• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • পোষ‍্য : অংশুমান গুহ

    অতসী বসার ঘরে আলো জ্বালল। এবং জ্বালানো মাত্র আমাকে দেখে নুন-ছেটানো শামুকের মত শুকিয়ে গেল।

    “আপনি এখানে?”

    আমি অন্ধকারে খোলা জানলার পাশে বসে ছিলাম চুপ করে।

    বললাম, “হ‍্যাঁ।”

    বসার ঘর না বলে বসার জায়গা বলাটাই ঠিক হবে। বসার জায়গাটা একটা লম্বা ঘরের একদিকে। অন‍্যদিকে রান্নাঘর আর আরেকটা ছোট বসার জায়গা। সেই ছোট বসার জায়গায় সীমামাসি বসে ছিলেন তাঁর ইজিচেয়ারে। পাশে তাঁর উয়িলচেয়ার।

    সীমামাসি একটু চেঁচিয়ে বললেন, “তুমি কখন এলে?”

    “আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছি। আপনি ওখানে ঘুমোচ্ছিলেন। এখানে জানলা দিয়ে সুন্দর হাওয়া দিচ্ছিল। তাই বসে ছিলাম। তারপর কখন জানি না ঘুমিয়ে পড়েছি।”

    মিথ‍্যে বলিনি। কিন্তু কখন ঘুম ভেঙেছে সেটা সীমামাসি আর অতসীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর বললাম না।

    সাধারণত সন্ধ‍্যার পর বাড়ি ফিরি। আমি জীবনবিমার সেল্‌সম‍্যান। সারা কলকাতা ও কাছাকাছি মফঃস্বলে ঘুরে ঘুরে আমার জীবিকা। আজ বিকেলে দুজন ক্লায়েন্টের সাথে অ‍্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, দুজনেই বাতিল করল। কিছু করার ছিল না, তাই বিকেল বিকেল বাড়ি ফিরে এলাম।

    বাড়ি বলতে সীমামাসির বাড়ি। আমি পেয়িং গেস্ট। আমার নিজের বাড়ি বীরভূমে। সেখানে মাসে একবার কি দুমাসে একবার যাই।

    সীমামাসির খবর আমাকে দিয়েছিল আমার কলেজবেলার বকাটে বন্ধু রজত। সীমামাসি রজতের কোনো দূর সম্পর্কের মাসি হন। এই বাড়িতে একটা ঘরে একজন পেয়িং গেস্ট থাকত। সে ছেড়ে যাবার পর নতুন কোনো বিশ্বস্ত লোক খুঁজছিলেন। সে আজ থেকে ছ’মাস আগের কথা। তখন থেকেই আমি এ বাড়িতে আছি।

    সীমামাসির বয়স আটষট্টি। স্থূলকায় চেহারা। ডায়াবেটিস আছে। দিনে দু’বার ইনসুলিন নিতে হয়। বিশেষ হাঁটাচলা করতে পারেন না। উইলচেয়ার লাগে।

    মাসির ছেলেমেয়ে বা অন‍্য কোনো আত্বীয়স্বজন নেই। আছে শুধু এই অতসী। অতসীর জন্মের সময় ওর মা মারা যান। ষোল বছর অবধি এক ইতর প্রকৃতির বাবার কাছে বড় হয়ে, একদিন ও বাড়ি ছেড়ে পালায়। কোনোভাবে সীমামাসি আর তাঁর স্বামীর সাথে তখন ওর যোগাযোগ ঘটে। সেই থেকেই ও এই বাড়িতে থাকে। সীমামাসির স্বামী আচমকা ক‍্যানসারে মারা যান অতসী আসার দু’বছর পরে। তারপর থেকে মাসি আর তাঁর পোষ‍্য অতসী এই বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। এ ছাড়া একজন করে পেয়িং গেস্ট আসে, কিছুদিন পরে ছেড়ে যায়, আবার নতুন লোক আসে। গত ছ’মাস ধরে আমিই সেই অস্থায়ী ভাড়াটে।

    পার্ক স্ট্রিটের কোনো এক বড়লোক রেস্তোরাঁয় অতসী পরিচারিকার কাজ করে। স্কুল পাশ করেছে। সীমামাসির বাড়িতে ভাড়াও দিতে হয় না, খেতেও পায়। উপরন্তু কিছু হাতখরচাও পায় হয়তো। বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার ইত‍্যাদি ও-ই সামলায়।

    সীমামাসির প্রতি অতসীর টানটা মূলতঃ কৃতজ্ঞতার। মাসির এক একটা ইচ্ছে বা আদেশ অতসী দেববাক‍্যের মত মান‍্য করে।

    আজ বিকেলে যখন আমার দু’জন খদ্দের শেষ মুহূর্তে তাদের অ‍্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করল, তখন বিরক্ত হয়ে আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম। গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে এমনিতেই ক্লান্ত লাগছিল। মনে হল বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম করব।

    বাড়ি এসে দেখি রান্নাঘরের পাশে ইজিচেয়ারে বসে সীমামাসি ঘুমোচ্ছেন। আমি নিজের ঘরে ব‍্যাগ রেখে, জামাকাপড় বদলে, মুখ-হাত ধুলাম। তারপর রান্নাঘরে এসে জল খেয়ে দেখলাম বসার জায়গায় জানলাটা খোলা। বেশ সুন্দর একটা ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। জানলার পাশেই আরামপ্রদ সোফা। বসে পড়লাম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

    ঘুম ভাঙল দরজা খোলার শব্দে। জানলা দিয়ে দেখলাম সন্ধে হয়ে গেছে। বাইরে অন্ধকার মেঘ।

    বাড়িতে ঢোকার দরজাটা বসার জায়গার কাছে নয়। ঢুকেই একটা সরু হলঘর – সেখানে পর পর এক একটা শোবার ঘরের দরজা, আর একটা বাথরুমের দরজা আর একটা রান্নাঘরের দরজা।

    দরজা খোলার শব্দের পর, সেই হলঘর থেকে কিছু আওয়াজ এল। সীমামাসি চেঁচিয়ে বললেন, “কে? অতসী নাকি?”

    “হ‍্যাঁ,” বলে অতসী রান্নাঘরে ঢুকে আলো জ্বালল। বসার জায়গায় আমি অন্ধকারেই বসে রইলাম।

    মাসি বললেন, “একি! তোর কী হল? কী হয়েছে?”

    দেখলাম অতসীর বাঁ-গালে কিছু একটা হয়েছে। আমি দূর থেকে প্রথমে ঠিক স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না।

    মাসি বললেন, “একি হয়েছে? কী করে হল? টেবিল ল‍্যাম্পটা জ্বালা।”

    অতসী ঝুঁকে মাসির পাশের টেবিল ল‍্যাম্পটা জ্বালাল। তারপর ও ঝুঁকেই রইল।

    দূর থেকেই আমি এবার ভালো দেখতে পেলাম। ওর বাঁ-গালটা খানিকটা লাল, খানিকটা বেগুনি। ওর যৌবনদীপ্ত আকর্ষণীয় মুখে স্বাভাবিক ভারসাম‍্যটা নেই। বিশ্রী লাগছে।

    অতসী কোনো কথা বলল না। ঝোঁকা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

    মাসী আবার শেষ প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করলেন, “কী করে হল? আলোটা নিবিয়ে দে।”

    অতসী আবার ঝুঁকে টেবিল ল‍্যাম্পটা নিবিয়ে দিল। রান্নাঘরের অন‍্য আলোটা জ্বলাই থাকল।

    অতসী বলল, “শুয়োরের বাচ্চা আমাকে ক্লিপ-বোর্ড দিয়ে মেরেছে!”

    “ক্লিপ বোর্ড?”

    “হ‍্যাঁ। ওই যে, খাতার মত, কাঠের মাথায় ক্লিপ লাগানো, আর ক্লিপে কাগজ আটকানো।”

    “কে মেরেছে?”

    “খদ্দের।”

    “কেন?”

    বিরক্ত কন্ঠস্বরে অতসী বলল, “জানি না।”

    “ঠিক কী হয়েছে বল্!”

    “আমরা হোটেলের ঘরে ছিলাম। যখন কাজ… শেষ হয়ে গেছে, আমাকে জিগ‍্যেস করল, ‘তুই কী করিস?’ আমি বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘তার মানে কী? আমি কী করি।’ বলে কি, ‘যখন সঙ্গম করিস না, তখন কী করিস?’ শুধু সঙ্গম বলে নি, অন‍্য কিছু। আমি তখন হেসে ফেলেছি। বললাম, ‘আমি শুধু এটাই করি।’ তখন ও খুব রেগে গেল। বলল, ‘হাসছিস কেন মাগী? আমার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে?’ আমি বললাম, ‘না।’ তখন ও কিছু একটা বলল, তার উত্তরে আমি কিছু একটা বললাম। কথা বলতে বলতে ও আরো রেগে গেল। আমার হাতে ক্লিপ-বোর্ডটা ছিল। কারণ যখন হোটেলের ঘরে পৌঁছেছি, তখন রজতদা ছিল না। রজতদাকে আমার ক্লিপ-বোর্ডটা ফেরত দেবার কথা।”

    এবার সীমামাসি রেগে গিয়ে বলল, “তুই ক্লিপ-বোর্ড নিয়ে হোটেলের ঘরে গেছিলি? তোর কি মাথা খারাপ?”

    “হ‍্যাঁ। রজতদা কোথাও ছিল না। খুঁজে পেলাম না।”

    “ওরে গাধী! ওখানে তো সবার কথা লেখা থাকে, ফোন নাম্বার, নাম, হ‍্যান ত‍্যান।”

    “হ‍্যাঁ, কিন্তু সবই সংকেতে…”

    “তোর কি একটুও বুদ্ধি নেই?”

    একটু থেমে মাসি বললেন, “হতভাগী মেয়ে! তারপর বল্। তারপর কী হল?”

    “আমাকে ধাক্কা মেরে দরজায় ঠেলে দিল। তারপর আমার হাত থেকে ক্লিপ-বোর্ডটা কেড়ে নিল। আমার পিঠ তখন দরজায় ঠেকে গেছে। ক্লিপ-বোর্ডটা দিয়ে আমাকে বেদম মারতে শুরু করল।”

    “ভগবান!”

    “বেশ কয়েকবার মেরেছে।”

    মাসি এবার মায়ের ভঙ্গীতে দু’হাত তুলে অতসীকে কাছে আসতে ইশারা করলেন। মাসির পায়ের কাছে অতসী মাটিতে বসল। তারপর মাথাটা মাসির পায়ের ওপর রাখল।

    মাসি বসে বসেই সামনের দিকে ঝুঁকে অতসীর মাথায় হাত রাখলেন। তারপর আস্তে আস্তে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন, “আমার হতভাগী মেয়ে!”

    এইভাবে খানিকক্ষণ কাটল। আমি বসার জায়গায় অন্ধকারে বসে আছি। মাসি ইজিচেয়ারে বসে তার পোষ‍্যর মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। অতসী নতজানু ও নতমস্তক।

    আমি তখন আস্তে আস্তে ব‍্যাপারটা বুঝতে শুরু করেছি। অতসীর নতুন পরিচয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু যে ভাবে এক আহত যুবতী সান্ত্বনা চাইছিল এবং পাচ্ছিল এক বয়স্কা পঙ্গুর কাছে, তার মধ‍্যে একটা শান্তির রস ছিল। একটা মাধুরী।

    মাসি বললেন, “কয়েক দিনেই সেরে যাবে। আমি রজতকে বলব কয়েকটা দিন রোজগারের ক্ষতি হবে।”

    অতসী একই ভাবে পড়ে রইল।

    ওর মাথা থেকে মাসি হাত সরিয়ে নিলেন। বললেন, “যা, চান করতে যা।”

    অতসী আস্তে আস্তে উঠে পড়ল।

    মাসি বললেন, “আমি রজতকে বলব ক্ষতিপূরণ আদায় করতে। শুয়োরের বাচ্চা।”

    অতসী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মাসি ডেকে বললেন, “ক‍্যাশ বাক্সে আজকের টাকা রাখতে ভুলবি না!”

    “হ‍্যাঁ মাসি, রাখছি।”

    “আর বসার জায়গার আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে যা। জীবনবিমার মক্কেল এক্ষুনি এসে পড়বে। তার আগে পরিষ্কার হয়ে নে। জিগ‍্যেস করলে বলবি পড়ে গিয়েছিলি।”

    অতসী তখন বসার জায়গায় এসে আলো জ্বালল।

    জ্বালানো মাত্র আমাকে দেখে ও নুন-বিকীর্ণ শামুকের মত বিশীর্ণ হয়ে গেল।

    “আপনি এখানে?”

    “হ‍্যাঁ।”

    সীমামাসি চেঁচিয়ে বললেন, “তুমি কখন এলে?”

    “আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছি। আপনি ওখানে ঘুমোচ্ছিলেন। এখানে জানলা দিয়ে সুন্দর হাওয়া দিচ্ছিল। তাই বসে ছিলাম। তারপর কখন জানি না ঘুমিয়ে পড়েছি।”

    বলতে বলতেই অঝোরে বৃষ্টি নামল।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments