• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • নিষ্ঠীবন : অংশুমান গুহ

    “ওনার গলা আমার দারুণ লাগে,” সঞ্জয় বলল। “কন্ঠস্বরে জাদু আছে।”

    “ঠিক বলেছিস,” পল্লব সহমত প্রকাশ করল।

    তারপর অনেকক্ষণ ধরে পল্লব নিজের কফির কাপের দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছু একটা চিন্তা করছে। সঞ্জয় গুনগুন করে একটা পুরোনো গানের সুর ভাঁজছিল আর হাতের আঙুলগুলো নাচাচ্ছিল।

    পল্লব বলল, “তুই জানিস এক সময় আমি ওনার প্রেমে পড়েছিলাম? উনি বিখ‍্যাত হবার অনেক আগে।”

    “তার মানে?”

    পল্লব মৃদু হাসল।

    সঞ্জয় বলল, “কি বলছিস তুই?”

    “সে অনেক কাল আগের কথা। তখন আমার উনিশ বছর বয়স।”

    পল্লব থামল। একটু ভেবে আবার কথা বলতে লাগল।

    “প্রথমবার আমি ওর গলা শুনি কোনো রেডিও প্রোগ্রামে। কন্ঠস্বরটা ছিল… ছিল…”

    পল্লব থেমে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, “আমার এখনো সেই সকালটা পরিষ্কার মনে আছে। ঠিক কী রকম অনুভূতি হয়েছিল সব মনে আছে। তার আগে যত মানুষের গান শুনেছি, ওর কন্ঠস্বরটা ছিল সবার থেকে আলাদা। শুনে আমার বুকের ভেতরটা কাঁপছিল। ধমনীর ভেতরে আমার রক্তের তাপমাত্রা বাড়ছিল। আমার তাক লেগে গেছিল। অন‍্য কিছু করার… বা অন‍্য কিছু ভাবার ক্ষমতা ছিল না, শুধু ওর কন্ঠস্বর আমার সমস্ত মনটা জুড়ে বসেছিল।”

    সঞ্জয়ের মুখে প্রথমে একটা স্মিত হাসি ফুটল। তারপর ও জোরে হেসে উঠল।

    “তখন তুই ওনার প্রেমে পড়লি?”

    “হ‍্যাঁ, তাই হবে বোধহয়।”

    একটু চুপ করে পল্লব আরো বলল, “তার দু’তিন সপ্তাহ পর আমি বম্বে গেলাম ওর সঙ্গে দেখা করতে।”

    “কী?! সত‍্যি সত‍্যি?”

    “হ‍্যাঁ রে। না গিয়ে চলছিল না। মুখোমুখি চাক্ষুষ দেখা করা ছাড়া উপায় ছিল না।”

    “হতেই পারে না!”

    পল্লব হাসল। বলল, “গেলাম। আমার এক খুড়তুতো ভাই থাকত বম্বেতে। অবশ‍্য তখন জানতাম না যে ওর বাড়িটা ছিল আমার ভাইয়ের বাড়ি থেকে অনেক দূরে, প্রায় একঘন্টা। আমি ভাইয়ের সাথে ছিলাম মাসখানেক।”

    “তো, কী হল?”

    “প্রথম এক সপ্তাহ কিছুই হল না। কয়েকদিন লাগল শুধু খুঁজে বার করতে ও কোথায় থাকে। ও থাকত একটা বড় ফ্ল‍্যাটবাড়িতে। মাসির সাথে একটা ফ্ল‍্যাটে। আমি রোজ সকালে ওখানে গিয়ে সারাদিন ধরে সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতাম।”

    সঞ্জয় বলল, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। তবে তোকে যতটা চিনি, তোর পক্ষে সম্ভব। তুই পুরো পাগল।”

    “হা হা!”

    “বল্! তারপর কী হল?” সঞ্জয়ের কৌতূহল তর সইছে না।

    “প্রথমে কিছুই হল না। কিছুদিন ধরে রাস্তার হকার আর ওর বাড়ির দারোয়ানদের সাথে আলাপ পরিচয় হল। ওর দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হলাম। প্রত‍্যেক দিন ভোর বেলা ও গলা সাধা শুরু করত, আমি ও পাড়ায় পৌঁছনোর অনেক আগে। শুধু কয়েকদিন আমি দারোয়ানের সাথে রাত কাটিয়ে ছিলাম - সেই দিনগুলোতে আমি সূর্যোদয়ের আগে উঠেছিলাম আর ওর গান গাওয়া শুরু থেকে শুনতে পেয়েছিলাম।”

    “তুই দারোয়ানের সাথে রাত কাটিয়েছিলি? কোথায় শুলি? না কি শুসনি?”

    “ওর বিল্ডিঙে কয়েকজন দারোয়ান ছিল। তারা সামনের গেটের কাছে একটা ছোট ঘরে থাকত। ওদের সাথে বন্ধুত্ব পাকিয়েছিলাম। ওরা আমাকে স্নেহ করত। আমি তো তখন একেবারেই বাচ্চা। ওরা বুঝত আমি প্রেমে পড়েছি। হয়তো ওদের সহানুভূতি হত। কিম্বা হয়তো স্রেফ মজা পেত।”

    পল্লব একটা লম্বা চুমুকে কফি শেষ করল। সঞ্জয়ের কফি আগেই শেষ হয়ে গেছে।

    সঞ্জয় বলল, “তোর গল্পটা মারাত্মক। আরো কফি লাগবে।”

    সঞ্জয় দাঁড়িয়ে উঠে কাউন্টারে গেল। আরো কফি অর্ডার করে, দাম দিয়ে, ফিরে এল টেবিলে।

    বলল, “তারপর বল্! তারপর কী হল?”

    “আমি মাঝে মাঝে ওকে বারান্দায় দেখতে পেতাম। অনেক দূর থেকে… ওর বয়স তখন তিরিশের ঘরে, কিন্তু আমার অপূর্ব সুন্দরী মনে হত। আমি খালি আরো, ক্রমাগত আরো, গভীর প্রেমে ডুবে যাচ্ছিলাম।”

    “তুই ওর সাথে কথা বলিসনি?”

    “হ‍্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু সেটা অনেক পরে। প্রথম সপ্তাহটা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় কাটত। পায়চারি করে। এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করে। ওই জায়গাটায় শুধু দাঁড়িয়ে থাকাটাই যেন আমার জীবনকে অর্থবহ করে তুলছিল।”

    একজন ওয়েটার এল দ্বিতীয় দফার কফি নিয়ে। ওরা দুজনেই এক চুমুক করে খেল।

    “তারপর একদিন – ওখানে প্রথম যাবার সপ্তাহখানেক পরে – ওর বারান্দা থেকে একটা তোয়ালে পড়ে গেল। শুকোতে দিয়েছিল। আমি দেখলাম তোয়ালেটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে মাটিতে এসে পড়ল। আমি কাছে গিয়ে তোয়ালেটা তুলে নিলাম আর যেন কোনো অদৃশ‍্য বিধাতার আদেশে পাঁচতলায় উঠে গেলাম তোয়ালে ফেরত দিতে। ও নিজেই দরজা খুলল। সামনা-সামনি দেখে মনে হল আরো সুন্দর, প্রাণ-ভোলানো মন-হারানো রূপ। পরনে ছিল একটা সাধারণ সুতির সালওয়ার-কামিজ। বোধহয় হলুদ। তারপর যখন ও কথা বলল, তখন ওর সৌন্দর্যর আসল উৎসটা স্পষ্ট হয়ে উঠল! ওঃ সে কী গলার স্বর!

    “আমাকে তোয়ালের জন‍্য ধন‍্যবাদ জানাল। হয়তো হেসেছিল – আমার মনে নেই। আমার হৃৎপিণ্ড তখন এত জোরে ধুকপুক করছিল, যে মনে হচ্ছিল হয়তো মরেই যাব। আমি তখন এক স্বর্গীয় ভাবাবেশে। সেই প্রেমের স্বর্গে ওর কন্ঠস্বরের জন‍্য আমি মরতে দ্বিধা করতাম না।”

    সঞ্জয় হাসছিল। কিন্তু ওর হাসির পেছনে ক্রমশ একটা অস্বস্তিও মেঘের মত জমা হচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিল একটা মজার ঘটনা শুনতে চলেছে। কিন্তু গল্পটা আস্তে আস্তে কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে। পল্লবকে যতটা পাগল মনে করত, হয়তো ও তার থেকেও বেশি উন্মাদ।

    “তারপর কয়েকদিন ধরে ও যখনই বারান্দায় আসত, আমাকে লক্ষ‍্য করতে শুরু করল। দেখত আমি দারোয়ানদের সাথে বসে আছি, কিম্বা রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছি। নিশ্চই বুঝতে পারত যে আমি সব সময়েই ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আমি না তাকিয়ে থাকতে পারতাম না।

    “ও আমার নাম জানত না। একদিন একজন দারোয়ানের সাথে কথা বলে আমাকে ওপরে আসার অনুরোধ পাঠাল।”

    পল্লব আর এক চুমুক কফি খেয়ে একটা সিগারেট ধরাল। সঞ্জয় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল।

    এক রাশ ধোঁওয়া ছেড়ে পল্লব আবার গল্পের গাড়ি চালাল।

    “সেই প্রথম কথোপকথনের সব খুঁটিনাটি আমার মনে নেই। আমি খুব নার্ভাস ছিলাম। আর ও ছিল করুণাময়ী ও কুতূহলী। আমাকে অনেক প্রশ্ন করল। আমি যে প্রেমে পড়েছি, সে কথা আমি বলিনি। কিন্তু যা কিছু বলেছি, সত‍্যি বলেছি। কেমন করে ওখানে গেছিলাম। কেন আমি ওখানে দিন কাটাচ্ছিলাম। শুনে ও খুব অবাক হয়ে গেছিল। এবং হয়তো খানিকটা স্তুতিমুগ্ধও হয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কবে বাড়ি ফিরব। আমি বললাম জানি না, ভাবিনি। বললাম আমার কলেজ আরো কয়েক সপ্তাহ পর খুলবে।

    “সেই দিনের পর, আমি ওর ফ্ল‍্যাটে যাতায়াত শুরু করলাম। প্রায় রোজই যেতাম। ওর নানা কাজ করে দিতাম, ফাইফরমাস খাটতাম। দুধ এনে দেওয়া, বাজার করে দেওয়া, ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। কখনো কখনো ও যখন গলা সাধত বা গান গাইত, আমি ওর ঘরে বসে শুনতাম। ওর কন্ঠস্বরে আমার একটা অভূতপূর্ব স্বর্গীয় আনন্দ হত। যেন আমাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে ওর গলার আওয়াজ অন‍্য কোথাও পৌঁছে দিত। যখন ও গান গাইত, আমি আর সব কিছু ভুলে যেতাম। নিজের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকত না। আমি তখন চরম প্রেমে পড়ে গেছি।”

    সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে পল্লব বলল, “বাপ রে বাপ, কী ভীষণ ভাবে যে প্রেমে পড়েছিলাম, কী বলব!”

    তারপর বলল, “আমার মনে হয় ও সেটা জানত।”

    পল্লব কথা বলা বন্ধ করল। সঞ্জয় প্রশ্ন করল, “তারপর কী হল?”

