আমার একটা কালো পাথর ছিল। ছোট। মসৃণ। হাতের মুঠোয় এঁটে যায়। সাধারণ পাথর নয়। ওই পাথরে জাদু ছিল।
পাথরটা আমায় দিয়েছিল ন’বছরের মেয়ে, অল্কা। দিয়েছিল উশ্রী নদীর ধারে। আমার তখন তেরো বছর বয়স। উশ্রী নদীতে তখন হাঁটু জলও নেই। কিন্তু শুকনো নয়। অল্প জল। বয়ে যাওয়া জল। ক্রমাগত পাথর আর নুড়ির উপর দিযে ছোট ছোট ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করতে করতে বয়ে চলেছে। সবচেয়ে নীচু জায়গায় জলের গভীরতা কয়েক ইঞ্চি মাত্র। সেখানে আমি বসে বা দাঁড়িয়ে ছোট্ট ছোট্ট মাছ দেখতাম। কখনো কখনো আঁজলা করে জল তুলতাম দুই হাতে। জলের সাথে হাতে উঠে আসতো একটা মাছ। চঞ্চল মাছ, খুবই ছোট। কখনো লাফ মেরে আমার হাত থেকে পালাতো। নয়তো আমি ছেড়ে দিতাম।
সেইখানে, উশ্রী নদীর যৎসামান্য জলে দাঁড়িয়ে, একদিন বিকেলে অল্কা আমাকে পাথরটা দিয়েছিল। রোগা পাতলা মেয়েটা। বিনুনি করে বাঁধা চুল। একটা সবুজ ছিটের ফ্রক পরে আছে। আমার মতই খালি পা। ওর কন্ঠস্বর ছিলো দূর থেকে ভেসে আসা পাহাড়ি মন্দিরের ঘন্টার শব্দের মত। যেমন বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে বনস্পতি, আমার মনে হত অল্কার মধ্যে যেন এক বিশাল কূল-ছাপানো স্রোতস্বিনী উশ্রী বয়ে চলেছে।
অল্কা বললো, “এই নাও।”
আমি পাথরটা নেড়েচেড়ে দেখলাম। খুব সুন্দর, মসৃণ, চকচকে।
অল্কা বললো, “এটা একটা ম্যাজিক পাথর।”
আমি বললাম, “কোথায় পেলি?”
“কি ম্যাজিক জানো?”
“খুব সুন্দর পাথরটা।”
নাক কুঁচকে অল্কা গালের কাছটা চুলকালো।
তারপর বললো, “আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে।”
আমি পাথরটা নিজের গালে ঘসলাম। তারপর ঠোঁটে ঘসলাম।
বললাম, “হাজার হাজার বছর ধরে জলে ঘসা খেয়ে খেয়ে এরকম স্মুদ্ হয়ে গেছে।”
“স্মুউদ্?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।” ওকে কি করে বোঝাবো স্মুদ্ মানে কি!
অল্কা বললো, “এটাতে ম্যাজিক আছে।”
“হাওয়ায় ভাসতে পারে?”
“অ্যাঁ?”
“অন্ধকারে এর থেকে আলো বেরোয়?”
“না।”
“তাহলে কি? ছুঁড়ে মারলে ফিরে আসে?”
“ধ্যাৎ,” বলে অল্কা হেসে ফেললো।
সরস্বতী পুজোর দিন ভোরবেলা আমি শিউলি গাছের তলা থেকে যে ফুল কুড়োতাম, অল্কার হাসিটা সেই ফুলের মত। সাদা দাঁত আর কমলা ঠোঁট। সারাটা রাত একটি দুটি তিনটি করে শিউলি ঝরে। ঝরে ঝরে ভেজা মাটিতে শুয়ে থাকে।
“তাহলে ম্যাজিকটা কি?”
“তুমি বলতে পারবে এখন আমি কি ভাবছি?”
আমি একটা বড় পাথরে উঠে, লাফ মেরে আরো বড় একটা পাথরে উঠে পড়লাম। হাতে আমার ম্যাজিক নুড়ি।
“তুই ভাবছিস… তুই ভাবছিস… কেমন করে আমাকে বোকা বানাবি।”
“হি হি। আচ্ছা, কি ভাবছি না। বলো তো আমার কি হচ্ছে? মানে, আমি কি খুশি না দুখি? আমি কি শান্ত, না কি আমি রেগে আছি। কি হচ্ছে আমার মনের মধ্যে?”
“সে আমি কি করে জানবো? এই তো বললি তোর রাগ হচ্ছে!”
“সে তো আমি মিছিমিছি বলছিলাম।”
“পাজি।”
“মোটেই আমি পাজি নই। তুমি পাজি।”
আমি আবার এ-পাথর থেকে সে-পাথর লাফিয়ে, একটু হেঁটে, আবার লাফিয়ে নতুন একটা পাথরে উঠে দাঁড়ালাম। কোনো কোনো পদক্ষেপ জলে পড়লো, কোনো কোনোটা পাথরে। ঠিক আমার পেছন পেছন তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে লাফিয়ে আসলো অল্কা। ঠিক সেই ছোট্ট বেড়াল ছানাটার মত, যাকে একবার ফুটপাথ থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। সে সারাক্ষণ আমার পেছন পেছন ঘুরতো। পিছু ছাড়তো না।
“বলো না! আমার মনের মধ্যে কি হচ্ছে?”
“জানি না।”
“ওই পাথরটা শক্ত করে ধরো। তারপর চোখ বন্ধ করো।”
“তাহলে কি হবে?”
“দেখবে। ম্যাজিক হবে। চোখ বন্ধ করো।”
“করলাম।”
“একদম বন্ধ করেছো তো? চুরি করলে হবে না কিন্তু।”
“একদম বন্ধ। সব অন্ধকার।”
অদ্ভুত লাগছিলো চোখ বন্ধ করে, উশ্রীর বয়ে যাওয়া জলের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। জলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কলকল। কলকল। জলের ধারে লম্বা লম্বা গাছের মধ্যে দিয়ে হাওয়া দিচ্ছে জোরে জোরে। তার শব্দ পাচ্ছি। দূরে কোথাও একটা পাখির আওয়াজ পেলাম। কিছু একটা ঝপ্ করে জলে পড়লো কাছাকাছি কোথাও। কোনো ডাল-টাল হবে।
“পাথরটা শক্ত করে ধরে আছো?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে। এইবার আমার কথা ভাবো। এক মনে। অন্য কিচ্ছু ভাববে না।”
“ভাবছি।”
“আরো ভাবো। আরো খানিকক্ষণ।”
আমি চুপ করে চোখ বন্ধ রেখে উশ্রীর জলে দাঁড়িয়ে অল্কার কথা ভাবতে লাগলাম। ভাবলাম ওর মনের মধ্যে কি হচ্ছে? কি ভাবছে ও?
কাল ছুটি শেষ, বাড়ি ফিরবো। অল্কাকে ছেড়ে, উশ্রীকে ছেড়ে চলে যাবো আমার শহরে।
আস্তে আস্তে আমার বন্ধ চোখের পাতায় যেন কিছু একটা নড়াচড়া করলো। কিছু দেখলাম বলবো না। কিছু শুনলাম বলবো না। কিছু অনুভব হল। কি করে বোঝাবো? কতগুলো রঙ যেন। অথবা কিছু রূপ, নকশা, আকার। একটা ছোট ধুকপুক। একটা সামান্য উত্তেজনা। হালকা, হ্যাঁ, হালকা একটা কিছু। এটা নিশ্চয়ই আনন্দ।
আমি বললাম, “কিছু একটা হচ্ছে। এটা কি তোর মনের ভেতরে?”
“কি বুঝছো? কি হচ্ছে?”
“তুই কি খুব খুশী?”
“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি আর কথা বলবে না। চুপ করে শুধু আমার কথা ভাবো। কোনো কথা নয়।”
চুপ করে রইলাম।
সেই একটা ধুকপুক। বুঝতে পারছি একটা চঞ্চলতা । হালকা একটা হাওয়ার মত। সূর্যোদয়ের রঙের হাওয়া। নড়ছে চড়ছে। উশ্রী নদীর পাথরে পাথরে যেন নেচে বেড়াচ্ছে। কে নাচছে? কেউ না। কেউ না। নাচটা নিজেই নাচছে। অদ্ভুত। নিঃশব্দ হাততালি। স্বরহীন গান।
যেন উঁকি মারতে পারছি, কিন্তু দেখতে পারছি না। আড়ি পাততে পারছি, কিন্তু শুনতে পারছি না।
আস্তে আস্তে ধুকপুকটা বদলে যেতে শুরু করলো। খানিকটা শান্ত হল যেন অল্কার মন। মেঘ কেটে যাচ্ছে কোনো আশ্চর্য আকাশে। নীল। স্নিগ্ধ নীল। একটা হলুদ হাওয়া হঠাৎ সাঁই করে বয়ে গিয়ে, থেমে গেল, চলে গেল। গন্ধ। অথবা গন্ধের মত কিছু। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় নিভৃত হাসনুহানা। সাদা একটা আভা, শুভ্র, তাতে কোনো দাগ নেই। শিশির পড়ার শব্দ।
এইভাবে বদলাতে লাগলো ম্যাজিকের পৃথিবী। অল্কার মন। কোনো কিছুর নাম নেই। গন্ধ স্পর্শ শব্দ দৃষ্টি কিছুই নেই, কিন্তু সবই আছে। নাম নেই। শান্তি আরো শান্ত হল।
কতক্ষণ সেই ভাবে দাঁড়িয়ে আছি জানি না। আমি ডুবে গেছি ম্যাজিকের স্বপ্নের দেশে। যেখানে ভাষা নেই। সুর আছে। কোনো কথা নেই। সমুদ্র আছে। নাম নেই। আকাশ আছে। আছে নদীও, তবে সেটা উশ্রী নয়। চিন্তা নেই।
অল্কার মনের মধ্যে একটা বিশাল সীমাহীন জায়গা। সেখানে রাগ-দুঃখ সবই আছে, কিন্তু তাদের কোনো নাম নেই। কোথায় আনন্দ শেষ হয়ে অভিমান শুরু হয়, তার কোনো লাইন টানা নেই। নামহীন আশা, নামহীন নিরাশা।
স্থান আর কাল-এর অনেক বাইরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। পায়ের তলায় উশ্রী নদীর পাথর, সামান্য ভেজা ভেজা। কিন্তু সে আমার খেয়াল নেই।
অনেকক্ষণ পর শান্তিটা একটু অশান্ত হল যেন। অশান্ত নয়, ক্লান্ত, শ্রান্ত।
একটা আবছা ধূসর অন্ধকার নামতে শুরু করলো। যেন একটা সন্ধ্যা নামছে। চোখের উপর নেমে আসছে অন্ধকার, চোখের পাতার মত। নামছে একটা ঘোমটা।
দূরে কোথাও কি শুকনো পাতা বা কাঠের টুকরো বা অন্য কিছু পুড়ছে? অথবা কিছু একটা শুকিয়ে যাচ্ছে, খরায় গাছের মত, মরুভূমিতে নদীর মত, রোদ্দুরে হেঁটে এসে যেমন গলা শুকিয়ে যায়।
জল একটু বয়ে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। আর বইতে চায় না। মরা জল।
একটা গাঢ় খয়েরি আচ্ছাদন গ্রাস করছে সব কিছু। খুব নরম কোনো মৃত্যুর মত।
কোনো নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেই। না, না, আছে। মাঝে মাঝে একটা আটকানো নিঃশ্বাস।
ভাল্লাগ্ছেনা কিচ্ছু।
সময়ের হিসেব নেই। অনেক যুগ যুগান্ত কেটে যাবার পর, একসময়ে ক্লান্ত হয়ে চোখ খুললাম।
উশ্রী আগের মতই বয়ে চলেছে। কলকল। কলকল। হাওয়া দিচ্ছে আস্তে। একটা অচেনা পাখি উড়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। গাছগুলো নড়ছে। পাতাগুলো কাঁপছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি পাথরের উপর। অল্কা চলে গেছে। আমার হাতের মুঠোয় ম্যাজিক পাথর - কালো, মসৃণ।
অল্কা কোথায় গেল?
আহা, বড় সুন্দর পাথরটা।
সন্ধে হওয়ার মুখে নিশার বাড়ি পৌঁছলাম। এই দিন আসবো বলে দিয়েছিলাম। বলার পর অবশ্য তিন মাস কেটে গেছে। এর মাঝে কোনো রকম যোগাযোগ হয়নি। দেখা তো নয়ই, ফোনও নয়।
সদর দরজা খোলাই ছিল। ঢুকে পড়ে জুতো খুললাম। ওর মা আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন, “এত দিন আসা হয়নি কেন?”
একটা নার্ভাস হাসি দিয়ে আমি টুক করে কেটে পড়লাম। কি বলবো? তিনমাসের অন্তর্ধান আমার ইচ্ছাকৃত।
পর্দা সরিয়ে বসার ঘরে ঢুকলাম। নিশা বসে আছে একটা সমারসেট মম্-এর লেখা বই খুলে। বইটা এ বাড়িতে আগে দেখিনি। মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। ও কি ভুলে গেছে যে আজ আমার আসার দিন?
নিশা বললো, “দুমিনিট। এই পাতাটা শেষ করে নিই।”
বলে আবার বই পড়তে লাগলো। আমি একটা অস্পষ্ট “হুঁ” বলে পাশের সোফায় বসলাম। বুকটা একটু ধুকপুক করছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা নামিয়ে মেঝেতে সোফার পাশে রাখলাম। ঠিক বুঝতে পারছি না ওর মুডটা কি। ওকি আমার উপর রেগে আছে? অভিমান হবার কারণ হয়তো থাকতে পারে। ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে। কিন্তু সেটা বোধহয় ঠিক হবে না।
অনেক দিন পরে দেখছি নিশাকে।
দেখে মনে হয় অনেকদিন চুল আঁচড়ায়নি। একটা ঢিলেঢালা পুরোনো জামা পরে রয়েছে। যে রকম সস্তার ছাপা-কাপড়ের জামা ও বাড়িতে পরে, গলা থেকে পা অবধি। জামাটা খুব একটা পরিষ্কারও মনে হচ্ছে না। চোখে বড়ো ফ্রেমের চশমা। ডান হাতে কয়েকটা নকলি সোনার চুড়ি।
ভাব করছে যেন বইটা খুব মন দিয়ে পড়ছে। কিন্তু গত দুবছরে আমি ওকে অনেকটাই চিনে গিয়েছি। ওর বই-তে মন বসছে না। হয়তো সত্যিই চেষ্টা করছে পৃষ্ঠাটা শেষ করতে। কিম্বা হয়তো শুধু আমাকে একটু বসিয়ে রাখতে চায়। রাগ হয়েছে।
কি বলবে ও? আমি কি বলবো? কিছুই জানি না। তবে মনে হয় আমাদের খারাপ সময়টা কেটে গেছে। আশা হয়। এবার নতুন করে শুরু হবে আবার। বন্ধ তালা ভেঙে দেখি আপন-মাঝে প্রেমের রতনভার।
কয়েক মিনিট নীরবতা। যে পাতায় বইটা খোলা ছিল, সেই পাতার কোণটা মুড়ে নিশা বইটা বন্ধ করলো। রেখে দিলো পাশে।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “কেমন আছো? শরীর ভালো আছে এখন?”
প্রথমে মনে হল যেন অনেক দূর থেকে নিশার কন্ঠস্বর ভেসে এলো। একটা কৌতূহলহীন বেড়ালের মিউ মিউ-এর মত। দড়ি না বেঁধে কুয়োতে বালতি ফেলে দেওয়া - জল তোলার জন্য। উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে।
পর মুহূর্তেই মনে হল যেন কতদিন জল খাইনি! একটা টিউব ওয়েল মাটির অনেক গভীর থেকে ঠান্ডা জল তুলে আনছে এখন। এইবার জল খাবার সময়।
আমি বসে থাকতে পারলাম না। সোফা থেকে উঠে পড়ে নিশার কাছে গেলাম। ওর সামনে মেঝেতে বসে পড়লাম। ওর কোমর জড়িয়ে ধরলাম জোরে। মাথা রাখলাম ওর কোলে। অনেক দিন পর নিশার শরীরের গন্ধ।
আমার মাথায় হাত রাখলো ও। চুলের মধ্যে আঙুল ঢোকালো। কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তারপর ওর আঙুলগুলো আলগা হয়ে গেল। হাতটা শিথিল হয়ে গেল। হাত সরিয়ে নিল।
আমি একই ভাবে আমার মন্দিরে পড়ে রইলাম।
একটু পর নিশা হাত দিয়ে আমার কাঁধ ধরে আস্তে আস্তে আমাকে ওঠানোর চেষ্টা করলো।
বললো, “ওঠো। এক্ষুনি চা নিয়ে আসবে।”
আমি জোর করে বসে থাকতে চাইলাম। কিন্ত পারলাম না। উঠতে হল। ইচ্ছে হল চুরি করে একটা চুমু খাই ওর গালে। সাহস হল না। নিজের সোফায় গিয়ে বসলাম।
বললাম, “বইটা কার?”
“পার্থ-র।”
“ওঃ” আমি বললাম, “ওর সাথে রাস্তায় দেখা হল একটু আগে। এখানে আসার পথে।”
নিশা বললো, “আমি আর পারছি না।” ওর গলায় একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আভাস।
আমি বললাম, “কি পারছো না?”
“এই স-অব… তুমি…তোমাকে…।”
একটু থেমে বললো, “খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি।”
কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকলাম।
নিশা বললো, “আমরা এখানেই শেষ।”
আমার বুকে একটা ধক্ করে আওয়াজ হল।
“বইটা কার জিজ্ঞেস করেছি বলে?”
“বোকার মত কথা বলো না!”
“নিশা!” বলে কিছু একটা বলতে গেলাম। ঠিক সেই সময় পর্দা সরিয়ে একজন ঘরে ঢুকলো, দুকাপ চা নিয়ে।
নদীতীরে অন্ধকার নামলো নীরবে। কিন্তু না, প্রেমনত নয়নের স্নিগ্ধচ্ছায়াময় দীর্ঘ পল্লবের মত নয়। নামলো খাঁ-খাঁ করা তপ্ত দিনের শেষে উত্তপ্ত সূর্যাস্তের মত। তাতে কোনো সান্ত্বনা নেই।
কিম্বা কোনো হিমশীতল আদালতকক্ষে বিচারপতি রায় দিয়েছেন। আসামীর অপরাধ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
গলাটা শুকনো লাগছিল। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “শেষ মানে? আমাদের সম্পর্ক শেষ?”
বিস্বাদ বিশ্রী চা।
নিশা উত্তর দিলো, “হ্যাঁ।”
“কেন?”
“কেন?” নিশার গলায় বিস্ময়।
“কারণ আমি আর পারছি না। তুমি একদিন হঠাৎ বলবে - তিন মাস দেখা দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ, তারপর উধাও হয়ে যাবে। তারপর আবার একদিন এসে কি দেখতে চাও? সব ঠিকঠাক? সব আগের মত? আমার পক্ষে আর এইসব সম্ভব নয়। এটা কি সীতার অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে?”
তারপর নরম কন্ঠস্বরে বললো, “আমি শেষ হয়ে গেছি।”
ঠিকই তো বলেছে। একদম ঠিক। কিন্তু…
বললাম, “কত দিন আলাদা থাকবো আমি তো বলেছিলাম! আমি তিন মাস সময় চেয়েছিলাম সুস্থ হয়ে উঠতে। বিশেষ করে মানসিক ভাবে।”
“আমি তো মেশিন নই! এ-ভাবে আমি আর চালাতে পারছি না। প্রথমে তুমি ক্লিঙি হয়ে উঠেছিলে...”
“ক্লিঙি?”
“হ্যাঁ। গায়ের সাথে ক্লিং করে - মানে চিপ্কে - থাকতে চাইতে সারাক্ষণ। বোকার মত তোমার ঈর্ষা। নিরর্থক পোজেসিভ তুমি।”
আমি সম্মতিতে মাথা নাড়লাম। কিছু বললাম না।
“তারপর হাসপাতাল। আমি তখন রোজ হাসপাতালে গেছি। তুমি আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠলে। আমরা তখন কত ভালো ছিলাম!”
আমি চুপ।
“তারপর হঠাৎ, ভগবান জানে কেন, একদিন ঘোষণা করলে তিন মাসের বিচ্ছেদ। একবারও জানতে চাইলে না আমি তা চাই কিনা। আমি তো চাইনি। আমি তো মানুষ, মহাপুরুষ নই।”
ঠিক কথা। একদম ঠিক। কিন্তু আমার তো উপায় ছিল না।
বললাম, “তুমি সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছো?”
“হ্যাঁ। আবার আমরা বন্ধু হয়ে যেতে পারি। পারি না?”
এই আদালতে করুণা নেই।
আমি চোখের সামনে নিশাকে দেখতে পারছিলাম। সোফায় পা-মুড়ে বসে আছে। হাতে চায়ের কাপ। পাশে পার্থ-র বই। কিন্তু আমার ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে। আর কোনো দিনও ছুঁতে পারবো না?
নিশা চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে উঠে গেল। পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি কি করবো তাহলে? কিসের জন্য বাঁচবো? সন্ধ্যা হল, মাগো!
