১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ অবধি পশ্চিমবঙ্গ ছিল যাকে বলে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ। খাদ্য আন্দোলন, প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট, নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন এবং তদ্ভূত সি. পি. আই. এম. এল পার্টির আত্মপ্রকাশ, গণবিপ্লবের মোহময় আহ্বানে শত শত তরুণ-তরুণীর আত্মবলিদান, ভ্রাতৃঘাতী রাজনৈতিক খুনোখুনি, রাষ্ট্রের নির্মম পীড়ন এইসবের স্মৃতি আমাদের কাউকেই অপাপবিদ্ধ থাকতে দেয়নি। ১৯৭২ আসতে আসতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর পথভ্রান্তির আগুনে পশ্চিমবঙ্গে পুড়ে খাক হয়ে গেছে নকশালপন্থী আন্দোলন। ’৭২ এর বিধানসভা ভোটে বাংলা ভাষায় যুক্ত হয়েছে নতুন লবজ — রিগিং। পুলিশ আর গুন্ডাদের প্রত্যক্ষ মদতে ভোটে ‘জিতে’ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পা দিলাম তখনও ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে প্রতিধ্বনি রয়ে গেছে সেই সময়ের। তবে খুঁজে নিতে হত।
মন একেবারে জয় করে নিয়েছিল ক্যাম্পাস। কি সুন্দর সুন্দর সবুজের টুকরো, আর দিঘি, আর ঝলমলে চেহারার তরুণ-তরুণীর ঝাঁক। তখনও ছেলেরা মূলত জিনস আর টি-শার্ট বা জামা, এলোমেলো বড় চুল, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। মেয়েরা মূলত শাড়ি শোভিত, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। ইংরেজি, কম্প্যারেটিভ লিটারেচার আর ইকনমিক্স বিভাগের মেয়েরা ব্যাতিক্রম, তাদের মধ্যে জিনস, টপ, সালোয়ার কামিজ (কুর্তি কথাটা তখনও চালু হয়নি) পরিহিত মেয়েদের সংখ্যা বেশি। আমাদের ক্লাসের বনানী বাসু, সদ্য নাইজেরিয়া থেকে কলকাতায় এসে উঠেছে, তো যেদিন মিনি স্কার্ট পরে আসত এমনকি কারিগরি বিভাগেও অঘোষিত ছাত্র হরতাল হয়ে যেত। সেই সময়ে খেয়াল হয়নি, বিভিন্ন বিভাগগুলোর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অর্থনীতিভেদ ছিল। ইংরেজি, কম্প্যারেটিভ, ইকনমিকস এবং কিছুটা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছেলেমেয়েরা সাধারণত আসত তুলনামূলকভাবে সম্পন্ন পরিবার থেকে, অধিকাংশই ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে আসা। বাংলা, দর্শন, সংস্কৃত, ইতিহাস বিভাগে ভিড় সাদামাটা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের। কারিগরি বিভাগে বা বিজ্ঞান বিভাগেও তখন সরকারি বাংলা স্কুল থেকে পড়ে আসা ছাত্রছাত্রীদেরই আধিক্য। এখন শুনেছি বাংলা স্কুল থেকে আসা ছাত্র অনেক কমে গেছে এবং তা ক্রমহ্রাসমান।
বাহাত্তর সাল থেকেই নির্বাচনের বদলে গা-জোয়ারি দখলদারি চালু হয়ে গেছিল। ছাত্র-সংসদ নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই ছিল না। কলা, বিজ্ঞান এবং কারিগরি বিভাগের ছাত্র পরিষদের নেতাদের মধ্যে তখন সবথেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিল জিওলজি-র জয়প্রকাশ মজুমদার, যে এখন বিভিন্ন দল ঘুরে অবশেষে তৃণমূলে ঠাঁই পেয়েছে। আমাদের কলা বিভাগে কে যে ছাত্রসংসদের প্রতিনিধি কেউ খোঁজ-ই রাখত না। চার নম্বর গেট দিয়ে ঢুকেই ছিল প্রশস্ত লবি। আর পিজি আর ইউজি বিল্ডিং-এর মাঝখানে পুরোনো বিবেকানন্দ হল-এর পিছনের দেওয়াল ঘেঁষে মিলন দা-র বেড়ার ক্যান্টিন। এই দুটো ছিল কলা বিভাগের ধুকধুকি। পরে মিলন দা-র ক্যান্টিন স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসবে নতুন বিবেকানন্দ হল-এর উলটো দিকে। চার নম্বর গেট দিয়ে ঢুকলে ডান হাতে সেই বিখ্যাত ঝিল যা কলা আর বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে কারিগরি বিভাগের এক মনোরম সীমান্ত যা লাল-নীল মাছেরা পাহারা দিত না বটে তবুও যাদবপুরের কিংবদন্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা কদাচিৎ এইট বি বাস স্ট্যান্ড-এর উলটো দিকে দু নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে ডান পাশে বহু-কাহিনীবিজড়িত সত্যেন-দার ক্যান্টিনে গেলে সত্যেন-দা হাঁক দিয়ে বলতেন ঝিল পাড়ের ছেলেরা এসেছে, ওদের একটু যত্ন করিস। আর সেই ঝিলে থাকত ঝাঁঝি আর শাপলা। যাদবপুর বিদ্যাপীঠের পাঁচিল যেখানে ঢুকে শেষ হয়েছে সেই বরাবর ছিল এক অনুপম কাঠের সাঁকো। পারাপারের পক্ষে একটু নড়বড়ে কিন্তু প্রবাদ ছিল পরপর তিনদিন কোনো ছেলে আর মেয়ে যদি ওখানে বসে গল্প করে প্রেম অনিবার্য। লেডিজ হোস্টেলের পাশে যে বিরাট দিঘি তার শেষপ্রান্তে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাশে ছিল রহস্যময় কসমিক রে হাট নামের একটা ছোট্ট কাঠের কুঁড়ে — তার ছায়ায় বা তার সিঁড়িতে যে যুগলদের দেখা যেত তাদেরও অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়র দরকার পড়ত না। পিজি বিল্ডিং-এর নীচে ছিল আর্টস কমনরুম, সেখানে ক্যারম, দাবা আর টেবল টেনিস খেলার বন্দোবস্ত ছিল। আর্টস কলেজ চ্যাম্পিয়ন ছিল সুজাত ভদ্র। বিশ্ববিদ্যালয় দলে সেই একমাত্র আর্টস কলেজের, বাকি সবাই মোটামুটি কারিগরি বিভাগের। ’৭৫ সালের কোনো একটা সময়ে আমাদের জন্যে উন্মুক্ত হবে এমেনিটি সেন্টার বা এসি — সব বিভাগের ছেলেমেয়েদের প্রিয় ক্যান্টিন যেখানে প্রথমে চা পাওয়া যেত দশ পয়সায় আর একটা ডালপুরি যেটা কানাঘুষো শুনতাম খোদ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে তৈরি। এসি-র সূত্রপাত থেকেই যাদবপুরের লোককথার অংশ হয়ে যাবে নাথু দা। এ ছাড়া তিনটে শক্তি কেন্দ্র ছিল নিউ ব্লক হোস্টেল, পিজি হোস্টেল আর লেডিজ হোস্টেল। মেন হোস্টেল ছিল ক্যাম্পাসের বাইরে যাদবপুর থানার পিছনে। আর্টস বা সায়েন্স কলেজের ছেলেরা সাধারণত নিউ ব্লকে জায়গা পেত। লোকস্মৃতিতে মেন হোস্টেল তখনও পুলিশ বনাম নকশালপন্থী ছাত্রদের সেই বিখ্যাত এক রাতের লড়াইয়ের জায়গা। যদিও আমরা যখন ভর্তি হলাম সে হোস্টেল শাসন করছে ছাত্রপরিষদের ‘দাদা’রা। মেন হোস্টেলে পা পড়তে আমার বছর ঘুরে যাবে।
কলা বিভাগে ছাত্রীদের আধিক্য। ইংরেজি বিভাগে আমাদের ক্লাসে আমরা ছয়টি ছেলে আর বাকি চৌত্রিশ জন মেয়ে। আমার স্কুলের সহপাঠীরা অনেকেই লেখাপড়ায় তুখোড়। তারা কারিগরি কলেজের নানা বিভাগে ভর্তি হয়েছে। তারা বিজ্ঞানবিভ্রান্ত, ইংরেজি বিভাগে ছিটকে পড়া আমাকে রীতিমতো ঈর্ষা করে। এখনকার ছেলেমেয়েদের কিছুতেই বোঝানো যাবে না মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরদের কাছে অনাত্মীয় কিশোরীদের নৈকট্য কতটা দুর্লভ ছিল। আমাদের ক্লাসের সঞ্জয় ছিল সবথেকে ভালো দেখতে — রেশমি, মসৃণ, কাঁধ অবধি লম্বা চুল, জন লেনন চশমার পিছনে আয়ত, স্বপ্নালু চোখ তার মাটি-পৃথিবীর দিকে বিশেষ নামত না। মনেপ্রাণে সে হিপি দর্শনে বিশ্বাস করত। লেখাপড়া শেষে সে মানালিতে আপেল বাগান করে থাকছে এরকমই শুনেছিলাম। পরিতাপের বিষয় সে আমলে যোগাযোগ রাখতে যে পরিশ্রম করতে হত সেটা করিনি। শান্ত একটা আত্মবিশ্বাস ছিল সঞ্জয়ের। সেই কিশোর বয়েসেই সে জানত সে কী করতে চায়। হলিমুজ জামান ছিল আরেক বর্ণময় চরিত্র। সেন্ট্রাল এভিনিউ-এ বাড়ি, বিত্তবান ব্যবসায়ী পরিবারে অনেক ভাইবোনের মধ্যে নিচের দিকের ছেলে জামান ছাত্র অবস্থা থেকেই নিজেও ব্যাবসা করত। শখ ছিল তার জকি হবে। চেহারা বড় হয়ে যাওয়ায় সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু ঘোড়ার দৌড়ের সমঝদার খেলোয়াড় ছিল জামান।এমনিতেই সে দিলদরিয়া, প্রতিদিনই প্রায় আমাদের আপ্যায়ন করত জামান। তার মধ্যে একদিন বড়া খানা। আগের দিন বিরাট বাজি মেরেছে সে। মিডনাইট কাউবয় ভারত বিখ্যাত স্টার হয়ে ওঠার আগেই জামান-এর জহুরি চোখ তাকে চিনে নিয়েছিল।
আমাদের ক্লাসে সব থেকে স্থিতধী ছেলে ছিল এইনসলি এডগার, দীর্ঘকায়, অতি সুভদ্র, স্মিতবাক। তাদের ডেন্ট মিশন রোডের বাড়িতেই আমি প্রথম শুনি নিল ডায়মন্ড, ক্লিফ রিচার্ড, এঙ্গেলবার্ট হাম্পারডিঙ্ক, জিম রিভস, ন্যাট কিং কোল। এইনসলি কলকাতার নানা নামী খৃস্টান স্কুলে পড়াবার পর পঞ্চগোনি-তে প্রধান শিক্ষক হয়ে চলে গেছিল। তারপর ইয়েমেন-এ শিক্ষকতার কাজ নিয়ে চলে যায়।
উৎপল — উৎপল মিত্র - আমার প্রায় পাশের পাড়ার। আমারই মতো বাংলা স্কুলে পড়ে আসা। ভালো ছবি আঁকত সে। আমাদের দেয়াল পত্রিকা এবং পরে আমাদের পোস্টার আঁকার গুরুভার ছিল তার ওপরে। পরে ব্যাঙ্ক কর্মীদের আন্দোলনেও অতি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে উৎপল। ঘন ঘন প্রেমে পড়ত উৎপল। এখনকার রাশভারি উৎপল আপত্তি করবে কিনা জানি না। তবে ওর পিছনে আমি সারা জীবনই লেগে এসেছি। বেশি আপত্তি করলে সব ফাঁস করে দেব।
নির্মল মজুমদার হেয়ার স্কুল থেকে পাশ করে আসা ছেলে। শেল-এর চশমা, ব্যাকব্রাশ করা নিপাট চুল, ফর্সা রং, পাতলা গোলাপি ঠোঁট, সুন্দর করে কবজি অবধি বোতাম-আঁটা শার্ট গোঁজা প্যান্ট — উত্তর কলকাতা বসানো চেহারা। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্দরমহলে ঢুকেছিলাম নির্মলের প্রেরণায়। বলাই বাহুল্য আবৃত্তি করত নির্মল। কোনো অশিষ্ট শব্দ শোনা যেত না তার মুখে। কিন্তু আদতে সে ছিল রসিক ফিচেল। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার আগেই সে ছড়া লিখেছিল —
গায়ের জামায় আঁকা তাদের কৃষ্ণপ্রেমের ফ্রেস্কো
হাতের ফাঁকে দিচ্ছে উঁকি ইউজেন আয়নেস্কো।
আমাদের আর্ট এন্ড লিটারারি সোসাইটি-র পত্রিকাতে নিরুপমদা আয়নেস্কো-র গন্ডার অনুবাদ করবে আরও দু’বছর পর। কিন্তু সে গল্পে আসার আগে কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। শুনেছি পরম্পরাযুক্তভাবে বলাই নাকি মুনশিয়ানা। হে পাঠক আপনার সে প্রত্যাশার গুড়ে কিন্তু বালি।