• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • নাতাশা স্পিকিং : লুনা রাহনুমা

    মিসেস মজুমদার না ছাই, অমন মহিলার নামের আগে মিসেস বললে মানায় না। সংক্ষেপে অনেকে এম,এম বলে ডাকে। কিন্তু আমার মুখে ওসব ডাক আসতে চায় না। ভদ্রমহিলাকে দেখলে আমার বরং আরেকটা শব্দ মনে হয়, মাতারি। এর জন্য যুৎসই একটা কারণও আছে অবশ্য। এত বছর ধরে লন্ডন শহরে আছে, অথচ এখনো দেখলে মনে হয় সবাইকে ভেল্কি দেখিয়ে সদ্যই যাত্রাবাড়ীর যাত্রাপালার দল থেকে পালিয়ে এসেছে।

    বলছি আমাদের নিউহ্যাম কাউন্সিলের আরেক প্রতিবেশী নুরুল মজুমদার ভাইয়ের স্ত্রী স্বর্ণা ভাবির কথা। আমাদের এই তল্লাটে অনেকগুলো বাঙালি পরিবার আছে। আমরা এসেছি পাঁচ বছর আগে। আমরা আসার অনেক আগে থেকেই স্বর্ণা ভাবিরা এখানে আছে। প্রথমে কাউন্সিলের বাড়িতে ছিল। অনেক বছর একটানা থেকে যাওয়ায় বাড়িটি তারা কিনে নিয়েছে রাইট টু বাই নিয়মে মার্কেট রেটের চেয়ে অনেকটা কম দামে। স্বর্ণা ভাবির মেয়ে ও আমার মেয়ে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ার কারণে তাদের দুজনের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। আমার মেয়ে রুবানার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী স্বর্ণা ভাবির মেয়ে সুস্মিতা। ক্লাসের পড়া ছাড়াও স্কুল হলিডেতে সময় কাটানোর জন্য আমাদের মেয়েরা মাঝেমাঝে কয়েক ঘন্টার জন্য একে অন্যের বাড়িতে চলে যায়। সেই সুবাদে সুস্মিতা আসে আমার বাসায়। মেয়েটিকে দেখে ওর মায়ের সাথে মেলাতে কষ্ট হয়। একেবারেই মায়ের মতো হয়নি। না রূপে, না গুণে। সুস্মিতার শরীরের গঠন মারাত্মক আকর্ষণীয়, গায়ের রং প্রায় এখানকার সাদাদের মতোই বলা যায়, ধবধবে ফর্সা মুখের উপর আমাদের এশিয়ান কুচকুচে কালো চুলে মেয়েটা দেখতে হাতে বানানো পুতুলের মতো। এমন সুন্দর মেয়ে এখানে আমাদের বাঙালি পরিবারে আর কারো নেই। রূপের সাথে সাথে মেয়েটির গুণের কথাও বললে এত্ত লম্বা লিস্ট হয়ে যাবে। সুস্মিতাকে দেখলে প্রতিবার আমি রুবানার দিকে নতুন করে তাকাই। নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে না চাইলেও আমার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আমার মতো মায়ের পেট থেকে এমন মেয়ে, আর স্বর্ণা ভাবির মতো শাকচুন্নির পেট থেকে অমন রত্ন ধপাস করে পয়দা হয় কেমন করে, আমার মাথায় আসে না।

    গতসপ্তাহে একদিন স্বর্ণা ভাবি আমার বাড়ির দরজায় নক করেছিল। আমাদের বাড়ি আসতে তাদের অন্তত চল্লিশ মিনিট সময় লাগে, গাড়িতে। স্বর্ণা ভাবি দেখতে যেমন কুরূপা, কাজে-কর্মেও তেমনি খুব পেছানো। দেশ থেকে আসার এক বছরের মাথায় আমি ড্রাইভিং পাশ করে ফেলেছি, অথচ উনি এত বছরেও গাড়িটা চালানো শিখতে পারলেন না। ফলাফল, মজুমদার ভাই না থাকলে তার ভরসা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, অর্থাৎ সেই বাস অথবা আন্ডারগ্রাউন্ড রেল। সেদিনও হয়তো তেমনি একটাতে করে বাদুড়ঝোলা হয়ে এসেছে আমার বাড়িতে, মেয়েকে নিয়ে যেতে। এমনিতে সুস্মিতাকে আমি নিজেই নামিয়ে দিয়ে আসি, কিন্তু আমার অফিসের একটা জরুরি মিটিং পড়ে যাওয়ায় সেদিন ভাবিকে আসতে হয়েছিল মেয়েকে নিয়ে যেতে। লাঞ্চ-ব্রেকে কিছুক্ষণ কথা বললাম তার সঙ্গে। আমরা ওয়ার্কিংক্লাস অফিস উইমেন, স্বর্ণা ভাবির মতো হাউজ ওয়াইফদের সঙ্গে কথা বলে তেমন আরাম পাই না, তবুও বাড়ি চলে আসা একজন মানুষের সাথে একটু অন্তত সৌজন্য আলাপ না করলে ব্যাপারটা খুব খারাপ দেখায় বলেই নিতান্ত অনিচ্ছায় আন্তরিক হবার ভান করতে হয় মাঝেমধ্যে।

    এত সাদাসিধে মানুষ স্বর্ণা ভাবি, একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বললেই কিছু উত্তর করতে পারে না আর। ওই যে, আমি যখন বললাম, ‘ভাবি সুস্মিতাকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না আপনি ওর মা, এত সুন্দর আর এত মেধাবী হয়েছে আপনার মেয়েটি মাশাল্লাহ।’ স্বর্ণা ভাবি তখন কিছুতেই কথাটি নিজের গায়ে নেওয়ার কথা ভাবল না। বরং মেয়ের প্রশংসা শুনে কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়তে চাইছিল যেন, কালো দুই গালের উপর ঈষৎ লালচে রং ফুটে উঠতে দেখা গেছে সহসা। ভীষণ আনন্দিত কণ্ঠে বলেছে, ‘আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন ভাবি, মেয়েটি দেখতে ওর বাবার মতো হয়েছে, আমি চাই মানুষ হিসেবেও যেন সে ওর বাবার মতো ভালো ব্যবহার ও সুন্দর মনের মানুষ হয়।’

    এমন একটি কথার পরে, শুধু আমার মুখে কেন, তল্লাটের কারোর মুখেই দ্বিতীয় কথা আসার কথা নয়। স্বর্ণা ভাবির স্বামী, আবার সুন্দর মনের মানুষ? পেহ! হতে পারে পরিবারে স্ত্রী, পুত্র, কন্যার কাছে লোকটা একজন ভালো মানুষ। কিন্তু সংসারের বাইরে, এই সমাজে তার ভীষণ বদনাম। জম্মের-কিপ্টা একটা লোক। শীতের দিন বরফ পড়ুক আর একটানা বৃষ্টি নামুক, পকেটের একটি পাউন্ড বাঁচাতে কিছুতেই বান্দা বাসে চড়বে না। নিজের গাড়ি আছে, তবু বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সেই গাড়ি চালাতে দেখা যায় না তাকে। বাংলা গ্রোসারি শপের সমস্ত দোকানদারেরা মজুমদার ভাইকে দেখলে না দেখার ভান করে। আধা কেজি বিফ আর এক কেজি চিকেনের বেশি কিচ্ছু কখনো কেনে না যে কাস্টমার, তার পেছনে সময় নষ্ট করতে যাবে কোন দোকানদার? তারা পরিচিত মানুষদের বাড়ি থেকে পুরোনো আসবাবগুলো দরদাম করে কিনে নিয়ে ব্যবহার করে। সারা বাড়ি পইপই করে খুঁজলেও একটা নতুন তৈজস অথবা দোকান থেকে কিনে আনা ফার্নিচারের দেখা মিলবে না কোথাও। শুনেছি সেইসব ভাঙা-চোরা আসবাবগুলোকেই স্বর্ণা ভাবি প্রতিদিন খুব যত্ন করে শুকনো কাপড় দিয়ে মোছে। এই দেশে কি আর বাংলাদেশের মতো ধুলো ওড়ে বাতাসে, যে ফার্নিচার হলুদ করে ধুলার গুঁড়ো জমে থাকবে? তবুও সেই যে, বুয়ার স্বভাব, এখনো রয়ে গেছে ভেতরে, ধোয়া মোছা আর পরিষ্কার থাকার বাতিক।

    মেয়েকে নিয়ে যাবার আগে স্বর্ণা ভাবি আমার সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলে। সবটাই আমার অফিস, কলিগ ও কাজ নিয়ে। নিজে জীবনে চাকরিবাকরি না করলেও, অন্যের চাকরির গল্প শুনতে খুব পছন্দ করে। তার কাছে তাই আমার অফিসের গল্প করতে বেশ ভালোই লাগে।

    ‘ভাবি আপনি বাড়ি থেকে অফিস করেন? একদিনও অফিসে যেতে হয় না?’ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে স্বর্ণা ভাবি।

    ‘আমাদের মনে হয় আর কখনোই অফিসে যেতে হবে না। বাড়িতে অফিস সেট করা হয়েছে, এটাকে বলে ওয়ার্কিং-ফ্রম-হোম।’

    ‘সুস্মিতার বাবাকে পাঁচ দিনই অফিসে যেতে হয়। ইঞ্জিনিয়াররা সবাই ওয়ার্কিং ফ্রম হোম, অথচ ওর দায়িত্ব ফিল্ডে মেশিনপত্র চেক করা, তাই ওর আর বাড়ি বসে অফিস করার আরাম হয় না।’ পরিষ্কার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বর্ণা ভাবি।

    ‘তবু ভালো, ভাবি। মজুমদার ভাই কত চমৎকার একটা চাকরি করছেন। আমাদের বাঙালিদের ভেতর ভাইয়ের মতো হাইলি পেইড চাকরি আর কে করছে দেখান দেখি।’ অকপটে মনের কথাটি বলে ফেলি আমি।

    আমার স্বতঃস্ফূর্ত এই কথাতেও আস্বস্ত হন না তিনি। একটু আমতা আমতা করেন। মিনমিনে সুরে স্বর্ণা ভাবি বলেন, ‘তবু ভাবি, জানেন তো, এই দেশে একজনের ইনকামে সংসার চালানো খুব কঠিন। যা খরচ প্রতি মাসে!’

    এবার আমি মনে মনে সতর্ক বোধ করি। এইবার বোধহয় আমার কাছে সে চাকরি চাইবে। চাকরিহীন মানুষদেরকে নিয়ে এই এক বিপদ। আকারে ইঙ্গিতে খালি কাজ খুঁজে দিতে বলে। কিন্তু সে সুযোগ দেওয়ার মতো মোটেই বোকা পাত্রী আমি নই। দ্রুত কথার মোড় ঘুরাই অন্যদিকে।

    ‘ভাবি, কিছু মনে করবেন না। আমার লাঞ্চ টাইম পার হয়ে যাচ্ছে। আমাকে ল্যাপটপে লগইন করতে হবে এখনই। আরেকদিন কথা হবে আপনার সঙ্গে।’

    পাছে সত্যি আমার অফিসের কাজে মহা কোনো ঝামেলা হয়ে যায়, এই ভয়ে আমার চেয়েও বেশি ব্যস্তভাবে স্বর্ণা ভাবি মেয়েকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। তাদের মা মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমার একটু মায়া হয়েছিল সেদিন। অনেকক্ষণ ধরে আমি ভাবছিলাম, মানুষ এমন খ্যাত আর মূর্খ হয় কেমন করে? মজুমদার ভাইয়ের মতো রাজকুমার চেহারার একজন অত্যন্ত দামি ইঞ্জিনিয়ার এমন একটা শ্রীহীন ভগ্নদশা স্ত্রীর সাথে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, অথচ ভদ্রলোক কোনোদিন কারো কাছে এই চরম স্ত্রী-দুর্ভাগ্য নিয়ে একটুও আক্ষেপ প্রকাশ করেনি। স্ত্রীর নামে একটি নালিশ পর্যন্ত করে না। একটিও খারাপ কথা বলে না। কী অদ্ভুত! স্ত্রীকে নিশ্চয়ই সে সীমাহীন করুণা করে একটি অসহায় মেয়েলোক বলে! বিষয়টি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবনা চিন্তা করার পর এই ব্যাপারে আমার মনে বিশেষ কোনো সন্দেহ থাকেনি আর।

    রাতে শোবার আগে আমি আমার বরের গায়ের উপর একটা পা তুলে দিয়েছি খুব স্বাচ্ছন্দ্যে। বললাম, ‘দেখো না ডান পায়ের গোড়ালিতে খুব ব্যথা করছে আজ, একটু টিপে দাও প্লিজ।’

    আমার বর যথারীতি নিজের স্বভাব মতো আমার পায়ের নিচ থেকে নিজের শরীরের অর্ধাংশ সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘নিজের পা নিজে টিপো। আমাকে ঘুমাতে দাও।’

    অন্যদিন কিছু না বললেও আজ লাম (?? মানে?) পাল্টা কথা বললাম। খাটে শুয়ে পরপুরুষ মজুমদার ভাইয়ের প্রসঙ্গ তুলে আনলাম নির্দ্বিধায়। শোবার ঘরের বন্ধ দরজা খুলে লাম দেদারসে চোখ বুলালাম স্বর্ণা ভাবির অন্দরমহলের সর্বত্র।

    ‘আমার পায়ের গোড়ালিটা একটু দেবে দিতে তোমার হাতে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে আর মজুমদার ভাইকে দেখো, স্ত্রীকে কেমন মাথায় করে রেখেছেন। উনাকে দেখেও তো একটু শিখতে পারো কিছু, নাকি?’

    আমার বর ঠোঁট ভেংচিয়ে এরপর যে কথা বলল, সে কথা স্বামী-স্ত্রীতে আলোচনা করা গেলেও, পাঠককে তা বলা যায় না কিছুতেই। আমি তবু নিচুস্বরে যুক্তিহীন তর্ক করার চেষ্টা করলাম আমার বরের সঙ্গে।

    ‘হুম তোমাকে বলেছে, উনাদের তিনটি বাচ্চা কি আকাশ থেকে পড়েছে?’

    ‘হুম, আকাশ থেকে না পড়লেও বাচ্চা হওয়ার জন্য আসমান জমিন ভেঙে ঝড় নামার দরকার হয় না। নাও এখন পায়ের ব্যথা আর বুকের ব্যথা দুটোই ভুলে ঘুমানোর চেষ্টা করো। কাল ভোর ছয়টায় আমাকে ফিল্ডে যেতে হবে।’

    কথা শেষ করে আমার বর পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তৎক্ষণাৎ। কিন্তু আমার ঘুম আসে না। স্বর্ণা ভাবির এলেবেলে মুখের উঁচু দাঁতগুলোর কথা মনে পড়ে। নিয়মিত পান খাওয়ায় দাঁতে লালচে দাগ পড়েছে। হাসলে খুব বাজে দেখায়। এমনিতে মহিলা অতিরিক্ত হাসিখুশি মানুষ না হলেও মুখে একটা হালকা হাসি লেগে থাকে সারাক্ষণ। ভীষণ মার্জিত এবং পরিচ্ছন্ন স্মিত হাসি বলে যাকে। মজুমদার ভাই মানুষটা কথাবার্তায় বেশ দিল দরাজ হলেও খরচের বেলায় ভীষণ কৃপণ স্বভাবের। আবার, কৃপণতার কারণে প্রতিদিন পুরোনো রং জ্বলে যাওয়া একই গেঞ্জি আর ঢোলা প্যান্ট পরলেও, স্বভাবে হাসিখুশি ভাবের কারণে মুখটা সদা উজ্জ্বল থাকে। ঠিক দুই ধরনের দুটি মানুষ তারা দুজন, তবুও মনে হয় তাদের দাম্পত্য জীবনটা বেশ সুখের। বাচ্চা তিনটিকে দেখলে ‘হ্যাপি ফেইস’ মনে হয়। খেয়ে না খেয়ে বড় হওয়া তিনটি ছেলেমেয়েরই লেখাপড়ায় দারুণ মাথা। আর অংকে ডাব্বা মারা আমার মাথামোটা বাচ্চা দুটি? থাক ওদের কথা। এরপর আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

    সপ্তাহ দুয়েক পর, একটা উইকেন্ডে জারা ভাবির বাড়িতে গার্ডেন পার্টি ছিল। চার বেডরুমের বাড়ির পেছনে বেশ বড় একটা খোলা বাগান আছে তাদের। প্রতিবছর সামারে চমৎকার পার্টির আয়োজন হয় সেখানে। বলা যায় লন্ডনে বাঙালিদের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি এটাই। পরিচিত বাঙালিদের সবাই নিমন্ত্রিত হয় এই পার্টিতে। ডেকোরেটর থেকে রান্না করিয়ে এনে বাগানে খাওয়া, পান করা, গান করা, গেমস, ছেলে-মেয়েদের জন্য কুইজ, বারবিকিউ চিকেন আর কাবাব, রেফেল ড্র, ম্যাজিক শো, এমন আরো অনেক ধরনের হইচই আনন্দের সমারোহ থাকে এই পার্টিতে। জারা ভাবির গার্ডেনে সেদিনও আবার দেখা হলো মজুমদার ভাই ও স্বর্ণা ভাবির সঙ্গে। সেই তেল চুবচুবে মাথার চুলগুলো টেনে খোঁপা করা। পুরোনো একটা কামিজ, ক্ষয়ে যাওয়া পাম সু, হাতে চিকন দুটি সোনার বালা। আদ্যিকালের মা-খালাদের কথা মনে করিয়ে দিল স্বর্ণা ভাবি প্রতিবারের মতো। সুস্মিতাকে দেখে আমার মেয়ে খুশিতে নেচে ওঠে, সঙ্গেসঙ্গেই দুজন বাগানের একপাশে গিয়ে বসে গল্প করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। আমিও সৌজন্য সাক্ষাৎটুকু সেরে দ্রুত সটকে পড়ি আমার বান্ধবীদের দলে।

    হাসি আনন্দের কলকলে সময়টা খুব ভালো কেটেছে সেদিন। পার্টিতে বরাবরের মতো সেদিনও স্বর্ণা ভাবিকে নিয়ে আমরা বান্ধবীরা ভীষণ ঠাট্টা মস্করা করেছি। তার পোশাক, ব্যাকডেটেড কথাবার্তা, খাওয়ার সময় রোবটের মতো শক্ত হাতে চামচ ধরা, কারো হাতে এলকোহলের গ্লাস দেখলেই আঁতকে ওঠা, বেহায়ার মতো মুগ্ধ চোখে অন্যদের দিকে তাকিয়ে থাকা, এমন সবকিছুই আমাদের খুব আমোদ দিল। আমরা আড়ালে ইঙ্গিতে রয়ে সয়ে এসব মজা করলেও, পার্টির অনেকে স্বর্ণা ভাবির সামনেই বিভিন্ন আপত্তিকর কথা বলত। কিন্তু এমন মানুষ সে, যেন লোকের তিরস্কারের কিছুই গায়ে মাখে না। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি চোখে দেখেও সেই দৃষ্টির অর্থ বোঝে না প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাটি। আধুনিক এই যুগে জন্মেও কেমন ধারার মহিলা সে, আমি বুঝি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, নিজেকে হয়তো সে পোকামাকড়ের চেয়েও নগণ্য বলেই মেনে নিয়েছে, তাই জগৎসুদ্ধ সবার কটু কথাতেও কিচ্ছু গায়ে মাখে না। বরং যেন সে ধরেই নিয়েছে এসব কথা, এসব আচরণ, এমন কটাক্ষ— এ সকলই তার যোগ্য প্রাপ্য, এই পৃথিবীতে।

    এরপর বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি স্বর্ণা ভাবির সঙ্গে। আমরা অনেকগুলো বাঙালি পার্টিতে গিয়েছি। কিন্তু মজুমদার পরিবার সেখানে নিমন্ত্রিত হলেও, উপস্থিত হয়নি কোথাও। বান্ধবীদের একজন বলল, ‘দাওয়াতে যেতেও খরচা আছে বুঝলি, একটা কিছু উপহার নিতে হয় তো।’ আমার কাছেও ব্যাপারটা তাই মনে হলো। স্বর্ণা ভাবির সাথে আমাদের বান্ধবীদের কারোর সখ্যতা না থাকলেও আমরা চাইতাম প্রতিটি পার্টিতে তারা আসুক। আমরা তাকে নিয়ে টিকাটিপ্পনি কেটে যে নির্মল আনন্দ পেতাম, সেটি থেকে আমাদের বঞ্চিত করছে বলে তার অনুপস্থিতি সবসময় আমাদের হতাশ করত।

    একদিন রুবানা স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে টিভি দেখছিল। আমি পাশে বসে স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করছিলাম, সাথে সুস্মিতার কথা জানতে চাইলাম।

    ‘সুস্মিতারা এখান থেকে চলে যাচ্ছে, মা। হঠাৎ করে আমার মেয়ে সংবাদটি দিল।’

    রুবানার কথায় আমি চমকে গেলাম। বেশ আশ্চর্য লাগল কথাটি চিন্তা করে। অনেক বছর ধরে হাড়ভাঙা কষ্ট করেছে মজুমদার ভাই আর ভাবি। মাত্র দুইবছর আগে কাউন্সিলের কাছ থেকে তারা বাড়িটি কিনেছে। তিনটি ছেলে-মেয়ের স্কুল কলেজ এখানে। মজুমদার ভাইয়ের এমন চমৎকার চাকরি। সবকিছু এত সুন্দর করে গুছিয়ে নেয়ার পর এখন সবকিছু ফেলে রেখে কোথায় চলে যাবে তারা?

    ‘কেন? কোথায় যাচ্ছে জানিস?’ প্রশ্ন করলাম মেয়েকে।

    ‘সুস্মিতা বলেছে সুইজারল্যান্ডে যাবে। সামনের সেপ্টেম্বরে। মজুমদার আংকেল যাবার জন্য জেদ করছেন, কিন্তু আন্টি নাকি রাজি হচ্ছে না কিছুতেই। তাই এখনো কিছু ফাইনাল হয়নি।’

    এবার মনে মনে হাসি পেল আমার। স্বর্ণা ভাবি পরিচিত গণ্ডির বাইরে যেতে রাজি হবে না, সেই তো স্বাভাবিক কথা। নতুন দেশ মানে আবার নিজেকে নতুন করে এডাপ্ট করা। সে কাজ কঠিন দুরূহ তার জন্য, আমি জানি। তাছাড়া ইংল্যান্ড আর সুইজারল্যান্ডের মানুষের কথার একসেন্ট আলাদা, তাদের কথা বুঝতেই স্বর্ণা ভাবির কয়েক বছর লেগে যাবে। রুবানার জন্য একটু মন খারাপ হলো যদিও। কারণ সত্যি যদি সুস্মিতারা চলে যায় লন্ডন থেকে, তাহলে আমার মেয়েটা খুব কষ্ট পাবে। আফটার অল, কাছের বান্ধবী ওর ওই একজনই যে।

    অফিসের কাজে পরের কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। রুবানার সাথেও আলাদা করে প্রয়োজনের বেশি কথা হয়নি। আসলে সমস্ত দিন এতটাই ঝড়ের মধ্য দিয়ে যায় যে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কখন রাত হয়ে যায়, টেরই পাই না। একটি উইকেন্ডে কয়েকজন বন্ধুকে দাওয়াত করেছি, সন্ধ্যায় বন্ধুরা অতিথি হয়ে আসবে। সেই উপলক্ষ্যে দুপুরে খুব রান্নার তোড়জোড় চলছিল বাড়িতে। বলাকওয়া ছাড়াই ঘরের দরজায় নক করেছেন মজুমদার ভাই। আমার ছেলে এসে জানালো আংকেল আমার সাথে কথা বলতে চান। রান্নার চুলা বন্ধ করে আমি ড্রয়িংরুমে গেলাম কথা বলতে। মজুমদার ভাই, বরাবরের মতোই রং জ্বলে যাওয়া একটা বহুব্যবহৃত টি-শার্ট আর একটা বেখাপ্পা ট্রাউজার পরে এসেছেন। পায়ের জুতোর রং একপাশে জ্বলে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। সবকিছুই আগের মতো শুধু একটা নতুন ব্যাপার লক্ষ করলাম, সেটি হচ্ছে তার চোখে মুখে একটা দিশেহারা ভাব যুক্ত হয়েছে। আমাকে দেখে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আমি বসার পর আবার ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন।

    ‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো ভাই?’ আমি জানতে চাইলাম।

    ‘সব ঠিক আছে ভাবি। আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’ কাঁচুমাচু মুখে বলেন মজুমদার ভাই।

    ‘স্বর্ণা ভাবি কোথায়? ভাবি, বাচ্চারা সবাই ভালো আছে?’

    ‘ওকে নিয়েই একটা কথা বলতে এসেছি আপনার কাছে।’

    এরপর মজুমদার ভাই অনেকটা সময় নেন। হয়তো বুঝে উঠতে পারছেন না কেমন করে কথা শুরু করবেন। খুব অসহায় দেখায় ভদ্রলোকের মুখটি আমার সামনে। আমি অপেক্ষা করি। স্বর্ণা ভাবিকে নিয়ে কী কথা বলার জন্য এসেছেন মজুমদার ভাই আমি তা চিন্তা করতে চেষ্টা করছি। মনে মনে আশা করছি, আমাদের বন্ধুমহলের জন্য বাক্যে একটা কিছু দারুণ আলাপের গল্প পাওয়া যাবে নিশ্চিত। অনেকদিন হলো, বাঙালি কমিউনিটির কারো গোপন সংবাদ আমাদের কানে আসেনি। মাথা নিচু করে একটু নিচু গলায় কথা আরম্ভ করলেন তিনি।

    ‘আপনি আর ভাই অনেকদিন থেকে দেখছেন আমাদের, চেনেন, জানেন। প্রয়োজনে, বিপদে আপদে নিঃশর্তে আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। আমি আসলে আজ একটা আবদার নিয়ে এসেছি আপনার কাছে ভাবি। আপনার সাহায্য প্রয়োজন খুব।’

    ‘এত ইতস্তত করছেন কেন? বলুন না, আমি কী করতে পারি?’

    ‘আপনি স্বর্ণাকে একটু বোঝান প্লিজ। স্বর্ণা যেন স্কলারশিপের অফারটা গ্রহণ করে। এত বড় একটা অপরচুনিটি, কয়জনের ভাগ্যে মেলে বলুন!’

    আমি ভদ্রলোকের কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না। স্বর্ণা ভাবি আর স্কলারশিপ এই শব্দ দুটো এক সাথে যায় না। আমরা সবাই স্বর্ণা ভাবিকে মোটামুটি প্রাইমারি পাশ বলেই ধরে নিয়েছিলাম। তারচেয়ে বেশি হলে টেনেটুনে মেট্রিক পাশ হতে পারে। তাই বলে স্কলারশিপ? ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ না তো আবার? হঠাৎ করে আমার মনে হলো আমরা কেউই আসলে স্বর্ণা ভাবি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না। তার সামনে আমরা সবাই নিজেকেই জাহির করতে সদা ব্যস্ত ছিলাম যে।

    ‘স্বর্ণা ভাবি স্কলারশিপ পেয়েছেন? কীসের জন্য?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

    ‘ওহ, আপনাকেও কিছু বলেনি তাহলে? আমি ভেবেছিলাম আপনি ওর এত প্রিয় মানুষ, আপনার কাছে ঘটনাটি জানিয়েছে অন্তত। আসলে স্বর্ণার একাডেমিক পেপারস দিয়ে আমিই ওর নামে একটা স্কলারশিপের এপ্লিকেশন করেছিলাম। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যাবার পর আমার কথা রাখতেই স্বর্ণা ইউনিভার্সিটির রিসার্চ এলিজিবিলিটি টেস্ট দিতে রাজি হয়েছিল। তখন ভাবেনি সেই টেস্টে কোয়ালিফাই করে যাবে আর স্কলারশিপের ইন্টারভিউতেও পাশ করে যাবে। সুইজারল্যান্ডের এথ জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় ওকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএচইডি করতে সম্পূর্ণ স্কলারশিপ দিতে রাজি হয়েছে। সমস্ত কাগজপত্র তৈরি, কিন্তু স্বর্ণা গোঁ ধরেছে। কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছে না। ভাবি আপনি যদি স্বর্ণার সাথে একটুখানি কথা বলে ওকে সুইজারল্যান্ডে যেতে রাজি করাতে পারতেন, তাহলে আমার খুব উপকার হয়। চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।’

    মজুমদার ভাইয়ের কথা শুনে উত্তর দিব আর কী, আমি অবাক বিস্ময়ে জমে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছি। কথা বলতে গিয়ে শক্তি পাচ্ছি না যেন মুখে।

    ‘স্বর্ণা ভাবি ফিজিক্স-এ লেখাপড়া করেছেন, বলেননি তো কোনোদিন। বিড়বিড় করে বললাম, কোথায় লেখাপড়া করেছেন?’

    ‘ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ে। ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল ওদের ব্যাচে। অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছিল স্বর্ণা। আমার সাথে বিয়ে হয়েই ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল একেবারে। এ কারণে আমার খুব অপরাধবোধ হয়, সবসময়।’ কথা শেষ করে মাথা নিচু করে বসে থাকেন মজুমদার ভাই। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল বলে মনে হলো আমার কাছে।

    ‘আপনার অপরাধবোধ হবার কিছু নেই ভাই। অনেক মেয়েরাই বিয়ের পর নিজের স্বপ্নের কথা ভুলে যায়। একজনকে তো সংসারের হাল ধরতে হবে। ঘরের কাজ, বাচ্চা লালনপালন করা এগুলোও তো কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়, তাই না?’ আমি বললাম।

    ‘সে কথা আমি জানি, ভাবি। কিন্তু নিজের কাছে খুব গিল্টি ফিলিংস হয়, বুঝলেন। ক্যারিয়ার তৈরি করার যোগ্যতা আমার চেয়ে বরং ওরই বেশি ছিল, কিন্তু আমার কথা চিন্তা করে স্বর্ণা এতগুলো বছর এত বড় স্যাক্রিফাইস করে এসেছে। এখন যেহেতু সময় ও সুযোগ দুটোই একসাথে হাতে পেয়েছি, আমি চাই ও এটাকে ব্যবহার করুক।’

    ‘কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি মজুমদার ভাই? আপনাদের কি লাভ ম্যারেজ ছিল?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

    ‘এটাকে ঠিক লাভ ম্যারেজ বলা যায় না, ভাবি। আসলে ভার্সিটিতে স্বর্ণা আমার চেয়ে দুই ইয়ার নিচে ছিল। কিন্তু প্রতিবছর ওর রেকর্ড গড়া রেজাল্টের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার আলোচনার মধ্যমণি হয়ে থাকত। বরাবর আমি মেধাবী মানুষের প্রতি আকর্ষণবোধ করি। স্বর্ণার মেধা এবং বিনয় আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল ওর প্রতি। বলতে পারেন একতরফা প্রেম ছিল আমার দিক থেকেই। অনেক পটিয়ে আমি ওকে বিয়ে করতে রাজি করিয়ে ছিলাম।’

    ‘স্বর্ণা ভাবি দেশে থাকতে চাকরি করতেন কোথাও?’ আবার প্রশ্ন করলাম আমি। আমি যেন আজ স্বর্ণা ভাবিকে জানার এবং চেনার চেষ্টা করে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছি নিজের বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে।

    ‘না, সে সুযোগ আর পেয়েছে কই। মাস্টার্স ফাইনাল দেওয়ার পরপরই আমার সাথে লন্ডনে চলে আসলো। তখন থেকেই তো আমাদের প্ল্যানে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। বিয়ের আগে স্বর্ণা আমার কাছে একটাই আবদার করেছিল, বলতে পারেন বিয়েতে রাজি হবার একমাত্র শর্ত দিয়েছিল, বিয়ের পর সে ডক্টরেট করতে চায়। নিজের নামের পাশে ডক্টর শব্দটি লাগানো ওর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল, সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে।’

    ‘এই দেশে তো যেকোনো বয়সেই লেখাপড়া আরম্ভ করা যায়। কত রকমের সুযোগ সুবিধাও আছে সবার জন্য।’

    ‘তা আছে, কিন্তু একটা অর্থনৈতিক সাপোর্ট না থাকলে, আমাদের মতো নিম্ন মধবিত্তের জন্য কয়েক বছর ধরে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এখানে আসার পর, আমরা এমন অর্থকষ্টে পড়ে গেলাম চোখে শুধু সর্ষে ফুলের মতো হলুদ দেখতাম চারদিক।’

    ‘হলুদ আমার প্রিয় রঙ,’ কথাটি আমার মুখ ফস্কে প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল, ভাগ্যিস সময় মতো মুখে খিল দিতে পেরেছি, আমার উসখুস করতে থাকা মুখ ও মন নিয়ে কত যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে আমাকে, কতদিন!

    ‘আমরা দুজনেই ফার্স্টফুড শপে কাজ করেছি তখন, দিন রাতের আলাদা শিফ্টে। এরপর, আমাদের সংসারে পরপর তিনটি বাচ্চা এলো, ওদের তিনজনকে দেখাশোনা করা, গ্রামের বাড়িতে আমার বাবাকে নিয়মিত টাকা পাঠানো, মাথার উপর ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব, সব কিছু মিলে মাথা খারাপের মতো অবস্থা হলো আমার। স্বর্ণাকে দিয়ে রাখা প্রতিশ্রুতির পিএইচডি পড়া আর ওর চাকরিবাকরির সমস্ত চিন্তা আমার মাথা থেকে কোথায় যে উড়ে চলে গেল, বলতেও পারব না।’

    ‘তবু তো আপনাদের একজন এই দেশে নিজের একটা ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পেরেছেন, ভাই। বিদেশের মাটিতে আমাদের দেশের মানুষের জন্য কাজটি খুব সহজ নয়,’ মজুমদার ভাইয়ের কাছে একটি সত্যি কথা বললাম, মাঝে মাঝে আমি দার্শনিকের মতো বেশ ভালো ভালো কথা বলে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই।

    ‘হয়তো আপনার কথা ঠিক ভাবি, কিন্তু স্বর্ণার দিকটাও তো ভুলে গেলে চলবে না। যদিও সেসময় স্বর্ণা নিজেই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল, নিজের ইচ্ছায় নিজেকে ঘরের কাজে নিয়োজিত করে আমাকে সে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে।’

    আমি চুপ করে থাকি। কয়েক সেকেন্ডের মতো বিরতি নিয়ে মজুমদার ভাই আবার বলেন,

    ‘একটা কথা না বললেও সত্যি, আমি নিজেও তখন স্বার্থপরের মতো এটাকেই স্বাভাবিক বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন আমার খুব অনুশোচনা হয়। ওর মুখের দিকে তাকালে নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। নিজেকে আমার খুব লোভী ও স্বার্থপর মনে হয়।’

    নিজেদের একান্ত গোপন কিছু কথা বলতে বলতে মজুমদার ভাই যেন হাঁপিয়ে গিয়েছেন। কথা বন্ধ করে বুক ভরে বায়ু টানলেন। আগে কখনো শুনিনি, কিন্তু এইমুহূর্তে আমার মনে হলো লোকটির মনে হয় শ্বাসকষ্টও আছে। অপেক্ষা করছিলাম পকেট থেকে ইনহেলার বের করে ব্যবহার করবে কিনা। তেমন কিছু ঘটল না অবশ্য, শুধু বেশ অনেকক্ষণ ফ্লোরের কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল গভীর চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে। অবশেষে নীরবতা ভেঙে আমিই কথা আরম্ভ করলাম।

    ‘ভাই, আপনারা সবদিক গুছিয়ে ফেলেছেন। এখন স্বর্ণা ভাবির নতুন করে লেখাপড়া শুরু করতে অসুবিধা কোথায়? উনি কি এত বছর পর লেখাপড়া আরম্ভ করতে ভয় পাচ্ছেন?’

    ‘তা তো একটু ভয় আছেই। কিন্তু ওর যা ডিটার্মিনেশন, আমি জানি ও ঠিক ধরে ফেলতে পারবে আমার বিশ্বাস আছে। সমস্যাটি আসলে অন্যখানে। স্বর্ণা এখন বলছে সে লন্ডন ছেড়ে কোথাও যাবে না কারণ এখান থেকে মুভ করলে ওর ছেলে মেয়েদের জীবন নাকি এলোমেলো হয়ে যাবে। সংসারের চিন্তা করে সে নিজের জীবনের একমাত্র স্বপ্নটিকে জলাঞ্জলি দিতে চায়। বলেন দেখি ভাবি, এমন পাগলামি করার কোনো মানে আছে? এত বড় একটা সুযোগ যখন তার জীবনে এসেছে তখন সেটাকে গ্রহণ না করা কত বোকামি হবে!’

    ‘একদম না। সত্যিই তো, এত ভালো একটা সংবাদ, স্বর্ণা ভাবির উচিত অফারটা একসেপ্ট করা। ভাবিকে কি একা থাকতে হবে ওখানে?’

    ‘না। সুইজারল্যান্ডে আমরা সবাই যাবো। ওখানে বাচ্চাদের স্কুল, আমার একটা নতুন চাকরি, আর স্বর্ণার ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া ও গবেষণা শুরু করা সহ সব পরিকল্পনা করা হয়ে গেছে। ওর স্কলারশিপের সাথে আমাদের ফ্রি থাকার জন্য একটা বাড়ির ব্যবস্থাও করা হবে। এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও সে যেতে রাজি হচ্ছে না। ভাবি, স্বর্ণা আপনার কথা খুব মানে। আপনি কি ওকে একবার বুঝিয়ে বলবেন? মাত্র তো পাঁচটি বছর। তারপর আবার আমরা লন্ডনে ফিরে আসব।’

    মজুমদার ভাইয়ের কথার উত্তর আর কী দিব, নিজের বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা চাপা কষ্ট টের পাচ্ছি আমি। এতদিন যাকে নিয়ে এত হাসি, ঠাট্টা, তামাশা, তিরস্কার করেছি, যার মূর্খতা অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাই ছিল আমাদের আড্ডার প্রধান রসদ, সেই স্বর্ণা ভাবি যাচ্ছে বিশ্বের সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করতে, আর আমরা মহিলারা এখানে বসে কিটি পার্টি করব, আর অন্যদেরকে নিয়ে মুখরোচক ব্যঙ্গ রসিকতায় পার করতে থাকব আমাদের মূল্যবান জীবন! ওহ, শেষদৃশ্যে এসে গুরুর চপেটাঘাত বুঝি একেই বলে। আমার চিন্তাশক্তি ক্ষয় হতে থাকে ভীষণ দ্রুততালে।

    মজুমদার ভাইকে বললাম, ‘জি নিশ্চয়ই। অবশ্যই আমি স্বর্ণা ভাবির সাথে কথা বলব। ওনাকে অবশ্যই এই স্কলারশিপটা গ্রহণ করতে হবে। লন্ডনে বাঙালি মহিলাদের ভেতর স্বর্ণা ভাবি আমাদের সবার জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের অনেকের আদর্শ তিনি। উনাকে অবশ্যই এই ডিগ্রীটা অর্জন করে আমাদের সম্মান বাড়াতে হবে। আপনি একদম চিন্তা করবেন না, ভাই। ভাবিকে আমি ঠিক রাজি করিয়ে ছাড়ব, দেখবেন।’

    আমার কথায় আস্বস্ত হয়ে মজুমদার ভাই বাড়ি চলে গেছেন। সোফায় হেলান দিয়ে আমি চোখ বুঁজে পড়েছিলাম কতক্ষণ, বলতে পারব না। বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে রাখা বন্ধু-বান্ধব-কাম-অতিথিদের জন্য রান্না করার কথা আমার মনে এলেও দৌড়ে রান্নাঘরে যাবার তাড়া অনুভব করছি না আর ভেতর থেকে। নিজেকে কেমন নির্বোধ ও অপদার্থ বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। কোলের কাছে এলিয়ে থাকা আমার প্রিয় বার্গেন্ডির ঝলমলে দীঘল কেশরাশিকে সাপের মতো ঘিনঘিনে লাগছে। এর আগে কখনো নিজেকে এভাবে এতটা মূল্যহীন, শুকনো পাটকাঠির মতো পলকা অনুভূত হয়নি। নিরর্থক আকাশপাতাল ভাবতে লাগলাম, কিংবা কিছুই ভাবছি না, কেবল শূন্য মস্তিষ্কে বসে রইলাম নিথর হয়ে, আরো কয়েক মিনিট। একসময় মনে হলো কোথাও থেকে যান্ত্রিক শব্দ আসছে। আচ্ছন্নের মতো আমার কানের কাছে ক্রমাগত বিপ-বিপ-বিপ করে বাজছে আমার অফিসের কল, কাস্টমার সার্ভিসের বিরক্তিকর সেই একঘেয়ে টেলিফোন রিং। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিস আওয়ারে যার জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হয় ঠিক সেই জমিদার বাড়ির পিঠ টান করা দারোয়ানের মতো। বহুদিনের অভ্যাসবশে, মাথার ভেতরে ফোন বাজার শব্দে ছটফট করে উঠলাম, টেলিফোন রিসিভ করে অবচেতন মনেই বললাম, ‘হ্যালো চিপ ফ্লাইট ট্রাভেল এজেন্সি, নাতাশা স্পিকিং, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?’



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments