পূজোর দিনগুলোতে আমাদের শহর ছিল পৃথিবীর সেরা। নরম রোদ্দুরে সেঁকা রাজধানীর রাস্তাঘাটে ভিড় হত না। ডিটিসির বাসে চেপে গড়গড় করে আমরা পার্কটাউন বা কাশ্মীরী গেটে গিয়ে অঞ্জলি দিয়ে আসতাম। ফুল-বেলপাতার গন্ধের মধ্যে যখন প্রসাদ বিতরণ হত তখন স্কুলের নিজস্ব চেনাজানা আর সহপাঠীদের দল খুঁজে নিয়ে পম্পা মুখার্জি আর আমি পরস্পরকে দূর থেকে দেখতাম। টোটোদার সঙ্গে কলেজ স্টুডেন্টদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার সালক্তকা বান্ধবী সুতির শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ পরে যখন তখন হেসে গড়িয়ে পড়ত। স্যাণ্ডেলের ফাঁক দিয়ে তার রক্তের চেয়ে লাল পা দেখে ফেলার পর কথার খেই হারিয়ে জটলার সবচেয়ে নালায়েক সদস্যের মতো আমি আনতাবড়ি ফোড়ন কেটে ঝাড় খেতাম।
- কী করে এটা সম্ভব যে একটা ময়ূর আর একটা প্যাঁচা এত কাছে থাকা সত্ত্বেও ইঁদুরটা পালিয়ে যাচ্ছে না?
- বকরা, তোর পিঠে একটা হাতি চেপে বসলে তুই পালাতে পারতিস?
প্রথম ব্যাচে ভোগ সংগ্রহ করে আমাদের বন্ধুরা একটা কাঠের টেবিল দেখে বসে পড়ত। চাটনি মাখা ঘ্যাঁট দিয়ে খিচুড়ি ধ্বংসের পর গপগপিয়ে পায়েস খাওয়া হয়ে গেলে আমি আর পম্পা আলাদাভাবে সবার অলক্ষ্যে সরে পড়তাম। মল রোড থেকে তাড়াতাড়ি কোনো বাস ধরে আমরা চলে যেতাম করোল বাগ কিম্বা কনট প্লেসের বাজারে। সেখানে দশহরার ঝলমলে রোদে উদ্ধত সুটিং শার্টিং আর ড্রেস মেটিরিয়ালের মডেলের মতো রোদচশমায় টানটান হয়ে ফুটপাথের ধুলোর সেলাম কুড়িয়ে নিতাম আমরা। বিশেষ করে ছোট দোকানগুলো আমাদের পছন্দ ছিল, কারণ দেয়াল থেকে ঝোলানো অসংখ্য এটা-সেটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করার সময়ে বিনা পয়সায় মিউজিয়ম দেখা হচ্ছে বলে দুজন দুজনের দিকে ফিরে ফিক ফিক করে হাসা যেত। দোকানদাররা আমাদের মন পাওয়ার জন্য মরীয়া হয়ে উঠলে আমি পম্পার দিকে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে তাকাতাম। সুযোগ বুঝে দোকানদার তড়িঘড়ি যোগ করত – সস্তা ভী হ্যায় ম্যাডম্। আর আমার বান্ধবী তার একটু উপর দিকে ঘোরানো নাক কুঁচকে মধুর হাসির সঙ্গে বলত – সস্তা মুঝে বিলকুল পসন্দ্ নহীঁ।
শিবাজী মার্গের অর্জুন গাছগুলোর ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে গোলমার্কেট ছাড়াবার পর ভাই বীর সিং রোডের দোকান থেকে এক ঠোঙা গরম জিলিপি কিনে আমরা পৌঁছে যেতাম বিড়লা মন্দিরের চত্বরে। মন্দিরে ওঠার সিঁড়িকে দূর থেকেই নমস্কার জানিয়ে তারপর রামনবমীর মেলার রং-বেরংয়ের পুঁতির মতো মানুষগুলোকে কমলা আলোর বন্যায় মুগ্ধ চোখে দেখব বলে দুজনে ঘুরতাম, আর সেই সঙ্গে আঙুলের ডগায় সাবধানে ধরা জিলিপিও কয়েকটা খাওয়া হয়ে যেত। কখনো পথ আটকে দিত সাপ কিম্বা বাঁদরের নাচ। বা মালকোঁচা মারা শাড়ি আর সাদা লুঙ্গি পরা প্রৌঢ় কোনো দম্পতি মোটা কাঁচের ছানিকাটা চশমার ভিতর দিয়ে আমাদের ভালো করে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন – হাউ টু গো টু ডি-টি-ই-এ-এস অন রীডিং রোড? আমি আর পম্পা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম আর আমার বান্ধবী ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করত – স্যর, ক্যান ইউ টেল আস দ্য ফুল নেম অফ দ্য প্লেস? তখন মালকোঁচা মারা শাড়ি বলতেন – ট্যামিল স্কুল অফ রীডিং রোড। আমার মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে যেত যে আমাদের জন্মের অনেক আগে রীডিং রোড হয়ে গেছে মন্দির মার্গ, আর তামিল অ্যাসোসিয়েশানের স্কুল তো কাছেই। – আই বিলীভ উই আর স্ট্যান্ডিং অন দ্যাট রোড অ্যাণ্ড দ্য স্কুল ইজ় বিহাইণ্ড ইউ। জানাতাম আমি। বান্ধবী আমাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখিয়ে দিত যে অভিশপ্ত আত্মা না, আসলে একটা মানুষই রয়েছে তার পাশে, এবং বলত – ওয়েলকাম টু আওয়ার হিস্টরিক সিটি। উড ইউ লাইক টু হ্যাভ এ ওয়ার্ম জলেবী?
প্রৌঢ়দের রওনা করে (??করিয়ে) দিয়ে যখন আমরা কালিবাড়ির চত্বরে এসে উপস্থিত হতাম তখন প্রথম গেটের সামনে বিরাট অশ্বত্থ গাছটার নিচে ঘোড়ার মল-মূত্র আর কালো চানার সুগন্ধ নিয়ে টাঙ্গার স্ট্যাণ্ড আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য প্রস্তুত থাকত। লোকজনের আনাগোনা কমে গেছে। পম্পা নাকে একটা কাপড় দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেত দূরের গেটে যেখান থেকে শুরু হয়ে রবীন্দ্র রঙ্গশালা মার্গ পর্যন্ত রিজের জঙ্গল আর নাম-না-জানা ফুলের রাজত্ব। পূজোপ্যাণ্ডেলে প্রবেশ করে আমরা প্রতিমা আর বইয়ের স্টলগুলো ঘুরে দেখতাম। মন্দিরের কলে জিলিপির রস মাখা আঙুলগুলো ধোওয়ার সময় জোর করে কেউ আমাদের হাতে এক দোনা প্রসাদ বা একটা মোতিচূরের লাড্ডু ধরিয়ে দিত। ঈশানতোষ হলের বাইরে রাখা বাংলা খবরের কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেবার পর আরো একবার চাতাল প্রদক্ষিণ করতাম দুজন। তারপর পম্পা সবার অলক্ষ্যে নতুন চুড়িতে অলঙ্কৃত হাত দিয়ে আমার কবজি ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করত – আর ইউ অফরেইড? আর আমি বলতাম – জাস্ট এ লিট্ল্। দুপুরের ভোগের শেষ ব্যাচ উঠে যাওয়ার পর তখন এক এক করে নারী-পুরুষ ও শিশুরা প্রাঙ্গণ থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে। কেউ মারছে হাইয়ের উপর তুড়ি, কেউ থেমেছে গেটের নিচের পানের দোকানে। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো এক এক করে চলে যাওয়ায় রীডিং রোডের চওড়া নির্জন বুক আবার শহরটাকে ব্রিটিশ যুগে ফিরিয়ে নিতে চাইছিল। প্যাণ্ডেল আর লাইব্রেরির মাঝখানে ঝুলে থাকা একটুকরো আকাশ পেরিয়ে যাওয়ার পথে পাখিরা শব্দ না করার জন্য ডানা মুড়ে ফেলছে। স্বচ্ছ বাদাম তেলের মতো মসৃণ আলোয় কালিবাড়ি মার্গ ধরে আমরা গোল ডাকখানায় চলে আসি। - আর এক পা হাঁটতে পারছি না, জয়। এই আমি বসে পড়লাম, বলে শাসাতে থাকে গুলাবো-জান। কোথাও কোনো রিকশার চিহ্ন নেই। তবে এরকম দিনে বান্ধবীর নালিশ ফুরোবার আগে পথ ফুরিয়ে যায়।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে এবার যক্ষিণীর মূর্তিটাকে আরো বড়ো মনে হচ্ছিল। সামনের বাসস্টপের রেলিংয়ের উপর পা ঝুলিয়ে বসে পম্পা বলল – তুই যেতে চাইলে যা, আমি এখানেই থাকব।
– কতক্ষণ?
– যতক্ষণ না ওই যক্ষটাকে তুই আর টোটো সরিয়ে ফেলছিস ততক্ষণ তো বটেই। বেশিও হতে পারে। কী ঠিক করলি বল।
আমার গার্লফ্রেণ্ড নিউ দিল্লীর রাস্তায় ঘুরতে ভালোবাসত। আজ রাস্তাটাকে সে এমনভাবে দেখছিল যেন এই শেষ দেখা।
- আগেই তো বলেছি, তুমি যা চাও। তুমি চাইলেই ‘হ্যাঁ’।
- সেটা হচ্ছে না। নিজের থেকে, নিজের জন্য চাইতে হবে। নইলে তোর মায়ের কাছে কী মুখ থাকবে আমার?
বান্ধবী রেগে যাবে জেনেও আমার মুখে মুখে তর্ক করার স্বভাব যায় না। বললাম - কেউ কী করে জানবে আমি কার জন্য ‘হ্যাঁ’ বলছি? একটা অমীমাংস্য ব্যাপার। আনপ্রুভেবল্ হাইপথেসিস।
- তোর চোখ দেখে বোঝা যায় তুই মিথ্যে বলছিস না সত্যি।
- যা বোঝার বোঝো। কিন্তু তোমরা কীভাবে এত সহজে একটা আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করো সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। লোকটা যা বলে তার অর্ধেক বানিয়ে বলে।
- এটা গল্প নয়, সত্যি। তুই নিজেও তার প্রমাণ দেখেছিস।
- আমি যা দেখেছি তার কোনো মানে হয় না। হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট মীনিংলেস। এক বর্ণও সত্যি সেটা তুমি জানলে কী করে? ঠাকুরের গাইডেন্স?
পম্পা মুখার্জির কনুইয়ের সঙ্গে আমার কনুই ঠেকে যাচ্ছিল। সে রেগে গিয়ে রেলিং থেকে নেমে বিবেকানন্দের মতো বগলের নিচে হাত লুকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমিও লাফিয়ে নামি এবং আমাদের পায়ে হেঁটে শহর মাপার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছিল।
কনট প্লেস থেকে তখন ফেরার বাস ধরতে যেতাম আমরা। আমার বান্ধবী বলত – দেখ, আজ রাতে একটা নতুন স্যাটিনের লহঙ্গা পরব। দেখলে মাথা ঘুরে যায়। পার্ক টাউনে আসছিস তো? হোল-নাইট সিনেমার প্রোগ্রাম। মহিলারা সব এক সঙ্গে বসবে, অনেক গল্প হবে। তোকে আমি টেনে নেব সেই দলে। স্টলের অসাধারণ ঘুগনি। গোটা প্যাণ্ডেলে তার সুগন্ধ পাবি। আমি বলতাম - হোল নাইট জাগতে পারব না। সকালে আবার শিমলিপুরের পূজোবাড়িতে কী সব বয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। পম্পা বলত – তিনটের সময়ে বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়িস। বাবা-মা আগেই ফিরে যায়। না রে, এক ঘরে শোওয়া হবে না তোর। আমি পাহারা দেব বাইরের ঘরে। তুই আমার বেডরুমটা পাবি। তাও তো কী কাছে, বল? মাঝখানে মাত্র এক ইঁটের দেয়াল। আমি মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলতাম – আগুন আর ঘি। এ জিনিস খেলার নয়। রাত্রিবেলা যদি আমাদের খাট দুটো চুম্বকের মতো একটা আরেকটাকে টানতে থাকে, আর দরজার ছিটকিনিটা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে সড়াৎ করে নেমে যায়? পম্পা হা হা করে হাসত। – আমাকে এত ভয় পাস তুই? কী ছেলে রে বাবা! তখন আমি বলতে বাধ্য হতাম – যাই ঘটুক না কেন, কে আমাকে বিশ্বাস করবে? গুলাবো থেমে গিয়ে বলত – কে তোকে বিশ্বাস করবে জানিস? তোর মা আর তোর মামিমা। কিছু হলে তারা বলবেন আমি তোকে জাদু করে হীরে থেকে কয়লা বানিয়েছিলাম।
বাসে ওঠার আগে আমরা আইসক্রীম কিনতাম। সীটে বসে আমার বান্ধবী বলত – আই ক্যান সী দ্য ইনসাইড অফ এ ক্যারেক্টার। আমি একটা মানুষের ভিতরটা দেখি। তুই দেখিস বাইরেটা।
- তুমি রঙ্গার ক্যারেক্টারের ভিতরে ঢুকে বুঝতে পেরেছিলে সে তোমায় কিছুক্ষণ বাদেই চুষতে শুরু করবে?
রেগেমেগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিত আমার গুস্সেওয়ালি গার্লফ্রেণ্ড। চুপ করে বসে একসঙ্গে আইসক্রীম খাওয়ার সময়ে আমি জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে হাওয়ায় চুলের সুগন্ধ আরেকটু বেশি করে পাওয়ার জন্য সন্তর্পণে তার দিকে সরতাম। এক সময়ে সেটা টের পেয়ে গিয়ে চট করে একটা সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে তাকাত আমার সঙ্গিনী। তারপর কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে উদাসভাবে বলত – আমি রঙ্গার নয়, ডক্টর বাজাজের কথা বলছি।
না বোঝার ভান করি। আসলে আমি জানতাম।
আমাদের বাস বারাখাম্বা রোড, মডার্ন স্কুল, মন্ডী হাউস, আইটিও হয়ে লালকেল্লার দিকে এগোত। শরতের দুপুরে এই শহরে কোনো কাজ করা সম্ভব নয় বলে তখন কলম নামিয়ে রেখে কেরানিরা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়, ইলেক্ট্রিশিয়ানরা দাঁতে টেস্টার চেপে স্ত্রীট লাইটের পোল বেয়ে নেমে আসছে, ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামার ছাত্র-ছাত্রীরা পরস্পরকে না চেনার কপটভানে কেউ ইণ্ডিয়া গেট আর কেউ প্রগতি ময়দানের দিকে হাঁটা দিয়েছে, টুরিস্টরা তাদের সারাজীবনের অন্বেষণ সাঙ্গ করে এই ধুলোতেই মিলিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় কালোজাম গাছের নিচে চটি পেতে বসে পড়ছে। গুলাবো আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলত – গুরু গোবিন্দ্ সিংয়ের মতো সাহসী চাইলে তুইও হতে পারিস, জয়।
আমি লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার মতো বাসটাকে আরো খানিকটা এগিয়ে যেতে দিতাম। আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আমার বান্ধবী হঠাৎ একটা নতুন আশার উদ্দীপনায় ছটফটিয়ে উঠে বলত – আর এর বদলে যেটা তুই চাস সেটা যদি পেয়ে যাস, তাহলে? কথাটা বলে ফেলার পর সে অসম্ভব সরলতায় দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে হাসতে থাকত যেন এরকম নির্লজ্জ আচরণ পৃথিবীতে এই প্রথম কোনো মেয়েকে করতে হল। আমি তখন গুলাবোর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলতাম – আমি কী চাই জানো তুমি? সোডার বুদবুদের মতো বেরিয়ে আসা বিস্ফোরক হাসির ভলি এসে ঝাঁকাত আমার তন্বী বান্ধবীকে। সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে সে বলত – হ্যাঁ, জানি। আমি যেন সেটাকেই মেনে নিয়েছি এমনভাবে চুপ করে বসে থাকতাম। সে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমার দিকে একবার অপাঙ্গে দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলত – আমার স্কিন। অল অফ ইট! নো?
পরে লালকেল্লার সামনে রামলীলা গ্রাউণ্ডের ভিড় সামলাতে গিয়ে আমাদের বাসটা ক্লান্ত হয়ে পড়ত। গুলাবো আর আমি রাত জাগতে হবে বলে চোখ বুজে ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম। ভাঙা রাস্তার ঝাঁকুনি আর বাস আড্ডার কোলাহলে যখন তন্দ্রাঘুম, লজ্জাঘুম, তীব্রঘুম, স্বপ্নঘুম, শঙ্খঘুম, আর ঘন্টাঘুম পেরিয়ে ধাক্কাঘুমে প্রায় পৌঁছে গিয়েছি তখন খেয়াল হত – কোথায় আমরা? বাস কবে কিংসওয়ে ক্যাম্প থেকে ঘুরে পার্কটাউনের রাস্তায় এসে পড়েছে। - ওঠো, ওঠো! স্টপ মিস্ হয়ে যাবে। সঙ্গিনীর হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে নামাই তাকে। - এই কী করছিস, বদমাইশ? লোকজন দেখে কী ভাববে? আমি থামি না। – যা ভাবে ভাবুক। বাড়ি যেতে হবে না? – এত টানা-হেঁচড়ার কী দরকার ছিল? আগে জাগাতে পারলি না? আমার সোলটাই বাসে রয়ে গেছে। - থাকুক সোল বাসে। তোমার মা তোমার আত্মার ফ্যান হয়ে বসে নেই। বডিটা তাঁর জিম্মায় করে দিয়ে তবে আমার ছুটি। রাত এখানে কাটাতে চাইলে আমাকেও তো বাড়িতে একটা খবর দিয়ে আসতে হয়। পরে আমার বান্ধবী মাথা ভর্তি চুল ঝাঁকিয়ে বলে - ছি, ছি। একটা সামান্য বডি বের করে আনার জন্য এত গর্ব করছিস? করবি না কেন? তোর সমস্ত লোভ যে বডির উপর। পারভার্টেড ক্রীপ!
আমি গুলাবোকে তাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়ে বললাম – তোমাকে একটা গল্প শোনাতে চাই। আমাকে গুরু গোবিন্দ্ সিং বানাবার আগে সেটা শুনে নিও।
- নতুন লিখলি? কী নাম?
- নাম হল ‘আওয়ার স্কিন’। আমাদের ত্বক। তোমার প্রিয় টপিক। কিন্তু আমি লিখিনি। আমার জন্মের অনেক আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। এই গল্পটা শোনার জন্য ডক্টর বাজাজ আমার পা ধরতে রাজি হয়ে যাবেন।
- উঃ। মনে হচ্ছে থ্রিলিং। সিনেমা-টিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পর শোনা যাক তাহলে? দুজনে পাশাপাশি, হালকা কম্বলের তলায়?
পম্পাদের পূজোর ব্যবস্থা শিমলিপুরের চেয়ে ভালো। ভিড় অপেক্ষাকৃত কম। চেয়ার বেশি। শিমলিপুরে গেলে আমাদের মাটিতে পাতা দরির উপর বসতে হত। এখানে প্রোগ্রাম শুরু হবার অনেক আগে না গিয়েও মহিলাদের ব্লকে চেয়ারে জায়গা পেয়ে গেলাম। পম্পার একদিকে আমি, আর একদিকে মাসিমা। মেসোমশাই ঘুগনির স্টলে ক্যাশ বাক্সের ভার নিতে চলে গেছেন।
সুচিত্রা-উত্তমের ছবি। আমার চারদিকে তার মুগ্ধ দর্শক। এক-একটা রীল শেষ হলে কেউ সেটাকে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে ভরে শিমলিপুরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেখানে একই সিনেমা দেখানো হয় আধঘন্টার গ্যাপ দিয়ে। পম্পা গদ্গদিয়ে উঠে বলে – বাঙালিদের মধ্যে উত্তমের মতো ছেলে আর পাওয়া যায় না! মাসিমাও গাল ভরা হাসি হাসছিলেন। আমি বললাম – আমার বড়োমামার মতো গায়ের জোর কোনো অভিনেতারই নেই। তিনিও ফিল্মে চান্স পেয়েছিলেন। কিন্তু অত পাউডার লিপ্স্টিক মাখতে রাজি হননি বলে ডাইরেক্টারের সাথে ঝগড়া হয়ে যায়। হয়তো উত্তমকুমার অভিনয়ে একটু এগিয়ে, কিন্তু বড়োমামার মুখশ্রী ঢের বেশি রোমান্টিক। দেরাদুনে চলুন, দেখিয়ে আনব।
চারপাশের মহিলাদের ব্যূহ থেকে যা-তা রকমের মন্তব্য ভেসে আসতে শুরু করে। – কোত্থেকে এসেছে এই ভুঁইফোঁড়? – ওভারস্মার্টটাকে কান ধরে বার করো। পিছন থেকে কেউ বলল – আরেকবার বললে গরম সাঁড়াশি দিয়ে জিভ ছিঁড়ে নেওয়া হবে।
পম্পা আমার কনুই খামচে ধরেছিল। – মুখ ঢাক নির্বোধ, নইলে তোর জন্য আমরা মুখ দেখাতে পারব না।
টোটোদার দেওয়া জিমখানা লেখা টুপির ভাইজ়ার নামিয়ে নটা-বারোটার শো শেষ করলাম। তারপর প্যাণ্ডেলে আলো জ্বলার আগেই টুপিটা সরিয়ে ফেলি যাতে টুপিওয়ালা বলে আমাকে কেউ চিনতে না পারে।
বিরতিতে জানা যায় পরের শো’য়ের রীল এখনো মিন্টো রোডে চলছে। বেলুন নিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা খেলতে শুরু করল দরির উপর। বড়োদের কেউ কেউ উঠে যাচ্ছে। মাসিমা হাই তুলতে লাগলেন। ওঁদের হয়ে গেছে। - বাড়ি যাবে, মা? পম্পা জিজ্ঞেস করে। - তোর বাবা থাকে থাকুক, আমরা যাই চল। কিন্তু মেসোমশাইও স্টল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। আধখানা চাঁদের নিচে কুকুরের ঘেউ ঘেউ উপেক্ষা করে আমরা চারজন শরতের ঠাণ্ডা হাওয়া উপভোগ করতে করতে বাড়ির দিকে চলে আসি। পার্কটাউনে আমার প্রথম রাত্রিযাপন। পম্পা কানের কাছে বলে – মা চাইছে আমি বেডরুমেই শুই। তোকে বাইরের ঘরে বিছানা করে দিলে মাইণ্ড করবি?
মাইণ্ড হী নহীঁ তো কেয়া মাইণ্ড করনা? বললাম – বিছানাটা মাইণ্ড করবে কিনা জিজ্ঞেস করো। রাত্রে আমার গা থেকে নতুন শিকারের খোঁজে ছারপোকা আর উকুন বেরিয়ে আসে।
- জয়, এই পোকাদুটোর নাম তুই মায়ের সামনে ঠাট্টা হিসেবেও উচ্চারণ করিস না। ম্যাসিভ প্রবলেম হয়ে যাবে।
- এবার গল্পটা বল। ভূত আছে কি?
- না। তবে একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে।
- ভূতে আপত্তি নেই। তবে অন্ধকার যেন না থাকে। অন্ধকারের গল্প পড়তে আমার ভীষণ অসুবিধে হয়। দম আটকে আসে।
আমরা বাইরের ঘরে জানালার পাশে দুটো আদা চা নিয়ে বসে অত্যন্ত মৃদু গলায় বিড়বিড় করছি। ঘরের আলো নেভানো হলেও রাস্তা থেকে চন্দ্রালোকের সঙ্গে বড়ো রাস্তার স্তিমিত ল্যাম্পপোস্টের শুঁড়ের মতো রশ্মি অনেকগুলো বাঁক ঘুরে আমাদের সঙ্গ দিতে এসেছে। প্রায় নির্লিকার পানীয়টা আমি বানিয়েছিলাম। - কোন দিশি চা এটা? না দুধ না চিনি। এক চিমটে চায়ের পাতা। এক কুচি আদা। আমি আমার চায়ের স্বপক্ষে(??সপক্ষে) বলি - মিডনাইট টি। বডিকে ঘুম পাড়িয়ে স্বপ্নগুলো জাগায়। আমাদের ছোটবেলা দেওয়া হত।
বান্ধবী তার বেতের আরামচেয়ারে পিছিয়ে যাবার পর কাপে চুমুক দিয়ে শুরু করেছি। - অনেক দিন আগে শিমলিপুরের পুরোনো ক্যান্টনমেন্টে একটা ছোট জেনারেল হসপিটাল ছিল। বালকবাবা হাসপাতালটা তখনো তৈরি হয়নি। এক ইংরেজ লাশকাটা সার্জেন সেই হাসপাতালের প্রধান হয়ে এসেছিলেন। আধপাগল এবং খিটখিটে এই বুড়োর নাম হামফ্রি চিল্কট। চিল্কটের বেশির ভাগ পেশেন্ট ছিল দিশি, এবং তিনি শিমলিপুরের ইংলিশ জানা ভারতীয়দের যে কয়েকজনের সঙ্গে ভাব করেছিলেন তাদের অন্যতম হলেন আমার দাদু। উদ্বাস্তু ডাক্তার গুলজ়ারীলাল বাজাজও পরে এই দলটায় যোগ দেন। তবে চিল্কটের জীবনে একটা রহস্য ছিল যা আমি আগে জানতাম না, তাই তোমাকেও বলা হয়নি। সেটা চার্চিলের যুগ। সে সব দিনে ব্রিটিশরা যে কজন ভারতের মাটিতে পা রেখেছিল, মাউন্টব্যাটেন বাদে তাদের কেউ নেটিভদের সঙ্গে ওঠাবসা করত না। তখনকার দিল্লীতে চিল্কটই বোধহয় একমাত্র ইংরেজ যিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। তাঁকে কোনো কারণে সাহেবদের সমাজ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে। চিল্কট বিকেম অ্যান আউটকাস্ট। দ্য কোয়েস্চন ইজ় হোয়াই।
- জয়, দাঁড়া। হোয়াই আসছে পরে। আগে বল তুই এসব জানলি কী করে? তোর মামা বলেছেন?
- মামাবাড়ির কেউ চিল্কট নামটাও জানে কিনা সন্দেহ।
- তার মানে ডক্টর বাজাজ?
- তুমি হয়তো অবাক হবে শুনে, কিন্তু আমার ধারণা যে বাজাজও এই ঘটনাগুলো জানেন না।
- তাহলে গল্পটা কি তোর মাথায় আকাশ থেকে ঝরে পড়ল?
- সেরকমই ধরে নিয়ে পুরোটা শুনতে ক্ষতি কী?
পম্পা খানিকক্ষণ তার কুর্সীর গদিতে এপাশ ওপাশ করার পর চাদরের ভিতর নিজেকে আরো ভালো করে মুড়ে নিয়ে বলল – আচ্ছা, বল। কিন্তু আমি জানি তুই কিছু লুকোচ্ছিস এবং এর মধ্যে একটা কিছু জোচ্চুরি আছে।
জোচ্চুরি ছিল আমার তকদীরে। যা নিয়ে আমি বান্ধবীকে ভাবাতে চাইনি। তাই তাকে একটু গুঁইগাঁই করার অবসর দিয়ে আবার বলতে শুরু করি।
- হামফ্রি উইলিয়াম চিল্কট কবে ভারতে পদার্পণ করেন আমি জানতে পারিনি। তবে ১৯৩৬ সালে অল ইণ্ডিয়া রেডিও স্থাপিত হয়। এর বছরখানেকের মধ্যেই আমার দাদু দিল্লীতে চলে এসেছিলেন। চিল্কট আসেন তার অনেক আগে। তুমি হয়তো জানো, উনিশশো আঠেরো সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একটা মহামারী দেখা গিয়েছিল। একটা নতুন টাইপের ভাইরাল জ্বর, যার নাম দেওয়া হয় স্প্যানিশ ফ্লু। ওই মহামারীর সময়েও চিল্কট ভারতে। হয়তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত ভারতীয় আর্মি যখন ইওরোপ থেকে ফিরছিল তখন চিল্কট তাদের সঙ্গে ডাক্তার হয়ে আসেন। একটা মোঘল শহরকে ভেঙেচুরে তখন নিউ দিল্লীর সরকারি বাড়িগুলো সবে তৈরি হচ্ছে। কোকিল আর বুলবুলিতে মুখরিত সিভিল লাইন্সের ফাইন বাগানঘেরা বাংলোগুলো পেয়ে যেত ইংরেজরা। সেই লাক্সারি ছেড়ে কে শিমলিপুরে আসে? কিন্তু দশ বছর পরে যখন আমার দাদু দিল্লীতে উদয় হলেন তখন চিল্কটকে পাওয়া যায় শিমলিপুরের একেবারে শেষ প্রান্তে, আর্মি ব্যারাক্সের পাশে যমুনার ধারের বালিতে পোঁতা জাট আর গুজ্জরদের পাড়ায়। কী এমন অপরাধ করেছিলেন হামফ্রি চিল্কট যে তাঁকে এই নির্বাসন দণ্ড পেতে হয়?
- ভারতীয় মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন নিশ্চয়ই। ট্রাইবাল মহিলা? পম্পা তার প্রিয় কোনো নভেলের প্লট লাগাতে চায়। - কিংবা হয়তো, ইউ নো, নচ্ গর্ল?
আমি বেচারার আশায় জল ঢেলে দিয়ে বলি – চিল্কটের জীবন একটা নারীচরিত্রবর্জিত নাটক। তিনি না করেছিলেন বিয়ে, না ছিল তাঁর প্রেমিক অপবাদ। অপরাধটা নারীঘটিত না হলে আর কী হতে পারে?
- ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইম?
- হ্যাঁ, টাকাকড়ির ব্যাপারে ব্রিটিশরা ঢিলেঢালা জাত নয়। কিন্তু সার্জেনদের প্যানেল থেকে চিল্কটের নাম কাটেনি। ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকলে সেটা হত কি? তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায় না। তাহলে অপরাধটা কি সামাজিক? মানুষটাকে সোশ্যালি অস্ট্রাসাইজ় করা হয় কেন?
পম্পা তার খালি পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে আমাকে ঠেলে দিয়ে বলে – তুই নিজে জানিস, কি জানিস না?
যে গল্পের কিছুই নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব না সে গল্প বলার সময় এক পা এগিয়ে দু পা পিছোনো দোষের নয়। আমি বললাম - ভদ্রলোকের একটা বৈশিষ্ট্যের কথা আমি জানি। ভাবছি সেটা এর কারণ কিনা। ডক্টর হামফ্রি চিল্কট নাকি একবার মরে গিয়ে বেঁচে উঠেছিলেন। তাঁকে গোরও দেওয়া হয়। বাট হি কেম ব্যাক ফ্রম দ্য ডেড। তাঁকে কি এই অখ্রীষ্টানী ব্যাপারটার জন্য বয়কট করা হয়েছিল? ফর বিইং দ্য আনডেড?
বান্ধবীকে বলতে যাচ্ছিলাম যে চতুরাননও মরে গিয়ে বেঁচে উঠেছেন শোনা যাচ্ছে, এবং আর্যসমাজী পরিবারের কেউ তাতে ভয় পায়নি, কিন্তু সে তার আগেই হু-হু করতে করতে আমার গল্পের গাধাটাকে লাগাম ধরে থামিয়ে দেয়।
- হে মাই প্রভু-উ-উ-উ-উ! ও ঠিক রাত্রিবেলা একটা ভূতের গল্প বার করেছে। এবার আসবে অন্ধকার। পম্পা নিজেই ভূতের মতো চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে সোফায় এলিয়ে গেল। আমি চুপচাপ অপেক্ষা করছি। একটু পরে চাদরের ভিতর থেকে আওয়াজ আসে – এই ভূতটার সাথে আমাদের স্কিনের কী সম্পর্ক, সেটা বললি না তো!
আমি বললাম – আজ থেকে পঁয়ষট্টি বছর আগের এক শরতকালে চিল্কট পাঞ্জাবে পোস্টেড ছিলেন। সেখানে স্প্যানিশ ফ্লুয়ের দ্বিতীয় এবং মারাত্মক ঢেউটা গিয়ে আছড়ে পড়ে। এত কম সময়ের মধ্যে এত শব নাদির শাহের আক্রমণের বেলাও দেখা যায়নি। পাঞ্জাবের পাঁচ শতাংশ মানুষ কয়েক মাসের মধ্যে খতম। শোনা যায় রাজস্থানের বর্ডারে কোনো একটা প্রিন্সলি স্টেটে কর্মরত চিল্কট প্রথম রাউণ্ডেই তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। চার্চের জমিতে তাঁকে কবর দেবার পর সঙ্গীরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য অর্ধেক লাহোর আর অর্ধেক দিল্লীতে পালায়। তারপর কী হয়েছিল? এক বছর ধরে কেউ কারো খবর রাখেনি। নদীগুলো বেওয়ারিস লাশের কনভেয়ার বেল্টের মতো একটু একটু করে যখন দেশটাকে আবার ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে, তখন পাক্কা বারো মাস অজ্ঞাতবাসে থাকার পর হামফ্রি উইলিয়াম চিল্কট নামের একটা অপরিচিত লোক দিল্লীতে এসে হাজির। তাকে আর চেনার উপায় নেই। গায়ের ওজন অর্ধেক। মাথার সোনালি চুল পড়ে গিয়ে নতুন যে চুলগুলো গজিয়েছে সেগুলো কিছুটা বাদামি আর বাকিটা সাদা। গায়ের সমস্ত লোম ঝরে যে নতুন লোমগুলো গজিয়েছে সেগুলোও তাই। আর স্কিন? হ্যাঁ, স্কিনই এই গল্পের আসল চরিত্র। চিল্কটের চামড়া থেকে যেন কোনো কবরের পিশাচ সমস্ত কোলাজেন শুষে নিয়েছিল। স্বচ্ছ এবং ছাড়ানো চিকেনের গায়ের মতো ফিনফিনে আর লোল সেই চামড়ার রং ছিল ছাইয়ের চেয়ে সাদা। তার উপর বেশ কিছু চোখের মতো ক্ষত।
পম্পা মুড়ি দেওয়া মাথাটা একটু বার করে বলল – ডিজ়গাস্টিং। সিফিলিসের ক্যাঙ্কারের মতো শোনাচ্ছে। লোকটা যে চিল্কটই, কোনো ইম্পস্টার নয়, সেটা কী করে বোঝা গেল?
একটু চুপ করে বান্ধবীর সন্দেহগুলো নিয়ে ভাবছি। আমি নিজেও ব্যাপারটা ভালো বুঝিনি, তার মন্তব্য আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করছিল। চায়ের কাপের গভীরে একটা স্ফটিক স্তম্ভ দেখা যাচ্ছে। আমি এক নিঃশ্বাসে ডুব দিয়ে সেটাকে তুলে আনার চেষ্টা করি।
পরে নিজের সমর্থনে বললাম - হামফ্রি চিল্কটের তিনকূলে কেউ ছিল না। সম্পত্তিও ছিল না। শুধু একটা সরকারি চাকরি। এরকম হাঘরে চরিত্রের পরিচয় কেউ চুরি করবে কেন? তাছাড়া একটা হাইলি কোয়ালিফায়েড সার্জেন আকাশ থেকে পড়ে না। এটা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা না, যে র্যানডাম কোনো অশিক্ষিত মানুষকে এস্টেটের মালিক হিসেবে কল্পনা করা যায়। যাহোক, চিল্কট তাঁর কবর পাওয়ার ঘটনা অস্বীকার করতেন না। তিনি বলতেন তাঁকে ট্রাইবালরা মাটি খুঁড়ে বের করে আনে। মরা দেহটা কী করে আবার বাঁচল সেটা কেউ ধরতে পারেনি। চিল্কটের ভুরু ছিল উঁচু, গভীর চোখের কোটর থেকে ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হত। ট্রাইবালরা তাঁর কান বিঁধিয়ে দিয়েছিল। পুঁতির একটা মালাও নাকি ছিল গলায়। লম্বা, কঙ্কালসার, গা ভরতি আলসারওয়ালা এই মানুষটাকে দেখে ভদ্র ইংরেজ এবং অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পরিবারগুলো শুধু নয়, উচ্চপদস্থ ভারতীয়রাও যে বিতৃষ্ণা আর ভয় অনুভব করবে সেটা কি আশ্চর্যের?
পম্পা আবার উঠে বসেছিল। মুখোমুখি চেয়ারে বসেছি আমরা এবং মাটিতে আমাদের পা দুটো পরস্পরকে মাঝে মাঝে ঠেলে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। হঠাৎ সে একটা ঠ্যাং আমার হাঁটুর উপর তুলে দিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলটা আমার পেটের উপর আস্তে আস্তে বুলোতে শুরু করে। বেশি খাওয়ার ফলে আমার প্রায়ই পেটে ব্যথা হয়। আরাম হচ্ছিল বলে সোজা হয়ে বসে জায়গা করে দিলাম। আদা চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে পম্পা বলে – এই ঘটনাগুলো বাজাজ জানবেন না সেটা হয়? তুই নিজেই বলেছিস উনি চিল্কটের জুনিয়ার ছিলেন।
- সে তো তিরিশ বছর পর। ততদিনে কত কী পালটে গেছে! চিল্কটের চামড়ায় পুরু কোলাজেনের স্তর চলে এসেছে কোথা থেকে। ক্ষতগুলো গায়েব। গায়ের রং হয়ে গেছে বাদামি। ইংরেজরা প্রায় সবাই ভারত থেকে বিদায় নিয়েছে। বয়কট করবে কে? নদীর ধারে, টিলার উপর, বাবলা গাছের জঙ্গলে, বা আরাবল্লীর নির্জন প্রান্তরে একা ঘুরে বেড়াতেন শিমলিপুরের সার্জেন। ভবঘুরে আর ফকীররা তাঁর সঙ্গী। বাজাজ তাঁকে চিনেছিলেন ময়লা সাহেব বলে। আনডেড বলে নয়।
- তাহলে তোর জ্ঞানচক্ষু খোলাল কে? প্রশ্নটা তুই বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিস।
- বলব। সময় হলে বলব। আগে গল্প তো শেষ হোক। বাজাজ যখন লাহোরে তখন দিল্লীতে বসে চিল্কট মেডিকাল জর্নলে দুটো আর্টিকল্ প্রকাশ করেছিলেন। তার বিষয় ছিল স্কিনের টাইপ। এই জর্নলটার নাম কী বলো তো?
- হাউ অন আর্থ ক্যান আই নো?
- ব্রিটিশ জর্নল অব ডারমেটলজি অ্যাণ্ড সিফিলিস। তুমি সিফিলিসের কথা তুলেছিলে? সেখানেই চলে এসেছি। চিল্কট এমন এক ধরণের ত্বকের কথা লেখেন যাতে সিফিলিসের ক্যাঙ্কারের মতো চাকা চাকা ক্ষত দেখা যায়, চামড়া ঝুলে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মানুষটা সুস্থ থাকে। চিল্কট এই বিচিত্র উপসর্গের নাম দিয়েছিলেন আরাবল্লী সিন্ড্রোম। তিনি একটা কেস স্টাডির বর্ণনা করেন, যাতে পেশেন্টের ফ্লু হবার পর তাকে মৃত বলে পরিত্যাগ করা হয়।
- মানে আসলে মরেনি?
- কে বলতে পারে? আরাবল্লীর ট্রাইবালরা বডিটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোনো উপায়ে রিভাইভ করেছিল। লোকটা যখন জাগে তার সারা গায়ে জ্বালা। হাই ফিভার। কয়েক বছর পরে চিল্কটের কাছে এই পেশেন্ট উপস্থিত। শুধু সুস্থ হয়ে যায়নি, বয়সও দশ বছর কমে গিয়েছে। সমস্ত গা জুড়ে কাঁথার মতো এপিডারমিসের প্যাচ। চিল্কটের মতে উল্কিওয়ালারা যেভাবে উল্কি তোলে সেইভাবে ঘষে ঘষে আসল চামড়ার জায়গায় অন্য চামড়ার স্তর বসানো হয়েছিল। পরে সেই টুকরোগুলো থেকে টক্সিন বেরিয়ে সারা শরীরে দাগ আর আলসারের সৃষ্টি করে। অনেক বছর ধরে সেই দাগগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়েছিল। তবে ততদিনে মানুষটার শুধু গায়ের রং নয়, গোটা শরীরটাই পালটে যায়।
- আমি তোকে লিখে দিচ্ছি। পেশেন্ট চিল্কট নিজে।
- আমারও তাই সন্দেহ। এই সব ঘটনাগুলো ঘটছিল উনিশশো পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে। তারপর যেমন হঠাৎ করে চিল্কট সার্জেন থেকে ডারমেটলজির এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই হঠাৎ তাঁর রিসার্চের স্রোত অবরুদ্ধ হয়ে যায়। তিনি হয়ে গেলেন ডার্টি সাহেব, কারণ তখন নদীর চরে ডেরা গেড়ে বসা যত রাজ্যের ভণ্ড সাধু, ভ্যাগাবণ্ড আর ঘর থেকে পালানো দরবেশরা হয়ে গেছে তাঁর সঙ্গী। পরে আরেকটা যুগান্তর ঘটে সাতচল্লিশে, যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে এই নামগোত্রহীন ঘরবাড়িছাড়া যমুনাপাড়ের মানুষগুলোও শীতের কুয়াশার মতো উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাদের লুকিয়ে থাকার জঙ্গল আর জমিগুলো জাটরা চাষের জন্য দখল করে নেয়। উদ্বাস্তুদের চাপে রাতারাতি দিল্লীর জনসংখ্যা আট লক্ষ থেকে পঁচিশ লক্ষ হয়ে গেছে। হাসপাতালে রুগীর লাইন দশগুণ। চিল্কট সাহেব তখন বাজাজের ঘাড়ে হাসপাতালের দায়িত্বগুলো চাপিয়ে অর্ধেক দিন গা ঢাকা দিতেন। বাজার থেকে কখনো রুটি উধাও হয়ে যেত, কখনো সাবান। একদিন চিল্কট সাহেবকেও আর খুঁজে পাওয়া গেল না। যেমন আকাশ থেকে টপকে পড়েছিলেন তেমনই মাটি তাঁকে হাঁ করে গিলে ফেলেছিল বোধহয়।
আমাদের কাপে চা ফুরিয়ে এসেছে। ভাবছিলাম এখানে থামা উচিত। পম্পা আমার নাভিতে আঙুল দিয়ে বিলি কাটা শেষ করে বলল – তারপর?
– মনে হচ্ছে তোমার ঘুম পেয়ে গেছে। এখানেই কি আজ ইতি করব?
চায়ের খালি পেয়ালাটা ঠকাস করে নামিয়ে রেখে পম্পা বলল – ঘুম আমার পায়নি, পেয়েছে তোর। নইলে এভাবে কেউ গল্প বলে নাকি? না আছে মানে, না আছে যুক্তি। আসল চরিত্র যদি স্কিন হয় তো সেই স্কিনের পরিণতি কী হল? এই চিল্কট বলে লোকটার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কী?
- আজই শুনতে চাও সব? এক রাত প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে পারলে হত না?
পম্পা অধৈর্য হয়ে আমার নাভিতে একটা তীক্ষ্ণ খোঁচা মেরে দেয়। - ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলি আমি। - আজই শুনে নাও সব। বাজাজের আবির্ভাবের কয়েক বছর আগে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিয়াতে স্কিন নিয়ে যে লম্বা পরিচ্ছেদ থাকে তাতে আরাবল্লী সিন্ড্রোমের উপর একটা সংযোজন হয়। এতে বলছে উপসর্গটা আসলে কোনো জীবাণুজনিত রোগ নয়। স্কিন গ্র্যাফটের মাধ্যমে একটা মানুষের ভোল পালটানোর টেকনিক। এটা যে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে চলে আসছে তাদের বিশ্বাস এইভাবে তারা নিজেদের ক্রমশ সরীসৃপদের মতো ঠাণ্ডা রক্তের দীর্ঘজীবী কোনো প্রাণীতে পরিণত করে ফেলতে পারে, যারা একটা শীতঘুমের অবস্থায় চলে যেতে সক্ষম।
- আনডেড থেকে শুরু করে হাইবারনেশান! উফ্ফ্, তোর মামাদের চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছিস তুই, জয়! আমার মধ্যরাতের সঙ্গিনী আর গল্পটাতে বিশ্বাস করছিল না। সে বলে - এর মধ্যে ব্রিটানিকাকে কেন ঢোকাচ্ছিস? ইজ় নাথিং সেক্রেড?
বললাম - কী করে সেক্রেড হবে? তার একটা কপি যে আমাদের বাড়িতে বসে ছিল। চামড়ায় বাঁধানো চল্লিশ বছর পুরোনো দশ ভলিউমের বিশ্বকোষ। বেশ খানিকটা অংশ পোকায় খাওয়া হলেও বইটা পড়া যায়। তুমি ভাবছ এতগুলো মোটা খণ্ড হজম করলাম কীভাবে? সাকুল্যে আট-দশ পাতা পড়েছি হয়তো। আমার জন্মের বহুদিন আগে থেকে স্থির করা ছিল ব্রিটানিকা খুলে এই আরাবল্লী সিন্ড্রোমের পাতাটাই সবচেয়ে আগে দেখতে পাব।
- সবই কো-ইনসিডেন্স্? কাজটা টোটোর হাতে না হয়ে তোর হাতে হল কেন?
- কারণ আমার কপাল। গল্পের একটা উপসংহার আছে। সেটা শোনাই আগে। দিল্লীতে ফিরে আসার পর ডার্টি সাহেবের দুজন সহযোগী ছিলেন। চিল্কট ঘুরে ঘুরে যখন উত্তর ভারতে সার্জারির ক্যাম্প চালাতেন তখন তাঁর সঙ্গে এই দুজনকে দেখা যেত। আমাদের গুলজ়ারীলাল বাজাজ দিল্লীতে আসারও আট-দশ বছর আগে শিমলিপুরে একটা পুলিশ তদন্ত হয়েছিল। কেন জানো? চিল্কটের সেই দুজন সহযোগী ছমাসের ব্যবধানে রহস্যজনকভাবে ভ্যানিশ করে যান। কারো খোঁজ মেলেনি। না লাশ, না মানুষ। তো একে আনডেড। তার উপরে যেই কাছে যায় সে-ই ভ্যানিশ হয়ে যায়। এরকম সুনাম নিয়ে কে জনপ্রিয় হতে পারে? এই হল আমার থিওরি।
আমি চুপ করে গিয়েছিলাম। পম্পা কাপগুলো তোলার পর রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকে। মা-বাবার সামনে সে আমাকে পা দেখাবে না বলে ম্যাক্সির নিচে একটা পাজামাও পরে নিয়েছিল। তাও আমি কিছুটা রাস্তার আর কিছুটা কল্পনার আলোয় সুতির অর্ধস্বচ্ছ আবরণের আড়ালে চলন্ত দুটো উরুর বদলে একটা চিতাবাঘিনীর মোমের চামড়ার নিচে লুকোনো পেশিগুলোর ওঠানামা দেখতে পেয়ে যাই। আমার উচিত ছিল উঠে গিয়ে বান্ধবীকে সাহায্য করা, কিন্তু জানালার কাছ থেকে ঘরটাকে এক নজর দেখে আমরা দুজনেই বুঝেছিলাম এই এক্স-রের মতো রহস্যময় তালজোছনার পুকুরে শুধু একজনকে নামতে হয়, আর অন্যজনকে বসে থাকতে হয় পাড়ে।
- এর সাথে বাজাজের সম্পর্ক কী? ফিরে আসার পর আমাকে আর নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত দেয়নি পার্কটাউনের শকুন্তলা, যার হাতে শহরের বিবেক।
- বাজাজের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলিনি তো!
- না বললেও আমি জানি গল্পটা কেন শোনাচ্ছিস। তোর চোখ দেখে আমি বুঝতে পারি।
- কী বুঝতে পারো?
- একটা হাইস্কুলের ছেলেকে বোঝা কী এমন শক্ত? শকুন্তলা ম্যাক্সিতে ভিজে হাতটা মুছতে মুছতে যুক্তি দেয়। - তোর গল্প শুনে মনে হয় চিল্কটের কোনো পুরোনো সঙ্গী আজও বেঁচে আছে এবং তার কাছ থেকে তুই উদ্ভট কোনো গোপন তথ্য পেয়ে গেছিস। হয়তো এমন কোনো জিনিসও তোর হাতে এসে পড়েছে যা এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না। তবে আমি আলাদা করে এই খবর পেয়েছি যে বাজাজ তোর কাছ থেকে একটা কিছু চাইছিলেন, আর তুই সেটা এখনো দিসনি। এই দুটো যদি একই জিনিস না হয় তাহলে কী সেই বস্তু যা পাওয়ার জন্য ডক্টর বাজাজ হাত ধুয়ে তোর পিছনে পড়ে গেলেন?
- ঠিক আছে। আমি যা জানি বলে দিচ্ছি। তোমার যা বোঝার বোঝো। বাজাজ কী চাইছেন আমি জানি না। তবে কারো পারমিশান ছাড়া ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়াবার পর উনি অলরেডি আমার বাঁ হাত থেকে একটা স্কিনের স্যাম্পল্ নিয়েছেন।
- হে মাই প্রভু! পম্পা নিজের চেয়ার থেকে ছিটকে মাটিতে বসে পড়ে। আমার বাঁ হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সে কাতর হয়ে বলল। - আমি জানতাম না, জয়। বিশ্বাস কর। এত বড়ো পিশাচ, আমি ভাবতে পারিনি।
- চিন্তার কিছু নেই। আমিও মেঝেতে নেমে গিয়ে বললাম। - খুব ছোট স্যাম্পল্। এখন বুঝতেও পারবে না। তোমাকে বাজাজ বলেছেন তো যে শিমলিপুরের বাংলোতে একটা প্রসিজর হত? কোনো কারণে সেটা আবার করার জন্য বাজাজের আমাকে প্রয়োজন। আমাকে ধরে আনার কাজে তোমায় লাগানো হয়েছে। কিন্তু একটা ডিরেঞ্জ্ড লাশকাটা সার্জেনের দলে সামিল হবার আগে এটা কি ভাবা উচিত নয় যে এ সবের মূলে যে নোংরা সাহেব, সেই হামফ্রি চিল্কট শুধু একা নিজে ভ্যানিশ হয়ে যাননি, দুই ঘনিষ্ঠ সহকারীকেও গায়েব করে দিয়েছিলেন?
টিক টিক টিক টিক করে পূজোর প্রহরগুলো আমাদের পাড়া ছেড়ে অন্তরীক্ষে উড়ে যাচ্ছে। মনে উড়ছিল আশার ময়ূর। বেকুবের মতো মাটিতে বসা দুটো ভাগ্যের পুতুল কি পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে দমন করতে পারে?
তার বদলে পম্পা মুখার্জি আমার বাঁ হাতটা আবার পর্যবেক্ষণ করে আস্তে আস্তে বলল – রিস্ক সব কাজেই আছে, জয়। তাই বলে আমরা সারাজীবন ভীতুর মতো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব?
এর পরের কদিন টোটোদা আর আমি ভোরবেলা শিমলিপুরের প্যাণ্ডেল থেকে হোল নাইট প্রোগ্রামের চেয়ারগুলো তুলে দিয়ে মণ্ডপের টুকিটাকি কাজ সারতাম। প্রসাদের ফল কাটার দল এসে হাজির হওয়ার আগে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ক্যান্টনমেন্টের ধার দিয়ে আমাদের মর্নিং ওয়াক শেষ হয়ে যেত। রাস্ক দিয়ে চা খাবার পর টোটোদা দাড়ি কামিয়ে স্নান করতে যেত, আর আমি সোফার উপর ফ্যান চালিয়ে আরেকটু ঘুমিয়ে নেবার পর মায়ের দেওয়া কড়া লুচি কিংবা পাতলা একটা রুটির সাথে কাঁচা লংকা দিয়ে আলুর তরকারি খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম সে দিনের অভিযানে, যা শুরু হত মল রোড কিংবা ইউনিভার্সিটির বাস স্টপ থেকে। বেলা এগারোটা নাগাদ গুলাবো এসে পৌঁছোত। পূজোর দিনগুলোতেও সে শাড়ি পরতে না, কারণ আমরা দূর পাল্লার বাস ধরে কোনোদিন যাব কনট প্লেসের কাছে আর কোনোদিন সাউথ দিল্লী।
- স্টিল অফরেইড?
- নো।
- যাদের মন পরিষ্কার তারা কখনো ভয় পায় না।
বিনয়নগর কিংবা মিন্টো রোডের পূজোবাড়ি থেকে একটা ভোগের দোনা ভাগাভাগি করে খেয়ে আমরা কনট প্লেসের কফি হাউসে গিয়ে বসতাম আবার। শরতের দিন বলে উন্মুক্ত ছাদের কোনো টেবিল দখল করা যেত। কফি ছিল বাহানা। আসলে আমরা ইনার সার্কেলের বাড়িগুলোর উপর ফাঁকা জায়গায় হ্রদের মতো জড়ো হওয়া নীল আকাশের শরবত বিনে পয়সায় চোঁ চোঁ করে গিলতে আসি।
পম্পা হয়তো গুনগুন করে রবীন্দ্রনাথ কি আনন্দ্ বকশীর গান গাইতে শুরু করেছে। আমি একটা হিন্দী দৈনিক যোগাড় করে খবর খুঁজছি; শিমলিপুরের খুনের সমাধান কি হবে এ বছর? উর্দি পরা বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করত – কিছু চাই, ম্যাডাম? ম্যাডাম তার রোদ চশমার ভিতর দিয়ে উদাসভাবে চেয়ে বলত – সবই তো আছে। – কোই প্রবলেম নহীঁ, বলে পুরোনো পাম্প-শু পরা বেয়ারা তার খালি থালা নিয়ে চলে যেত।
সব কি সত্যিই আছে? খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলে আমি মনে মনে ভাবতাম। রোদ চশমাকে ঝাঁকিয়ে নাকের ডগায় নিয়ে আসার পর তার উপর থেকে সন্দেহের দৃষ্টি ফেলে ম্যাডাম শুধোত – তোর কী চাই বলতো?
- কিছুই না।
- না। কিছু একটা চাই তোর। আমি বুঝতে পারছি। কী সেটা?
খবরের কাগজ পাশে সরিয়ে রেখে বলি – চল্লিশ বছর আগে এখানে একটাও উঁচু বিল্ডিং ছিল না। হনুমান মন্দির বলতে একটা ছোট্ট গাঁয়ের বাড়ি। সকালবেলা কনট প্লেসের রাস্তায় গাড়ি নয়, শত শত সাইকেলে কেরানিরা ছুটত সেক্রেটারিয়েটের দিকে। চিন্তা করো, হাতে গোনা যায় এমন কয়েকটা মাত্র বাস। ছাদখোলা মরিস কিংবা অস্টিন গাড়িতে ভারতীয় রয়্যাল ফ্যামিলির সদস্যরা হুশ করে আমাদের সামনের বাবা খড়ক সিং মার্গ দিয়ে চলে যাচ্ছে, যার নাম তখন ছিল আরউইন রোড। অথবা ভাবো ইণ্ডিয়া গেটের কাছে রাজপথ বা কিংসওয়ে নেই, সে জায়গায় শের শাহ সুরীর আমলের দেয়াল আর দূর্গের ধ্বংসাবশেষ। রাইসীনা হিলের উপরে অস্তগামী সূর্যের আলোয় একটা সোনার লঙ্কার রূপ নিয়েছে। তার নিচে কিলবিল করছে মাইলের পর মাইল জুড়ে আণ্ডারগ্রাউণ্ড প্যাসেজ আর গলির তৈরি লুকোনো শহর। সেই শহরটাকে আমি ফিরে পেতে চাইছিলাম। বা তার অভাবে দুজন ফিট করতে পারে এমন একটা টাইম মেশিন।
- ওঃ, কী আব্দার! একটা অমলেট আর টমেটো সস্ পেতে পারিস। নিবি?
- হুম্ম্ম্। আচ্ছা, দাও।
পেট ভরলেও মন ভরত না। মন ভরলে ইচ্ছেগুলো বেরিয়ে এসে ন্যাংটো ছেলের মতো ফুটপাথে দৌড়োত। রিখিরামের সেতারের দোকানে আমরা এস্রাজ আর পাখোয়াজগুলো খরিদ্দারের মতো পরখ করতাম। গলগোটিয়া ব্রাদার্সে গিয়ে খুঁজতাম এমন কোনো বুড়ো জেলখাটা কয়েদীর মতো বই, তিরিশ বছরে যে কোনো মানুষের মুখ দেখেনি। - আজ আমি পার্কটাউনের পূজোবাড়িতে ধুনুচি নিয়ে নাচব। তুই আসবি তো? বান্ধবী জানতে চায়।
আমি বলি – নিশ্চয়ই। তুমি কি হিপ গ্রাইণ্ড করবে?
– বাজে বকিস না। আমি পাড়ার লোকদের সামনে ওসব করব কেন?
– ইচ্ছে করে নয়। এমনিই।
- এমনিই?
– হ্যাঁ। মানে যদি না চাইতেও হয়ে যায়?
খানিকক্ষণ রাগী রাগী মুখ করে চলার পর যথারীতি আমার বান্ধবী হেসে ফেলত।
কীসের আশায় আমরা এইভাবে চলে বেড়াই? কী খুঁজছি দুজনে? একই জিনিস খুঁজছি কী? দিনের আলো নিভে আসার সাথে কারো রক্তে লাগে যায় ধুম। কেউ সেই রূপোর টাকার মতো দিনটা আরেকবার খরচ করা যাবে না বলে হতাশ হয়ে যায়।
সন্ধ্যেবেলা আমার বান্ধবী একটা সুতির লালপাড় সাদা শাড়ি পরে বেরিয়েছিল। ধুনুচি নাচার সময়ে সিল্ক চলবে না। মাথার চুল ডাকিনী স্টাইলে খুলে দেবার পর কাপড়ের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে সুরক্ষিত। আঁচল টাইট করে কোমরে জড়ানো। পায়ের গোড়ালি থেকে খানিক উপরে শেষ হয়েছিল কস্টিউম। - শাড়ি বেশি উঁচু হয়ে গেল কি? সে আমাকে জিজ্ঞেস করে। মুগ্ধ চোখে তার পায়ের গোছ দেখতে গিয়ে আমি তোতলাতে শুরু করেছি। মাসিমা আমাদের আলাদা করে দিলেন।
একটা নতুন পাঞ্জাবি পেয়ে গেছি। মাসিমা বললেন – কাল দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু আজ যখন তুই পূজোর কোনো জামা আনিসনি তখন আজই পরে ফেল।
মেয়েরা নাচবে বলে বাঙালি লুম্পেনদের মধ্যে কিছু অবাঙালিও ঢুকে গেছে। পম্পা হাতে একটা মিষ্টির বাক্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ঝলমলে প্যাণ্ডেলে পা দিল। পিছনে মাসিমা আর মেসোমশাইয়ের সঙ্গে এক পরিবারের সদস্যের মতো আমি। মণ্ডপের সামনে সাফসুফ করা কিছুটা জমি দড়ির বেষ্টনী দিয়ে আগলানো। তার বাইরে পার্কটাউনের স্থানীয় বাসিন্দাদের গুঁজে দেওয়া হচ্ছে যাতে বাইরের লোকেরা ঢুকে ঝামেলা না পাকায়। কিন্তু বেঁটেরা জায়গা ছিনিয়ে নেওয়ার ফলে মেসোমশাই আর আমি পিছিয়ে গেলাম।
গোটা চারেক ধুনুচি জ্বালানো হয়েছে। ঢাকের বাজনার সাথে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রবীণদের মধ্যে দু একজন শুভারম্ভ করেছিলেন। বিগত ফিটনেস, ঝরা পাতার গতি। তবু ধুনোর ধোঁয়া এবং গন্ধে আকাশ যখন ভরপুর তখন পায়ে তাল ধরে রাখতে পারলেই হল। নন্দী ভৃঙ্গী এবং শিবের বিদেহী অনুচররা এসে আসর জমিয়ে তোলে।
ঢাকীরা বাংলার গ্রাম থেকে অপহরণ করে আনা মজুর। মুখে অবিরল হাসি, বুকে অফুরন্ত দম, পোষাক পরিচ্ছদ ধুলোমলিন এবং শরীরের কাঠামো মর্মান্তিক। এই হাড় জিরজিরে খড়ের মূর্তিগুলোকে পূজো কমিটি নীলকরের জমিদারদের মতো চোষে। পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চান্ন বছর বয়সের মধ্যে যখন বঙ্গবীরদের পেট, লোভ, আর পাষণ্ডত্ব পূর্ণ বিকাশ লাভ করে, তখন তাদের কাজ হল পূজো কমিটি বানিয়ে চালানো। সত্যি বলতে কী, তিরিশের পর বেঁচে থাকতে আমার ভয়ের মূল কারণ এটাই। মাঝে মাঝে ভাবি, সোজা তিরিশ থেকে ষাটে পৌঁছে যাবার একটা এক্সপ্রেস ট্রেন যদি পাওয়া যেত!
চার নম্বরে পম্পাকে ঢুকিয়ে দিল ওরা। সবাই খুব আশা করে থাকলেও বান্ধবী আমাকে কানে কানে বলেছিল – ঢাকের স্পীড বাড়াতে বলেছি। খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে, দেখিস। তবে একটা পোজ়ও রিপিট করব না।
তারপর মণ্ডপের সামনে একটা ঝড় উঠেছিল। সবার মতো পাঁচ মিনিট ধরে স্লো মোশনে প্রণাম করেনি চণ্ডীগড়ের সিখনী। লো-পাওয়ার, গতানুগতিক যে মুদ্রাগুলোর মাধ্যমে নাচিয়েরা ভক্তির প্রদর্শন করে তার একটাও আমি হতে দেখিনি। পম্পা মুখার্জির প্রতিটি ভঙ্গী ছিল নতুন। একটার বেশি ধুনুচি সে তোলেনি, কিন্তু তার মুক্ত হাত আর উত্থিত জঙ্ঘার টেম্পো ঘূর্ণিহাওয়া বইয়ে দিচ্ছিল। দুরন্ত ঢাকের কাঠির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার বান্ধবী ববি সিনেমার ঝুট বোলে কৌয়া কাটে নাচটার অবলম্বনে মঞ্চের একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত এক পায়ে হপ আর অন্য পায়ে কিক করতে করতে যখন গেল তখন লুম্পেনদের জটলা থেকে আলতো সিটি শুনেও মাসিমার উদ্ভাসিত মুখ থেকে গর্বের হাসি মোছেনি। পরে সমালোচনা বা প্রশংসা কুড়োবার জন্য ধুনুচিটাকে মঞ্চে বসিয়ে দিয়ে গুলাবো চট করে বেরিয়ে এসেছিল। আমার সঙ্গে তার চোখাচোখি হবার পর আড়মোড়া ভাঙার ছলে স্পষ্ট একবার হিপ গ্রাইণ্ড করে দেখায় সে।
শাড়ি পালটে লহঙ্গা পরার জন্য পম্পা বাড়ি ফিরবে। মাসিমা আর আমি সঙ্গে এলাম। নাচের ধুমে ঠাসা শকুন্তলা কলকলিয়ে উঠে তার মাকে বলে – আমার তো ইচ্ছে করে প্রত্যেকটা পাড়ায় গিয়ে নেচে আসি। এতে কি কিছু দোষের আছে, মা?
– তোর নিজের কী মনে হয়?
হাই অ্যাড্রিনালিনের জন্য শকুন্তলা হাঁপাচ্ছিল একটু। খানিকদূর গিয়ে সে বলল – আমি বুঝতে পারি না।
মাসিমার কাছ থেকে একটা গজল উদ্ধৃত করার অনুমতি চাইলাম। কবির নাম সুদর্শন। তখল্লুস ‘ফাকির’, যার অর্থ ভাবুক।
গম বঢ়ে আতে হ্যাঁয় কাতিল কী নিগাহোঁ কী তরহ
তুম ছুপা লো মুঝে অ্যায় দোস্ত গুনাহোঁ কী তরহ।।
অপনী নজ়রোঁ মেঁ গুনাহগার ন হোতে, কিঁউকর
দিল হী দুশমন হ্যায় মুখালিফ কে গওয়াহোঁ কী তরহ।।
ফুল আর কবিতা। দিল্লীর অধিকাংশ মহিলার ফেভারিট। প্রথমটা সস্তার সস্তা। দ্বিতীয়টা পাওয়াই যায় না। সারাদিন বসে গজ়লের বই চাটবার সুবাদে আমার কাছে দ্বিতীয়টার অভাব নেই। সেই একটা গুণে আজ আমি পম্পা মুখার্জির গা ঘেঁষে হাঁটছি।
পম্পা বলে – এটা আমি আগে শুনেছি। কিন্তু সবকটা শব্দের মানে জানি না।
বান্ধবীর মনোরঞ্জনের জন্য ফাকিরের তর্জমা আমার আগেই করা ছিল। বললাম – মুখালিফ মানে হল প্রতিপক্ষ। বাকিটা আশা করি বুঝতেই পেরে গিয়েছিলে।
বিষাদগুলি বাড়িয়ে আসে থাবা, আততায়ীর দৃষ্টি যেমন হত
বন্ধু আমায় লুকিয়ে তুমি ফেলো, গভীরতম অপরাধের মতো।
নিজের কাছে না হয়ে যাই দোষী, সফল হবে কী করে এই সাধ
হৃদয়ও যখন দুশমনের দলে, আমার অভিযোগীর অনুগত।
পম্পা মাসিমাকে আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। - লাস্ট দুটো লাইনে বলছে মন যখন নিজেরই বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে থাকে তখন নিজেকে অপরাধী ভাবা ছাড়া মানুষের কোনো উপায় থাকে না। আর মন তো যুক্তি দেবেই। তোমরা সারাক্ষণ কানের কাছে বলো যার আড়াল নেই সে বৃষ্টিতে ধুয়ে বেরিয়ে যায়। অথচ ছেলেদের বেলা সেটা খাটে না। জয়কে কোথাও লজ্জা পেতে দেখেছ? যা ইচ্ছে তাই করে। বাড়িতে তাও বলে হীরের টুকরো। আমি সেরকম পারি? না মেয়েদের কেউ কখনো হীরের টুকরো বলে?
এই কথাটার পর আমরা সবাই চুপ করে গেছি। দেখতে দেখতে চলার পথও ফুরিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমাদের চিন্তার মেশিনগুলো বন্ধ হয় না। কয়েক দিন ধরে আমার স্কিনটা আমার বান্ধবীকে দিয়ে আমি তারটা পেতে চাইছিলাম। যাতে ভাগ্যের সঙ্গে বোঝাপড়া সে আমার সহযোগিতা ছাড়াই করে নিতে পারে।
উৎসবের কদিন একটানা ঝড়ের মতো কেটে যায়। পার্কটাউনের আট দশ মাইলের মধ্যে কোনো পুজোবাড়িতে কলকাতার যাত্রা পার্টি এসেছে। পম্পার খুবই ইচ্ছে যাওয়ার। মাসিমা বললেন – রাত দুটোয় শেষ হয়, তারপর কী করবি? বান্ধবী আমার দিকে তাকায়। আমি বলি – অত রাতে বাস নেই। সাধারণত সবাই চেয়ারে ঘুমোয়, বা গল্প করে কাটিয়ে দেয়। মাসিমা বলেন – সারারাত চেয়ারে? পম্পাও মুষড়ে গেল। আমার আইডিয়ার দৌড় প্রবুদ্ধ। বললাম – তার মোপেডে ফিরলে কেমন হয়? মাসিমা চোখ কপালে তুলে বলেন – সেই ক্ষ্যাপাটার ভরসায় অত রাতে রাস্তায় নামবি? চোখে দেখে কিনা কে জানে।
অত রাতে কারোই প্রবুদ্ধর পিলিয়নে চাপবার সাহস হল না। ফলে রাতগুলো পার্কটাউনেই কাটত। একটা কি দুটো বাংলা সিনেমা দেখে আমরা পম্পাদের বাড়িতে ফিরে আসতাম। সকালে আবার ছুটতে হত বাড়ি, যাতে টোটোদার সঙ্গে মর্নিং ওয়াক মিস না হয়ে যায়।
সেই ছাই-ধূসর সকালগুলো গোলাপি হয়ে যাওয়ার আগে আমি টোটোদাকে যমুনার পুল পার করিয়ে দিতাম। টোটোদা আর তার বন্ধু মনু যখন ক্লাস টেনের ছাত্র তখন গুজ্জররা তাদের সাইকেলের চেন আর বাঁশ দিয়ে মেরেছিল। তারপর মেরুদণ্ডের ইনফেকশানে দুজনেই মরো-মরো হয়। নতুন এক ধরনের সার্জারির পর টোটোদা বেঁচে ফিরল। মনু বাঁচেনি। তখন বহুদিন আমরা যমুনার দিকটা আসতাম না। অবাক হয়ে দেখলাম টোটোদার মন থেকে এখনো ভয় কাটেনি। আমাকে সে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
- টোটোদা, এই সব রাস্তায় কত দোকান উঠছে এখন। কোথাও সাইকেল সারায়। কোথাও নতুন একটা র্যাশন শপ। আগের মতো আর নেই। আমাদের বয়সী ছেলেদের উপর চাকরি খোঁজার চাপ। গুণ্ডামি কমে গেছে অনেক।
আমি টোটোদাকে পুরোনো কয়লার দোকানটা দেখিয়ে আনতে চাইছিলাম। তার বদলে সে-ই আমাকে টানতে টানতে পুলের এদিকে নিয়ে আসে। - জয়, এই বছরেও একটা লাশ পাওয়া গেছে যমুনার ধারে। আজ অবধি কিনারা হয়নি। শোন, পুলের দুদিকে শিমলিপুর। কিন্তু এদিকটা হল শহুরে ইঁদুরদের কলোনি, আর ওদিকটা মেঠো ইঁদুরদের পাড়া। শহুরে ইঁদুররা মেঠো হতে পারে না।
বাড়িতে মামিমা বলে – তোদের তো দেখা পাওয়া ভার। মনেই হয় না এ বাড়ির ছেলে। টোটো তাও মাঝে মাঝে রাতে ফেরে। জয়, তুই কোথায় থাকিস?
মা দূর থেকে অনুরোধ করল – বৌদি, পারলে জিজ্ঞেস কোরো নতুন বাবা-মা পেয়ে গেছে কিনা।
মামিমা তাড়াতাড়ি মাঝখানে চলে আসে। - দুল, তুমি থামো। ছেলেকে ওইভাবে বলতে নেই। জয় কি ভুল কিছু করে?
কোথায় রাত গুজরান করি সবাই আন্দাজ করে নিয়েছে। অপমানে কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। টোটোদা আমাকে বাঁচাবার জন্য ডাহা মিথ্যে বলে দেয়। - আমার কাছাকাছিই থাকে। মাঝে মধ্যে প্রবুদ্ধর সঙ্গে। প্রবলেমটা কী?
মা বলে – একটা কিটব্যাগে জামাকাপড় আর কিছু টাকা নিয়ে রাখ। তাহলে সকালবেলা চোরের মতো বাড়ি ফিরতে হয় না। যেখানে রাত কাটাস সেখানেই স্নান করে নতুন জামা পরে নিস। লোকেরা অন্তত জানুক যে আমরা নিজেদের ছেলেটাকে অযত্ন করি না।
- টাকা আমার কাছে আছে। বলে পালালাম।
দিন হয়ে যায় বিকেল। বিকেলগুলো সন্ধ্যে। মেলা গ্রাউণ্ডের পূজো প্যাণ্ডেলের বাইরে আমি আর গুলাবো পাশাপাশি এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফাটাতে থাকি। অথবা গে-লর্ডের দোকান থেকে আইসক্রীম কিনে কনট প্লেসের সেন্ট্রাল পার্কে বসে গলে যাওয়ার আগে খেয়ে ফেলা যায়। টাকা যা লাগে গুলাবোই দিচ্ছে। কে জানে কোথায় পায়। সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট থেকে বাস ধরতে গিয়েছিলাম। আমার বান্ধবী বলল – রকাব গঞ্জের গুরদুয়ারাটা কি দেখে যাব? দুর্গাপূজোর মাঝখানেও জুতো খুলে এবং মাথায় রুমাল বেঁধে তার পিছু পিছু গুরদুয়ারায় মাথা ঠেকিয়ে আসতে হল।
পরে গুরদুয়ারার সংলগ্ন নীরব নিউ দিল্লীর চওড়া সড়কের ফাঁকা ফুটপাথ দিয়ে নীম আর অশ্বত্থ গাছের তলায় হাঁটতে হাঁটতে পম্পা মুখার্জি তার সানগ্লাস খুলে আমাকে বলে – বেশি খাটাচ্ছি তোকে, জয়?
- না তো!
দাঁত দিয়ে সানগ্লাসের ডাঁটি চেপে ধরে সে ভেবে নেয় কিছু। তারপর আমার দিকে একটা স্বপ্নের লজেন্স ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে উদার হয়ে সে বলল - তুই যদি কোনোদিন কাউকে প্রপোজ় করিস তাহলে কোথায় গিয়ে করবি?
একটু চিন্তা করে বলি - হুম্ম্। ধরো এখানেই। এরকম কোনো নিরিবিলি অতীতের ছায়ায় ডোবা রাস্তায়। যেখানে গাছের উপর থেকে অতিকায় পাখি সেজে পুরোনো দিনের ভূতেরা আমাদের উপর নজর রেখেছে।
- কোনো হিল স্টেশন কি সমুদ্রের ধারে কেন নয়? শিমলাতে কী ভালো ভালো স্পট আছে! তোর সেরকম রোমান্টিক কিছু করতে ইচ্ছে করে না?
মহিলাটির মন থেকে রঙ্গার স্ট্যাম্প এখনো মোছেনি। বললাম – ধুর্! শিমলাতে আছে সুইসাইড পয়েন্ট। আর লুত্যেনের দিল্লীর নিরালা রাস্তাগুলোতে অসংখ্য জিন এসে আস্তানা গাড়ার পর পুরো শহরটাই লাভার্স লেন হয়ে গিয়েছিল।
- হা, হা, হা। হাউ অ্যামিউজ়িং! ব্যুরোক্র্যাটদের শহর একটা!
- ব্যুরোক্র্যাটদের কম ভেবো না। ব্রিটিশ যুগে ছেলেরা শনিবার বিকেলবেলা সেজেগুজে পার্টিতে যাবার পথে একেবারে অচেনা মেয়েদের মুখোমুখি হয়ে যেত। কেউ কাউকে চেনে না, একজন অন্যজনের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আচমকা মিষ্টি সুরে ঘন্টা বেজে উঠত। হঠাৎ দেখা যেত নীম গাছের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে জিনরা রাস্তার পাশে ফাঁকা জমির উপর একটা পুরোনো চার্চ বসিয়ে দিচ্ছে।
পম্পা হাসতে থাকে। - আস্ত চার্চ?
- ব্রিটিশ শহরে তো তাজমহল বসালে ঠিক মানায় না! পুরোনো চার্চটা কোথা থেকে তুলে এনেছে কে জানে। হয়তো আফ্রিকা, কিম্বা স্পেন। চার্চের দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে দিত কোনো পাদ্রী। - কাম, কাম, মাই চিল্ড্রেন, হারি। কেউ এসে পড়ার আগে কাজটা ফিনিশ করে নাও। আর কী? ক্রিশ্চান না হলেও দুজনে এক ছুটে ঢুকে পড়ত অজানা সেই গির্জার ভিতর আর একটু পরে যখন হাতে একটা ছোট ফুলের বুকে নিয়ে বেরোত তখন তাদের গা দিয়ে ঘাম বেরোচ্ছে। চোখের মণির ভিতর দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন যা জিনরা সেখানে ফুঁ দিয়ে ভরে দিয়েছিল। ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য তখন তাদের টাই, আর স্কার্ফ উপড়ে ফেলে ছুটতে হত একটা হোটেল ঘরের খোঁজে।
- অ্যাবসার্ড! এটা মোঘলদের দিল্লী নয়। ব্রিটিশদের শহরকে কেউ কোনোদিন লাভার্স লেন বলবে ভাবাই যায় না।
- সত্যি কি তাই? এই শেষ পাঁচ মিনিটে তোমার কোনো অনুভূতি হয়নি?
- কীসের অনুভূতি?
- এই যেমন রাস্তাটাকে কেউ পালটে দিয়েছে। আমাদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে এটাকে। চার্চ না হোক, আমরা হয়তো তার যোগ্য নই, কিন্তু গাছের উপর থেকে নির্ঘাত কারো হাত এসে একটা ফুলভর্তি ডালের তলায় দুজনের বসার মতো বেঞ্চ রেখে যাবে।
- কোথায় বেঞ্চ? চোখ খুলে দ্যাখ, শুধুই অশ্বত্থ গাছ আর ফুটপাথ, আর পিচের রাস্তা, আর ইঁটের দেয়াল, আর… এটা কী? আমার বান্ধবীর চোখ বেলুনের মতো বিস্ফারিত।
একসঙ্গে এগোতে এগোতে আমরা দেখতে থাকি। রাস্তার বাঁদিকে একটা পুরোনো ক্যাথিড্রাল উদিত হচ্ছিল। লাল চূড়ার উপর ক্রসটা খুব ভালো করেই দেখা যাচ্ছে এবার।
- গুড গড! চার্চই তো দেখছি একটা। পম্পা মুখার্জিকে বলি আমি। - চেহারাটাও পুরোনো খুব। আগে দেখেছ নাকি?
- না তো!
- একটা কলোনিয়াল গন্ধ পাচ্ছি। আফ্রিকারই কি? চলো ভিতরে গিয়ে চেক করে আসি পাদ্রী আছে কিনা। তাহলে…।
পম্পা এদিকে কোনোদিন আসেনি আগে। ক্যাথিড্রাল অব রিডেম্পশানটা তাকে দেখাব বলেই আমি এই রাস্তা ধরেছি। ভেবেছিলাম যীশুর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করব ত্রিশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সে আমাকে তার একমাত্র বয়ফ্রেণ্ড হিসেবে কবুল করতে পারবে কিনা। কিন্তু জিন ফিনের গল্প শুনিয়ে দেওয়ায় সব পণ্ড। পম্পা স্তব্ধের মতো আরো খানিকদূর গিয়ে সেটা যে সত্যিই একটা চার্চ যাচাই করে আসে। সঙ্গে একটা জেনুইন গোরস্থানও আছে। সব দেখার পর সে আমাকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ফিরিয়ে নিয়ে চলল।
পরে গুলাবো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে গাঁট্টা মারতে চেয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে আমরা একটা পূজোবাড়িতে ঢুকে পড়েছি। ধুনোর ধোঁয়া আর ঢাকের শব্দ আমাদের সংযমের দরজা ভেঙে দিচ্ছিল। সেটা সামলাতে গিয়ে আর কার কী মনে থাকে।
প্রতিমা বিসর্জনের দিন এসে যায়। কাহারবা ছেড়ে ধাগেটে তাকেটে করে ঝুমুর তাল বাজাচ্ছে বিষণ্ণ ঢাক। যমুনার ঘাটে সত্তরটা পূজোর ব্যানারের নিচে সত্তর হাজার চলন্ত পুতুলের মতো মানুষ। বালি আর ঘাসের জমিতে প্রতিমা এনে বসাচ্ছে এক একটা কোলোনি। অনেক হাঁটার পর প্রবুদ্ধ আর আমি পার্কটাউনের ব্যানার খুঁজে পেয়েছিলাম। একদিকে লরি আর অন্যদিকে বাস দাঁড় করিয়ে ওরা নিজেদের জায়গাটা আলাদা করে নিয়েছে। এখানে আরেকবার ধুনুচি নাচ হবার কথা। পম্পাকে সেখানে না পেয়ে আমি নিরাশ হয়ে প্রবুদ্ধর সঙ্গে শিমলিপুরের বলদে টানা প্রতিমার বাহনের কাছে ফিরে আসি। মাঝে মধ্যে চেনাজানা আর স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের দেখতে পাচ্ছি। কেউ পরেছে পাঞ্জাবি আর জিন্স্। কেউ পরেছে চুড়িদার। মাইকে চিৎকার। অমুক কলোনির সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে নিজেদের নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসুন, বিসর্জন শুরু হবে এবার। কোথাও বাচ্চাদের হামলায় ভড়কে গিয়ে বিপন্ন মালিককে নিয়ে আইসক্রীমের ঠেলাগাড়ি মেরেছে ছুট। কোথাও বেলুন বিক্রি করছে একটা অদৃশ্য রোবট। অর্ধেক মানুষ যাচ্ছে ডানদিক থেকে বাঁয়ে। অর্ধেক বাঁ থেকে ডাইনে। এমনকি নদীর বালি আর কাঁচের গুঁড়ো মেশানো হাওয়াও দুভাগে ভাগ হয়ে মানুষদের পিছনে ধাওয়া করে চলেছে দুটো বিপরীত দিকে। রাঙালুর মতো সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে টার্টল শেল প্যাটার্নের রোদ চশমার পিছনে লুকোনো দুটো আমাদের বয়সী মেয়ে আলাপ করতে এসেছিল। সেই মুহূর্তেই কান ফাটানো শব্দে কাছাকাছি কোথাও একসঙ্গে গোটা ছয়েক ঢোল বেজে ওঠে। তারপর আমরা কেউ কারো কথা শুনতে পাইনি, এবং স্লো মোশনে চলতে চলতে এক সময়ে সেই সত্তর হাজার বাচ্চা, বুড়ো, নারী পুরুষ, বলদ, লরি সব সমেত পূজোর শেষ দিনটা যমুনার উঁচু পাড় থেকে নিচের কালো শীতল জলের আবর্তে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল।
বান্ধবীর খোঁজে আমি বাস ধরে যতক্ষণে পার্কটাউনে ফিরে গিয়েছিলাম ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। প্যাণ্ডেল জনশূন্য। ওদের পার্টি আগেই ফিরেছিল। শান্তির জল নিয়ে সবাই বাড়ি চলে গেছে। নির্জন গলিগুলো পেরিয়ে গুলাবোদের পাড়ায় পৌঁছলাম। লাল সালোয়ার কামিজ পরে সে দুতলার জানালা দিয়ে রাস্তায় নজর রেখেছিল। আমায় দেখে দুদ্দাড়িয়ে নেমে আসে।
- এতক্ষণ কোথায় ছিলি? ভেবে ভেবে আমাদের মাথা খারাপ। তোর ঘাটে আসার কথা ছিল না? তিনঘন্টা ধরে হন্যে হয়ে খুঁজেছি। খুঁজতে খুঁজতে গায়ে হাত পায়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।
- সেখানেই তো ছিলাম! তিন ঘন্টা আমিও এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো চষে বেড়িয়েছি।
- বাজে বকিস না। এরকম একটা টকটকে লাল জামা তোর চোখ এড়িয়ে গেল?
- বাই গড, এরকম লাল জামা পরা ডজন ডজন মেয়ে এসেছিল। তাদের প্রত্যেকের মুখ আমি লক্ষ বার চেক করেছি। প্রবুদ্ধ ছিল আমার সঙ্গে।
ক্রমশ প্রকাশ হয় আমি আর পম্পা পরস্পরকে একই মেলায় একই সময়ে এক ব্যানারগুলোর তলায় খুঁজেছি। একই পাথরগুলোতে হোঁচট খেয়েছি, একই আইসক্রীমের ঠেলা, বেলুনওয়ালা, চানাওয়ালার চারদিকে ঘুরপাক খেয়ে মরেছি। ইস্কুলের একই ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে পালিয়েছি। কিন্তু অবিকল এক রকম দেখতে হলেও তকদীরের জগতে এই দুটো বিসর্জনের ঘাট আলাদা হয়ে ছিল। কপাল যাদের পৃথক করতে চায় তাদের মনের ইচ্ছের জোর কী করবে? বালির উপর প্রতিমার সামনে আমাকে দেখিয়ে ধুনুচি নাচার শখ গুলাবোর পূর্ণ হয়নি বলে সে আক্ষেপে মরে যাচ্ছিল।
মাসিমা আমাকে মালপোয়া, সন্দেশ, আর ঘুঘনি এনে দিয়েছিলেন। পম্পা খুন খুন করে ভাগ্যকে দোষ দিয়ে যায়। আমি বললাম – কাল একটা পুরোনো আর ভাঙা চার্চ দেখতে যাবে? আমাদের হেরম্ব জ্যাঠা বলেন দ্য চার্চ অব আওয়ার মিস্ফরচুন। সেটাতে যে বছরেই মাস্ হয়েছে তার ছ মাসের মধ্যে চার্চে আগুন লেগেছে। সেই থেকে মাস্ বন্ধ কিন্তু প্রতি রবিবার সার্ভিস হয়।
- এটাও কি আফ্রিকা থেকে জিন এসে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল?
- না। এটা আমাদের শিমলিপুর ব্র্যাণ্ডের মাল।
পম্পাকে বলিনি গীর্জাটা বেশ খালি থাকে। অনেকের বিশ্বাস একমাত্র ভাঙা কপাল যাদের তারাই এই চার্চে গিয়ে নিরাপদে ফিরতে পারে। এতদিন কেন যে যাইনি?
পরের দিন সকালটা আমি আর টোটোদা শিমলিপুরের প্যাণ্ডেল তোলার কাজে লাগিয়ে দিলাম। যতদিন প্রতিমা ছিল ততদিন কাজের লোকের অভাব ছিল না। প্রতিমা গায়েব তো মানুষও অদৃশ্য। হেরম্ব জ্যাঠা তাঁর চেয়েও বুড়ো দু-একজনের সঙ্গে শূন্য মণ্ডপে চেয়ার পেতে বসে সুপারভাইস করছেন। সঙ্গীদের মুখে দাঁত নেই। কথা বলতে গেলে গাল দুটো চুপসে ভিতর দিকে ঢুকে যায়।
টোটোদা কাঠের ফোল্ড করা টেবিল তুলছিল, এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন – তুই ক্যা রা?
- অরিন্দম সেন। টোটোদা নিজের নাম বলল।
- তরে এত বড়ো দেখাইতাসে ক্যান? গত বছর এইটুকুনি দেখছিলাম।
টোটোদা বৈরাগ্য আর বিস্ময়ের একটা উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পর বলে – তখন আপনার চোখে এত মোটা প্লাস পাওয়ারের চশমা ছিল না।
- তবে কী ছিল?
- ছানি। দেখতে পেতেন না। কাছে ডেকে মুখের উপর হাত বুলোতেন।
- অ। এখন ঠিক দেখতে আসি?
- হ্যাঁ। এখন সব ঠিকই দেখছেন।
- তাইলে ক, তর নাম কী?
- আমার মনে নেই। বলে টোটোদা টেবিল সমেত রওনা দেয়।
হেরম্ব জ্যাঠা টোটোদার উপর বিরক্ত হয়ে আমাকে ডেকে নিলেন। তারপর পাশে বসা বৃদ্ধটিকে বললেন – এই ছ্যামরা বেটার। আপনি এরে নাম জ়িগান।
- তর নাম কী?
বললাম।
হেরম্ব জ্যাঠা বৃদ্ধকে উৎসাহ দেন। - ভালো হইতাছে। আরো কিছু জ়িগান।
- তুই ক্যা রা?
ধৈর্য না হারিয়ে নামটা আবার টেনে টেনে উচ্চারণ করি।
হেরম্ব জ্যাঠা খুশি হয়ে গেলেন। – শাবাস! একদিন আমাদের সবার এই অবস্থা হবে, সেইটা মনে রাখবি। জীবনের অভিশাপগুলো মাথা পেতে নিতে হয়।
- আমি নেব না। চলে আসার আগে হেরম্ব জ্যাঠাকে কঠিন সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। - বুড়ো বয়স অবধি বেঁচে থাকতে কেউ জোর করে না। সবাইকে মানায়ও না।
- কী-ই-ই? কী বললি শুয়ার?
টোটোদা দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। ঘাড়ে একটা টেবিল তুলে নিয়ে যেতে যেতে প্রতিজ্ঞা করি পরের বছর থেকে আর এখানে আসব না।
পরে বেলা তিনটে নাগাদ পম্পাকে সঙ্গে করে আমি শিমলিপুরের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আমার বান্ধবী আজ হলুদ টপ আর ব্রাউন প্যান্ট পরে তার ঘর থেকে বেরিয়েছিল। প্যান্টের তলা বেলবটমের মতো ছড়ানো। টপটা উপরে ঝুলিয়ে দিয়ে নিজের দেহভাস্কর্য যথাসাধ্য আড়াল করেছিল সে। আমায় দেখে আগে ভাগে বলেছিল – জানি শিমলিপুরে প্যান্ট পরে গেলে তোর গা জ্বলে, কিন্তু চার্চ বলে কথা। সেখানে একটু আধুনিক হয়ে যাওয়া উচিত।
আমি তাকে বলি – দেখো, তুমি যা ভাবছ সেরকম চার্চ নয়। এখানে কেউ যায় না। কুকুর ঢুকে বসে থাকে। কয়েকটা বুড়োবুড়ি মিলে চালায়। তারা যেদিন থাকবে না সেদিন চার্চও বন্ধ হয়ে যাবে।
- তাহলে আমরা যাচ্ছি কেন?
- কারণ এর পিছনে একটা গোরস্থান আছে। খুব ছোট। যমুনার কাছাকাছি এটাই একমাত্র ক্রিশ্চানদের সিমেটারি।
- হে প্রভু। এই কটা দিন মাত্র আছি দিল্লীতে, আর তুই সিমেটারি দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিস?
- ব্রিটিশরা যাদের সঙ্গে নেয়নি, দিল্লীতে কেউ মনে রাখেনি, এরকম আউটকাস্ট মানুষদের কবরগুলো বুলডোজ় হয়ে যাওয়ার আগে যদি একবার দেখে আসতে চাও তো চলো। নইলে যাবার দরকার নেই। যমুনার ধারের জায়গাটা এত ফাঁকা যে তোমাকে এই পোষাকে নিয়ে যেতে আমার সত্যি ভয় করছে। আমিই চোখ সরাতে পারছি না তো অন্যরা সরাবে কী করে?
- এত ভয়? তাহলে কি আউটফিটটা পালটে ফেলব?
একটু দোনামনায় পড়ে গিয়ে বলি – নাঃ, থাক। পালটিও না। চার্চের ভিতরে অসুবিধে নেই। রাস্তা আর গলি তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাব। বেশি দাঁড়াব না।
পম্পা আবার নিজের ঘরে ঢুকে যায় এবং একটু পরে যখন বেরোয় তখন প্যান্টটা রয়েছে কিন্তু হলুদ টপের জায়গায় প্রায় হাঁটু অবধি ঝুলের একটা ক্রীম রঙের কুর্তা।
- এইবার বল? যদি যেতেই হয়, তাড়াহুড়ো করব না। হাতে সময় নিয়ে সব দেখতে চাই আমি।
উত্তরে বলি – সেম হিয়ার। যদিও আমি চার্চ নয়, অন্য কিছুর কথা ভাবছিলাম।
সুতরাং বকশী রোড ধরে স্কুটারে দুজন যমুনার ধারের শেষ সরকারি কোয়ার্টার অবধি এসেছি। বাকিটা আমি হাঁটতে চেয়েছিলাম। গুলমোহর গাছ থেকে পাখিরা কিচিরমিচির করছিল। রাস্তার ধারে কোথাও ব্রিটিশ যুগের ভাঙা কোয়ার্টার, কোথাও বেবাক টিলা। পুল থেকে কদাচিৎ একটা ঝরঝরে বাস আসছে। গলিটা দেখা যাচ্ছিল, কিছুদিন আগে রাধা কিষনের মন্দির থেকে পম্পা এটার দিকে তার আঙুল বাড়িয়ে দেয়।
যত কাছে এসে পড়ছি আমার বান্ধবীর পেন্সিল দিয়ে সামান্য সাজানো ভুরুদুটো উপরে উঠে যাচ্ছিল। হনহনিয়ে হেঁটে আমরা গলিটাতে ঢুকে পড়ি। ডানদিকে বাজাজের বাংলো, বাঁদিকে টিলা। রাস্তা একদম শুনশান। পম্পা মুখার্জি আমাকে একটা ঠেলা দিয়ে বলে – চার্চ দেখাতে এনেছিস, না অন্য কিছু?
আঙুল দিয়ে গলির একেবারে শেষের আধ-ভাঙা বাড়িটা দেখাই। - ওই দেখো। এখনো ভিতরটা ব্যবহারযোগ্য আছে।
- বাজাজের বাংলোর গলিতেই চার্চ এটা তো বলিসনি আগে?
- তুমি জিজ্ঞেস করলে বলতাম। এটা একটা ঐতিহাসিক পাড়া। এককালে এখানে একটা অন্য ধরনের কলোনি ছিল।
লাল ইঁটের বাড়িটা খুব একটা উঁচু নয়, চওড়াও নয়। তবে গভীর। পাথুরে টিলার মাঝখানে একটা উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা। নীল আকাশের গায়ে আটকে থাকা ধূসর সিমেন্টের ক্রসের দিকে তাকিয়ে আমরা দুজন পরস্পরকে কনুই দিয়ে ছুঁয়ে থাকি। দৃশ্যটার মধ্যে একটা গা ছমছমে অনুভূতি লুকিয়ে ছিল। যেন কারো ছায়া পিছনের সিমেটারি থেকে আমাদের উপর নজর রেখেছে। অথবা চার্চের চূড়ার চারদিকে ধীরভাবে পাক দিয়ে যাওয়া চিলটা আসলে চিল নয়।
- গলিতে বাজাজের বাংলো আর এই চার্চ ছাড়া আর কিছু নেই কেন? পম্পা স্বগতোক্তির মতো মৃদুতম গলায় জিজ্ঞেস করে।
- আগে ছিল। বললাম তাকে। - অন্য স্ট্রাকচারগুলো মেরামতের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ময়লা সাহেবের কাছ থেকে বিনে পয়সায় উপহার পাওয়া বাংলোর মেইন্টেনেন্স ভালো করেছিলেন বাজাজ। চার্চের ভিতরে যাবে কি?
কিন্তু আমার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই আমার বান্ধবী মন্ত্রের নাগপাশে বাঁধা অসহায় প্রাণীর মতো আস্তে আস্তে গীর্জার বিরাট কাঠের দরজা অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল। এক পা পিছিয়ে আমি তাকে অনুসরণ করি। লোহার হাতল ধরে সে দরজাটাকে টেনে খোলার চেষ্টা করল। পাল্লা এত ভারী যে গায়ের জোর লাগিয়েও খুলতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। ভিতর থেকে একঘেয়ে অর্গ্যানের শব্দ ভেসে আসছিল। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। পিছন ঘুরে দরজাটা বন্ধ করতে গেলাম। তারপর যখন আবার সামনের দিকে ফিরেছি তখন পম্পাকেও আর দেখতে পাওয়া গেল না। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য আতঙ্কে আমার হাত পা আড়ষ্ট হয়ে যায়।
- হ্যালো-ও-ও! ফিসফিস করে উচ্চারণ করেছিলাম আমি। আমার গলার স্বর অর্গ্যানের মৃদু আওয়াজের সমুদ্রে ডুবে হারিয়ে গেছে। অনেকটা দূরে চার্চের একেবারে অপর প্রান্তে বেদির উপর রাখা পিতলের বাতিদানগুলোর উপর আলো এসে পড়েছিল। মাঝখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের ব্যবধান। গোলাপ আর রজনীগন্ধার উগ্র, ভ্যাপসা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। নিঃশ্বাস চেপে আমি পা বাড়াতে যাই এবং টের পাই এখান থেকে চওড়া এক একটা ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। আরেকটু হলে ভারসাম্য হারিয়ে গড়িয়ে পড়তাম। ভয়ের চোটে আমার লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। পম্পা কি পড়ে গেল? কিন্তু শব্দ পেলাম না কেন?
অর্গ্যানটা ইনিয়ে বিনিয়ে পুরোনো যুগের কান্নাগুলো গাইছে। প্রায় অনন্তকাল বান্ধবীর সাড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার পর বুঝতে পারি যে চোখ সয়ে যাওয়ার ফলে ক্রমশ আগের চেয়ে ভালো দেখছি। আমার সামনে কাঠের করিডরের দুধারে পিউয়ের বেঞ্চগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবার কিছু বুড়ো আর বুড়ির মাথা দেখা যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে কোনো অল্পবয়সী মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি না।
হাতড়ে হাতড়ে একটা রো খুঁজে নিয়ে কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লাম। সেখান থেকে একটার পর একটা সারি ধরে পম্পাকে সন্ধান করছি এমন সময়ে আমার সামনের বেঞ্চ থেকে একটা বিরাট মুণ্ডু পিছন দিকে আমার জন্য ঘুরেছিল।
এখানে যে কেউ ওৎ পেতে বসে থাকতে পারে সেটা দুঃস্বপ্নেরও অতীত। তার উপরে উৎকট হাসি আর বড়ো বড়ো দাঁত দেখে হাত-পা ঢিলে হয়ে যায়। মুণ্ডুটা যখন কথা বলতে শুরু করে তখন নিচু খাতের গর গর আওয়াজটা আমি চিনেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
- ঘোঞ্চু, তুই কি আমাকে খুঁজছিস? ভুরু নাচিয়ে গুলজ়ারীলাল বাজাজ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।