সিঁড়িতে পায়ের শব্দগুলো পিছনে ফেলে রেখে দোতলায় ওঠার পর টের পেলাম আমার ডান পায়ের তলাটা চেঁচাচ্ছে। আসলে দিন দুয়েক আগে কাঠের তক্তা থেকে বেরিয়ে থাকা একটা পেরেক আমার পায়ের তলায় সামান্য “আদর” করার পর থেকেই পায়ের তলার একটা টনটনে ব্যথা আমার সঙ্গেই হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে। একটা মেডিসিনের দোকান থেকে ইঞ্জেকশন নেবার পর সংক্রমণের ভয় কমেছে কিন্তু ব্যথা তেমন কমেনি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় অত যন্ত্রণাতেও একটা কথা ভেবে আমার হাসি পেল। মনে হল, একেই হয়ত বলে “সিঁড়িয়াস” ম্যাটার।
ব্যথা সামলে সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজের ঘরে ঢোকার আগে চোখে পড়ল একটা খাম কেউ গুঁজে দিয়ে গেছে আমার দরজার নীচে। খামটা দেখে আমি সাবধান হয়ে গেলাম। চারপাশে ভালো করে দেখে নিলাম কেউ আমাকে দেখছে কিনা। পূর্ব বর্ধমান জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমি এই ভাড়াবাড়িতে এসেছি মাত্র গত সপ্তাহেই। আমার এই নতুন ঠিকানার সন্ধান জানে মাত্র গুটি কয়েক লোক। কার চিঠি এল ভাবতে ভাবতেই দেখি, খা্মের উপর কোনও নাম বা ঠিকানা লেখা নেই। বুঝলাম তার মানে কেউ হাতচিঠি দিয়ে গেছে। সাবধানে সেই খাম নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সেই ঠিকানাবিহীন খামটা ছিঁড়ে দেখি ভিতরে উঁকি মারছে ছোট্ট এক টুকরো কাগজ – যাতে লেখা আছে, দেখা হল না। বিকেলে ফের চেষ্টা করব দেখা করার। আমি নিশ্চিত, আমার গুটিকয়েক পরিচিত জন – যারা জানে আমার এই আস্তানার কথা – তারা কেউ এমন হাত চিঠি ছেড়ে যাবে না আমার দোরগোড়ায়। তবে এই চিঠিতে আমি তেমন কোনও বিপদের গন্ধ পেলাম না। কারণ মনে হল আমি যে যাপনের ঘেরাটোপে বন্দি এখন তার বিপরীতে গিয়ে বিপদ নিশ্চয়ই চিঠি দিয়ে আসবে না। শেষে একটা সিদ্ধান্তে এলাম যে, ভুল করে কেউ অন্য কারও চিঠি আমার দরজায় গুঁজে দিয়ে গেছে। তাই চিঠিটাকে ছিঁড়ে না ফেলে বিছানার চাদরের নিচে চালান করে দিলাম।
বিকেলে কিন্তু সত্যিই একজন এল। আমি তখন চায়ের কাপের সঙ্গে ঠোঁট মেলাচ্ছি - শুনলাম দরজায় কড়া নাড়া। নিজেকে একটু “গুছিয়ে” নিয়ে ভিতর থেকেই প্রশ্ন করলাম, কে? উত্তর এল মেয়েলি গলায়, আমি, আমি শর্মিষ্ঠা। আসানসোলের শর্মিষ্ঠা। উত্তর শুনে অবাক আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম। শর্মিষ্ঠা ভেতরে এল। হ্যাঁ, শর্মিষ্ঠাকে আমি চিনি। আমার ফেলে আসা পাড়ায়, আমার বেড়ে ওঠা পাড়ায় একসময় আমরা একসঙ্গেই বড় হয়েছি। আমার এই ছোট ঘরে বসার জায়গা বলতে আমার বিছানা ছাড়া আর আছে ঘরের কোণে দাঁড় করানো বাড়িওয়ালার দেওয়া একটা ফোল্ডিং চেয়ার। শর্মিষ্ঠাকে ওই চেয়ারেই বসতে বললাম। চেয়ারে বসতে বসতেই শর্মিষ্ঠা বলল, কী বসন্তদা, চমকে দিলাম তো?
শর্মিষ্ঠার এই আগমন সত্যি-সত্যিই আমাকে চমকে দিয়েছে এটা বলার মতো কোনও ব্যাপার না। বরং ও আমার অজ্ঞাতবাসের এই নতুনতম ঠিকানায় কী করে এল, কেন এল সেটা জানাই তখন আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল। শর্মিষ্ঠাকে বহুদিন চিনি, তাই তেমন টেনশন হচ্ছিল না। তবু সাবধানের মার নেই এই আপ্তবাক্য মাথায় রেখে যথাসাধ্য মোলায়েম স্বরে শর্মিষ্ঠাকে শুধোলাম, আমার এই ঠিকানা কোথায় পেলি তুই? তোর সঙ্গে – যতদূর মনে পড়ছে শেষ দেখা হয়েছিল বছর ছয়েক আগে। উত্তরে শর্মিষ্ঠা আমার মূল প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে হেসে বলল, ছ’ বছর? বল কী? সে যাক, একাই চা খাবে, নাকি এপাশেও একটু…।
শর্মিষ্ঠাকে এক কাপ চা দিলাম। লক্ষ করলাম শর্মিষ্ঠা কথাবার্তায় এই ছ’ বছরে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছে, আর ওর চেহারায় এসেছে সামান্য রুক্ষ ভাব। আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফের ফিরে এলাম মূল প্রশ্নে, সঙ্গে বাড়তি আরও কিছু প্রশ্ন নিয়ে। বললাম, হ্যাঁ, খুব চমকে দিয়েছিস তুই। কিন্তু আমার এই ঠিকানা কোথায় পেলি তুই? কী করছিস এখন? আমার প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়ে শর্মিষ্ঠা প্রথমে হাত নেড়ে আমাকে থামতে বলল, তারপর বলল,
--আরে বাপরে, এত প্রশ্ন একসঙ্গে! ব্যাপার তেমন কিছু নয়। কাল তোমাকে দেখলাম – হাতে - মনে হল ছোট একটা বাজারের থলে - এই বাড়িতে ঢুকছ। এক গাল দাড়ি রেখেছ, মাথার চুলগুলোতে পাক ধরেছে প্রবল - ফলে প্রথমে চিনতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। তবে একটু সময় নিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝলাম যে, আরে এ তো আমাদের গ্রেট বসন্তদা!
--তুই এ পাড়াতেই থাকিস নাকি?
--হ্যাঁ তো। তা প্রায় এক বছর হয়ে গেল আমি এখানেই আছি।
--কী করছিস এখন?
--এই স্থানীয় একটা সরকারি স্কুলে পড়াই। চেষ্টা করছি বাড়ির কাছাকাছি যদি বদলি হতে পারি। শর্মিষ্ঠা প্রাঞ্জল হয়।
-- বিয়ে করেছিস? আমি হঠাৎ করেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিই।
আমার প্রশ্ন শুনে শর্মিষ্ঠা মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই মুখ তুলে বলল, না গো, বিয়েটা আর করা হয়ে ওঠেনি। তুমি বিয়ে করেছ বসন্তদা?
--না, আমারও ও কম্মটি করে ওঠা হয়নি। তা ছাড়া এই বাউন্ডুলেকে কে বিয়ে করবে বল তো? আমি হাসিমুখে বলি।
আমার উত্তর শুনতে শুনতেই শর্মিষ্ঠা হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, আমি এখন আসি বসন্তদা, অনেক কাজ পড়ে আছে। আর হ্যাঁ, আমি ফের আসব পরশু সকালে। তুমি থাকবে তো? বললাম, হ্যাঁ, থাকব। আমার উত্তর শুনে শর্মিষ্ঠা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, বসন্তদা, সেদিন কিন্তু আমার সঙ্গে আমার দু’চারজন কলিগ থাকবে। তোমার আপত্তি নেই তো? বললাম, না আপত্তি নেই। তবে ঘরের অবস্থা তো দেখছিস। এই ছোট ঘর। কাকে যে কোথায় বসতে দেব।
--তোমাকে সে সব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা বেশি ক্ষণ থাকব না। সে যাক, আজ আসি গো--বলে শর্মিষ্ঠা চলে গেল।
শর্মিষ্ঠা ফিরে গেল ওর গন্তব্যে আর আমি মনে মনে ফিরলাম আসানসোলে।
আসানসোলের রাহা লেন – যাকে এলাকার লোকজন আদর করে ডাকে “ওষুধ পাড়া” – ওখানেই আরও অনেকের সঙ্গে বেড়ে ওঠা আমার আর শর্মিষ্ঠার। শর্মিষ্ঠা আমার থেকে বয়েসে বেশ খানিকটা ছোট। আমার খুড়তুতো বোন ছিল ওর বন্ধু। ফলে আমাদের বাড়িতে শর্মিষ্ঠার যাতায়াত ছিলই। আমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা একটা সময় পর্যন্ত ছিল ওই “হাই”, “হ্যালো” মার্কা। সেই “হাই”, “হ্যালো” সামান্য বিস্তার পেয়েছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা ঘটনায়।
সে এক রাতে আসানসোলের রেল মাঠ থেকে ফিরছিলাম জুনিয়র পি সি সরকারের ম্যাজিক শো দেখে। পথে ঘাঁটি গলিতে দেখি একটা হোটেলের দেয়ালের আড়ালে শর্মিষ্ঠা একটা ছেলের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। শর্মিষ্ঠা তখন – যতদূর মনে পড়ছে তখন কলেজে ফাইনাল ইয়ার। আমি সম্ভবত ঠিক দেখছি কিনা দেখতে গিয়েই একটু বেশি স্পষ্ট করে ফেলেছিলাম আমার অনুসন্ধানী অবয়বকে। ফলে আমি শর্মিষ্ঠার একদম কাছাকাছি চলে আসি। ফলাফল, একদম শর্মিষ্ঠার সঙ্গে চোখাচোখি। এরপর – যেমনটা হয় - আমি সামান্য অস্বস্তি নিয়ে চোখ নামিয়ে হেঁটে পেরিয়ে গেলাম শর্মিষ্ঠা এবং তার পুরুষ বন্ধুকে - একবারও পিছন না ফিরে।
বলে রাখা ভালো যে, শর্মিষ্ঠাকে ওই রাতে ছেলেটির সঙ্গে দেখে আমার অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। ফলে এই নিয়ে কারোর সঙ্গে আলোচনা করারও প্রয়োজন মনে করিনি। সত্যি বলতে কী, ভুলেও গেছিলাম সে ঘটনা।
কিছু দিন পর একদিন রাস্তায় শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেখা। আমি হেসে চলে যাচ্ছিলাম। দাঁড় করালো শর্মিষ্ঠা। বলল, বসন্তদা, সেদিন রাত্রে…। আমি ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম, ও সব আমার মনে নেই, মনে রাখতেও চাই না। তুই কী করবি আর না করবি সেটা তোর ব্যাপার। নিশ্চিন্তে থাক, আমার ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমার উত্তর শুনে মনে হল শর্মিষ্ঠা খুশি হয়েই অন্য পথ ধরল।
কিন্তু মাথাব্যথা হল। আমি তখন ব্যবসায়ী। আমি তখন কলকাতার বাগড়ি মার্কেট আর মেহেতা বিল্ডিং থেকে স্যালাইন ইনফিউশন সেট, ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেট, রাইলস টিউব, ক্যাথিটার – এসব কিনে এনে আমাদের এলাকায় আর এলাকার বাইরেও হোলসেল ওষুধের দোকান আর নার্সিং হোমগুলোতে সাপ্লাই করি। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন খুব ভোরে অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস (আমরা বলি, বিধান এক্সপ্রেস) ধরে কলকাতা আর বিকেলে কোলফিল্ড ধরে বাড়ি ফেরা।
একদিন আমাদের এলাকার বাইরে এক নার্সিং হোমে ব্লাড ডোনার সেট সাপ্লাই করতে গিয়ে দেখি শর্মিষ্ঠা, কপালে হালকা সিঁদুর, সঙ্গে সেই আগের এক দিন দেখা ছেলেটা - বসে আছে নার্সিং হোমের বেঞ্চে। আমার মনে একটা কু-ডাক দিল। কেন জানি না মনে হল, কিছু একটা গন্ডগোল রয়েছে শর্মিষ্ঠার ওই নকল সাজ আর এই নার্সিং হোমে বসে থাকার পিছনে। ইচ্ছে ছিল নিজেকে আড়াল রেখে কেটে পড়ব। হল না। ওরা দু’জন, একটু যেন ভয়ার্ত মুখ, খুব ফিসফিস করে কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে। আমি ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়েই ডাক পড়ল শর্মিষ্ঠার। এবং শর্মিষ্ঠা বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আমাকে দেখে ফেলল। আমার মনে “পাপ”। ফলে বুঝতে পারছিলাম না শর্মিষ্ঠার সঙ্গে কথা বলাটা উচিত হবে কিনা। শর্মিষ্ঠা আমাকে দেখে একটু হাসল। খুব মলিন সে হাসি। ডাক্তারের ডাক না পড়লে হয়ত আমার সঙ্গে কথাও হত তার।
এ ঘটনার দিন দুয়েক পর ফের রাস্তায় মুখোমুখি শর্মিষ্ঠা আর আমি। শর্মিষ্ঠা একটু আড়ষ্টভাবে আমাকে বলল, বসন্তদা, তোমাকেই খুঁজছিলাম। আমার একটা উপকার করে দিতে হবে। শর্মিষ্ঠার কথা এবং কথা বলার ভঙ্গীতে আমি কেমন যেন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, বল, কী উপকার করতে হবে? শর্মিষ্ঠা দেখলাম একটু যেন জড়সড় হয়ে গেল কিছু বলার আগে। তারপর মাথা নামিয়ে আসতে আসতে বলল, বসন্তদা, সেদিন তুমি নার্সিং হোমে আমাদের দেখে যা ভেবেছ – সেটা একদম ঠিক ভেবেছ। খুব বিপদে পড়েছি জানো। নার্সিং হোম রাজি হচ্ছে না…খোঁজ নিয়ে জানলাম ওই নার্সিং হোমের যে ডাক্তারের কাছে আমরা গেছিলাম সে তোমার খুব ভালো বন্ধু…তুমি যদি একটু…। শর্মিষ্ঠা আর কিছু বলতে পারল না। শর্মিষ্ঠার “অনুরোধ” শুনে আমি সামান্য ঘেঁটে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না এই পরিস্থিতিতে আমার ঠিক কী করা উচিত। তবু শর্মিষ্ঠাকে বললাম, আচ্ছা, ঠিক আছে দেখছি কী করা যায়। উত্তরে শর্মিষ্ঠা বলল, বসন্তদা, প্লিজ, দেখো তুমি একটু। না হলে হয়ত আমাকে…। শর্মিষ্ঠা কথা শেষ না করেই চলে যায়।
আমাকেও কেমন যেন আবেগ ঘিরে ধরেছিল সেদিন। “অতটুকু” একটা মেয়ের জন্য খারাপ লাগছিল খুব। তাই নৈতিক না অনৈতিক এসব না ভেবেই পরের দিন শুধু বন্ধুত্বের জোরে অনেক বুঝিয়ে ডাক্তারকে রাজি করেছিলাম শর্মিষ্ঠাকে মুক্তি দেবার কাজে।
না, কাউকে বলিনি সেসব কথাও। তবে অন্য ভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে শর্মিষ্ঠার “প্রেমিক” ছেলেটি ঠিক সুবিধার নয়। অবশ্য প্রেম আর কবেই বা নিয়ম-কানুন মেনে ডানা মেলে। মিথ্যে বলব না, মাঝে মাঝে শর্মিষ্ঠার কথা মনে পড়ত এবং প্রার্থনা করতাম ও যেন ভালো থাকে।
এক বিকেলে আমি তখন দু’হাতে “মাল-পত্র” নিয়ে রাহা লেনেরই এক দোকানের পথে। পথ আগলে দাঁড়াল শর্মিষ্ঠা। বলল, বসন্তদা, দু’ মিনিট সময় হবে? তোমার সঙ্গে কথা আছে। ব্যাগদুটো রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে বললাম, বল, কী বলবি। শর্মিষ্ঠাও রাস্তার ধারে চলে এল। তারপরে আমাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বলল, আপাতত ফাঁড়া কেটেছে। আমি জানি, তুমি কাউকে কিছু বলোনি। সে জন্যেই তোমাকে ধন্যবাদ দেবার জন্য, প্রণাম করার জন্য দাঁড় করালাম এই মাঝরাস্তায়। আমি “ও ঠিক আছে। ভালো থাকিস, সাবধানে থাকিস” বলে পা বাড়ানো মাত্র শর্মিষ্ঠা ফের বলল, তোমাকে আরও একটা খবর জানিয়ে দি’। বললাম, কী? শর্মিষ্ঠা তার গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে বলল, যে পেটে ছিল, সে তো গেছেই, যে তাকে পেটে এনেছিল সেও আপাতত নিরুদ্দেশ। আমার কেন জানি না মনে হল, এ সব জটিল ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো। তাই শর্মিষ্ঠাকে বললাম, চলি রে, অনেকগুলো মাল ডেলিভারি করতে হবে। শর্মিষ্ঠা আর আমি দু’জন দু’দিকে হাঁটা লাগালাম।
আমি কাউকে কিছু না বললেও খেয়াল করেছিলাম পাড়ার লোকজন শর্মিষ্ঠার সম্বন্ধে খারাপ কথাই বেশি বলত। এমনকি আমার খুড়তুতো বোনও শর্মিষ্ঠা নামক চিঠিটিকে তার বন্ধুত্বের খাম থেকে বের করে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। ফলে শর্মিষ্ঠা আর আসত না আমাদের বাড়িতে, ফলে একই পাড়াতে থেকেও শর্মিষ্ঠার সঙ্গে আমার আর দেখা হত না।
এরপর সম্পূর্ণ অন্য এক প্রেক্ষিতে আমি এক “চরমপন্থী” রাজনৈতিক দলের হয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। “এই” রাজনীতিতে যেমনটা “নিয়ম” –প্রথমে বাড়িছাড়া, তারপর এলাকাছাড়া…এভাবেই চলছে গত পাঁচ বছর। এই রাজনীতিই আমাকে জেলে ঢোকাবে বলে গত বছর চারেক ধরে দৌড় করাচ্ছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। গালভর্তি দাড়ি নিয়ে কিছুদিন পর পরই ডেরা বদলাতে হয় আমাকে। তবে তেমন বড় “নেতা” নই বলেই বোধহয় এখনও প্রশাসন সে ভাবে গা লাগায়নি আর আমিও ধরা পড়িনি। এই কয়েক বছর দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে, আমি আপাতত বাড়ি থেকে খুব দূরে নয় – এই পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রত্যন্তে গোপন ডেরায় আছি।
গত ছ’ বছরে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেখা হয়নি একবারও। তবে এই ছ’বছরে শর্মিষ্ঠা একবার এসেছিল আমার, বলা ভালো আমাদের দলের গোপন মিটিংয়ের আলোচনায়। আমার সঙ্গে একই রাজনীতি করা এক মেয়ে শর্মিষ্ঠার নাম করে একদিন বলেছিল, আপনার পাড়ার ওই মেয়েটার থেকে সাবধানে থাকবেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন? সে আবার কী দোষ করল। উত্তর এসেছিল, মেয়েটি খুব সুবিধার নয়। আমি কথাটায় খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল এ বোধহয় কোনও মেয়েলি বিবাদের পরিণতি।
আজ এতদিন পর শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেখা, তাও আবার সম্পূর্ণ অন্য এক জনপদে। এই গোপন ডেরায় একজনও আমাদের পরিচিত বেরিয়ে গেলে, আমাদের জন্য একটাই নিদান, ডেরা বদলাও। আমাদের এই “আন্ডারগ্রাউন্ড” পর্বে অনেক কিছু একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয়। সেই “ভাবা”টা শুরু করতে গিয়ে প্রথমেই মনে হল, শর্মিষ্ঠা, দরজার ফাঁকে চিরকুট কেন রেখে গেল? ও কি আলাদা করে আমাকে কিছু বলতে চাইছিল, বলতে চাইছিল, এবার বলে এলাম, সময় দিলাম, পরের বার…। সবচে’ বড় কথা ও কিন্তু চিঠিতে কোনও সম্বোধন রাখেনি। এটা কি ও জেনে-শুনেই রাখেনি? পরে আরও অনেকগুলো ভাবনা একে-একে এসে আমাকে ঘিরে ধরল। আমি নিশ্চিত বাজার ফেরত আমার ডেরা পরে ও লুকিয়ে এসে দেখে গেছে। শর্মিষ্ঠা বলে গেল, আগামী পরশু সকালে ফের আসবে এবং সঙ্গে থাকবে ওর কিছু কলিগ। মনে হল, ও কেন এত স্পেসিফিক হতে গেল? তা ছাড়া পরশু কোনও ছুটির দিন নয়। যে মেয়ে স্কুলে চাকরি করে সে কী করে সকালে আসবে তার কাজ ছেড়ে। আমি কী এমন গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে যে সে ছুটি নিয়ে দেখা করতে আসবে। শর্মিষ্ঠা কেন বলল যে পরশু সকালে ও ওর কিছু সহকর্মীকে নিয়ে আসবে আমার ডেরায়, কেন বলল যে, ওরা বেশিক্ষণ থাকবে না। এতগুলো পয়েন্ট মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে হঠাৎ আমার মাথায় হাজার ওয়াটের লাইট জ্বলে উঠল।
পায়ের ব্যথা পুরোপুরি কমেনি। তাও দ্রুত জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিলাম। বেরোতে হবে, পালাতে হবে আজ রাতেই। আমি নিশ্চিত শর্মিষ্ঠা স্কুলে নয় – পুলিশে চাকরি করে অথবা পুলিশের ইনফর্মার ও। মনে হল, সে জন্যেই কি শর্মিষ্ঠা বলেছিল সরকারি স্কুল। আমার হিসেব বলছে যে শর্মিষ্ঠা জানে যে আমি ওয়ান্টেড। এবং সে মনে করেছে যে তার দায়িত্ব আমাকে গ্রেফতার করা বা গ্রেফতার করায় সাহায্য করা। অন্যদিকে সম্ভবত পুরনো কৃতজ্ঞতার বাঁধনে আটকে গিয়ে আমাকে পালানোর কিছুটা সুযোগ করে দেবার জন্য ও ঝুঁকি নিয়ে যতটা পেরেছে আমাকে সময় দিয়েছে এবং পালানোর সময়টাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাব জানি না। তবে এটুকু জানি যে যেতেই হবে, পালাতেই হবে।
রাতের ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরাতে কোনও রকমে একটা জায়গা পেলাম। বুকে হাতুড়ির শব্দ। সময় আর কাটতে চাইছে না। অবশেষে ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেনের কামরা থেকে বাইরে তাকিয়ে মনে হল স্টেশনের অন্ধকার এক কোণে দাঁড়িয়ে শর্মিষ্ঠা দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল সে হাসছে, সে হাত নাড়ছে আর বলছে, বসন্তদা, আজ আরও একটা গর্ভযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম।