• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • সোমনাথ ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ — এক অনাস্বাদিত পাঠ-অভিজ্ঞতা : রঞ্জন ভট্টাচার্য

    সোমনাথ ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ — যুগ্ম সম্পাদক- সুধীর ভট্টাচার্য ও প্রসূন মজুমদার; প্রচ্ছদ – রাজীব দত্ত; প্রকাশক- ইতিকথা পাবলিকেশন, কলকাতা; প্রথম প্রকাশ- এপ্রিল ২০২৩; ISBN: 978-93-93680-35-8

    সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিস্মৃত’ একটি অতি পরিচিত বিশেষণ। শুধু বাংলা নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেই এই শীর্ণ বিশেষণটির ব্যবহার চোখে পড়ে। আকারে ছোটো হলেও যখন কোনো কবি বা লেখকের প্রাথমিক পরিচিতি হয়ে ওঠে এই ‘বিস্মৃত’ শব্দটি তখন অসংখ্য অনুত্তর জিজ্ঞাসার ব্যাপ্তিতে তৈরি হয় সুগভীর গবেষণার পরিসর। এই বিষয়ে কোনো গবেষণা বাংলা তথা বিশ্বের অন্য কোনো ভাষায় হয়েছে কিনা জানা নেই। অবশ্য হবার সম্ভাবনাও কম। তার কারণ নিহিত রয়েছে ‘বিস্মৃত’ শব্দটির অর্থের ব্যাঞ্জনাতেই। একজন কবি বা লেখক সৃজনশীলতায় দুর্বল না হয়েও মহাকালের প্রচ্ছদ থেকে কেন মিলিয়ে গেলেন বা আরো সহজ করে বললে পাঠক তাঁকে বা তাঁদেরকে কেন মনে রাখল না, তার কারণ বহুবিধ। কখনো দেখা যায় সেই কলমচী হয়তো নিজেই সরে গেছেন সাহিত্যের জগত থেকে বা মাঝেমাঝে লেখালেখি থেকে দীর্ঘ বিরতিতে পাঠকের সঙ্গে তাঁর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রকাশিত গ্রন্থের অভাবেও পাঠকের কাছে কোনো স্রষ্টা প্রায় অপরিচিত থেকে যেতে পারেন। পাঠের সুযোগ না থাকলে তাঁকে নিয়ে আলোচকদের পক্ষে আলোচনা করাও অসম্ভব। সমসময় থেকে দূরবর্তী কবি ও লেখকদের সঙ্গে বর্তমানকালের সেতু হয় ওঠে এই আলোচনাগুলিই। আবার অনেকসময়ই দেখা যায় কবি বা সাহিত্যিকের মৃত্যুর পর তাঁর সাহিত্যকৃতি বিষয়ে পরিবারের অনাগ্রহ ক্রমশ তাঁকে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। কবি ও লেখকদের বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার আরো তথ্য ও কারণ উঠে আসতেই পারে এই বিষয়ে নিবিড় অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে।

    ভূমিকার প্রসঙ্গটির অবতারণার কারণ একটি বই “সোমনাথ ভট্টাচার্যের রচনা সংগ্রহ” প্রথম খণ্ড, যুগ্ম সম্পাদনা সুধীর ভট্টাচার্য ও প্রসূন মজুমদার। সাম্প্রতিক সময়ে সোমনাথ ভট্টাচার্য একটি প্রায় অপরিচিত নাম, যথার্থভাবেই একজন বিস্মৃত লেখক। অথচ এই শতকের শুরুর বছরগুলিতেও তাঁর কলম সচল ছিল। ২০০৩ সালে তিনি লিখেছিলেন তাঁর শেষ গল্প। তথ্যের নিরিখে সোমনাথ ভট্টাচার্যের প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে ‘বসুমতী’ পত্রিকায়। শিরোনাম ‘আমাদের পাতা’। যদিও ‘রচনা সংগ্রহ'-এর অন্যতম সম্পাদক প্রসূন মজুমদার নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় লিখেছেন ১৯৪৯-৫৬ পর্যন্ত লেখকের লেখা কোনো গল্প সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৭ থেকে ২০০৩, মাঝে প্রায় বারো বছর (১৯৬৬-৭৭) লেখালেখি থেকে স্বেচ্ছা বিরতিতে যাওয়া, সোমনাথ ভট্টাচার্যের সংগৃহীত ছোটোগল্পের সংখ্যা ৪২ ও উপন্যাসের সংখ্যা ২। প্রসূন মজুমদারের কথায়, “বলা বাহুল্য তার মাঝেও হয়তো বা রয়েছে খুঁজে না-পাওয়া এক আধটি গল্প।” প্রায় পাঁচ দশকের লেখক জীবনে লেখা ছোটোগল্প বা উপন্যাসের সংখ্যা দেখেই বোঝা যায় যে সোমনাথ ভট্টাচার্য সৃজনের ক্ষেত্রে বহুপ্রসূ ছিলেন না। তাঁর প্রকাশিত কোনো গল্প সংকলনের হদিশও পাওয়া যায় না। এ সম্পর্কে ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রিকার ২০২৫ বইমেলা সংখ্যায় “সোমনাথ ভট্টাচার্য” ক্রোড়পত্রে পত্রিকা সম্পাদক প্রশান্ত মাজী লিখেছেন, “ফোন নম্বর সংগ্রহ ক’রে অবশেষে ফোন করি তাঁর একটি গল্প চেয়ে। রাশভারী গলায় অতীব বিনীতভাবে বলেন —

    ‘আমি এখন আর গল্প লিখি না।’

    ‘আপনার কোনো বই পাওয়া যায়?’

    ‘দু'একটা হয়তো বা। একটা পেতে পারেন।’

    কলেজস্ট্রীট এর এক ছোট প্রকাশনার ঠিকানাও দেন। কিন্তু পাই না খুঁজে। “‘রচনা সংগ্রহ’- প্রথম খণ্ড-এর পরিশিষ্ট অংশে সংযোজিত তথ্য অনুযায়ী প্রশান্তবাবুর খুঁজে না পাওয়া সোমনাথ ভট্টাচার্যের সেই একমাত্র গল্পগ্রন্থটির নাম ‘মানবাত্মা’ (প্রকাশক “শাওনি”, প্রকাশকাল জুন, ১৯৮৬)।

    অর্থাৎ কম লেখা, মাঝে দীর্ঘ এক দশক লেখা থেকে সরে যাওয়া এবং প্রকাশিত কোনো গ্রন্থ না থাকা ক্রমশ লেখক সোমনাথ ভট্টাচার্যকে বিস্মৃতির পথে ঠেলে দিয়েছে। যেমনটি ঘটেছে সোমনাথের সমসাময়িক যশোদাজীবন ভট্টাচার্য, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় দাশগুপ্ত, বাসুদেব দাশগুপ্ত, মিহির মুখোপাধ্যায়, রতন ভট্টাচার্য (ইদানীং কিছু বই প্রকাশিত হওয়ায় রতন ভট্টাচার্য বিষয়ে পাঠকের আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে) বা পরবর্তী সময়ের কানাই কুন্ডু, শিবতোষ ঘোষ, রাধানাথ মন্ডল প্রমুখ লেখকদের জীবনে। হয়তো “সোমনাথ ভট্টাচার্যের রচনা সংগ্রহ”-এর প্রথম খণ্ড তাঁর ওপর থেকে বিস্মৃতির পর্দা কিছুটা হলেও উন্মোচন করতে সমর্থ হবে।

    দুই

    ১৯৩৪ সালের ৯ই অক্টোবর নৈহাটিতে সোমনাথ ভট্টাচার্যের জন্ম। তিনি বাংলার সারস্বত জগতে প্রবাদপ্রতিম হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উত্তরসূরি। অকৃতদার, অন্তর্মুখী, প্রচারবিমুখ সোমনাথের সাহিত্য চর্চার সূচনা ও বেড়ে ওঠা নৈহাটির অহংকার সমরেশ বসুর নিবিড় ছত্রছায়ায়। পরবর্তী সময়ে তিনি সাহিত্যিক বিমল করের সান্নিধ্যও পেয়েছেন। বিমল কর তাঁর “আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা” গ্রন্থে একটি অধ্যায় লিখেছিলেন সোমনাথ ভট্টাচার্য সম্পর্কে। বিমল করের এই লেখাটি এবং ১৯৮৬ সালে নৈহাটি থেকে প্রকাশিত ‘প্রৈতি’ পত্রিকার বাসন্তী সংখ্যায় সাহিত্যিক জ্যোৎস্নাময় ঘোষের লেখা সোমনাথ ভট্টাচার্যের একমাত্র গল্প সংকলন ‘মানবাত্মা’-র গ্রন্থ সমালোচনা ছাড়া তাঁর সাহিত্য বিষয়ে সেভাবে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০২৩ সালে প্রকাশিত “রচনা সংগ্রহ” প্রথম খণ্ড-এ রণবীর পুরকায়স্থের ভূমিকা এবং ২০২৫ সালে ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রিকার বইমেলা সংখ্যায় বিশেষ ক্রোড়পত্রে প্রশান্ত মাজী ও দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা দুটি ছোটো প্রবন্ধ সেই অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করছে। নাতিদীর্ঘ হলেও বিমল করের লেখাটিকে বাদ দিয়ে সোমনাথের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে কোনো বিশ্লেষণ অসম্ভব।

    ব্যক্তিগত জীবনে সোমনাথ ভট্টাচার্য কোনো চাকরি করেননি, যুক্ত ছিলেন পারিবারিক ব্যবসায়। এই প্রসঙ্গে বিমল কর লিখেছেন, “লোকমুখে খবর পেতাম সোমনাথ কনট্রাক্টরি করছে, ফার্মিং করছে। নৈহাটিতেও থাকে না সবসময়।” ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ৮৮ বছর বয়সে নৈহাটিতে নিজ বাসভবনে প্রয়াত হন সোমনাথ ভট্টাচার্য। এই মুহূর্তে তাঁর সৃষ্টি সম্ভারের কাছে পৌঁছনোর একমাত্র মাধ্যম এপ্রিল ২০২৩ সালে প্রকাশিত আলোচ্য “সোমনাথ ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ” প্রথম খণ্ড। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা এখনও প্রকাশিত হয়নি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল প্রথম খণ্ডের বানিজ্যিক অসাফল্য দ্বিতীয় খণ্ড-এর প্রকাশকে বিলম্বিত করছে। দুর্ভাগ্য বাংলা সাহিত্যের, দুর্ভাগ্য বাঙালি পাঠকের।

    প্রকাশিত প্রথম খণ্ডে সংকলিত হয়েছে তিরিশটি ছোটোগল্প। এই গল্পগুলির প্রকাশকাল ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৮। রচনা সংগ্রহের পরিশিষ্ট অংশে সংযোজিত আখ্যানসূত্র দেখলে লেখক সোমনাথ ভট্টাচার্য সম্পর্কে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়। এক) তিনি স্বল্প লেখায় বিশ্বাসী ছিলেন। কেননা ১৯৬১, ৬২, ৬৩, ৬৫, ৬৬, ৮৬, ৮৮ সালে তাঁর প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা মাত্র একটি। সবচেয়ে বেশি তিনটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫৭, ৬০ ও ৮২ সালে। কম লেখাও কি লেখকের বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার একটি কারণ? হবেও বা!

    দুই) সোমনাথ ভট্টাচার্য মূলত বহুল প্রচারিত বানিজ্যিক পত্রিকার লেখক। সংকলিত তিরিশটি গল্পের একটিও কোনো লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়নি। সবচেয়ে বেশি বাইশটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘দেশ’ পত্রিকায়। বাকি গল্পগুলি অমৃত, মহানগর, শিলাদিত্য ইত্যাদি পত্রিকায়। রচনা সংগ্রহের প্রথম গল্প ‘মহাকাশের স্বাদ’ ১৯৫৭ সালে হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত যে ‘বিংশ শতাব্দী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিকেও বোধহয় লিটল ম্যাগাজিন বলা যাবে না।

    তিন

    বিমল কর সোমনাথ ভট্টাচার্য সম্পর্কে লিখেছিলেন, “ভট্টাচার্য হলেই মাথা বিগড়োয় কিনা জানি না। অথচ রতন ভট্টাচার্য আর সোমনাথ ভট্টাচার্যকে দেখলে তাই মনে হয়। দুই ভট্টাচার্যই একই সময়ে লিখতে শুরু করে, এবং দুজনেই মোটামুটি একই সময়ে লেখা ছেড়ে দেয়। আর এটাও আশ্চর্য যে দুজনেই আবার প্রায় একই সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের পর, নতুন করে লেখা শুরু করে।”

    লেখা ছাড়া ও আবার শুরু করা — এই বিষয়টি ছাড়া রতন ভট্টাচার্য ও সোমনাথ ভট্টাচার্যের মধ্যে সাহিত্যিক বিষয়ভাবনার দিক থেকে তিলমাত্র সাদৃশ্য নেই। রতনের গল্প মূলত নাগরিক মননের মধ্যবিত্ত জীবনের নানা জটিলতার ওপর গড়ে উঠেছে। কিন্তু সোমনাথের গল্প গ্রাম থেকে শহর, প্রান্তিক মানুষ থেকে উচ্চবিত্ত জীবনের অলিগলিতে অনায়াসে বিচরণ করছে। এমনকী শিল্পাঞ্চলের অপরাধ জগতের আলো-অন্ধকারও তাঁর কাহিনির বিষয়। রচনা সংগ্রহের তিরিশটি গল্পই ভিন্ন স্বাদের। প্রত্যেকটিই আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু গ্রন্থ সমালোচনার বিধিবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তাই কয়েকটি গল্পের সংক্ষিপ্ত উল্লেখের মধ্যে দিয়ে গল্পকার সোমনাথ ভট্টাচার্যের বিশিষ্টতা স্পষ্ট করার চেষ্টা করব। বাকিটা তোলা থাকুক আগ্রহী পাঠকের উদ্দেশ্যে।

    সোমনাথ ভট্টাচার্য সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ গ্রামীণ জীবনে। পঞ্চাশের দশকের কথাসাহিত্যের গতিপ্রকৃতির নিরিখে এই বৈশিষ্ট ব্যতিক্রমী। এই সময়ের লেখকরা বেশিরভাগই শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে অভ্যস্ত। সোমনাথও তাই, নৈহাটির মতো ঘিঞ্জি শিল্পাঞ্চলের ভূমিপুত্র। কিন্তু তাঁর লেখায় বাংলার গ্রাম তার সর্বস্ব নিয়ে উপস্থিত। এক্ষেত্রে সমসাময়িক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা স্পষ্ট। বোধহয় বিমল কর কথিত ‘ফার্মিং’-এর সূত্রেই তাঁর লেখায় এই গ্রাম-সংসর্গ। আরেকটি বিষয়ও এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ, সোমনাথের এই ধরনের গল্পগুলির পটভূমি একটিই — ধর্মপুর স্টেশনের কাছে গ্রাম- কেয়াবন। প্লাবন, কই মাছের প্রাণ, গ্রাম-কেয়াবনের দুখী মানুষটি, হাটবার, বাবুর জমি, অশ্বশক্তি, ধানপোকা, খরা প্রভৃতি গল্পে গ্রামীণ জীবনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা বিষ্ময়কর।

    সোমনাথ ভট্টাচার্যের গ্রাম-জীবন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সরলরেখায় তৈরি নয়। তার শরীর ও মননে মানব চরিত্রের চিরায়ত বক্ররেখার ভাঁজ, পরনে নিখাদ গ্রামীণ ভাষা পরিচ্ছদ। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫৭ সালে লেখা ‘প্লাবন’ গল্পটির কথা বলা যেতে পারে। মদ্যপ হৃদয়ের উপার্জনের একমাত্র লক্ষ্য নেশা। তার কাছে স্ত্রী-সন্তান ‘আঁস্তাকুড়ের জঞ্জাল’। ভরা বন্যায় জীবন যখন বিপর্যস্ত, খিদে সর্বব্যাপী, তখন হৃদয় ভেলা নিয়ে বেরোয় জলে ভেসে আসা বেওয়ারিশ পাটের জাঁকের সন্ধানে। পেলে বিক্রি করে জুটবে তার নেশার তরল আগুন। কিন্তু সেদিন পাটের জাঁক নয়, ভেসে আসে একঝাঁক হাঁস। হৃদয় তাদের ধরার চেষ্টা করে। ঠিক সেইসময়ই একটি গামলায় ভাসতে দেখা যায় কাঁথা মুড়ি দেওয়া এক সদ্যোজাত শিশু। সংসারের বোঝ বাড়বে তাই শিশুটিকে না বাঁচিয়ে হৃদয় ছোটে হাঁসের পেছনে। কিন্তু হাঁসেরাও পালিয়ে যায়। শিশুটির সামনে অপেক্ষমান মৃত্যু। বিষ্ময়কর নিরাবেগ উপসংহারে পৌঁছে থেমে গেছেন লেখক। পাঠক কি হৃদয়কে খলনায়ক ভাববে? আবেগহীন লেখক তা ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের ওপরেই।

    নাগরিক পটভূমিতে এরকমই নিরাবেগ উপসংহারের গল্প ১৯৮১ সালে লেখা ‘বাতাবরণ’। বিমল করের মতে, “বিশেষ করে ‘বাতাবরণ’ অসামান্য গল্প।” ২০২৫-এও এই গল্পের বিষয়বস্তু ভীষণ প্রাসঙ্গিক। প্রোমোটার বিকাশ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে নিজের গাড়িতে বেড়াতে আসে এক নির্জন সৈকতে। হঠাৎই সেখানে হাজির হয় বিকাশের অভিযোগে জেলে যাওয়া দুটি ছেলে। প্রভাবশালী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। মস্তানি করে ভয়ে দেখিয়ে উপদ্রব করাই তাদের স্বভাব। তারা সরাসরি বিকাশদের কিছু বলে না। কিন্তু তীব্র ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে ছেলে দুটি যেন ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নিতে চায়। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া বিকাশ সপরিবারে পালাতে চায় শহরের নিরাপদ আশ্রয়ে। ছেলে দুটিও বিকাশের গাড়ির পিছনে ধাওয়া করে মোটরবাইকে। কাহিনির শরীর জুড়ে রোমহর্ষক থ্রিলারের উত্তাপ। অন্ধকার সংকীর্ণ রাস্তার একটি বাঁকে বিকাশের গাড়ি ধাক্কা মারে তাদের বাইকে। ছেলে দুটি কি মরে গেল? লেখক নিরুত্তর। রেবা বিকাশের কাঁধ খামচে ধরে জিজ্ঞেস করে, “এ কী করলে গো তুমি?” মেয়ে মিলি কেঁদে ফেলে, ছেলে জয় সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “বাবা? ওদের কি মেরে ফেললে—?”

    পড়তে পড়তে বিষ্ময় জাগে যখন এইধরনের আবেগহীন স্রষ্টা সোমনাথ ভট্টাচার্যের কলমে ১৯৮৪ সালে লেখা হয় ‘জন্মভূমি'--র মতো আদ্যন্ত তীব্র আবেগময় ছোটোগল্প। নিম্নমধ্যবিত্ত অনাদির বন্ধু এনআরআই সুবিমল ছেলে রাজাকে নিয়ে একদিন হঠাৎই অনাদির বাড়িতে আসে। জানায় দেশের প্রতি তার আর কোনো টান নেই । পূর্বপুরুষের বাড়ি ভাইবোনদের মধ্যে বিলি করে সে ফিরে যাবে। জন্মভূমি অনাদির হৃদয়ের আবেগ। সে প্রচন্ড রেগে যায় সুবিমলের ওপর। এখানেই জন্ম কিন্তু দীর্ঘ দিন প্রবাসী জীবনের অভ্যাসে বাংলা বলতে না পারা রাজাকে সুবিমলের অনুপস্থিতিতে সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় তার জন্মভূমি — গঙ্গা নদী, ইলিশ মাছ। একসময় সুবিমল ও রাজা ফিরে যায়। লেখক গল্প শেষ করেন অনাদির স্বগত ভাবনায়, “সে পেরেছে। রাজার মনে তার জন্মভূমির স্মৃতির বীজ বুনে দিতে পেরেছে। নিস্তার নেই রাজার। জন্মভূমির স্মৃতির এই ছবি তাকে হানা দিয়ে ফিরবে — সারা জীবন।”

    শেষ করি বিমল করের কথায়, “সোমনাথ হল সেই জাতের লেখক যারা চোখ এবং অনুভূতি দিয়ে সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে দেখে, ধরবার চেষ্টা করে কোনো না কোনো তাৎপর্য, সমাজের, জীবনের।” ‘সোমনাথ ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ’ প্রথম খণ্ডে সংকলিত তিরিশটি গল্প এই মন্তব্যের যথার্থতাকে পরতে পরতে বুঝিয়ে দেয়। ৫১০ পাতার দীর্ঘ পাঠ-অভিজ্ঞতা যেন এক মহত্তর ওডেসি — জীবন রহস্যকে প্রতি পদে পদে দেখা, জানা, অনুভব করার এক চিরায়ত যাদুঘর। রাজীব দত্তের প্রচ্ছদে যথাযথভাবে স্পষ্ট বিষয়ের ক্লাসিক আবহ।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments