• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • বোকা : অনিরুদ্ধ সেন

    “ডাক্তার, আপনার কাছে বোকা হওয়ার কোনো ওষুধ আছে?”

    ডঃ রায় কৌতূহলী চোখে সামনের মানুষটির দিকে তাকালেন। ডাক্তারটি এই শহরে নতুন, তবে তাঁর সামনের রোগীটি এলাকায় সুপরিচিত। কয়েক বছর আগে রিটায়ার করলেও লোকে তাঁকে এখনো মাস্টারমশাই বলে।

    ডাক্তারও তাই সম্ভ্রমজড়ানো স্বরে বললেন, “কেন মাস্টারমশাই, আপনার আবার কী হল?”

    রোগী কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “সে তো অনেক ব্যাপার। আপনি ব্যস্ত মানুষ, আপনার কি –”

    “ধরুন, সময় হল? নিন, খুলেই বলুন।” ডাক্তার আড়চোখে ঘড়ি দেখলেন। এ বেলায় এটিই শেষ রোগী, নয় মধ্যাহ্নভোজনে একটু দেরি হবে।

    “আসলে, বয়স তো হয়েছে। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো, ধরুন চোখ, কান, দাঁত, ফুসফুস, পেট ইত্যাদি ধীরে ধীরে বিকল হচ্ছে। কিন্তু দুশ্চিন্তার ব্যাপার, তার সঙ্গে তাল রেখে বুদ্ধিটা কমছে না। দিনে রাতে ব্যাটা মাথার মধ্যে পাক খায় আর জ্বালায়।”

    “মা-নে?”

    “ধরুন, রাত দুটো নাগাদ ঘুম ভেঙে গেছে। জলটল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ব, হঠাৎ মাথায় এল – আজই টিভিতে এক শিল্পপতি বলছিলেন, লোকের হাতে টাকা দেবার সরকারি স্কিমগুলি মানুষের খেটে খাবার ইচ্ছে নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু কেইনস তো আবার বলেছেন, মন্দার সময় সরকারের উচিত যেভাবে হোক লোকের হাতে টাকা তুলে দিতে। তাহলে?”

    “বাপ রে, গভীর রাতে এইসব গম্ভীর বিষয় নিয়ে ভাবলেন?”

    “ইচ্ছে করে কি ভাবলাম? ব্রেনের চুলকোনি ভাবতে বাধ্য করল।”

    “শেষ অব্দি নিস্পত্তি হল?”

    “সে একটা হল। কিন্তু মধ্যের থেকে, আমার ঘুমের বারোটা বাজল।”

    “শুধু রাতেই হয়?”

    “না তো। আরেক দিন মধ্যাহ্নভোজের পর একটু রিলাক্স করার জন্য সত্যজিৎ রায়ের ‘শঙ্কু’ নিয়ে বসেছি, হঠাৎ ঐ চুলকোনি। মনে হল, আধুনিক বিজ্ঞানের দুই ‘ক্রেজ’ কোল্ড ফিউশন আর কোয়ান্টাম কম্পিউটিংকে কি এক সুতোয় বাঁধা সম্ভব?”

    “সর্বনাশ! শেষ অবধি পেলেন আপনার সুতো?”

    “তা পেলাম, শক্তি সঙ্কটের সমাধান। কোল্ড ফিউশন অঢেল শক্তি জোগাবে আর কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এ-আইর অফুরন্ত শক্তির চাহিদাকে কমিয়ে ধরার সীমায় নিয়ে আসবে। কিন্তু এটা ভাবতে ভাবতে ততক্ষণে শঙ্কু উধাও।

    তাই বলছিলাম, যদি আপনার কাছে বুদ্ধি কমানোর, নিদেনপক্ষে ভোঁতা করার কোনো ওষুধ থাকে –”

    একটু ভেবে ডাক্তার বললেন, “সমস্যাটা তো আপনার মনের গভীরে। আমি বরং একজন ভালো মনোবিদের ঠিকানা দিচ্ছি –“

    “না ডাক্তার, এটা শ্রিঙ্কের কেস নয়। আমার লং টার্ম মেমরি চমৎকার, লজিকাল রিজনিং অটুট। এই বয়সে ডিমেনশিয়া শর্ট টার্ম মেমরিতে থাবা বসায়, আমার ক্ষেত্রে তারও কোনো লক্ষণ নেই। এই তো সেদিন বাজার থেকে কী আনতে ভুলে গিয়েছিলাম, মেয়ে গম্ভীরমুখে এসে বলল, ‘দেখি, তোমার ডিমেনশিয়া সেট করছে কিনা। বলো তো, আজ সকালে কী খেয়েছ?’ দিলাম বলে গড়গড়িয়ে, জেলি-পিকলের ব্র‍্যান্ডের নাম শুদ্ধু। তারপর, ‘মনে পড়ে, আমরা সবাই শেষ কোন সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম?’ বললাম, ‘শিবু-নন্দিতার বহুরূপী। আর কেন গিয়েছিলাম তাও মনে আছে, তোর এগারো ক্লাসের রেজাল্ট সেলিব্রেট করতে। তুই ইংরেজিতে সাতাশি, অঙ্কে আটানব্বই, ফিজিক্সে ছিয়ানব্বই আর কেমিস্ট্রিতে পঁচানব্বই পেয়েছিলি। শুধু বাংলাটাতেই –’ ‘থাক, থাক, আর বলতে হবে না।’ বলে সে হাওয়া।

    কাজেই মনে হয় আপনার শ্রিঙ্ক আমার ডিমেনশিয়া, অ্যালঝেইমার্স, বাইপোলার, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, সাইকোসিস, প্যারানইয়া, কিছুই পাবে না। শেষে কিছু ট্রাঙ্কুইলাইজার দিয়ে বিদায় করবে।”

    ডাক্তার ক্লান্তস্বরে বললেন, “আমিই কি কিছু পাব?”

    মাস্টারমশাই প্রত্যাশী চোখে চেয়ে বললেন, “আপনারা তো বুদ্ধি বাড়াবার ব্রেনোলিয়া-টিয়া কীসব ওষুধ দেন। তেমন বুদ্ধি কমানোর –“

    ডাক্তার গম্ভীরমুখে বললেন, “দেখুন, ওসবের ব্যবসা রমরমে কিন্তু কার্যকারিতা মেডিকালি ভেরিফায়েড নয়। আমি ভাবছিলাম, কোনো হাল্কা ঘুমের ওষুধের কথা বলব। কিন্তু আপনি তো একটু আগেই তার পেছন – সরি, পথ বন্ধ করে রাখলেন।”

    “ঘুমের ওষুধে নয় রাতটা কাটালাম। কিন্তু দিনের গুঁতোগুলো সামলাব কী করে? যাক, আপনি নিশ্চয়ই বুড়োর ভ্যাজভ্যাজানি শুনতে শুনতে বোর হচ্ছেন।”

    “একটুও না, বলুন আপনার গুঁতোর কথা।”

    “জানেন তো, বুড়োদের অনেক রকমের আড্ডা আছে। তার একটায় মাঝে মাঝে বসি। একদিন দেখি, সবাই গভীর তত্ত্ব আলোচনা করছে আবার ইতিউতি চাইছে। তাও চলত, তারপর শুরু হল এখনকার জেনারেশনের মুণ্ডপাত। এক সময় আর সইতে না পেরে বললাম, ‘আমরা ছোটবেলায় কেমন গোপাল বালক ছিলাম আর এখনকার ছোকরাছুকরিরা কী অমানুষ হয়েছে, বুড়োহাবড়াদের এই ভ্যাজভ্যাজানি অনাদিকাল থেকে চলছে। তাতে নেক্সট-জেনের এগিয়ে চলা কোনোদিন বন্ধ হয়নি, আজও হবে না। তাই পিএনপিসি ছেড়ে আর আড়চোখে পাসিং লেডিদের দেখা বন্ধ করে বরং কনস্ট্রাক্টিভ কিছু করুন, ধরুন শৃঙ্গার রসের আলোচনা। কালিদাস-জয়দেব, সমরেশ-সুনীল যা খুশি। এতে শরীর-মন দুয়েরই স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।’ “

    “এইসব বললেন?”

    “ঠিক হয়নি, না? কিন্তু কী করব বলুন, ঐ যে মগজের চুলকোনি।”

    “আপনার সমস্যাটা একটু-একটু বুঝতে পারছি। শুধু এই?”

    “আরো কত আছে। যেমন ধরুন, সুবোধের কাছ থেকে আমি দশ বছরের ওপর ফল কিনি। বিশ্বাসী লোক। সেদিন বললাম, বাপু, দেখেশুনে এক ডজন কমলা দাও তো। আমি চোখে অত ভালো দেখি না। কিন্তু ওর হাত চালানো দেখে বুঝে নিলাম, গোটা দুই দাগি ফল গছিয়ে দিল।

    ‘আপনাকে বলতে হবে না, আপনি আমার অ্যাদ্দিনের খদ্দের।’ সুবোধ ঠোঙাটা এগিয়ে ধরল।

    বললাম, ‘সে তো বটেই। তোমাদের তো কামধান্দা করে খেতে গেলে দাগি ফলগুলোও কাউকে চালাতে হবে। সেটা চেনা খদ্দেরকে দেওয়াই ভালো। অচেনা কাউকে দিলে তো ঘুরে এসে গাল দিয়ে ফিরিয়ে দেবে।’

    ‘দিন বাবু, পাল্টে দিচ্ছি।’ গম্ভীরমুখে বলল সুবোধ। কিন্তু ততক্ষণে আমি হাঁটা দিয়েছি।

    কথাটা না বললেও হত, কী বলেন? কিন্তু কী করব? মাথায় চুলকোয় – কী, আমায় বোকা বানাবে!”

    “কিন্তু এসব তো বাইরেই হয়। ঘরে এলে নিশ্চয়ই শান্তি। আর রিটায়ার করে আপনি সম্ভবত বেশি সময় –“

    “ঘরেই কাটাই। কিন্তু সেখানেও কি শান্তি আছে? ধরুন ছেলে পুণে থেকে ফোন করেছে, ‘বাবা, ভাবছি ক'দিনের ছুটি নিয়ে গিয়ে এবার তোমার আর মা'র হেলথ চেক-আপটা করিয়ে নেব। দরকার হলে –‘

    বাধা দিয়ে বললাম, ‘তুই কথাগুলি বললি বটে। কিন্তু আমার মনে হল বলতে চাইছিস, অদিতি ছোট বাচ্চা আর সংসার একা হাতে সামলাতে পারছে না। তাই এসে কয়েক মাসের জন্য মা'কে নিয়ে যাবি।’

    ‘তোমরা তো সব কথারই মানে খোঁজো।’ ছেলে ছেড়ে দিল। একটু অপ্রসন্নই হল, কী বলেন?”

    “তা আর বলতে!”

    “তারপর ধরুন মেয়ে এক সন্ধ্যায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে বলছে, ‘বাবা, তুমি প্রেসারের ওষুধটা ঠিকমতো খাচ্ছ তো? এবার একবার ডাক্তারবাবুকে দেখাতে হবে।’

    ভালো মনেই বলেছিল। কিন্তু আমি উত্তর দিলাম, ‘তুই কি বলতে চাইছিস আমি উইলটা আর কবে করব? এখন আমার ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে যে দাদার সঙ্গে তোর ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে লাঠালাঠি বাধবে।’

    সে তো গোঁসা করে দুদিন আমার সঙ্গে কথাই বলল না। তারপর ধরুন, আমার গিন্নি –“

    “থাক মাস্টারমশাই ওসব ঘরের কথা!” ডাক্তার বাধা দিয়ে বললেন, “আমি এতক্ষণে সম্যক বুঝে গেছি। তা, এই সমস্যা কি আপনার ইদানিং হচ্ছে, না আগেও ছিল?”

    “ঠিক ধরেছেন তো! এই রিটায়ার করার পর থেকে সমস্যাটা টের পাচ্ছি। আসলে বলে না, অলস মস্কিস্ক শয়তানের ডেরা? যখন স্কুলে পড়াতাম, মগজ ব্যস্ত থাকত বিচ্ছুগুলিকে ভালোবেসে, শাসন করে তাদের মধ্যে পড়ার ইচ্ছে জাগিয়ে তোলার যুদ্ধে। তখন চারদিকে তাকাবার ফুরসত ছিল না।

    আসলে, চাকরি থেকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয় বুদ্ধি আউলে যাবে, এই ভয়ে। সেটা না হলে গরমিলটা দেহমনকে অনবরত খুঁচিয়ে বিরক্ত করেই যায়।”

    “কিন্তু মাস্টারমশাই, ক্ষুরধার বুদ্ধি তো একটা সম্পদ। রিটায়ার করেছেন তো কী, এখনো আপনি বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ধরুন বই লিখতে পারেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে পারেন।”

    “লিখতে পারি, ছাপবে কে? ছাপলেও, পড়বে কে? লেখার তো কত আছে কিন্তু উৎসাহ পাই না। আজকাল নাকি ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ, ইন্টারভিউ, বিদেশে দরখাস্তের প্রবন্ধও চ্যাটজিপিটি দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে।”

    “আপনি তো শুনেছি অঙ্ক আর –“

    “ভৌতবিজ্ঞান পড়াতাম। তবে তাছাড়াও বলতে পারেন নানা বিষয়ে পড়া আর চিন্তা করা আমার নেশা। তাই অনেক সাবজেক্টেই আমার প্রাথমিক জ্ঞান আছে।”

    “দারুণ ব্যাপার! তবে তো আপনি প্রাইভেট টিউশন নিতে পারেন। একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাছ থেকে শিখে ছাত্ররা উপকৃত হবে, আপনার মস্তিস্কও আর অলস থেকে আপনাকে সমস্যায় ফেলবে না।”

    “আপনি জানেন না, সে দিন আর নেই। এখন প্রাইভেট টিউশনই বলুন, কোচিংই বলুন, তার উদ্দেশ্য হাত্রদের পাখিপড়া করে গিলিয়ে দেওয়া, যাতে তারা সেগুলো উগড়ে পটাপট দারুণ নম্বর পেয়ে কর্পোরেটদের দোকানে ভালো চাকরি পায়। স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই এমন মানুষ তাদের কাছে অপাংক্তেয়। এমনকি রিটায়ারমেন্টের আগেই শুনতাম আড়ালে গুঞ্জন – স্যার পড়ায় না, নোট দেয় না, খালি বোঝায়।”

    “সত্যিই এসব জানতাম না, জানাবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।” ডাক্তার চিন্তিত মুখে বললেন। একটু ভেবে আবার বললেন, “কিন্তু আপনি তো গরিবদের পড়াতে পারেন। তাতে টাকা হয়তো আসবে না, তবে –“

    “গরিবদের জীবনও আজকাল পাল্টে গেছে। নানা স্কিমের দৌলতে তাদের পেটে ভাত আছে, ছেলেমেয়েদের বিনে পয়সায় স্কুলে পড়ানোর সুযোগও আছে। তবু তারা মেয়েপুরুষ এটাসেটা রোজগার করে চেষ্টা করে বাচ্চাদের ইংরেজি স্কুলে দিতে আর এলাকার কোনো শিওর-সাকসেস টিউটরের টিউশন কারখানায় ঢোকাতে – যেখানে হয়তো টু থেকে এইটের গোটা তিরিশেক বাচ্চা বসে একসঙ্গে অঙ্ক, ইংরেজি, ভূগোল সব গিলছে।”

    ***

    ডাক্তার ভাবছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, “আপনার রোগটা ধরতে পেরেছি। চারপাশে স্বল্পমেধা আর মধ্যমেধাদের রাজত্বে আপনি নিঃসঙ্গ পর্বতচূড়ার বিচ্ছিন্নতায় দাঁড়িয়ে। তাই নানা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

    প্রশ্ন হচ্ছে, এর প্রতিকার কী? আমি বলি, আপনি নিজের লেভেলকে কৃত্রিমভাবে নামিয়ে এনে বোকার অভিনয় করুন।”

    “অ-ভিনয়?”

    “হ্যাঁ। আপনি নিশ্চয়ই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’তে লালকমল-নীলকমলের গল্প পড়েছেন। রাক্ষসীপুত্র নীলকমল তার মানবীপুত্র ভাই লালকমলকে নিয়ে গেছে রাক্ষপুরীতে। কিন্তু বলে দিয়েছে – ওখানে গিয়ে সব সময় রাক্ষস সেজে থাকবি, হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ করবি। একবার যদি জানতে পারে তুই মানুষ, তক্ষুণি খেয়ে ফেলবে। লালকমলও তাই রাক্ষস সেজে হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ করে যায়।

    আপনিও তেমন বোকাদের রাজত্বে বোকা সেজে থাকবেন। মনে কিছু এলেও মুখে আনবেন না। তাহলে দেখবেন, কিছুদিনের মধ্যেই আর বলতেও ইচ্ছে করছে না।”

    “এটা মন্দ বলেননি, ডাক্তার।” মাস্টারমশাই নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন, “কিন্তু অভিনয় তো আমি কস্মিনকালে করিনি। এই বয়সে –“

    “বয়সটা স্রেফ একটা সংখ্যা, মাস্টারমশাই। আর এ ব্যাপারে বোধহয় আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব। আজ কেউ জানে না, আমিও প্রায় ভুলতে বসেছি যে স্কুলজীবনে অভিনয় আমার নেশা ছিল। ক্লাবে, স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়োতাম আর স্বপ্ন দেখতাম, বড় হয়ে অভিনেতা হব। রেজাল্টও তো খুব একটা ভালো করতাম না, তাই বাড়িতে কেউ বাধাও দেয়নি।

    কিন্তু তারপর বিপদটা এল – মেডিক্যাল জয়েন্টে কীভাবে যেন ভালো র‍্যাঙ্ক পেয়ে একটা ভালো কলেজে চান্স পেয়ে গেলাম। ব্যস, আমার স্বপ্নের সমাধি।

    আমি ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু তারমধ্যেই দু-এক ঘণ্টা বের করে আমার পুরনো নেশাটা ঝালিয়ে নিয়ে আপনাকে বোকা চরিত্রে অভিনয়টা ভালো করে শিখিয়ে দিতে পারব। কিছু ব্যাপার নয়, শুধু চরিত্রটার সঙ্গে একাত্ম হবার চেষ্টা করবেন। ওটাই ভালো অভিনেতা হওয়ার রাস্তা।”

    “দারুণ বলেছেন! আর এভাবে একাত্ম হতে হতে আমি ভুলে যাব এককালে আমি বোকা ছিলাম না। তখন সবাই মিলে গাইব – আমরা সবাই বোকা আমাদের এই বোকার রাজত্বে।”

    “নইলে হবু রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?” উচ্ছ্বসিত হয়ে পাদপূরণ করলেন ডাক্তার।

    “বাঃ! কিন্তু – ঐ ‘হবু রাজা’ কথাটা – ওটা সিডিশন, মানে একশো বায়ান্ন ধারায় পড়বে না তো?”

    “নিশ্চিন্তে থাকুন, মাস্টারমশাই। পেয়াদা এলেই বলব আমরা তো হবু মানে ভবিষ্যতের রাজাকে রেফার করছিলাম, তবে আপনাদের ইস্যুটা কী?”

    “হা-হা! তবে এবার আগের কথায় ফিরি। আপনি তো আমার সমস্যার সমাধান করে দিলেন। কিন্তু আমি যে বিনামূল্যে পরিষেবা নিতে পারব না। আপনার ডাক্তারির ফী আছে, তারপর অভিনয় শেখানোর ফী। সব মিলিয়ে রিটায়ার্ড মাস্টারের পক্ষে ভারি পড়ে যাবে না তো?”

    “ওসব আমি ভেবেই রেখেছি।” ডাক্তার একগাল হেসে বললেন, “আপনি পরিষেবার বদলে পরিষেবাই দেবেন। যাকে বলে বিনিময় প্রথা। আসলে, আমার একটি ক্লাস সিক্সের বিচ্ছু ছেলে আছে। আমি তো বিশেষ সময় পাইনে। যা দু-এক ঘণ্টা পাই, তাতে ক্লাস সিক্সের ছাত্রকে পড়ানো সম্ভব নয়। আমি এগারো ক্লাসের বায়োলজি অনায়াসে পড়িয়ে দেব। কিন্তু ঐ ছোট ক্লাসের আধা পরিণত মনগুলিকে পথে এনে শেখাতে অনেক মানসিক ধকল পড়ে। তাই আপাতত ওর মা ওকে পড়ায়। কিন্তু সে নোটিশ দিয়ে রেখেছে, ‘উঁচু ক্লাসের পড়ানো আমার দ্বারা হবে না। তুমি টিউশন-কোচিং দ্যাখো।’

    সেটাই দেখতাম। কিন্তু আজ আপনার কথা শুনে ভয় লাগছে। তাই আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি যদি একটু ছেলেটার দায়িত্ব নেন। আপনাকে গেলাতে হবে না, নোট দিতে হবে না। শুধু ওকে একটু ভাবতে শেখাবেন। আপনার নিশ্চয়ই অজানা নেই যে এ-আই বা কৃত্রিম মেধা বলে একটা প্রাণী আজ দুনিয়া কাঁপাচ্ছে।”

    “কাঁপাবেই। যদি দেশে অঙ্গহীনের সংখ্যা বেড়ে যায় তবে কৃত্রিম অঙ্গের ব্যবসার রমরমা হবে। তেমন, যদি পৃথিবীতে প্রকৃত মেধার আকাল হয় –“

    “হা-হা, তখন কৃত্রিম মেধার চাহিদা আকাশ ছোঁবে। কিন্তু তার ফলে যেসব কাজ বাঁধা গতের, সেগুলো এ-আই ভিত্তিক সফটওয়্যারই করে দেবে। আর যারা মুখস্থবিদ্যা সম্বল, তারা কাজ হারাবে। তখন শুধু যারা সৃজনশীল, যারা ভেবে অভিনব কিছু বের করতে পারে, তারাই টিঁকে থাকবে। এই পাখি পড়ানোর কারখানাগুলো তখন বন্ধ হয়ে যাবে।”

    “তাই কি আর হবে? দেখবেন বানিয়ারা হয়তো ছ'মাসে সৃজনশীলতা আর কল্পনাশক্তি বিকাশের ক্র‍্যাশ কোর্স চালু করে দেবে।”

    “সে তারা করুক, আপনি বলুন কবে থেকে আসছেন?“

    “যখন বলবেন। তবে এবার উঠুন। বৌমা বোধহয় খেতে ডাকার জন্য মিসড কল দিতে দিতে হয়রান হয়ে গেছেন।”



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments