মেয়েটা অনেকটা পালটে গেছে। আরো যাচ্ছে। এখন আর নিজের মেয়েকে ঠিকভাবে চিনতে পারে না জয়দেব। বড় হবার পরে সন্তান অচেনা হয়ে গেলেও তার সুরটি ঠিক বাঁধা থাকে প্রাণের গোড়ায়। এটি আজীবনই থাকে। কিন্তু জয়দেব এখন বুঝছে এই সুরের তার কেটে গেছে। কবে, কখন, কোথায় বা কীভাবে সেটা কাটল জয়দেব বোঝে না। কিন্তু নাড়ির সেই বাঁধন যে আর নেই সেটা নিয়ে জয়দেব নিশ্চিত।
জয়দেব মণ্ডল একজন কৃষক। সারাজীবন চাষাবাদ করে এসেছে, এখনও করে। কিন্তু এখন আর কাজকর্ম করতে তার ভালো লাগে না। স্ত্রী বিয়োগের পরে মনে হয় সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে কোথাও গিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। তাতে প্রাণের আরাম হয়ত হয় কিন্তু পেট ভরে না। পাতে ভাতের জোগান রাখতে গেলে কাজ তাকে করতেই হবে; নিজের জমি নেই, কোনোদিনও তা ছিল না; পরের জমিতে কিষেন হিসেবে সে খাটে। এখন তাতে পেট ভরে, মন ভরে না। জয়দেব বোঝে, মন অন্য কিছু চায়। এমন কিছু, যা সে আগে মনকে দিতে পারেনি। কিন্তু সেটা কী, তা জয়দেব বোঝে না। তবে এটা সে বোঝে, মন আলাদা কিছুর খোরাক চাইছে, অন্যতর কিছু। কীভাবে সে মনের খোরাক মেটাবে, সেটাও সে বুঝতে পারে না।
এই সময় তারই এক সঙ্গী কৃষক তাকে বলল, তুমি তো গঙ্গার ধারে ‘ভদ্রাসন’এ যেতে পারো। ওখানে একজন সাধু আসে, সোমবার সোমবার করে, সে ধর্মকথা বলে। তুমি সেখানে যাও, মনের আরাম পাবে। আসলে তোমার মন ধর্মকথা শুনতে চাইছে।
কথাটা মনে ধরল জয়দেবের। জীবনের অনেকগুলো বেলা কাটল, ধম্ম-কম্মর দিকে সেভাবে মন দেওয়া হল না। সংসার প্রতিপালন, অন্নের চিন্তা—কখন সে ধর্মকথা শুনবে। স্ত্রী বিয়োগ, মেয়ে বিধবা হয়ে ফিরে এল বাপের সংসারে, আবার সেই অন্নের চিন্তা পেয়ে বসল। বিরুনিকে বিয়ে দিয়ে তারা ভেবেছিল, আর ‘হা অন্ন হা অন্ন’ করতে হবে না, যা জুটবে তাই খাবে। কিন্তু বিয়ের দু বছরের মাথায় জামাই মল্ল, মেয়ে ফিরে এল। এরপরে তার বউ বিরজা মারা গেল। বিরজা খুব ধার্মিক ছিল। জপতপ করত, গলায় ছিল দু পাকের তুলসি মালা। নিরামিষ খেতে পারবে না বলে জয়দেব ওসব ঝামেলার মধ্যে যায়নি। মাঠে-ঘাটে কাজের সময় গেঁড়ি-গুগলি কত কত সে নিয়ে আসত। বর্ষার সময় কত রকমের মাছ যে সে পেত তার আর ইয়ত্তা নেই। আর জল শুকুলে, আশ্বিন-কার্তিক মাসে মিলত কচ্ছপ, কাঁকড়া আর শামুক। এসবের স্বাদ থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত করতে চায়নি। ফলে এইসব মেঠো আঁশটে ফসল সে আর তার মেয়ে খেত, এদিকে তার বউ খেত নিরামিষ। এমনি করেই চলছিল তার। এখন সে শুনল ভদ্রাসনের কথা।
ভদ্রাসনের ব্যাপারটা সে জানে না তা নয়। সেটি হল বহু পুরাতন এক মন্দির। দিনে দিনে তার কলেবর বেড়েছে। সেখানে বিরজা যেত। পাড়ার আরও অনেকে যেত। এ-গ্রাম, সে-গ্রাম থেকে অনেক মেয়ে-বউ আসত। বিরজা তাকেও যেতে বলত। বলত, দুজনে একসঙ্গে দীক্ষা না নিলে কাজের কাজ কিছু হয় না। আমি একা দীক্ষা নিয়ে বসে আছি, নামজপ করছি, আর তুমি এ-পথ মাড়ালেই না! দু জনে না হলে মুক্তি নেই।
জয়দেব উত্তর করত, আমাকে সারাদিন মাঠে খাটতে হয়। ওসব নিরামিষ, শুকন-পাকনা খেলে শরীর থাকবে? মাঠে গিয়ে খাটব কীভাবে? তোমাকে তো আর হাল-বলদ চালাতে হয় না; তুমি পরিশ্রমের কী বুঝবে! মুক্তি তুমি নাও গে, আমার ওসবের আমার দরকার নেই।
দুজনের মধ্যে এইসব নিয়ে নানা কথা কাটাকাটিও হত। পরে বিরজা আর কিছু বলত না, সে বলা ছেড়ে দিয়েছিল।
এখন, বিরজার মৃত্যুর এতগুলো দিন পরে সে ভদ্রাসনের কথা শুনল। মনে হল, না, একবার যেতে হবে সেখানে। কী এমন সে টান যে বিরজা ছুটত হু-হু করে; কেমন সে ধর্মকথা?
একদিন গেল জয়দেব। সেখানে রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ আছে, আছেন বৈষ্ণবরা। তারা মাঝে মাঝে বৈষ্ণবধর্ম নিয়ে, শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে নানা কথা শোনান। ভক্তরা আসে সেই মধুর বাণী শুনতে। বেশিরভাগ সন্ধের দিকেই অনুষ্ঠান হয়। আরও ঠিকঠাক করে বললে, শুরু হয় বিকেল থেকে। শেষ হতে হতে সন্ধে। আর প্রতি সোমবার কোনো না কোনো মন্দির থেকে একজন করে সাধু আসে। ঘন্টা দুয়েক ধরে ধর্মকথা চলে।
আবার একদিন গেল জয়দেব। গিয়ে দেখল, জনা কুড়ি-ত্রিশ ভক্ত উপস্থিত। বেশির ভাগই মহিলা, পুরুষ স্বল্প। সে সকলের পিছনে বসে শ্রীকৃষ্ণের লীলা বিষয়ে পাঠ শুনল। কিন্তু ভালো লাগল না তার। কেন, তা সে নিজেই জানে না। বাকি সকলেই সেই পাঠে খুশি। গদগদ চিত্তে বিগ্রহকে সকলে প্রণাম করছে, প্রসাদ নিচ্ছে; নিজেদের মধ্যে নানাকথা আলোচনা করছে। পাঠ নিয়ে নয়, সংসার নিয়ে; মেয়ের বিয়ে নিয়ে, চাকরি নিয়ে, বা চাষাবাদ নিয়ে। এছাড়াও অন্যান্য নানা বিষয় ছিল তাদের আলোচনায়। জয়দেব নিজে প্রসন্ন হল না। সে ভাবল, বিরজা এখানে আসত প্রায়দিন। আসলে সে কী সত্যিই ধর্ম করতে আসত নাকি আসত গল্পগাছা করতে, এইসব গৃহস্থ বউদের মতন?
জয়দেব সকলের অগোচরে যেমন এসেছিল তেমনি সে বেরিয়ে পড়ল। সে এসব খুঁজছে না। এসব হল সময় কাটানোর ছল, গল্প করার ফন্দি-ফিকির। সে অন্যকিছু চায়। কী? তা সে নিজেই জানে না।
সেদিন বেরিয়েই সে বাড়ি ফিরল না। এখন বাড়ি ফেরার কিছু নেই। তার মেয়ে এখন আয়ার কাজ নিয়েছে, মাস গেলে ছয়-সাত হাজার টাকা ইনকাম করে। জয়দেব মেয়েকে নিয়ে অনেকটা চিন্তামুক্ত। মেয়ের আবার একটা বিয়ে দিয়ে সে দুচোখ বুজতে চায়। কারণ তার মনে হয়েছে, তার মেয়ে আর আগের মতন নেই; সে বদলে যাচ্ছে। কিন্তু বদলটা কোনদিক দিয়ে তা সে ধরতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে এল গঙ্গার ধারে। আধো আলো, আধো অন্ধকার এক জায়গায় এসে সে দেখল, গাছের গুঁড়ির উপর বসে আছে একটি লোক। তার পরনে মালকোঁচা মারা ধুতি, গায়ে একটি মলিন ফতুয়া। সে কিছু কথা বলছে আর তার সামনে, মাটিতে বসে কিছু চাষি, শ্রমিকেরা সেই গল্প শুনছে। জয়দেব দাঁড়িয়ে গেল। কী হচ্ছে এখানে? দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা।
লোকটা এক বেশ্যার গল্প বলছে। আর লোকজন হাঁ করে তাই গলাধঃকরণ করছে। জয়দেব বসে পড়ল সেখানে। লোকটাকে এদিকে সে আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। অবশ্যি, অনেকেই এরকম আসে, আবার চলেও যায়। মাঝে মাঝে উদয় হওয়া ও চলে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই; এদিকে এমনটা হতেই থাকে।
সে বসতেই ধুতি পরা সেই লোকটা তার গল্প থামিয়ে বলল, এই তো পরীক্ষিৎ এসে গেছে।
অমনি সকলে জয়দেবের দিকে ঘুরল। জয়দেব সকলের তফাত বাঁচিয়ে একদম পিছনের দিকে বসেছিল, যেমন সে বসেছিল ভদ্রাসনে। এখানেও তাই। সে বাতাসের প্রবাহের মতন এমনি নিঃশব্দে বসেছিল যে, বক্তিমে করা লোকটা না বললে কেউ তাকে ঘুরেও দেখত না।
লোকটা আবার বলল, তুমি যখন এসেই গেলে হে রাজা পরীক্ষিৎ, বাকি সাতদিনে আমার গল্প শুনে যাও।
জয়দেব থতমত খেয়ে বলল, আমার নাম তো পরীক্ষিৎ নয়!
আহা, নাই বা হল; ধরে নিতে দোষ কী?
পাশ থেকে একজন বলল, বেশ্যার গল্প শুনতে নিশ্চয় মজা পাবে তুমি। তাই চুপ করে বসে পড়ো।
তাই শুনে অন্যরা ফ্যাকফ্যাক করে হাসল।
গল্প বলিয়ে লোকটা বলল, আমরা কোথায় যেন ছিলাম?
বাকিরা বলল, এক ব্রাহ্মণ আর এক বেশ্যা জড়াজড়ি করছিল বাঁশবাগানে।
বাকিরা অমনি খ্যা খ্যা করে হেসে উঠল। জয়দেবের ব্যাপারটা ভালো লাগছিল না। এই বয়সে এসে বেশ্যার গল্প শুনতে বসে গেল সে! নিজের কাছেই ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছিল। সে উঠতে চাইছিল। ভাবছিল গঙ্গার ধারে, অন্য কোথাও একটু বসে, ঘরে ফিরবে; ধর্মকথা অনেক হল। সে যেমন ছিল তেমনি থাকবে; ধর্মকথা, ধর্মপালন তার জন্যে নয়। ঘরে গিয়ে তাকে রান্না করে রাখতে হবে। মেয়ের ফিরতে অনেক দেরি আছে। এখন সবে সন্ধে। ফলে বেশিরভাগ দিন রাতের রান্নাবান্না তাকেই করে ফেলতে হয়। দিনেরটা মেয়ে করেই বেরোয়। সঙ্গে সে নিজের দুপুরের আহার নিয়ে যায়।
কিন্তু সে উঠতে পারল না। নদী থেকে ঠান্ডা, শীতল বাতাস উঠে আসছিল। জল কোথাও চকচক করছে আবার কোথাও অন্ধকার। আকাশের কোণে বোধহয় মেঘ জমে আছে, কিন্তু তবুও আলোর রেখা আছে আকাশে। সে রেখাতেই গল্প বলিয়ে লোকটাকে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছিল। কেউ একজন, কিছু একটা তাকে বসিয়ে রাখছিল।
গল্প বলিয়ে লোকটা তার গল্প বলতে শুরু করল আবার-ঃ অজামিল প্রণত হয়েছিল সেই বেশ্যার চরণে। বেশ্যার গর্ভে তার দশটি সন্তান জন্মে। সবচেয়ে ছোট শিশুটির নাম ছিল নারায়ণ।
সকলে বলল, তারপরে তারপরে?
সেই ব্রাহ্মণ মরার সময় নারায়ণ নারায়ণ বলে ডেকেছিল। ফলে পতিত হলেও, পাপাকাজ করলেও সেই ব্রাহ্মণের গতি হয় যমলোকে নয়, বিষ্ণুলোকে।
আহা হাহা—চলো হে, আমরাও তবে বেশ্যা-বিবাহ করি আর ছেলের নাম নারায়ণ রাখি।
সকলে হৈহৈ করে উঠল।
গল্প শেষ হয়ে গেল। সকলে উঠে পড়ল। লোকটাও কখন উঠে পড়ে কোনদিকে সরে গেল জয়দেব কিছু টের পেল না। তার যখন খেয়াল হল সে দেখল সে একাকী গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, মেঘ সরে গিয়ে আকাশে তারা ফুটে উঠেছে; নক্ষত্রখচিত সেই আকাশের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। আর তার মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে। সেই বেশ্যাটি কে? কিবা তার পরিচয়? সে উদ্বেল হয়ে উঠল। মনটা ভয়নক উচাটন হয়ে আছে। কী করবে না করবে সে ভাবতে পারছিল না। সে আনমনে হাঁটছিল। কোথায় যাচ্ছে, কোথায় দাঁড়াচ্ছে তার কোনো ঠিক নেই। খানিকটা সময় পরে সে খুব অসহায় বোধ করল।
এমন কেন হল তার? জয়দেব ভাবতে বসল। এক নিমেষে মনের মধ্যে একি পরিবর্তন! সে স্পষ্ট বুঝল, বহু মানুষ সারাজীবনের সাধনায় যা পায় না, সে এক লহমায় তা পেয়ে গেছে। কিছু একটা হচ্ছে মনের ভেতর। নদী যেমন পাড় ভাঙে তেমনি ভাঙন মনে চলছে। হু-হু করে কোথায় ধসে যাচ্ছে পাড়, সে বুঝছে কিন্তু ধরতে পারছে না। হঠাৎ কান্না পেল জয়দেবের। কিন্তু কাঁদতে পারল না। এখানটা ফাঁকা, কাঁদলেও কেউ দেখবে না; কিন্তু তবু সে কাঁদতে পারল না। তবে সে বুঝল, কান্নায় ভেসে যাচ্ছে তার অন্তর।
কেন হচ্ছে এমন! তবে কি তার মধ্যে ধর্মের বীজ ছিল সুপ্ত অবস্থায়? অবকাশ পেয়ে তা মহীরুহ হয়েছে কবে, তা সে নিজেই টের পায়নি। বুঝল এখন। সাতদিনের একদিন কেটে গেল। বাকি রইল ছয়দিন। এই ছয়দিন সে রোজ আসবে, লোকটির গল্প শুনবে। লোকটা কবে থেকে গল্প করে এখানে?
গল্প থেমে গেলেও তার রেশটা রয়ে গেছে। জয়দেব অনেকক্ষণ রইল সেখানে, তারপরে অনেকরাত করে সে ফিরল। গিয়ে দেখে মেয়ে তখনও আসেনি। প্রায় মাঝরাতে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেল একটি বাইক। মেয়েটা আর মেয়ের মত নেই। মেয়ের যে বিয়ে হয়েছিল একদিন, সেটাও মনে হয় মেয়েটা ভুলে গেছে। জয়দেব যে তার বাপ, এখনও বর্তমান; সেটাও হয়ত সে আর মনে রাখার দরকার বোধ করে না।
পরের দিনেও জয়দেব নদীর ধারে গেল। কিন্তু গল্পকথককে আর দেখা গেল না। না সে এসেছে, না এসেছে গল্প শোনার লোকজন। লোকটা তাকে বলেছিল, এখনও ছদিনের গল্প শোনা বাকি রইল হে জয়দেব। সময় মত এসো, এই সময়ে। এই সময়ে আমি রোজ আসি। এসো, বাকিদিনের গল্পগুলি শুনতে।
সেদিন একা একা নদীর পারে অনেকক্ষণ ঘুরে, বসে সে ফিরে এল।
পরের দিন আবার সময়মত গেল সে। না, আজও সে নেই। কোথায় গেল সেই গল্প বলিয়ে? আর কি আসবে না সে? এমনি করে একদিন গল্প শুনিয়ে নেশা ধরিয়ে সে কোথা চলে গেল! তাহলে বাকি ছদিনের গল্প সে শুনবে কার কাছে? সে-যে আর আসবে না, সেটা বললেই বা অসুবিধে কী ছিল। জয়দেব তো আর নিজে থেকে গল্প শোনার আব্দার করেনি।
একদিন হয়েছে কি, নদীর পাড়ে গল্প-বলিয়ের সন্ধান শেষ করে; গভীর একটা শ্বাস ফেলে জয়দেব নদীর কিনার থেকে বাইরে এল। দেখল সামনেই একটা চায়ের দোকান। দোকানের ভেতর একটা টিমটিমে গ্যাসের আলো। সে কিছু না ভেবেই সেখানে গিয়ে বসল। সেখানে অন্ধকারে বসে কিছু লোক বসে চা খাচ্ছিল। তারা উঠে পড়ল। তারা চলে যেতে দোকানটা ফাঁকা হয়ে গেল। জয়দেব একটা চা নিল। প্রথম চুমুকটা দিয়ে তার মনে হল, চা দোকানির সঙ্গে কথা বলে। সে কথা শুরু করল। চা দোকানিও আলাপ জুড়ল তার সঙ্গে। আলাপ গড়িয়ে চলে গেল পারিবারিক স্তরে। গ্রামদেশে এমনি হয়।
চা-দোকানি বলে, তা পরিবারে কে কে আছে তোমার।
এক মেয়ে, আর কেউ নয়।
স্ত্রী?
গত হয়েছেন।
মেয়ের বে দাওনি?
দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই যা হয়—মদ খেয়ে, লিভার জামাই মল্ল।
হ্যাঁ, ঘরে ঘরে এখন এই হচ্ছে! বলে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোকানি। আমারও জামাই—
হ্যাঁ।
অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করে আমার মেয়েকে ছেড়ে দিয়েছে।
এইভাবে তারা নিজেদের নানান সাংসারিক কথা, দুখ-সুখের কথা আলোচনা করল। তারপরে তারা সিদ্ধান্তে এল, যারা এসব নিয়ে ভাবিত নয় তারা বেশ আছে।
পরের দিন সন্ধের সময় এসে জয়দেব নদীর পার ঘুরে এসে যথারীতি চা দোকানে গিয়ে বসল। তখন তাকে সেই গল্পবলিয়ের কথা বলল। দোকানি মাথা নেড়ে বলল, সে বলা ভারি মুসকিল জানো। আমি দোকান নিয়ে, খদ্দের নিয়ে ব্যস্ত থাকি; ওদিকে তাকাবার তেমন ফুরসত পাই নে। তবে মাঝে মাঝে যখন দেখি জনাকয়েক লোক ওই অন্ধকার থেকে বের হয়ে আলোয় আসছে তখন বুঝি সেই গল্পবলিয়ে এসেছিল; নিজগল্প শেষ করে সে বিদায় নিয়েছে; এবার ফিরছে শ্রোতৃগণ।
আমি তবে তাঁর দেখা পাচ্ছি না কেন?
বলা মুসকিল! হয়ত তোমার সময় আর তাঁর সময় মিলছে না।
তুমি পরীক্ষিৎকে চেনো?
কোন পরীক্ষিৎ?
তখন সেদিনের ঘটনাটা বলে জয়দেব। দোকানি বলে, তিনি নিশ্চয় অন্যজনের সঙ্গে তোমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন।
জয়দেব জলের জগ হাতে নেয়। মুখ উঁচু করে একটু জল খায়। বলে, যাই। অনেকটা রাত হল।
রাত আর কোথায়, এই তো সবে সন্ধে। রাত নামতে দেরি আছে। এট্টু চা নাও।
তা ঠিক। তবে কিনা যখনই সূর্য ডোবে আর আঁধার ঘনায় তখন আমার গা-টা কেমন যেন ছমছম করে ওঠে। পৃথিবী মানেই কেমন এক মায়ায় জড়ানো। রাত নামলেই সেই মায়া বেড়ে যায়। তখন নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হয়।
স্ত্রী গত হলে এই হয়।
এক বিশেষ পর্যায়ে এই মায়া হয়ে যায় বিষ্ণুমায়া।
বলো কী হে! ধর্ম তোমার সাথে আছেন।
তা আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, এই জগত মায়ার জগত। কখনও মনে হয়, আমাদের জীবন হল রূপকথার গল্প। রাজা, রানী, রাজপুত্র। এ হল এক বিশ্বমায়া।
তোমার মধ্যে যোগ আছে। হয়ত আগের জন্মে তুমি কোনো যোগী ছিলে।
ধুর।
নাও, চা নাও। তোমার জন্যে আলাদা করে তৈরি করলাম। ধার্মিক মানুষ তুমি।
বেশ বেশ। দাও। তবে সেসব কিছু নয় বুঝলে। ধর্মকর্ম আমার পরিবার করত, আমি নয়। তবে, এখন মনের ভেতর, বুকের ভেতরে, মাথার ভিতরি—কী যে সব হচ্ছে!
তার ধরতাই পাচ্ছ না তো? অমনি হয় প্রথম প্রথম; তারপরে দেখবে সয়ে গেছে। তবে সময় লাগবে। এখন বলো, স্বাদ কেমন?
চায়ে চুমুক দিয়ে জয়দেব বলে, জীবনের মত সুন্দর।
বলো মায়ার মত।
যা বলেছ। তুমিও দেখছি বেশ অন্য রকম কথা কও।
এখানে মাঝে মাঝে নানান সাধিক আসেন। মুনি-ঋষিরাও আসেন। গঙ্গার তীরে তাঁরা দিনকতক কুটির গড়ে থেকে যান। কারও সঙ্গে কথা বলেন না, কোনোদিকে তাকান না। আমিও তাঁদের কাছে ঘেঁষি না। তবে একবার এমন একজন সাধু এসেছিলেন তিনি চা খেতে খুব ভালবাসতেন। আমিও সুযোগ পেয়ে দিনরাত তাঁর সেবা করেছি। সেই সাধু খুশি হয়ে একবার আমাকে বলেছিলেন, ভগবান বিষ্ণু নিজেকে মায়ার সাহায্যে ব্যাপ্ত করেন। একজন সাধক যখন শ্রীবিষ্ণুর চরণ স্পর্শ করেন, সেই সংযোগ মায়ার দ্বারাই হয়ে থাকে।
শুনে ভালো লাগল। তুমি অনেককিছুই জানো। এবার উঠি।
কাল আসছ নাকি?
আসব। এখানে না এসে পারি না।
হ্যাঁ, তুমি না এলে আমারও ভালো লাগে না।
উঠেই বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল না জয়দেব। সেই এলোমেলো ভাবে সে হাঁটতে লাগল। নদীর ধার শান্ত আর নির্জন হয়ে উঠেছে। ইতিউতি জোনাকি জ্বলছে-নিভছে। এদিকওদিক থেকে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসছে শিয়ালের ডাক। নদীর জলে এখন প্রবল ঢেউ, সমুদ্রের মতন। সোঁ সোঁ করে বাতাস দিচ্ছে। দেখে বেশ ভালো লাগল জয়দেবের। সে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাথার উপরে প্যাঁচা ডেকে উঠল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল হিসেব নেই; তখন পিছন থেকে কে যেন বলল, তুমি কি আমাকে খুঁজছ?
তাকাল জয়দেব। অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ। তিনি উত্তরে বললেন, আমি গল্প বলিয়ে।
ওহহ, তুমিই সেই! কিন্তু পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না কেন?
কী বলবে?
আজই তো সেই সাতদিন।
না। আজ দ্বিতীয় দিন।
কী করে হয়? সাতদিন আগে তোমার গল্প শুনেছিলুম।
সেটা তোমার হিসেব। আমার হিসেবে প্রথমদিনই এখনও শেষ হয়নি।
একটু ধাঁধাঁয় পড়ল। তবে কথার মারপ্যাঁচে না গিয়ে সে বলল, তবে আমাকে সেই গল্পের রসস্বাদন থেকে বঞ্চিত করছ কেন?
তুমি তো আমাকে চাও না।
কে বললে?
আমি সব বুঝতে পারি।
কী বুঝলে?
এই যে, অজামিলের কাহিনি তোমার পছন্দ নয়।
হ্যাঁ, ওখানে বড্ড সোজাসুজি অনেক কথা বলা আছে।
লোকশিক্ষে দেবার গল্পর ওই নিয়ম।
কিন্তু শুনবার সময় কেমন যেন গা ছমছম করে।
বেশ্যার কথা লেখা আছে বলে!
এদিক-ওদিক তাকিয়ে জয়দেব বলে, হ্যাঁ।
কিন্তু তাতে তোমার অসুবিধা কী?
মনে হয় পাপ।
কিসের পাপ?
জানি না! কিন্তু সেদিন তুমি আমাকে রাজা পরীক্ষিৎ নামে ডাকলে কেন?
ধরে নাও তুমি একজন রাজা।
মানে!
আমি ধরে নিতে বলেছি।
আচ্ছা, তারপর?
বাহ্যিকরূপে তুমি এক রাজার কথা শুনে তাকে মনে মনে কল্পনা করে নিলে; আর অন্তররূপে তুমি নিজেই রাজা হয়ে গেলে। বাইরের প্রতিফলন অন্তরে হয়।
আমি কিছুই বুঝলাম না।
তুমি মায়ার কথা বলছিলে না?
তুমি শুনেছ! কীভাবে শুনলে? ছিলে কি তখন?
আমি সবখানেই আছি।
মায়ার কথা বলবে বলছিলে?
বাইরের প্রতিফলন এই যে অন্তরে হচ্ছে, তুমি নিজেকে একজন রাজা ভাবছ, ধরে নিই পরীক্ষিৎ ভাবছ; এগুলি আসলে মায়ার দ্বারা হয়। এই বিশেষ মায়াকে অনুমায়া বলে। যেমন এক বিশেষ পর্যায়ে মায়া বিষ্ণুমায়া হয়।
এগুলি পরীক্ষিৎ কেন করবে?
কারণ তার আয়ু আর সাতদিন।
মানে!
মেয়ের প্রতি টান তোমার কমাতে হবে।
আমি কিছুই বুঝছি না।
তোমার মেয়ে আলাদা এক পথ বেছে নিয়েছে, যা তুমি অন্তরে বুঝতে পারলেও বহিরঙ্গে তা মানতে পারছ না। তাই তোমার এই ছটফটানি, ঈশ্বরের কাছাকাছি আসতে চাওয়া। ঈশ্বর থেকে তুমি এখনও অনেক দূরে হে জয়দেব, এখুনি তাঁর ডাক তুমি পাবে না; নিজেও তাকে ডাকতে পারবে না। তাই মেয়ের বিষয়ে এত ভেব না, তাকে তুমি ফেরাতে পারবে না। লোভের যে পথ সে বেছে নিয়েছে তা থেকে তার মুক্তি নেই।
আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে!
মায়া বিষ্ণুমায়া হয়, যোগমায়া হয় আবার কখনও তা মহামায়াও হয়। একই ব্যক্তি সময় সময় নানা পরিচয়ে কাজ করে, সংসার করে, বন্ধুত্ব রাখে—এও তেমনি। যাক, বাকি কথা পরে হবে রাজা। আমি এখন আসি।
যাবে কোথায়?
আরও অনেক জায়গায় আমাকে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে গল্প শোনাতে হয়। সেখানে গিয়ে ‘পরীক্ষিৎ’ খুঁজে বের করতে হয়, যাদের আমি কিছু কথা বলতে পারব; কাহিনি শোনাতে পারব।
আসলে তুমি কে?
একজন গল্প বলিয়ে।
তুমি কি ঈশ্বর?
আমি একজন কথক।
তুমি কি ভগবান?
আমি তাঁকেই খুঁজে ফিরি।
তুমি এত খুশি থাকো কী করে?
মানুষকে গল্প শুনিয়ে।
এখানে আবার আসবে কবে?
আসব আসব, যখন তোমার সময় হবে, ডেকো আমায়…
কী বলে ডাকব?
সুন্দর হে সুন্দর।
আহা! ভারি চমৎকার বললে।
যাই।
মেয়ে আর আমার নেই।
এসব সংসারের অঙ্গ। মেনে নিতে হয়।
জীবন মানে কেবলই দুঃখ; মনে সুখ নাই।
জীবন দুঃখময় একথা ভাবার চেয়ে জীবন সুখময় এ কথাই অধিকতর সত্য। নিদারুণ দুখের মাঝেও সুখ আছে। খুঁজে নিতে হয়। আগামী সাতদিনে তোমার সেই খোঁজ সম্পূর্ণ হোক।
গেল না জয়দেব। মুক্তিই যদি নেই তবে ফিরে যাওয়া কেন। বন্ধন যখন চিরকালের তখন এখানেও যা ঘরের তা—একই ব্যাপার। তাই সেখানেই রয়ে গেল জয়দেব। সেই নদীর তীরে, শান্ত সমীরে। নদীর ধারে ধারে থাকে, জুটলে খায় না জুটলে নয়। সারাদিন ঘুরে বেড়ায় নদীর ধারে। নদীতে জল আসে জল যায়। ঢেউ জাগে ঢেউ ভাঙে। নৌকা ভাসে, মানুষ স্নানে নামে, সাঁতার দেয়। জয়দেব দেখে। সে নিজেও গঙ্গায় গা ডুবিয়ে বসে থাকে। আর মাঝে মাঝে সেই চা দোকানে গিয়ে বসে আর ভাবে সেই সাতদিন কবে শেষ হবে?
জয়দেব দোকানিকে বলে, গল্প-কথক আর আসে না?
সে কী এক ঠাঁইয়ের মানুষ? দেখো গে, আবার কোথায়, কোন নদীচরে বসে কাউকে কাহিনি শোনাচ্ছে।
একই কাহিনি সকলকে শোনায়?
তা কেন? কাহিনির তো অভাব নেই।
যারা শোনে তাদের কাউকেই কি চেনো না?
না। তবে মনে হয় যারা শোনে তাঁরা সকলেই তত্ত্বজ্ঞানী।
আহা—
এই কদিনেই তুমি তো বেশ ধার্মিক হয়ে উঠেছ জয়দেব। তবে কন্ঠে তুলসীমালা ধারণ কর না কেন? ওটিতে তোমায় বেশ মানাবে।
নাহ্!
তবে তুলসীমালা শুনে অমন আঁতকে উঠলে যে!
ও কিছু নয়।
দোকানি ওসব খেয়াল করলে না। বললে, অনেকে ধারণ করে কিন্তু কিছুই মানে না।
এরপরে অনেকদিন কেটে গেল। জয়দেবের মধ্যে আগের সেই আকুতি নেই। সে নদীর ধারে যায়, চাষের কাজকর্ম বাদ দিয়ে সে সেখানেই বসে থাকে আর মাঝে মাঝে সেই চা দোকানে যায়। যায়, বসে গল্প করে, আর দোকানি মাঝে মাঝে জানতে চায় সেই গল্প-কথকের কথা।
সেকথা উঠলেই জয়দেব কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। মনে হয়, সে সেই বিরাট, বিচিত্র, ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একদা। একদিন কত কথা হয়েছে। সেদিনও গঙ্গার এমন প্রবাহ ছিল; সেদিনও এমনি মৃদুমন্দ বাতাস দিচ্ছিল। তখন সেই তিনি বলছিলেন ঈশ্বরের কথা। জয়দেব জানতে চায়, আপনি আমাকে বলুন কথক, ঈশ্বরকে দেখব কীভাবে? কীভাবে তাঁকে অনুভব করব? প্রাণে আরাম পাচ্ছি না, মনে শান্তি নেই। বয়স হয়েছে, এত চাপ, এত চিন্তা, এত ভাবনা আর উৎকণ্ঠা আমি নিতে পারি না। আমার হাতে কিছু নেই, কিছুই আমি বদলাতে পারব না। আপনি আমাকে এটা বলুন, কী করলে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব।
কথক বললেন, খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশকে দেখলে যেমন পুরো আকাশ, তার সবকিছুকেই দৃষ্টিগোচর করা যায় তেমনি এই পৃথিবীর সবকিছু যিনি জুড়ে আছেন সেই শ্রীকৃষ্ণকে সেভাবেই দেখা যায়। ঋষিগণ তাই দেখেন। আকাশে, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে তাঁরা দেখেন চৈতন্যময়, আনন্দময় মহাসত্তার লীলা বিলাস। আজ থেকে তুমিও তাই দেখবে।
আমি চেষ্টা করব প্রভু।
এসো।
মেয়ে একেবারে অচেনা হয়ে উঠেছে। সে কখন আসে কখন যায় জয়দেব বুঝতে পারে না। ঘরের খাবার খায় নাকি বাইরের—সেটাও সে ঠাওর করে উঠতে অপারগ। মেয়ের বিয়েরও আর চেষ্টা করে না সে। বোঝে, মেয়ে আর বিয়ে করবে না। বিবাহিত জীবনে সে সুখ পায়নি, আর সে ও পথে পা দেবে না। সুখ বড় ক্ষণস্থায়ী।
কেবল মেয়ের দিকে যখন সে তাকায়, দেখে তার গায়ের ফর্সা রঙ ছাপিয়ে দেহে ঝিলিক দিয়ে ঝলসে উঠছে দু পাকের সেই তুলসীর মালা।