আজ দেখলাম ভদ্রলোককে। লম্বায় আমার মাথায় মাথায়, রোগা কিছুটা, মাথার চুল আমারই মতো পাতলা হয়ে এসেছে। অবসরের পর এই অভিজাত হাউসিং কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট কিনে মাসদুয়েক হল এসেছি। এখানে আসার পরেই শুনেছিলাম, ঠিক আমারই মতো দেখতে আরো একজন থাকেন এখানে। প্রথমদিকে সিকিউরিটির অনেকেই আমার নামটা ভুল করত। শুধরে দেওয়াতে বলত একরকম দেখতে আরো একজন থাকাতেই ওদের ভুল হয়। ভাবতাম কী আশ্চর্য, সিকিউরিটিরও ভুল হচ্ছে? এতটাই একরকম দেখতে দুজনকে? শুনেছি একই রকম দেখতে মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে অন্তত সাত জন। কিন্তু এত বড় পৃথিবীতে আমার মতো দেখতে আরো একজন এত কাছেই পেয়ে গেলাম ভাবতেই প্রথম প্রথম বেশ রোমাঞ্চ হল। সাথে অবশ্য একটু ভয়ও হল। কেউ কেউ বলে অবিকল একইরকম দেখতে মানুষের দেখা পাওয়া নাকি ভালো নয়। এরা নাকি প্রতিরূপ বা ছায়ামানুষ। দেখা হলে এদের একজনকে নাকি চলে যেতে হয়। কিন্তু কোথায় যেতে হয়? মৃত্যুর কোন অদৃশ্য যোগাযোগ আছে কি এই দেখা হওয়ার ঘটনায়? আমি অবশ্য এসব মিথ বিশ্বাস করি না। তবে চিন্তার বিষয় হল সেই ভদ্রলোক আমাকে দেখলে ব্যাপারটা কীভাবে নেবেন। যাই হোক আজ হঠাৎই দেখে ফেললাম তাঁকে। বরং বলা ভালো তিনিই প্রথমে দেখলেন আমাকে।
সকালে আবাসনের খুঁটিপুজোর অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম এখানকার সেন্ট্রাল গ্রীনে, মানে হাউসিং-এর মাঝের এক ফালি সবুজ লনে। হাল্কা রোদে একটা শামিয়ানার নিচে ঠাকুরমশাই পুজো করছেন। তার চারদিকে মহিলারা এবং বয়স্ক লোকজন বসে আছেন চেয়ার পেতে। কাছাকাছি কিছু মাতব্বর গোছের পুরুষ পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নতুন এসেছি বলে আমি এখানে বিশেষ কাউকে চিনি না। মহিলারা দেখলাম এসব পরিচয়ের ব্যাপারে অনেক এগিয়ে থাকেন। আমার স্ত্রী গিয়ে ওই মহিলাদের মাঝখানে বসে অবলীলায় গল্পগাছা শুরু করলেন। দু’-একজন তো তাঁকে দেখে হাসলেনও। বোধহয় এর মধ্যেই কখনও আলাপ হয়েছিল। আমি উদ্দেশ্যহীন ভাবে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। নজরে পড়ল এক জায়গায় চা ও জলের ব্যবস্থা রয়েছে। ভাবলাম চা খেয়ে সময় কাটানো যেতে পারে। চিনি ছাড়া কালো চা খাই আমি। তাই বানানো চা খেতে পারি না। তবে এখানে দেখলাম চিনি দুধ আলাদা রাখা রয়েছে। যার যেমন দরকার নিয়ে নিতে পারে। একটা কাগজের কাপ নিয়ে স্টিলের চায়ের ডিস্পেন্সারের নিচে কল খুলে কালো চা নিচ্ছিলাম। আমার মন ও দৃষ্টি দুইই নিবদ্ধ চায়ের দিকে, যাতে চা ঢালতে গিয়ে উপচে না পড়ে। কাপ ভর্তি হয়ে আসাতে কলটা বন্ধ করতে যাব এমন সময় পিছন থেকে কারো আওয়াজ এল ‘বন্ধ করবেন না প্লিজ।’ দেখলাম আরেকটি কাগজের কাপসুদ্ধু হাত এগিয়ে এল চায়ের কলের নিচে। তার অন্য হাতে কিছু কাগজপত্র ধরা। ওনার চা নেওয়া হলে কল বন্ধ করে ঘুরতেই দেখলাম ভদ্রলোককে। আকাশরঙা পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরা, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। সাথে একটা মিষ্টি গন্ধও নাকে এল। এখনকার ডিও, পারফিউম ইত্যাদি নয়। খুব চেনা পুরনো একটা সেন্টের গন্ধ। এখনও পাওয়া যায় নাকি এই সেন্ট? ছোট থাকতে কখনো কখনো আমি মায়ের শিশি থেকে ব্যবহার করতাম এই গন্ধ। মা-বাবা সহ আমার পুরো ছেলেবেলাটা মনে পড়ে গেল। বাড়িতে একটাই সেন্টের শিশি থাকত, সেটা থেকে দরকারমতো ব্যবহার করা হত। সেন্টের যে পুরুষ, নারী হয় তখনও জানতাম না। কোথাও নিমন্ত্রণবাড়িতে বিশেষ করে বিয়েবাড়ি গেলে মা ব্যবহার করতেন।
চায়ে চুমুক দিয়ে মানুষটি বললেন ‘আমি দুধ চা খেতে পারি না, আমার ‘ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স’ আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম ‘আমারও তাই, দুধের কিছু খাই না।’ এবারে তাঁর দিকে খুব ভালো করে তাকিয়ে সত্যিই অবাক হলাম। ওনাকে অনেকটাই আমার মতো দেখতে। উনিই তাহলে সেই মানুষ। চা নিয়ে ধীর পায়ে শামিয়ানার দিকে এগোচ্ছেন। আমাকে কোন অ্যাঙ্গেলে কেমন দেখতে সে ব্যাপারে যদিও আমার সম্যক ধারণা নেই তবু ভালো করে দেখে মনে হল ওনাকে মোটামুটি আমার রেপ্লিকা-ই বলা যায়। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন ‘দেখেছেন পূজার খুঁটিটা একটু বাঁকা করে পুঁতেছে এরা?’ গলার আওয়াজ বেশ ভারী, উচ্চারণ খুব পরিষ্কার। কথাটা বলে সামনের একটা জটলার মধ্যে ঢুকে গেলেন। দেখলাম সত্যিই খুঁটি একটু হেলে রয়েছে ডান দিকে। অবশ্য খুব ভালোভাবে দেখলে তবেই বোঝা যায়। নজর আছে বটে লোকটির। আমার আবার সবকিছু একদম ঠিকঠাক না থাকলে বড্ড অস্বস্তি হয়। একজন মালিকে তৎক্ষণাৎ ডেকে বললাম খুঁটিটা ঠেলে সোজা করে দিতে। মালি বলল ‘এইমাত্র তো বলে গেলেন আপনি, দুবার বলার দরকার নেই স্যার। এখনই করে দিচ্ছি।’ বুঝলাম আমি নয় ওই ভদ্রলোকই মালিকে এই কথা বলে গেছেন। মালি আমাকে উনি ভেবে ভুল করেছে। কিন্তু ওনারও কি সবকিছু একদম ঠিকঠাক না থাকলে অসুবিধে হয়? কোথায় গেলেন তিনি? কোথাও দেখতে পেলাম না আর। বোধহয় চলে গেছেন। ভাবলাম, উনিও কি লক্ষ্য করেছেন যে আমাকে অনেকটা ওনারই মতো দেখতে?
এরপরে তাঁকে আবার দেখলাম অষ্টমীর গানের অনুষ্ঠানে। ভদ্রলোক বাংলা আধুনিক গাইলেন। আর গান শুনে মোহিত হয়ে গেলাম আমি। শুধু দারুণ গাইলেন বলে নয়, এই গানটাই আমি মানিকদার কাছে ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ার সময় শিখেছিলাম। এখন আর বিশেষ শোনা যায় না গানটা। আমিও গুনগুন করতে করতে ভাবলাম ফ্ল্যাটে ফিরেই ইউটিউবে খুঁজতে হবে গানটা। মনে পড়লো পাড়ার সেই পুরনো ফাংশন। মানিকদা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছেন ‘প্রেমে পড়লাম এক নীল নয়নার সাথে/ এক ছায়া ছলনার সাথে।’ মানিকদা ছিলেন আমার গানের মাস্টারমশাই। গানটা ওনার কাছ থেকে তুলে নিয়েছিলাম সেই সময়। সারাক্ষণ গুনগুন করে গাইতাম। একদিন পিসি শুনে বললেন ‘কী যে গান করিস এসব? কয়েকটা ঠাকুরের গান তুলে রাখতে পারিস তো।’ মানিকদা পরদিন আমাকে গান শেখাতে আসতেই পিসি নিজেই আমাকে ঠাকুরের গান শিখিয়ে দেবার কথা বললেন। সেসব কতদিন আগের কথা, পৃথিবীটাই বদলে গেছে তারপর। আশেপাশের মানুষজন, তাদের মনোভাব, পছন্দ, অপছন্দ সব। লোকে বলে পরিবর্তনই জীবন। যা বদলায় ভালোর জন্য বদলায়। কী জানি?
এরপর অনেকদিন দেখা হয়নি ভদ্রলোকের সঙ্গে। এবারের শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। সোসাইটির দিনগুলো প্রাত্যহিক হোয়াটসআপ গ্রুপে বাসিন্দাদের ঝগড়াঝাঁটি, ফাটাফাটি আবার মিটমাট ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে। অভিজাত আবাসন হলেও এদের হোয়াটসআপের ঝগড়াঝাঁটিতে কলতলার ঝগড়াও লজ্জা পাবে। তবে ভাষাটা বেশিরভাগ সময়েই ইংরেজি এটাই যা তফাত। এরই মধ্যে একদিন বৃদ্ধা পিসি এলেন আমাদের এই নতুন ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটের অন্তরসজ্জা দেখে খুব প্রশংসা করলেন। স্ত্রী খুব খুশি। পিসি আরও বললেন ‘বাবলু আজ তোর বাবা মা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন রে।’ কিন্তু দু’-চারদিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। সেটা বুঝতে পেরে আমি পিসিকে নিয়ে একদিন গেলাম কাছাকাছি রামকৃষ্ণ মিশনে। মিশনের গেটে একজন হাসি-হাসি মুখ নিয়ে আমাকে বলল ‘দুলালদা, তাড়াতাড়ি যান, মহারাজ অপেক্ষা করছেন। আজ একটু দেরি হয়ে গেছে আপনার।’
ভীষণ অবাক হলাম আমি। এরা আমাকে চিনলো কী করে? পিসিও জিজ্ঞেস করলেন ‘তোকে তো এরা চেনে বলে মনে হচ্ছে। তুই যে বলছিলি আজই প্রথম এলি?’
আমি বললাম ‘পিসি ওরা বোধহয় ভুল করেছে।’
‘কিন্তু এই নামটা কী করে বলল।’
‘সেটা তো আমিও ভাবছি পিসি। আর এ নামও তো এখানে কারো জানার কথা নয়। তবে আমি সত্যিই কাউকে চিনি না এখানে।’
কিছুটা চিন্তা ও বিস্ময় নিয়ে মন্দিরে ঢুকলাম। ঠাকুরের মূর্তির দিকে তাকিয়ে মন একেবারে শান্ত হয়ে গেল। দেখলাম অন্য পাশে বসে পিসিও চোখ বুজে নামজপ করছেন। দীক্ষা নিয়েছিলাম সেই বারো ক্লাসে পড়ার সময় মা-বাবার সাথে বেলুড়মঠে গিয়ে। তখন প্রতিদিন নিয়ম করে জপ-ধ্যান করতাম। তারপর জীবনের ব্যস্ততায় সবই বেশ অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য যাঁর চরণাশ্রিত ছিলাম তাঁকে হৃদয়ে রেখে দিয়েছিলাম সব সময়ই। আমিও জপ করতে করতে এক অপার শান্তির রাজ্যে বিরাজ করছিলাম। আরতি হচ্ছে। সমবেত কণ্ঠে প্রার্থনাসঙ্গীত শুরু হলো ‘খণ্ডন ভব বন্ধন।’ ভাবাবেগে আমার চোখ বুজে আসছে। দেখলাম পিসির দু চোখে জলের ধারা নামছে। সদ্য পিসেমশাই চলে গেছেন। পিসির মনে পড়ছে নিশ্চয়ই। প্রার্থনা শেষ হবার পর সামনে বসা ভক্তদের মধ্যে কেউ একজন হারমোনিয়াম টেনে গাইতে শুরু করেছেন- ‘তুমি ব্রহ্ম রামকৃষ্ণ / তুমি কৃষ্ণ তুমিই রাম।’ চেনা চেনা গলা শুনে বেশ চমক লাগল। কে গাইছেন? সামনে অনেকে বসে আছেন। মানুষটি ঠাকুরের মূর্তির দিকে তাকিয়ে প্রাণ ঢেলে গান গাইছেন। এখান থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু গানের অন্তরাটা শোনার পরেই বুঝতে পারলাম এ কণ্ঠ আমাদের সোসাইটির সেই ভদ্রলোকের যাকে অনেকটা আমার মতো দেখতে। গান শুনতে শুনতে ওপাশের মহিলাদের আসনে বসে পিসি চোখের ইশারা করলেন আমাকে। মনে পড়ল এই গানটাই পিসির ফরমাইশে মানিকদা শিখিয়েছিলেন আমাকে, সেই কিশোর বেলায়। আশ্চর্য! সেসব কথা এখনও মনে আছে পিসির?
ঢোকার সময় মিশনের গেটের লোকটি তাহলে আমাকে দেখে ইনি ভেবেই ভুল করেছিল। এই ভদ্রলোকের নাম তাহলে দুলাল? অদ্ভুতভাবে, ওটাও তো আমারই ছোটবেলার নাম। মামাবাড়ির দাদুর দেওয়া বড় আদরের নাম। এই নামে শুধু মামাবাড়ির মানুষজনই অবশ্য আমাকে ডাকতেন। সেই মানুষদের বেশিরভাগই আজ আর নেই। তাছাড়া এখন মামাবাড়ির সাথে বিশেষ যোগাযোগ না থাকাতে নামটাও ভুলে গেছে সবাই। প্রসাদ বিতরণের সময় দেখা করতে গিয়েছিলাম ভদ্রলোকের সাথে, শুনলাম তিনি নাকি ততক্ষণে চলে গেছেন।
ফেরার পথে এক অদ্ভুত ভাবনা মনটাকে ঘিরে রাখল। বলা ভালো অনেক প্রশ্ন ছেঁকে ধরল আমাকে। এই ভদ্রলোককে দেখতে আমারই মতো । এটা তো হতেই পারে। কিন্তু ওনার নামটাও আমার ছোটবেলার ভুলে যাওয়া নাম। আবার আমার সেই সময়ের শেখা গানগুলোও উনি গাইছেন। এছাড়া ভদ্রলোকের সাথে আমার কিছু অভ্যাসও মেলে। দুজনেরই পছন্দ দুধ চিনি ছাড়া কালো চা। দুজনেরই লাক্টোজ ইন্টলারেন্স আছে।
ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল হিরনের কথা। ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। ওকে মাঝে মাঝে আমার মনের কথা বলি। সমস্যায় পড়লে ওর সাথে আমি শলা-পরামর্শ করি। আর দেরি না করে সেই রাতেই ফোন করলাম ওকে। ওই ভদ্রলোকের কথা সব খুলে বললাম। আমার খটকার কথাও বললাম।
ও বলল ‘একদিন ওনার সাথে দেখা করে খুলে কথা বল। ওনার জীবনের কথাও জেনে নে। কোথায় যেন পড়েছিলাম এই পৃথিবীতে একই রকম দেখতে কয়েকজন লোক থাকার কথা। বিরাট ভাগ্যের কথা যে তোর সাথে এদের মধ্যে একজনের দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু তোদের তো আরও অনেক কিছুই মিলে যাচ্ছে। ওনাকে প্রায় তোর সেলফ-শ্যাডো বা ছায়ামানুষ বলা যায়। তবে ভাবনার কিছু নেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা বল ওনার সাথে। তোর সমস্ত খটকা দূর হয়ে যাবে আশা করি।’
মা বড় শখ করে আমার গান শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। বলতেন, ‘গান কখনও ছাড়িস না রে বাবলু। চর্চাটা রাখিস।’ কিন্তু এখন আমার চর্চাহীন গান শুধু নিকট বন্ধুদের পান-ভোজনের আসরে সীমাবদ্ধ। যেভাবে ভাবা হয়েছিল তার থেকে আমার জীবন অনেকটা অন্যরকম ভাবে বয়ে গেছে। এটাই হয়ত স্বাভাবিক। সময়ের সাথে সব বদলে যায়। কিন্তু আমার জীবনটা যেভাবে বইবার কথা ছিল সেভাবেই কি বইছে ওই ভদ্রলোকের জীবন? আমার জীবনের না ফোটা কলিরা ওনার মধ্যে কি মুকুলিত হয়েছে? এরকম হয় নাকি? হয়তো সবটাই কাকতালীয়। শুনেছি কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান উনি। সেভাবে দেখতে গেলে আমাদের শিক্ষক পরিবারে আমারও শিক্ষকতা করারই কথা ছিল। অন্তত বাবা-মা তাই চাইতেন। কিন্তু কারিগরি বিদ্যায় ভালো কলেজে সুযোগ পেয়ে সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। তবে কি সত্যিই উনি আমার ছায়ামানুষ? আমার প্রতিরূপ?
কিন্তু এরপর চেষ্টা করেও কথা বলতে পারিনি ওনার সাথে। বেশ কিছুদিন ভদ্রলোককে দেখিনি। শুনেছিলাম মাঝে মাঝে উনি নাকি এখানে থাকেন না। অন্যও কোথাও ফ্ল্যাট আছে হয়ত। যাই হোক নানা ব্যস্ততায় ওনার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তবে একদিন হঠাৎই আবার দেখা পেলাম তার।
সেদিন সিনিয়র সিটিজেনদের একটা প্রতিযোগিতা হচ্ছিল আমাদের সোসাইটির ক্লাব হাউসে। গান বাজনা আবৃত্তি নৃত্য, যে যার ট্যালেন্ট শোকেস করতে পারে সেখানে। উদ্যোক্তাদের আগ্রহে আমিও উপস্থিত হয়েছিলাম অংশগ্রহণ করার জন্য।
অনেকে গান গাইলেন, অনেকে আবৃত্তি করলেন, অনেকে গিটার, বাঁশি ইত্যাদি বাজালেন। মহিলারা অনেকে নৃত্যেও অংশ নিলেন। বোঝা গেল বেশিরভাগেরই কিছুটা চর্চা এখনও আছে। বাকিরা খুঁজে চলেছেন নিজের পুরনো পারদর্শিতাকে। আমি গান গাইলাম একটা। আমার অত্যন্ত প্রিয় গান ‘সবার সাথে চলতেছিল অজানা কোন পথের অন্ধকারে।’ কয়েকজন প্রশংসা করে বললেন ‘আপনার গায়কি খুব সুন্দর, চর্চা বজায় রাখুন।’ জানি গানটার ভেতরে ঢুকতে পারিনি আমি। চিরদিনের ধন না-চেনাই থেকে গেছে আমার। অথচ অজানা পথের অন্ধকারে সে আমার সাথে সাথেই চলছে।
প্রতিযোগিতার শেষ প্রতিযোগী হিসেবে সেই ভদ্রলোকের নাম ঘোষণা হওয়াতে বেশ অবাক হলাম। শুনেছিলাম উনি এখানে নেই। ঘোষক অবশ্য বললেন উনি এইমাত্র আবাসনে ফিরেছেন। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কোন কাগজপত্র ছাড়াই আবৃত্তি করলেন একটি বড় কবিতা। প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে বসে দেখছিলাম ওনাকে। মাইকের সামনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন। পরিবেশটাও তৈরি হয়ে গেল সেই অবসরে। তারপর পরিষ্কার উচ্চারণে ভারী গলায় শুরু করলেন-
‘তোকে আমি সব দেবো / আমার রং পেন্সিল/
আমার না লেখা কবিতা / প্রেমিকার ‘উবুরডুবুর’ মুখ, সব।/
বদলে শুধু একদিন আমাকে তুই হতে দিবি?’
বললেন এটি স্বরচিত কবিতা। নাম ‘আমি ও তুই।’ কবিতাটি অদ্ভুত? ‘তুই’ বলতে কার কথা বললেন কবি? নিজেরই কি? অদ্ভুত কবিতাটির প্রতিটি শব্দ নিজের প্রিয় সন্তানের মতো যত্নে ও আদরে উপস্থিত করলেন শ্রোতাদের কাছে। আবৃত্তি তো নয় এ একেবারে নিজের মধ্যে ডুব দেওয়া। কিন্তু আবৃত্তি নয় আমাকে ভীষণ অবাক করল ‘উবুরডুবুর’ কথাটি। এ তো আমার কলেজ জীবনে লিখতে চাওয়া অসম্পূর্ণ কবিতার একটা শব্দ। আমি শুধু দুটি লাইনই লিখেছিলাম।
‘বৃষ্টি ভেজা সকাল বেলায় চু-কিতকিত আলো,
উবুরডুবুর মুখখানা তোর লাগছে ভারী ভালো।’
পরের লাইনগুলো লেখা হয়নি আর। কিন্তু মনে আছে অভিধান-বহির্ভূত এই ‘উবুরডুবুর’ শব্দটি প্রেমিকার ‘আদুরে’ মুখ বোঝাতে ব্যবহার করেছিলাম। কিন্তু উনি পেলেন কোথায় শব্দটি? আমার লেখার ডাইরি তো কবেই হারিয়ে গেছে। প্রশ্ন ও বিস্ময় জমেই যাচ্ছে। আরও একটা চিন্তা ক্রমশ পেয়ে বসছে আমাকে। যাকে উদ্দেশ্য করে ‘উবুরডুবুর’ মুখের কথা লিখেছিলাম, উনিও কি তাকে ভেবেই লিখেছেন? – এত মিল আমাদের? যদিও বিশ্বাস করি না তবু চিন্তাটা বার বার মনে আসছে - দুজন ছায়ামানুষের মধ্যে একজনকে নাকি যেতে হয়।
এর মাসকয়েক পর গ্রীষ্মের এক শনিবারের সকালে প্রি-বাথ নিয়ে সোসাইটির সুইমিংপুলে নামতে যাচ্ছি, পাশে রাখা নোটিশ বোর্ডে চোখ গেল। তাতে একটা লিস্ট লাগানো হয়েছে সদ্য। যারা মেন্টেনেন্স চার্জ দেননি বেশ কিছুদিন, তাদের নাম রয়েছে সেখানে। কাছে গিয়ে দেখলাম লিস্টে সবার উপরে জ্বলজ্বল করছে একটা বিশেষ নাম। নামটা আমারই কৈশোরের ভুলে যাওয়া নাম হওয়াতেই বোধহয় সেটা আমার চোখ এড়ালো না। কী হল আমার ছায়ামানুষটির? সাঁতার সেরে বের হবার সময় কৌতূহলবশত ক্লাবে ফেসিলিটি ম্যানেজারের অফিসে ঢুকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম লিস্টে থাকা ওই ভদ্রলোকের কথা। শুনলাম উনি নাকি গত চার মাস ধরে মেন্টেনেন্স চার্জ দেননি। ম্যানেজার আরও বললেন ওনারা নাকি বিগত কয়েকমাস ধরে এখানে আর থাকছেন না। আর যোগাযোগও করা যাচ্ছে না ওনার সাথে। হয়তো সপরিবারে বিদেশে কোথাও গেছেন, ফিরে এসে যোগাযোগ করবেন। কেউ কেউ আবার বলছে ইদানীং ওনার অর্থের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ফ্ল্যাটটা নাকি বিক্রি করে দেবার চেষ্টা করছেন তিনি। বিশ্বাস করলাম না। এরকম হবার কথা নয়। অন্য চাকরি নিয়ে কোন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছেন নিশ্চয়ই। এভাবেই তো মানুষ অর্থ, যশ ও প্রতিপত্তি বানায়। যাক গে মিথ সত্যি করে এতদিনে তবে আমার ছায়ামানুষ চলে গেল?