নিশা ফিরে এলো দুমিনিটে।
বললো, “এই নাও তোমার পাথর। ফিরিয়ে দিলাম।”
আমার জীবনের সবচেয়ে দামি জিনিসটা আমি নিশাকে দিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ম্যাজিক পাথর। যা দিয়ে অন্য লোকের মনের ভাব জানা যায়। আজ সেটা নিশা আমাকে ফিরিয়ে দিলো। ফিরিয়ে নিল ওর ভালোবাসা।
ওর হাত থেকে পাথরটা নিলাম। আমাদের হাতে হাত ছুঁয়ে গেল। কে জানে, হয়তো এই শেষ স্পর্শ! আমি পাথরটা প্যান্টের পকেটে রাখলাম।
নিশা ওর সোফায় গিয়ে বসলো। বললো, “তোমার জিনিস তুমি বোঝো। আমি তো কোনো দিনও কিছু বুঝলাম না। তুমি বলো সব ইমোশান নাকি বোঝা যায়। কি যে ছাই বোঝা যায়, জানি না। কোনটা রাগ, কোনটা আনন্দ, কোনটা দুঃখ কিছুই বোঝা যায় না। তুমি যা ইচ্ছে করো ওটাকে নিয়ে। আমি চাই না।”
গত ছ’সাত বছর আমি ওই পাথরটা নিয়ে অনেক মানুষের মনের মধ্যে ঢুকেছি। স্কুলের বন্ধুদের মন। বাড়ির লোকেরা। পাড়ার পান-ওয়ালা। আস্তে আস্তে শিখেছি কি করে ওই মনের পৃথিবীটা বোঝা যায়। মুখের ভাষায় আমরা একটা দুটো কি দশটা নাম দিয়েছি - ঘেন্না, রাগ, দুঃখ, আনন্দ এইসব। কিন্তু সেই সবের মধ্যে তো আরো অজস্র সংখ্যাহীন ইমোশান আছে। ইমোশানগুলো তো আর ছাড়া-ছাড়া নুড়ি পাথর নয়, বা মাঠের অগুন্তি অথচ স্বতন্ত্র ঘাস নয়। ইমোশানদের গোনা যায় না। ইমোশান হল একটা পুকুরের মত। বা সমুদ্রের মত। কোথাও জল ঘোলা, কোথাও পরিষ্কার। কোথাও গভীর, কোথাও অগভীর। কোথাও শ্যাওলা, কোথাও রুই-কাতলা। আমরা এক জায়গায় ডুব দিয়ে বলি দুঃখ, অন্য এক জায়গায় সাঁতার কেটে বলি আনন্দ, আবার অন্য কোথাও শ্যাওলা ঘেঁটে বলি ঘেন্না।
এ সব কথাই আমি নিশাকে বলেছি। বলেছি যে আমি যখন পাথরটা হাতের মুঠোয় ধরে কারুর মনের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন তার মনের পুকুরে ঘুরে বেড়াই। বুঝতে পারি কোথায় ঢেউ উঠেছে, কোথায় শান্ত, কোথায় ঠান্ডা, কোথায় গরম। আকারহীন অরূপ এক জগৎ সেটা, তবু নানান নকশা আছে। রঙহীন রঙের খেলা।
চেষ্টা করলে, ধৈর্য রাখলে বোঝা যায় কিছু একটা। কিন্তু ঠিক কি বুঝলাম ভাষায় বোঝানো যায় না অবশ্য। মনের পুকুরটাতে কিছুর কোনো নাম নেই।
নিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, “তুমি আর কিছু বলবে না তাহলে? এটাই শেষ?”
খেয়াল রেখেছি যাতে আমার চোখ দিয়ে জল না পড়ে।
“না। আমার আর কিছু বলার নেই।”
আদালতের অমোঘ সিদ্ধান্ত - যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
নিশা চোখ ফিরিয়ে নিল। পাশ থেকে বইটা কোলে তুলে নিল। তারপর বললো, “আমাকে ক্ষমা করো। আমরা বন্ধু থাকতে পারি।”
“বন্ধু?”
ভাবলাম কি বলবো। নিশাকে আর কোনো দিনও হাত দিয়ে ছুঁতে পারবো না। অথচ ও বসে আছে আমার থেকে তিন হাত দূরে!
বললাম, “জানি না পরে কোনো দিনও পারবো কিনা। কিন্তু এক্ষুনি সেটা পারবো না।”
কাঁধে-ঝোলানো ব্যাগটা মেঝে থেকে তুলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।
“চলি।”
শেষবারের মত একবার নিশাকে দেখলাম। তারপর পর্দা সরিয়ে যেতে যেতে, ওর দিকে না তাকিয়ে, বললাম, “ভালো থেকো।”
চটপট জুতো পরে নিশার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। ভাগ্য ভালো ওর মা বা অন্য কারো সাথে দেখা হল না।
রাস্তায় বেরিয়েই বুঝলাম চোখ থেকে জল বেরোনোর চেষ্টা করছে। ঝাপসা দেখছি। হাতের পেছন দিয়ে মুছে নিলাম। বুঝতে পারলাম আজ বাসে যাবো না। আজ আমায় হাঁটতে হবে। অনেকক্ষণ হাঁটতে হবে। এই জনবহুল নির্বান্ধব শহরে একা একা।
মোটামুটি কিছু-একটা দিক ঠিক করে হাঁটতে থাকলাম। খানিক পরে একটা রাস্তার মোড়ে এসে সিগারেট কিনলাম। তারপর সিগারেট খেতে খেতে হাঁটতে থাকলাম।
আকাশটা নীচু মনে হচ্ছে। যেন জায়গা কম। নিশ্বাস নেবার মত পর্যাপ্ত হাওয়া নেই। অক্সিজেন ফুরিয়ে যেতে পারে। গাছপালায় কোনো নড়াচড়ার লক্ষণ নেই। রাস্তায় উদাসীন ট্রাম-বাস আর লক্ষ লক্ষ নির্বিকার মানুষ। এই সন্ধে কি শেষ হবে কখনো? নেই তার শান্তির সময়? কোনোদিন ঘুমাবে না?
বোধহয় ঘন্টা খানেক কিম্বা ঘন্টা তিনেক এই ভাবে হাঁটতে থাকলাম। অগুন্তিবার সিগারেট কিনলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার ঠিক গা ঘেঁষে একটা ট্রাম যাচ্ছে ঢিমে গতিতে। তড়াক করে লাফ মেরে উঠে পড়লাম।
ট্রামটা খালি। কম লোক। জানলার ধারে সীট পেয়ে গেলাম। বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম অফিস টাইম পেরিয়ে গেছে। ঘরে যারা যাবার, গেছে ঘরে। পারে যারা যাবার, গেছে পারে। ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে। পুরো শহরটাকে হঠাৎ অবাস্তব মনে হল। কিসের এত আয়োজন? আজকেই যখন নিশার বাড়ি যাচ্ছিলাম এইসব রাস্তা দিয়ে, তখন শহরটা বেঁচে ছিল। এখন শহরটা মৃত। ট্রামে যে কটা লোক বসে আছে, সবাই মৃত, সব কটা ভূত। আমিও আর বেঁচে নেই। ভূতুড়ে ট্রামে চেপে চলেছি, ভূতুড়ে শহরের রাস্তায়। ভাবনাটা মাথায় আসা মাত্র মনে মনে নিজেকে ব্যঙ্গ করে হাসলাম।
একটা খাটিয়ায় সাদা ফুলে ঢাকা মৃতদেহ নিয়ে একদল লোক “বলো হরি, হরি বোল্” বলতে বলতে যাচ্ছিল। আমি জানলা দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ট্রামটা তাদের ওভারটেক করে গিয়ে একটা স্টপে থামলো। এক বয়স্ক ভদ্রলোক উঠে আমার পাশে বসলেন।
শবদেহ নিয়ে যাওয়া দলটা থেমে-থাকা ট্রামটাকে ওভারটেক করে এগিয়ে গেল।
আবার ট্রাম ছাড়লো। শ্মশানযাত্রীর দলকে ট্রামটা আবার ওভারটেক করে চললো।
আমি বললাম, “নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে”। বুঝতে পারিনি যে মনে মনে না বলে, আমি কথাগুলো মুখে উচ্চারণ করেছি। পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন, “তাতা থৈথে, তাতা থৈথে, তাতা থৈথে।”
ভদ্রলোক রোগা। পরনে কোঁচকানো কিন্তু পরিষ্কার সাদা হাত-কাটা ফতুয়া আর পাজামা। বুক পকেটে পেন গোঁজা। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। মাথার চুল আধপাকা। ভুরুর চুল সম্পূর্ণ সাদা। বসা গাল। গোঁফ-দাড়ি কামানো। তীক্ষ্ণ নাক, যার থেকে দুয়েকটা চুল বেরিয়ে আছে।
ভদ্রলোক পাজামার পকেট থেকে দুটো লজেন্স বের করে, একটার মোড়ক খুলে মুখে পুরলেন। তারপর অন্য লজেন্সটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “চলবে?”
আমি নিলাম। লজেন্সটা মোড়ক থেকে খুলে মুখে পুরলাম। টক ঝাল মিষ্টি। লোকটা অদ্ভুত। জানলার দিকে তাকালাম আবার। কি মনে হল – পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পাথরটা মুঠোয় নিলাম। তারপর চোখ বন্ধ করে পাশে বসা লোকটার কথা ভাবতে শুরু করলাম।
এমনিতেই মনের পুকুরগুলো গোলমেলে হয়। এই লোকটার পুকুরে যেন একটা ঘূর্ণি চলছে। ব্যাপার কি? দুটো বিরোধী শক্তির সংঘাত। দুটো স্রোত দুদিকে চলেছে। কিছু একটা পাক খেতে খেতে অতলে নেমে যাচ্ছে। কিসের আবর্ত? মিশে যাচ্ছে, কিন্তু মিশছে না। পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু পড়ছে না। সে রকমই বোধ হল একটা।
আমি চোখ খুলে লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখি ওনার চোখে জল আর মুখে একটা শান্ত হাসি।
বললাম, “ঠিক আছেন তো?”
“ঠিক?”
ভদ্রলোক এক মিনিট ভাবলেন। তারপর বললেন, “হ্যাঁ, ঠিকই আছি।”
চোখ মোছার কোনো চেষ্টা করলেন না। একগাল হেসে বললেন, “তোমার বয়স কম। তাই হয়তো বুঝবে না। একটা বুড়োর স্বগতোক্তি মনে করে নাও। কেমন?”
আমি ঠিক বুঝলাম না। মুখে একটা হাসি লাগিয়ে রাখলাম।
উনি বললেন, “আমার সব চেয়ে বড়ো যে আশা, সেটাই আমার সব চেয়ে বড়ো ভয়। কেন জানো?”
মাথা নাড়লাম।
“আমার স্ত্রী গত তিরিশ বছর শয্যাযায়ী। নার্ভের অসুখ। কোনো আরোগ্য নেই। সারা শরীরে রাতদিন সারাক্ষণ যন্ত্রণা। আমিই দেখাশোনা করি। মাঝে মাঝে আমার উপর অকারণে চিৎকার করে। গালাগাল দেয়। তিরিশ বছর শোনার পরও, এখনো, জানো এখনো, মাঝে মাঝে আমার শুনতে খারাপ লাগে। ওই পাগলের প্রলাপ শুনে দুঃখ পাই।”
ভদ্রলোক হাসলেন। তারপর বললেন, “কিন্তু আমার কাছে যেটা সব চেয়ে কষ্টদায়ক সেটা হল - ও আমাকে দেখতে পায় না। আমার কথা শুনতে পায় না। তার মানে এই নয় যে ওর চোখ-কান খারাপ হয়ে গেছে। না, না, দুটোই দিব্যি কাজ করে। আমার দিকে তাকায়, কিন্তু আসলে দেখে না। আমি যদি সারা রাত পাশের ঘরে কাশতে থাকি, তাহলে জিজ্ঞাসাও করে না আমি কেমন আছি। ওর কাছে আমি অদৃশ্য। ও জানে আমি আছি। কিন্তু ওর কাছে গভীরতর অর্থে, মানুষ হিসেবে, আমার অস্তিত্বই নেই। আমার সুখ-দুঃখ সব অবান্তর। ওর ব্যথাটা পৃথিবীর আর সব কিছু ছাপিয়ে গেছে। সেটা ছাড়া আর কিছুরই বা কারুরই কোনো গুরুত্ব নেই।”
একটু থেমে, আবার বললেন, “আমার সব চেয়ে বড়ো আশা হল ওর মৃত্যু। আবার সেটাই হল আমার সবচেয়ে বড়ো ভয়।”
আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
একটু পরে ভদ্রলোক বললেন, “তুমি কবিতা পড়ো?”
“একটু আধটু।”
“তোমার বয়সে আমি পড়তাম তো বটেই, লিখতামও। এখনো পড়ি। তুমি ইয়োনেজিরো নোগুচির নাম শুনেছো?”
“হ্যাঁ, জাপানি।”
“জাপানি-অ্যামেরিকান। একটা কবিতা শুনবে? হয়তো তোমার পড়া।”
“হ্যাঁ, বলুন।”
শান্ত, ধীর কন্ঠস্বরে ভদ্রলোক আবৃত্তি করলেন—
I followed the twilight to find where it went,বললাম, “হ্যাঁ, পড়েছি। সুন্দর কবিতা।”
It was lost in the days full light.
I followed the twilight to find where it went,
It was lost in the dark of night.
Last night I wept in a passion of joy,
Tonight the passion of sorrow came.
O light and darkness, sorrow and joy,
Tell me: Are ye the same?
উনি বললেন, “জানো তো? - ইংরিজিতে twilight শব্দটা ভোর-এর ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়, আবার সন্ধের ক্ষেত্রেও। আমার বাংলা তরজমা শুনবে?”
“নিশ্চয়ই।”
উনি বললেন—
ঊষার আলোর পিছনে ছুটেছি, দেখতে কোথায় যায়।আমি বললাম, “বাঃ।”
দেখলাম যে সে ধীরে ধীরে মেশে দিনের শুভ্রতায়।
গোধূলির আলো অনুসার করে খুঁজেছি কোথায় মেশে।
দেখলাম ধীরে অন্ধ তিমিরে নিজেকে হারায় শেষে।
কাল রাতে আমি সুখের আবেগে ভেসেছি নয়ন নীরে।
অশ্রুর মেঘ দুঃখ-আবেগ এলো আজ রাত্তিরে।
ও আলো-আঁধার, শোন্ রে আমার জিজ্ঞাসা আনকোরা-
দুঃখ ও সুখ যদিও দুমুখ, আসলে কি এক তোরা?
ভদ্রলোক ওনার প্রশান্ত হাসিটা হাসলেন। তারপর বললেন, “জাস্ট্ ইন্ টাইম্। আমার স্টপ এসে গেছে। আসি।”
উনি উঠে পড়লেন। ট্রামটা থামলো। আবার চললো। আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আবার নিশার কথা মনে পড়লো।
ট্রামে কতক্ষণ চড়লাম জানি না। ট্রাম থেকে কোথায় নেমে পড়লাম তাও জানি না। নিশার বাড়ি থেকে বেরোনোর পর, মোটামুটি একটা দিক ঠিক করে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। আমি হয়তো সেটা ভুলে গেছি, কিন্তু আমার পা দুটো ভোলেনি। এক সময়ে দেখলাম গঙ্গার ধারে পৌঁছে গেছি। একটা খালি বেঞ্চি পেয়ে গেলাম। বসলাম। হেঁটে হেঁটে শরীরটা ক্লান্ত হয়েছে। সারা গায়ে ঘাম।
কালো পাথরটা প্যান্টের পকেট থেকে বার করে হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরলাম। চোখ বন্ধ করে নিশার কথা ভাবতে শুরু করলাম। কিছু হল না।
মনটাকে আগে শান্ত করতে হবে। চোখ খুলে গঙ্গার জলের উপর ঝিলমিল আলোর দিকে তাকালাম। ভাঁটার টান এসেছে জলে। নিজের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দিলাম, বৌদ্ধ ধ্যানের মত।
একটু পর চোখ বন্ধ করে, পাথরটা মুঠোর মধ্যে ধরে, জোর করে নিশার কথা ভাবতে চেষ্টা করলাম। আমি জানতে চাই।
আস্তে আস্তে নিশার মনের ভেতর ঢুকে গেলাম। সেখানে তখন উত্তাল ঢেউ উঠেছে। টালমাটাল জল। লাল রঙের এলোপাথাড়ি হাওয়া। জলের গন্ধ। ঘাম। কুয়াশা-ঢাকা চোখ। জলের উপরে ভেসে আছে নোংরা তেল – মিশ খাচ্ছে না। শক্ত কিছু একটা পথের মাঝখানে পড়ে আছে, লোহার মত কঠিন, ঠান্ডা। আর তার পাশেই উষ্ণ ফুল, নরম, ছেঁড়া পাপড়ির মত ছড়ানো। একটা আদিম নিশ্বাস আটকে গেছে যেন। একটা ব্যর্থতার শূ্ন্যতা, একটা কলঙ্কের কাঁপুনি, নির্যাতিতের ক্রোধ, সব-হারানোর অতল হাহাকার। এক-ফুঁয়ে নিবে গেছে অবাস্তব মোমবাতি।এবার হু-হু করে বইছে ইচ্ছের হাওয়া। ইচ্ছে। ইচ্ছে। নতুন একটা বেপরোয়া ইচ্ছে। ইচ্ছে। ইচ্ছে। ইচ্ছে।
বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খেয়ে চোখ খুললাম। সবটা নয়, কিন্তু নিশার হতাশা, ব্যর্থতা আর ক্লান্তি কিছুটা বুঝতে পারলাম । কিন্তু এ-ও বুঝলাম যে তার সাথে কোথাও একটা আশা আছে, একটা চাঞ্চল্য, একটা খিদে, একটা প্রেম, একটা হাত-বাড়ানো। নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো না – নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় – কিন্তু মনে হল কোথাও একটা নিশার গল্পের মধ্যে পার্থ লুকিয়ে আছে। গল্পটা আমার না-জানাই থেকে যাবে। তাতে আমার আর জায়গা হবে না।
আমার চোখ ভরে জল এলো। আসুক। আমি আর বাধা দেবো না। ঝরুক জল নয়নে হে। হাত থেকে পাথরটা নিয়ে পকেটে রাখলাম। বসে থাকলাম নির্জন গঙ্গার ধারে, বেঞ্চিতে।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। খুব ভোরে। অথচ অনেক রাত অবধি ঘুম হয়নি। ত্রিদিব আমার সাথে শুয়েছিল এই ঘরে। এখনো মড়ার মত ঘুমোচ্ছে। পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে সুধা।
ঘরে একটা বড় আলমারি, একটা টেবিল, একটা চেয়ার, ডবল-বেড, খাটের দুপাশে ছোট ছোট টেবিল। এটা আমার ভাড়া বাড়ি। একদিকে লাগোয়া বাথরুম। অন্য দরজাটা ঘর থেকে বেরোনোর জন্য।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে দাঁত মাজলাম। মুখে যেন গন্ধ না হয়। সুধা কি উঠেছে?
ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি সুধার দরজা বন্ধ। আজ ও চলে যাবে। ত্রিদিব যাবে কাল। আমরা তিনজন সমবয়সী বাল্যবন্ধু। সেই ক্লাস সিক্স থেকে। ত্রিদিব আর সুধা আমার কাছে বেড়াতে এসেছে কয়েকদিনের জন্য।
সুধা ওঠেনি। আশা করেছিলাম – আশা করে আছি – যে আমরা দুজনে একটু সময় পাবো।
কেন? একটু সময় পেলে কি হবে?
জানি না।
আটান্ন বছর বয়স হতে চলেছে। এখনো নিজের মনের ঠিকানা জানি না। আসলে হয়েছে কি – এত বছর কেটে গেছে নিজের ইচ্ছে চেপে রেখে, নিজের সাধ উপেক্ষা করে, যে এখন আর জানিই না সেগুলো কি। ভেবেছিলাম হয়তো আমার আর কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছে অবশিষ্ট নেই। কিন্তু সে বিষয়ে আমি আর নিশ্চিত নই। মনের মধ্যে এত বছর পর অচেনা কিছু একটা নড়াচড়া করছে। সেটা আমি চিনিও না, জানিও না।
গত তিন দিন ধরে শরীরটা যেন উত্তপ্ত হয়ে আছে। জ্বর নয়, কোনো একটা অদৃশ্য আগুনের তাপ। সুধা আসার আগে থেকেই তলে তলে একটা উত্তেজনা ছিল। হয়তো পুরোনো বন্ধুদের সাথে কদিন কাটানোর প্রত্যাশায় উত্তেজনা। আমি সে নিয়ে খুব একটা সচেতন ছিলাম না। দেখেও দেখিনি। বুঝেও বুঝিনি।
তিনদিন আগে সুধা এলো একা, ত্রিদিব আসার একদিন আগে। এয়ারপোর্টে সুধাকে তুলতে যাবার সময়ে পকেটে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার মানসপাথর। সেই পাথর হাতের মুঠোয় ধরে চোখ বন্ধ করে কারুর কথা ভাবলে, তার মনের ভাব জানা যায়। চিন্তা জানা যায় না। বোঝা যায় শুধু ইমোশান। মানুষের মনের ভিতরকার বিচিত্র পুকুরে সাঁতার কাটা যায়, যার মাত্র কয়েকটা কোণের বা বিন্দুর নাম আছে মানুষের ভাষাতে।
এয়ারপোর্ট থেকে সুধা বেরোলো একটা হলুদ-কালো শাড়ি পরে। শাড়ির রঙটা উজ্জ্বল কিন্তু অত্যাধিক উজ্জ্বল নয়। শরীরটা ফরসার দিকে, একটু রোদে-পোড়া। রোগাও নয়, মোটা তো নয়ই। ছিমছাম চেহারা। ছোট করে কাটা কালো চুল মাথার পেছনে ক্লিপ বা রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। বড় ফ্রেমের চশমা। চোখে কাজলের ইঙ্গিত। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। মুখের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সুশ্রী নাকটা। যেন কোনো কবির কল্পনায় এক পৌরাণিক সুন্দরীর মত। সারা মুখে একটা লাবণ্য আর করুণা। হাসিটা সরল, সহজ, সৎ এবং সম্পূর্ণ ভারহীন। সেই হাসিতে অধিকাংশ সময়ে কোনো আত্মসচেতনতা থাকে না। চৈত্রসন্ধ্যার হাওয়ার মত সবার প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। সুধাকে না চিনলে বয়স অনুমান করতে পারতাম কিনা সন্দেহ আছে। আমার ওকে চির-নতুন লাগে।
সুধাকে এয়ারপোর্ট থেকে তুলে সোজা গিয়েছিলাম জঙ্গলের মধ্যে একটা জলপ্রপাতের কাছে। অনেকটা দূরে। গাড়ি করে প্রায় দুঘন্টা। তখন গাড়িতে যেতে যেতে অনেক কথা হল। অনেক প্রশ্ন আর উত্তর। অনেক বছর আগে স্কুলের পর দুজনে চলে গিয়েছিলাম দুদিকে। যোগাযোগ ছিল অবশ্য। আরো কিছু স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে একটা দল ছিল আমাদের। সেই দলের যোগাযোগ ছিল। বছরে একবার কি দুবছরে একবার দেখা হত। মাঝে আবার কখনো কয়েক বছর দেখা হয়নি। একে অন্যের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের অনেক কিছুই জানতাম না। সেই সব কথা হয়েছিল গাড়িতে যেতে যেতে। ইতিহাস। পুরোনো বন্ধুদের গল্প। আর একটিবার প্রাণের মাঝে সুখের দুখের কথা।
সেই জলপ্রপাত যাবার লম্বা যাত্রা থেকেই আমি একটা আনন্দে ডুবে আছি। যেন একটা অন্য জগৎ। যেন কিছু একটা হতে চলেছে। যেন আমি চাই কিছু একটা হোক।
জলপ্রপাত দেখে সুধা খুব খুশি। আমি বললাম, “চল্। এবার বীচে যাই।”
“আমার মালপত্র?”
“গাড়িতে থাক না! রাত্রে যখন বাড়ি পৌঁছব, তখন নামাবো।”
বিকেল থেকে রাত অবধি আমরা সমুদ্রের ধারে কাটিয়েছিলাম সেদিন। বেশিরভাগ সময়টাই ছিলাম একদম জলের ধারে, যেখানে পায়ের কাছে অবিরাম ঢেউগুলো এসে ভাঙছে। দুটো প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ছিলাম আমরা। সামনে প্লাস্টিকের টেবিল। সেখানে পানীয়। আলুভাজা। মশলা-মাখিয়ে আগুনে পোড়ানো টাটকা মাছ। সেখানেই সন্ধেবেলা দিগন্তে ঢললো সূর্য। টেবিলে এলো মোমবাতি, হাওয়া-থেকে-বাঁচানো কাঁচের চোঙার মধ্যে। আমরা বসে রইলাম একটা আনন্দের ঘোরে, প্রবহমান সময়ের বাইরে – এইখানে, এই মুহূর্তে, এই বাস্তবে, অন্য কোথাও নয়। কখনো কখনো পুরোনো দিনের কথা - যা দুজনেই জানি। কখনো সেই সব কথা যা একজন জানি, অন্যজন জানি না। কখনো বা কোনো কথাই নয়। মুহূর্তের সূচাগ্রে, অনন্ত কালের কোলে।
তখনো অবধি আমি শুধু আমার মনের কাঁপুনি বুঝতে পেরেছিলাম। নিজের শরীর সম্বন্ধে ততটা ওয়াকিবহাল ছিলাম না।
রাত্রে যখন চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকলাম, তখন সাবধান হলাম। মনে পড়লো যে সুধা আসার আগেই আমার মাথায় এসেছিল একটা চিন্তা। ও আমার অতিথি হয়ে আসছে। মধ্যবিত্ত পুরুষের বাড়িতে মধ্যবিত্ত নারী অতিথি। আমি যেন এমন কিছু না করি যাতে ওর অসম্মান হয়। আমার ব্যবহারে ও যেন নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে, কখনো যেন বিপদের ভয় না পায়।
সেই রাত্রে মালপত্র জায়গায় রেখে, জামাকাপড় বদলে, একটু কথাবার্তা বলেই আমরা যে যার ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। আমি পকেট থেকে পাথরটা বার করে খাটের পাশের টেবিলের নিচে ড্রয়ারে রেখে দিলাম। তারপর শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়লাম অচিরেই – লম্বা শান্তির ঘুম।
পরদিন, মানে পরশু, আমরা সকাল-দুপুর কাটিয়েছিলাম অন্য একটা বীচে। আগের সন্ধ্যাকে যদি বলি জয়জয়ন্তীর প্রার্থনা, সেদিন সকালটা ছিল ভৈরবীর অনুরোধ। আরো একটু বসো তুমি, আরো একটু বলো।
আমি খানিকক্ষণের জন্য সমুদ্রে নামলাম। সুধা নামতে চাইলো না।
বিকেলে দুজনে গেলাম এয়ারপোর্টে, ত্রিদিবকে তুলতে। তারপর তিনজনে মিলে আরেকটা বীচে। অনেক গল্প, অনেক ঠাট্টা-ইয়ার্কি। খুব ভালো কাটলো। ত্রিদিবের উপস্থিতিতে আমার খানিকটা নিরাপদ লাগছিল। সুধাকে অনুপযুক্ত কিছু বলে ফেলবো না বা ভুলভাল কিছু করে ফেলবো না।
রাত্রে বাড়ি ফিরে আরো আড্ডা। অনেক রাত অবধি।
অগত্যা গতকাল আমরা সবাই দেরি করে উঠলাম। তিনজনে সকালটা কাটালাম ঢিলেমি করে। তারপর একটা রেস্তোরাঁয় স্পেশাল ব্রেকফাস্ট খেতে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া-দাওয়া চললো। দারুণ খাবার। একাধিক কাপ কফি। সিগারেট।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে একটা পুরোনো ধ্বংসাবশেষ দেখতে গেলাম। ভাঙা দুর্গ, ছোট পাহাড়ের উপর, সমুদ্রের ধারেই। সেখান থেকে অনেক দূর অবধি সমুদ্র দেখা যায়। রোদ ঝলমলে আকাশের নীচে দিগন্ত পর্যন্ত ঝকঝক করছে নীল জল। একটা পাথরের উপর বসে আমরা নিজেদের ছবি তুললাম। সুধা সেখানেই বসে রইল খানিকক্ষণ। ত্রিদিব আর আমি অন্য একটা জায়গায় পা ঝুলিয়ে বসে সিগারেট খেলাম। একটা জায়গা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম আমার পাথরটার মত দেখতে হাজার হাজার পাথর। এখানে যদি আমার পাথরটা নিয়ে এসে মিলিয়ে দিই, সেটা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ধ্বংসাবশেষ থেকে আমরা গেলাম সমুদ্রের বীচে। আমার জলে নামতে ইচ্ছে করছিল। ত্রিদিব নারাজ। সুধাকে জোর করে আমার সঙ্গে নিয়ে গেলাম জলে। দুজনে স্নান করতে করতে ইচ্ছে করলো ওকে জড়িয়ে ধরি। ইচ্ছেটা অবশ্যই অবৈধ। তাই তক্ষুনি মন থেকে দূর করে দিলাম।
রাতে সমুদ্রের ধারেই একটা রেস্তোরাঁয় অনেকক্ষণ ধরে বসে তিনজনে খেলাম। আরো আড্ডা। এক সময় রেস্তোরাঁর আলো থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের ধারে বালির উপর সুধা হাঁটতে গেল। নির্জন অন্ধকারে একা হাঁটছে ভেবে আমার চিন্তা হল। আমি ওদিকে গিয়ে দেখি সেখানে সুধা নেই।
তখন সমুদ্রের থেকে উল্টোদিকে গিয়ে দেখি একটা লম্বা গলিতে সুধা হাঁটছে। কিছু হয়েছে? আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি পৌঁছে বুঝলাম কিছু হয়নি। মনের খুশিতে হাঁটছে।
বললাম, “ঠিক আছিস তো?”
“হ্যাঁ। তুই কেন এসেছিস?”
বললাম, “দেখতে তুই ঠিক আছিস কিনা।” মনে মনে জানি কথাটা অর্ধসত্য। ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরতে। আমি চটপট ত্রিদিবের কাছে ফিরে গেলাম।
কাল রাতে আমরা দেরি করিনি। সময়মত শুয়ে পড়েছি। ত্রিদিব অবিলম্বে নাক ডাকতে শুরু করেছে। সুধা ঘুমোচ্ছে অন্য ঘরে। আমি ছটফট করেছি সারা রাত। সুধা কি আমাকে বন্ধু ছাড়া আর কোনো ভাবে ভাবতে পারে? একবারও ভেবেছে কি? নাকি আমি নিজেদের বয়স ভুলে নিজেকে ঠকাচ্ছি?
তারপর এই ভোর। সুধা আজ চলে যাবে।
আমি এক কাপ চা বানিয়ে বাইরের ঘরে বসলাম। দুটো শোবার ঘরেরই দরজা বন্ধ। একটাতে ত্রিদিব ঘুমোচ্ছে। একটাতে সুধা।
সূর্য এখনো ওঠেনি। আকাশটা ফিকে হতে শুরু করেছে। চা খাচ্ছি আমার প্রিয় নির্জনতাকে সঙ্গী করে। আমার যে রকম অভ্যাস। দেখি উশ্রী নদীতে একটা পাথরের উপর ক্লাস সিক্সের ফ্রক-পরা সুধা দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে বললো, “তুই আমার মনের মন্দিরে ঢুকতে চাস পারমিশান ছাড়া?”
ছোট্ট মেয়েটার কন্ঠস্বরে রাগ বা অভিমান। আমার বয়স আটান্ন। ধরা পড়ে গিয়েছি। আমতা আমতা করলাম, “না, মানে, আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করিনি, বল্!”
“ও সব চলবে না আর!”
“তুই প্লিজ. রাগ করিস না।”
“পাথরটা দে।”
আমার ভয় করছে। জানি না ছোট্ট সুধা কি করবে। আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। হাতে আমার মানসপাথর।
সুধা পাথরটা নিল।
বললো, “পাথরের মধ্যে আটকে আছিস তুই। পাজি।”
“দে না একবার, একটু ঘুরে আসি তোর মনের মধ্যে। তুই তো আমার বন্ধু।”
“না। বলছি না? – আর না!”
সুধার গলায় রাগ বেড়ে যাচ্ছে। পাথর-ধরা হাতটা ওপরে তুললো – যেন ছুঁড়ে মারবে। বলতে চাইলাম, “কি করবি তুই? ছুঁড়িস্ না প্লিজ।” কিন্ত আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলো না।
সুধা সবেগে পাথরটা ছুঁড়লো। আমি রুদ্ধনিশ্বাসে দেখছি। পাথরটা কোথাও একটা গিয়ে লাগলো। ঠক্ করে শব্দ হল একটা। পাথরটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। আমি তো পাথরটার মধ্যেই ছিলাম। কোটি কোটি বছরের পুরোনো স্বচ্ছ অ্যাম্বারের মধ্যে যেমন প্রাগৈতিহাসিক পোকা আটকে থাকে। আমি সেরকমই ছিলাম পাথরের মধ্যে। পাথরটা ভেঙে গেল। ছোট ছোট টুকরোগুলো আমার চারপাশ থেকে খসে গেল। এইবার আমি নিশ্বাস নেব। এইবার আমি ভাঁজ-করা ডানা সোজা করে নিয়ে উড়ে যাবো।
দরজা খোলার শব্দ হল। শোবার ঘর থেকে সুধা বেরোলো।
বললো, “তুই উঠে পড়েছিস?”
একটু চমকে গিয়ে আমি বললাম, “অনেকক্ষণ।”
সুধার হাতে খালি জলের গ্লাস। রান্নাঘরে গেল।
আমি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “চা খাবি?”
সুধার উত্তর ভেসে এলো, “না।”
একটু পর জল-ভর্তি গ্লাস নিয়ে সুধা আবার নিজের ঘরে চলে গেল। আমার দিকে তাকালো একবার। কিছু বললো না।
আমি বসে থাকলাম। সুধা আজ চলে যাবে। তারপর কাল ত্রিদিব চলে যাবে। জীবন বয়ে যাবে আগের মতন।
সুধা আজ চলে যাবে।
একটু পর তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম সুধার ঘরের দরজা খোলা।
খোলা কেন? ও কি ইচ্ছে করে বন্ধ করেনি? নিশ্চই ইচ্ছে করে খুলে রেখেছে।
আমি সোফা থেকে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের কাপটা রেখে দিলাম। তারপর ত্রিদিব যে ঘরে ঘুমোচ্ছে সেখানে ঢুকে দেখি হতভাগা মনের আনন্দে নাক ডাকছে। পাশের টেবিলের নিচে ড্রয়ারটা খুললাম। যা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই। পাথরটা ভেঙে গেছে। অনেকগুলো টুকরো। তার সাথে খানিকটা কালো বালির গুঁড়ো। বসার ঘরে ফিরে এসে ধপ্ করে সোফায় বসে পড়লাম।
সুধা ঘরের দরজাটা বন্ধ করেনি কেন? ও ঠিক আছে তো?
উঠে পড়লাম। ওর দরজার কাছে উঁকি মেরে দেখলাম ও বিছানায় শুয়ে আছে। ওর মুখটা দরজার দিকে নয়, অন্যদিকে। পাশ ফিরে আছে, প্রায় উপুড় হয়ে।
আমি সোফায় ফিরে এলাম। খুব বিভ্রান্ত লাগছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। কি করা উচিত? নিকুচি করেছে উচিত, কি করবো আমি?
আবার উঠে দরজার কাছে গেলাম। এবার ঘরে ঢুকলাম দু-এক পা। সুধা কি চাইছে আমি ঘরে ঢুকি? এটা আবার কি ধরনের প্রশ্ন! আমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে?
ভাবলাম কিছু একটা বলি। কি বলবো? কি বলা উচিত? ধুত্তোর!
পাশের ঘরে ত্রিদিব ঘুমোচ্ছে শান্তিতে। আর আমি এখানে স্বর্গ বা নরক কোনো একটা পথে পা বাড়িয়ে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে রয়েছি।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না।
ডাকলাম, “সুধা।”
“উঁ?”
সুধা নড়লো না। আমি ওর পাশে বিছানার ওপর বসলাম।
“ঘুমোচ্ছিস?”
“না।”
আমি যন্ত্রের মত ওর পাশে শুয়ে পড়লাম।
আবার বললাম, “সুধা।”
“হুঁ।”
আমি সুধার দিকে পাশ ফিরলাম। নিজের শরীরটাকে ওর শরীরের দিকে ঠেলে দিলাম। যা হবার হোক।
নিজের সর্বস্ব পণ করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার শরীরটা বেজায় বেখাপ্পা। বাঁ হাতটা নিয়ে কি করতে হয় জানি না। ওটা আটকে রইল আমার শরীরের নিচে। ডান হাতটা ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে ওর ডান কনুইটা ধরলাম।
সুধা ওর বাঁ হাত দিয়ে আমার ডানহাতটা টানলো। কনুই থেকে টেনে নিয়ে, চেপে ধরলো ওর বুকের মধ্যে। আমার মুখটা থাকলো ওর গলার পেছন দিকে। আমার নাকে ওর চুল লেগে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। দিক্।
কয়েক সেকেন্ড পর সুধা আমার দিকে ফিরলো। আমার ঘাড়ে ওর মুখ গুঁজে দিলো। দুহাত দিয়ে জোরে জাপটে ধরলো আমাকে।
আর আমি? আমার শুধু একটি মুঠি ভরি, দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী। হল না সারা, কত-না যুগ ধরি।