পাশের ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে বললেন, "আপনার ফোনটা একটু দেবেন? আমার চার্জ শেষ হয়ে গেছে। একটা জরুরি ফোন করতে হবে।" আমি বললাম, "আমার কোনও ফোন নেই।" ভদ্রলোক বিশ্বাস করলেন না। বললেন, "একটা লোকাল কল। খুব জরুরি।" আমি আবার বললাম, "আমার কোনও ফোন নেই। আমি ফোন রাখি না।" ভদ্রলোক খুব রেগে অন্যদিকে ফিরে ওপাশের ভদ্রলোকের থেকে ফোন চাইলেন। কেউ বিশ্বাস করতে পারে না যে আমার কোনও ফোন নেই, আমি ফোন রাখি না। অনেকে তো তাদের পুরনো ফোন দেবার প্রস্তাবও করেছে। এই ২০২৫ সালে কেউ যে ইচ্ছে করে ফোন না রাখতে পারে, সেটা অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে না।
বাড়ি ফিরতে গঙ্গাদা বলল, "বড়মা ফোন করেছিল। তোমায় যেতে বলেছে।" বড়মা সপ্তাহে অন্তত তিনবার ফোন করে আমাকে যেতে বলে। গঙ্গাদা আদেশ করল, "চানে যাও। গিজার চালানো আছে। খাবার গরম করছি।" আজ খুব গরম পড়েছে। তিনবার গায়ের ঘাম গায়ে, মানে পাঞ্জাবীতে, শুকিয়েছে। গঙ্গাদা আমার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ঘাম-শুকোন দুশো টাকা খুঁজে পেয়ে খুব খুশি। 'আজ তাহলে দুপুরে খেয়েছে!' প্রত্যেকদিন সকালে গঙ্গাদা আমার পকেটে অনেক টাকা গুঁজে দেয়। রাতে দেখে কত বেঁচেছে। সেই দেখে স্থির করে আমি সারাদিন কী খেয়েছি, কী করেছি। আজ হাজার দিয়েছিল। ভাগ্যিস বাড়িতে ঢোকার আগে সুদর্শনকে আটশো টাকা দিয়েছিলাম।
সুদর্শন আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। সরকারি স্কুল। আমার সরকারি স্কুলে পড়ার কথা নয়। কারণ আমার বাবার প্রচুর বিত্ত, প্রচুর যোগাযোগ, প্রতি সপ্তাহেই কাগজে ছোট হরফে নাম বেরোয়। আমার বাবার বিরাট ল ফার্ম আছে। নিজে সুপ্রিম কোর্টেও অ্যাপিয়ার করে। প্রত্যেকবার অ্যাপিয়ার করলে কয়েক লাখ টাকা পায়। আমার সেই অনুযায়ী দামি ও ইংরিজি মিডিয়ামে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার বাবার অত সময় ছিল না। তাই বাড়ির কাছের বাংলা মিডিয়াম সরকারি স্কুলে চান্স পাওয়ার পরে বাবা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।
সুদর্শনের বাবা ৪৬এ রুটে বাসের কন্ডাক্টর ছিল। সুদর্শন একটা ইলেক্ট্রনিক শোরুমে কাজ করে। নিজের বাবার থেকে সুদর্শন সমাজে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। কিন্তু মুশকিল হল সুদর্শনের অলরেডি দু ছেলে আর এক মেয়ে। তিনজনকেই ওঁচা ইংরিজি মিডিয়ামে ভর্তি করেছে। সুদর্শন আমাকে বলল, "তোর কাছে পাঁচশো টাকা হবে? কাল স্কুলের মাইনে। পাঁচশো টাকা শর্ট পড়ে গেছে। তোকে পরের মাসের স্যালারির পরে দিয়ে দেব।" আমি ওকে আটশো টাকা দিয়েছি। এটাও জানি, পরের মাসে স্যালারি হবার পরে সুদর্শন আমাকে আটশো টাকা ফেরত দেবে। গরীবরা আজ অব্দি আমার টাকা মারেনি। যারা গরীব কিন্তু ফুটানি দেখায় তারা কোনওদিন টাকা ফেরত দেয় না। সুদর্শন জানে সে তার বাবার তুলনায় ধনী, কিন্তু আসলে গরীব।
খেতে বসার পর গঙ্গাদা জিগেস করল, "দুপুরে কী খেয়েছ?" আমি বললাম, "সুপ, চাউমিন আর চিলি চিকেন।" আসলে খেয়েছি ভাত, ডাল, ঝুরি আলুভাজা আর পোনা মাছের ঝোল। বাজারে নিতাইয়ের দোকানে। শুনলে গঙ্গাদা রেগে যাবে। তাই বলিনি। হোয়াইট লাই বললে কিছু হয় না। গঙ্গাদার ধারণা নিতাই আমার মাথায় কাঁঠাল ভাঙে। নিতাই মাঝে মাঝে পয়সা চায়। থাকলে দিই। পরে সেই টাকা নগদে শোধ করে দেয়। নইলে হোটেলে খাইয়ে। নিতাই-ই হিসেব রাখে। আর তাই জন্যেই গঙ্গাদা ভাবে নিতাই আমাকে ঠকাচ্ছে। কোনও প্রমাণ ছাড়াই। যাদের সন্দেহ করার তার প্রমাণ-অপ্রমাণের ধার ধারে না। তাদের সন্দেহ করা অভ্যেস। কিছুতেই সেটা কাটাতে পারবে না।
বাবুলাল
দরজা খুলল তুলি। তুলি আমার জ্যাঠতুতো বোন। বড়মার মেয়ে। "তোকে মা কবে থেকে ফোন করছে, আসছিলি না কেন?" আমি বললাম, "কাজ ছিল।" তুলি রেগে গেল, "বাজে কথা বলিস না তো। তোর কাজ মানে তো টো-টো করে ঘুরে বেড়ান আর পরোপকার করে বেড়ান। সব জানি। তাও যদি একটা গার্লফ্রেন্ড জোটাতে পারতি!" আমি ধমক দিলাম, "যা যা, মেলা ফ্যাচফ্যাচ না করে এক গ্লাস সরবত করে নিয়ে আয়!"
- লেমোনেড খাবি না কোক খাবি?
- কিচ্ছু নয়। ঠান্ডা এক গ্লাস দিশি লেবুর সরবত নিয়ে আয়!
- তুই একেবারে গাঁইয়াই থেকে গেলি!
তুলি ঝমঝম করে লেবুর সরবত আনতে চলে গেল। ভারী ভাল মেয়ে। যাদবপুরে সোশিওলজিতে পিএইচডি করে আর সায়ন নামের একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করে। সায়ন যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিঙের পরে জোকা থেকে ম্যানেজমেন্ট করে এখন মাল্টিন্যাশনালে চাকরি করে। সামনের জানুয়ারিতে ওদের বিয়ে। আমি চেষ্টা করছি বিয়েতে যতরকম বাগড়া দেওয়া যায়। খুব সফল হচ্ছি না।
বড়মা হাঁপাতে হাঁপাতে এল। "তুই এসেছিস? কবে থেকে গঙ্গাকে ফোন করছি তোকে পাঠাবার জন্যে, তোর আর সময়ই হয় না। খুব জরুরি দরকার আছে।" বড়মার জরুরি দরকার আমার জানা আছে। হয় নতুন কোন রেসিপিতে এক্সোটিক রান্না শিখেছে - পেঁপের মালাইকারি টাইপের - আর নয়ত আমার জন্যে দুর্দান্ত একজন পাত্রী পেয়েছে। এররকম পাত্রী হাতছাড়া হলে আমার ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার। বড়মা প্রতি তিনমাসে এররকম একজন করে পাত্রী খুঁজে পায়। আমি জিগেস করলাম, "নতুন কোন রেসিপি শিখেছ?" বড়মা সিরিয়াস হয়ে গেল, "ইয়ার্কি করিস না গোর্কি। তোর জ্যাঠাকে নিয়ে বিরাট সমস্যা চলছে।" জিগেস করলাম, "জ্যাঠার আবার কী হল? ফার্মে ধর্মঘট? ভাল হয়েছে। শ্রমিক শোষণ বেশিদিন চলে না। শ্রমিকরা একদিন দুনিয়া শাসন করবে। ডিক্টেটরশিপ অফ দা প্রলেতারিয়েত। যারা শোষণ কম করেছে, তাদের হয়ত মাসোহারার বন্দোবস্ত করবে, বাকিদের স্রেফ ঢিচক্যাঁও। মনে হচ্ছে শুরু হয়ে গেছে। খালি দেখতে হবে তোমরা মাসোহারার দলে না ঢিচক্যাঁওয়ের দলে।"
- একটা চড় মারব। চুপ করে বোস। চা দিচ্ছে। কোথায় থাকিস তুই? চেহারা করেছিস তো কাঁকলাসের মত।
- কাঁকলাস কী?
- বাজে বকিস না। শোন যেটা বলছি। তোর জ্যাঠা বলছে ফার্ম বন্ধ করে দেবে।
- বাহ, এ তো খুব ভাল খবর।
- রিটায়ার করবে। তুলির বিয়েটা হয়ে গেলেই তার নাকি সব দায়িত্ব শেষ। তারপরেই রিটায়ার।
- বিয়ে দিচ্ছ তুলির? ছেলে পেয়েছ?
- সায়ন থাকতে ছেলে আবার পাব কী?
- সায়নর সঙ্গেই দিচ্ছ? তোমরা যদি মেয়েকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিতে চাও আমি আর কী বলব।
তুলি সরবত নিয়ে আসছিল। শুনতে পেয়ে বলল, "হ্যাঁ দেবে, তোর তাতে কী?" বড়মা বলল, "দেখ কালকের আনা পেস্ট্রির একটা আছে ফ্রিজে। গোর্কিকে দে। আর নমিতাকে বল চা দিতে।" তুলি বলল, "ওই পেস্ট্রিটা তো আমি খাব বলে রেখেছিলাম।" আমি বললাম, "তুই-ই খা। আমার লাগবে না। আমি অনেক খেতে পারব। বিয়ের পর তোর তো আর এসব লাক্সারি থাকবে না।" তুলি মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। আমি বড়মাকে বললাম, "জ্যাঠা রিটায়ার করলে তোমার অসুবিধেটা কোথায়? তোমার তো ভালই হবে। তুমি সারাদিন ধরে অত্যাচার করতে পারবে।"
- সেটাই তো বলছি। সারাদিন বাড়িতে থাকবে, এমনিতেই বুড়িয়ে গেছে, আরও বুড়িয়ে যাবে। আর সারাদিন ফরমাস করবে, চা আনো, অমুক খাবারটা করো, তমুক দোকান থেকে এটা আনিয়ে দাও। আমার মাথা খাবে। তুই এটা বন্ধ কর। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
- তোমার কি সমস্যা স্ট্যাকে এটাই এখন সবচেয়ে ওপরে আছে? অন্য কিছু সমস্যা থাকলে বল। এইটা এখন কিছু করার নেই। তুলির বিয়েটা হোক আগে, তারপরে ভাবব।
দুপুরে খেয়ে ঘর অন্ধকার করে ফুল ব্লাস্টে এসি চালিয়ে ঘুমোলাম। জ্যাঠা ফেরার আগেই চলে এলাম। বাড়ি ফিরে আমাকে দেখলে জ্যাঠার আনন্দের সীমা থাকবে না। সামনে বসিয়ে জোর করে নানা রকম সুখাদ্য খাওয়াবে আর নানা রকমের প্ল্যান ফাঁদবে। অধিকাংশ প্ল্যানই মূলত আমাকে কী করে অর্থকরী পেশায় ঢোকান যায় তাই নিয়ে। সাধারণত শুরু হয়, "তাহলে এবার অফিসে এসে বসতে শুরু কর" দিয়ে। তারপর নানারকম সম্ভব-অসম্ভব প্রকল্প। তারপরে ওখান থেকে বেরোন খুব মুশকিল হয়ে যায়।
জ্যাঠার বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিক্সাস্ট্যান্ডে বাবুলালের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাবুলাল আমার ফেভারিট রিক্সাওলা। নিজের রিক্সা দারুণ সাজিয়ে গুজিয়ে রাখে। আর পেছনের লেখাটা প্রত্যেক মাসে বদলায়। শেষবার দেখেছিলাম লেখা আছে "অল্প প্রেমে সময় নষ্ট বেশি প্রেমে বুকে কষ্ট"। এবার দেখলাম লেখা "জলপরীর বিয়ে"। আমি জিগেস করলাম, "মানে কী রে?" বাবুলাল বলল, "জলপরীর বিয়েতে এই রিক্সা ভাড়ায় যাবে"। বাবুলালের আসল গুণ হল সে দারুণ বাঁশি বাজায়। আড়বাঁশিতে যা সুর তোলে, সে শুনলে রোনু মজুমদার বাঁশি বাজানো ছেড়ে দেবে। আমি ঠিক করেছি তুলির বিয়েতে সানাইয়ের বদলে বাবুলালের বাঁশি বাজবে। বাবুলালকে বললাম, "বিয়েতে বাঁশি বাজাতে হবে।" বাবুলাল জিগেস করল, "কী সুর?" আমি বললাম, "তুই ঠিক কর"। বাবুলাল বলল, "যিসকি বিবি মোটি"। আমি বললাম, "যার বিয়ে সে মোটি নয়, সে খুবই রোগা"। বাবুলাল আকাশের দিকে চেয়ে বলল, "ঠিক আছে তাহলে 'যিসকি বিবি পাতলি' লাইনটা বাজাব।" একই সুরের লাইনে কোন লাইনটা বাজাচ্ছে কী করে বোঝা যাবে আমি জানি না। বাবুলাল নিশ্চয়ই জানে।
অটোযাত্রা
পরেরদিন ঘুম ভাঙাল মকবুল। "শিগগির ওঠ।" সকালে তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে ওঠা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। শারীরিক, মানসিক - কোন স্বাস্থ্যের পক্ষেই। তাই আমি ঘুম ভেঙে গেলেও প্রথমেই চোখ খুলি না। আগে পারিপার্শ্বিকটা বোঝার চেষ্টা করি। মনে করার চেষ্টা করি, কোথায় আছি। তারপরে ভাবি আজ কী বার, কত তারিখ, কোন মাস, কোন বছর। তারপরে মেন্টাল এক্সারসাইজ। একেকদিন ৮৯ থেকে উল্টোদিকের ফিবোনাচ্চি সিরিজ আওড়াই, কখনও কপালকুন্ডলার 'দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য' শ্লোক বলি, কখন মনে মনে জিভ না জড়িয়ে 'বেটি বটার বট সাম বাটার' আবৃত্তি করি। মেন্টাল এক্সারসাইজ শেষ করে ফিজিকাল। প্রথমে পায়ের আঙুল নাড়াই। তারপরে হাঁটু, কোমর, হাতের আঙুল, কনুই নাড়াতে নাড়াতে শেষে এসে আস্তে আস্তে চোখ খুলি। তারপরে ডান নাক দিয়ে দশবার, বাঁ নাক দিয়ে দশবার আলাদা আলাদা নিশ্বাস নিই। এইসব করার পরে তবে উঠে বসি। আজ মকবুলের ডাকে এসব করার সুযোগ পাওয়া গেল না। ধড়মড় করে উঠে বসতে হল।
মকবুল বলল, "মুখ ধুয়ে জামা পর। বেরোতে হবে।" এসব সময়ে নিয়ম হচ্ছে কোনও প্রশ্ন না করে চটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়া। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি মকবুল চা, ডিমের অমলেট শেষ করে মুখ পুঁচছে। আমাকে দেখে বলল, "তুই এখন চা-অমলেট খেলে দেরি হয়ে যাবে বলে তোরটা আমি খেয়ে নিয়েছি।" গঙ্গাদাকে সবাই সমীহ করে। খাবার পড়ে থাকতে দেখলে বাড়ি থেকে বেরোতে দেবে না। আমি মকবুলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। মকবুল বলল, "দুদিন অনিমেষদা বাড়ি ফেরেনি, খবরও দেয়নি।" অনিমেষদা আমাদের বন্ধু অরণির দাদা। একজন তিরিশ বছরের সুস্থসবল মানুষ দুদিন বাড়ি ফেরেনি বলে কেন আমাকে জাগরণী রিচুয়ালস পালন না করে বেরিয়ে আসতে হল বুঝলাম না। তাও নিশ্চিত হবার জন্যে মকবুলকে জিগেস করলাম, "তুই কি সেই জন্যে আমাকে নিয়ে এলি?" মকবুল বলল, "নয়ত কী! তুই ছাড়া আর বেকার কে আছে যে এসব কাজ করবে?" সেটা ঠিক। আমাদের আর সব বন্ধুরাই চাকরি করে, ব্যবসা করে। এক আমি আছি কিছু করি না। আর মকবুল পোস্টডক করে - মানে তারও কোন কাজ নেই। তাই বনের মোষ তাড়ানোর সবরকম দায়িত্ব আমাদের ওপরই পড়ে। এখানে অবশ্য মনে হচ্ছে বনের মোষ নয়, ঘরের গরু ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পড়বে।
"তা এখন আমরা করব কী? অরণির বাড়ি যাব?" আমি জিগেস করলাম। মকবুল বলল, "অরণির বাড়িতে গিয়ে কোন লাভ নেই। ওর ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। সাতটার পরে আর বেরোতে পারবে না বলে সকাল ছটায় এসে আমায় খবর দিয়েছে।" অরণি বাড়িতে অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ায়। সকাল সাতটা থেকে ব্যাচ শুরু হয়। চলে রাত নটা অব্দি। দুপুরে ঘন্টা তিনেক বিশ্রামের জন্যে আশ্রম বন্ধ থাকে। আবার তিনটে থেকে চালু। অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ানো ছাড়া অরণির জীবনে আর কোনরকম উদ্দীপনা নেই।
- তাহলে কোথায় যাচ্ছি?
- আগে চল একবার অনিমেষদার কলেজে যাই। সেখান থেকে যদি কিছু খবর পাওয়া যায়।
- এখন এই সাড়ে আটটার সময়ে কলেজ খুলেছে নাকি? কলেজে কাজের লোক কেউ সাড়ে বারোটার আগে আসে না।
- কারেক্ট।
- কারেক্ট তো আমাকে এই সাতসকালে টেনে বের করলি কেন? ধীরেসুস্থে বেরোতে পারতাম।
- কারণ দশটায় আমার একটা প্রেজেন্টেশন আছে। আমি নটার মধ্যে তোকে ব্রিফটা বুঝিয়ে দিয়ে প্রেজেন্টেশন দিতে ইউনিভার্সিটি চলে যাব।
- ব্রিফ? তুই কি নিজেকে শার্লক হোমস ভাবছিস নাকি?
- আমি কি ভাবছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তুই আমাকে তোর লিডার ভাবছিস কিনা সেটা জানা জরুরি।
পাশেই একটা অটো প্যাসেঞ্জার নাবিয়ে চলতে শুরু করেছে। আমি চট করে চলন্ত অটোটায় চেপে বসলাম। মকবুল হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবলাম একবার মুখ বাড়িয়ে 'টা টা লিডার' বলি। গেঁতোমি লাগল। অটোটা উল্টোডাঙা যাচ্ছে। ওই অব্দি তো আগে যাই, তারপরে ভাবা যাবে আজকের দিনের গতিবিধি কী হবে। আমাকে একজন বলেছিল, ঠিকমতন অটোর রুট জানা থাকলে, অটো চেঞ্জ করে করে কলকাতা থেকে পাঞ্জাবে পাকিস্তান বর্ডার অব্দি চলে যাওয়া যায়। আমি ভাবলাম আজ সেটা চেষ্টা করে দেখি। প্রথমবার পাকিস্তান বর্ডার নয়, বাংলাদেশ বর্ডার অব্দি যাই। উল্টোডাঙায় নেবে প্রথম সমস্যা হল টাকা। গঙ্গাদা পাঞ্জাবীর পকেটে আজ তিন-হাজার টাকা দিয়েছে, ছ'টা পাঁচশো টাকার নোট। অটোর ভাড়া হয়েছে দশ টাকা। আমি পাঁচশোর নোট দিলাম। অটোওলা বলল, "ইয়ার্কি করেন? সকালবেলা পাঁচশোর নোটের ভাঙতি চান? খুচরো দিন।" আমি বললাম, "আমার কাছে খুচরো নেই। ভাঙতি না থাকে রেখে দিন। বাকি টাকার অটো চড়িয়ে দেবেন।" লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে, টাকাটা নিয়ে কোন কথা না বলে নেবে গেল। আমি ভাবতে শুরু করলাম, এখান থেকে তিনটে রুটে অটো যায় - কাঁকুড়গাছি, গ্রে স্ট্রিট আর বাগুইহাটি। আর সব রুট সল্ট লেক আর বাইপাসের দিকে। ওদিকে গিয়ে লাভ নেই। কোনদিক দিয়ে বাংলাদেশ বর্ডার কাছে হবে এ সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাও নেই। কিন্তু বাগুইহাটি থেকে যশোর রোড যে কাছে, এটা জানি। যশোর রোড ধরে চলতে থাকলে নিশ্চয়ই একসময়ে বাংলাদেশে বর্ডারে পৌঁছে যাব। যশোর তো বাংলাদেশে। অ্যালেন গিন্সবার্গ না পীট সিগার - কে যেন 'অন যশোর রোড' বলে কবিতা লিখেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। সেই ভেবে বাগুইহাটি অটোর স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকি। পেছন থেকে অটোওলা 'এই যে ভাই' বলে এসে হাতে এক বাণ্ডিল টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, "সকালবেলা যত্ত ঝুটঝামেলা।"
রহস্যের খাসমহল
দুপুরবেলা একটা ধাবায় বসে রুটি, তড়কা আর কোক খাচ্ছি। টেবিলে আমার উল্টোদিকে বসে অনিমেষদা এক প্লেট চাউমিন আর বিয়ার খাচ্ছে। এর আগে হাফ তন্দুরি চিকেন আর বিয়ার খেয়েছে। অনিমেষদা আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে পেছনের বোর্ডে যেখানে খাবারের নাম-দাম লেখা আছে সেটা দেখছে, ঘাড় ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে একটা নিমগাছের ডালে টায়ার বাঁধা আছে সেটা দেখছে আর মাঝে মাঝে নিজের খাবারের থালার দিকে দেখছে। আমি এখনও সেরকম জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করিনি। দেড় ঘন্টা ধরে বাতাবরণ সৃষ্টি করছি। এর আগে পাশে চায়ের দোকানে চা খেয়েছি। সেই চায়ের দোকানেই অনিমেষদাকে আবিষ্কার করেছিলাম। আবিষ্কার করেছিলাম বলাটা ভুল।
বাগুইহাটিতে অটো থেকে নেবে এয়ারপোর্ট তিননম্বর গেটের অটো নিলাম। সেখান থেকে মাইকেলনগরের। এইভাবে বারাসাতে এসে মনে পড়ল কাছাকাছিই অনিমেষদার কলেজ। বাংলাদেশ বর্ডার যাবার প্ল্যান ক্যান্সেল করে একটা অটো ধরে কলেজে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে মেয়েদের কলেজ চলছে। সকালে মেয়েদের কলেজ, দুপুরে কো-এড, রাতে ছেলেদের কমার্স। দারোয়ান বলল। কলেজের একটা মস্ত গেট। পাশের একটা ছোট গেট থেকে মুন্ডু বের করে কথা বলল দারোয়ান। বোধহয় মেয়ে-কলেজ চলার সময়ে পুরো বডি বের করার অনুমতি নেই। আমি বললাম, "পুলিশ থেকে আসছি একজন মাস্টারমশাইয়ের খোঁজে। দরজা খোল।" পোড় খাওয়া দারোয়ান। পুলিশ শুনে ঘাবড়াল না। বলল, "কোন মাস্টার?" আমি বললাম, "অনিমেষ মিত্র।" দারোয়ান বলল, "কালুর গ্যারেজে খোঁজ নিন।" বলেই ঠং করে বেবি দরজা বন্ধ করে দিল।
কালুর গ্যারেজের বাঁ-পাশে একটা ধাবা আর ডান পাশে একটা চায়ের দোকান। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে অনিমেষদা চা খাচ্ছে। আমি পাশে বসলাম। অনিমেষদা দেখল, কিছু বলল না। আমার খুব খিদে পেয়েছে। মনে পড়ল সকাল থেকে কিছু খাইনি। একটা চা চাইলাম। কম দুধ আর বেশি চিনি দেওয়া কড়ক চা। চা খেতে খেতে দেখলাম তোবড়ান সসপ্যানে ডিম-রুটি বানানো হচ্ছে। আবার খিদেটা চাগাড় দিল। অনিমেষদাও কিছু বলছে না, আমিও কিছু বলছি না। ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে যে আগে কথা বলবে, সে হেরে যাবে। অনিমেষদা চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরাল। আমি বসে সামনে চেয়ে রইলাম। ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে যে কিছু না করে বসে থাকতে পারে, সে এক্সট্রা পয়েন্ট পায়। অনিমেষদা সিগারেট খাচ্ছে, তাই পয়েন্ট কাটা গেছে। আমি নানারকম জিনিস দেখছি।
- একটা গরু ঘাড় বেঁকিয়ে নিজের বাঁদিকের পাঁজরের কাছটা চাটছে।
- রাস্তার উল্টোদিকে একটা বাড়িতে একটা ঘুন্সিপরা শিশু মাটিতে বসে মুঠোয় ভরে ধুলো খাচ্ছে। ভাল করে মুঠো করতে পারে না বলে মুখে পৌঁছনর আগেই অধিকাংশ ধুলো মুঠো থেকে পড়ে যাচ্ছে।
- একটা ছেলে সাইকেলে চেপে এসে এক পায়ের ব্যালেন্সে দাঁড়িয়ে কালুর গ্যারেজের দিকে তাকিয়ে বলল, "এখন নেই, বিকেলে আসবে।" বলে চলে গেল।
আড়চোখে দেখলাম অনিমেষদার সিগারেট শেষ হল। আমি সামনের দৃশ্যাবলী দেখছি। এবার দেখলাম
- সামনের ধুলোখেকো শিশুর বাড়ির কলাগাছে অনেক কলা ধরেছে।
- সেই বাড়ির পাশে একটা মাঠ ঘেরা পাঁচিলে লেখা আছে তৃণমূল সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দেবার কথা, কিন্তু প্রার্থীর নামের ওপর জেরক্স দোকান আর আয়া সেন্টারের বিজ্ঞাপন লেগে নামটা আর পড়া যাচ্ছে না। যাকে বা যাদের বিজ্ঞাপন সাঁটার কাজ দেওয়া হয়েছিল সে বা তারা ফাঁকি মেরেছে। পাশাপাশি একই জেরক্স দোকানের ছটা আর একই আয়া সেন্টারের চারটে বিজ্ঞাপন মারার কারণ কী?
- রাস্তার ওপর একটা ছোট গর্ত হয়েছে। বর্ষার আগে গর্তটা যথেষ্ট বড় হয়ে যাবে। তখন পুলটিশ দেওয়া হবে যাতে বর্ষায় পুলটিশ উঠে গিয়ে আবার গর্ত হয়ে যায়।
খিদে চাপা দেবার জন্যে আবার এক কাপ চা খেলাম। এবার দুটো চা নিয়েছিলাম। একটা অনিমেষদাকে দিলাম, একটা আমি খেলাম। দৃশ্যাবলী দেখলাম। আরেকবার চা খাব আর খাওয়াব কিনা ভাবলাম। আবার দৃশ্যাবলী দেখলাম। এই করে ঘন্টা দেড়েক কাটাবার পরে উঠে অনিমেষদাকে বললাম, "চল, খেয়ে নিই।" তারপরে ধাবায় ঢুকে খাবার অর্ডার দিয়েছি। খাবার এসেছে। আমি রুটি, তড়কা আর কোক খাচ্ছি। অনিমেষদা তন্দুরি চিকেন খাবার পরে এখন চাউমিন আর বিয়ার খাচ্ছে। খাবার সময়ে মানুষ সবচেয়ে রিল্যাক্সড থাকে। আগে যখন মানুষ বনে-জঙ্গলে থাকত চারদিকে বন্য পশুর মধ্যে - যেকোন সময়ে নিজে খাদ্য হয়ে যেতে পারে - তারা তখনই নিশ্চিন্ত মনে খেতে পারত যখন জানত যে কাছাকাছি কোন বিপদ লুকিয়ে নেই। এইরকম লক্ষ লক্ষ বছরের অভ্যেসে ব্রেন ব্যাপারটাকে উল্টো করে নিয়েছে। চোয়াল চললে ভাবে বিপদের আশংকা নেই, মনকে বলে, "রিল্যাক্স বেবি।" এই জন্যে ভিভ রিচার্ডস লিলি-টমসনকে সংহার করার সময়ে চুইং গাম চিবোত। হাফ তন্দুরি খেয়েই অনিমেষদার বর্ম শিথিল হয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে বিয়ার। বর্ম অগোছাল, ব্রেন টলোমলো। তন্দুরি চিকেন শেষ হয়েছে, চাউমিন চলছে - এসময়ে অনিমেষদা আর থাকতে পারল না। কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, "পুরো ফেঁসে গেছি রে গোর্কি।" আমি চুপ করে রইলাম। "পুরো ফেঁসে গেছি। বাড়িতে ফিরতে পারব না আর।" এখন জানি কথা গলগল করে বেরোবে, আমাকে খালি ঠিকঠাক দিকে চ্যানেল করে দিতে হবে। অথচ পেটে যতক্ষণ খাবার পড়েনি, অনিমেষদা কোন ইনফর্মেশন দেয়নি, পেটে খাবার পড়তেই প্রতিরোধ ভেঙে গেল। এই জন্যেই চে গেভারা থেকে চারু মজুমদার সবাই আধপেটা থাকতেন।
"মেয়ে-ঘটিত না অর্থ-ঘটিত?" আমি জিগেস করলাম।
অনিমেষদা আবার নিমগাছের টায়ার দেখছে। কিছুক্ষণ পরে বলল, "তোকে অরণি কী বলেছে?" আমি জানালাম, কিছুই বলেনি কারণ অরণির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমি ভায়া-মিডিয়া শুনেছি। "কী শুনেছিস", অনিমেষদা আবার জিগেস করল। আমি বললাম, "শুধু এই যে তুমি খবর-টবর না দিয়ে দু-রাত্তির বেপাত্তা।" হুঁ বলে আবার কিছুক্ষণ টায়ার দেখল। "ভায়া-মিডিয়াটা কে?" অনিমেষদা জানতে চাইল। আমি বললাম অরণি মকবুলকে বলেছে, মকবুল আমাকে। মকবুলের নাম শুনেই অনিমেষদা একেবারে তিড়িং-বিড়িং করে উঠল। "ওই মকবুল। ওর জন্যে আজ আমার এই হাল।" এইবার আমি অল্প ঘাবড়ে গেছি। এই বাজারে গোয়েন্দা নিজেই অপরাধী? অপরাধী না হোক, অ্যাকমপ্লিস! কেসটা কী?
পুলিশ
আমি একটা বাড়ির সামনের ঘরে বসে আছি। খাটের ওপর। খাটটাই ঘরের প্রায় আদ্ধেক জুড়ে রয়েছে। খাটে ছতরিও আছে। খাটের ওপর টানটান করে চাদর পাতা। খাটের বাইরে ঘরের অল্প যে অংশ বাকি আছে তাতে একটা চাদর চাপা দেওয়া সোফাও আছে। সোফাটা হয় প্রচণ্ড পরিষ্কার আর নইলে খুব নোংরা আর ছেঁড়া। এ ছাড়া আর কোনও কারণে লোকে সোফায় চাদর চাপা দেয় না। আর একটা বইয়ের আলমারি আছে। কাঁচ দেওয়া। তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলীর শতবর্ষ এডিশন রয়েছে। সঞ্চয়িতা আছে, নজরুলের সঞ্চিতা আছে। যে দরজা দিয়ে ঢুকেছি তার ওপর একটা বাঁধানো ছবি আছে। মক্কায় কাবার ছবি। ফ্রেমের কাঁচের ওপর উর্দু বা আরবিতে কিছু লেখাও আছে। দরজার উল্টোদিকে বাড়ির ভেতরে যাবার আর একটা দরজা আছে। সেটায় একটা পর্দা ঝুলছে। খাটের বেডকভার আর দরজার পর্দা সবুজ রঙের। সোফার চাদর সাদা। তাতে কালোর ছোপ ধরেছে।
এটা অনিমেষদার শ্বশুরবাড়ি। অনিমেষদা একটা মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করেছে। বাড়িতে জানে না। অনিমেষদা যে অল্পসল্প প্রেম করছে সেটাই জানে না। অনিমেষদার মা যদি জানতে পারে অনিমেষদা মুসলমান বিয়ে করেছে, যেখানে জানবে সেখানেই ধপ করে পড়ে মরে যাবে। এটা অনিমেষদার বয়ান। আমি মাসিকে চিনি। সেরকম কিছু হবে না। অল্প দুঃখ পেলেও মোটামুটি খুশিই হবেন। দুঃখটা মূলত না-জানিয়ে বিয়ে করার জন্যে। আর খুশিটা হল যে দুই ছেলেকেই মাসি বিয়ের ব্যাপারে খরচের খাতায় ধরে রেখেছিলেন। অরণি তো অ্যাকাউন্টেন্সি আশ্রমের বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না। অনিমেষদারও, মাসির ধারণায়, ফিলোজফি পড়িয়ে আর বিবেকানন্দপন্থী হয়ে সাধু-সন্ন্যাসীর লাইনে চলে যাবার সম্ভাবনা আছে।
খাটে অন্য কোণে রুকসানা বসে আছে। রুকসানা অনিমেষদার সদ্য-পাওয়া বউ। আমি এখন বসে বসে ভাবছি অনিমেষদার বউকে আমি বৌদি বলে ডাকব না ভাবি বলে ডাকব। নাকি নাম ধরে ডাকব। কারণ সে মকবুলের ফুফাতো বোন। মানে পিসতুতো বোন। খালা আর ফুফু - একজন মাসি আর একজন পিসি। কিন্তু কোনজন খালা আর কোনজন ফুফু আমার গুলিয়ে যায়। মকবুলই ফুফাতো বোনকে পড়ানোর জন্যে অনিমেষদাকে ঠিক করে দিয়েছিল।
খাটের অন্যধারে অনিমেষদা বসেছিল। এখন উঠে বারন্দায় গেছে বাড়িতে ফোন করতে। যেতে চাইছিল না। জোর করে পাঠিয়েছি। জোর করে মানে খুব জোর করে। এবং একজন বিবাহিত প্রফেসরের ন্যাকামি দেখে অসম্ভব বিরক্ত হয়েছি। সামনে সোফায় বসে আছে অনিমেষদার সদ্য-পাওয়া শ্বশুর আর সদ্য-পাওয়া শালা। শালার এখনও গোঁফ ওঠেনি। উঠে যাবে, রেখা দেখা যাচ্ছে। আমরা আলোচনায় বসেছি। আলোচনা আপাতত স্থগিত আছে। অনিমেষদা ফিরে এলে আবার শুরু হবে।
বিষয় হচ্ছে এই - অনিমেষদার আর রুকসানার অল্প প্রেম জমেছিল। রুকসানার দিক থেকে নব্বই শতাংশ, অনিমেষদার দিক থেকে পঁচাত্তর শতাংশ। গড় করলে সাড়ে বিরাশি শতাংশ। বিয়ে করার পক্ষে যথেষ্ট। এর অনেক কম গড়ে অনেক লোকের বিয়ে হয়। পঞ্চাশ শতাংশের বেশি হলেই বিয়ে হতে পারে। কিন্তু মুশকিল হল পাড়ায় তাহের বলে একটা ছেলে আছে। মস্তান টাইপের, পলিটিকাল লাইন করার চেষ্টা করছে, এখনও পুরো লাইন ক্লিয়ার করতে পারেনি। সে রুকসানাকে একশো শতাংশ ভালবাসে। রুকসানা ভালাবাসে শূন্য শতাংশ। গড় পঞ্চাশ। বিয়ে হতে পারে না। কিন্তু তাহের বিয়ের এই হিসেবটা জানে না। তাই সে অনেকদিন ধরে থ্রেট দিচ্ছে - 'তুলে নিয়ে যাব'। কদিন আগে কয়েকজন সাগরেদ নিয়ে এসে আবার হল্লা করেছে। পুলিশকে জানিয়েও কোন কাজ হয়নি। তাহের হয়ত পুলিশকে পয়সা খাইয়ে রেখেছে। রুকসানার স্কুল শিক্ষক বাবা খুব ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি মেয়ের বিয়ে ঠিক করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। অনিমেষদা আর রুকসানা সেই সুযোগে বিয়ে করে নিয়েছে। সে জেনে তাহের এসে আরেক দফা হল্লা করেছে। আবার পুলিশে জানিয়ে আবার কোন কাজ হয়নি। বরং থানা থেকে এসে শাসিয়ে দিয়ে গেছে যে অনিমেষদা আর রুকসানা যেন পাড়া ছেড়ে কোথাও না যায়। প্রতিদিন তাদের থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হবে। হিন্দু-মুসলমান বিয়ে হয়েছে। কমিউনাল ভায়োলেন্স হয়ে যেতে পারে।
আলোচনা স্থগিত থাকায় আমাদের মধ্যে কোনও কথাও হচ্ছে না। তার মূল কারণ আমার ব্রেন এখনও ভেবে চলেছে রুকসানাকে বৌদি বলব, নাকি ভাবি বলব, নাকি রুকসানা বলব। আলোচনা স্থগিত থাকার দ্বিতীয় মূল কারণ হল আলোচনা করার মতন কোন বিষয় নেই। আমি বলেছি, থানা-ফানা গুলি মারো। বাড়ি চলে যাও রুকসানাকে (বৌদি/ভাবি) নিয়ে। থানার দম থাকলে গিয়ে নিয়ে আসুক। কমিউনাল ভায়োলেন্স-টায়োলেন্স বলে ফালতু বাজার গরম করছে। কিন্তু অনিমেষদা ভয় পাচ্ছে পাছে সদ্য-পাওয়া শ্বশুরবাড়িতে এসে পুলিশ আর তাহের গোলমাল করে। এইটা শুনে আমি একটু থমকে গেছি। ইয়ে বাতমে দম হ্যায়। ভাববার বিষয়।
এর কিছুক্ষণ পরে আমি আবিষ্কার করলাম আমি একটা সিভিকের সঙ্গে থানার বাইরে বসে আছি। সিভিক আমার থেকে নিয়ে দ্বিতীয় সিগারেট খাচ্ছে। দামি সিগারেট কিনেছি থানায় আসার আগে। কুড়িটার প্যাকেট। সিভিকরা নিজের পয়সায় এরকম দামি সিগারেট খেতে পারে না। ঘুগনিও খাইয়েছি। অনিমেষদা আর রুকসানা থানার ভেতরে গেছে। "এস-আইটা বহোত খচ্চর আছে। ওসি রগচটা, কিন্তু অ্যাজ পার্সন খারাপ নয়।" তাহেরের কথা জিগেস করলাম। "ফুটা মস্তান। আগে তিনোমুল করার চেষ্টা করেছে, ঢুকতে পারেনি। এখন বিজেপি হবার চেষ্টা করছে। হবে না। সামনে লাইনে অনেক লোক আছে। তাছাড়া তাহেরের কিসু নেই। চারটে বন্ধুর সঙ্গে মস্তানি করার চেষ্টা করে। পার্টি কেন নেবে? তাও আগে যদি সাগরেদি করে উঠত। প্রথম থেকেই নেতা হবার শখ। ওসি মালটাকে দেখলেই ফুটিয়ে দেয়। এস-আই বসিয়ে চা খাওয়ায়। হাতে রাখে আর কি!"
আমি থানার ভেতরে গিয়ে দেখলাম এস-আই-এর সামনে চোর-চোর ভঙ্গিতে অনিমেষদা আর রুকসানা (ভাবি/বৌদি) বসে আছে। সামনে এস-আই ফোন দেখছে। আমাকে ঢুকতে দেখে এস-আই জিগেস করলেন, "কী চাই?" আমি বললাম, "আমি এঁদের নিয়ে যেতে এসেছি।"
- আপনি কে?
- আমি ওঁর ভাইয়ের বন্ধু। ওঁদের থানায় হাজিরা দেবার কথা দিয়েছেন। এবার আমার সঙ্গে যাবেন।
- ওসি না আসা অব্দি থাকতে হবে।
- ওসি কখন আসবে?
- বলতে পারি না।
- অতক্ষণ বসতে পারব না। আপনাকে হাজিরা অলরেডি দেওয়া হয়েছে। আপনি ওসিকে বলে দেবেন।
আমি এস-আই-এর টেবিল থেকে একটা প্যাড আর পেন তুলে বাড়ির ঠিকানা লিখে দিলাম। বললাম, "ওসি আসা অব্দি থাকার কোন কথা নেই। থানায় হাজিরা দেবার, দিয়েছেন। এরপরে এই ঠিকানায় থাকবেন। দরকার হলে ওসিকে বলবেন এই ঠিকানায় দেখা করতে। কাল আবার এসে হাজিরা দেবে।" হতভম্ব এস-আই-এর সামনে দিয়ে সন্ত্রস্ত দুজনকে নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।
এইবার দ্বিতীয় যুদ্ধ।
পাল্টা দান
পরের দিন অরণিদের বাড়িতে গিয়ে দেখি সে আবার অন্য কেলো। মাসি রুকসানাকে ছাড়বেন না। বাড়ির বউ থানায় যাবে না। দরকার হলে পুলিশ বাড়িতে এসে সই নিয়ে যাক। কালকের ঘটনার অভিঘাতে ভেবেছিলাম অরণির আশ্রম আজ বন্ধ থাকবে। কোথায় কী? আশ্রম ফুল স্টিমে চলছে। আমার মন আজ ভাল। নিজের সঙ্গে হেস্তনেস্ত করে নিয়েছি। রুকসানাকে রুকসানাই বলব। নামটা খুব সুন্দর।
আমার কথাই ঠিক হয়েছে। মাসি কোন গোলমাল করবে না, আমি জানতাম। মাসি সারাদিন ফোনে বাংলাদেশি নাটক দেখে। অনিমেষদা-রুকসানা আসার পরেই লোক জুটিয়ে বরণ-টরন করেছেন। আর বলেছেন, ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। বিয়ের ধুমধামে আশ্রম বন্ধ রাখার আশংকায় অরণি খুব মুষড়ে পড়েছে। আর সবাই খুশি। মাসি আমাকে আজকের কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমি আগে রুকসানার বাড়িতে যাব। যাবার সময়ে মিষ্টি কিনতে হবে। মিষ্টি কেনার সময়ে কিপ্টেমি করলে হবে না। মিষ্টি দিয়ে বাড়ির সবাইকে সন্ধ্যেবেলা এ বাড়িতে আসতে নেমন্তন্ন করতে হবে। তারপরে যেতে হবে থানায়। ঘুষ-টুষ দিয়ে যেভাবে হোক থানায় হাজিরা মকুব করাতে হবে। সেই সঙ্গে অনিমেষদা একটা খাম দিয়ে বলেছে তার কলেজে পৌঁছে দিতে। ছুটির দরখাস্ত। মকবুল আজ সকাল থেকে অরণিদের বাড়িতে এসে বসে আছে। এমন হাবভাব নিচ্ছে যেন অনিমেষদার বিয়ের পুরো কৃতিত্ব তার। আমি মকবুলকে একদম পাত্তা দিচ্ছি না। আমি আর মকবুল দুজনে বেরলাম। ফুফুর বাড়িতে গিয়ে মকবুল যা বলার বলবে। আমি আগে কলেজে, তারপরে থানায় যাব।
থানায় ঢুকে সোজা চলে গেলাম এস-আইয়ের ঘরে। কাল দেখেছি রেলা নিলে পুলিশ হতভম্ব হয়ে যায়। সেই হতভম্বতার সুযোগ নিয়ে কাজ হাসিল করতে হয়। কিন্তু আজ আর সেই কৌশল কাজ করবে না। কাল কৌশলটা এস-আই দেখে নিয়েছে। আজ নতুন চাল ভাবতে হবে। আজ এস-আই নেই। ওসি আছে। একটা আড়কাঠি টাইপের লোক ওসির ঘরে আমাকে নিয়ে ঢুকে গেল। "এই যে স্যার। এই লোক।" ওসি একটা গোল টিফিন কৌটো খুলে লুচি তরকারি খাচ্ছিলেন। বিরক্ত চোখ তুলে তাকালেন। "কাল এসে ঠিকানা দিয়ে গেছিল, এই লোক স্যার।" ওসি শুনেই টিফিন কৌটো রেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আড়কাঠিকে এক ধমক, "লোক বলছিস কী, স্যার বলতে পারিস না?" তারপর আমাকে কী খাতির! আমি তো ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছি না। "বসুন, বসুন। এই যা চা নিয়ে আয়। চা খাবেন, না ঠান্ডা?" আড়কাঠি এইসব গোলমাল দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে এসেছিল ওসির কাছে ঝাড় খাওয়ানোর জন্যে। ঘটনাপ্রবাহ হঠাৎ উল্টোদিকে চলতে শুরু করায় তার মাথা কাজ করছে না। আমার মাথা কাজ করছে, কিন্তু আমিও বুঝতে পারছি না ঘটনা কী ঘটছে। এত খাতির কী কারণে? যে কারণেই হোক, আস্তে আস্তে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে। আপাতত খেলাটা খেলে যেতে হয়।
আমি একটা চেয়ারে বসলাম। ওসি নিজের চেয়ারে বসে আধ-খাওয়া টিফিন কৌটো আবার ঢাকনা বন্ধ করে রেখে দিলেন। আড়কাঠির হতভম্বভাব তখনও কাটেনি। সে দাঁড়িয়ে আছে। ওসির চোখ পড়তে আবার ধমক দিলেন, "কী হল, চা আন। আর ছোটবাবুকে একবার পাঠিয়ে দে।" এইবার আড়কাঠি চলে গেল। এইবার আমার হালকা সন্দেহ হচ্ছে। এত খাতির করছে কেন? হোয়্যাট ইজ দা বিকজ? সিনেমার পুলিশের মতন আদর করে তারপর বাটাম দেবে নাকি? বলা যায় না। পুলিশের লোকেদের বিশেষ কাজ থাকে না, সারাদিন মোবাইলে রিল দেখে। তার থেকে আইডিয়া পেতেই পারে। সিভিক বলেছিল এস-আইটা খচ্চর। হয়ত এটা এস-আইয়ের প্ল্যান। তাই এস-আইকে আসতে বলল। এখন ব্যক্তিত্ব হারালে চলবে না। যদিও পুলিশের সামনে বসে বাটাম খাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে ব্যক্তিত্ব বজায় রাখা খুব শক্ত। "ওঁরা কেমন আছেন?" ওসি জিজ্ঞাসা করলেন। আমি ন্যাকা সাজলাম। "ওঁরা মানে?"
- আরে পাত্র-পাত্রী।
- ভাল আছেন। ওনারা আসতে পারলেন না।
- আরে না না, ওঁদের আর আসতে হবে না। সব ঠিক আছে।
তারপরে গলা নাবিয়ে বললেন, "থানায় রোজ হাজিরার ব্যাপারটা ছোটবাবুর প্ল্যান। আমার ইচ্ছে ছিল না। কী হবে বলুন হ্যারাস করে? কিন্তু ছোটবাবু বললেন, যেরকম কমিইউনাল টেনশন চলছে, ব্যাপারটা একটু কন্ট্রোলে রাখা দরকার।" মিলে যাচ্ছে। সিভিক বলেছিল কাল, এস-আইটা খচ্চর। শুধু খচ্চর না, রাম-খচ্চর। আড়কাঠি দুটো চা নিয়ে এসে বলল, "ছোটবাবু নেই, বেরিয়েছেন।"
আমি চা খেতে খেতে ওসি-সাহেবকে বললাম, "আমার একটা কাজ করে দিন। তাহের বলে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলব। ব্যবস্থা করে দিন।" ওসি-সাহেব "নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই" বলতে বলতে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। দু'মিনিট বাদেই ফিরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, "আনতে পাঠিয়েছি। দশ-পনেরো মিনিটে এসে যাবে। ততক্ষণ আরেকটা চা বলি?" আমি বললাম, "দরকার নেই। আমি বাইরে আছি। তাহের এলে ফিরে আসব।"
বাইরের ঘুগনির দোকানের বেঞ্চে কালকের সিভিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আজকে সে কিছুতেই আমার থেকে সিগারেট নেবে না। শেষ পর্যন্ত ঘুগনি আর চা খাইয়ে রহস্য উদ্ধার করা গেল। আমরা চলে যাবার পরেই এস-আই আমার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে খবর লাগিয়েছে। খবর লাগিয়ে আমার বাবার নাম দেখে তার হাত-পা পেটে সিঁধিয়ে গেছে। ওসি সেই শুনে এস-আইকে উত্তম-মধ্যম ঝেড়েছে আর বলেছে গোলমাল কিছু হলে এস-আইকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ছুটিতে পাঠিয়ে দেবে। "এস-আই সেইজন্যে সকালেই বেরিয়ে গেছে। আপনাদের ফেস করবে না। সে ত আর জানে না যে আপনি একা আসবেন। জানলেও ফেস করত না।''
চা খেতে খেতে দেখলাম জিপ ঢুকল। জিপের পেছনে দুটো কনস্টেবলের সঙ্গে তাহের। তাহেরে মুখ-চোখ দেখে মনে হল অলরেডি পুলিশের কাছে ভালমতন চড়-থাপ্পড় খেয়েছে। চা শেষ করে দশ মিনিট পরে আমি আবার থানায় এলাম। তাহেরের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।
রাজ্যজয় করে অভিযানের রিপোর্ট দিতে সন্ধ্যেবেলা অরণিদের বাড়ি যেতে মাসি ঘাড়ে আবার দায়িত্ব চাপাল, "পরশু শুক্রবার। ভাল দিন। পরশু কজন আত্মীয়স্বজন আর রুকসানাদের বাড়ির কয়েকজনকে ডেকে খাওয়াব। তিরিশজন মতন লোক। তোকে খাবার আনার দায়িত্ব দিলাম। ভাল বিরিয়ানি, মাংস আর মিষ্টির ব্যবস্থা কর। কাল সাতটার মধ্যে খাবার ডেলিভারি করতে বলবি।" আমি বললাম, "আমার তিনজন গেস্ট থাকবে। তাদের একজন অরণি।"
চাকরি
আমি এখন ডালহাউসিতে একটা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্মে ঢুকছি। আমার সঙ্গে তাহের। ফার্মের মালিকের সঙ্গে দেখা করব। রিসেপশনে গিয়ে সে কথা বলতে বলল, "স্যার তো বম্বে গেছেন। মঙ্গলবার ফিরবেন।" আজ বৃহস্পতিবার। মানে পাঁচদিন পরে। আমি বললাম ফোনে তাহলে কথা বলব। কিন্তু আমার ফোন নেই। "আপনি স্যারের চেম্বারে চলে যান। আমি আপনাকে স্যারের মোবাইল নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। চেম্বারের ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করে নিন।"
আমি চেম্বারে ঢুকে ফোন লাগালাম। বাজছে।
- হ্যালো।
- জ্যাঠা, আমি গোর্কি বলছি।
- অফিসে এসেছিস?
- হ্যাঁ। এসে শুনলাম তুমি বম্বে গেছ, মঙ্গলবার ফিরবে।
- হ্যাঁ। ক্লায়েন্ট মিটিং আছে, ট্রাইবুনালে অ্যাপিয়ার্যান্স আছে।
- তুমি কি এখন মিটিঙে?
- না, মিটিং শেষ করেছি। লাঞ্চে যাব। তোর কী লাগবে বল। আমার অফিসে এসেছিস কেন?
- তোমার ক্লায়েন্টের ব্ল্যাক মানি হোয়াইট করতে পেরেছ?
- পেরেছি।
- কত?
- সে অনেক। কেন?
- তোমার পাপ হবে।
- হতে পারে। তাই জন্যে এসব ছেড়ে দেব।
- কিন্তু পাপস্খালনের জন্যে আমি আছি, গোর্কি দা গ্রেট।
- কী চাস?
- একটা ছেলেকে চাকরি দিতে হবে।
- চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট?
- না, ক্লাস এইট পাশ।
- ক্লাস এইট? তাকে আমার ফার্মে কী চাকরি দেব?
- তোমার ফার্মে বলেছি নাকি? যে ক্লায়েন্টের ব্ল্যাক মানি হোয়াইট করলে তাদের কোম্পানিতে।
- সে তো এখানে, মহারাষ্ট্রয়, পুনেতে। কলকাতায় নয়।
- আরও ভাল। কলকাতার বাইরে গিয়ে চাকরি করবে। পারবে না?
- আমি বললে করে দেবে। কিন্তু ছেলেটা কে?
- সে বড় গল্প। পরে বলব।
- বিশ্বাসী তো?
- জানি না। আমি কাল তাকে প্রথম চিনেছি।
- বলিস কী?
- আরে রিস্ক না নিলে রিটার্ন হয় না। আমি ওকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি কাল। অফিস থেকে হোটেলের ঠিকানা নিয়ে নিচ্ছি। ওর নাম তাহের। টাটা।
আমি ফোন রেখে দিলাম। তাহেরকে বললাম, "পরশু শনিবার বম্বে চলে যা। চাকরি হয়ে গেছে।" তাহের বিস্ফারিত চোখে বলল, "মুম্বাই?"
- হ্যাঁ মুম্বাই। কিন্তু চাকরি মুম্বাইতে নয়। একটু দূরে, পুনেতে। ট্রেনে যেতে হয়।
- মুম্বাই জানি তো। বলিউড আছে।
- সে আছে। কিন্তু বলিউডের চক্করে পড়লে দফারফা।
- না না। চাকরি পেয়ে গেলে ওসব করব কেন?
তারপরে ফোন করলাম তুলিকে। তুলির থেকে সায়নের ফোন নাম্বার নিয়ে সায়নকে ফোনে ধরলাম। একটু সময় দিয়ে। তুলির সায়নকে স্কুপটা দিতে যতক্ষণ সময় লাগে।
- হ্যালো।
- হ্যালো গোর্কিদা!
- তুলিকে বিয়ে করার ইচ্ছে আছে?
- হেঁ হেঁ।
- তাহলে একটা কাজ কর।
- কী কাজ? তুমি এস না, একসঙ্গে লাঞ্চ করব। তুমি তো ডালহৌসিতেই।
- তেল দিস না। তেল দিয়ে লাভ হবে না। আমার কাজটা করে দে।
- কাজটা কী?
- তোদের ট্রাভেল ডেস্কের কোটা থেকে আমার এক বন্ধুর জন্যে কাল বম্বে যাবার একটা ট্রেনের টিকিট বের করে দে।
- সে কী করে হবে! আজকাল অফিসের কেউ আর ট্রেনে যায় নাকি যে কোটা থাকবে? প্লেনে হলে চেষ্টা করতে পারি।
- ট্রেনেই লাগবে। ট্র্যাভেল ডেস্কের কন্ট্যাক্ট লাগা। ওদের সব জায়গায় লাইন থাকে।
- দেখছি।
- দেখছি-ফেকছি নয়। করে দে। তাহলে লাঞ্চ খাওয়াবার একটা সুযোগ দিতে পারি কয়েকদিনের মধ্যে।
- টিকিট পেলে কোথায় তোমায় যোগাযোগ করব?
- টিকিটটা জ্যাঠাদের বাড়িতে পৌঁছে দিস, আমি তুলে নেব।
- ঠিক আছে।
- এটা করতে না পারলে তুলির সঙ্গে বিয়ের কথা ভুলে যা।
- হেঁ, হেঁ।
আমি তাহেরকে বললাম, "কী হচ্ছে বুঝতে পারছিস?" তাহের লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। আমি বললাম, "ভাবিস না তোর জন্যে করছি। আমি করছি রুকসানার জন্যে। রুকসানার জন্যেও ঠিক নয়, আমার বন্ধু অরণির ভাবির জন্যে, বুঝলি। তোকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছি যাতে মাথা বিগড়োলেও গোলমাল না করতে পারিস। কারণ গোলমাল করলে তোকে লম্বা সময়ের জন্যে জেলে ঢুকিয়ে দিতে হবে। আমার ক্ষমতা দেখেছিস তো।" তাহের প্রায় আমার পা ধরতে যায় - "না, দাদা। আর হবে না। আমি শুধু রোয়াব দেখাতে ওসব করেছি। নইলে আমি কী আর বুঝি না যে আমাদের কিছু হয় না। ওরা কত ল্যাখাপড়া জানা ফেমিলি। আমি এইট পাশ, আমার আব্বা ভ্যানরিক্সা চালাত। তোমাকে বলছি দাদা, আমি রাস্তায় ছোটখাটো ছিনতাইও করেছি। কিন্তু আল্লার নামে বলছি, আর হবে না।"
- ছিনতাইয়ের কথা তো কালকেই বলেছিস। আর যা করেছিস আমাকে বলতে হবে না।
- না দাদা, আর কিছু করিনি। চাকরিটা যদি লেগে যায়, দেখে নিও তাহের একদম লাইনে চলে আসবে।
- ঠিক আছে। এবার তাহলে দুটো কাজ কর।
- বল দাদা।
- আমি এখন বিরিয়ানির অর্ডার দিতে যাব। তুই আমার সঙ্গে যাবি। কাল বিকেলে ছটার মধ্যে ওই দোকান থেকে খাবার তুলে আমার বন্ধু অরণিদের বাড়িতে পৌঁছে দিবি। পারবি না?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ। পারব। ঠিকানা দিয়ে দিও।
- সকালে আমার বাড়ি আসবি। দুটো ঠিকানা দিয়ে দেব, প্রথমে একটা ঠিকানায় গিয়ে তোর ট্রেনের টিকিট নিবি। তারপর খাবার তুলে দু নম্বর ঠিকানায় পৌঁছে দিবি।
- দাদা একটা কথা বলি? বিরিয়ানি কোথা থেকে কিনবেন?
- কেন? আরসালান ভাবছিলাম।
- আরসালান ভাল বিরিয়ানি করে না। ফাঁকিবাজির বিরিয়ানি। আমার চেনা একজন কারিগর আছে, আমাদের ওদিকেই -
- বারাসাতে?
- কাছেই। সেখান থেকে বিরিয়ানি নিন। ওরকম বিরিয়ানি আর কোথাও পাবেন না। আরসালান কাছে আসে না।
- বলছিস?
- পাক্কা দাদা।
- ঠিক আছে, চল। দেখে আসি তোর পাক্কা বিরিয়ানি কীরকম।
- পাক্কা নয়, কাচ্চি বিরিয়ানি।
জ্যোৎস্না
আজ পূর্ণিমা। এখন রাত দেড়টা। অরণিদের বাড়ির ছাতে বসে আছি। সন্ধ্যেবেলা অনিমেষদার সঙ্গে রুকসানার বিয়ের ভোজ সমাপ্ত হয়েছে। অভ্যাগতরা চলে গেছে। মাসি বলেছে আজ নাকি অনিমেষদা-রুকসানার ফুলশয্যা। অরণির আশ্রম আজ বন্ধ ছিল। কাল সকাল সাতটায় আবার খুলবে। ছাতে আমি আমার বাকি দুই গেস্টকে নিয়ে বসে আছি - বাবুলাল আর তাহের। বাবুলাল আজ সন্ধ্যেয় 'যিসকি বিবি পাতলি' বাজিয়েছে। তাহেরের আবির্ভাবটা একটু গোলমেলে আড়ষ্ট হয়েছিল। কিন্তু শেষ অব্দি অনিমেষদা আর রুকসানার বাবার কাছে নিজের মতন করে ক্ষমা-টমা চেয়ে নিজেই ম্যানেজ করেছে। তাহেরের রেকমেন্ডেশনে কাচ্চি বিরিয়ানি, চিকেন চাঁপ আর ফির্নি একেবারে সুপার হিট। আমি কিছু খাইনি। নিজের ছাত্রীকে প্রেম-করে-বিয়ে করার অপরাধে, আর নিজের থেকে দশ-বারো বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে অনিমেষদার বাড়িতে তিনমাস জলস্পর্শ করব না জানিয়ে দিয়েছি। কিছু খাইনি বলে মাথাটা একটু ঘুরছে।
চতুর্দিক অন্ধকার। আকাশের পূর্ণিমা আর অনিমেষদা-রুকসানার ফুলশয্যাকে অভিবাদন জানাতে ইলেট্রিসিটি বোর্ডের বাবুরা রাস্তার সব আলো নিভিয়ে রেখেছেন। পূর্ণিমায় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। তাহের ছাতের আলসের গায়ে ঠেসান দিয়ে বসে আছে। বাবুলালের এক পায়ে একটা ঘুঙুর বাঁধা। আমি বাবুলালকে বললাম, "বাবুলাল, বাঁশি বাজা।" বাবুলাল আকাশের দিকে চেয়ে বলল, "অনেক তারা!" পায়ের ঘুঙুরের তালে গেয়ে উঠল, "সোনার গৌর ক্যানে কেঁদে এল ও নরহরি"। দু-লাইন গেয়ে আড়বাঁশি তুলে নিল বাবুলাল। ওই সুরটাই বাজাতে শুরু করল। সুরটা আমি চিনি। আগে শুনেছি। কিন্তু অন্য কথায়। মনে করতে পারছি না।
আমি পথে নেবে এলাম। আমি অরণিদের বাড়ি থেকে দূরে যাচ্ছি, কিন্তু আলোও কমছে না, বাঁশির সুরও ফিকে হচ্ছে না। আমি এবার অন্য গানটা চিনতে পেরেছি। বাবুলালের বাঁশির সুর এখন জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশে চরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে -
কে তোরা খুঁজিস তারে কাঙাল-বেশে দ্বারে দ্বারে,
দেখা মেলে না মেলে না,--
ও তোরা আয় রে ধেয়ে দেখ্ রে চেয়ে আমার বুকে --
ওরে দেখ্ রে আমার দুই নয়ানে॥