১
ভিয়েনার সারোভস্কির আউটলেটের কাচের জানলায় সাজিয়ে রাখা গয়নাগাঁটির ক্রিস্টাল-বাহার দেখে চোখ ঝলসে গিয়েছিল পরমার। রুদ্রর নজর এড়ায়নি। ইচ্ছা হয়েছিল বৌকে ছোটখাটো একটা কিছু গিফট করে, একজোড়া কানের দুল বা একটা পেন্ডেন্ট। ভিয়েনায় এসেছিল, তার একটা স্মৃতি থাকবে।
ছেলে ফ্রান্সে মাস্টার্স করছে। থিসিস লিখতে ব্যস্ত, বলেছিল, ‘এক্ষুণি দেশে আসতে পারছি না, তোমরা বরং এসে একবার ঘুরে যাও।’ রথ দেখার সঙ্গে কলা বেচাও দস্তুর। ছেলের সঙ্গে দেখা করা হবে, ইউরোপের আরও দু’-একটা শহরও ঘুরে নেওয়া যাবে, রুদ্র অফিস থেকে তিন সপ্তাহের ছুটি ম্যানেজ করে পরমাকে বগলদাবা করে ফ্লাইট ধরেছিল। ছেলে ইউনিভার্সিটির ডর্মে থাকে, বাবা-মার জন্য প্যারিসের শহরতলিতে এয়ার বিএনবি বুক করে দিয়েছিল। বলেছিল, নিজেদের মত থাকো, খাও, ঘোরো, আমার জন্য বসে থেকো না। আইফেল টাওয়ারে চড়ে প্যারিস দর্শন, সেইন নদীতে নৌকা-বিহার, ল্যুভর মিউজিয়ামে লাইন দিয়ে মোনালিসার রহস্যময় হাসির অর্থোদ্ধার করে সপ্তাহ দেড়েক কাটল। ছেলে এসেছিল মাঝেমধ্যে, কিন্তু সে সত্যিই মহা ব্যস্ত, থিসিস জমা করার ডেডলাইন এগিয়ে আসছে। রুদ্র বলল, “চলো, ভিয়েনা ঘুরে আসি। বছর কুড়ি আগে অফিসের কাজে এসেছিলাম একবার। যাওয়ার পথে মিউনিখ, সালসবুর্গ ছুঁয়ে যাব। সালসবুর্গের মিরাবেল প্যালেস গার্ডেনে সাউন্ড অভ মিউজিকের শ্যুটিং হয়েছিল, দেখে যাব…”
ছেলে ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছিল। ভিয়েনায় পৌঁছে একটা মাঝারি মাপের হোটেলে লাগেজ রেখে শহর দেখতে বেরিয়েছিল দু’-জন। ড্যানুব নদীর পাড় ধরে হেঁটে সিটি সেন্টারে পৌঁছে সারোভস্কির আউটলেটের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল পরমা। রুদ্র দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, পরমা বলল, “গিয়ে কী হবে? তোমার তো আর কিনে দেওয়ার মুরোদ হবে না। বাবা থাকলে ঠিক...”
হাফ সেঞ্চুরি পার করে ফেলল, পরমা আজও খোঁটা দিতে ছাড়ে না। সুযোগ পেলেই মনে করিয়ে দেয় রুদ্রর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খরচ যুগিয়েছিলেন পরমার বাবা নিরুপমবাবু। রুদ্র জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ভাল র্যাঙ্ক করেছিল। কিন্তু কোলকাতা শহরে হোস্টেলে রেখে পড়াশুনা করানোর সামর্থ্য ছিল না রুদ্রর বাবার। বর্ধমানে নিরুপমবাবুর বেকারিতে ম্যানেজার ছিলেন তিনি। জানতে পেরে নিরুপম বাবু টোপ ফেলেছিলেন। রুদ্র যতদিন পড়াশুনো করবে ততদিন তার সব খরচ চালাবেন নিরুপমবাবু। পরিবর্তে তাঁর রুগ্ন কালোকুলো ছোট মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে। রুদ্রর অত বাছবিচার ছিল না। গরিব ঘরের ছেলে, পড়াশুনো করে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই তখন জীবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল। রাজি হয়ে গিয়েছিল। কালক্রমে সেই পরমা আজ দশাসই গিন্নি।
ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে মাস্টার্স করার জন্য বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল রুদ্র। নিরুপমবাবু সেই পড়ার খরচও স্পন্সর করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তবে শর্ত দিয়েছিলেন বিয়ে করে তবেই বিদেশ পাড়ি দিতে পারবে। খোঁটায় গরু বেঁধে দিয়েছিলেন। যত খুশি চরো, কিন্তু দূরে যেতে গেলেই গলায় টান পড়বে। মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে একটা তেল কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিল রুদ্র। বাবা-মার বয়স হচ্ছিল। বাড়ির যত কাছাকাছি থাকে যায়। তা সেই কোম্পানি রুদ্রকে ঠেলে গুজরাটের একটা গণ্ডগ্রামে পাঠিয়ে দিল। কী আর করে? সেখানেই কোম্পানি কোয়ার্টারে পরমাকে নিয়ে সংসার পাতল। রুদ্র পরমাকে বলল, “এসোই না, কিনি না কিনি, দেখতে দোষ কী?”
“সারা জীবন দেখেই গেলাম, গায়ে তোলার আর সৌভাগ্য হল না,” পরমা ঠোঁট বেঁকাল। কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। কোনওদিন সোনা কিনে দেয়নি এমন নয়। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারে টানাটানি লেগেই থাকে। শেষ বয়সে রুদ্রর বাবা-মা ওদের সঙ্গেই থাকতেন। দু’-জনেরই শরীর ভেঙে গিয়েছিল। ডাক্তার-বদ্যি লেগেই থাকত। পরমা একা পেরে উঠত না বলে এজেন্সি থেকে আয়া রাখা হয়েছিল। তার ওপর ছেলের পড়ার খরচ। আজকাল কোচিং সেন্টারগুলো হাঁ করে বসে থাকে। এনআইটি থেকে পাস করে রাহুল ফ্রান্সে মাস্টার্স করার সুযোগ পেল। তার টিউশন ফীও কম নয়। তার ওপর থাকা-খাওয়ার খরচ, ইন্সিওরেন্স… এখন অবশ্য সে ইন্টার্নশিপ পেয়েছে, অল্পস্বল্প উপার্জন করে। ডিসপ্লেতে রাখা একটা ছিমছাম হালকা হারের দিকে আঙুল তুলে রুদ্র বলল, “পছন্দ হয়?”
পাশে লাগানো প্রাইস ট্যাগে ইউরো-মূল্য দেখে পরমা চোখ কপালে তুলল, “পাগল হয়েছ? এত দাম দিয়ে কেউ কাচের মালা কেনে নাকি?”
রুদ্র হেসে বলল, “ভাবছ কেন? ক্রেডিট কার্ডে কিনব। একটা এরিয়ার পাওয়ার কথা আছে। ম্যানেজ হয়ে যাবে।”
পরমা মুখে কিছু না বললেও খুশি হয়েছে, দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসার পর বলল, “কী গো, বুড়ো বয়সে হঠাৎ প্রেম জেগে উঠল কেন?”
“প্রেমের কি আর ছুঁড়ো-বুড়ো হয় গো মামণি?” রুদ্র চোখ টিপল। যেন প্রেম না জাগলে গিফট কিনে দেওয়া যায় না। পরমা রুদ্রর হাতে টান দিয়ে বলল, “চলো, চলো, আর পিরিত দেখাতে হবে না।”
হঠাৎ জেগে ওঠার বস্তু যে প্রেম নয় সে কথা পরমাকে এতদিনেও বোঝাতে পারল না রুদ্র। রোমান্স ব্যাপারটা পরমা বরাবরই নিচু চোখে দেখে। রুদ্র তাকে দোষ দেয় না। বড় ঘরের মেয়ে। ব্যবসায়ী পরিবার। ছোট থেকে দেখে এসেছে ঐশ্বর্যের দম্ভই অনুভূতি প্রকাশের একমাত্র মাপকাঠি। নীরস গলায় বলল, “ভাবলাম, যখনই তুমি গলায় পরবে আমাদের ভিয়েনা আসার কথা মনে পড়ে যাবে, তাই...”
পরমা চিরকালই একটু অবুঝ প্রকৃতির। এখনও মনে আছে গুজরাটের সেই কোয়ার্টারে ঢুকেই নাক সিটকে বলেছিল, “ইশ, এখানে মানুষ থাকে?”
প্রথম দাম্পত্য, রুদ্র ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলে পরমা ঠেলে সরিয়ে দিত। বলত, “আগে একটা ভদ্র-সভ্য জায়গায় পোস্টিং নাও, তারপর সোহাগ করতে এসো।”
নতুন বৌ। তার ওপর ঘাড়ে কৃতজ্ঞতার বোঝা। রুদ্র জোর করতে পারত না। কিন্তু কত আর সহ্য হয়! রুদ্র একদিন বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “আমার উপায় নেই, চাকরিতে ঢোকার সময় বণ্ড সই করেছি। ছাড়লে মোটা টাকা খেসারৎ দিতে হবে। তুমি বরং বর্ধমানে ফিরে যাও। কোনও শহর-টহরে পোস্টিং হলে তোমায় নিয়ে আসব।”
পরমা ঠান্ডা চোখে তাকিয়েছিল। সাপের মত হিসহিস করে বলেছিল, “আমি চলে গেলে তোমার খুব সুবিধে হয় না? পরের দিন থেকেই কুলি-বস্তির ঘাঘরা-চোলি পরা আদিবাসী মেয়েগুলোর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করবে।”
রুদ্র থেমে গিয়েছিল। ছোট্ট একটা কলোনি, কয়েকটা মাত্র বাংলো। সত্যিই তো, কোনও মহিলা তো দূরের কথা, কাছেপিঠে বাংলায় কথা বলার মত একটা মানুষও নেই। অফিসার্স কলোনিতে সামনের বাংলোয় থাকতেন দুবেজি, রুদ্রর বস। কিন্তু তাঁর পরিবার থাকত দিল্লিতে। মিসেস দুবে দিল্লিতে থেকে সংসার সামলাতেন, ছেলেমেয়ে পালতেন, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল করতেন। হোলি-দিওয়ালি-কড়ুয়া-চৌথে কোয়ার্টারে আসতেন না এমন নয়। কিন্তু দু’-একদিন থেকেই দিল্লি ফিরে যেতেন। দুবে সাহেবেরও দিল্লিতে অফিস ট্যুর লেগে থাকত। রুদ্র জুনিয়র অফিসার, ঘোরাঘুরির সুযোগ ছিল না। কোম্পানির জিপে কোয়ার্টার থেকে পাম্পিং স্টেশন আর পাম্পিং স্টেশন থেকে কোয়ার্টার। সন্ধেবেলা ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই পরমার ঘ্যানোর-ঘ্যানোর শুরু হয়ে যেত। রুদ্র কানে তুলো গুঁজে বসে থাকত।
কোলকাতার দিকে বদলির জন্য অ্যাপ্লাই করেছিল। কারণ দেখিয়েছিল, বাবা-মা অসুস্থ। কাছে থাকা দরকার। কিন্তু চাইলেই তো আর বদলি হয় না। সময় লাগে। অফিসে গিয়েও মনমরা হয়ে বসে থাকত। জিপের ড্রাইভার মুকেশ একদিন জিজ্ঞেসই করে বসল, “আরে মল্লিক-সাহাব, আপ ইতনা খোয়া খোয়া কিঁউ রহতে হো?”
মুকেশ ঠিকাদারের লোক নয়, কোম্পানির স্থায়ী কর্মচারী। বিহারের ছেলে, জিলা মুঙ্গের। সেও পেটের দায়ে এত দূরে এসে কাজ নিয়েছে। রুদ্র কী জবাব দেবে? ম্লান হেসে বলেছিল, “আরে ভাই, ইধারকা ওয়েদার বিলকুল স্যুট নেহি হোতা। তবিয়ত হামেশা ঢিলা রহেতা হ্যায়।”
কী বুঝেছিল কে জানে, মুকেশ আর কথা বাড়ায়নি।
২
ক’মাস যেতে না যেতেই রুদ্রর তবিয়ত সত্যি সত্যি খারাপ হল। ক্যান্টিনের তেল-মসলা পেটে সহ্য হচ্ছিল না। অগত্যা মধ্যাহ্নভোজনটা বাড়িতে এসেই করবে ঠিক করল। পরমা সারাদিন একা থাকে। ভেবেছিল তারও কিছুটা সময় কাটবে। পরমা যে খুব খুশি হয়েছিল তেমন বোধহয় নয়। রুদ্র না থাকলে দুপুরটা সে চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিত। রুদ্র এলে তার জন্য রান্না করাটা বাধ্যতামূলক। তার ওপর তার দ্বিপ্রাহরিক সুখনিদ্রাটুকু বিঘ্নিত হল। সে ব্যাজার মুখে স্বামীসেবা করতে শুরু করল বটে কিন্তু তার গজগজানি আরও বেড়ে গেল।
এইভাবে কতদিন চলত কে জানে? মাঝখানে দুবেজি ঢুকে পড়লেন। বলা ভাল রুদ্র খাল কেটে কুমীর আনল। পরমা বলেছিল, “তোমার বস একা থাকেন। নিজে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খান। ছুটিছাটা দেখে এক দিন রাত্রে খাওয়ার জন্য ডাকতে পারো তো!”
রুদ্র বলেছিল, “দুবেজি তো শুদ্ধ শাকাহারী। আমরা মাছ-মাংস খাই। আমাদের ঘরে কি খেতে রাজি হবেন?”
একবার বলতেই রুদ্রকে অবাক করে দুবেজি সাগ্রহে নৈশভোজনের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। পরমা বাসন্তী পোলাও, পিঁয়াজ-রসুন ছাড়া নিরামিষ আলুর দম আর মটর পনীর বানিয়েছিল। দুবেজি তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন। আঙুল চাটতে চাটতে বলেছিলেন, “মিসেস মল্লিক, আপ ইস গাঁওমে কিঁউ পড়ে হো? আপকো তো কোই ফাইভ স্টার হোটেলকা কিচেনমে শেফ হোনা চাহিয়ে থা।”
পরমা লজ্জা পেয়েছিল। নেহাত তখন ভাল হিন্দি বলতে পারত না বলে উত্তর করেনি। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়েছিল। কেবল দুবেজি যখন চলে যাচ্ছিলেন, হাসি হাসি মুখ করে বলেছিল, “ফির আইয়েগা।”
দুবেজি হয়তো না বললেও আসতেন। কে না জানে, কৃষ্ণকলি হোক বা গৌরী, যৌবনবতী নারীর হাতের রান্না সর্বদাই সুস্বাদু হয়। লবণ কিঞ্চিৎ কম হলেও মনে হয় বারবার চেয়ে খাই। তার ওপর দুবেজি আংশিক নারী-বর্জিত জীবন কাটাতেন। লোভনীয় খাদ্যদ্রব্য দেখে তাঁর পক্ষে দুর্বল হয়ে পড়া সঙ্গত। ফলত রুদ্রদের কোয়ার্টারে তাঁর যাতায়াত বেড়ে গেল। পরিস্থিতির বিচারে দুবেজির এই আচরণ অস্বাভাবিক ছিল না। আশ্চর্যের কথা হল রান্নাবান্নার চাপ বাড়লেও পরমা বিশেষ আপত্তি করল না। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে রুদ্র দেখেছিল, দুবেজি যখনই পরমার রান্নার তারিফ করেন পরিবর্তে পরমা গুনগুন করে রুদ্রর বদলির আবেদন জানিয়ে রাখে। শুনে দুবেজি এমন ভাবে ঘাড় দোলান যেন পরের দিনই রুদ্রর বদলির আর্জি মঞ্জুর হয়ে যাবে। যেন দুবেজি সর্বেসর্বা বিধাতা। তিনি চাইলেই কলমের এক খোঁচায় রুদ্রকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিতে পারেন।
রুদ্রর কোয়ার্টারে দুবেজির ঘন ঘন আসা যাওয়ার ব্যাপারটা কলোনিতে চাউর হতে বেশি সময় লাগল না। কুলিবস্তি থেকে যে মেয়ে-বৌগুলো অফিসার্স কোয়ার্টারে সাফ-সাফাই ঘরের কাজ করতে আসে প্রথমে তারা জানল। তাদের থেকে তাদের মাতাল-চাতাল পেটপাতলা পতিদেবরা। কাজকর্মের ফাঁকে ফিসফাস, কানাঘুষো, ঠিকাদার-খেদানো জুনিয়র স্টাফেদের জানতে বাকি রইল না। খবরটা এতই মুখরোচক যে তারা চটজলদি তাদের অফিসারদের কানে তুলে দিল। ছোট পাম্পিং স্টেশন। ততোধিক ছোট সেখানকার মানুষের মন। আড়ালে আবডালে হাসিঠাট্টা শুরু হয়ে গেল। মুকেশ একদিন অযাচিত উপদেশ দিয়েই ফেলল, “ছোটি মুখ বড়ি বাত, শোভা নেহি দেতা। ফিরভি বোলতা হুঁ, সাহাবজি ঘরমে থোড়া ধিয়ান দিজিয়ে।”
কাছাকাছি একটা টাউনশিপ ছিল। হাইওয়ে ধরে যেতে আসতে ঘণ্টা দুয়েক লাগত। ছোটখাটো কিছু কেনাকাটা করতে হলেও সেখানে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ইদানীং দুবেজি কোনও না কোনও বাহানায় সকালের দিকটায় রুদ্রকে টাউনে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন। হাবিজাবি পারচেজ, ভেন্ডরের সঙ্গে মিটিং… ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যেত। মুকেশ খবর দিল, রুদ্রর অনুপস্থিতে দুবেজি নাকি রুদ্রর কোয়ার্টারে নিয়মিত মধ্যাহ্নভোজন সারতে যান। অনেকেই দেখেছে।
রুদ্রর সন্দেহ হচ্ছিল দুবেজি বোধহয় নিরামিষ ছেড়ে আমিষ ধরেছেন। অফিসে কথা বলার সময় তাঁর নিঃশ্বাস থেকে প্রবল আঁশটে গন্ধ পাচ্ছিল। পরমা কি তাঁকে মাছ-মাংস খাওয়াতে শুরু করেছে নাকি? এই বয়সে দুম করে আমিষ ধরলে দুবেজি সামলাতে পারবেন তো? গলায় কাঁটা-টাঁটা বিঁধে একটা হুজ্জুত না হয়! পরমা কি তাঁকে মাছের কাঁটা বেছে খাইয়ে দেয়? বিকেলবেলা টাউন থেকে ফেরার সময় নানা রকম উদ্ঘট ভাবনা মাথায় আসছিল। সেগুলোকে মাথা থেকে জোর করে তাড়ানোর জন্য রুদ্র মুকেশকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুম শাদি-বিহা নেহি কিয়া?”
মুকেশ গাড়ি চালাতে চালাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “লম্বি কহানি হ্যায় সাহাব। কভি ফুরসৎমে শুনায়েঙ্গে।”
রুদ্র বলেছিল, “চায়ে পিনে কা মন কর রহে। কহিঁ রুখ যাও। তুমহারি কহানি ভি শুন লেঙ্গে।”
হাইওয়ের ধারে একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ধাবা দেখে মুকেশ গাড়ি থামিয়েছিল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুনিয়েছিল তার নিজের বিয়ের ‘দর্দ ভরি কহানি’। বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটা জঘন্য প্রথার চলন আছে, যার নাম - ‘পাকাড়োয়া বিহা’। যে সমস্ত মেয়ের বাপেরা মেয়ের বিয়ের জন্য দহেজ বা পণ জোগাড় করে উঠতে পারে না, তারা বিয়ের যোগ্য ছেলেদের উঠিয়ে আনার জন্য গুণ্ডা লাগায়। ছেলেকে তুলে এনে মেয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। রীতিমত মন্ত্র পড়ে, অগ্নি সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়। অবশ্য পাত্রপাত্রীর সম্মতির কেউ ধার ধারে না। মুকেশ সেই পাকাড়োয়া বিহার শিকার হয়েছিল।
রুদ্র আবছা শুনেছিল এই ধরনের বিয়ের কথা। ব্যাপারটা যদিও অবৈধ, আইনানুগ নয়, তবু চলে আসছে। শুধু বিহার নয়, দেশের অনেক জায়গাতেই পণপ্রথা একটা অভিশাপ। বিশেষ করে শিক্ষিত, সচ্ছল, চাকুরে পাত্র পেতে হলে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে যে পরিমাণ অর্থ লগ্নী করতে হয় তাতে অনেক পরিবারই দেউলিয়া হয়ে যায়। পাত্র সরকারী চাকুরে হলে তো কথাই নেই। মেয়ের বিয়ে দিতে বাড়িঘর জমিজায়গা বিক্রি হয়ে যায়। লোকে পথে বসে। রুদ্র জিজ্ঞেস করেছিল, পাত্রীপক্ষ মুকেশকেই বেছেছিল কেন? কী করত মুকেশ তখন?
মুকেশ হাত উলটে বলেছিল, “উনলোগোনে গলতি কিয়া থা। উঠানা থা হামারে কাজিনকো, উঠায়া হামে।”
মুকেশের চাচাতো ভাই রাজেশ বিহার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাস করে টাউন স্কুলে শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিল। মুকেশের তখনও আঠারো হয়নি। ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স বার করে ভাড়ার গাড়ি চালায়। কি একটা পরব ছিল, দুই ভাই একসঙ্গে বাসে করে গ্রামে ফিরছিল। মাঝরাস্তায় বিপত্তি। বাস থামিয়ে মুকেশকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যায়।
“মুসটান্ডেলোক রাজেশকে বদলে হামেই আগোয়া করকে লেকে গয়া থা,” মুকেশ বলল। প্রথমে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বিলকুল রাজি হয়নি। পাত্রীর ভাই দাদারা পিঠে দু’-চার ঘা দেওয়ার পর বাধ্য হয়ে ঘোমটা টানা একটা মেয়ের পাশে গিয়ে বসে পড়ে। পুরোহিত মশাই সনাতনী নিয়মকানুন মেনে দু’-জনের বিয়ে দিয়েছিলেন। না দিয়ে উপায়! তাঁকেও হয়তো ‘আগোয়া’ করে আনা হয়েছে। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কনের বাড়ির লোকজন বর-কনেকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল টেনে দেয়। ঘি আর আগুন পাশাপাশি রেখে দিলে কতক্ষণ আর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে থাকবে? যৌবন বয়স, একবার শরীরের স্বাদ পেয়ে গেলে ছেলে আর পালাবার পথ খুঁজবে না। তখন সে সুড়সুড় করে পাত্রীকে নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে যাবে। ফেরার পথের গাড়িভাড়াটা না-হয় শ্বশুরজী পাত্রের পকেটে গুঁজে দেবেন।
মুকেশের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা সে রকম হয়নি। সে কথা পরে। বন্ধ ঘরে মুকেশ নতুন বৌয়ের ‘ঘুঙ্ঘট’ তুলে দেখেছিল কান্নাভেজা একটা কচি মুখ। বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার মতামতেরও কেউ তোয়াক্কা করেনি। সেই মুখ সুন্দর ছিল কি অসুন্দর, সে কথা মুকেশের আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, নতুন বৌ সুরতিয়ার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। প্রাকৃতিক কাজকর্ম ঘরের লাগোয়া গরাদ দেওয়া বারান্দার এক কোণে, মেকশিফট বাথরুমে। মাঝে-মধ্যে দরজার শিকল খুলে অন্দরমহলের কোনও মহিলা ওদের খাবার দিয়ে যেত। তাদেরই একজনের মুখ থেকে সুরতিয়া জানতে পেরেছিল বাড়ির লোকে খবর পেয়ে গেছে যে তার সঙ্গে ভুল লোকের বিয়ে হয়েছে। ‘লওণ্ডাটা’ স্কুল-টিচার নয়, পাতি ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার। সুরতিয়ার বড়েভাই রাগে গসগস করতে করতে বলেছে, হারামিটাকে নিকেশ করে বোনের আবার বিয়ে দেবে। নেহাত সুরতিয়ার পিতাজি হাভেলিতে নেই, মোকদ্দমার কাজে মুঙ্গের গেছেন, না-হলে এতদিনে মুকেশের ‘রাম নাম সত্য’ হয়ে যেত।
সেদিন রাতেই মুকেশ পালিয়েছিল। সুরতিয়া কাকে যেন বলে রেখেছিল। দরজার শিকলটা খোলা ছিল। বেরোবার আগে মুকেশ সুরতিয়াকে বলেছিল সে ফিরে আসবে। সুরতিয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কথা রাখতে পারেনি মুকেশ। ফিরে যেতে পারেনি। মুকেশের মা নিজের মাথায় হাত রাখিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল মুকেশ আর কোনোদিন ও-মুখো হবে না। তবে… রুদ্র দেখেছিল মুকেশের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। রুদ্র চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলেছিল, চলো উঠি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
৩
রাহুল বলল, “ইউ নো, ম্যারেজ অ্যাক্ট ইন ফ্রান্স ইজ হাইলি বায়াসড এগেইন্সট মেন। শুধু ফ্রান্স বলে নয় গোটা পশ্চিমি দুনিয়াতেই তাই। ওই জন্য এখানকার ছেলেরা সহজে বিয়ে করতে চায় না।”
ভিয়েনা থেকে ফিরে আসার পর পরমা ছেলের পিছনে পড়েছিল, “আর কতদিন ধর্মের ষাঁড়ের মত ঘুরে বেড়াবি? এবার একটা বিয়ে-থা কর। দূর বিদেশে একা একা থাকিস, চিন্তা হয়।”
পরমার কথার উত্তরে রাহুল ম্যারেজ অ্যাকটের পক্ষপাতিত্বর প্রসঙ্গ তুলেছিল। কথা ঘোরানোর জন্য রুদ্র বলেছিল, “একটা পার্মানেন্ট চাকরি-বাকরি হোক আগে। তারপর না-হয়…”
পরমা ঘাড় নেড়ে বলছিল, “আরে না না, ফিরে গিয়েই আমি আমি মেয়ে দেখতে শুরু করব। ছেলে ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশে পা দেবে সে খেয়াল আছে? আমাদের যখন বিয়ে হয় তোমার বয়স ছিল তেইশ।”
তেইশ বছর বয়সে বিয়ে। পঁচিশে সেই গুজরাতি গণ্ডগ্রামে গিয়ে খেলনাপাতির সংসার। এখনও মনের মধ্যে খচখচ করে। পরমা যে কেন দুবেজিকে প্রশ্রয় দিত তা আজও রুদ্রর কাছে পরিষ্কার নয়। শুধুই কি রুদ্রর বদলির তদবির, না কি অন্য কিছু? দুবেজির কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রুদ্র মাস খানেকের ছুটি নিয়ে পরমাকে বর্ধমানে শ্বশুরালয়ে গ্যারেজ করে পড়িমরি করে দিল্লি দৌড়েছিল। হেডঅফিসে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে ট্রান্সফার অর্ডার বার করে এনেছিল। ছেলে বলল, “মা তোমাদের জেনরেশন অন্যরকম ছিল। আজকাল বিয়ের চেয়ে ডিভোর্স বেশি হয়, এত তাড়াহুড়ো কোরো না।”
কথাটা বহুলাংশে সত্যি। রুদ্রর জেনরেশনের মানুষ মনে করত বিয়ে মানে সাত জন্মের বন্ধন। পান থেকে চুন খসলেই ডিভোর্সের কথা ভাবত না। পরমা নাছোড়বান্দার মত বলল, “তোর কাউকে মনে ধরে থাকলে বল। না-হলে আমিই…”
রাহুল পরমার কথা কেটে বলল, “তোমরা দেখে দিলেই যে বিয়েটা টিকবে তার কোনও গ্যারান্টি আছে? আমাদের ব্যাচের কৃষ্ণেন্দুর জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছিল। আজকাল যেমন হয়, দুটো পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা হওয়ার পর ছেলেমেয়ে দেখা-সাক্ষাত করে। মেয়েটা ফ্রান্সেই থাকে, পিএইচডি করছে মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে। ক’দিন দু’-জন খুব ঘোরাঘুরি করল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ক্রিসমাস মার্কেট, রেস্তোরাঁ… এমনিতে সব ঠিক ছিল, বিয়ের কথা উঠতেই মেয়েটা বেঁকে বসল, বলল, এক বছর লিভ টুগেদার করার পর সিদ্ধান্ত নেবে বিয়ে করবে কি না।”
পরমা বিষম খেল, বলল, “কী মেয়ে রে বাবা! লজ্জাঘেন্না নেই? একটা ছেলের সঙ্গে এক বছর থাকার পর বলবে বিয়ে করবে কি না! কালে কালে কত কী দেখব!”
রাহুল বলল, “আজকাল মেয়েরাও কমিট করতে চায় না। বিয়ের আগেই পরীক্ষা করে দেখে নিতে চায় ছেলেটা কেমন, স্বভাব-চরিত্র, সেক্সুয়াল প্রেফারেন্স কম্প্যাটিবল কি না।”
পরমা চোখ পাকিয়ে বলল, “খুব পাকাপাকা কথা বলতে শিখেছিস আজকাল।”
রাহুল হাসল, বলল, “বাই দ্য ওয়ে ওদের সম্পর্কটা ভেঙে গেছে। বলা ভাল কৃষ্ণেন্দুই কাটিয়ে দিয়েছে।”
ফোনে টুং করে একটা মেসেজ ঢুকল। আর দু’-দিন পরেই রুদ্ররা ফিরে যাবে। অফিসে জানতে চেয়েছিল, দমদম বিমানবন্দরে গাড়ি পাঠাতে পারবে কি না। দুটো আখাম্বা স্যুটকেস টেনে রেডিও ক্যাবে বাড়ি ফেরাটা একটু চাপের হয়ে যাবে। আসলে ফিরছে রবিবার সকালে। ছুটির দিন বলে অফিসের কোনও ড্রাইভার আসতে চায় না। ট্রাভেল সেলের ছেলেটা জানিয়েছে, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একজন নতুন ড্রাইভার আসবে। সম্প্রতি ট্রান্সফার হয়ে এসেছে, নর্থ ইস্ট থেকে। মোবাইল নম্বর দিয়েছে। নেমে ফোন করলে গাড়ি নিয়ে চলে আসবে।
রুদ্ররা চলে যাবে বলে রাহুল কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে ডেকেছিল সন্ধেবেলা। উজ্জ্বল মুখের এক ঝাঁক যুবক-যুবতী। অধিকাংশই ভারতীয়, কয়েক জন বিদেশি, জাপানিজ, সাউথ কোরিয়ান, রুমানিয়ান, স্প্যানিশ। কলকল করে কথা বলছিল সবাই। হাতে ওয়াইনের গ্লাস, সামনের প্লেটে পিজার টুকরো। ছোটখাটো শ্যামলা এক বাঙালি মেয়ে পাকা গিন্নির মত এয়ার বিএনবির কিচেন সামলাচ্ছিল। পরমা শ্যেন দৃষ্টিতে মেয়েটার চালচলন জরীপ করছিল। রুদ্রর মনে হল মেয়েটার কিচেনের দখল নেওয়াটা পরমা ভাল চোখে দেখছে না। মেয়েটার অবশ্য ভ্রূক্ষেপ নেই। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ জমাল। মেয়েটার ভাল নাম সীমন্তিনী, সবাই তিন্নি বলে ডাকছে। বাড়ি কোলকাতার ভবানীপুরে। মেয়েটার স্বভাব ভারী মিষ্টি। বলল, “আঙ্কেল, তোমার গ্লাস তো খালি। ওয়াইন নেবে আর একটু?”
তিন্নি রুদ্রর গ্লাস ভরে দিল। রাহুল এসে পাশে দাঁড়াল, বলল, “বাবা, জানো তো, তিন্নি খুব ভাল ভারতনাট্যম নাচে। তিন্নি একটু নেচে দেখা না।”
তিন্নি ছদ্ম কোপ দেখিয়ে বলল, “ভ্যাট!”
স্প্যানিশ ছেলেটা গীটার বাজিয়ে একটা গান ধরল। সবাই গলা মেলাল। হৈ-হুল্লোড় করে কেটে গেল সন্ধেটা।
সবাই চলে যাওয়ার পর রাহুল কাচের প্লেটগুলো ধুয়ে সিঙ্কের পাশে নামিয়ে রাখছিল। রুদ্র বলল, “তিন্নি মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে রে?”
রাহুলও কি তিন্নির কথা ভাবছিল? অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “ওয়ান গুড থিং ’বাউট হার ইজ শি ইজ ভেরি সিম্পল অ্যান্ড স্ট্রেট ফরোয়ার্ড,” তারপর বোধহয় রুদ্রর ইঙ্গিতটা বুঝল, মুখ ফিরিয়ে হেসে বলল, “ডোন্ট ইম্যাজিন থিংগস। উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস, বাবা। ইট হ্যাজন্ট গন বিয়ন্ড দ্যাট।”
রুদ্রও হাসল, বলল, “মেয়েটা যখন ভাল, আর একটু এগিয়ে ভাবতে পারিস।”
পরমা অসন্তুষ্ট গলায় বলল, “থাক, তোমাকে আর আস্কারা দিতে হবে না।”
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্রাভেল সেল থেকে পাওয়া নম্বরটায় ফোন করেছিল রুদ্র। ড্রাইভারটা হিন্দিতে বলেছিল, পার্কিং-এ আছি, পাঁচ মিনিটে আসছি। গলাটা শুনে চেনা চেনা লাগছিল। গাড়িটা সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখল ড্রাইভারের সীটে মুকেশ। কী আশ্চর্য সমাপতন! ক’দিন আগেই ছেলেটার কথা ভাবছিল। ছেলে নেই অবশ্য, এখন সে রীতিমত লোক হয়ে গেছে। চেহারায় মেদ জমেছে, চুলে অল্পস্বল্প পাক ধরেছে। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে, মুকেশ সামনে এসে দাঁড়াল। হাত জোড় করে এক মুখ হেসে বলল, “নমস্তে ভাবিজি, নমস্তে সাহাবজি, ক্যায়সে হো আপলোগ?”
রুদ্র তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, “তুম ইঁহা ক্যায়সে? কিতনে দিনোকে বাদ...”
গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সীটে বসল রুদ্র। পরমা পিছনে। পদমর্যাদা ভুলে পুরনো বন্ধুর মত দু’-জনে স্মৃতি রোমন্থন করছিল। রুদ্ররা চলে যাওয়ার পর দুবেজি চাকরি ছেড়ে দিল্লিতে অন্য কোম্পানি জয়েন করেছিল। জায়গাটা এতই অজ পাড়া-গাঁয় ছিল কেউ থাকতে চাইত না। যেই আসত ক’দিন পরেই পালাই-পালাই করত। মুকেশও বেশিদিন থাকেনি। সাত ঘাটের জল খেয়ে মুকেশের শেষ পোস্টিং হয়েছিল গৌহাটিতে। সেখান থেকে তদবির করে এই কোলকাতা, নিজের গাঁওয়ের যত কাছে থাকা যায়। রুদ্রর জিজ্ঞেস করতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মুকেশ নিজে থেকেই বলল, “সুরতিয়াকো লেকর আয়া সাহাবজি। মা-কি দেহান্তকে বাদ…”
রুদ্র ওর পিঠ চাপড়ে বলল, “বহোত আচ্ছা কিয়া।”
মুকেশের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে এগারো ক্লাসে, মেয়ে আটমি। সুখের সংসার। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পালা-পার্বণে যায়-টায়। ফ্রান্সে ছেলেকে ছেড়ে এসে মনটা ভার হয়ে ছিল রুদ্রর। মুকেশের সঙ্গে দেখা হয়ে সেটা কেটে গেল। গাড়িটা ওদের আবাসনের সামনে এসে থামল। গাড়ি থেকে নেমে পরমা ভদ্রতা করে বলল, “মুকেশজি, একদিন সুরতিয়াকো লেকর হামারে ঘর আও।”
মুকেশ গাড়ির ডিকি থেকে মাল নামাচ্ছিল। মুখ ফিরিয়ে বলল, “জরুর ভাবিজি।”
মুকেশ চলে যাওয়ার পর আবাসনে ঢুকতে ঢুকতে পরমা গলায় রাজ্যের শ্লেষ নিয়ে বলল, “মুকেশকে দেখে এমন ভাব করছিলে, মনে হচ্ছিল ও তোমার ছোটবেলায় কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই। ঢং দেখে বাঁচি না। পারো বটে!”
রুদ্র ভাবল, সেভাবে দেখলে মুকেশ আর রুদ্রর মধ্যে কতটুকুই বা তফাৎ? বিবাহোত্তর জীবনের প্রথম দিকে যতই ঝামেলা হোক না কেন, পরে দু’-জনেই তো বেশ সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে। এটা কি এক ধরনের স্টকহোম সিন্ড্রোম! যারা একসময় জবরদস্তি বন্দী করেছিল তাদের সঙ্গেই হলায়-গলায় বন্ধুত্ব পাতানো! কে জানে! প্রথম পাতে নিম পাতা খেলে পরে ছাইপাঁশ যাই মুখে দেওয়া যায় মিষ্টি লাগে। এখন কেমন দু’-জনেই ‘লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার’!
নিজের অজান্তেই পরমা বোধহয় একটা নিদারুণ সত্যি কথা বলে ফেলেছে। পরমার কথার উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে হাসল রুদ্র। মুখে বলল, “চলো…”