“পাখির কোনো পাসপোর্ট লাগে না।
শুকনো পাতা সেও অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারে —
শুধু মানুষকেই সীমান্ত মেনে চলতে হয়।
কাঁটাতারের দুপাশে থমকে দাঁড়ায়,
স্মৃতি, হাতছানি আর চোখের জল।”
(বর্ডার – কবি-অরণি বসু)
একটি স্মৃতিকথার শরীর বেড়ে ওঠে শৈশবের নরম রোদ, কৈশোরের রোমাঞ্চ অথবা যৌবনের উদ্দীপ্ত আকাঙ্ক্ষায়। চাওয়া না চাওয়া, পাওয়া না পাওয়ার হিসেবনিকেশও ধরা থাকে সেখানেই। ‘অশ্রুধারাবতী’ শুধুমাত্র একটি স্মতিকথা নয়, তার শরীর জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প, দেশভাগের অশ্রু সজল ইতিহাস।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যাওয়া দুটি দেশের এক পারে জন্মভূমি অন্যপারে যাপনভূমি। ধর্মীয় মৌলবাদকে সমর্থন অথবা রাষ্ট্রীয় নির্বাসন। পায়ের নিচে এক টুকরো শক্ত মাটির খোঁজে যাযাবর জীবন যাপন। আজীবন নিঃশব্দে এই বেদনার ধারাপাত ব্যক্ত করে গেছেন যাঁরা, লেখিকা অঞ্জলি দাশ তাঁদেরই একজন।
“এইখানে একটু দাঁড়াইবয়স্ক স্মৃতির ধূসর মলাট সরিয়ে এক অনাবিল শৈশব অথবা কৈশোর হাত ধরাধরি করে খেলে এক্কাদোক্কা। বইয়ের পাতায় শুকনো ফুল, ভরা নদীতে ডুব সাঁতার — এসব কিছুর সাক্ষী হয়ে বয়ে চলে ভৈরব।খুলনা জেলার মহকুমা শহর বাগেরহাট। তারই পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভৈরব নদী। লেখিকার আশৈশবের সই এই নদীটিই যেন ছায়া ফেলে গেছে সমগ্র স্মৃতিচারণায়।
গোল্লাছুটের গর্তে পা পড়েছে, পিছনে ডাকছে কেউ,
একটু ব্যথা, একটি দুটি অশ্রুবিন্দু ছাপিয়ে
উপচে উঠছে আনন্দ ভৈরব… …” (পৃ--২৪)
১৯৫৭ সালে স্বাধীনোত্তর পূর্ব পাকিস্তানে লেখিকার জন্ম। বাবা কর্মসূত্রে থাকতেন বাগেরহাট। আদি নিবাস সুলতানপুর, যেখানে থাকতেন তাঁর ঠাকুমা। শহর এবং গ্রাম জীবনের নিবিড় সম্পৃক্ততায় সমৃদ্ধ লেখিকার ছোটবেলা। কাঠবাদাম আর কেলিকদমের ডালে হয়তো আজও ধরা আছে সেই স্নেহ-সবুজ ছায়াছবির কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া মুহূর্ত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ধর্মীয় সৌহার্দ্যতায় ছিল না কোনো আড়ষ্টতা। ভোরের আজান,সন্ধের পাঁচালীর সুর কখনও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে দিগন্ত রেখায়। আবার কখনও দুর্গাপুজোর ভাসান,ঈদের কোলাকুলি একসাথে অবগাহন করেছে সম্প্রীতির শীতল জলে। পালাপার্বন বার-ব্রত, পরব এই সমস্ত উপাদান একটি পাত্রে দ্রবীভূত হয়েই যেন সৃষ্টি করেছে এক বিরাট লোকসাংস্কৃতিক ইতিহাস, যার খন্ড চিত্র কোলাজ হয়ে ধরা দিয়েছে এই স্মৃতিকথায়।
ছোটবেলা থেকে লেখিকার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে বাবা, মা, দাদা, ঠাকুমার সান্নিধ্যে। ভালোবাসা এবং প্রশ্রয়ের সহাবস্থানে তাঁর ছেলেবেলার দৌরাত্ম বিস্তৃত ছিল ঠাকুমার বাপের বাড়ি পর্যন্ত। নিবিড় স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে সে কথাও। “দাদুদের একটা পুকুর ছিল, যেটা একটা ছোট নালা দিয়ে জুড়ে দেওয়া ছিল দপার আড়ার সঙ্গে। জোয়ার-ভাটায় জল আসত যেত। এই পুকুরের মধ্যে গোটা দুয়েক ডিঙিনৌকো ডোবানো থাকত। ভাটার সময় পুকুরটার জল নেমে গেলেও ঐ নৌকোর মধ্যে জল জমে থাকত এবং জলের সঙ্গে কিছু মাছও আটকা পড়ত। দুজন দুদিকে গামছা ধরে সেই মাছ ধরাটা ছিল আমাদের বড় আনন্দের। খলসে মাছ, রয়ান মাছ, দু-একটা ডগরা মাছও থাকত। দাদুদের বাঁধা কাজের লোকের একজন ছিল মল্লিকচাঁদ। আমাদের ভয়ে মল্লিকচাঁদ নৌকোর বৈঠা লুকিয়ে রাখত।” (পৃ-৭১)
বাহান্নয় ভাষা আন্দোলন এবং পঁয়ষট্টিতে পাক ভারত যুদ্ধের আবহে দ্রুত বদলাতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক আবহাওয়া। চেনা পরিবেশ ক্রমশ অচেনা হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ এ দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে যে বিভাজনের বীজ বপন করা হয়েছিল তাই মহীরুহ হয়ে ওঠে পঁয়ষট্টিতে। হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলিতে অসম্পন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের কার্যত দলিত বা অস্পৃশ্য করে রাখার প্রবণতা ভেতরে ভেতরে উগ্র ধর্মীয় ভাবাবেগকেই উসকে দিয়েছিল। শিশুবয়সে দেখা সেই সমস্ত ঘটনার অভিঘাত বর্তমান সময়েও লেখিকাকে ব্যথিত করে। “শীতকালে মাঝে মধ্যে রাঙাঠাকুমা বারান্দার উনুনে রান্না করতেন। একদিন তেমন রান্নার তোড়জোড় করছেন, রাবির মা এসে বারান্দায় বসল। মাছ কেটে ধুয়ে এনে দিল, তরকারি কেটে দিল। হঠাৎ শুনলাম রাঙাঠাকুমা বললেন, রাবির মা এবার তুই বারান্দা থেকে নাম, আমার ভাত ফুটে উঠেছে। সেও হাসিমুখে নেমে উঠোনে দাঁড়াল। এটাই যেন প্রথা। আসলে দুইপ্রান্তরের মাঝখানে এই যে কাঁটাতার,এটাই বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে, রক্ত ঝরিয়েছে দুদিকেই। এখন ভাবি দীর্ঘদিনের এই অবহেলা, অসম্মান, মানবিকতার এই অবমাননা, সময় কতদিন বহন করে? মানুষকে এর মূল্য তো দিতেই হয়।” (পৃ-৭৩)
ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মূলত মুসলিম সম্প্রদায় আড়াআড়ি দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভারতবিদ্বেষী কট্টরপন্থী মুসলিমদের হিন্দুদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ একেবারেই প্রকাশ্যে চলে আসে ছয়ের দশকের শেষ দিক থেকেই। নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন লেখিকা ও তাঁর পরিবার। “পরিচিতদের মধ্যেও দুটো বিভাজন হয়ে গেছে। একদিকে পাকিস্তানপন্থী মুসলমান, যারা ভারত বিদ্বেষী, হিন্দু বিদ্বেষী। আর অন্যদিকে বাংলাদেশপন্থী স্বাধীনতাকামী মুসলমান যাঁরা নিজেরা বিপন্ন, তবু তাঁরাই তখন হিন্দুদের পরম আত্মীয় ও নির্ভরতা।” (পৃ-১২৪) আটাত্তরে পাকাপাকিভাবে পরিবারের সঙ্গে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন লেখিকা। বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত অঞ্জলি নিজেকে চিরকাল ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঘৃণা এবং সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে মুক্তি পায়নি এই উপমহাদেশ।
‘অশ্রুধারাবতী’ স্মৃতিকথাটি মূলত জন্মভূমির প্রতি লেখিকার ভালোবাসা এবং আবেগের শাব্দিক নামান্তর। বেড়ে ওঠার প্রতিটি মুহূর্তের আনন্দ, বিষাদ ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা। সময় এখানে অবাধ্য শিশুর মতো কখনও শান্ত, কখনও অশান্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। তারই ভিত্তিতে বইটিকে তিনি মোট ছটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন– মায়াবী কুয়াশা, অস্বস্তির বিস্তার, উপদ্রুত বর্ণমালা, কলেজ বেলা, ইত্যাদি। আবার প্রত্যেকটি বিভাগের মধ্যে রয়েছে ছোট ছোট শিরোনামাঙ্কিত উপবিভাগ।
অঞ্জলি দাশ একাধারে কবি এবং সাহিত্যিক। সমগ্র স্মৃতিকথাটিতে সংযোজিত টুকরো টুকরো কবিতার অংশ ও বাক্যগঠনের দক্ষতা বারবার সেকথাই স্পষ্ট করে। কিছু কিছু স্বল্প ব্যবহৃত শব্দের প্রয়োগ লেখাটিকে অলঙ্কৃত করেছে।
১৯৪৭এ দেশভাগ, দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে বহু স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে। সেগুলি পাঠকমহলে বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। এর পরেও ওপার থেকে মানুষ এসেছেন, লিখেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা, তবে তা সংখ্যায় কম। বিশিষ্ট লেখক মিহির সেনগুপ্তের লেখায় স্বাধীনোত্তর সময়ের কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অঞ্জলি দাশের ‘অশ্রুধারাবতী’ও দেশভাগের পর তৈরি হওয়া পূর্ব পাকিস্তান ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জীবনের ব্যথা ও যন্ত্রণার অনন্য নিদর্শন। প্রণবেশ মাইতির স্নিগ্ধ প্রচ্ছদ ও নজরকাড়া অলঙ্করণ বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। কালো কাগজ কেটে সাঁটা ছবিগুলি স্মৃতিদৃশ্যগুলিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
স্মৃতিচারণার শুরুতেই লেখিকা যে কবিতার অংশটুকু মেলে দিয়েছেন, পাঠশেষেও রয়ে যায় তার রেশ।
“সীমান্তের একহাত দূরত্বে যে নদী শান্ত শুয়ে থাকে,দৃষ্টির অগোচরে প্রতিনিয়ত ভাঙা গড়া আর বিভাজন রেখা মুছে দিয়ে আনন্দ, বিষাদ, বেদনার নুড়ি-কাঁকর বুকে নিয়ে দেশ-কাল-গন্ডির সীমান্ত পেরিয়ে বয়ে চলেছে কোনো অশ্রুধারাবতী।
তার নাম অশ্রুধারাবতী… ..
কাঁটাতারে ছেড়ে আসা অভিমান, শান্ত হও
চলো আজ স্মৃতি খুলে
আমাদের বাদামপাতার ছায়া, নয়ানজুলির ছিপ
আর কঞ্চির কলমে লেখা
তালপাতার আদিবর্ণ দেব… ..।”