লাইব্রেরীতে বসে ছিলেন মোহনবাবু, একাই। যাবার আগে শেষবারের মতো ওঁর প্রিয় বাংলা অডিও-বইগুলো শুনছিলেন। এগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না তো, মনটা তাই খারাপ।
ডিজিটাল ফর্মে হলেও এত ডাটা নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। একে তো প্রচুর ডাটা-স্টোরেজ-ডিভাইস লাগবে, তাছাড়া এইসব পুরনো বাংলা বই প্রায় কেউই শোনে না আজকাল। এইসব বইয়ে যে পরিবেশের কথা আছে — সেই সমাজব্যবস্থা, সেই প্রকৃতি, সেই সময়ের মানুষের অনুভূতি, ভালো বা মন্দ লাগা--সে সবই থেকে আজকের দুনিয়া একেবারেই আলাদা। তাই আজকের মানুষ ওই সময়ের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে না; এই অডিও-বইগুলোকে তাই আর তেমন উপভোগ করে না। আর এখন যেখানে যাচ্ছেন, সেখানের পরিবেশ বা প্রকৃতি তো আরোই আলাদা। কাজেই অমূল্য হয়েও এই সব বইই আজকের প্রজন্মের কাছে মূল্যহীন। তাই অনেক তর্কবিতর্কের পর এগুলো নিয়ে যাওয়া হবে না, এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে।
বইগুলো শুনতে শুনতে ভাবছিলেন এইসব। এমন সময় দরজা খুলে ঢুকলো সঞ্জয়। “এবার কি বেরোবো স্যার? আমরা কিন্তু রেডি।”
“হ্যাঁ, চল। মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই — ফেলেই তো যেতে হবে সব।” বললেন মোহনবাবু।
“মন খারাপ লাগছে?”
“সে তো হবেই, সঞ্জয়। তোমাদের এখানে আমার ডেপুটেশন তো কম দিনের নয়। এতো বচ্ছর থাকলাম তোমাদের সঙ্গে, তাই আজ সব ছেড়ে চলে যেতে…”
“স্যার — এখানে তো আর থাকার অবস্থা ছিল না।” বলল সঞ্জয়। “এভাবে মাটির তলায় অথবা লোহার এয়ারটাইট ঘরে, সম্পূর্ণ আর্টিফিসিয়াল পরিবেশে কতদিন থাকবো আমরা? শুধু নিউক্লিয়ার এনার্জি আর বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনার জোরে বেঁচে থাকা যায়? আপনিই বলুন?”
“সেই তো! যেদিন পৃথিবীতে আর একটিও গাছ বেঁচে রইলো না, ন্যাচেরাল সোর্সে জল থাকলো না একবিন্দুও, অতি-বেগুনী রশ্মির জন্যে বাইরে বেরোনো বন্ধ হলো, একটি পাখিও থাকলো না, তখনই জানতাম —; দ্য ডেজ আর নাম্বারড।” বললেন মোহনবাবু। তারপর মাথা নেড়ে বললেন “এত তাড়াতাড়ি সব ধ্বংস হয়ে যেতো না সঞ্জয়, যদি তোমাদের আগের লোকেরা একটু ভেবেচিন্তে …যাক গে, এখন ওসব বলে আর কী হবে।”
“ধ্বংসই তো শেষ নয় স্যার। আরেকপ্রান্তে অপেক্ষা করে আছে আমাদের নতুন পৃথিবী। গত পাঁচবছরে সবাইকে আস্তে আস্তে যেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। আজ আমাদের নিয়ে এই পৃথিবীর লাস্ট স্পেসশিপটা ছাড়বে। চাঁদে একটা স্টপ, সেখান থেকে হাইপার-স্পেশিয়াল জাম্পে পৌঁছে যাবো চল্লিশ আলোকবর্ষ দূরের ট্র্যাপিস্ট থ্রি-তে। সেখানে নতুন স্বপ্ন নিয়ে নতুন পৃথিবী তৈরি করবো আমরা। এখানকার ভুলগুলো করবো না কিছুতেই, দেখবেন স্যার। আপনি শুধু একটু গাইড করবেন…।”
“দেখা যাক কী হয়,” বলে উঠে দাঁড়ালেন গ্রহান্তরের, যুগান্তরের নামহীন সেই তিনি — যিনি যুগে যুগে নানান চেহারায় মানুষের অগ্রগতির পথে শক্তি যুগিয়েছেন অলক্ষ্যে। এবং যাঁর প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও এই পৃথিবীটা আজ জল-বৃক্ষ-আকাশ-পুষ্পবিহীন শুকনো পাথুরে কঙ্কাল হয়ে গেছে। ওঁর আসল পরিচয় অবশ্য খুব কম লোকেই জানে, বেশিরভাগ লোকের কাছেই উনি রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধান রাধামোহন সেনগুপ্ত। সংক্ষেপে মোহন।
অফ বোতামটা টিপে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মোহনবাবু। তারপর ধীরপদে বেরিয়ে এলেন ওঁর প্রিয় লাইব্রেরী ছেড়ে। তারপর দু-পা ফেলে আবার দাঁড়িয়ে গেলেন কী ভেবে। সঞ্জয়ও দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
একটু চুপ করে থেকে তারপর সঞ্জয়ের কাঁধে হাত রেখে মোহনবাবু খিন্নকণ্ঠে বললেন—
“যাবার আগে এই অডিও বইটার শেষটা একটু শুনে নিই দুজনে মিলে? তুমি অবশ্য এইসব দৃশ্য দেখোনি কোনদিন, পুরোটা বুঝতেও পারবে না হয়তো… তবুও — শোনো। ভালো লাগবে।”
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাউন্ড সিস্টেমটা শেষবারের মতো চালু হল। পৃথিবীর শেষ দুজন মানুষ শুনতে থাকলো লাইব্রেরীর স্পিকারে বাজতে থাকা সেই আশ্চর্য কয়েকটি পংক্তি—
“পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন — মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যাঙ্গাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়…”
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'ফাউল প্লে')