• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • মেঘ, বিদ্যুৎ আর জলরাশি : অমিত মণ্ডল

    রামকিঙ্করের রাধারানি; — প্রকাশ দাশ; প্রচ্ছদ চিত্র - রামকিঙ্কর; প্রচ্ছদ রূপায়ণ— গণেশ হালুই; প্রথম প্রকাশ— কলকাতা বইমেলা ২০২৫; ISBN: 978-81-19723-91-1

    রামকিঙ্কর রাধারানির সম্পর্কের রসায়ন চেনা-ছকের বাইরে। এক লৌকিক-অলৌকিক বৃত্তের ভিতর দুটি মানুষের আশ্চর্য যাপন যা মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষজনের ধারণার বিপরীত মেরু। তিন শিল্পীর বয়ান থেকে তুলে আনি তাঁদের সম্পর্কের মেদুর গন্ধ। শঙ্খ চৌধুরী লিখছেন ‘মায়া পড়ে গিয়েছিল তাঁর রাধারানির ওপর। মায়া মানে প্রত্যাশা না করে ভালোবাসা।’ প্রভাস সেন জানাচ্ছেন ‘রামকিঙ্কর যে রাধারানিকে ভালোবাসতেন আমার মধ্যবিত্ত মন নিয়ে এটা বিশ্বাস করতে মাঝে মধ্যেই দ্বিধা হয়েছে কিন্তু সব সন্দেহের নিরসন হয়েছে যখন মৃত্যুশয্যায় অজ্ঞান অবস্থায় শুধু তাঁর (রাধারানি) নামই ওঁর মুখে শুনেছি।’ সোমনাথ হোর লিখলেন ‘হিতৈষীদের কেউ কেউ তাঁর সঙ্গিনী নির্বাচনে দুঃখিত ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে কিঙ্করদার ভালোবাসা অপার ছিল। সঙ্গিনীর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অপরের সমালোচনায় মৌনী থেকেছেন, কিন্তু প্রেম পরিহার করেননি।’

    এক অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী ও প্রায় নিরক্ষর এক মহিলা সারাজীবন একত্রে থেকে গেলেন তাঁদের মতো করে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রামকিঙ্করের জীবন ও সৃষ্টির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা রাধারানি রামকিঙ্করের অনেক শিল্পকর্মের উৎস। যোগ্য সহচরী না হয়েও পরম ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়, নির্ভরতায় নিজেকে নিঙড়ে দিয়ে সহজ স্বাভাবিক জীবনচর্চার মধ্যে এক শিল্পীর চলার পথে রসদ জুগিয়েছেন রাধারানি। রাধারানির জীবিতকালে তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না, তিনি পাননি কোনো সমাদর, বরং তাঁর প্রতি তৈরি হয়েছে এক ধরনের অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য। রামকিঙ্করের সঙ্গে রাধারানির সম্পর্ক সূত্রে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে ‘পরিচারিকা’ ‘ঝি’ বা ‘রাঁধুনি’ শব্দগুলি, কেউ কেউ আর একটু এগিয়ে বলেছেন ‘শয্যাসঙ্গিনী’। রাধারানি-রামকিঙ্কর ঘিরে যে আশ্চর্য জীবনকথা তার পরতে পরতে জমতে থাকে, প্রকাশ দাসের ভাষায় ‘মেঘ, বিদ্যুৎ আর জলরাশি।’


    কীভাবে যোগাযোগ হল রামকিঙ্কর-রাধারানির? সে বিষয়ে অনুপুঙ্খ ছবি পাঠকের সামনে এসেছে। নিম্নবিত্ত অন্ত্যজ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা রাধারানির কুড়ি বছর বয়েসে বিয়ে হয়। বিবাহ পরবর্তী জীবন সুখের হয়নি তাঁর বরং বিয়ের পর-পরই অকস্মাৎ নেমে আসে চরম বিপর্যয়। রাধারানি জানতে পারেন অন্য নারীর প্রতি তাঁর স্বামীর আসক্তি। রাগে-দুঃখে-ঘৃণায় স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসেন পিতৃগৃহে। বাবার কাছেও আশ্রয় জোটেনি। বাবা তাঁকে ফিরে যেতে বলেন স্বামীগৃহে। ক্ষোভে-দুঃখে রাধারানি চলে আসেন বোলপুরে। এ বাড়ি, সে বাড়ি কাজ করতে করতে অবশেষে থিতু হলেন শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দির ভেতরে ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়। শান্তিনিকেতনের নিচু বাংলার বাসিন্দা অন্নদাকুমার মজুমদার কবিগুরুর ছোটো মেয়ে মীরা দেবীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে। মীরা দেবীর পাশেই রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর বাড়ি। মীরা ও প্রতিমার প্রিয়জন হয়ে উঠলেন রাধারানি। ঠাকুরবাড়ির এই অন্দরমহলেই রামকিঙ্করের সঙ্গে রাধারানির পরিচয়।

    প্রকাশ দাস সম্পাদিত ‘রামকিঙ্করের রাধারানি’ গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায় সাতটি পর্বে বিন্যস্ত। রাধারানির পারিবারিক পরিচয় থেকে শান্তিনিকেতনে মীরা দেবীর বাড়িতে রামকিঙ্করের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ, রামকিঙ্কর-রাধারানির সম্পর্ক ঘিরে আশ্রমিকদের কৌতূহল, এবং শান্তিনিকেতনের চারপাশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা— সবকিছুই লেখক উল্লেখ করেছেন। জানতে পারা যায় রামকিঙ্করকে রাধারানি ‘বাবু’ বলেই সম্বোধন করতেন এবং রামকিঙ্করের ‘সেবাদাসী’ হিসেবেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন আমৃত্যু।

    গ্রন্থটিতে শুধু রাধারানি নয়, যে সব নারী বা মডেলরা রামকিঙ্করের ছবিতে ও ভাস্কর্যে কোনও না কোনও ভাবে একসময় স্থান করে নিয়েছিলেন তাঁদের কথারও উল্লেখ আছে। স্বাভাবিকভাবেই জয়া আপ্পাস্বামী, সোমা যোশী, বিনোদিনী, নীলিমা বড়ুয়া উঠে এসেছেন। পাতাকুড়ানি খাঁদুবালা ও আবরনিও জায়গা করে নিয়েছে আলোচ্য বইটিতে। রামকিঙ্করের কোনো এক ছাত্র জানিয়েছেন যে সুন্দর মুখ দেখলেই তাঁকে চিত্রে বা ভাস্কর্যে ধরে রাখতেন রামকিঙ্কর। ষাটের দশকে এভাবেই তিনি করেছিলেন শীলা বর্মা, চৈতালী দে, কিরণ থাপা, কুমকুম ভট্টাচার্য বা দনুজ দলুনীর আবক্ষ প্রতিকৃতি ভাস্কর্যগুলি। এগুলির মধ্যে গ্রামের বৌ দনুজ দলুনী ছাড়া বাকিরা প্রত্যেকেই কলাভবনে শিল্পকলার পাঠ নিতে এসেছিলেন কোনো না কোনো সময়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয় এইসব আবক্ষ প্রতিকৃতি ভাস্কর্যগুলি তেমনভাবে সংরক্ষণের কথা কেউ ভাবেননি।

    রাধারানি রামকিঙ্করের মডেল। রামকিঙ্করের অনেক ন্যুড স্টাডির আধার রাধারানি। গুণের দিক থেকে রামকিঙ্করের ন্যুড ড্রয়িংগুলো রদ্যাঁরই মতো। রদ্যাঁ কোনো মডেলকে বসিয়ে ন্যুড স্টাডি করতেন না। তাঁর নির্বাচিত কয়েকজন মেয়ে মডেল ছিল। তাঁরা নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াত। রদ্যাঁ তাঁদের দেখতেন এবং ড্রয়িং করতেন। রামকিঙ্করও সেইভাবে রাধারানির ড্রয়িং করেছেন। এগুলোতে ছিল গতি অর্থাৎ মুভমেন্ট। নারীসঙ্গ লোলুপতার ‘মিথ’ ভেঙে চুরমার করে নির্মিত হল স্বাধীন একজন শিল্পীর স্পর্ধা। এদেশের আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসের সূচনা পর্বের একটি মূল্যবান দলিল হল রামকিঙ্করের রাধারানি ভিত্তিক নগ্নিকার চিত্রগুলি।

    ‘যক্ষ-যক্ষী’ নিয়ে আলোচনা গ্রন্থটিকে ঋদ্ধ করেছে। জীবনের উপান্তে পৌঁছে রামকিঙ্করের জীবনের শেষ বড় ও একমাত্র পরিবেশীয় শিলাভাস্কর্য নির্মাণ পর্বে তিনি আকুল উন্মাদনায় খুঁজে বেড়িয়েছেন যক্ষীর পরিণত রূপ এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছোবার আগে দু বছরের বেশি সময়ে বিপুল উদ্যমে যক্ষ বা যক্ষীর অসংখ্য খসড়া চিত্র বা ম্যাকেট তৈরি করেছেন। রামকিঙ্করের প্রিয় ছাত্র প্রভাস সেন জানাচ্ছেন ‘এই খসড়া ভাস্কর্যগুলির মধ্যে অন্তত দশ জোড়া যক্ষ-যক্ষীর মূর্তিকে রামকিঙ্করের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের মধ্যে ধরা যায়।’ যক্ষীর মুখমণ্ডল, নিতম্ব বা নিম্নাংশের সঙ্গে রাধারানির দেহসৌষ্ঠবের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই ভাস্কর্য নির্মাণে সময় লেগেছিল দশ বছরের বেশি। এই দীর্ঘ সময়ে রামকিঙ্করের নিবিড় অনুধ্যান, শ্রম আর মেধার যক্ষীর রূপ নিয়ে উঠে এসেছিল যে নারী, তাঁর নাম রাধারানি।

    দ্বিতীয় অধ্যায় মূলত রাধারানির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। গ্রন্থটির অমূল্য সম্পদ। যে সাক্ষাৎকারটি মৃত্যুর আগে রাধারানির শেষ সাক্ষাৎকার। লেখক দুটি পর্যায়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, প্রথমটি ভেদিয়ায় নিত্যগোপাল রায়ের বাড়ির দাওয়ায় ১৭.৬.৮৬ তারিখে, দ্বিতীয়টি লেখকের বাড়িতে ২৯.৭.৮৬ তারিখে। এইসময় রাধারানির ঝোলায় থাকতো রামকিঙ্করের নির্মিত একটি ভাস্কর্য— মা ও ছেলে। ভাস্কর্যটির কপালে ও সিঁথিতে ছিল সিঁদুর। রাধারানি এই মূর্তিটিকে প্রতিদিনই পুজো করতেন। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে রামকিঙ্করের সঙ্গে তাঁর জীবনের নানাদিক—প্রথম পরিচয়, মাঝি-মেঝেনদের সঙ্গে রামকিঙ্করের সম্পর্ক, রামকিঙ্করের পছন্দ-অপছন্দ, মডেল হিসেবে রাধারানির নিজেকে মেলে ধরার অকপট কাহিনি, দৈনিক এক-একবারে চারটে / পাঁচটা / ছটা / সাতটা করে ছবি আঁকার কথা, আছে তাঁদের বিবাহ প্রসঙ্গ, হাসপাতালের শয্যায় মাটি দিয়ে ছোট্ট দুর্গামূর্তি তৈরির কাহিনি, হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার আকুতি, বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা, নতুন করে ছবি আঁকার আগ্রহ এবং শেষ জীবনে রামকিঙ্করের অসহনীয় শারীরিক কষ্টের কথা। জীবনের প্রান্তবেলায় পৌঁছে, স্মৃতি ভারাক্রান্ত রাধারানি রামকিঙ্করের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন, ‘তুমি আমাকে আর জন্মে পেও আর আমি তোমার পাশে পাশে আছি। আমি তোমাকেই কামনা করছি। সব সময়ই কামনা করি।’ রাধারানি বলেছেন, ‘যখন একা থাকি, যখন ঠাকুরকে জল দিই তখন বলি, ‘তুমি যেন আবার পেও আমাকে। আমার অনেক কথা বলার আছে, সেগুলো প্রকাশ করা হয় নাই, সেগুলো বলব আর জন্মে।’

    প্রকাশ দাস রাধারানির অন্তিম সময়ের করুণ অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন, ‘দেখি, বাহ্যজ্ঞানহীন, অচৈতন্য রাধারানি দান করে দেওয়া তাঁর নিজের দোতলা বাড়ির বারান্দায় ছেঁড়া চট-কাঁথা–কানি- পায়খানা-পেচ্ছাপের আবর্জনার মধ্যে শুয়ে আছেন নির্জন একাকী। ভগ্নস্তূপ নোংরা বিছানার ভেতরে মুখ লুকিয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছেন নীরব সাক্ষী দুটি-একটি কুকুরছানা।’ চরম অর্থকষ্ট আর বিনা চিকিৎসায় তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন রাধারানি, ১৯৮৭ সালের ১৮ নভেম্বরের এক ভরদুপুরে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। রামকিঙ্করের মৃত্যুর পর রাধারানি বেঁচে ছিলেন সাত-আট বছর। স্বার্থের প্রয়োজনে যারা একদিন জড়ো হয়েছিলেন তাঁর চারপাশে, ধীরে ধীরে তাঁদের সকলেরই দৃষ্টির অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন রাধারানি। রাধারানির মন গড়া মুখের কথা বসিয়ে রামকিঙ্করকে নিয়ে যারা গল্প ফেঁদেছিলেন, তাঁদের কাউকেই সেদিন আর দেখা যায়নি মৃত্যুপথযাত্রী রাধারানির আশেপাশে। রামকিঙ্কর প্রেমী বহুল প্রচারিত খবরের কাগজও একটি লাইন ছাপেনি রাধারানির প্রয়াণ সংবাদ। এভাবেই নীরবে নিভৃতে কলঙ্কের দায়ভার মাথায় নিয়ে এই গ্রহের মাটি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন রাধারানি।

    গ্রন্থের শেষাংশে দুটি উল্লেখযোগ্য লেখা সন্নিবেশিত হয়েছে— সোমনাথ হোরের ‘রামকিঙ্করের ড্রয়িং: ভুমিকাহীন একটি কথকতা’ ও শঙ্খ চৌধুরীর ‘কিঙ্করদার শক্ত তুলি, কিছু রং, কিছু রেখা, কিছু কথা’। লেখাদুটিতে রাধারানি প্রসঙ্গ নেই, কিন্তু যা আছে তা অতুলনীয়। রামকিঙ্করের ড্রয়িং বিষয়ে দুই শিল্পীর মননঋদ্ধ সংক্ষিপ্ত আলোচনা। পাঠকের জানার পরিসরকে প্রসারিত করবে নিঃসন্দেহে।

    শান্তিনিকেতনের দীর্ঘদিনের বন্ধদুয়ারে সৃষ্টিমাতাল রামকিঙ্করের সামনে রাধারানিই প্রথম রক্তমাংসের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রাঁধুনি, ঝি বা শয্যাসঙ্গিনী— যে-কোনো বিশেষণের লেবেলই তাঁর শরীরে সেঁটে দেওয়া হোক না কেন, আধুনিক ভারতীয় শিল্পের সূচনাপথের একটি মাইলস্টোন রাধারানি। রামকিঙ্কর বরাবরের নিয়মভাঙা দুঃসাহসী শিল্পী, প্রথা ভেঙে ন্যুডস্টাডির প্রথম সূচনা শান্তিনিকেতনের বজ্রকঠিন প্রস্তরভূমিতে, যা ছিল শুধু দুঃসাধ্য নয়, কল্পনার অতীত, রামকিঙ্করের সেই ন্যুডস্টাডির আধার ছিলেন রাধারানি।

    সবশেষে বলার, গ্রন্থের অন্তর্গত বেশকিছু ফটোগ্রাফ ও রামকিঙ্করের ড্রয়িং বইটির মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। প্রচ্ছদ এ গ্রন্থের অন্যতম ভূষণ।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments