, তখন আমার জীবনদর্শন দীর্ঘ এক কবিতায় লিখি, ‘সুখী রাজপুত্রের সন্ধানে’। সেই যে happy prince এর কাহিনী...যে সবকিছুই দিয়ে দেবে, নিজের জন্যে কিছু রাখবে না। পরে কখনও তোমাদের সে-কবিতা শোনাবার ইচ্ছে রইলো।
কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ি... তখন আঠেরো বছর বয়স পুরোয়নি আমার। ওয়াল-ম্যাগাজিনে বেরোনো একটি কবিতা খুব হৈ চৈ তুলেছিলো, চারটে লাইন আজও মনে আছেঃ
“আরেকটি চুম্বন দাও, স্বপ্নের মাধুরিমা মাখা।পরবাস : উনিশশো পঞ্চাশের দশকে এরকম কবিতা প্রকাশ করা যথেষ্ট ব্যতিক্রমী ছিল বই কি!...
শ্বেতপদ্ম তুষারের মুঠি মুঠি ছোঁয়ার মতন
বারেক কাঁপুক ভীরু হৃদয়ের পল্লবিত শাখা
বিকালের ম্লান সূর্য আকাশেরে রাঙালো যখন”...
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, এই কবিতা পড়ে দলে দলে ছাত্রছাত্রী আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিল বটে...
পরবাস : বীরভূমের সেই অখ্যাত গ্রাম থেকে লন্ডন স্কুল অব্ ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিকাল সায়েন্সের যাত্রাপথটি তো হ্রস্ব নয় মোটেই। একটু যদি করেন সে-সব গল্প...
আপনার সহপাঠিদের কথাও এই প্রসঙ্গে একটু শুনতে ইচ্ছে করছে, আর বিশেষ করে সেইসব কিংবদন্তী অধ্যাপকদের কথা, যাঁদের কাছে আপনার দীক্ষা।
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : বীরভূম জেলার উদয়পুর গ্রামে আমার পৈতৃক নিবাস, ওখানেই আমার জন্ম। রামপুরহাট হাইস্কুলের ছাত্র ছিলুম আমি। ওখান থেকেই স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় জেলার মধ্যে ফার্স্ট হই। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার ইচ্ছে। আই এ-তে। কিন্তু বাবার উপদেশে তখনই চৌদ্দ বছরের তরুণ কলকাতার হস্টেলে না এসে ‘সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ’ থেকে আই এ পাশ করি, রাজ্যে পঞ্চম স্থানাধিকার করে। এর দু’টি সুদূরপ্রসারী ফল হয়েছিল।
(এক) অসাধারণ নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রবৎসল কয়েকজন শিক্ষক মহাশয়ের ছত্রছায়ায় আসি। যাঁদের প্রভাব আমার উপর সারাজীবন রয়েছে। আর,
(দুই) বন্ধুবর প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই ১৯৫২ সাল থেকে পরিচয় ঐ কলেজেই, যা আজ পঁয়ষট্টি বৎসর অতিক্রম করেছে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন একটি ঘটনা আমার জীবনের মস্ত বড় এক শিক্ষা হয়ে দেখা দেয়, সেটা না ঘটলে হয়তো আজ আমার পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট হওয়াই হতো না। আমাদের সময় ইকনোমিক্স এন্ড পলিটিকাল সায়েন্স একসঙ্গে পড়তে হতো। ইকনোমিক্স আমার মোটেই ভালো লাগত না, তাই ঠিক করলুম ছেড়ে দিয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ব। সে সময়ে একদিন নবনীতার বাড়িতে গেছি। নবনীতার মা রাধারাণী দেবী কারণ জানতে চাইলেন আমার এই সিদ্ধান্তের। বললুম, বড়ো নীরস লাগে ইকনোমিক্স। উনি প্রত্যুত্তরে যা বলেছিলেন, আজও সেটা আমার জীবনের এক বড়ো শিক্ষা হয়ে আছে। বললেন, ‘অমল, জীবনের সব কিছুই নীরস। সেটাকে তোমার মনের রস দিয়ে রসসিক্ত করে তুলতে হবে। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আমরা এইটাই করছি।’ সারাজীবন আমি রাধারাণী দেবীর ঐ উপদেশ অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করে চলেছি।
পরবাস : এম এ পাশ করে তো স্যর লন্ডনে চলে গেলেন ডক্টরেট করতে...
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : টি এচ গ্রিনের উপরে। টমাস হিল গ্রিন। উনবিংশ শতাব্দীর ‘সামাজিক উদারনীতি’ মতবাদের জনক, ইংরেজ দার্শনিক। তাঁর মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে ফ্রান্সিস ব্রাডলি, লিওনার্ড হবহাউজের মত ভবিষ্যতের দার্শনিকদের প্রভাবিত করে গেছেন টি এইচ গ্রিন। আমাকে তখন অনেকেই নিষেধ করেছিলেন ওইরকম কঠিন এক বিষয়ের মধ্যে ঢুকতে। যেমন, অধ্যাপক অম্লান দত্ত। একদিন সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে দেখা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াই টি এইচ গ্রিন?’ বলেছিলুম, রবীন্দ্রনাথের দর্শনের সঙ্গে টি এইচ গ্রিনের বড় মিল আছে বলে আমার মনে হয়েছে। সেটাই গবেষণা করে দেখতে চাই।
তা, LSE-তে গিয়ে প্রথমেই প্রধান অধ্যাপক মাইকেল ওকশটের কাছে যাই। ‘I’m afraid, I cannot go beyond seventeenth century philosophers.’ বলে উনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন অধ্যাপক কে. বি. স্মেলির কাছে, যিনিই হলেন আমার গুরু। প্রথমেই কিন্তু উনি আমায় ‘you’re hardly an Indian lad in your early twenties and you dare to research on T H Green!’ বলে নিরুৎসাহিত করতে চাইলেন। পরে আমার জেদ দেখে ওঁর বিশাল লাইব্রেরি থেকে H. A. Prichard-এর লেখা একটা বই, Four Lectures on T. H. Green, পেড়ে নিয়ে এসে তার প্রথম বাক্যটি পড়ে শোনালেন, 'the more I read T H Green the more I don’t understand him.'
তাতেও নিরুৎসাহী না হয়ে আমি দু’ সপ্তাহের সময় ওঁর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসে এক দীর্ঘ introductory essay লিখে নিয়ে গিয়ে ওঁকে দেখাই। ভালো ইংরিজি লিখতে পারি বলে আমার প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব ছিল...আই এ পরীক্ষায় ইংরিজিতে ফার্স্ট হয়েছি, অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত সংকলনে তখনই আমার রচনাকে ঠাঁই দিয়েছেন। তা, আমার রিসার্চ-গাইড প্রফেসর স্মেলি একটি পেন্সিল দিয়ে আমার সেই আর্টিকেল আপাদমস্তক সংশোধন করে দিয়ে বললেন যে ‘এ’ধরনের ইংরিজি লিখলে তুমি লন্ডন ইউনিভার্সিটির ডক্টরেট পাবে না। মনে রেখো, simple English is elegant English’. ওঁরই উপদেশে লন্ডনের ‘বাঙালিপাড়া’ ছেড়ে গ্রবনস স্কোয়ারের কাছে খাস ইংরেজ মহলে বাসাভাড়া নিই, Guardian পত্রিকা ছেড়ে Times পড়া ধরি. BBC-র Third Programme শুনতাম। বিজ্ঞানের বই পড়ে পড়ে precision-এ লিখতে শেখান উনিই। এখন বুঝি, এ’গুলি না করলে, ইংরেজ জীবনকে না বুঝলে, গ্রিনের উপরে গবেষণা করা যেত না।
আমার ডক্টরেট পাবার খবরটা জানতে পারাও বেশ নাটকীয়। LSE-তে খুব কড়া এক ভাইভা-ভোসে হতো, এক্সটার্নাল দু’জন পরীক্ষক আসতেন। তা, তাঁরা দেড়টি ঘন্টা ইন্টারভ্যু নিয়েও আমাকে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই জানালেন না। খুব টেনশনে আছি। পরের দিন আমার এপার্টমেন্টে ফোন এসেছে একটা। আমার রুমমেট আমাকে ডেকে দিতে দিতে অনুযোগ করলে, "কী অমল, তুমি ডক্টরেট পেয়ে গেছ আর আমাদের জানালে না?”
“কী করে জানলে সেটা তুমি? আমিই তো জানিনে।" বলি। “তোমার প্রফেসরের মিসেস ফোন করেছেন, আর ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। যাও, ফোন ধরো গিয়ে।“
তা, সেই ডক্টরেটের বলে, আর আমার গুরু প্রফেসর কে বি স্মেলির উচ্ছসিত রেকমেন্ডেশন লেটারের দ্বারা আমার সরাসরি সিনিয়র এডুকেশনাল সার্ভিসে চাকুরি হয় পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসে। এর পিছনেও আবার একটু গল্প আছে। এখানকার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যদের কেউ কেউ আপত্তি ওঠালেন যে মাত্র সাতাশ বছরের একজনকে সিনিয়র সার্ভিসে কী করে সরাসরি নেওয়া যায়? দিল্লি ইউনিভার্সিটির এক্সটার্নাল-মেম্বার বলেছিলেন যে তোমরা গত বছরই ছাব্বিশ বছরের অমর্ত্য সেনকে যদি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে সরাসরি সিনিয়ার ক্যাডারে এপয়েন্টমেন্ট দিতে পার তো অমলকুমার মুখোপাধ্যায়কে প্রেসিডেন্সি কলেজে নয় কেন? তা, লন্ডন থেকে জাহাজে দেশে ফেরার পথে এডেন বন্দরে এসেই অনেক চিঠিপত্রের মধ্যে আমার চাকুরিপ্রাপ্তির চিঠি পাই। হ্যাঁ, আমার চাকরি in absentia হয়েছিল, এটাও একটা ব্যতিক্রম।
দেশে ফিরে রাইটার্স বিল্ডিঙে গেলুম ডি পি আই-এর সঙ্গে দেখা করতে। তিনিও আমার মাস্টারমশাই। বললেন, অমল, তুমি তো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছ হে! যাও, যাও, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করে এসো। উনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। তবে হ্যাঁ, তোমার এই দাড়িগোঁফের জঙ্গলটা বাপু একটু সাফ করে যেও। তখন সবে সবে LSE থেকে ফিরেছি কিনা। সেই র্যাডিকাল ধারায় দাড়িগোঁফ ছিল বটে মুখভর্তি।
পি এস সি-র চেয়ারম্যান সে সময়ে ছিলেন মিঃ এন আর দাশ গুপ্ত, ওয়ান অব দ লাস্ট আই সি এস অফিসার্স...সে সব কবেকার কথা...কত গল্প...
পরবাস : সে সময়কার পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষত প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষার আবহ, আর তার পরেই যে ষাটের দশকের গোড়ায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন, সেখানকার পরিবেশ... কেমন আসে তুলনায়?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : বস্তুত, কোনো তুলনাই হয় না। আমরা যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছি, স্বর্ণযুগ ছিল সেটা। অধ্যাপক তারকনাথ সেন, সুশোভন সরকার, গোপীনাথ ভট্টাচার্য, প্রবাসজীবন চৌধুরী! মহারথী ছিলেন এঁরা! ছাত্র-অন্ত-প্রাণ! এঁদের ডক্টরেট ডিগ্রিও ছিল না। তার প্রয়োজনও হয়নি। বইটই-ও যে খুব লিখেছন তা নয়। ক্লাসরুমই ছিল এঁদের লীলাক্ষেত্র। কী করে ভালো ছাত্র তৈরি করা যাবে, কী করে তাদের এক অনুসন্ধিৎসু মন গড়ে দেওয়া যাবে, এই ছিল তাঁদের সমগ্র ধ্যান-ধারণা জুড়ে। সে তুলনায় লন্ডনে প্রফেসর ওকশটের মত অধ্যাপকদেরও নোটখাতা খুলে ক্লাসে লেকচার দিতে দেখেছি। অনেক বছর পরে, আমি তখন প্রেসিডেন্সিতে ডিপার্টমেন্টের হেড, বৃদ্ধ গোপীনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় এক সেমিনারে লেকচার দিতে কলেজে এসেছেনঃ Kant’s critic of pure reason. আমি আমার ছাত্রদের নিয়ে গেলুম শোনাতে--দ্যাখো, শোনো, প্রকৃত অধ্যাপক কাকে বলে। কী তাঁর পাণ্ডিত্যের গভীরতা!
আরও ছিলেন ভবতোষ দত্ত। ধীরেশ ভট্টাচার্য। অসাধারণ সব শিক্ষক। ধন্য হয়েছি এঁদের সংস্পর্শে এসে।
পরবাস : এরপর আসবেই আপনার সুদীর্ঘ অধ্যাপনাজীবনের কথা। কতদিন হবে? চারদশক তো বটেই, নয়? আপনার ছাত্রছাত্রী তো মিছিলপ্রমাণ...সুদীর্ঘ! তার মধ্যে কাদের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য সোনালী বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো আপনারই ছাত্রী ছিলেন? ‘প্রসার ভারতী’র প্রাক্তন সি ই ও জহর সরকার, ...শিক্ষা প্রশাসনের নানান ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বসমূহ আপনার ছাত্র ছিলেন।
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, অনেকই ছিল, আছে, ছাত্র ছাত্রী। বিশেষ করে আর কার কার নাম বলি? সকলেই আমার প্রিয়।
পরবাস : আপনার সঙ্গে কথা বলতে বসলে প্রেসিডেন্সির কথাই অবশ্যম্ভাবীভাবে বারে বারে উঠে আসবে, যদিও আমাদের সব পাঠক যে ঐ কলেজেরই তা তো নয়, আবার বহুজন আছেনও। অধ্যক্ষ হিসেবে আপনার কথা আমরা কলেজের ‘অটাম এনুয়াল’ পত্রিকার দ্বিশতবার্ষিকী সংখ্যায় বিস্তারিত পড়েছি। এখানে সংক্ষেপে যদি কিছু বলেন। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে গৌহাটির কটন, কটকের র্যাভেনশ’, শিবপুরের বি ই কলেজ... এর দ্বারা পঠনপাঠনের মানোন্নয়ন সুনিশ্চিত করা যায় কি?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : অধ্যক্ষ থাকাকালীন ১৯৯৫-র ৫ জুন প্রেসিডেন্সি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উন্নীত করার দাবি তুলি, ও একটি রূপরেখা জমা দিই সরকারের কাছে। তাতে আমরা দেখিয়েছিলাম, পঠনপাঠন ও পরিকাঠামোর যে যে উন্নতি করা আশু কর্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে উন্নীত না করলে সেটা সম্ভব নয়। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও আমাদের প্রাক্তন ছাত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত, ও শিক্ষামন্ত্রী সত্যসাধন চক্রবর্তীর প্রত্যক্ষ সমর্থন সত্ত্বেও অন্য এক প্রবল প্রতাপান্বিত বামপন্থী নেতার বিরোধিতার ফলে সে সময়ে প্রেসিডেন্সির বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে উন্নতি সম্ভব হয়নি। ওঁর প্রয়াণের পরে ২০১০-সালে বিধানসভায় এই বিল পাশ হয়। এম কে নারায়ণন তখন রাজ্যপাল। বিলটিতে স্বাক্ষর দিতে টালবাহানা করতে লাগলেন উনি নানা মহলের চাপে। ওঁর সঙ্গে প্রথম মিটিং এ সুকান্ত চৌধুরী, সুনন্দ সান্যাল ও দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আমার সঙ্গে। রাজ্যপাল পরে বলেছিলেন যে, Principal Amal K Mukhopadhyay seems to be very much emotionally charged about Presidency College, যেটা কিনা সত্যি কথা। আমি আগেও বারে বারে বলেছি লিখেছি যে প্রেসিডেন্সি কলেজ আমার মায়ের মতো। তাঁর ভালোর জন্যে আমি সর্বতোভাবে নিবেদিত হব সেটাই তো স্বাভাবিক। তা, জুলাই মাসে বিলটি পাশ হয়ে গেল। প্রথমে অনিতা চট্টোপাধ্যায় ও তারপরে মালবিকা সরকারকে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। দু’জনেই আমাদের ছাত্রী। ভালোই চালাচ্ছিলেন তাঁরা। যদিও বেশি সময় পান নি। তবে বর্তমান অধ্যক্ষার আমলে যে ভাবে আধুনিকীকরণের নামে প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্যকে ধুয়েমুছে দেওয়া হচ্ছে তাতে আমি ব্যথিত। অঙ্গহানি করা হচ্ছে আমার মায়ের। লেখাপড়ার মান? তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভালো ভালো অধ্যাপকগণ কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আরও দুঃখের কথা, প্রেসিডেন্সির ২০০ বছরের পূর্তির অনুষ্ঠান হলো গঙ্গার ধারে, কলেজের এত বড়ো বিল্ডিং ও মাঠ থাকতে, যেখানে আমরা ১৭৫ বৎসর পূর্তির অনুষ্ঠান করেছিলুম রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মাকে আমন্ত্রণ করে এনে।
অর্থাৎ, প্রেসিডেন্সির মানোন্নয়নের যে উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়, আজকের দিনে তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সেই আশা পূরণ হবার লক্ষ্য থেকে অনেক দূরেই রয়ে গেছে।
পরবাস : এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি সঙ্গীতের বড়ো ভক্ত, শুনেছি। বিশেষত, মার্গীয় সঙ্গীতের... আমীর খাঁ সাহেবের খেয়ালের, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের। এখন কার কার গান-বাজনা শোনেন? শাহিদ পরভেজ, রশিদ খান, কৌশিকী দেশিকান ভালো লাগে?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : কৌশিকী তো খুবই ভালো গাইছে। ওর বাবার গানেরও আমি বিশেষ ভক্ত, অজয় চক্রবর্তীর। তবে এখন রবীন্দ্রনাথের গানই বেশি শুনি, বেশি ভালো লাগে। আমাদের ছাত্র শ্রীকান্ত আচার্যের গান খুব ভালো লাগে, ও’ও পলিটিকাল সায়েন্সের ছাত্র ছিল সেন্ট জেভিয়ার্সে। আধুনিক গানে শুভমিতার গান ভালো লাগে। এরা দুজনেই আমার খুব স্নেহের পাত্র।
পরবাস : আশির দশকের প্রেসিডেন্সি কলেজে আমরা আপনাকে এক পাইপ-স্মোকিং প্রখর মার্ক্সবাদী হিসেবে দেখেছি, পেয়েছি আপনার নানান লেকচার, প্রবন্ধলিখনের মধ্যে দিয়ে।
জানতে ইচ্ছে করছে, মার্ক্সিজমে আপনার দীক্ষা কবে কী করে হলো।
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : সেটা লন্ডনে। তখন LSE-র বাতাবরণটিই ঐ রকম ছিল কিনা। ক্রমশঃ আমি মার্ক্সীয় পন্থায় কট্টরবিশ্বাসী হয়ে পড়ি। আমার সে সময়কার লেখায়, কথায় এই মত বারংবার জোরদার হয়ে ফিরে ফিরে এসেছে। ১৯৮৪ পর্যন্ত এই মতে গভীর বিশ্বাসী ছিলুম। কিন্ত কী করে বলতে পারবো না, পরে ক্রমে ক্রমে মতপরিবর্তন আসতে থাকে, যখন শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানধারণা-শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি, যাঁকে আমি একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বলে মনে করি। আর পরমহংসদেবের শিক্ষার প্রতি আকর্ষিত হয়ে থেকেই আমি মার্ক্সবাদের অসারত্ব অনুভব করতে থাকি ও সেই পথ আমি ছেড়ে দিই। সে সময় থেকেই আমার পড়ার ঘরে কার্ল মার্ক্সের ছবির পাশাপাশি পরমহংসদেবেরও ছবি থাকত, যা নিয়ে তখন অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছে।
আমার একটা বই খুব শীঘ্রই বেরোবে, ‘অন্য প্রেক্ষিতে শ্রীরামকৃষ্ণ’ যেখানে আমি পরমহংসদেবকে এক সমাজতাত্ত্বিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছি।
কয়েক বৎসর আগে মণীন্দ্র কলেজের এক সেমিনারে আমি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের শিক্ষার অপ্রমেয়তার কথা বলি। সেখানে আমারই এক অতি স্পষ্টবক্তা ছাত্র, বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যাপক সুব্রত চ্যাটার্জি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যর, সতের বছর আগে হেগেলের উপর এক সেমিনারে আমি এ’কথা বলেছিলাম, তখন আপনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিক্ষাকে উপেক্ষা করেছিলেন। আজ তবে এই কথা বলছেন কেন?’ আমি আমার ভ্রান্তি স্বীকার করে নিলুম, বললুম, তখন আমি রামকৃষ্ণদেবের শিক্ষার স্বরূপ অনুধাবন করতে পারিনি। আজ পারছি। স্বীকার করি, আমার ভুল হয়েছিল।
পরবাস : পাইপ-স্মোকিং এখনও করেন, স্যর?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : না না, কন্যার শাসনে ধূম্রপান ত্যাগ করেছি। প্রতিদিন প্রাতে আধঘণ্টা প্রাণায়াম করি। ভালোই আছি।
পরবাস : মার্ক্সবাদের উপর আপনার আজকের অনীহার পিছনে কি পশ্চিমবঙ্গের বাম শাসনের কোনো প্রভাব আছে?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : না, তা নয়। মার্ক্সবাদ মূল্যবোধের ওপর জোর দেয়নি। Material condition of life-এর উপর সমস্ত জোরটা দিয়েছে। সমাজবাদের সাফল্যের জন্যে যে এক সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠার প্রয়োজন আছে, বলপূর্বক নয়, সেটা যেন ভিতর থেকে উঠে আসে। সেটা হয়নি। আর মার্ক্সবাদে যে withering away of the state-এর কথা বলা হয়েছে সেটা তো সম্পূর্ণ অলীক। বাস্তবে, সেই স্তালিনের সময় থেকেই সকল কম্যুনিস্ট দেশেই over bureaucratization হয়েছে। আজকের দিনে তাই মার্কসিজম তার উপযোগিতা হারিয়েছে।
যদিও মার্ক্সের দুটি শিক্ষা, ‘ডায়ালেক্টিকাল মেটিরিয়ালিজম’ এবং ‘হিস্টোরিকাল মেটিরিয়ালিজম’ for the formulation of the laws of history-কে আমি অমোঘ সত্য বলে আজও মনে করি।
পরবাস : কিন্তু এই ধারণার প্রথম উদ্গাতা তো ছিলেন ফ্রিডরিখ হেগেল...
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, তা অবশ্যই। হেগেলের কাছে কার্ল মার্ক্স প্রাথমিকভাবে ঋণী ডায়ালেক্টিকাল মেটিরিয়ালিজমের ধারণার জন্যে।
পরবাস : আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রসঙ্গ... এখানেই ফিরে ফিরে না এসে যে উপায় নেই...
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা কী? এই শাস্ত্র পড়লে আমাদের চারিপাশের রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডকে জানতে-বুঝতে কি বিশেষ কিছু সুবিধা হয়, হতে পারে?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : কোনো সুবিধা হয় না। এই কথাটা আমি বহুদিন থেকেই বলছি, তৃতীয় বিশ্বের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পঠনপাঠন দেশকাল অনুযায়ী করতে হবে। এখন আমার যে বইটির উপর কাজ করছি, ‘Politics and all that’ সেখানে বলেছি আমি সে কথা। এটা না করতে পারলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ কেবল পুঁথিগতই থেকে যাবে।
পরবাস : এই প্রসঙ্গে নকশাল আন্দোলনের কথা এসে যায়। সেই গরম সময়, সেই ভাঙার সময়... ষাটের দশকে অধ্যক্ষ সনৎকুমার বসু মহাশয়ের হেনস্থা ও পদত্যাগের কাহিনি পড়েছি। আপনি সে-সময়েও ছাত্রমহলে বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন এবং বহুক্ষেত্রে মধ্যস্থতাও করেছেন। একটা সময়ে হিন্দু হস্টেলের সুপারও ছিলেন আপনি। আজ প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে কী মূল্যায়ন করবেন আপনি--নকশাল আন্দোলনের, আপনাদের ছাত্র কাকার, অমল সান্যালের ?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : এই যে অতি সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে আমরা কৃষক আন্দোলন দেখলুম, দেখছি, নকশালরা এই ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা’-র কথা বলেছিলেন। এঁদের আদর্শ অত্যুচ্চ ছিল, কিন্তু সঠিক পরিচালনার অভাবে শীঘ্রই আন্দোলনটি দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়ে। এই সব মূর্তি ভাঙা, নিরীহ মানুষকে হত্যা করা কোনো গণ-আন্দোলন হতে পারে না, এটা নিখাদ হুলিগানিজম। আজ অসীম বলছে, ‘আমাদের ভুল হয়েছিল’। কিন্তু তার ফলে কত সহস্র তরুণের প্রাণ গেছে, কত সহস্র পরিবার ভেসে গেছে! আর আজ অসীম ঘোষিতভাবেই নকশাল পন্থায় বিশ্বাস করে না।
আমাদের পাঠকগণ কিছু জানতে চাইবেন, আপনার লেখালেখির কথা, বিশেষত আপনার অতি-জনপ্রিয় পাঠ্যপুস্তকগুলির সম্পর্কে--Political Sociology, Western Political Thought; এবং আপনার সংবাদপত্রে লেখালেখির কথাও। আপনার “Socialist Perspective” ম্যাগাজিনের কথা।
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : Socialist Perspective পত্রিকার সংশ্রব আমি ত্যাগ করেছি, চল্লিশ বছর এডিট করার পর।
সম্প্রতি একটি বই বেরিয়েছে, A Journey Across the Indian Constitution.
নতুন প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘নানা রঙের ভাবনা’ বেরোবে, কাজ চলছে।
নতুন বই ‘Politics and all that’ চৌদ্দটি অধ্যায় লেখা হয়ে গেছে।
‘রবীন্দ্রনাথঃ নানা প্রসঙ্গ’ এবং ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’ আমার সম্পাদনায় বেরিয়েছে।
‘রাষ্ট্রদর্শনের ধারা’, ‘বিষয় রাজনীতি্ ‘ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র’... এতাবৎ একুশটি বই বেরিয়েছে, সেদিন এক ছাত্র গুনে বললো।
পরবাস : প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শ্রীপ্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার প্রায় সত্তর বছরের বন্ধুত্ব...
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, প্রণব তখন দিল্লীতে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। দেখা করতে গেছি। আমাদের ব্যাচমেট অর্জুন সেনগুপ্ত তখন সেখানকার মেম্বার-সেক্রেটারি। প্রণব তাকে ডেকে বললেন, ‘অমল এসেছে। তুমি এসো। ওর কবিতা শুনবো।’ কী কাণ্ড! অর্জুনকে বললুম, না, না, আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন আগে। এসো গল্প করি। কবেকার কথা সে সব...
পরবাস : প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেবার কথা কখনো ভাবেননি? একবার কি আপনার রাজ্যসভায় যোগ দেবার কথা উঠেছিল, কংগ্রেসের টিকিটে....কাগজে পড়েছিলাম বলে মনে পড়ছে।
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, প্রণবই বলেছিল।
সে তো আমি প্রেসিডেন্সি থেকে রিটায়ার করার পরে বাংলাদেশের হাই-কমিশনার বা কোন্ রাজ্যের গভর্নর হবার কথাও উঠেছিল। তো আমি সারাজীবন পড়াশুনো আর প্রেসিডেন্সি কলেজ নিয়ে থেকেছি। ও’সব আমার cup of tea নয়। আমি তাই সম্মত হইনি ও’সবে।
পরবাস : আজকের ভারতের এক প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আসি। ধর্মীয় অসহনশীলতা... কিছু বার্তা দেবেন না, স্যর?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : এটাকে আমি অন্তর থেকে ঘৃণা করি। আজকের কেন্দ্রের ক্ষমতাশীল দল যে ঘৃণ্য রাজনীতি ছড়াচ্ছে, সেটা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। তারা মাত্র একত্রিশ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদে এতগুলো আসন পেয়ে গেছে। অতএব, এদের বিরুদ্ধে সমস্ত বিরোধী দল জোটবদ্ধ হলে ভেসে যাবে এরা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোতেও ত্রুটি-বিচ্যুতি, চুরিচামারি আছে। কিন্তু এই যে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা এ’ এক অতি ভয়ঙ্কর খেলা। দেশকে ধ্বংস করে দেবে এটা। আমি এর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করি, ঘৃণা করি, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই এটা।
পরবাস : প্রেসিডেন্সির প্রথম শতবর্ষে কবি-অধ্যাপক মনমোহন ঘোষ এক অসাধারণ কবিতা লিখেছিলেন ... মাঝখান থেকে একটু পড়ি...
From law and church who rose
And shop, this lasting fane to raise
For the lov’d Muses, verse and prose,
Thought, science, numbers; to enshrine
Fair learning’s self, the lamp divine
In God’s hand for mortality
To see by. Gulf of ‘mine’ and ‘thine’,
Though come from o’er the bitter brine,
They knew not no dividing sea
In race, pride, alien ancestry, …
আর, ১৯৯৩-তে কলেজের ১৭৫-তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার সামনে অধ্যক্ষ হিসেবে আপনি বলেছিলেন, Presidency College is Bengal, Bengal is Presidency College.
শিক্ষাক্ষেত্রে elitism-এর ব্যাপারে আপনার মতামত জানবার ইচ্ছে।
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, এই নিয়ে তো তখন অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র মশায় আমার নিন্দা করে লিখেও ছিলেন। কিন্তু দ্যাখো, ভারতবর্ষের শিক্ষায় আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিল ‘হিন্দু কলেজ’। সেই ধারা, বাংলার র্যাডিকালিজমের ধারা, আজও বয়ে নিয়ে চলেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, আজকের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। আজও এই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বাংলার মুখ। তাই আজও আমি আমার সেই পুরনো মতে বিশ্বাসী, যে Presidency College is Bengal, Bengal is Presidency College.
পরবাস : আজকের এই digital revolution-এর যুগে--internet, e-book, social media, digital library... এ’সবকে কী চোখে দেখেন আপনি এক বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ হিসেবে? এগুলি কি ছাত্রদের পরিশ্রমবিমুখ করে তুলছে? তারা short attention syndrome-এর শিকার হয়ে পড়ছে কি?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : এর অপব্যবহার হচ্ছে। আমাদের মাস্টারমশাইরা কোনো বিষয়ের উপর চারটে-পাঁচটা বইয়ের রেফারেন্স দিতেন। আমরা লাইব্রেরিতে বসে সে-সব বই ঘেঁটে বিষয়টির মধ্যে ঢুকতে চেষ্টা করতুম। ছাত্র হিসেবে এ কাজ তোমরাও করেছ, আশির দশকের গোড়ার দিকে। এতে চারটে বই পড়া হয়ে যেত। আজকের ছাত্রছাত্রীরা চট করে মোবাইলে বইয়ের পাতার ছবিটা তুলে নিচ্ছে। এর একটা কুফল থাকবে না? আর আজকের চিকিৎসকরাও তো স্মার্টফোনের নিরন্তর ব্যবহারের কুফল সম্বন্ধে সাবধান করে দিচ্ছেন--চোখের উপর, ব্রেনের উপর এর কুপ্রভাব রয়েছে।
পরবাস : শেষে, স্যর, দুটো প্রশ্ন রেখে শেষ করব--সেই বীরভূমের গ্রাম থেকে পুনরায় যদি যাত্রাপথ শুরু হতো কোনো মায়ামন্ত্রবলে, কী করতেন কী হতে চাইতেন আপনি? বাকি কোনো কাজ? -- আপনার প্রথম চয়েসটা আমরা জানি, দ্বিতীয়টা?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : আমার নাড়ির টান, আমার শিকড় আমার উদয়পুর গ্রামের সঙ্গে, যেখানে আমি বারংবার ফিরে ফিরে যাই, যাব।
আর, কেরিয়ারের দ্বিতীয় চয়েস? আমাদের দেশে তো সম্ভব নয়, তবে আমার রিটায়ারমেন্টের পর থেকেই ভেবেছি, যদি ডাক্তারি পড়তে পারতুম! ডাক্তারি শাস্ত্রটা পড়ে দেখার খুব ইচ্ছে করে, যদিও জানি...
পরবাস : আপনার প্রিয় একটি রবীন্দ্রকবিতা পড়তে ইচ্ছে করছে এখানে যেটা রিটায়ারমেন্টের দিনে আপনি আবৃত্তি করেছিলেনঃ
প্রথম দিনের সূর্যরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে —
কে তুমি,
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় —
কে তুমি,
পেল না উত্তর।
স্যর, আপনার প্রিয় তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত বাছতে বললে কোন্টা কোন্টা বাছবেন?
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : (অনেকটা সময় ধরে ভেবে) আমার অতি প্রিয় তিনটি রবীন্দ্রগানঃ
• সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি, দুঃখে তোমায় পেয়েছি প্রাণ ভরে
• খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি মনের ভিতরে
• ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জন্ম দাও হে
পরবাস : সর্বশেষ প্রশ্নঃ কলেজে আমাদের কট্টর মার্ক্সবাদী শিক্ষক অমলকুমার মুখোপাধ্যায় আজ ঘোর ঈশ্বরবিশ্বাসী কিনা জানতে ইচ্ছে করে।
অমলকুমার মুখোপাধ্যায় : অবশ্যই বিশ্বাসী। প্রবল বিশ্বাসী।
Robert Browning-এর সেই বিখ্যাত ‘The Melon-Seller’ কবিতাটি মনে করিঃ
“Shall we receive good at the hand of God
And evil not receive?”
তাই,
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।পরবাস : আমাদের প্রণাম নেবেন, স্যর।
ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন।
নয়ন আমার রূপের পুরে
সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে,
শ্রবণ আমার গভীর সুরে
হয়েছে মগন।তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার
বাজাই আমি বাঁশি।
গানে গানে গেঁথে বেড়াই
প্রাণের কান্নাহাসি।
এখন সময় হয়েছে কি।
সভায় গিয়ে তোমায় দেখি
জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব
এ মোর নিবেদন।
|| আলাপচারিতা সমাপ্ত ||