সেপ্টেম্বর ২০২৫
সান ফ্রান্সিস্কো শহরে গেছিলাম একটা কাজে। সেখান থেকে সবে গাড়ি করে বেরিয়েছি। সান ফ্রান্সিস্কো উপসাগরের উপর দিয়ে ‘বে’-ব্রিজ পেরিয়ে বাড়ি যাব। ওকল্যান্ডে। কিন্তু শহর ছেড়ে বেরোতেই পারছি না, এত যানজট। গাড়ির স্রোতটা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে বিশাল একটা সাপের মত। তার মধ্যে আটকে আছি।
ক্লান্ত লাগছে। ডাইনে বাঁয়ে সামনে পেছনে অজস্র গাড়ি।
গাড়ির স্টিরিওতে গান চালালাম। ভালো লাগল না। সেই একই গান। হাজার বার শুনেছি, আবার শুনতে বিরক্ত লাগছে।
গান বন্ধ করে রেডিও চালালাম। রাজনীতি নিয়ে বাজে আলোচনা চলছে। অসহ্য। তবু চলুক। শুনি বা না শুনি।
কতক্ষণে বাড়ি পৌঁছব কে জানে। কতক্ষণ এইভাবে গাড়ির মধ্যে বন্দী হয়ে বসে থাকতে হবে জানি না।
একটু থামা। একটু চলা। আবার একটু থামা। অসংখ্য যানবাহনের অসহ্য জট। বেরোবার উপায় নেই। অন্য কোথাও যাবার উপায় নেই। আটকে আছি। বাঁধা পড়ে আছি।
আশেপাশের গাড়ির মানুষগুলো বেশির ভাগই বাংলার পাঁচের মত মুখ করে বসে আছে। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে। পেছনের সীটে কেউ কেউ ঘুমন্ত। দু’একটা বাচ্চা অস্থির হয়ে দাপাদাপি করছে আর মাঝে মাঝে বাবা-মা’র কাছে বকুনি খাচ্ছে।
স্টিয়ারিঙের সামনে আমি সীটে বসে আছি। আমার গাড়িতে আমি একা। বসে বসে এই বদ্ধ পরিবেশে সময় চলে যাচ্ছে। কত সময় গেছে তাও হিসেব রাখিনি। মিনিট ঘন্টার মাপজোক নেই। এরই মধ্যে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে, যদি এটাকে এগোনো বলা যায়। পথে বাঁধা আছি। পথ থেকে বেরোনোর পথ নেই।
ফোন বাজল।
“হ্যালো।”
“তুমি কোথায়?”
“জ্যামে ফেঁসে আছি। এখনো বে ব্রিজে উঠতে পারিনি।”
“ও।”
কুট্ করে লাইন কেটে গেল। কেটে দিল। ফোনটা পাশের সীটে রেখে দিলাম।
অনেক চিন্তা নিয়ে যে কাজে সান ফ্রান্সিস্কো এসেছিলাম সেটা মিটে গেছে। এখন মাথাটা সম্পূর্ণ খালি। শুধু একই কথা ভেবে যাচ্ছি যে কখন বাড়ি পৌঁছব। আর কোনো চিন্তা নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। গাড়িতে খাবার জল নেই।
আচমকা একি?!
খুব স্পষ্ট ভাবে যেটা সত্যি, সেই সাফ সহজ সত্যটা হঠাৎ উপলব্ধি করলাম।
বুঝলাম যে আমার দুটো চোখই বন্ধ। আমি কিছুই দেখতে পারছি না। এই ভয়ংকর জটিল জটে আমি অন্ধ যাত্রী। চোখ খুলবার সামর্থ্য বা উপায় আমার নেই।
***
এই মুহূর্তটা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার মুহূর্ত। কিন্তু আমি কি ঘুমোচ্ছি?
ভয় করছে না। কেন জানি না।
এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্নে চলে গেলাম। কিম্বা হয়তো এক বাস্তব থেকে অন্য এক বাস্তবে। এক জগৎ থেকে সমান্তরাল ও সমসাময়িক আরেক জগতে।
***
যেখানে বসে আছি সেটা একটা মহাকাশযান। মহাশূন্যের মধ্যে দিয়ে চলমান একটা বিমান। তার ভেতরে একটা বিশাল ঘরে বসে আছি। চারপাশে গোল বিরাট কাঁচের জানলা। জানলার নিচে টানা বসার জায়গা। আরামের গদি – অতিরিক্ত নরমও নয়, বেশি শক্তও নয়। কাঁচের বাইরে আলো নেই বা আলো কম – ঠিক করে দেখিনি। আমি তাকিয়ে আছি উলটো দিকে, যেখানে মন্থরা বসে আছে।
এই যান-যন্ত্রটা মন্থরার নিয়ন্ত্রণে। মহাকাশের মধ্যে দিয়ে পথ চিনে চলেছে মন্থরা। আমি যাত্রী। খুব নিশ্চিন্ত লাগছে। নিরাপদ। শান্তি।
বললাম, “আরাম লাগছে।”
মন্থরা মৃদু হেসে বললো, “খুব ভালো।”
বনের মৌচাক থেকে সদ্য সংগ্রহ করা মধুর মত মন্থরার গলার স্বর চুঁয়ে চুঁয়ে পড়লো সারা ঘরে। প্রথম ফ্লাশ দার্জিলিং চায়ের গন্ধের মত ছড়িয়ে গেল সর্বত্র।
আমি চোখ বুজলাম। এখানে চোখ খোলা আর চোখ বোজার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই।
বললাম, “আর ভয় নেই।”
“এতদিন কোথায় ছিলে?”
কোনো উত্তর না দিয়ে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “তুমি কি সব জানো?”
“না। কিছু কিছু জানি, কিন্তু সব জানি না।”
“ভবিষ্যৎ?”
“ভবিষ্যৎ তো এখনো হয়নি, জানব কী করে?”
“কিন্তু এই আকাশযানটা তো তোমার আয়ত্তে, তাই না?”
“আমি চালাচ্ছি।”
“তাহলে চিন্তার কিছু নেই।”
“তোমায় কিছু চিন্তা করতে হবে না। আমি তো আছি!”
“তুমি তো আছো – তার মানে কী?”
“আমি চলেছি এই মহাকাশের পথহীন পথে। চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এই স্পেস-শিপ। যখন যা কিছু হবে, তার মোকাবিলা করার দায়িত্ব আমার।”
“কী হবে?”
“কী হবে তা তো আমি জানি না। এই সীমাহীন আকাশে আরো কত আকাশযান আছে। সেগুলো চালাচ্ছে…”
মন্থরা চুপ করে গেল।
একটু পর আমি বললাম, “কে চালাচ্ছে?”
“অন্য… অন্যান্য... বিভিন্ন চালকরা।”
“ওঃ।”
“অন্য কোনো যান যদি আমার পথে এসে পড়ে, যদি দেখা হয় অন্য কারো সাথে, তখন আমি দরকার মত মানিয়ে নেব, গতি পরিবর্তন করব, খবর নেব, খবর দেব।”
“ধাক্কা লাগতে পারে?”
“খুবই কম সম্ভাবনা, তবে সম্পূর্ণ অসম্ভাব্য নয়।”
“ওইসব চালকরা, ওরা সবাই কি তোমার মত ভালো?”
মন্থরা শব্দ করে জোরে হেসে উঠলো। আমি একটু অপ্রস্তুত।
“আমি ভালো কে বলেছে? এখানে ভালো-মন্দ নেই। শুধু যাওয়া-আসা আছে, অনেক রকমের প্রবণতা আছে, সম্ভাবনা আছে। বলতে পারো ইচ্ছে আছে।”
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, “উদ্দেশ্য নেই?”
মন্থরা বললো, “হয়তো থাকতে পারে। তোমার কী মনে হয়?”
“আমার মনে হয় আছে। উদ্দেশ্য একটা থাকতেই হবে। হয়তো উদ্দেশ্য হল ভা…”
যে শব্দটা মুখে আসছে, সেটা আমি উচ্চারণ করতে পারলাম না।
“শব্দটা উচ্চারণ করতে দ্বিধা হচ্ছে যখন, ছেড়ে দাও। করতে হবে না।”
এই বলে মন্থরা হাসল। আমার অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর দিল না।
আমি বললাম, “হয়তো আস্তে আস্তে বুঝতে পারব।”
“ভাষার সীমানা ছাড়িয়ে যাও যদি, তাহলে বুঝতে সুবিধে হবে।”
“কী করে ছাড়াব?”
“কবিতার মত কথা বলার চেষ্টা করো। আর সেরকমই চিন্তা। তারপর আস্তে আস্তে নিঃশব্দতার দিকে যাও, যে নীরবতা একটা শব্দের থেকে পরের শব্দটার মধ্যে অবস্থিত থাকে, যে রকম পাহাড়ি রাস্তায় দুটো পাথরের ফাঁকে বুনো ফুল থাকে।”
“একটু আগেই আমি একটা গদ্যের মধ্যে ছিলাম।”
“না না, গদ্য নয়। সেখানেও কবিতা ছিল।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, সেখানেও কবিতায় কথা বলা যায়। সেখানেও বাতাসের গর্ভে অনেক নিঃশব্দতা আছে।”
আমি কোনো কথা বললাম না। একটা সর্বাঙ্গীণ শান্তিতে সারা শরীর শিথিল হয়ে এল।
বসে বসে কতক্ষণ ঝিমিয়েছি জানি না, হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে উঠে বসলাম।
বললাম, “আরেকটা স্পেস-শিপের সাথে কি আমাদের ঠোকাঠুকি হল? একটু যেন ঝাঁকুনি লাগল মনে হল।”
“হ্যাঁ।”
“সব ঠিক আছে?”
“সব ঠিক। সন্দীপের মহাকাশযান আমার মহাকাশযানকে একটু ধাক্কা মেরেছে।”
“সন্দীপ কে?”
“আমার মত আরেকজন স্পেস-শিপ চালক।”
“তোমার বন্ধু?”
“হ্যাঁ, বন্ধু বলতে পারো। ওরা সবাই আমার বন্ধু। সন্দীপ, বনলতা, রঞ্জন…”
“সবাই স্পেস-শিপ চালায়?”
“হ্যাঁ।”
“মাঝে মাঝে ধাক্কা লাগে?”
“হ্যাঁ।”
“সন্দীপ কি তোমায় ইচ্ছে করে ধাক্কা মারল? সবাই যদি বন্ধু হয়, তাহলে কেন এমন ধাক্কা মারে?”
“বন্ধুদের মধ্যে কখনো কখনো মতভেদ হয় না?”
***
কী উত্তর দেব ভাবছি, এমন সময় দৃশ্য পরিবর্তন হল। এটা কি নতুন স্বপ্ন?
ট্রেনের নাম গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস। অনেক বছর আগে সপরিবারে চড়েছিলাম।
সুইৎসারল্যান্ডের বিখ্যাত পর্বতশৃঙ্গ ম্যাটারহর্ন। বিরাট উঁচু এবং তীক্ষ্ণ-পাথরের ফলার মত। তার কোলে ছোট্ট গ্রাম জেরম্যাট। ভারী সুন্দর। গাড়ি চলে না। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। শীতকালে লোকে আসে স্কী করতে।
জেরম্যাট থেকে ট্রেন ছাড়ে। সারা দিন ধরে দারুণ সুন্দর অজস্র পাহাড় নদী উপত্যকা বরফ জলপ্রপাত পাথর দেখতে দেখতে, দু’শ একানব্বইটা অবিশ্বাস্য ব্রিজ আর একানব্বইটা টানেল পার হয়ে, পৃথিবীর একটা অনন্যসুন্দর জায়গা দিয়ে যাত্রা করে। শেষে পৌঁছয় আরেকটা পাহাড়ি শহর সেন্ট মরিৎস্-এ।
আজ আমি আবার সেই ট্রেনে। এখন আমি একা। অনেক বছর আগে ছিলাম যাত্রী। এখন – কী করে জানি না – আমি চালক। অর্থাৎ আমিই ট্রেন চালাচ্ছি। খুব জোরে নয়, মোটামুটি আস্তে আস্তেই যাচ্ছি। আমিই যাত্রী, আমিই চালক।
সুইৎসারল্যান্ডের বিশাল রেল নেটওয়ার্ক। কিন্তু আমার পথটা বিশেষ ভাবে সুন্দর। এই তো, একটু আগেই একটা বিরাট লম্বা আর ঘোরানো ছ’পেয়ে ব্রিজ পেরোলাম বন্ধুর দুর্গম পাহাড়ে। একশ বছরের পুরোনো ব্রিজ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে এক বিস্ময়কর ইঞ্জিনিয়ারিঙের নিদর্শন।
শেষবার যখন এই ট্রেনে এসেছিলাম, স্পষ্ট মনে আছে জানলার ধারে বসে ছিলাম – প্রায় পুরো ট্রেনটাই জানলা, ছাদেও কাঁচ। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম সবুজ আর নীল রং কত রকমের হয়। ক্রমাগত ডাইনে বাঁয়ে উপরনীচ করতে করতে একসময় হুশ্ করে একটা টানেলে ঢুকে গেল ট্রেনটা। কামরার ভেতরে আলো জ্বলছিল। তবু আমি এতই মগ্ন ছিলাম বাইরের আলোতে, যে টানেলে ঢুকে আমার চোখদুটো পুরো অন্ধকার হয়ে গেল। ঝিকঝিক করে কাঁপুনি দিয়ে ট্রেন চলছিল নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। আশেপাশের যাত্রীরা সব উধাও হয়েছে নিমেষে। হয়তো একটু একটু করে চোখ সয়ে যেত। কিন্তু টানেলটা ছোট। যে রকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল, সে রকমই অপ্রত্যাশিত ভাবে শেষ হয়ে গেল। চোখে এল আলোর বন্যা। এক মুহূর্তে সব-কালো থেকে সব-সাদা। এত বছর পরেও আমার স্পষ্ট মনে আছে। ওঃ সেকি চোখ ধাঁধানো আলো! বিরাট কামরায় আমি একা যাত্রি। রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে, সেই মোহানার ধারে।
ক্রিং করে রেডিও-টেলিফোন বাজল।
ফোন তুলে বললাম, “হ্যালো, গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস।”
“তুমি কি তোমার সময়সূচি মত চালাচ্ছ?”
“হ্যাঁ, মোটামুটি ঠিকই আছি।”
“তাহলে সামনের শান্টিং করার জায়গায় একটু সরে দাঁড়াও। সন্দীপ তোমার উলটো দিক থেকে আসছে। ওর ট্রেনে কোনো একটা এমারজেন্সি হয়েছে।”
“নিশ্চই।”
লাইনটা কেটে দিয়ে সন্দীপকে ফোন করলাম।
“হ্যালো, সন্দীপ?”
“কে? মন্থরা?”
“হ্যাঁ। সব ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সব ঠিক।”
“ওঃ! আমাকে এক্ষুনি খবর দিল তোমায় পথ ছেড়ে দিতে। কিছু একটা এমার্জেন্সি…”
“চিন্তার কিছু নেই। তবে পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
কুট করে লাইন কেটে দিল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই শান্টিং করার জায়গাটা এসে গেল। আমি মেন লাইন থেকে সরে পাশে দাঁড়ালাম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পাশ দিয়ে সন্দীপের ট্রেন এল। বেশ জোরে চালাচ্ছে। আমায় হাত নাড়ল। কিন্তু ভালো করে দেখতে পেলাম না। এত জোরে যাচ্ছিল যে আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। সেই যেমন অনেক বছর আগে হয়েছিল – সেইখানেতে সাদায় কালোয়, মিলে গেছে আঁধার আলোয়।
***
যতক্ষণে ধাতস্ত হলাম, দৃশ্য পালটে গেছে।
লক্ষ লক্ষ বছর আগে কিম্বা হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর পরে আমি জন্ম নিয়েছি নতুন কোনো গ্রহের প্রশান্ত মহাসমুদ্রে। আমি এখন একটা বিশালকায় চ্যাপটা-দেহ চিতল মাছ। প্রায় অর্ধেক গ্রহ জুড়ে আমার দেহ।
ধীরে, অতি ধীরে, সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছি। আমি রঞ্জন।
এই অন্তহীন জলের আমি বাসিন্দা। আমার নাম বনলতা।
আমি শুধু ভেসে বেড়াই। আমি সন্দীপ।
আমি সাঁতার কাটছি গ্রহটার সারা গা বেয়ে। আমার নাম মন্থরা।