• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৩ | জুলাই ২০২১ | উপন্যাস
    Share
  • পরিক্রমা : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়


    || ১ ||

    মেজবাবু উমাপদ টেবিলে বসে পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে রুটি মাংস খাচ্ছিল। তার আঙ্গুল চাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সকাল-সকাল গগন মণ্ডলকে আগাপাছতলা রগড়ে সে যার-পর-নাই সন্তোষ লাভ করেছে। থানার লক আপের পেছনে একটা জানলা-বিহীন ঘর আছে। পোশাকি নাম ইন্টেরোগেশন রুম। হেড কনস্টেবল চন্দ্রনাথ নাম দিয়েছে – হুড়কো-ঘর। হুড়কো-ঘরের বন্ধ দরজার পেছন থেকে এখনও মাঝেমধ্যে গগন মণ্ডলের কাতরোক্তি শোনা যাচ্ছিল। বর্ষাকালে ঝোপে-জঙ্গলে সাপে ব্যাং ধরলে যেমন শব্দ ওঠে গগনের গলা দিয়ে থেকে থেকে অনেকটা সেই রকম শব্দ বেরোচ্ছিল। মেজবাবুর ভ্রূক্ষেপ নেই। সে কাঠের টেবিলের ওপর বাঁ-হাতের আঙুল দিয়ে তবলার বোল তুলতে-তুলতে মাংসর হাড় চিবোচ্ছে। যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে গগনের আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গত করছে।

    মাতাজির আশ্রমে নিশিকান্তর মার্ডারের পর এই অঞ্চলের দু’-চারজন হিস্ট্রি শিটারদের মত গগনও ক’দিন বেপাত্তা ছিল। গতকাল মাঝরাতে উমাপদ গগনকে লাইনের ধারের জুগ্‌গি-ঝোপড়ি থেকে তুলে এনেছিল। সঙ্গে একখানা ছ’-ঘরা আর গোটা কতক কার্তুজ। গগন খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে একটা ঝাড়খণ্ডী বেশ্যা মেয়ের বুকে মুখ গুঁজে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। দেওয়ালে ঝোলানো প্যান্টের পকেট থেকে অস্ত্রটা সময় মত বের করতে পারেনি। চুলের মুঠি ধরে বসিয়ে দেবার পরও বুঝতে পারছিল না সামনে কারা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল বেচারা মাস খানেক ঘুমোয়নি। মেয়েটাও বোধ হয় লাইনে নতুন। জানত না বেশ্যাপাড়ার বেশির ভাগ দালালই পুলিশের খব্‌রি। ঘুম ভেঙে হাঁউমাঁউ করে ভোজপুরী হিন্দীতে বিলাপ করছিল। আগে থেকে খবর ছিল বলে দময়ন্তীও সঙ্গে গিয়েছিল। গগনের পিছন-পিছন মেয়েটাকেও টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলার সময় তার মনে হচ্ছিল মেয়েটার কী দোষ? জেনেশুনে তো আর গগনকে ঘরে ঢোকায়নি।

    আসলে এখনও হাতপায়ের আড় ভাঙ্গেনি দময়ন্তীর। পুলিস-জন্মের কায়দা-কানুনগুলো ঠিকঠাক রপ্ত করে উঠতে পারেনি। মাত্র মাস দু’য়েক হল পোস্টিং পেয়েছে। বাবা মাতাজিকে ধরে পড়েছিল। প্যানেলে নাম ওঠার পরও চিঠি আসছিল না। মাতাজি আশ্বাস দিয়েছিলেন – হবে। তাও সাড়ে তিন লাখ টাকা জায়গা মত গুনেগেঁথে দেবার পর চাকরির চিঠিটা এসেছিল। বাবার বেশ কয়েক বিঘে চাষজমি গিয়েছিল টাকাটা যোগাড় করতে। দাদার মুখ ভার হয়েছিল। বাবা পাত্তা দেয়নি। বলেছিল – দু’-বছরে ওই টাকা উঠে আসবে। ছ’-মাসের কনস্টেবল ট্রেনিং শেষ করে, পোস্টিং পেল - থানা শান্তিপুর, জিলা হুগলী। এ অঞ্চলের গা-বাঁচানো মধ্যবিত্ত মানুষেরা অবশ্য বিরক্তিতে নাক কুঁচকে বলে - অশান্তিপুর। খুন-জখম, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দলবাজি লেগেই আছে।

    থানায় জেনানা লক আপের গরাদ ভেঙে গেছে। ভেতরে পুরোন ফাইল ডাঁই করে ফেলে রাখা। ইঁদুরের উৎপাতে পা রাখা দায়। মেয়েটাকে ধরে রাখা গেল না। উমাপদ মেয়েটাকে বেশ করে ধমক-ধামক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। ভয় দেখিয়েছিল ঝোপড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করলে ধরে এনে অস্থানে-কুস্থানে লঙ্কা ডলে দেবে। দময়ন্তী ভাবছিল পালিয়ে বাঁচার ইচ্ছে থাকলে আর কে রেল লাইনের ধারে বেশ্যাবৃত্তি বেছে নেয়!

    থানার দায়িত্ব উমাপদর ঘাড়ে চাপিয়ে বড়বাবু তারকেশ্বরে শ্বশুরবাড়ি গেছেন। উমাপদর এখন বেজায় রোয়াব। নেহাতই ঘুম পেয়ে যাওয়ায় উমাপদ গত রাতে পুলিস কোয়ার্টারে ফিরে গিয়েছিল। চটজলদি গগনকে নিয়ে লেগে পড়েনি। সকালবেলা ডিউটিতে এসে ডেস্কের হাবিজাবি কাগজ-পত্র ক্লিয়ার করতে করতে উমাপদর মেজাজ খিঁচড়ে গেল। নিরামিষ কলমপেষা কাজ তার মোটেই পছন্দ নয়। সাড়ে এগারটা বাজতে না বাজতেই সে উঠল। প্যান্টটা পেটের ওপর তুলে টাইট করে বেল্ট বাঁধল। চন্দ্রনাথকে হেঁকে বলল গগনকে হুড়কো ঘরে নিয়ে যেতে। ডাণ্ডাটা হাতে তুলে বেরিয়ে যেতে যেতে দময়ন্তীকে বলে গেল, “দাশুর দোকান থেকে রুটি-মাংস আনিয়ে রাখিস। তোর বৌদি দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছিল। রান্না করতে পারেনি।”

    থানার বাইরেই বটতলায় দাশরথি লাঞ্চহোম। সেখান থেকে রুটি-মাংস নিয়ে এসে ঢাকা দিয়ে রেখে দিয়েছিল দময়ন্তী। মেজবাবুর জন্য এটুকু না করলেই নয়। গগনকে আড়ং ধোলাই দিয়ে ফিরে, ভাল করে হাত ধুয়ে উমাপদ খেতে বসল। হাতে গগনের পেচ্ছাপ লেগে গিয়েছিল। তলপেটে দুটো লাথি পড়তেই শুয়োরের বাচ্চা ছড়ছড়িয়ে মুতে দিল। জমাদারকে ডেকে ফিনাইল ঢেলে মেঝে সাফ করাতে হবে। টেবিলের ওপর পরিপাটি করে খবরের কাগজ বিছিয়ে থালার ওপর থেকে ঢাকা সরাল উমাপদ। থালার পাশে ফালি করে কাটা লাল পিঁয়াজ, একখানা গাঢ় সবুজ রঙের কাঁচালঙ্কা। মাংসর ঝোলে রুটি ভিজিয়ে মুখে তুলে পিঁয়াজে কামড় দিল কচ করে। দময়ন্তী নিজের টেবিল থেকে দেখছিল উমাপদ চোখ বুজে মাংসর নলী চুসছে। সামনে রাখা ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। উমাপদ দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখ্‌ তো, গগনের কোন বাপ ফোন করছে। মালটা এখনও পুরোটা উগরোয়নি। এক্ষুণি ছেড়ে দিতে হলে ঝামেলা।”

    দময়ন্তী উঠে এসে ফোন তুলে শুনল কোনও কল সেন্টার থেকে মিহি গলায় একটা মেয়ে ক্রেডিট কার্ড বেচার জন্য অনুরোধ করছে। কোনও উত্তর না দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখতে-রাখতে বলল, “উমাপদদা, লোকটা এখনও কাৎরাচ্ছে, মরে যাবে না তো?”

    উমাপদ ততক্ষণে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বাসি খবরের কাগজে হাতের তেল মুছছিল। এঁটো হাতেই দময়ন্তীর থুতনি ধরে আদর করে নেড়ে দিয়ে বলল, “না গো মামণি, মরবে না। সে আমি জায়গা বুঝেই কেলিয়েছি,” একটু থেমে মিচকে হেসে যোগ করল, “তবে তোর কষ্ট হলে গগনের পাছায় বাম ঘষে দিয়ে আসতে পারিস। আমার আপত্তি নেই।”

    উমাপদর মুখ থেকে পিঁয়াজের ঝাঁঝ আসছিল। দময়ন্তী সরে গেল। টয়লেটে গিয়ে বেসিনে জল খুলে দিয়ে ভাল করে ঘষে-ঘষে মুখ ধুল। গাল থেকে উমাপদর তেল আঙ্গুলের দাগ যাচ্ছে না। চোখে, মুখে, কানের পিছনে জল দিল। চুল আঁচড়ে একটা হাত খোঁপা বেঁধে ক্লিপ লাগাল। ফিরতেই উমাপদ বলল, “কোথায় গেছিলি? তোর বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল।”

    বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল মানে – মা। দুপুরবেলা মা ব্যস্ত থাকে, সাধারণত ফোন করে না। আজ কী হল কে জানে? সরে এসে নিজের মোবাইল থেকেই মাকে ফোন করল দময়ন্তী। জানলার কাছে না এলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। বাইরে কড়া রোদ, চোখ ঝলসে যায়। মা ফোন ধরে বলল, “কাল ছুটি নিতে পারবি? তোর বাবা বলছিল মাতাজির আশ্রমে যাবে।”

    দময়ন্তীর বাড়ি নবগ্রামে। শান্তিপুর থেকে দুটো ষ্টেশন। মাতাজির আশ্রম এই শান্তিপুরেই - গঙ্গার ধারে প্রায় বিশ-পঁচিশ কাটা জায়গা নিয়ে। ভেতরে দেবী-মন্দির। মন্দিরের সামনে প্রশস্ত চাতাল। হেসে খেলে সাত-আটশ লোক বসে প্রবচন শুনতে পারে। প্রসাদ পায়। বর্ষায় তেরপলের ছাউনি পড়ে। মন্দিরের পেছন দিকে গঙ্গা, আম-জাম-জামরুলের বাগান, আশ্রমিকদের হোস্টেল। মাতাজি শান্তিপুরে থাকলে ওখানেই একটা ঘরে থাকেন। গঙ্গার দিকটা ছাড়া আশ্রম ঘিরে উঁচু পাঁচিল, সিকিউরিটি গেট। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে সার দিয়ে নারকোল গাছ। দময়ন্তী আগে গেছে বাবা-মার সঙ্গে। মন্দিরের চাতালের ঠান্ডা মেঝেতে বসে প্রবচন শুনেছে। সারা দেশে মাতাজির ভক্ত ছড়িয়ে আছে, তারা সব সময় তাঁকে ডাকাডাকি করে। মাতাজি বাইরে গেলে নিশিকান্তদার ওপর আশ্রম পরিচালনার ভার দিয়ে যেতেন। ওই মন্দিরের চাতালেই নিশিকান্তদা মার্ডার হলেন। মাতাজি তখন পুনেতে। ভোরবেলা খবর এল। দময়ন্তীরা গিয়ে বডি তুলে আনল। পুলিশের চাকরিতে জয়েন করার পর সেই প্রথম কাঁচা রক্ত দেখল দময়ন্তী।

    দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, “একবেলা ছুটি নিলে হবে না?”

    মা বলল, “মাতাজি ডেকে পাঠিয়েছেন। কী কাজ আছে, কতক্ষণ লাগবে কে জানে!”

    মেজবাবুকে বললে এক্ষুণি খেঁকিয়ে উঠবে। তবু না বলে যাওয়ার উপায় নেই। মহিলা কনস্টেবল বলতে দময়ন্তী আর ললিতাদি। ললিতাদির বাচ্চা হবে। মেটারনিটি লীভে গেছে প্রায় মাস খানেক। মিন-মিন করে ছুটির কথাটা উমাপদর কাছে পাড়ল দময়ন্তী। উমাপদ মরা মাছের মত চোখ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল, যেন শুনতে পায়নি। তারপর বলল, “যাবি বইকি, মাতাজি ডেকেছেন, না গেলে চলে?”

    দময়ন্তী অবাক হল। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। উমাপদ টেবিলের সামনের খালি চেয়ার দেখিয়ে বলল, “বোস, কাল আশ্রমে যাবিই যখন গোটা কতক কাজ সেরে আসবি।”

    *

    আশ্রমে পৌঁছোতে বেশ দেরিই হয়ে গেল দময়ন্তীদের। স্নান করে নিত্যপুজো সেরে বেরোতে বেরোতে মা এগারোটা বাজিয়ে দিল। আশ্রমে আজ ভিড় নেই বেশি। মন্দিরের সামনের চাতালে উঁচু চেয়ারের ওপর কম্বলের আসন পেতে মাতাজি বসে ছিলেন। শান্ত সৌম্য চেহারা। পরনে গেরুয়া বসন। চেয়ারটা বেশ সিংহাসনের মত দেখতে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মলিনাদি। চব্বিশ ঘন্টা মাতাজির সঙ্গে ছায়ার মত লেগে থাকেন। মাতাজির সুবিধে-অসুবিধে খাওয়া-দাওয়া দেখার ভার মলিনাদির। সামনে মেঝেতে সতরঞ্চি পাতা। দু’-চার জন ভক্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। তাদের পাশ কাটিয়ে বাবা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ওদের দেখে মৃদু হাসলেন মাতাজি। হাত দেখিয়ে বসতে বললেন। নিচু স্বরে কথা বলছিলেন মাতাজি। দু’-একজন করে ভক্তদের বিদায় জানাচ্ছিলেন। দময়ন্তীরা বসেই ছিল। আর একটি পরিবারও ওদের সঙ্গে বসে ছিল। দময়ন্তী চেনে না, দেখেনি আগে। বয়স্ক ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা আর একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলে। ছেলেটির চোখে পুরু কাচের চশমা। দময়ন্তী নজর করছিল মাতাজির কথাবার্তায় ছেলেটির বিশেষ আগ্রহ নেই। উসখুস করছিল, ঘড়ি দেখছিল বারবার। বোঝা যাচ্ছিল নেহাতই দায়ে পড়ে এসেছে, বাবা-মার কথা রাখতে। অন্যরা চলে যেতে, মাতাজি হাতের ইশারায় ওদের ডাকলেন। সামনে যেতে বললেন। ওরা দুটি পরিবার এগিয়ে গিয়ে মাতাজিকে প্রণাম করে পায়ের কাছে বসল।

    মাতাজি হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন, “দয়াময় ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।”

    স্নেহ ভরা দৃষ্টিতে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে মাতাজি বললেন, “তোমার হাতটা একবার দাও তো মা।”

    দময়ন্তী নিজের ডান হাত এগিয়ে দিতে মাতাজি তার হাতটি নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিলেন। তাঁর হাতের পাতা অসম্ভব ঠান্ডা, দময়ন্তী শিউরে উঠল। তার সদ্য পুলিস-ট্রেনিং নেওয়া শক্ত হাত পুকুরের জলে পানকৌড়ির ডুব দেওয়ার মত মাতাজির কমনীয় হাতের মধ্যে ডুবে গেল। মাতাজির শরীর থেকে ফুল-চন্দন মাখা সুন্দর একটা গন্ধ আসছে। এর আগে যখন আশ্রমে এসেছে দূর থেকে মাতাজিকে প্রণাম করে চলে গেছে। মাতাজিকে কখনও স্পর্শ করেনি। পাশের বয়স্ক ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে মাতাজি বললেন, “এই মেয়েটির কথাই তোমায় বলছিলাম শ্রীমন্ত। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে।”

    বয়স্ক ভদ্রলোকটি মুখ ফিরিয়ে দময়ন্তীর দিকে তাকালেন। মাতাজি অল্প নিচু হয়ে পাশে বসে থাকা যুবকটির একটি হাতও অন্য হাতের মধ্যে নিলেন। তাদের দুজনের হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, “দুটিতে খুব মানাবে।”

    দময়ন্তী নিদারুণ আশ্চর্য হল। মাতাজি তার বিয়ের সম্বন্ধ করছেন। পাশে তাকিয়ে দেখল বাবার চোখ মুখেও বিস্ময়। তার মানে এখানে আসার আগে বাবাও এ ব্যাপারে কিছু জানত না। মাতাজি বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শ্রীমন্তর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, হুগলী পলিটেকনিক থেকে পাস করে সরকারি চাকরি করে, মুম্বাইতে।”

    বাবা বলল, “কিন্তু মাতাজি... মেয়ে তো এই সবে চাকরিতে ঢুকল। এক্ষুণি কী করে...? তাছাড়া অত দূরে…”

    মাতাজি বাবাকে থামিয়ে দিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “সে না হয় জয়ন্তই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসবে। নিজের মাটি ছেড়ে কতদিন আর দূরে পড়ে থাকবে? আমার এখানে লোকবল দরকার। দেশবিদেশ থেকে অনেক অতিথি আসে, নতুন গেস্টহাউস তৈরি হবে। জয়ন্তকে তার ভার দেব ঠিক করে রেখেছি।”

    ছেলেটির নাম জয়ন্ত। সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল। মাতাজি চোখ বুজে ধ্যানস্থ হলেন। তাদের দুটি হাত ওঁর হাতের মধ্যে ধরা রইল। যারা আশ্রমে নিয়মিত আসে তারা জানে মাতাজি এমন আচমকাই ভাব-সমাধিতে চলে যান। সেই মুহূর্তে দময়ন্তী টের পেল মাতাজির হাতের মুঠি থেকে তার শরীরে রিন-রিন করে একটা অদ্ভুত অনুভূতির স্রোত ঢুকছে। তার স্নায়ুতন্ত্র ধীরে-ধীরে অবশ হয়ে আসতে লাগল। সে মাথা নিচু করে বসে রইল। মিনিট খানেক পরে মাতাজি চোখ খুলে তাকালেন। ওদের দু’জনের হাত ছেড়ে দিলেন। দূরের দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে বললেন, “আমার ধ্যানের সময় হল, আমি এবার উঠব। তোমরা প্রসাদ খেয়ে যেও।”

    মলিনাদির হাত ধরে মাতাজি উঠলেন। মন্দিরের দরজার কাছে গিয়ে হাতজোড় করে প্রণাম করে হোস্টেলের দিকে পা বাড়ালেন। দুটি মধ্যবয়স্কা নারী পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছেন। মলিনাদি মাতাজিকে স্পর্শ করে নেই। কিন্তু সব সময় যেন তাঁকে বেষ্টন করে রয়েছেন। দময়ন্তী আড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখল জয়ন্ত নামে ছেলেটি এক দৃষ্টে হাতের পাতার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। বাবা অন্য ভদ্রলোকটির সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন। ওনারা তিন পুরুষ ধরে শান্তিপুরেরই বাসিন্দা। শান্তিপুর বাজারে শ্রীমন্তবাবুর রেডিমেড গারমেন্টসের দোকান – শ্রীমাধব বস্ত্রালয়। বড় ছেলে অনন্তই দেখভাল করে। চার-পাঁচটি কর্মচারী আছে। শ্রীমন্তবাবুও সন্ধ্যের দিকে বসেন। দময়ন্তী দেখল কথাবার্তার মাঝখানে জয়ন্ত উঠে চলে গেল। একটু যেন অসন্তুষ্ট। মাতাজি তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছেন বলেই বোধ হয়।

    দুটি পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তা গড়ে তোলার একটা প্রস্তুতি থাকে। সেটা এই আশ্রমে বসে সম্ভব নয়। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব সারা হলে ওরাও উঠল। আশ্রমের খাবার জায়গা হোস্টেলের নিচের দালানে। পংক্তিতে বসে খাওয়া। সরু চালের ভাত, কাঁচা মুগের ডাল, আলু কপি শিম কলাইশুঁটির পাঁচমিশালি তরকারি। শেষ পাতে পায়েস। খাওয়া শেষ করে দময়ন্তী বারান্দায় বেরিয়ে এল। লম্বা টানা বারান্দা। গাছপালার ফাঁক দিয়ে টুকরো-টুকরো রোদ এসে পড়েছে। খাবার দালানের পাশে আনাজ মশলার ভাঁড়ার। আধখোলা দরজার ভিতরের অন্ধকার থেকে দু’-চারটে কথা ভেসে আসছে। দময়ন্তীকে দেখে ডানা ঝাপ্টিয়ে দুটো পায়রা উড়ে গেল। একটা কাঠঠোকরা গাছের ডালে ঠোঁট ঠুকছে। দময়ন্তী হাঁটতে-হাঁটতে বারান্দার অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেল। হোস্টেলের পিছনে একটা পুকুর আছে। দময়ন্তী আগে আসেনি এদিকটায়। পুকুর থেকে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। দময়ন্তী দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। পুকুরের অন্যদিকে একটা অ্যাসবেস্টসের শেড দেওয়া একানে ঘর।

    “আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল,” দময়ন্তী ফিরে তাকিয়ে দেখল জয়ন্ত। কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। তার দিকে কিছুটা কুন্ঠিত হয়ে তাকিয়ে আছে। বুঝতে চেষ্টা করছে, নিজে থেকে এগিয়ে এসে কথা বলায় দময়ন্তী অখুশি হল কিনা। দময়ন্তী কিন্তু উৎসুক হল, “বলুন।”

    জয়ন্ত বলল, “এখানে কথা বলা যাবে না। আপনি কি আমার সঙ্গে আশ্রমের বাইরে একবার দেখা করতে পারবেন?”

    দময়ন্তী ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। জয়ন্ত বলল, “তাহলে এক কাজ করুন। চুঁচড়োয় বইমেলা লেগেছে। সামনের শনিবার বিকেলবেলা ওখানে চলে আসুন। আপনার মোবাইল নম্বরটা দিন। আমি আপনাকে খুঁজে নেব।”

    দময়ন্তীর ভাল লাগল। ছেলেটির বেশ সহজ গলায় কথা বলছে। কোনও পর্দা-ফেলা রেস্তোরাঁয় নেমন্তন্ন না করে বইমেলার ভিড়ে দেখা করতে চাইছে। জয়ন্তর নম্বরটা জেনে একটা মিস্‌ড কল দিল। সে ফিরে যাচ্ছিল। দময়ন্তী একটু দোনামোনা করে পিছু ডাকল। একটু ইতস্তত করে বলল, “শুনুন, কিছু মনে করবেন না। আমার কিন্তু এই মুহূর্তে চাকরিটা ছাড়া নিতান্তই অসম্ভব... ক’দিন আগেই বাবা অনেকগুলো টাকা দিয়েছে।”

    জয়ন্ত বলল, “না, না, সে কথা নয়। আসলে...” বলতে বলতে থেমে গেল। একজন আশ্রমিক মহিলা ভাঁড়ার ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ওদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। হয় তো ওদের কথা শুনছিল। ওরা ফিরে তাকাতে অন্য দিকে চলে গেল। জয়ন্ত প্রসঙ্গ বদলাল, বলল,“মাতাজি বলছিলেন গেস্টহাউস তৈরির কথা। আসুন না, আশ্রম চত্বরটা ঘুরে দেখে আসি।”

    বারান্দার শেষে একটা নিচু কাঠের গেট। পেরিয়ে, তিন-চার ধাপ সিঁড়ি নেমে, একটা সরু খোয়া ওঠা রাস্তা। রাস্তাটা পুকুরের পাড় ধরে জিজ্ঞাসা চিহ্নর মত বেঁকে গেছে। দুপাশের বুনো ফুল ফোটা ঝোপ-ঝাড় সরিয়ে কোনোমতে একলা দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটার দরজায় গিয়ে উঠেছে। ওরা দুজনে পায়ে পায়ে সেদিকে এগোল। পুকুরধারে কচু পাতার জঙ্গল। একটা পঞ্চমুখী জবার গাছ জলের ওপর ঝুঁকে আছে। তার ডালপালার জ্যামিতিক ফাঁক ফোকর দিয়ে পানা ভাসা পুকুরের সবুজ জল দেখা যাচ্ছে। রাস্তার অন্য দিকে একটা শিউলি ফুলের গাছ। দু’-একটা অসময়ের শিউলি গাছের নিচে ঘাস আগাছার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। গাছটা পার হবার সময় দময়ন্তী নিচু হয়ে কয়েকটা শিউলি ফুল তুলে নিচ্ছিল। সেই সময় একটা লোক ওদের পথ আটকে দাঁড়াল। লোকটা মাথায় ওদের থেকে প্রায় হাত খানেক লম্বা। কানে মাকড়ি। পরিষ্কার করে কামানো মাথা। গায়ের রঙ মিশ্‌মিশে কালো। জয়ন্তর সামনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে বলল, “হে ম্যান...ক্যান উ লেন্ড মি আ ফিউ বাক্‌স?”

    দময়ন্তী জানত আশ্রমে আজকাল কিছু বিদেশি ভক্ত এসে থাকছে। তারা যে ভিক্ষাবৃত্তিও শুরু করেছে সেটা জানা ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় জয়ন্ত পিছিয়ে এল। একটু সামলে নিয়ে বলল, “নো... নট অ্যাটল।”

    “ডু উ স্মোক?” লোকটা নির্লজ্জের মত হাত বাড়িয়ে রাখল, “দেন গিম্মি আ সিগারেট।”

    জয়ন্ত কড়া গলায় বলল, “সরি, আই ডোন্ট।”

    দময়ন্তী দেখল জয়ন্ত রুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে জয়ন্তর হাত ধরে টান দিল। বলল, “আমরা বরং অন্য দিকটা দেখে আসি... আসুন।”

    জয়ন্তর বাহুর পেশী শক্ত হয়ে আছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ। যদিও কালো লোকটাকে আর অত লম্বা লাগছে না, দময়ন্তী এই মুহূর্তে কোনও ঝুট-ঝামেলা চায় না। উমাপদ যে কাজ সেরে যেতে বলেছিল তা এখনও বাকি।

    লোকটা নড়ল না। রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের পকেট থেকেই একটা চুট্টা বার করে ধরাল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে দাঁত বার করে হাসল। দময়ন্তী জয়ন্তকে জোর করে টেনে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা দিল। আশ্রমের অন্যদিকে একটা স্নানঘাট আছে। চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে গঙ্গার জলে। পাড়ে খোঁটা পুঁতে দুটো ভটভটি নৌকো বাঁধা আছে। ওরা সেখানে গিয়ে দু’-মিনিট দাঁড়াল। চারিদিক শান্ত, নির্জন। পাখিদের ডাক ছাড়া শব্দ নেই। জয়ন্ত চুপ করে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। দময়ন্তী চাইছিল একটু আগের সহজ আলাপচারিতা আবার ফিরে আসুক। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। তার হাতের মোবাইলটা কেঁপে উঠল। মা ডাকছে। দময়ন্তী বলল, “চলুন, ফিরে যাই।”

    *

    মোবাইলটা হাতের তালুবন্দী করে রেখেছিল দময়ন্তী। বইমেলার ভিড়, শোরগোলের মধ্যে বাজলে যেন শুনতে পায়। মায়ের হাজারটা প্রশ্নর পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। যে সময়টা ঠিক করা ছিল তার প্রায় আধ ঘন্টা পরে দময়ন্তী পৌঁছেছে। জয়ন্ত তার জন্য অপেক্ষা করে ফিরে যায়নি তো? বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে। পড়ন্ত রোদ্দুরের মধ্যে পড়ুয়া মানুষরা ভিড় করে বই দেখছে। দময়ন্তী অনিশ্চিত ভাবে একটা বইয়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিল ফিরে গেলে জয়ন্ত একটা ফোন করত নিশ্চয়ই। তখনই হাতের ফোনটা একবার বেজে উঠে থেমে গেল। দময়ন্তী দেখল মোবাইলের স্ক্রিনে জয়ন্তর নামটা ভাসছে। পিছন থেকে তার নাম ধরে কেউ ডাকল। ফিরে তাকাতেই দেখল পুরু কাঁচের চশমার আড়ালে দুটি ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। চোখাচোখি হতে জয়ন্ত হাসল। দময়ন্তী একটু কুন্ঠিত হয়ে বলল, “আমার আসতে দেরি হয়ে গেল...।”

    জয়ন্ত বাধা দিয়ে বলল, “না না, তাতে কী হয়েছে? আমি স্টলগুলো ঘুরে দেখছিলাম। মুম্বাইতে বাংলা বইয়ের দোকানপত্র নেই। পুজোর সময় প্যান্ডেলের পাশে একটা স্টল দেয়। তাতে পছন্দ মত বই পাই না।”

    “আপনার বুঝি বই পড়তে খুব ভাল লাগে?”

    জয়ন্তর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “ঠিক বলেছেন। বইয়ের মত বন্ধু পাবেন না। সুখ-দুঃখে আপনাকে সঙ্গ দেবে। কখনও আপনাকে ছেড়ে যাবে না।”

    দময়ন্তী দেখল জয়ন্তর কাঁধের ঝোলাটা এর মধ্যেই ভরে উঠেছে। দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে গল্প করছিল। কখনও কোনও স্টলে দাঁড়িয়ে বই দেখছিল, উল্টেপাল্টে। দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, “সেদিন বলছিলেন, কিছু কথা আছে। কী কথা?”

    জয়ন্ত থেমে পড়ল। একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বলল, “হেঁটে হেঁটে পায়ে ব্যথা করছে। আসুন একটু চা খাওয়া যাক।”

    বইমেলা ময়দানের একধারে এক সারি চা-জলখাবারের দোকান। সামনে কতকগুলো প্লাস্টিকের রঙ-জ্বলা চেয়ার ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। দময়ন্তীকে বসিয়ে রেখে জয়ন্ত দু’-কাপ চা নিয়ে এল। সঙ্গে একটা কাগজের প্লেটে দু’খানা ডিমের ডেভিল। জানাল এই বস্তুটি সে সচরাচর মুম্বাইতে পায় না। তাই নিতান্তই লোভে পড়ে...। দময়ন্তী হাসল। পেটুক মানুষের মন ভাল হয়। ওরা দু’জনে অন্যদের থেকে একটু সরে বসেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, “সেদিন যখন মাতাজি হাত ধরেছিলেন, আপনি কি একটা শিরশিরানি ফিল করেছিলেন? হাতের ওপর দিয়ে পিঁপড়ে হেঁটে গেলে যেমন হয়।”

    দময়ন্তী চমকে উঠল, “আপনিও টের পেয়েছেন?”

    জয়ন্ত তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “আপনার কি মনে হয় মাতাজির কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আছে?”

    দময়ন্তী চোখ নামিয়ে নিল, “জানি না। সবাই তাই বলে। সেদিন মাতাজি হাত ছেড়ে দেবার পরও অনেকক্ষণ আঙ্গুলে সাড় ছিল না।”

    বইয়ের স্টলগুলোয় একটা একটা করে আলো জ্বলে উঠছে। জয়ন্ত সেদিকে তাকিয়ে বলল, “শরীরের মধ্যে দিয়ে পরিমিত মাত্রার বিদ্যুৎ চালনা করলেও স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় শিখেছিলাম কত মাত্রার বিদ্যুৎ পাঠালে শরীরে কী কী বিপত্তি ঘটবে।”

    দময়ন্তী অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাল, “আপনি কী বলতে চান?”

    জয়ন্ত চশমাটা খুলে হাতে নিল। বলল, “সাধু সন্ন্যাসীরা যে সমস্ত অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখান তার অধিকাংশই বিজ্ঞানভিত্তিক জাদু। সাধারণ মানুষকে বশ করার চাতুরী। মাতাজির হাতের তালুর মধ্যে লুকোন পরিবাহী তার থাকলে আশ্চর্য হব না।”

    তাকে দেখে দময়ন্তীর মনে হল সে খুব একটা নিশ্চিত নয়। নিজের মনে যুক্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে। দময়ন্তী বলল, “কিন্তু মাতাজি আমাদের সঙ্গে ছলচাতুরী করবেন কেন?”

    জয়ন্ত দুহাত ছড়িয়ে অসহিষ্ণুতা দেখাল, “সেটাই বুঝছি না। কেন? আমাদের ম্যাজিক দেখিয়ে মাতাজির কী লাভ? আমি তো আবার পালাব। আপনার জন্য চিন্তা হচ্ছে। আপনি সাবধানে থাকবেন।”

    এই কথা বলার জন্য জয়ন্ত তাকে ডেকে এনেছিল। তাকে সতর্ক করে দেবে বলে। দময়ন্তী মুখ তুলে জয়ন্তর দিকে তাকাল। ছেলেটার চোখ দুটি বেশ বড় বড়। সর্বদা বেশি পাওয়ারের চশমা পরে থাকে বলে বোঝা যায় না। মানুষের চোখ দেখে মন পড়া যায়। কাছ থেকে ভাল করে দেখল জয়ন্তর দু’চোখে সত্যিকারের উদ্বেগ। দু’দিনের আলাপেই ছেলেটা বন্ধু হয়ে গেছে। কিন্তু জয়ন্তর মুখে ‘পালাব’ শুনে দময়ন্তীর মন খারাপ হয়ে গেল। তারও কিছু কথা বলার ছিল। পরামর্শ করার ছিল। মনে হচ্ছিল ছেলেটাকে বিশ্বাস করে বলা যায়।

    মাতাজির আশ্রম নিয়ে থানায় কিছু উড়ো খবরাখবর আসছিল কিছুদিন ধরেই। তারপর নিশিকান্তদার মার্ডার। মাতাজি পুনে থেকে ফিরে এসেছিলেন পরের দিনই। এসেই শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন। থানা, পুলিশ, ইনভেস্টিগেশন সব নিজেই সামলেছিলেন। মাতাজির অনেক ভক্তই লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রশনে পদস্থ অধিকারী। ব্যাপারটা তখনকার মত ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। গগন ধরা পড়ার পর আবার কেস ফাইল খুলেছে উমাপদ। গগনের পেট থেকে কী কথা বের করেছে সে-ই জানে। দময়ন্তীকে বলেনি। সেদিন জয়ন্তরা চলে যাবার পর, মেজবাবুর কথামত সে আবার একবার আশ্রমের স্নানঘাটে ফিরে গিয়েছিল। ততক্ষণে আলো পড়ে এসেছে। দময়ন্তী দেখল পাড় থেকে ভাঁটার জল সরে যাচ্ছে। নৌকোদুটো কাদায় আটকে ছিল। অন্ধকার নাবাল মাটি ডিঙিয়ে সে ছইয়ের মধ্যে উঁকি দিয়েছিল। বিকেলের ফুরিয়ে আসা আলোয় নৌকোর ছায়াচ্ছন্ন অন্দর-মহল দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। অন্তত গোটা দশেক আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র একটা সাধারণ চটের বস্তায় জড়িয়ে রাখা। তাড়াতাড়ি সরে এসেছিল। এই জিনিসগুলোকে কেউ নিশ্চয়ই বিনা পাহারায় ফেলে রাখবে না। ফেরার সময় আশেপাশে কাউকে দেখতে পায়নি। পরের দিন থানায় উমাপদকে রিপোর্ট করতে সে আগ্রহ নিয়ে শুনেছিল। তারপর গম্ভীরভাবে বলেছিল – চেপে যা, কাউকে বলিসনি এখন।

    জয়ন্ত যখন মাতাজির অলৌকিক ক্ষমতায় সন্দেহ করল তখন দময়ন্তীর মনে হচ্ছিল সেদিনের কথা বলে। এখন মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেল। কী দরকার ছেলেটাকে এ সবের মধ্যে জড়ানোর। আজ নয় কাল সে শান্তিপুর ছেড়ে চলে যাবে। জয়ন্ত তাকে লক্ষ করছিল, জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবছেন এত?”

    দময়ন্তী কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল, “ফিরে যাবেন বললেন? তা’হলে মাতাজির আশ্রমের কাজ করার প্রস্তাবটা নিচ্ছেন না?”

    বলেই মনে মনে জিভ কাটল। মাতাজির কাছে কাজ নেওয়া মানেই বিয়েতে রাজি হওয়া। ছেলেটা ভাবল হয়ত, দময়ন্তী বিয়ের জন্য আদেখলেপনা করছে। জয়ন্ত কিন্তু সে সব দিকেই গেল না। বলল, “সরকারি চাকরি, ছেড়ে দেব বললেই তো আর হুট করে ছাড়া যায় না। তাছাড়া প্রোজেক্টের কাজ সময়ে শেষ করার একটা দায়িত্ব থেকেই যায়।”

    সন্ধে ঘন হচ্ছিল। মেলায় মানুষের ভিড় বাড়ছিল। দময়ন্তী উঠে পড়ল। দেরি হলে মা চিন্তা করবে। মেলার বাইরেই স্টেশনে যাবার একটা শেয়ার অটো পেয়ে গেল। জয়ন্তও এল ওর সঙ্গে। বলল দময়ন্তীকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তালডাঙ্গায় কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। আজকাল নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে ওই অঞ্চলে। ওরা অটো থেকে নেমে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে না ঢুকতেই হুড়মুড় করে লোকালটা এসে পড়ল। ট্রেনে চড়ার পর দময়ন্তীর হঠাৎ মনে হল, জয়ন্তর সঙ্গে আর হয়তো কোনওদিন দেখা হবে না। সে দরজা দিয়ে মুখ বার করে দেখল জয়ন্তও তাকিয়ে আছে। ট্রেন ছেড়ে দিল। গতি বাড়ছে। জয়ন্ত দূরে চলে যাচ্ছে। একটা লোক দৌড়ে এসে হাঁকুপাঁকু করে পাশের কামরায় চড়ল। দময়ন্তীর আবছা মনে হল লোকটাকে সে কোথাও দেখেছে। তাকে কি কেউ ফলো করছে? লোকটাকে ঠিক কোথায় দেখেছে মনে পড়ল না। মনে করার ইচ্ছাও হল না।

    *

    গগন মণ্ডল মুখ খুলেছে সকালবেলায়। নিশিকান্তকে খুন করার সময় সঙ্গে ছিল তারাপদ, আর কানু। দুটোই নামকাটা সেপাই। তারাপদ কোথায় গগন ঠিক জানে না। বাংলাদেশে তার কোন দূর সম্পর্কের মামা থাকে। সম্ভবত সেখানেই পালিয়েছে। কানু গড়ের ধারের বস্তির একটা ঘরে তিন মাস ধরে গেঁড়ে বসে আছে। সেই কাজটা এনেছিল। কাজটা কে দিয়েছিল গগন জানে না, কানু জানে। গগনের পেটে আর কিছু নেই। তাকে ছেড়ে রেখে এসে উমাপদ খেতে বসল। আজ উমাপদর বৌ খাবার দিয়েছে, চাওমিন আর চিলি চিকেন। সম্ভবত সস্তার কোনও ধাবা থেকে আনানো গত রাতের উদ্বৃত্ত। আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো রাস্তার মোড়ে-মোড়ে দোকানগুলো গজিয়ে উঠছে। সন্ধের দিকে মোগলাই পরোটা, হাক্কা নুডল, রাত বাড়লে হাতে গড়া রুটি। খাওয়া শেষ করে উমাপদ ঢেকুর তুলল। মুখের বিকৃতি দেখে মনে হল নির্ঘাত অম্বলের। দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলল, “বেরোচ্ছি একটু, খেয়াল রাখিস...”

    ফিরল সন্ধে পার করে। দেখে মনে হল বেশ খোশমেজাজে আছে। চন্দ্রনাথকে দাশরথির দোকান থেকে চা আনতে পাঠাল। গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে চা খেল। তারপর বড়বাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে গগনকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে জীপে তুলল। গগন নাকি কানুর গর্তটা চিনিয়ে দেবে। দময়ন্তীকে বলল, “তুইও চল। সে আবার কোন মাগীর আঁচলের তলায় লুকিয়ে বসে আছে কে জানে।”

    দময়ন্তী ফেরার তোড়জোড় করছিল। আটকে গেল। গগনকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে জীপের পেছনে প্যাকিং করে উমাপদ আর চন্দ্রনাথ মাঝখানে বসল। সামনে ড্রাইভারের পাশে দময়ন্তী। পেছনের দরজাটা ভেতর থেকে খোলা যায় না। গগন ঝপ করে নেমে দৌড়ে পালাতে পারবে না। অবশ্য দৌড়োন দূরের কথা, তার পায়ে হেঁটে যাবার মত শক্তি অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ। স্টেশনে পৌছোনোর আগে ডান দিকে মোড় নিয়ে দু তিন কিলোমিটার গেলেই গড়ের ধার। জীপটা কিন্তু স্টেশনে যাবার রাস্তা ধরল না। গঙ্গার ধার ঘেঁষে যে রাস্তাটা শ্মশানের দিকে এগিয়েছে সেই রাস্তাটা নিল। এদিকটায় জনবসতি কম। রাস্তাঘাট ফাঁকা। মফস্‌সলে তাড়াতাড়ি রাত নামে। গগন পিছন থেকে মৃদু আপত্তি জানাল, “ও মেজবাবু, এদিকে কোথায় নে যাচ্ছেন?”

    উমাপদ পাত্তা দিল না। জীপটা হঠাৎ বাঁ-দিকে মোড় নিল। কয়েক ফোঁটা জলের কণা উড়ে এসে দময়ন্তীর মুখে ঝাপটা দিল। পুজোর আর মাত্র ক’দিন। আকাশের মুখ ভার কমার এখনও কোনও লক্ষণ নেই। পান থেকে চুন খসতে পারে না, দূরদর্শনে নিম্নচাপের পূর্বাভাস সম্প্রচারিত হতে থাকে। সারাদিন গুমোট ছিল। জীপের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একটা সরু পিচ-রাস্তা ঝোপ-জঙ্গল পার হয়ে গঙ্গার দিকে নেমে গেছে। রাস্তার শেষে আট-দশটা সিঁড়ি। নেমে গেলে গঙ্গার কালো জল। সিঁড়ির মুখে জীপটা থেমে গেল, সামনে যাবার রাস্তা নেই। উমাপদ দময়ন্তীকে বলল, “যা, পেছনের দরজা খুলে গগনকে নামা।”

    দময়ন্তীর মাথায় ঢুকল না, এইখানে গগনকে নামিয়ে কী রাজ্যোদ্ধার হবে। তবু মেজবাবুর হুকুম, দময়ন্তী দরজা ঠেলে নামল। ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো টিম-টিম করে জ্বলছে। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বৃষ্টির দাপট বাড়ছে। দময়ন্তী টুপিটা মাথায় লাগিয়ে জীপের পেছনের দরজাটা খুলল। এর পরের আধ মিনিটের মধ্যে পরপর যে ঘটনাগুলো ঘটে গেল তার জন্য দময়ন্তী একেবারেরই প্রস্তুত ছিল না। লক খোলার শব্দ পেয়েই গগন ভিতর থেকে দরজায় ঠেলা দিয়ে লাফিয়ে নেমে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে দৌড় লাগাল। দরজার ধাক্কায় দময়ন্তী একপাশে ছিটকে গেল। সামলে নেবার আগেই একটা কানের পর্দা ফাটানো আওয়াজ। গগন খোয়া বার করা পিচের রাস্তার ওপর মুখ গুঁজড়ে পড়ল। দময়ন্তী ফিরে দেখল উমাপদ ভাবলেশহীন মুখে কোমরের খাপে রিভলভার ঢুকিয়ে রাখছে।

    পরের দিন থানায় পৌঁছোতে বেশ দেরি হয়ে গেল দময়ন্তীর। গতকাল রাতে গগনের বডি তুলে এনে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। শোওয়ার পরও ঘুম আসছিল না। শেষ রাতে চোখের পাতা লেগে এসেছিল। নিশিকান্তদাকে স্বপ্ন দেখল। সদাহাস্যময় মানুষ ছিলেন। একা হাতে দশজনের কাজ সামলাতেন। আশ্রমে গেলে ওদের নিজের হাতে পরিবেশন করে খাওয়াতেন। দময়ন্তী দেখল কাল যেখানে ওদের জীপটা থেমেছিল সেই ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নিশিকান্তদা নেমে যাচ্ছেন। ঘাটের পাশে দুটো নৌকো বাঁধা আছে। তারা অল্প অল্প দুলছে। পেছন থেকে গগন তাঁকে চেঁচিয়ে ডাকছে, “ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন গো কত্তা? ওদিকে বেপদ আছে, যাবেননি।”

    নিশিকান্তদা একবার ফিরে তাকালেন। তাঁর মুখে আলগা হাসি লেগে আছে। বললেন, “কীসের বিপদ? তুইও আয় না সঙ্গে।”

    গগন মাথা নেড়ে বলল, “মেজবাবু নৌকোর কাছে যেতে বারণ করেছে গো। বলেছে গেলেই প্যাঁদাবে।”

    নিশিকান্তদা বললেন, “তাহলে তুই দাঁড়া। আমি যাই।”

    নিশিকান্তদা জলের দিকে নেমে গেলেন। দময়ন্তীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। আচ্ছা স্বপ্নের কি কোনও মানে থাকে? কথায় বলে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। কিন্তু এই স্বপ্নটা সত্যি হবার কোনও উপায় নেই। থানায় নিজের টেবিলে বসে চোখ জুড়ে ঘুম আসছিল দময়ন্তীর। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছিল। কোনওমতে মাথা খাড়া রেখেছিল। উমাপদ সামনে এসে দাঁড়াল। একটা খবরে কাগজে জড়ানো প্যাকেট ওর সামনে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল। বলল, “নে, ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখ।”

    দময়ন্তী প্যাকেটটা খুলে হাঁ হয়ে গেল। দুখানা পাঁচশ’ টাকার নোটের বান্ডিল। সে সন্ত্রস্ত হয়ে ডাকল, “উমাপদদা...”

    উমাপদ ফিরে যাচ্ছিল। ডাক শুনে ফিরে তাকাল। বলল, “আর হ্যাঁ, সেদিন আশ্রমের ঘাটে নৌকোর মধ্যে যা দেখেছিলি ওগুলো বাচ্চাদের খেলনা বন্দুক। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি। আশ্রমের কিচেনে ফতিমা বিবি রান্না করে। তার খসম করিমুদ্দিন শেখ মেলায় বেচবে বলে নিয়ে যাচ্ছিল। ও নিয়ে তোর আর মাথা ঘামানোর দরকার নেই।”

    দময়ন্তী বুঝল মুখ বন্ধ রাখার মূল্য ধরে দিচ্ছে মেজবাবু, বলল, “উমাপদদা, এই টাকা আমি নিতে পারব না।”

    উমাপদ জুলজুল করে তার দিকে খানিক তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তোকে কে দিচ্ছে? তোর বাবার কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম। ফেরত দিলাম। বাড়ি গিয়ে বাবাকে দিয়ে দিস। বলিস উমাপদদা দিয়েছে। বাবা ঠিক বুঝতে পারবে।”

    দময়ন্তী টাকার বান্ডিলদুটো উমাপদর দিকে বাড়িয়ে দিল। কঠিন গলায় বলল, “তুমি নিজে গিয়ে বাবাকে দিয়ে এস।”

    তার বুকের ভিতরটা কাঁপছিল। কোথা থেকে কথাগুলো বলার জোর পেল কে জানে? গত কয়েক দিনের উৎপটাং ঘটনাগুলো তাকে অনেক বদলে দিয়েছে। উমাপদ থমকে গেল। তারপর টাকার বান্ডিলদুটো ফেরত নিয়ে বলল, “আচ্ছা, বেশ, তাই করব।”

    সত্যিই তাই করল উমাপদ। পরের দিন সকালবেলা মা ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে বলল, “ওঠ দমু, কত বেলা পর্যন্ত ঘুমোবি? উমাপদ এসেছে। তোর বাবার সঙ্গে কথা বলছে। তোকে ডাকছে।”

    তাড়াতাড়ি চোখেমুখে জল দিয়ে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল দময়ন্তী। বাবা আর উমাপদদা সামনা-সামনি দুটো চেয়ারে বসে কথা বলছে। মাঝখানে সেন্টার টেবিলের ওপর গত কালকের চেনা কাগজের বান্ডিলটা পড়ে রয়েছে। উমাপদ বলল, “তোর সঙ্গে দেখা করে যাব বলেই বসে ছিলুম,” তারপর বাবার দিকে ফিরে বলল, “দীননাথদা, এই বোকা মেয়েটাকে বোঝাবেন, পুলিশের চাকরির কিছু তৌর-তরিকা আছে। সে সব যত তাড়াতাড়ি শিখে নেয় ততই ভাল।”

    বাবা বিগলিত হয়ে বলল, “সে তো বটেই। সে তো বটেই।”


    (এর পরে)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: কল্লোল রায়
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)