বর্ষা তখনও ভালোভাবে শুরু হয়নি, কলেজ-জীবনের জনাতিনেক বন্ধুর সাথে গেলাম ঝাড়খণ্ডের এক পাহাড়-ঘেরা জঙ্গলে। পাহাড়ে চড়া ও জঙ্গলে হাইকিং করার প্ল্যান। এটা আদিবাসী অধ্যুষিত জায়গা। আপাতভাবে শান্ত হলেও মাঝে মাঝে উগ্রপন্থীদের কার্যকলাপ চলে এইসব জায়গায়। এই জেলার পুলিশ সুপার আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজনের বিশেষ পরিচিত। তারই নির্দেশে স্থানীয় পুলিশ আমাদের দেখভাল ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। জঙ্গলের মাঝে একটা বড় তাঁবুতে আমাদের চারজন বন্ধুর বেশ ভালোই কাটল প্রথম কয়েক দিন। হাইকিং-এর সাথে সাথে আড্ডাও হল বেশ। বেশ কতগুলো লাজুক ঝরনা আবিষ্কার করলাম আমরা। ক্লান্তি কাটাতে একটা দিন আমি ছাড়া সবাই পুরো বিশ্রাম নিতে চাইল। আমি ওইদিন সকালে একাই বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এলাম। একটা উঁচু টিলা দেখে কী মনে হওয়াতে উঠে পড়লাম চুড়োয়। বেশ কষ্ট হলো। আগের মতো আর দম নেই শরীরে। চুড়োয় উঠেই বসে হাঁপাতে লাগলাম। বুঝলাম দৈনন্দিন যেটুকু ওয়ার্কআউট করি সেটা যথেষ্ট নয় এইরকম এক নাগাড়ে পাহাড়ে ওঠার জন্য। তবে এই টিলার ওপর থেকে চারদিকে তাকিয়ে কিন্তু মন একেবারে জুড়িয়ে গেল। একটা মেঘলা আকাশ মাথার উপর ঝুলে আছে। মৃদু একটা গুমোট কাটানো হাওয়া বইতে শুরু করেছে চারপাশে। অনেক নিচে টিলার চারদিকে সবুজ জঙ্গল আর মাঠ। একদিকে অনেকটা দূরে জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে। এক শীর্ণতোয়া নদী গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। নদীর নাম জানি না। গুগলে দেখতে হবে। এখানে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। ব্যাকপ্যাক থেকে বাইনাকুলারটা বার করে যতটুকু হয় ফোকাস করে দেখলাম নদীর পাড়েই একটা কুঁড়েঘর। উঠোনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ কিছু বলছেন আর তার সামনে মাটিতে বসে রয়েছেন বেশ কিছু মানুষ। যে মানুষটি কথা বলছেন তার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। আর বাকি মানুষজন আদিবাসীদের মতো পোশাক পরা। কুঁড়েঘরের সামনের বাগানটা বেশ বড়। অনেক গাছ লাগানো আছে তাতে। এক বয়স্ক মহিলা কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এসে সামনে বসা মানুষজনদের কিছু বিতরণ করলেন। বোধহয় খাবারদাবার। বায়নাকুলারটা পুরো জুম করেও এর বেশি দেখা গেল না কিছু। বয়স্ক মহিলা সবাইকে খাবার দিয়ে আবার কুঁড়েঘরে ঢুকে গেলেন মনে হল। এতদূর থেকে বাইনাকুলার দিয়েও কোন কিছুই খুব স্পষ্ট দৃশ্যমান হল না। দাঁড়ানো মানুষটির কথা সবাই মনে হল মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথা। এখান থেকে নেমে জায়গাটার দূরত্ব হবে প্রায় তিন কিলোমিটার মতো। আমার টিলাটার নিচেও একটা জঙ্গল আছে, তারপরে মাঠ পার করে ওই শীর্ণতোয়া নদী। নদী হয়ত হেঁটে পেরোনো যাবে। জল বিশেষ নেই। ভীষণ ইচ্ছা করছিল ওখানে গিয়ে দেখে আসি এই আদিবাসীদের মাঝে কী করছেন ওই মানুষটি। জায়গাটা অবশ্য একেবারেই নিরাপদ নয়। স্থানীয় প্রশাসন আমাদের যতটুকু যাবার অনুমতি দিয়েছেন ওই জায়গাটা তার বাইরে। পুলিশ বলেছে ওদিকটা উগ্রবাদী অধ্যুষিত এলাকা। শুধু পুলিশ নয়, আর্মিও ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলে। শুট অ্যাট সাইটের অর্ডার আছে তাদের। এছাড়াও অনেক জায়গায় পোঁতা আছে ল্যান্ডমাইন। আমি এতটা এসেছি কাউকে না বলেই। বন্ধুদের শুধু বলেছি ‘একটু ঘুরে আসছি।’ এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমার না ফেরা তাদেরকে বিব্রত করছে। বের হবার সময় সবাই সাবধান করেছিল। বার বার বলেছিল আমি যেন বেশিদূরে না যাই। এইসব ভেবে এখন আর ওই গ্রামে যেতে সাহস হলো না।
তাঁবুতে ফিরেই প্রচণ্ড বকুনি খেলাম বন্ধুদের কাছে। ওরা থানায় যাবার উদ্যোগ করছিল আমার দেরি দেখে। জায়গাটা সত্যিই ভালো নয়। কাজেই থানার লোকজন আমাদের ভালোই গার্ড দিয়ে রেখেছে। যাই হোক আমি আমার অভিজ্ঞতা বললাম। সবাই অবশ্য খুব উৎসাহিত হল। ঠিক করলাম পরের দিন সবাই মিলে ওই মানুষটির ওখানে যাওয়া হবে। অবশ্য তার আগে স্থানীয় থানার অনুমতি নিতে হবে। জঙ্গলের মাঝে ওই মানুষরা কারা তা জানি না আমরা।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই শুরু হল বৃষ্টি। তাঁবুতে খিচুড়ি রান্না হল। থানার থেকে ঠিক করে দেওয়া একজন লোক আমাদের জন্য রান্নাবান্না করে দিয়ে যায় দুবেলা। এই বর্ষামুখর সন্ধ্যায় বেগুন ভাজা দিয়ে খিচুড়ি। অসাধারণ হল খাওয়া। তাঁবুর বাইরে ঝরঝর বৃষ্টি আর ভেতরে পান-ভোজন, গানবাজনা, আনন্দ। দারুণ এক অভিজ্ঞতা। বৃষ্টি বেড়ে যাওয়াতে রাতে খুব তাড়াতাড়ি এসে গেল গভীর ঘুম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, হঠাৎই ক্যাম্পের বাইরে থেকে কাদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ি বলছে এখন মাঝ রাত। মন দিয়ে ডাক শুনে বুঝলাম থানা থেকে দুজন কনস্টেবল এসে আমাদের ডাকছেন। বৃষ্টির তোড়ে তার জীপের আওয়াজও শুনিনি আমরা। আমরা বেরিয়ে আসতেই তারা জানালেন এখানে আজ রাতেই ফ্ল্যাশ-ফ্লাড হবার সম্ভাবনা প্রবল। রেড এলার্ট জারি করেছে প্রশাসন। এক্ষুনি আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে এই জায়গা ছেড়ে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। এখানে ফ্ল্যাশ-ফ্লাড মাঝে মাঝে হয় এবং ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। তবে আজই হতে পারে সেটা আন্দাজ করা যায়নি একেবারেই। খুব তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে উঠে পড়লাম আমরা। বৃষ্টির মধ্যে তাঁবুটা খোলা গেল না। কনস্টেবলরা বললেন যদি সব ঠিক থাকে তবে কাল এসে তাঁবু খুলে নিয়ে যাবেন ওনারা। এখন তাঁবু খুলতে গেলে দেরি হয়ে যাবে, আর তাতে সর্বনাশ হতে পারে। তড়িৎগতিতে পুলিশের জিপের পেছন পেছন আমাদের গাড়ি থানায় পৌঁছল। একটানা বৃষ্টির শব্দ আমাদের সমস্ত রাস্তা তাড়া করে ফিরল। দেখলাম থানার পুরো পুলিশ ফোর্স তৈরি হয়ে আছে যে কোনরকম বিপর্যয়ের মোকাবিলায়। দেরি হলে আমরা জলে আটকে পড়তে পারি। তাই ওনারা রাতেই আমাদের এসকর্ট করে হাইওয়েতে পৌঁছে দিলেন। যা বৃষ্টি হচ্ছে তাতে এতক্ষণে নিশ্চয়ই জঙ্গলে আমাদের তাঁবুর অর্ধেক জলে ডুবে গেছে। আসার সময় থানাতেই শুনেছিলাম, হঠাৎ অতিবৃষ্টি আর কাছাকাছি বাঁধে জল ছাড়ার জন্য হঠাৎ এই হড়পা বানের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
কলকাতায় নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে কয়েকটা দিন কেটে গেল গায়ের ব্যথা মরতে। জঙ্গলের স্মৃতি ফ্যাকাসে হয়ে আসার আগেই একদিন সকালে খবরের কাগজের মাঝের পাতায় চোখে পড়ল ছোট্ট একটা খবর। আমরা যেখানে গিয়েছিলাম খবরটা সেই জায়গা সম্পর্কিত। সেখানকার বিস্তীর্ণ এলাকা হঠাৎ-বন্যায় প্লাবিত হয়েছে সেইরাতে। আশেপাশের গ্রামের লোকজনকে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে পাঁচ কিলোমিটার দূরের বড় একটা স্কুলে। বহুদিন পরে এরকম ভয়াবহ একটা হড়পা বান এল সেখানে। সেখানকার আদিবাসী মানুষের বন্যার জন্য আগাম প্রস্তুতি ছিল না। আদিবাসীদের ঘরবাড়ি সব জলের তলায় চলে গেছে। সবশেষে লেখা আছে স্থানীয় মানুষ বলেছে যে দুলাল বসুরায় নামের একজন মানুষ আদিবাসীদের এই স্থানান্তরণে দারুণ সাহায্য করেছেন। উনি না থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হত, এমনকি মানুষের জীবনও যেত। দুলালবাবু আদিবাসীদের মধ্যে থেকে অনেকদিন ধরে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং কৃষিকাজে সাহায্য করতেন, বেশিরভাগই নিজের বিস্তর অর্থ ব্যয় করে। ওনার সাথে থাকতেন ওনার পিসি। বন্যাত্রাণে উনিও যথেষ্ট কাজ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখন তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে দুর্ভাগ্যবশত দুলালবাবুর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে জঙ্গলে জলের মধ্যে কোথাও আটকে আছেন তিনি। উদ্ধারকারী দল তার খোঁজ নেবার চেষ্টা চালাচ্ছে। এখনো সব মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা যাবে জল নামলে।
খবরটি পড়ে বেশ মুহ্যমান হয়ে পড়লাম। কিছুটা গর্বিতও বোধ করলাম অবশ্য। বুঝলাম, দুলাল বসুরায় মানে আমার ছায়া মানুষটিই আদিবাসীদের মধ্যে গিয়ে এতদিন কাজ করছিলেন শহরের এই বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে। সেদিন টিলা থেকে আমি তাকেই দেখেছি। এই কাজের জন্যই তিনি মাঝে মাঝেই এই আবাসন থেকে উধাও হয়ে যেতেন। গত কয়েকমাস নিশ্চয়ই একনাগাড়ে এই প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে ছিলেন তিনি। মনে পড়ল বাবা আমাকে বলতেন ‘মানুষের সেবাই ঈশ্বরের সেবা। যদি প্রান্তিক মানুষজনের জন্য কাজ করতে পারিস তাহলেই জীবন সার্থক।’
সেসব বহুদিন আগের কথা। কবে স্মৃতির অতলে চলে গেছে সেই দিনগুলো। এখন আমি আপাতভাবে সফল একজন মানুষ। নিজের আখের গুছিয়ে পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছি জীবনের পথে চলতে চলতে। তবু কেন জানি না সেই থানায় ফোন করে বড়বাবুর কাছ থেকে জানার চেষ্টা করলাম দুলালবাবুর খোঁজখবর। শুনলাম এখনো তার কোনো খোঁজ নেই। যতদিন যাবে তার ফেরার সম্ভাবনা ততটাই কমবে। এতদিন তো আমিই চাইতাম ছায়ামানুষটি দূরে চলে যান। তবে আজ কেন বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল?
কেন জানি না কিছুদিন আগে শোনা কবিতার পঙ্ক্তিগুলো মনে পড়ল--‘তোকে আমি সব দেব / আমার রং পেন্সিল/.../ বদলে শুধু একদিন আমাকে তুই হতে দিবি?’