    পল্লব বলল, “ওই ভাবেই চলল দু-এক সপ্তাহ। তারপর একদিন নতুন এক মাস্টারের কাছে গান শিখতে ওকে যেতে হল। আমাকে সঙ্গে যেতে বলল। আমি তো এক বাক‍্যে রাজি! যাব না কেন? আমার মনে হচ্ছিল আমরা আস্তে আস্তে একে অন‍্যের ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলাম। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা গাঢ় হচ্ছিল। ও আমাকে বিশ্বাস করত। আমার আশা ছিল একদিন ও-ও আমাকে ভালোবাসবে। আমাদের বয়সের ফারাকটা আমার মাথাতেও আসত না। ও ছিল দেবী। আমি ছিলাম ভক্ত। বয়সে কী আসে যায়?”

    পল্লব থামল। সিগারেটটায় শেষ একটা টান দিয়ে, অ‍্যাশট্রেতে নিবিয়ে দিল।

    তারপর বলল, “সেদিন ছিল পড়ন্ত বিকেল। ও নিচে নেমে এল। একটা লাল শিফন সাড়ি পরে। গায়ে লাল ব্লাউজ। আমি গেটের কাছে অপেক্ষা করছিলাম। ওকে যথারীতি দারুণ দেখাচ্ছিল। আর আমার মনে তখন সীমাহীন আনন্দ। অত খুশি বোধহয় আর কখনো হইনি – তার আগেও নয়, তার পরেও নয়। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। আধঘন্টা মত হাঁটার পথ যেতে হবে। বাস বা ট‍্যাক্সি করার থেকে ও হাঁটা পছন্দ করত। আমরা কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম। কী নিয়ে কথা বলছিলাম মনে নেই। আমরা বেশির ভাগ সময়ই পাশাপাশি হাঁটছিলাম। মাঝে মাঝে ও এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি জোরে হেঁটে ওকে ধরে ফেলছিলাম।

    “গন্তব‍্যস্থলে প্রায় পৌঁছে গেছি – আমরা তখন একটা রাস্তার মোড়ে – এক রাস্তা ছেড়ে আরেক রাস্তায় ঢুকব – এমন সময়, ও হঠাৎ আস্তে হয়ে গেল। আমি একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনলাম, একটা গুড়গুড় গার্গল করার মত শব্দ। শব্দটা ওর মুখ থেকেই আসছিল। আমার বাবা – মুখের ভেতরে জমা হওয়া যত শ্লেষ্মা একত্রিত করে যখন বাবা থুতু করে কফ ফেলার জন‍্য প্রস্তুত হত, তখন ওই রকম শব্দ করত। আমি ওই শব্দে হতবাক হয়ে গেছিলাম।

    “আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ও এগিয়ে গেল। সেই আশ্চর্য শব্দটা করতে থাকল। তারপর আরো কিছু মুহূর্ত পর, চরম একটা পর্যায়ে পৌঁছে ওর মুখ থেকে একটা খয়েরি রঙের কফের বড় দলা ফুটপাতের একপাশে নিক্ষিপ্ত হল। ব‍্যস্! আমার প্রেম ফুরিয়ে গেল এক নিমেষে।”

    “মানে?” সঞ্জয় বিস্ময় প্রকাশ করল।

    “যে প্রেমের স্বর্গে আমি ঢুকে ছিলাম, তার থেকে আমি ছিটকে বেরিয়ে এলাম। আমাকে বার করে দিল। আমি দেখলাম বীভৎস একটা খয়েরি আধ-তরল পিণ্ড রাস্তায় পড়ে আছে। যেন জীবন্ত একটা কুৎসিত জীব। সেই দৃশ‍্য এক মুহূর্তে আমাকে প্রেমের স্বর্গ থেকে ধাক্কা মেরে বার করে দিল।”

    “মানে?” সঞ্জয় পুনরাবৃত্তি করল।

    “আমি দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ও আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমার মনে হল একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন সমস্ত পৃথিবীটাকে গ্রাস করতে চলেছে। আমি শেষবারের মত ওর দিকে তাকালাম। তারপর পেছন ফিরে দৌড় দিলাম।”

    “বুঝলাম না,” সঞ্জয় বলল।

    পল্লব চুপ করে হাসিমুখে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। কোনো কথা বলল না।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments