আগের রাতে শুতে অনেক দেরি হয়েছিল। ফিনিক্স মলে প্রসেনজিতের একটা বাংলা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। নাইট শো-এ। জাতিস্মর। বেশ ক’মাস আগে কলকাতায় রিলিজ করেছে। এতদিনে মুম্বাইয়ে এসেছে। সকালে দু’কাপ চা ডাইনিং টেবিলে রেখে শ্বেতা লিভিং রুমের ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পর্দাটা টেনে দিতেই আমার চোখ আটকে গেল। সাদা লাল হলুদের সমারোহে একটু নীলের ছোঁয়া। জানালার বাইরের এক চিলতে ফ্লাওয়ার বেডে শ্বেতার শখের বাগান। বাহারি টবে মরশুমি ফুল ছাড়াও, গ্রিলে জড়িয়ে ওঠা নানান লতায় হলুদ ঝুমকো, লাল মাধবীলতা, সাদা জুঁই। রোজই চোখে পড়ে। তার মধ্যেই একটা লতা কবে বেড়ে উঠেছে খেয়াল করিনি। আজ সেই লতায় একটা নীল ফুল, অপরাজিতা। শ্বেতার দিকে তাকাই, ওর তখনও ভালো করে ঘুম কাটেনি। গরম চায়ের কাপটা সামনে টেনে, মুখোমুখি বসে মস্ত হাঁ করে হাই তোলে। আমি ওর গোলাপী আলজিভ থেকে চোখ সরিয়ে আবার ফুলটার দিকে তাকিয়ে বলি, "এই গাছটা আবার কবে হল, আগে তো দেখিনি।"
আওয়াজ করে চায়ে চুমুক দিয়ে শ্বেতা বলল, "কোন গাছ?"
"নীল একটা ফুল ফুটেছে দেখছি," ফুলের নামটা উচ্চারণ করি না।
"বাব্বা, সুঁটকো গাছটার ভাগ্য ভাল। এত সব রঙবেরঙের ফুলের প্রতি তো কখনও কোনও আগ্রহ দেখিনি, ছোট্ট একটা ফ্যাকাশে ফুল, সেটাই চোখে পড়ল," এতক্ষণে শ্বেতা ঘাড় ঘুরিয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, "বাঁচবে বলে মনে হয় না।"
"কেন?"
“ক' মাস আগে তোমার মা-র একটা পুরনো ব্যাগ পেয়েছিলাম। হাবিজাবি জিনিসে ভর্তি। কান খোঁচানোর পায়রার পালক, চুলের গোড়া বাঁধার কালো দড়ি, চুলের কাঁটা, কোন জম্মের পোস্টকার্ড, ম্যাগাজিন থেকে কেটে রাখা প্রসেনজিতের ছবি, একটা ছোট ডায়েরি ভর্তি বাংলা কোটেশন আর কাগজে মুড়ে রাখা কয়েকটা গাছের বীজ। টবের মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলাম, তার থেকেই একটা বেরিয়েছে। আর কয়েকটা গাঁদার চারা। কিন্তু কেমন রুগ্ন... বাড়ছে না তেমন..."
মা মারা গেছে প্রায় তিন বছর। তার মানে ২০১১-তে কলকাতার পাট চুকিয়ে যখন মাকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম, তখন ওই ফ্ল্যাটের পূব-মুখো ব্যালকনিতে বেড়ে ওঠা অপরাজিতা গাছটার বীজ মা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। মা-র গাছের শখ ছিল। শখ ছিল গাছের বীজ সংরক্ষণের, সে ফুল হোক বা লাউ, কুমড়ো, লঙ্কা। তবে সে সব আর মাটিতে পোঁতার সময় পায়নি, এখানে আসার ঠিক আড়াই মাসের মাথায় মা চলেও গেল। মাত্র আটান্ন বছর বয়সে। হার্টফেল। ঘুমের মধ্যেই। মার পরিত্যক্ত ব্যাগের মধ্যে তিন বছর ধরে পড়ে ছিল এই অপরাজিতার বীজ।
অপরাজিতা দেখেই মনে পড়ে গেল অপুর কথা। আর অপুর সঙ্গে সঙ্গেই ঝিমলির কথাও। অপুর ভাল নাম ছিল অপরাজিতা। গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা, দীর্ঘাঙ্গী, সরু কোমর, সুগোল নিতম্ব, হাঁটু অবধি বিনুনি। ও যখন হেঁটে যেত, পেছনে থাকা যুবকেরা, হাঁটার গতি বাড়িয়ে ওকে অতিক্রম করে পেছন ফিরে তাকাত। কিন্তু মুখের দিকে দু’বার তাকিয়ে দেখার মতো সুশ্রী ও ছিল না। যুবকদের গতি আবার কমে যেত।
আমি ছিলাম অত্যন্ত সুদর্শন। উচ্চতা প্রায় ছ’ ফুট, মাথা ভর্তি ঢেউ খেলানো চুল, টিকালো নাক ও চিবুক, ধবধবে রঙ, আর নীল রঙের চোখ। তবে এত সুন্দর ছিলাম বলেই লোকে নাকি আড়ালে বলত মাকাল ফল। বাবা মারা গিয়েছিল যখন ক্লাশ সিক্সে পড়ি। অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে। বাজারে চারটে দোকান ছিল, ঠাকুরদার থেকে পাওয়া। মাসে মাসে ভাড়া আসত। বাড়ির মেজেনাইন ফ্লোরে আমি থাকতাম, একতলাতে পেছনের দুটো ঘর, কলতলা পার্টিশন দিয়ে আলাদা করে মা ভাড়াটে বসিয়েছিল। সামনের ঘর দুটোর একটায় রান্না খাওয়া আরেকটায় মা নিজে থাকত। ব্যাঙ্কে কিছু জমানো টাকা ছিল, তাই দিয়েই মা ম্যানেজ করত। দু’বছর বাদে বাদে মা ঠিক কৌশল করে ভাড়াটে বদলাত বেশি ভাড়ায়। আর আমি কোনও রকমে গ্র্যাজুয়েশন করে পাড়ার ক্লাবে ক্যারাম পেটাতাম। উপার্জনের চেষ্টা না করে ঘরে বসে কবিতা লিখতাম। ক্যালেন্ডার দেখে ছবি আঁকতাম। হারমনিয়াম পিটিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করতাম। এই কবিতা লেখা, গান গাওয়া, ছবি আঁকা কোনটাই যে খুব ভাল পারতাম তা নয়, তবে ইচ্ছেগুলো পেয়েছিলাম মায়ের কাছ থেকে। আর ছিল কোটেশন ব্যবহারের নেশা। ডায়েরি ভর্তি করে লিখে রাখতাম যেখানে যা পছন্দ হত। কিশোর বয়সেই এ নেশাও পেয়েছিলাম মায়ের থেকেই। পাড়ার পালকাকুর মেয়ে আলোদির জন্মদিনে উপহারের প্যাকেটের ওপর লিখে দিয়েছিলাম 'আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা।' পরের দিন আলোদি বলেছিল, "এসব কী লিখেছিস? তুই তো খুব পাকা দেখছি।" তখন ক্লাশ এইট। নাইনে পড়তে অংক খাতায় ত্রিকোণমিতির প্রশ্নগুলো লিখে তার নিচে লিখেছিলাম 'কোথায় পাব তারে?' কেন যে লিখেছিলাম আজও জানি না।
যখন বয়স চব্বিশ, আমার জীবনে পর পর দুটো ঘটনা ঘটেছিল। প্রথম ঘটনাটা হল, আমাদের একতলায় ঝিমলিরা ভাড়া এল। ঝিমলি ডানা-কাটা সুন্দরী (??পরী?)। এখানে এসেই ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হল। স্মার্ট। বাবা রেলে চাকরি করে, দুর্গাপুর থেকে বদলি নিয়ে কলকাতায় এসেছে। আমি হাড়গোড় ভেঙে ঝিমলির প্রেমে পড়লাম। ঝিমলি বুদ্ধিমতী, বুঝতে বেশি সময় নিল না এবং আমাকে লেজে খেলাতে থাকল। মেধাবী ঝিমলি আমাকে দিয়ে সাইন্সের প্র্যাকটিক্যাল খাতায় সব ছবি আঁকিয়ে নিত। আমি ওর বায়োলজি খাতায় পেন্সিল দিয়ে লিখে দিয়েছিলাম, 'তোমাকেই যেন ভালবাসিয়াছি শতরূপে শতবার, জনমে জনমে...'। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ঝিমলি আমাকে সেদিন সন্ধ্যায় ছাতে একলা পেয়ে নিরীহ মুখে প্রশ্ন করেছিল, "মাকাল ফলকে ইংরেজিতে কী বলে জান?"
দ্বিতীয় ঘটনাটা হল, একদিন সকাল দশটা নাগাদ যখন লেকের পারের রাস্তা দিয়ে ডানলপে যাচ্ছিলাম, অপু, মানে অপরাজিতা, খুব জোরে হেঁটে আমাকে ওভারটেক করে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। একদম মুখোমুখি। আমিও ওকে সেদিনই প্রথম দেখি।
"আপনাকে না দেখতে একদম কবীর বেদীর মতো, আপনি জানেন?" আমি মাকালের মতোই তাকিয়ে ছিলাম। কোনো উত্তর দিতে পারিনি। নিজের রূপের প্রশংসা ছোটবেলা থেকেই শুনেছি, তাই বলে কোনও অচেনা তরুণী যে প্রথম আলাপেই মুখের ওপর সে কথা এমন সহজ ভাবে বলতে পারে জানা ছিল না। বলল, "ভাগ্যিস আজ বিটি রোডে মারাত্মক জ্যাম, তাই ভেতরের গলি দিয়ে হেঁটেই কলেজ যাচ্ছি। নাহলে আপনাকে দেখতেই পেতাম না। আপনার নাম কী?"
"বিভাস। আপনার?" আমি কোনওরকমে বলি। ততক্ষণে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করেছি।
"অপরাজিতা, ফুলের নাম। খুব বড় নাম, তাই না? আপনি অপু ডাকবেন। বাবাকে কোন জ্যেতিষ বলেছিল মেয়ের নাম পাঁচ অক্ষরের রাখতে। দিদির নাম রেখেছিল, চন্দ্রমল্লিকা। দিদি পরে ছেঁটে মল্লিকা করে নিয়েছে," তড়বড় করে বলল।
"ছোট বোন নেই কোনও?" আমি প্রশ্ন করি।
আমার প্রশ্ন শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল, "না নেই, থাকলে কী নাম দিত ভাবছেন? নিশ্চয়ই কাঠগোলাপ।"
ওর কথা শুনে আমিও হেসে ফেলেছিলাম। ওর কলেজের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলাম। বলল সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, থাকে সুভাষ কলোনিতে। আমাদের বাড়ি থেকে রেললাইন যাওয়ার পথে পড়ে। আমার স্কুলের বন্ধু সুজিত ওখানেই থাকে বলাতে বলল চেনে। সুজিতের বাড়ির কাছেই নাকি ওদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির হদিশ জেনে নিয়ে একগাল হেসে হাত নেড়ে কলেজে ঢুকে গেল। এতক্ষণে আমি ওকে পেছন থেকে দেখলাম। মোটা সাপের মতো বিনুনি দুলিয়ে ও লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে কলেজের ভেতরে হারিয়ে গেল।
সেদিনই দুপুরে আমরা, মানে আমি আর ঝিমলি, প্রথম একসঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। প্রসেনজিতের সিনেমা 'বাবা কেন চাকর'। মায়ের দেখাদেখি তখন আমিও প্রসেনজিতের অন্ধ ভক্ত। ঝিমলি শ্যামবাজারে ট্রাম ডিপোর সামনে অপেক্ষা করছিল। কলেজ থেকে এসেছে। তিনটে-ছটার শো। সিনেমার নাম শুনেই বেঁকে বসল। ভেবেছিল ইংরেজি না হোক অন্তত কোনও হিন্দি সিনেমার টিকিট কাটব। যাই হোক, অনেক কষ্টে হলে তো নিয়ে যাওয়া গেল, কিন্তু হাফ টাইমে জেদ করে বেরিয়ে এল। ঝিমলি যা বলবে আমার কাছে সেটাই মান্য। শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়েই আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারতাম। বাড়ি ফেরার পথে ঝিমলি বলল, ওর বন্ধুর প্রাকটিক্যাল খাতাতেও ব্যাঙের পৌষ্টিক তন্ত্র এঁকে দিতে হবে। কারণ, এই বন্ধুটি নাকি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। টিকিট কেটেও প্রসেনজিতের সিনেমা পুরোটা দেখতে না পারার শোক ভুলে বলেছিলাম, "তথাস্তু!" আমি আর ঝিমলি যে বাড়ির বাইরেও দেখা-সাক্ষাৎ করছি সেকথা আমরা গোপন রাখতাম।
দিন পনেরো বাদে একদিন সকাল এগারোটা নাগাদ অপু বাড়ি খুঁজে হাজির। আমি তখন আমার মেজেনাইন ফ্লোরের ঘরে। ঝিমলি কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য একটা বাংলা পদ্য লিখেছে, আমি বসে সেটাকেই কী ভাবে আরেকটু ভাল করা যায় সেই চেষ্টা করছি। হঠাৎ দেখি ঘরের সামনে মা, পেছনে অপু। মা বলল, "দেখ, তোর কাছে এসেছে। বলছে তোর বন্ধু, কই, তুই কখনও বলিসনি তো!"
অপু অসংকোচে, যেন কতবছরের চেনা, টেবিলের ওপর ঝুঁকে আমার খাতার লেখাটা এক ঝলক দেখেই বলল, "ওমা, তুমি কবিতাও লেখ, বিভাসদা?"
সেই শুরু। মাঝে মাঝেই এরকম কলেজ থেকে ক্লাস কামাই করে চলে আসত অপু। ঝিমলি তখন ওর নিজের কলেজে। হেঁদুয়ায়। (??হেদুয়ায়?)
দেখা গেল অপুর সঙ্গে আমার অনেক মিল। ও কবিতা লেখে। ছবি আঁকতে ভালবাসে। কোটেশন কালেকশন ওর নেশা। আর ওর নাকি খুব ভাল লাগে সুন্দর পুরুষ দেখতে। বলত, "ধুর, মেয়েরা আবার কী সুন্দর! বেশিরভাগই সাজানো গোছানো, যত্নের সৌন্দর্য। সুন্দর তো সটান পুরুষ।" আমরা বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। কখনও বিকেলে ওর কলেজের সামনে হাজির হতাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বিটি রোড। রাস্তায় কখনও কোনও সুদর্শন পুরুষ দেখলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত। আমাকে ওর হাত ধরে টেনে আনতে হত। আমি ওর কাছে ঝিমলির গল্প করতাম। মন দিয়ে শুনত।
অপু যে আমাকে অত্যন্ত পছন্দ করত এটা কোনওদিনও গোপন করেনি। বরং স্থানকালের তোয়াক্কা না করে এমন সোচ্চারে তা প্রকাশ করত যে আমি প্রায়শই বিব্রত হতাম। একদিন বাসে দেখা। ভিড় বাসে সবার সামনে জোরে বলে উঠলো, "এই বিভাসদা, 'ধুম' দেখেছ?"
"না। সুজিতের সঙ্গে তোমার দেখা হয়?" প্রসঙ্গ ঘোরানোর চেষ্টা করি।
"শোনো না, ধুম দেখে এসো। দারুণ বই। আর জানো, জন আব্রাহামকে না একদম তোমার মতো দেখতে।" আমার অস্বস্তি হয়। সহযাত্রীদের মুখে চাপা কৌতুক লক্ষ করি। বলতে পারি না, আলাপের দিন তো কবীর বেদীর মতো দেখতে বলেছিলে। আরেক দিন আমাদের বাড়িতে বসে অ্যালবামে আমার একটা সাদা প্যান্ট, সাদা টিশার্ট পরা ফটো দেখে চেঁচিয়ে উঠল, কী সুন্দর লাগছে তোমায়! ঠিক যেন পতৌদি! এই ছবিটা আমি নিলাম। কবির বেদী, জন আব্রাহাম আর পতৌদি, এই তিনজনের সঙ্গে যে একই মানুষের দেখার মিল থাকতে পারে না সে কথা ওকে কে বোঝাবে!
শুধু আমাকে যে ভালোবাসে এ কথাটা ও গোপন রেখেছিল। কখনও বুঝতে দেয়নি। অথবা আমিই বুঝতে পারিনি। প্রায় প্রতি মাসেই এক আধবার কলেজ কেটে চলে আসত আমাদের বাড়ি। আমার নিচু ছাদের মেজেনাইন ফ্লোরের নিরিবিলি ঘরটিতে তুমুল আড্ডা হত। হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে ও গাইতে বসলেই, মা হাতের কাজ ফেলে এসে যোগ দিত সেই আড্ডায়। মাও বেশ পছন্দ করত অপুকে। ভালোবাসত ওর হাসিখুশি উচ্ছল স্বভাব। গান হত, সিনেমার কথা হত, আর হত কোটেশন আদান-প্রদান। অপুর ব্যাগে সবসময় থাকত একটা গোলাপি কাগজের ছোটো ডায়েরি। কোনো কবিতার দুটো লাইন ভালো লেগেছে বললেই ও টুক করে ব্যাগ থেকে সেই ডায়েরিটা বের করে ওর মুক্তোর মতো হাতের লেখায় লিখে নিত। একদিন খুব উত্তেজিত হয়ে এসে বলল, "বাবা একটা নতুন জিনিস কিনে দিয়েছে। কী বলো তো?"
"আমি কী করে বলব! কী কিনে দিয়েছে?"
ব্যাগ থেকে একটা মোবাইল বের করে বলল, "নোকিয়া ৭৬৫০, ক্যামেরা আছে। চলো, ছাদে চলো, তোমার ফটো তুলে ক্যামেরার উদ্বোধন করব।"
আমার তখনো মোবাইল ফোন কেনা হয়নি। ছাতে যেতেই হল। ফটোগ্রাফারের মতো আমাকে নানান ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে অনেক ছবি তুলল। অপুর পাগলামির কোনও ঠিক-ঠিকানা ছিল না। আরেক দিন একটা ছোট্ট, তিন-চার ইঞ্চির চারা গাছ এনে নিজের হাতে পুঁতে দিল আমাদের সদর দরজার পাশের মাটিতে। মা তো খুব খুশি। হাত-টাত ধুয়ে আমার ঘরে এসে বলল, "আজ একটা চারা পুঁতে দিলাম তোমাদের বাড়ির উঠোনে।"
বললাম, "কেন? কী গাছ?"
"অপরাজিতা। যেদিন প্রথম ফুল ফুটবে, দেখ, সেদিন ঠিক আমার সঙ্গে তোমার দেখা হবে, সে তুমি যেখানেই থাক।"
"পাগলি!" হেসে বলেছিলাম।
ইতিমধ্যে অপু একদিন এমন দিনে এল যেদিন ঝিমলি বাড়িতে ছিল। ওকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলাম। অপু ঝিমলিকে দেখে বলল, "এ তো বাচ্চা মেয়ে, খুব মিষ্টি দেখতে।"
তার উত্তরে ঝিমলি, "আমি জয়েন্টের প্রিপারেশন নিচ্ছি, এখন খুব ব্যস্ত। আপনারা রবীন্দ্রসংগীত গান, আমি উঠি," বলে আমার দিকে একবারও না তাকিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অপু আবারও, "কী মিষ্টি দেখতে!" বলে সত্যি সত্যিই হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গান ধরল, "আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব..." আমি গান শুনব কি, শুধু ভাবছি ঝিমলি না জানি কী প্রতিক্রিয়া দেখায় পরে!
না, ঝিমলির সঙ্গে দেখা হলে এই প্রসঙ্গই তুলল না। বেঁচে গেলাম। এভাবেই আরও মাস কয়েক কেটে গেল। আমিও একটা নোকিয়ার ফোন কিনলাম। ঝিমলির জয়েন্ট আর অপুর পার্ট টু পরীক্ষা দুয়েরই পাট মিটল। আমারও ছাব্বিশ পেরোল। মা বলা শুরু করল, চাকরি-বাকরি জোগাড় করে এবার বিয়ে কর।
একদিন বিকেলে অপু এল। ওর বিয়ের কার্ড দিতে।
"হবু বর কেমন? নিশ্চয়ই হেব্বি দেখতে!" দেখার প্রতি ওর অসীম দুর্বলতার কথা মাথায় রেখে জানতে চাইলাম।
"দেখিইনি।"
"সে কি! আজকাল আবার না দেখে বিয়ে হয় নাকি!"
"বিভাসদা, তুমি আমার হবু শ্বশুরকে দেখনি। দেখলে পাগল হয়ে যাবে। কী দেখতে ভদ্রলোককে! পুরো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যেদিন উনি প্রথম আমাকে দেখতে এলেন, সেদিনই আমি ঠিক করেছি ওঁর ছেলেকেই বিয়ে করব," হাসতে হাসতে বলল যেন দারুণ মজার কথা।
বললাম, "বিয়ের পরে আবার কবে কোথায় দেখা হবে, আজ গান শোনাবে না?" হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে শুরু করল, 'আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন...।' বললাম "কীসব দুঃখের গান গাইছ। এত আনন্দের দিন। অন্য গান করো।" খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে এলোমেলো সুর বাজাল। তারপর ধরল, 'ডেকো না আমারে, ডেকো না, ডেকো না। চলে যে এসেছে মনে তারে রেখো না... '। গাইতে গাইতে দেখলাম ওর গলা বুজে আসছে। স্বর কাঁপছে। হঠাৎ খাট থেকে নেমে আমার চেয়ারের সামনে মেঝেতে বসে পড়ে ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করল। ভাবলাম, বিয়ে হয়ে চলে যাবে তাই মন খারাপ। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, "কী হয়েছে পাগলি, কাঁদছ কেন? বাপের বাড়ি এলে আবার এখানে আসবে, আড্ডা মারব।"
"তুমি কিচ্ছু বোঝ না, না বিভাসদা? তুমি সত্যিই কোনওদিন কিছু বুঝতে পারনি?"
"কী? তুমি তো কখনও কিছু বোঝাতে চাও নি। তাছাড়া তুমি তো জানোই আমি ঝিমলিকে...”
"না, না, ঠিকই তো। সরি! আমি সরি। ঝিমলি খুব ভালো মেয়ে, আমি চাইনি তোমাদের..."
"হোয়াট দ্য হেল ইজ গোয়িং অন?" ঝিমলি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, "মাসীমা, আমাকে তোমাদের চা-টা এখানে একটু দিয়ে যেতে বলল। মাসীমা সন্ধ্যা দিয়ে আসছে।" ঝিমলি ঠক করে সেন্টার টেবিলে ট্রে-টা নামিয়ে আমার দিকে একটা তপ্ত দৃষ্টি হেনে বেরিয়ে গেল। অপু তখনও আমার পায়ের কাছে বসে।
"ইশ। ও কী ভাবল। ছিঃ! ছিঃ! কী লজ্জা! খুব ভুল করে ফেললাম। আমি এখন আসি। বিয়েতে মাসীমাকে নিয়ে এসো কিন্তু," বলে চা না খেয়েই অপুও তরতরিয়ে নেমে গেল।
সেদিন সন্ধ্যায় ঝিমলি ছাতে উঠল না। পরের দিনও না। তার পরের দিনও না। ঝিমলির কোনও মোবাইল ছিল না। থাকলে মেসেজ করতে পারতাম। একই বাড়িতে থেকেও যখন তিন দিন আমাদের দেখা হল না, আমি একটা কাগজে "বঁধু মিছে রাগ কোরো না, কোরো না, মম মন বুঝে দেখো মনে মনে...কোরো করুণা," লিখে খামে ভরে ঘর মোছার ঠিকে কাজের মাসিকে দিয়ে পাঠালাম। একটু বাদেই মাসি খামটা ফেরত দিয়ে গেল, খুলে দেখি ঝিমলি উত্তর দিয়েছে। "ফাক অফ্! হেল উইথ ইওর রবীন্দ্রসংগীত। মাকাল।"
অপুর বিয়েতে যাব না-ই ঠিক করেছিলাম। নিজে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো দেখতে শ্বশুর জোগাড় করে বিয়েতে বসছে, আমার আর ঝিমলির সম্পর্কটা বরবাদ করে দিয়ে গেল! বিয়ের দিন সকালবেলায় ইচ্ছে করেই গড়িয়ায় এক বন্ধুর বাড়ি চলে গিয়েছিলাম আড্ডা দিতে, তারপর ওর সঙ্গে বিকেলে কলেজস্ট্রিট কফিহাউজে। কিন্তু সন্ধ্যায় সেখান থেকে ফেরার পথে হঠাৎ সৈয়দ মুজতবা আলীর উপন্যাস সমগ্র কিনে অভ্যাস মতো বইয়ের প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথের দুটি পঙ্ক্তি লিখে সোজা বিয়ে বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম। আমাকে অমন সাধারণ পোশাকে দেখে অপু অবাক হয়েছিল। আবার এসেছি বলে খুশিও। মাকে না নিয়ে আসার জন্য অভিযোগও করল। আমি অবশ্য বর আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি, উপহার দিয়ে, না খেয়েই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। বাড়ি ঢুকতেই মা বলল, "জানিস, আজ অপুর লাগানো গাছটাতে প্রথম ফুল ধরেছে।"
আমি চমকে উঠেছিলাম।
এর কদিন বাদেই জয়েন্টে এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলে ঝিমলি বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে ওখানকার হোস্টেলে চলে গেল। ওর বাবাও ঘর ছেড়ে দিয়ে পাইকপাড়ায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেল ক’দিন পরেই। ঝিমলির সঙ্গে আমি আর কথা বলতে পারিনি। আমি শুধু একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলাম সেই কাজের মাসির হাতে, "যদি আর কারে ভালবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস, তবে তুমি যাহা চাও..." লিখে। ঝিমলি যেদিন বাঁকুড়ার জন্য রওনা দিচ্ছে, মাকে প্রণাম করে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দিকে নীরবে সেই চিরকুটের খামটা বাড়িয়ে দিল। আমি দৌড়ে আমার ঘরে এসে খামটা খুলে দেখলাম, ঝিমলি সেই চিরকুটটার পেছনে লাল কালি দিয়ে শুধু লিখেছে, 'Trichosanthes Tricuspidata'... যার মাথামুণ্ডু কিছুই তখন বুঝতে পারিনি। পরে পাড়ার অশোকদা, বেশ পণ্ডিত মানুষ, উইকিপিডিয়া খুঁজে বলে দিলেন এর মানে মাকাল ফল।
আমি একা। কিছুই আর ভালো লাগে না। ঝিমলির বিরহে খাতা ভর্তি করে কবিতা লেখার চেষ্টা করি। তন্ময়, এক বন্ধু যে ভাল কবিতা লেখে, একদিন কফিহাউসে বসে আমার লেখাগুলো পড়ে বলল, "একটা কথা বলব? কঠিন কথা, নিতে পারবি?"
বললাম, "আমি ট্রাইকোসানথাস ট্রাইকাসপিডাটা, সব সহ্য করতে পারি।"
তন্ময় ভুরু কুঁচকে বলল, "ও, আমি জানতাম তুই স্যাজেটেরিয়ান। যাকগে, কথাটা হল, তোর লেখাগুলো বস্ কবিতা হয় না। ফালতু এই চেষ্টা না করে এবার জীবনটা নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু ভাব।"
আমার বিশেষ ভাবতে হল না, আমার চৌখস মা সব ব্যবস্থা করে দিল। কোথা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এল মুম্বাইয়ের সোনার কারবারি সজল জানার এক মাত্র কন্যা শ্বেতা জানার সঙ্গে। নায়কোচিত চেহারা তো ছিলই, তারপর বাবার রেখে যাওয়া চার চারটে দোকান, নিজেদের বাড়ি, বি.কম. ডিগ্রি আর ঝাড়া হাত পা পরিবার, সব মিলিয়ে পাত্র হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হলাম। ঠিক আঠাশ বছর বয়সে বিয়ে করে মুম্বাইবাসী হলাম।
শ্বশুরের জাভেরি বাজারে ব্যবসার হিসাবপত্র সামলানোর দায়িত্ব পড়ল আমার ঘাড়ে। কলকাতার বিটিরোডের ওপরে দোকান চারটে বিক্রি করে মালাডে একটা ফ্ল্যাট কিনলাম। শ্বশুরমশাই নানাভাবে সাহায্য করলেন। বাকি টাকা মায়ের নামে ব্যাংকে জমা পড়ল। নতুন বউকে দেখে ঝিমলিকে ভুলে গেলাম। নতুন বউ শ্বেতাও যথেষ্ট সুন্দরী। ফুলশয্যায় আংটি পরিয়ে, একটা খাম হাতে দিলাম। কৌতূহলী ভ্রূভঙ্গি করে নতুন বউ বলল, "ক্যাশ টাকাও দিচ্ছ?"
"খুলেই দেখ না," স্মিত মুখে বললাম। শ্বেতা মুম্বাইয়েই বড় হয়েছে, সেখানেই পড়াশোনা করেছে, বেশ সপ্রতিভ। খাম খুলে সোনালী ফুল ছাপ, সুগন্ধি কাগজটা বের করে বলল, "এটা কী লিখেছ? আমি তো বাংলা পড়তে পারি না।"
"তুমিও একটা ট্রাইকোসানথাস ট্রাইকাসপিডাটা," বলে ওকে বুকে টেনে নিলাম। কাগজটায় লিখেছিলাম, "ওহে সুন্দর, মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি।"
বিয়ের পাঁচ দিনের মাথায় আমার সেই মেজেনাইন ফ্লোরের ঘর ছেড়ে, নতুন বউকে নিয়ে মুম্বাই চলে আসি। হাওড়া স্টেশনের জন্য যখন তিনটে সুটকেস সহ নতুন বউকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম, সদর দরজায় মা দাঁড়িয়েছিল। আর ছিল মায়ের পাশেই বারান্দার রেলিং জড়িয়ে ফুটে থাকা অসংখ্য নীল অপরাজিতা।
মা একমাত্র ছেলেকে নিজের উদ্যোগে বিয়ে দিয়ে মুম্বাইয়ে পাঠিয়ে দেয়ার পর এক বছরের মধ্যেই একা একা হাঁপিয়ে উঠল। মধ্যে অবশ্য দু বার মুম্বাইয়ে এসে দিন পনেরো কুড়ি কাটিয়ে গেছে। কিন্তু এখানকার ছোট ফ্ল্যাটেও মায়ের দম বন্ধ হয়ে আসত। এক বছর বাদে মা ফোনে বলল, "বাড়িতে সারাদিন একা থাকতে ভালো লাগে না, রাতে ভয়ও করে। তাই বাড়িটা ভাবছি প্রোমোটারকে দিয়ে দেব, ফ্ল্যাট বাড়ি হলে পাশাপাশি কথা বলার প্রতিবেশীও পাব আর নিরাপত্তাও থাকবে।"
সারা জীবনই মায়ের যেমন কথা তেমন কাজ। সই সাবুদ করতে কলকাতায় গেলাম। আমি কলকাতায় এসেছি শুনে সুজিত এল দেখা করতে। ওর কাছে খবর পেলাম অপুর বিয়ে ভেঙে গেছে। কী কারণে ভাঙল, যদিও সেটা কেউ জানে না। অপু নিজে মুখে কুলুপ এঁটেছে। তবে নানান জনে নানান কথা বলছে। এত বছরের বাড়িটা ভাঙা হবে ভেবে মনটাও খারাপ ছিল, অপুকে নিয়ে ভাবার আর সময় পেলাম না। যত দিন না আমাদের জমিতে নতুন বাড়ি হবে ততদিন থাকার জন্য প্রোমোটার মাকে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিল। তবে তাতে জিনিসপত্র রেখে মা বেশিরভাগ সময়টাই মুম্বাইয়ে আমাদের কাছেই ছিল। ঠিক এক বছর বাদে, ২০১০-এ আমাদের জমিতে চারতলা আবাসন তৈরি হল। দু তলার দুটো আর তিন তলার একটা ফ্ল্যাট পেলাম। মা ফিরে এসে দোতলার ফ্ল্যাটটায় একার সংসার গুছিয়ে বসল। দোতলার অন্য ফ্ল্যাটে ভাড়াটে বসালো। এগারো মাসের চুক্তি করে। আর ফ্ল্যাটের বড় ব্যালকনিতে টবে বাগান করল। লঙ্কা, টমেটো, ধনেপাতা থেকে গাঁদা, দোপাটি, নয়নতারা, নাইন ও ক্লক। আর আগের বাড়ির উঠোনের সেই অপরাজিতার বীজ থেকে অপরাজিতা। মা নতুন ফ্ল্যাট সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার চার মাস পরে আমি আর শ্বেতা কলকাতায় এলাম। দিন দশেকের ছুটি নিয়ে।
একদিন রবীন্দ্রসদন থেকে মেট্রো নিয়েছি। একাই। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। শিশির মঞ্চে একটা বাংলা নাটক দেখতে এসেছিলাম। শ্বেতা মায়ের সঙ্গে বাড়িতেই ছিল, ওর বাংলা নাটক দেখার কোনো আগ্রহ নেই। মেট্রোয় ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখি, সামনেই অপু বসে। আমাকে দেখেই একদম আগের মতই হৈহৈ করে উঠল। একগাল হেসে বললো, “কত দিন বাদে তোমাকে দেখলাম বিভাসদা। প্রায় পাঁচ বছর, তাই না? তুমি তো এখনও দেখতে ঠিক তেমনই আছো। সুজিতদার বাড়িতেও তো আর আসো না!"
আমি কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই বলল, "জানি, জানি এখন বম্বে থাকো। বিয়েতে তো নিমন্ত্রণও করলে না!" কৃত্রিম অভিমানে এক মুহূর্ত মুখ গম্ভীর করে থাকল। পরক্ষণেই আবার, "তোমার বউকে নাকি খুব সুন্দর দেখতে, সুজিতদার মুখে তোমাদের সব খবরই পাই।"
আমি শুধু হাসলাম। ও একাই কথা বলে চলল, গোলপার্কে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করছে। সরকারি চাকরিরও পরীক্ষা দিচ্ছে। এখন সুভাষ কলোনীর বাপের বাড়িতেই থাকে। আর রোজ এই সময়ে মেট্রোতেই ফেরে। বুঝতে পারছিলাম আমি চেষ্টা করেও আর আগের মতো সহজ হতে পারছি না। ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে যেন কেমন এক অচেনা অস্বস্তি হচ্ছিল। বললাম, "অপু, আমার একটা জরুরি কাজ আছে। আমি গিরীশ পার্কে নেমে যাব।"
গেটের দিকে এগোতে যাব, হঠাৎ ঘন নিচু স্বরে ডাকল, "এই বিভাসদা, শোনো!"
থমকে ওর চোখের দিকে তাকালাম। ঠিক আমার সামনেই ও সিটে বসে। আশেপাশের সহযাত্রীদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমার চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে বলল,
"আপ পছতায়ে নেহি জোরসে তওবা না করে
আপকে সরকি কসম 'দাগ' কা হাল আচ্ছা হ্যায়।" আর তারপরই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। আমি ওর চোখ থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে ভিড় ঠেলে গেটের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। গিরিশ পার্কে নেমে পরের মেট্রো ধরে দমদমে আসি। ফ্ল্যাটে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে বসেছি, মা হঠাৎ বলল, "ব্যালকনিতে গিয়ে দেখ। আজ অপরাজিতা গাছটাতে প্রথম ফুল ফুটেছে। ভাগ্যিস আমি বাড়ি ভাঙার আগে বীজগুলো গুছিয়ে রেখেছিলাম।"
আমার ব্যালকনিতে যেতে ভয় করছিল। আমি উঠে বেডরুমে শ্বেতার পাশে, যেখানে বসে ও টিভি সিরিয়াল দেখছিল, গিয়ে বসি। তার দু’দিন পরেই আমি আর শ্বেতা মুম্বাই ফিরে আসি।
ঠিক এক বছর। হ্যাঁ, ঠিক এক বছর থাকার পরে এই নতুন ফ্ল্যাটেও মার মন টিকল না। আবার সব বিক্রি করে কলকাতার পাট চুকিয়ে মা পাকাপাকিভাবে চলে এল মুম্বাইয়ে। আমরাও একটা দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট নিলাম। আসলে মা আমাদের সঙ্গেই থাকতে চাইছিল। কিন্তু ঠিক আড়াই মাসের মাথাতেই ঘুমের মধ্যে চলে গেল। এখন মনে হয়, মা কি টের পেয়েছিল, তাই নিজে থাকতে থাকতেই আমাকে সব গুছিয়ে দিয়ে গেল!
***
রাতে আমারও ঘুম পুরো হয়নি বলে জাভেরি বাজারের অফিসে বসে দুপুর থেকে হাই উঠছিল। হাতের কাজ শেষ করে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়ি। শেয়ার ট্যাক্সিতে মেরিন লাইন্স স্টেশনে এসে বোরিভিলির ট্রেন ধরি। তখনও অফিস ছুটির সময় হয়নি বলে ফাঁকা ট্রেন। ট্রেনের পূব দিকের দরজায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে খেতে ফিরছিলাম। খার স্টেশন ক্রস করেই সিগনাল না পেয়ে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়ল। পাশেই সিগনালের কারণে দাঁড়িয়ে আছে চার্চগেটমুখী একটা ট্রেন। এত কাছাকাছি যে ঝুঁকে দুই ট্রেনের যাত্রী বোধহয় হ্যান্ডশেক করতে পারে। হঠাৎ শুনি এক মহিলা কন্ঠ, "এই বিভাসদা..."
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিপরীতমুখী ট্রেনের লেডিস কামরার দরজায় রড ধরে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে এক মহিলা। ঘন কৃষ্ণাঙ্গী। কপাল ঢেকে মাথায় ফুল ছাপ স্কার্ফ বাঁধা। শীর্ণ, গাল ভাঙা। বিশাল চোখ দুটো অতিরিক্ত উজ্জ্বল। ঈষৎ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ সরিয়ে নিই।
"চিনতে পারছ না, আমি অপু, বিভাসদা।"
চমকে উঠি। মনে পড়ে যায় আজ সকালেই প্রায় দশ বছর আগে অপুর পোঁতা সেই অপরাজিতার বীজ থেকেই হওয়া নতুন গাছে, প্রথম ফুল ফুটেছে।
"তুমি, এখানে?" ঘটনার আকস্মিকতায় এর চেয়ে বেশি কিছু কথা বেরোয় না। কথাও জোরে বলতে হচ্ছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলেও দুই ট্রেনের মধ্যে কম করে আট দশ ফুটের দূরত্ব তো হবেই।
"দেখে বুঝতে পারছ না? খুব দেরিতে ধরা পড়েছে গো। চিকিৎসার জন্য এসেছি। টাটা হাসপাতালে। যদিও কোনো লাভ হবে না, জানতামই," হাসল এমন ভাবে যেন কোনো সাধারণ কথা বলছে। তারপরেই বলল, "তোমার কি বয়স বাড়ে না, বিভাসদা? এখনও দেখছি তেমনি সুন্দর আছ।"
"এখানে তুমি কোথায় আছ, অপু?" আমি ব্যস্ত হয়ে বলি। ট্রেনে হর্ণ বাজল। যে কোনও একটা ট্রেন চলতে শুরু করলেই অপু আবার হারিয়ে যাবে।
"আমি কালই কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি," ট্রেন দুলে ওঠে, অপু একটু ঝুঁকে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, "এই বিভাসদা, শোনো না, তুমি এখনও উপহারে কোটেশন লিখে দাও?" আমি ঝুঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ওর এক মুখ হাসি। সচল ট্রেনের দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে অপু হাত নাড়ল।
আমি ট্রেনের ভেতরে এসে ফাঁকা সিট দেখে বসে পড়ি। আমি এমন মাকাল, এত কথা হল, অথচ ওর ফোন নম্বরটাও চাওয়া হল না। বুকের ভেতরটা হঠাৎ শীতল ও শূন্য অনুভব হয়। মনে পড়ে যায় ওর বিয়ের উপহারে লিখে দিয়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপের শেষ দু লাইন,
"আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে।
ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে।"
কেন লিখেছিলাম? কোনও মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ের বিয়ের উপহার যে তার ব্যক্তিগত উপহার থাকে না, পরিবারের অনেকে মিলে সে সব উপহার নাড়া চাড়া করে, সে কথা একটি ছাব্বিশ বছরের ছেলে সেদিন কেন বুঝিনি! নাকি ঝিমলিকে হারানোর জন্য অপুকে দায়ী করে প্রতিশোধ নিয়েছিলাম। কেন জানি মনে হল, অপুর বিয়ে ভাঙার পেছনে আমার ওই হঠকারী উদ্ধৃতির কোনও ভূমিকা থেকে থাকবে।
বাড়ি ফিরেই সোজা জানলাম কাছে গিয়ে দাঁড়াই। পশ্চিমে তখন সূর্যাস্তের লাল আভা। সকালে ফোটা অপরাজিতা ফুলের পাপড়িটা কুঁচকে আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
"বাঁচানো যাবে বলে মনে হয় না," বিস্মিত শ্বেতা পিঠে হাত রেখে বলে, "মায়ের কথা মনে পড়ছে, তাই না? আমি চেষ্টা করব, যদি বাঁচানো যায় গাছটা।"
আমি শ্বেতাকে জড়িয়ে ধরি। প্রায় ফিসফিস করে বলি, "প্লিজ, চেষ্টা কোরো।"