“বাবা, তুমি অকারণে এত উত্তেজিত হচ্ছো! এখনকার ফুটবল — বলতে গেলে সব খেলাই যথেষ্ট টাফ হয়ে গেছে। ফুটবল, ক্রিকেট সবই। এমনকি কোচিং ক্লাসেও সেরকমই শেখায়।” বলল সুব্রত।
বিমলবাবু চুপ করে নিজের খাটে বসে রইলেন। আজ, জীবনে প্রথম, নাতিটার গায়ে হাত তুলেছেন। তাও আবার সবার সামনে। কাজটা ঠিক হয়নি।
নাতি-অন্ত প্রাণ বিমলবাবুর। আর নাতি রোহিতও ওঁর খুব ন্যাওটা — ওঁর সঙ্গেই ফুটবল কোচিং ক্লাসে যায়। যদিও ক্লাস এইটে পড়ে — একা যেতেই পারে, তবুও বিমলবাবু সঙ্গে যান। একটু হাঁটাও হয়, তাছাড়া ফুটবল খেলা দেখা হয় বেশ।
ফুটবল বলতে বিমলবাবু একসময় অজ্ঞান ছিলেন। ফুটবল আর মোহনবাগান। বড় খেলা মানেই মোহনবাগান গ্যালারীতে বিমল চৌধুরীকে দেখা যাবেই। সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা। মাঠে যান না উনি আজ অনেককাল। মাঝে মাঝে টিভিতে ওই বিদেশী ফুটবল দেখেন একটু আধটু। আর এই নাতি রোহিতের কোচিংয়ের ফুটবল।
আজকে রোহিতদের ম্যাচ প্র্যাকটিস — উনি মন দিয়ে দেখছিলেন। রোহিতটা রাইট ব্যাকে খেলে। বেশ ভালো খেলে — নিখুঁত ট্যাকলিং, ডিসট্রিবিউশন, দ্রুত ওভারল্যাপে ওঠা। বেশ ভালো।
কেন জানি না, আজ রোহিত খেলতে পারছে না। উলটোদিকের ফরওয়ার্ডে খেলা ছেলেটা — লালন চৌবে — অসম্ভব দ্রুতগামী আর দারুণ খেলে, একেবারে নাচিয়ে দিচ্ছে ওকে। কিছুতেই তাকে সামলাতে পারছে না রোহিত। দুবার তো তার জার্সি ধরেও টানলো রোহিত।
মাথা নাড়লেন বিমলবাবু। ঠিক নয় এটা।
তারপরই হঠাৎ কাণ্ডটা ঘটলো। একেবারের হাফলাইন থেকে বাঁদিক ধরে বল নিয়ে একটা লম্বা দৌড়ে উঠে এলো লালন — রোহিতের ঠিক সামনে। তারপর বাঁপায়ে বল রেখে একটা চমৎকার বডি-ফেইন্ট দিলো, আর তাতেই টলে গেল রোহিত। নিখুঁতভাবে ব্যালেন্স রেখে লালন যখন রোহিতের পাশ দিয়ে বেরোচ্ছে, ঠিক তখনই পা-টা চালালো রোহিত। লালনের শিনবোনে লাগলো রোহিতের স্পাইকবুট, হুমড়ি খেয়ে পড়লো ছেলেটা।
ফাউল।
না, ফাউল নয়। কোচ আখতারউদ্দিন — যিনি এই খেলার রেফারিং করছেন — দেখতে পাননি। দৌড়ে এসে বললেন খেলা চালিয়ে যেতে।
খেলা অবশ্য বন্ধ করতেই হলো। ইতিমধ্যে বিমলবাবু মাঠে ঢুকে পড়েছেন। লম্বা লম্বা পায়ে এসে পড়েছেন কোচ আখতারউদ্দিন আর রোহিতের সামনে। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন “এটা ফাউল। আপনার রোহিতকে লাল কার্ড দেখানো উচিত। এক্ষুনি।”
“আরে নেহি স্যার — আজকালকা ফুটবলমে থোড়া বহুত চলতা হ্যায়। লালন কো ভি সিখনা পড়েগা ডিফেন্ডারকা রাফ ট্যাকল সে ক্যায়সে বচনা হ্যায়।” আখতারউদ্দিন বলে উঠলেন।
“আ ফাউল ইজ আ ফাউল, স্যার। ইয়ে আপ আপকা বাচ্চেলোগোকো সিখাইয়ে প্লিজ।”
“দাদু, ছেড়ে দাও। এসব একটু চলে — এখন কেউ…”
বাকিটা আর বলতে পারে নি রোহিত। কারণ ঠিক তখনই একটি মোক্ষম থাপ্পড় এসে পড়েছিল তার গালে। দাদু যে কোনদিন তার গায়ে হাত তুলতে পারে, রোহিত কল্পনা করতে পারেনি।
“বাবা, ও আজকালকার ছেলে। সবাইয়ের সামনে ওইভাবে মারলে ওকে? এরা তো আমাদের মতো নয়, বাবা, যে সাত চড়ে রা কাড়বে না। অত্যন্ত সেন্টিমেন্টাল — কিসের থেকে কী করে বসে…” বাবাকে বলছে সুব্রত।
হাত তুললেন বিমলবাবু। “তুই চিন্তা করিস না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো কাল সকালে। বুঝিয়ে বলবো। আমিও…যাক গে…আমি বুঝিয়ে বলবো ।”
খাট থেকে উঠে বিমলবাবু ধীর পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিছনে একটা চওড়া বারান্দা আছে — সেখানে একটা ডেকচেয়ার ওঁর খুব পছন্দ। সেখানেই গেলেন বোধহয়।
বিমলবাবুর খাটে একটা পুরনো ছবির অ্যালবাম পড়ে আছে — বিমলবাবু এতক্ষণ সেটাই দেখছিলেন বোধহয়। কৌতূহল বসে সুব্রত তুলে নিলো সেটা। আগে এটা দেখেনি ও।
অ্যালবামটা বেশ পুরনো — সেকেলে স্টাইলের। সাদাকালো ছবি সব — ফটো-কর্নার দিয়ে লাগানো। বিমলবাবুর ছোটবেলার সব ছবি। ছবিতে আছেন বিমলবাবুর বাবা এবং মা, ছোট্ট বিমলবাবু আর ওর আরও ছোট্ট ভাই — কমল। এঁকে অবশ্য দেখেনি সুব্রত — সুব্রতর ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছেন।
অ্যালবামের অনেকটাই খালি। শুধু প্রথম দশপাতায় কিছু ছবি, তারপর দুটো পাতায় কয়েকটা সংবাদপত্রের কাটিং। খেলার খবর। তখনকার দিনের নাটকীয় স্টাইলে লেখা ম্যাচ রিপোর্ট। শিরোনামঃ “লীগের বড়খেলায় মেজাজ হারালেন বিদেশ। গ্যালারি উত্তাল — ১৬জন নিহত।”
নিচের খবরে বিশদ বর্ণনা ম্যাচের।
“অরুণ ঘোষের মোহনবাগান টিমের দ্রুততম অস্ত্র বিদেশ বোসকে অকেজো করে দিতে পিকে রাইট ব্যাক হিসেবে নামিয়েছিলেন প্রাক্তন অধিনায়ক দিলীপ পালিতকে। দিলীপ পালিত কড়া ট্যাকলার, স্কিলের দিক থেকে তেমন জোরালো না হলেও অভিজ্ঞতায় এবং মারকুটে স্টাইলে খেলে বিদেশকে রুখে দেবেন বলেই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বিদেশের তীব্র গতির সামনে বারবার নাকানি-চোবানি খেয়ে গেলেন দিলীপ পালিত, এবং ক্রমাগত চোরাগোপ্তা পা চালাতে থাকলেন বিদেশের ওপর। একসময় ফুঁসে উঠলেন বাটানগরের শান্ত ছেলেটি — দ্বিতীয়ার্ধের বারো মিনিটের মাথায় একটি বিশ্রী ফাউল করলেন দিলীপ পালিতকে। রেফারি সুধীন চ্যাটার্জি, যিনি এতক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের মতো দিলীপ পালিতের অজস্র অপরাধ ক্ষমা করে চলেছেন, অকস্মাৎ অতীব কর্তব্যনিষ্ঠ হয়ে উঠে লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন বিদেশ বোসকে। বোধহয় সেই মুহূর্তেই, অজান্তে তিনি আরও ষোলটি প্রাণকে এক অদৃশ্য লালকার্ড দেখিয়ে পৃথিবীর মাঠ থেকে বের করে দিলেন।
হ্যাঁ, দিলীপ পালিতকে মার্চিং অর্ডার তিনি দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। দুদলের সমর্থকদের মধ্যে তর্কাতর্কি বেড়েই চলেছে, যা ম্যাচের শেষে খণ্ডযুদ্ধের রূপ নেয়। আর ষোলই আগস্টের সেই খণ্ডযুদ্ধে আমরা হারালাম ষোলটি প্রাণ, যাদের কয়েকজনের বয়েস তখনো ষোলও হয়নি।
খেলার ফল ১-১, অর্থাৎ হারজিত হয়নি। কিন্তু আজ, ১৯৮০ সালের ষোলই অগস্টে হেরে গেল কলকাতা ফুটবল — যাকে বলা হয় ফুটবলের মক্কা।”
আলাদা একটা ক্লিপিংয়ে ওই ষোলজন মৃতের নাম দেওয়া আছে। বোধহয় একদিন পরের ক্লিপিং। তাতে একটা নাম পেন দিয়ে আন্ডারলাইন করা আছে। অস্পষ্ট হলেও এখনো কমল চৌধুরীর নামটা পড়া যায়।
আজকের তারিখটা মনে পড়লো সুব্রতর। ১৬ই অগস্ট।
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'পথ ও পথের প্রান্তে')