• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • অশরীরী : গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য

    এক…দুই…তিন…চার…

    আর এক পা। শুধু এক পা এগোলেই পায়েল রান্নাঘরে পৌঁছে যাবে। ওর শোয়ার ঘর থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত কত পা যেতে হয় সেটা ও মুখস্থ করে নিয়েছে, যাতে রাতের অন্ধকারে একবারও চোখ না খুলতে হয়। কারণ চোখ খুললেই…থাক, সে কথা না বলাই ভালো।

    ঠিক পাঁচ পা এগিয়ে পায়েল হাত বাড়িয়ে দিল। দেওয়ালের বাঁ দিকে সুইচবোর্ড। একটু…আর একটু…ওর হাতের চাপ লেগে সুইচ জ্বলে উঠল। ভুতুড়ে ছায়ার জগত নিমেষে মিলিয়ে গিয়ে ঝকঝকে আলোয় সারা রান্নাঘর ভরে গেল। এতক্ষণে পায়েল চোখ খুলল।

    রান্নাঘরের ঘড়িতে রাত তিনটে বাজে। ফ্রিজ খুলে পায়েল ঢকঢক করে ঠান্ডা জল খেল। তারপর মুখ মুছে আলো নেভানোর জন্য হাত বাড়াল। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর সারা শরীর পাথর হয়ে গেল।

    জানলার কাঁচে কার যেন ছায়া পড়েছে…

    পায়েল জানে, ঘুরে তাকালে ও কি দেখতে পাবে। ও ঢোঁক গিলল। চেঁচিয়ে ওর মাকে ডাকতে গেল, কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরল না। বুকের ভেতর জোরে জোরে হাতুড়ি পড়তে লাগল। ধীরে ধীরে পায়েল ঘুরে দাঁড়াল।

    জানলার বাইরে সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। কালো জামা পরা, মাথায় টুপি, মুখের ওপর মুখোশ টানা, শুধু চোখ দুটোয় ভয়ংকর পৈশাচিক দৃষ্টি। পায়েলকে দেখে ও ঠোঁটে একটা আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বলল। পায়েলের সারা গা ঠকঠক করে কাঁপছে। লোকটার চেহারা ও দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু লোকটা ওকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে৷ দু'জনে দু'জনের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। তারপর লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ওর হাতে ধরা চকচকে ধারালো ছুরিটা পায়েল একটু পরে খেয়াল করল।

    “বাঁচাও! বাঁচাও!”

    পায়েল ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। ঘামে ওর সারা গা ভিজে গেছে। অন্ধকারে হাতড়ে জলের গ্লাসটা নিতে গিয়ে সেটা মেঝেতে পড়ে চৌচির হয়ে গেল। দরজার তলা দিয়ে পায়েল পাশের ঘরে আলোর রেখা দেখতে পেল। একটু পরেই ওর মা ঘরের ভেতর দৌড়ে ঢুকে এল।

    “কি হল বাবু? স্বপ্ন দেখেছ?”

    “ও…ওই লোকটা…লোকটা…”

    পায়েলের মা বিছানায় উঠে ওকে জড়িয়ে ধরল।

    “ওই লোকটা আর আসবে না। ও কবেকার কথা! তুমি স্বপ্ন দেখেছ!”

    পায়েল মাথা নাড়ল।

    “ও এখানেই আছে, আমি জানি! আমি বুঝতে পারছি ও এখানে আছে!”

    পায়েলের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শব্দটা পায়েলের বুকে গিয়ে লাগল। ও বুঝতে পারে, ওর কথা বিশ্বাস করা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শান্তিনিকেতন থেকে কোলকাতা, সেখান থেকে আসানসোল, তারপর পুনে আর এখন সিমলা। সব জায়গায় সেই এক ঘটনা। কিছুদিন শান্তিতে থাকার পরেই পায়েলের মনে হয় লোকটা ওকে ধাওয়া করে চলে এসেছে। রাস্তায় বেরলেই মনে হয় পায়েল ওর সামনে চলে আসবে। পায়েল লোকটাকে চেনে না, কিন্তু লোকটা তো পায়েলকে চিনতে ভুল করবে না!

    “আমি ফীল করতে পারছি,” পায়েলের দু'চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল, “লোকটা এখানেই কোথাও আছে!”

    পায়েলের মা দু'হাতে ওর মুখ তুলে ধরল।

    “আমার কথাটা ভালো করে শোন। তোমার সঙ্গে যে ঘটনাটা ঘটেছিল ওটা বারো বছর আগের কথা। তারপর থেকে লোকটা একবারও তোমার সামনে আসেনি। আর আসবেই বা কেন? তুমি তো ওকে চিনতেই পারনি। তোমার ক্ষতি করে ও কিচ্ছু পাবে না। এই অমূলক ভয়টা মন থেকে বের করে দাও।”

    কথা বাড়ানোর কোন মানে হয় না। পায়েল অনেকদিন আগেই বুঝে গেছে যে কেউ ওর দিকটা বুঝবে না। ও আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।

    “আচ্ছা।”

    “আমি কি আজ রাতে তোমার সঙ্গে শোব?”

