প্রশান্ত শুনতে পেল কেউ বলছে, “পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।”
জটলার দিকে এগিয়ে প্রশান্ত জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার, দাদা?”
এক মাঝবয়সী মহিলা উত্তর দিলেন, “ওই ভদ্রলোক ওখানে দুপুর থেকে বসে আছেন। মনে হয় রাস্তা ভুলে গেছেন।”
একজন দাড়িওয়ালা লম্বা ভদ্রলোক বললেন, “আমাকে বললেন যে ওনার বাড়ি কোথায় মনে নেই।”
আরেকজন বললো, “নিজের নাম মনে আছে তো?”
মহিলা উত্তর দিলেন, “জানি না। আমরা জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি।”
বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা চলছে। কিছু প্রশ্ন। কিছু উত্তর। উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই। আর বেঞ্চিতে বসা বুড়ো ভদ্রলোক, যাঁকে নিয়ে সবার এত চিন্তা, তিনি বসে আছেন নিশ্চিন্ত নির্ঝঞ্জাট নির্বিকার।
প্রশান্ত বললো, “আমি ওনাকে চিনি। উনি কোথায় থাকেন আমি জানি।”
ভদ্রলোক সস্ত্রীক থাকেন প্রশান্তর সামনের বাড়িতে। ওনার স্ত্রী সারাক্ষণ ওনার উপর চেঁচামেচি করেন। সন্ধে বেলা বিশেষ জোরগলায়। মহিলার বেশিরভাগ কথাই দোষারোপ। সারা জীবন ধরে জমানো অভিযোগ। অনেক পুরোনো রাগ। নানান শাস্তির বিধান। প্রশান্ত ওর ঘরের জানলা দিয়ে সব শুনতে পায়। মাঝে মাঝে এত বিরক্ত লাগে যে প্রশান্ত গান চালিয়ে দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই প্রশান্ত কানে নেয় না। শুনে শুনে সয়ে গেছে। বুড়োটার জন্য কষ্ট হয়। কল্পনা করার চেষ্টা করে ভদ্রলোক কম বয়সে কেমন ছিলেন। জীবনটা কি চিরকাল এ রকমই ছিল? নিপীড়ক আর নিপীড়িতের মধ্যে এইরকম একটা ভারসাম্য বজায় রাখা অবস্থা? নাকি আগে নিপীড়নের দিকটা উলটো ছিল? তারপর কোনো এক অদৃষ্টলগ্নে অদল-বদল হয়ে গেছে।
“চিন্তা করবেন না। আমি ওনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো। আমার বাড়ির পাশেই থাকেন।” প্রশান্ত সবাইকে আশ্বস্ত করলো।
বয়স্ক ভদ্রলোকের পাশে বেঞ্চিতে বসে প্রশান্ত বললো, “কেমন আছেন?”
ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, “সন্ধ্যাটা ভারি সুন্দর।”
জটলাটা আস্তে আস্তে ভেঙে গেল। সবাই একে একে চলে গেল। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি। দীঘির চার ধারে আলোগুলো জ্বলে উঠলো। ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মত। সেগুলো থেকে জলে আলো পড়ে চকমক করছে। হাঁসগুলো সব বাড়ি চলে গেছে, একটাও আর নেই।
ভদ্রলোকের মুখরা স্ত্রীর কথা মনে পড়লো প্রশান্তর। সেই উঁচু সরু পীড়াদায়ক কন্ঠস্বর। সেই অনন্ত অভিযোগের রাগ-রাগিণী। ভদ্রলোকের গলা কদাচিৎ শুনেছে প্রশান্ত। শুধু মাঝে মাঝে যখন স্ত্রী নিশ্বাস নিতে থামেন, তখন প্রশান্ত শুনেছে ভদ্রলোকের অনুনয়। কৈফিয়ত দেওয়া আর ক্ষমা চাওয়া।
প্রশান্ত পকেট থেকে মোবাইল বার করে কটা বাজে দেখলো। তারপর বললো, “আপনার কাছে মোবাইল আছে?”
ভদ্রলোক প্যান্টের পকেট চাপড়ে বললেন, “হুঁ।”
“আমাকে চেনেন?”
ভদ্রলোক প্রশান্তর দিকে ফিরে হাসলেন।
“বিলক্ষণ। প্রশান্ত মহাসাগর। হলুদ জবার গাছ। গত বছর সরস্বতী পুজোর দিন তোমার ফোন নাম্বার দিয়েছিলে, আমি সেভ করে রেখেছি। মোবাইলটা অফ্ করে রেখেছি। এত উটকো কল্ আসে আজকাল!”
আরো আধঘন্টা বেঞ্চিতে বসে প্রশান্ত উঠে পড়লো। বুড়ো লোকটাকে “গুড নাইট” জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলো একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ জবা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে চাবি বার করলো। দরজা খুলে বাড়িতে ঢোকার সময় দেখতে পেলো, বুড়ো ভদ্রলোকের বাড়িতে ওনার স্ত্রী বসার ঘরে বসে একজন পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলছেন। তখন চোখে পড়লো জবা গাছের পেছন দিকে একটা ফুল এসেছে।