    “না, আমি ঠিক আছি।”

    পায়েলের মা একটু ইতস্তত করল।

    “বিছানা থেকে নামতে হলে ওধার দিয়ে নেমো। আমি কাল কাঁচটা পরিষ্কার করে দেব।”

    পায়েল বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ল। মা ওর গায়ে লেপ টেনে দিয়ে নিজের ঘরে ফেরত চলে গেল।

    ঘুমিয়ে পড়ার আগে পায়েলের মনে হল জানলা দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল। ও মাথার ওপর লেপ টেনে নিল।

    ***

    পরদিন শনিবার। পায়েলের কলেজে ছুটি। ধীরেসুস্থে বিছানা থেকে উঠে ও পর্দা সরিয়ে জানলা খুলে দিল। সকালের মিষ্টি রোদ আর পাহাড়ের ঠান্ডা হাওয়া একসঙ্গে ওর মুখে এসে লাগল। সামনে সবুজ গাছের সারি। নীচ দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে। খাদের ধারে দুটো বাঁদর বসে কি যেন খাচ্ছে।

    এরকম সকাল হলে লোকটার কথা দূর স্মৃতির মতো মনে হয়। এই শান্তির জায়গা, সুন্দর দৃশ্য, অলস জীবন – এখানে খারাপ কিছু ঘটতে পারে না। আর যাই হোক, লোকটা এখানে আসতে পারবে না।

    “গুড মর্নিং!” মা চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে এল। “কাল ঘুম হয়েছিল?”

    পায়েল মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলল।

    “আজ কালীবাড়িতে পুজো দিয়ে আসব, আর ফেরার সময় তোর জন্য একটা লোহার আংটি নিয়ে আসব।”

    মা মনে করে লোহার আংটি পরে থাকলে মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে না। কিন্তু যার গোটা জীবনটাই একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে, ওই আংটি তার কোন উপকার করতে পারবে কি?

    “আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিই, না?” পায়েল বিসকুটের টিন খুলতে খুলতে মাকে জিজ্ঞেস করল।

    মা অল্প হাসল। “ধুর পাগল! তুই ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি।”

    স্নান সেরে ধোয়া জামা কাপড় পরে পায়েল মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। মল রোড পেরিয়ে গ্র‍্যান্ড হোটেল, আর সেটা পেরলেই মন্দিরের রাস্তা শুরু।

    “ফেরার সময় তোকে ফুচকা খাওয়াব।”

    পায়েল মনে মনে হাসল। প্রথমে কালীবাড়ি, তারপর ফুচকা। মা ওর মন ভালো করার চেষ্টা করছে।

    রাস্তা দিয়ে উঠতে উঠতে মালা, চুড়ি, আংটির দোকানগুলো এসে গেল। মা কথা মতো একটা রুদ্রাক্ষর মালা, আর একটা লোহার আংটি কিনে নিল। আর একটু উঠতেই কালীবাড়ির গেট। বাঙালী আর পাহাড়ি স্টাইল মিশে একটা ছোট্ট অথচ সুন্দর মন্দির তৈরী হয়েছে। এখানে কালীর নাম 'শ্যামলা'। শোনা যায়, এই শ্যামলা থেকেই জায়গাটার নাম 'সিমলা' হয়েছে।

    মা থালা থেকে ফুল, সিঁদুর নিয়ে দেবীর পায়ে ঠেকাচ্ছে। পায়েলও পেছন পেছন প্রণাম করতে গেল।

    কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই অনুভূতিটা বাঘের মতো ওর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবার আর স্বপ্ন নয়। দিনের আলোর মতো বাস্তব। সেই হাড় হিম করে দেওয়া অনুভূতি। যেন পেছন থেকে কেউ ওর ওপর নজর রাখছে। কখন থেকে লোকটা ওকে ফলো করছে? বাড়ি থেকেই? না মল রোড থেকে? পায়েল চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। মন্দিরে কয়েকজন স্থানীয় লোক আর টুরিস্ট ঘুরছে। কাউকেই ও চেনে না। অথবা অনেকদিন আগে চিনত। পায়েলের হাত ঘামতে শুরু করল।

    এটা যখন শান্তিনিকেতনে শুরু হয়েছিল, সবাই বলেছিল 'খুব স্বাভাবিক'। পায়েল রাতে ঘুমতে পারত না, একা স্কুল থেকে ফিরতে পারত না। সব সময় ওর মনে হত ছায়ার মতো কেউ ওকে অনুসরণ করছে। কোথাও কালো জামা পরা লোক দেখলেই ও থরথর করে কাঁপতে থাকত।

    শেষটায় ওর বাবা বিশ্বভারতীর চাকরি ছেড়ে, শান্তিনিকেতনের পাট চুকিয়ে কোলকাতার একটা স্কুলে পড়াতে ঢুকল। পায়েলকেও সেই স্কুলে এক ক্লাস নীচে ভর্তি করে দিল। কিছুদিন শান্তিতে কাটল। তারপর মাধ্যমিকের বছর এল। আবার পায়েলের মনের সেই অজানা ভয় দানা বাঁধতে লাগল। পড়তে বসলে মনে হত ওর চোখের কোণায় একটা কালো ছায়া নড়ছে। মাঝেমাঝে ভিড়ের মধ্যে একটা চাদর মুড়ি দেওয়া লোককে দেখতে পেত।

    মা-বাবাকে সেকথা বললে ওকে একজন সাইকোলোজিস্টের কাছে নিয়ে গেল।

    “আমরা শান্তিনিকেতনে থাকতে আমাদের পাশের বাড়িতে একটা ভায়োলেন্ট খুন হয়েছিল,” পায়েলের বাবা ডাক্তারকে বোঝাতে লাগল। “পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলাকে কেউ গলা কেটে মার্ডার করেছিল। আমার মেয়ের তখন বারো বছর বয়স। ও খুনীকে দেখে ফেলে…”

    আরো অনেক কথা বলেছিল বাবা। ডাক্তার পায়েলকে কিছু প্রশ্ন করে বাইরে বসতে বলেছিল। যাওয়ার সময় পায়েলের কানে 'প্যারানয়েড হ্যালুসিনেশন' কথাটা এসেছিল।

    ডাক্তারের চেম্বারে বসে সেদিন পায়েল হাউহাউ করে কেঁদেছিল। ও কি করে বোঝাবে, ও কিছু হ্যালুসিনেট করে নি? সত্যিই ও লোকটাকে দেখেছিল? এখনো সত্যিই ও লোকটার উপস্থিতি টের পাচ্ছে। কেমন করে পাচ্ছে তা জানেনা। কিন্তু পাচ্ছে। লোকটা তক্কে তক্কে আছে। ওর প্রতিশোধ পূরণ না করে ও থামবে না।

    পরদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে পায়েল থানায় গেছিল।

    “আমি রিপোর্ট লেখাতে চাই।”

    “কার বিরুদ্ধে?”

    “…জানি না…”

    থানার ও সি কলম বন্ধ করল।

    “জান না?”

    “আমি একজন খুনীকে দেখেছি।” শান্তিনিকেতনের সব ঘটনা পায়েল খুলে বলল। ও সি কিছুক্ষণ বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রইল।

    “তুমি খুনীর মুখ দেখতে পাওনি?”

    “না, কিন্তু খুনী আমাকে দেখতে পেয়েছিল! আপনি ফাইলটা দেখবেন, সব লেখা আছে।”

    “হুঁ…তুমি যে বলছ খুনী তোমাকে ফলো করছে, তা তুমি কি কাউকে ফলো করতে দেখেছ?”

    “না…হ্যাঁ…জানি না! আমি তো ওকে চিনি না!”

    “কেউ তোমার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে?”

    “না।”

    “কেউ জোর করে তোমার বাড়িতে ঢুকেছে? হুমকি দিয়ে চিঠি লিখেছে?”

    “না! এসব কিচ্ছু হয়নি, কিন্তু আমি জানি ও আমার ওপর নজর রাখছে!”

    ও সি খাতা বন্ধ করে টেবিলের ওপর দু'হাত রাখল।

    “কেউ যদি তোমার ক্ষতি না করে থাকে তাহলে আমি কিসের ভিত্তিতে রিপোর্ট লিখব? তুমি কারুর নাম পর্যন্ত দিতে পারছ না। আমি শান্তিনিকেতন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলে কেসটার স্ট্যাটাস চেক করে নেব, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার আর কিছু করার নেই।”

    পায়েলের মনের শেষ আশাটাও ধীরে ধীরে নিভে গেল।

    “তার মানে লোকটা আমার ক্ষতি করার আগে অবধি কিছুই করা যাবে না?”

    ও সি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।

    “যদি সেরকম মনে হয় তাহলে একটা বডিগার্ড ভাড়া করতে পার।”

    পায়েল উঠে পড়ল। কোনরকমে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। তারপর বাড়িতে জানিয়ে দিল, ও কোলকাতার বাইরের কোন স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক পড়বে। এবার আর বাবার পক্ষে ওদের সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হল না। পায়েল আর ওর মা আসানসোল চলে গেল। সেখান থেকে পুনেতে। কিন্তু যেখানেই যায় ওই লোকটার অশরীরী ছায়া ওকে তাড়া করে বেড়ায়। রাতে পায়েলের স্বপ্নে এসে ওকে ভয় দেখায়। ঠোঁটে একটা আঙুল ঠেকিয়ে ওকে চুপ করে থাকতে বলে।

    পায়েল যখন রাতে একা একা বিছানায় শুয়ে থাকে, তখন ওর মনে হয় সেই রাতে আরো কিছু ঘটেছিল। কোন একটা স্মৃতি ওর মনের গভীরে লুকিয়ে আছে। মাঝেমাঝে মাকড়সার জালের মতো একটা নকশা ভেসে ওঠে, কিন্তু ধরার চেষ্টা করলেই মিলিয়ে যায়। ও ভাবে, সেই রাতে জানলার বাইরে লোকটাকে দেখার পরে ও কি করেছিল? আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল? ওর বাবা মাকে ডাকল না কেন? লোকটা চুপ করতে বলেছিল বলে? ও কি ভয় পেয়েছিল, যে ওর মা বাবাকে ডাকলে লোকটা সবাইকে খুন করে দেবে? নাকি ও সবটাই স্বপ্ন দেখেছিল? প্যারানয়েড হ্যালুসিনেশন?

    এক এক সময়ে পায়েলের মনে হয় ও সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।

    “চল, ফুচকা খাই।”

    মা পুজোর থালা হাতে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পায়েল মাথা নাড়ল।

    “পরে একদিন খাব। আজ বাড়ি চল।”

    “ঠিক আছে তাহলে।”

    মা গেটের দিকে পা বাড়াল। যেন আরো একবার পায়েল সবাইকে হতাশ করেছে।

    দু'জনে চুপচাপ ঢালু রাস্তা দিয়ে নামতে লাগল। মল রোড পৌঁছে মা পুজোর থালাটা পায়েলের হাতে ধরিয়ে দিল।

    “তুই বাড়ি যা, আমি একটু বাজার হয়ে আসছি।”

    পায়েলের বুক ঢিপঢিপ করে উঠল।

    “আমি একা বাড়ি যাব?”

    “ভয় করছে? তাহলে আমার সঙ্গে আয়।”

    সেটা আরো ভয়ংকর।

    বাজারে কত লোকের ভিড়। তাদের মধ্যে যে কেউ সেই অচেনা খুনী হতে পারে। নাঃ, পায়েল যত তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে যেতে পারবে ও ততই নিরাপদ থাকবে। ও একবার ভাবল মাকে বলে, ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর বাজারে যেতে। কিন্তু ও জানে, মা ওর কথা শুনবে না। মা তো ওর কথা বিশ্বাসই করে না, মনেই করে না লোকটা এই সিমলার আনাচে কানাচে কোথাও লুকিয়ে আছে।

    ওকে মাঝেমাঝে একা ছেড়ে দিন, ডাক্তার বলেছিল, ওর ভয়টা কাটাতে সাহায্য করবে।

    পায়েল আশেপাশে তাকাল। মল রোডে মানুষের মেলা। কিন্তু গত এক বছরে ওর কোন বিপদ হয়নি। রাত ন'টাতেও ইভিনিং কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেছে। হয়তো সত্যিই লোকটা এখানে নেই। হয়তো আজও ও প্রাণে বেঁচে যাবে।

    মা অলরেডি বাজারের দিকে চলে গেছে। পায়েল বাড়ির দিকে পা চালাল। মাঝেমাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকল কেউ ফলো করছে কি না। দূরে একটা লোক ওর পেছন পেছন আসছে। এটা বড় রাস্তা, অনেকেই এদিকে আসতে পারে। তবু্ও পায়েল হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। পেছনে তাকিয়ে দেখল লোকটা ওর সঙ্গে সমান দূরত্ব রেখে হাঁটছে। পায়েল গুনতে লাগল।

    এক…দুই…তিন…চার…

    আর কুড়ি পা গেলেই ও ওর বাড়ির গলিতে ঢুকে যাবে। পায়েল চোখ বন্ধ করে নিল। ঠিক কুড়ি পা গিয়ে ও বাঁ দিকে ঘুরল। তারপর একটা বাড়ির আড়ালে লুকিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ বাদে দেখতে পেল লোকটা রাস্তা দিয়ে সোজা হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে। পায়েল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

    থালাটা এক হাতে ব্যালেন্স করে ও বাড়ির চাবি বের করল। তারপর গলি দিয়ে হেঁটে গিয়ে ওর বাড়ির সামনে দাঁড়াল। কি একটা অস্বস্তি ওর মাথার মধ্যে মাছির মতো ভনভন করছে। জানলার পর্দাটা কি বেরনোর আগে এরকমই ফাঁক করা ছিল? থাকবে হয়তো। তাড়াহুড়োয় বেরনো হয়েছে। পায়েল দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তারপর থালাটা ঠাকুরের সামনে রেখে প্রণাম করল।

    কোথাও একটা জানলা বন্ধ হওয়ার শব্দ হল। পায়েলের বুকের ভেতর ফের দুরমুশ শুরু হয়ে গেল। শব্দটা কি ওর বাড়ির ভেতর থেকে এল, না পাশের বাড়ির?

    ক্যাঁচ…

    দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। এবার আর কোন সন্দেহ নেই। শব্দটা রান্নাঘর থেকে এসেছে।

    এই ঠান্ডাতেও পায়েলের কপাল থেকে এক বিন্দু ঘাম নেমে এল। একবার মনে হল, খোলা জানলা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু ওদিকের রাস্তা অনেক নীচে। পড়লে বাঁচার কোন উপায় নেই। কোন উপায় নেই। নিজের সবটুকু সাহস একত্র করে ও পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে এল। রান্নাঘর একতলায়, কাজেই লোকটা এই মুহূর্তে দোতলায় নেই। নিঃশব্দে পায়েল সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরের ঘর। এখনো লোকটা ওকে দেখতে পায়নি। আর একটু গেলেই দরজা। তারপর মুক্তি! চেঁচিয়ে ও লোক জড়ো করবে আর তারপর-

    “সারপ্রাইজ!”

    বাবা?

    পায়েল থমকে গেল। দুমদুম করে পায়ের শব্দ এসে পায়েলের সামনে থামল। সত্যিই বাবা। পায়েলের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

    “গরমের জন্য ক'দিন আগেই ছুটি পড়ে গেল। তাই ভাবলাম তোদের চমকে দেব। মা কই?”

    পায়েল আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলল। ও ভুলেই গেছিল বাবার কাছে বাড়ির এক সেট চাবি আছে।

    “বাজারে গেছে। এক্ষুনি আসবে।”

    বাবার চোখে দুষ্টুমি খেলে গেল।

    “আমি রান্নাঘরে কফি বানাতে যাচ্ছি। মা এলে বলিস না আমি এসেছি। সারপ্রাইজ দেব!” বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবা ঠোঁটে একটা আঙুল ঠেকাল।

    পায়েলের মনে হল যেন ও কয়েক'শ ভোল্ট কারেন্টের ঝটকা খেয়ে গেল। যেন উলটে রাখা ঝুড়ির তলা দিয়ে বিষাক্ত কেউটে সাপ ফনা তুলে বেরিয়ে এসেছে।

    না…আসম্ভব…

    ওর অনিচ্ছুক চোখের সামনে দেখতে দেখতে একটা ছবি তৈরী হয়ে গেল।

    রাত বারোটা। মা শুয়ে পড়েছে। পায়েল রান্নাঘরে জল খেতে ঢুকেছে। এমন সময় জানলার কাঁচে কার যেন ছায়া পড়ল। পায়েল ঘুরে দাঁড়াল।

    বাবা? কিন্তু বাবা তো কোলকাতা গেছে ঠাম্মার সঙ্গে দেখা করতে!

    বাবা ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে পায়েলকে চুপ করতে বলল। তারপর পাশের বাড়ির দিকে রওনা দিল। হাতে একটা চকচকে ধারালো ছুরি…

    পায়েলের চোখের সামনেটা সাদাকালো হয়ে গেল। ও পিছিয়ে গিয়ে প্রায় ধাক্কা খেয়ে সোফার ওপর বসে পড়ল। বাবা এক পা এক পা করে ওর দিকে এগিয়ে এল। পায়েল আগে খেয়াল করেনি ওর বাবা কতখানি লম্বা চওড়া মানুষ।

    “কি হয়েছে বাবু?” বাবা মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল। “শরীর ভালো নেই?”

    পায়েলের গলা আটকে আসছে।

    “তুমি…সেদিন…”

    একটু একটু করে ওর বাবার মুখের অভিব্যক্তি পালটে গেল।

    “সেদিন? কোনদিন?”

    “তুমি কোলকাতা যাওনি…”

    বাবা পায়েলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে চলে এল। হিসহিসে গলায় বলল,

    “কতবার বলেছি না, ওসব কথা না ভাবতে? সেদিন কিচ্ছু হয়নি। তুমি বিছানায় ঘুমচ্ছিলে। সবটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলে। বুঝেছ?”

    পায়েল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বাবা ওর দু'কাঁধ ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিল।

    “এখনো যদি না বুঝে থাক তাহলে এবার তোমাকে পাগলাগারদে পাঠাতে হবে।”

    কলিং বেল বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বাবা পায়েলের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিল।

    “চোখ মুছে নাও,” ফিসফিস করে বলে বাবা দরজা খুলতে গেল।

    পায়েলের কান ভোঁ ভোঁ করছে। দরজা থেকে মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে এল। বাবা উত্তরে কি যেন বলল। মা হাসল।

    “কি রে, বাবা এত দূর থেকে এসেছে এক কাপ চা-ও করে দিস নি?” মা ঢুকতে ঢুকতে বলল।

    পায়েল বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

    “ও আমাকে দেখবে বলে এক্সপেক্ট করেনি তো, তাই চমকে গেছে!”

    বাবা এমন সহজভাবে বলল, যেন একটু আগে পায়েলের সঙ্গে খোশগল্প করছিল। নিজের সব শক্তি দিয়ে পায়েলও নিজেকে সামলে নিল। মায়ের হাত থেকে শপিং ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে চা বানাতে গেল। জানলা দিয়ে দেখল, আকাশে ঘন মেঘ নেমে এসেছে। সকালের ঝকঝকে রোদের চিহ্নও আর নেই।

    দুপুরবেলা তিনজনে মিলে খেতে বসল। বাজারে কোন সবজির কি দর হয়েছে তাই নিয়ে মা গজগজ করতে লাগল। বাবা মাঝেমধ্যে হুঁ হাঁ করছে। পায়েল ওর প্লেট থেকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না।

    “ওহ, ভুলেই গেছি,” মা প্লেটে পনীরের সবজি ঢেলে নিয়ে বলল, “আজ সন্ধেবেলা মিসেস রায়নার বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্ন আছে।”

    পায়েল ওর চামচটা জোরে চেপে ধরল। মা আজ সন্ধেবেলা থাকবে না? পায়েলকে কি সারা সন্ধে বাবার সঙ্গে থাকতে হবে?

    “তুমিও চল না,” মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে ওনাদের আলাপ করিয়ে দেব।”

    “হ্যাঁ ভালোই তো,” বাবার গলায় হালকা সুর, “চল গিয়ে আলাপ করে আসি।”

    স্বস্তিতে পায়েলের আঙুল আলগা হয়ে চামচটা ঠক পড়ে গেল। ও খেয়ালই করেনি কতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিল।

    বিকেল হতে না হতে মা-বাবা তৈরী হয়ে নিল। আকাশে মেঘ ঘন হচ্ছে। মা বেশী দেরী করতে সাহস পেল না।

    “একা বাড়িতে ভয় পাবি না তো?” মা পায়েলকে জিজ্ঞেস করল।

    পায়েল একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। চোখ না তুলেই মাথা নাড়ল।

    “তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুরে এস।”

    এই প্রথম ও একা বাড়িতে সবচেয়ে নিরাপদ ফীল করবে।

    একটু পরে দরজা টানার আওয়াজ পাওয়া গেল।

    এটাই সুযোগ।

    পায়েল খাটের তলা থেকে ওর সুটকেসটা বের করল। কিছুক্ষণ হাতড়ানোর পর ওর পুরনো ডায়েরিটা খুঁজে পেল। কিছুক্ষণ ডায়েরি ঘাঁটার পর ফোন নম্বরটাও জোগাড় হয়ে গেল। অন্ততঃ বারো বছর আগের নম্বর। আজও সচল আছে কি না কে জানে। তবু পায়েল একবার চেষ্টা করে দেখল। হ্যাঁ, ফোনটা বাজছে। তিনটে রিঙের পর শোনা গেল,

    “চীফ ইনস্পেকটর সায়নদীপ মিত্র স্পিকিং।”

    “সায়ন আংকেল? আমি পায়েল বলছি।”

    পায়েলের মনে হল সায়ন আংকেলের ওকে প্লেস করতে একটু সময় লাগল। তারপর বাতি জ্বলে উঠল।

    “আরে পায়েল! কি খবর? এখন কোথায় আছ? কি করছ?”

    “ভালো আছে গো। সিমলায় আছি। ইভিনিং কলেজে পলিটিকাল সায়েন্স পড়ছি।”

    “বাঃ, খুব ভালো খবর!”

    সায়ন আংকেল সহজভাবে কথা বললেও গলায় একটা প্রশ্ন রয়েছে। এতদিন বাদে হঠাৎ? পায়েল ঢোঁক গিলল।

    “তোমার শ্রীতমা ঘোষের মার্ডার কেসটা মনে আছে?”

    ফোনে সায়ন আংকেলের গলাটা একটু সাবধানী শোনাল।

    “হ্যাঁ, মনে আছে।”

    “কেসটা কি সলভ করা গেছে?”

    “না, এখনো ওটা কোল্ড কেস হয়ে রয়েছে।”

    পরের প্রশ্নটা করার আগে পায়েল একটা গভীর নিঃশ্বাস নিল।

    “ওই কেসটার সঙ্গে কি আমার বাবার কোন যোগাযোগ ছিল?”

    মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। পায়েল ভাবল বোধহয় লাইন কেটে গেছে। তারপর, যেন বহু দূর থেকে, সায়নদীপের গলা ভেসে এল।

    “এটা আমার বলা উচিৎ নয়, কিন্তু যেহেতু বহু বছর কেটে গেছে…আর কেসটার ব্যাপারে নতুন এভিডেন্স আসার সম্ভাবনাও নেই…ওয়েল, শ্রীতমা ঘোষের সঙ্গে অনেক পুরুষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। তোমার বাবার নামও সেই সূত্রে এসেছিল। কিন্তু কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।”

    কান ফাটা বাজের আওয়াজের সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি নামল। আলোটা দু'বার মিটমিট করে ঝপ করে নিভে গেল। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল। চমকে উঠে পায়েলের হাত থেকে ফোনটা পড়ে দু'টুকরো হয়ে গেল। সেটাকে কুড়িয়ে জোড়া লাগাতে লাগাতে লাইন কেটে গেল।

    পায়েল আর কল ব্যাক করল না। ও জানে না সায়ন আংকেলের কথা ও আর শুনতে চায় কি না।

    অন্ধকারে বসে পায়েল চিন্তা করতে লাগল। ও ক্রমশই নিশ্চিত হচ্ছে, আজ যে ছবিটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেটা ওর কল্পনা নয়, সত্যিকারের স্মৃতি। তার মানে যে অচেনা, অবয়বহীন খুনীকে ও সারা জীবন ভয় পেয়ে এসেছে সে ওর পাশেই ছিল? ও যে ঘরে একা শুত তার পাশের ঘরেই ঘুমত? স্কুল থেকে ফেরার সময় ওর পাশে পাশে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটত? সেদিন রান্নাঘর থেকে ও ওর বাবাকেই দেখেছিল?

    তাই ও কাউকে কিছু বলেনি। শ্রীতমা ঘোষের সঙ্গে ওর বাবার যোগাযোগ ছিল। সেই রাতের ঘটনার সঙ্গে ওর বাবার যোগাযোগ ছিল!

    কিন্তু সায়ন আংকেল বলেছে, ওর বাবার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আজ বারো বছর পরে প্রমাণ জোগাড় করা সম্ভবও নয়। এখন যদি পায়েল ওর বয়ান বদলায়, কোন লাভ হবে না। মাঝখান থেকে পায়েলকেই ওর বাবা পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেবে। পায়েলের কানের কাছে বেজে উঠল “প্যারানয়েড হ্যালুসিনেশন”।

    বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। তার শব্দ ভেদ করে পায়েলের কানে একটা আওয়াজ এল। এক মুহুর্ত পরে ও বুঝল, সেটা দরজা খোলার আওয়াজ।

    বাবার কাছে বাড়ির চাবি আছে।

    পায়েল নিঃশব্দে দোতলা থেকে নেমে রান্নাঘরে চলে গেল। কাউন্টারের ওপর রাখা মাছ কাটার ধারালো ছুরিটা তুলে নিল। বাবা বাইরের ঘরের কোন একটা আসবাবে ঠোকা খেয়ে অস্ফুটে “উঃ” বলে উঠল।

    পায়েল বাইরের ঘরে গেল। বাবা কোথায় আছে ও জানে না, কিন্তু গত এক বছর ধরে ও এই বাড়িতে থেকেছে। ঘরের প্রত্যেকটা কোণার সঙ্গে ও পরিচিত। তুলনায় বাবা দিন সাতেকের বেশী এই বাড়িতে থাকেনি। পায়েল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজার দিকে এগোতে থাকল। এক মুহূর্ত পরে বিদ্যুতের আলোয় ও দেখতে পেল বাবা একেবারে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার দৃষ্টি ওর হাতে ধরা ছুরির দিকে।

    “শোন,” বাবা চাপা গলায় বলল, “আমার হাতে বেশী সময় নেই। তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”

    “আমারও তোমার সঙ্গে অনেক কথা বলার আছে।”

    পায়েলের গলার স্বর শনে ওর বাবা থমকে গেল।

    “সেদিন রাতে তুই যা দেখেছিলি-”

    “সব ঠিক দেখেছিলাম। সেদিন তোমার কোলকাতায় ঠাম্মার কাছে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তুমি রাতে শান্তিনিকেতন ফিরে এসেছিলে। শ্রীতমা আন্টির সঙ্গে দেখা করার জন্য। আমি রান্নাঘরে জল খেতে গেছিলাম। জানলা দিয়ে তোমাকে আমি দেখে ফেলেছিলাম। তুমি ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে আমাকে চুপ করতে বললে। তারপর তুমি শ্রীতমা আন্টির বাড়ি গিয়ে ঢুকলে। আমি জানি, কারণ আমি তোমার পেছন পেছন গেছিলাম!”

    বাবার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে।

    পায়েলের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। অনেক দিনের ভুলে থাকা স্মৃতির দানব আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে।

    বারো বছরের পায়েল খুব ভালোই জানত বউকে লুকিয়ে রাত বারোটার সময় কেন একজন পুরুষ একজন মহিলার বাড়ি যায়। তার তিনদিন পর…

    রাত তিনটের সময় পায়েল ওর কালো বর্ষাতিটা পরে নিল। রান্নাঘর থেকে মাছ কাটার ধারালো ছুরিটা সঙ্গে নিল। জানলার কাঁচে নিজেকে একবার দেখে নিল – কালো বর্ষাতি পরে, মাথায় কালো টুপি, চোখে একটা পৈশাচিক দৃষ্টি – যেন ওর মুখের ওপর মেলায় কেনা রাক্ষসের মুখোশটা কেউ টেনে দিয়েছে।

    রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পায়েল শ্রীতমা ঘোষের বাড়ি চলে গেল। তিন চারবার বেল বাজানোর পরে বাড়ির ভেতর একটা আলো জ্বলল। কিছুক্ষণ পরে শ্রীতমা নাইটি পরে এসে দরজা খুলল। পায়েলকে দেখে একটু অবাক হল।

    “তুই? কি হয়েছে?”

    পায়েল আগের থেকেই উত্তর তৈরী করে রেখেছিল।

    “মা…আমার মা খুব অসুস্থ! একবার একটু এস!”

    শ্রীতমা ওদের বাড়ির দিকে তাকাল। তারপর বলল,

    “ভেতরে আয়। আমি হাউসকোট চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

    পায়েল শ্রীতমার পেছন পেছন ওর বাড়ির ভেতর ঢুকল। শ্রীতমা বেডরুমের দিকে চলে গেল। পায়েল ওর পিছু নিল। শ্রীতমা ঝুঁকে পড়ে মেঝে থেকে হাউসকোটটা তুলতে যাবে এমন সময় পায়েল পেছন থেকে ওর মুখ চেপে ধরল। তারপর ছুরিটা ওর গলায় বসিয়ে দিল।

    শ্রীতমার গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরল। তারপর ফিনকি দিয়ে রক্তের সঙ্গে ওর শরীরটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

    কাজ শেষ করে পায়েল শ্রীতমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঢুকে ছুরি আর বর্ষাতি ধুয়ে মেলে দিল।

    পায়েলের বাবা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

    “ছুরিটা আমাকে দিয়ে দে বাবু, কারুর লেগে যেতে পারে।”

    পায়েল মাথা নেড়ে 'না' বলল। বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

    “তুই এসব কথা কেন মনে করিস, বাবু? যতবার তোর মনে পড়েছে কষ্টই পেয়েছিস। তাহলে কেন ভুলে থাকিস না?”

    “কারণ ভুলে থাকাটা অন্যায়!”

    “অন্যায়…আচ্ছা, মানছি অন্যায়। কিন্তু মানুষের তো ভুল হয়ে যায়। তুই একটা ভুল ক্ষমা করতে পারবি না?”

    “কেন ক্ষমা করব?” পায়েল ঝাঁঝিয়ে উঠল। বাইরে বৃষ্টি আরো জোরে পড়তে লাগল। “একই ভুলের জন্য শ্রীতমা আন্টিকে যখন মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি তখন তোমাকে কেন ক্ষমা করব?”

    প্রথমবার পুলিশকে বয়ান দেওয়ার সময় পায়েল জেনেশুনে মিথ্যে কথা বলেছিল। কিন্তু তারপর, কোন একদিন থেকে, ওর সত্তা ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেল। একটা সত্তা ওর মিখ্যেটা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিল। আর একটা ছায়া সত্তা – কালো বর্ষাতি পরা, রাক্ষসের মুখোশ আঁটা খুনী সত্তাটা – চেপে রাখা স্মৃতির জুজু হয়ে ওকে তাড়া করতে শুরু করল। কোন অব্যাহতি নেই। শান্তিনিকেতন থেকে কোলকাতা, সেখান থেকে আসানসোল, তারপর পুনে, এখন সিমলা…পায়েল যেখানেই যায়, যতদূরেই পালায়, ওর ছায়াসঙ্গী ওকে ঠিক খুঁজে বার করে। অতর্কিতে আক্রমণ করে ওর বুকের ওপর চেপে বসে।

    “আমি ভয় পেয়ে পেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি!” পায়েল বাবার দিকে ছুরি নিয়ে এক পা এগিয়ে গেল। “তোমাকে না মারা অবধি ও আমাকে ছাড়বে না!”

    “…বাবু…”

    “ওকে তাড়ানোর একটাই উপায় আছে।”

    পায়েল ছুরিটা নিজের বুকের দিকে ঘুরিয়ে দিল।

    “না!” বাবা ছুটে এসে পায়েলের হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করল। “এটা কি করছিস? এরকম করিস না!”

    পায়েল বাবার হাত ছাড়াতে চেষ্টা করতে লাগল।

    “আমাকে মরতে দাও বাবা, আমি আর এভাবে বাঁচতে পারছি না!”

    “না! তুই কেন মরবি? তুই আমাকে মারতে চাস তো? দে, আমাকে ছুরি দে আমি সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করছি! আই প্রমিস! তুই যেমন চাইছিস তাই হবে! কিন্তু তুই নিজের ক্ষতি করিস না! দে ছুরি দে!”

    “সত্যি? সত্যি তুমি আত্মহত্যা করবে?”

    “সত্যি! একদম সত্যি!”

    কিন্তু পায়েল ওর বাবার হাতে ছুরিটা দিল না।

    চেঞ্জ অফ প্ল্যান। আমরা বাবাকে মারতে পারব না।

    কেন পারব না? ওর ভেতরের লোকটা ঠান্ডা গলায় জবাব দিল। বাবাকে আমরা ঘেন্না করি। শ্রীতমা ঘোষকে মেরে তার পরের দিন বাবাকে মারার প্ল্যান ছিল আমাদের! দু'জনের সঙ্গে দু'রকম আচরণ করলে আমরা হিপোক্রিট হয়ে যাব!

    কিন্তু মা? মা'র কি হবে? মা-কে দুঃখ থেকে বাঁচানোর জন্যই আমরা সেদিন শ্রীতমা আন্টিকে মেরে এসেছিলাম। মা তো বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবে না!

    লোকটা চুপ করে রইল।

    মা কোন দোষ করেনি! মাকে শাস্তি দিলে সেটা অন্যায় হবে না?

    লোকটা একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

    বেশ, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু মনে রেখ, আমার প্রতিশোধ পূরণ না হওয়া অবধি আমি তোমাকে ছাড়ব না!

    পায়েল হেসে উঠল।

    “এসব ঘটনা আগেও অনেকবার ঘটেছে, তাই না বাবা?”

    যেমন হঠাৎ নেমেছিল, তেমনি হঠাৎ বৃষ্টিটা ধরে এল। বাড়ির বাইরে ছপ ছপ পায়ের আওয়াজ এল। কারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

    জেগে ওঠা দানবটা ঢুলতে শুরু করল। পায়েল যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই অল্প অল্প দুলতে লাগল। তারপর হঠাৎ যেন তার সম্বিৎ ফিরল।

    “বাবা!”

    হাতের ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পায়েল বাবাকে জড়িয়ে ধরল।

    “ওই লোকটা এখানে এসেছিল বাবা! তোমরা যখন ছিলে না তখন। আমার খুব ভয় করছে বাবা! আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও!”



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments