[অনুবাদকের ভূমিকা: ‘লোহার জিনিসপত্র পুরোনো হলে মরচে ধরে ঝুরঝুরে হয়ে যায়। জিনিসটা তখন অচল, অকেজো হয়ে পড়ে। মানবিকতা, পরস্পরের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতির অভাবে সমাজও তেমনি ঝুরঝুরে হয়ে পড়ে। বিপদে-আপদে মানুষ মানুষের সহায় না হলে জীবন চলে কি?’ পাকিস্তান থেকে আমার সঙ্গে কথোপকথনে দুঃখ করছিলেন গল্পের লেখক মির্জা হামিদ বেগ। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের একটি উদ্দেশ্য ছিল এ গল্পের উর্দু শিরোনামের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা। আইনি এক্তিয়ার আর লাল ফিতের বাঁধন আর মানুষের দায়িত্ব এড়ানোর পরিণাম কী হতে পারে তার একটি হৃদয়বিদারক উদাহরণ এই গল্পটি। মৃত মানুষের জাত বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, কিন্তু তাকে কবরস্থ করার ব্যাপারে সকলেই উদাসীন।
গল্পকার এক কথায় অনুবাদ প্রকাশ করার অনুমতি দিলেন। তাঁর কাছে আন্তরিক ঋণ স্বীকার করছি।
মুঘল বাদশাহদের উত্তরাধিকারী মির্জা হামিদ বেগের জন্ম ১৯৪৯-এ, করাচিতে। উর্দু ভাষার খ্যাতনামা কথাকার, সমালোচক, গবেষক, অনুবাদক ও নাট্যকার। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি তিনি। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর চল্লিশটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮১-তে প্রকাশিত ‘গুমশুদা কালিমত’ প্রথম গল্পগ্রন্থ। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গল্পসংগ্রহের মধ্যে আছে ‘তার পর চলনেওয়ালি’, ‘জানকি বাই কি আরজ়ি’ ইত্যাদি। দোস্ত পাবলিকেশনস্, ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত এই শেষোক্ত গল্পগ্রন্থ থেকে অনূদিত গল্পটি গৃহীত। অজস্র অনুবাদ ও সাহিত্য সমালোচনামূলক গ্রন্থ লিখেছেন মির্জা হামিদ বেগ। পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতির খেতাব তমঘা-এ-ইমতিয়াজ়, পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড, ন্যাশনাল বুক কাউন্সিল অফ পাকিস্তান ইত্যাদি বহু সংস্থা প্রদত্ত পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ]
দূর সফরে অভ্যস্ত যাত্রী আর রেলকর্মীদের কাছে ঘটনাটা তেমন অস্বাভাবিক না ঠেকলেও কথা বলতে থাকা, হাসতে থাকা একটা লোক যদি হঠাৎ চুপ মেরে যায়, আর আপনি দেখেন সে মরে গেছে, তা হলে তো তাকে বিরল ঘটনা বলতেই হয়!
মোট-বোঝাই উপচে-পড়া ঠেলাগাড়ি টানতে থাকা কুলি, পান-বিড়ি-সিগারেট আর নান-পকোড়া বেচা ছোকরা, চা-দোকানের ছেলেপিলে, ডাকবাবু, টিকিট কালেক্টর আর সন্ধের কাগজ বেচা ছেলেটা -- সকলেই তাজ্জব হয়ে গেল।
অনেক লোকের ভিড়ে লোহার খালি বেঞ্চির ওপর আরাম করে বসে থাকা মাঝবয়সী লোকটার মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে ছিল -- মনে হচ্ছিল যেন কোনও জীবন্ত লোক গভীর চিন্তায় মগ্ন।
‘এ এসেছিল কোত্থেকে?’
‘আসেনি তো। বোধহয় যাচ্ছিল কোথাও।’
‘কোথায় যাচ্ছিল?’
‘খোদাই জানেন।’
‘পকেটটা দেখে নিতে!! কোনও টুকরো কাগজ-টাগজ যদি থাকে.....’
‘না....না.....সব দেখা হয়ে গেছে।’
‘ওর জিনিসপত্র তো সঙ্গেই থাকবে!’
‘ও সে কেউ নিয়ে পালিয়েছে বোধহয়। ’
‘ওর পাশেও তো নিশ্চয়ই কেউ বসেছিল। কেউ কিছু দেখেনি নাকি? এমনটা হলই বা কীভাবে?’ সাদা ভুরুওলা একজন বয়স্ক মানুষ জিজ্ঞেস করল। কেউ উত্তর দিল না, সবাই চুপ। সকলেই অন্যের দিকে সন্দেহের নজরে চাইছে।
‘দেখে তো স্থানীয় লোক বলেই মনে হচ্ছে!’
‘হ্যাঁ, তাই হবে।’
‘ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড-এ খবর দাও ভাই!’ কেউ একজন পরামর্শ দিয়ে চলে গেল।
‘উর্দিপরা দুজন এসেছিল তো! দেখেটেখে চলে গেল।’
‘চলে গেল? কেন?’
‘ওরা বলছিল এটা ওদের থানার এক্তিয়ারে পড়ে না। দূরের অন্য কোথাও থেকে একে আনা হয়েছে।’
‘না ভাই, এটা সম্ভব নয়!’
‘এখানে কোন্ জিনিসটা অসম্ভব সাহেব? হতে পারে আধঘণ্টা আগে যে এইট্টিন ডাউন খাইবার এক্সপ্রেস করাচির দিকে ছেড়ে গেল, তাতেই একে নিয়ে এসে এখানে বসিয়ে রেখে কেউ পালিয়ে গেছে।
‘আরে না ভাই! গত এক ঘণ্টা তো আমরাই একে এখানে বসে থাকতে দেখছি। আমাদেরও আগে পুলিশ এসে দেখে গেছে। হয়ত তারও আগের কোনও গাড়ি করে আনা হয়েছে।’
‘কিন্তু এটা তো কোনও কথা হল না। ওরা এল, আবার দেখেশুনে চলেও গেল। তদন্ত করা তো ওদেরই কাজ!’
‘তদন্ত করবে ...........বাহ্, বেশ বললেন যা হোক......কেস হল অন্য কোনও এলাকায় -- আর খামোখা এদের হবে হয়রানি! অন্যের এক্তিয়ারের এলাকার ব্যাপার এরা তদন্ত করতে যাবেই বা কেন?’
‘আপনি পুলিশের পক্ষে খুব কথা বলছেন দেখছি!’
‘ঠিক আছে ভাই, পুলিশকে সমর্থন না হয় নাই করলাম। ডাকঘরের পেছনেই ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের কামরা। সেখানে গিয়ে বলুন না! ওদের এখানে নিয়ে আসুন! দেখুন না আপনার কথায় তারা এখানে আসে কিনা......?’
‘আরে যদি না আসে তো না আসুক............সত্যি কথাটা তো বলতে হবে না......’
‘সত্যি কথা! ঠিকই বলছেন আপনি। আপনি সাক্ষী হবেন তো যে এই মরা লোকটাকে এই বেঞ্চিতে বসে থাকতে দেখেছিলেন?’
‘আমি সাক্ষী হতে যাব কেন? শুধুমুধু? সবাই তো দেখছেন ...... আমরা, এই এতগুলো লোক..... সকলেই তো ........’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। চলুন, আমার সঙ্গে কে কে যাবেন? ডেকে নিয়ে আসছি আবার ওদের। কিন্তু কথা যা দিচ্ছেন তার যেন নড়চড় না হয়।’
বিরক্ত যুবক ভিড় চিরে এগিয়ে চলল।
‘আসুন আমার সঙ্গে আসুন দেখি..... কী হল? কেউ এগোচ্ছেন না কেন?’
নওজোয়ান জমায়েতের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে গেল। এইবার জমতে থাকা লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে শুরু করল, হয়ত এই ভয়েই যে যদি উর্দিধারীরা এসে পড়ে? কেউ কুঁজোয় জল ভরার জন্য কলের দিকে গেল, কেউ বাচ্চার আঙুল পাকড়ে নিজের নিজের জিনিসপত্রের আশপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। কারও আবার নান-পকোড়া বেঁধে নেওয়ার ছিল, সেই ধান্দায় এগিয়ে গেল। এক কথায়, সকলেরই কোনও না কোনও কাজের কথা মনে পড়ে গেল।
অবশ্য সবাই দূরে দাঁড়িয়ে লোকটাকে আড়চোখে দেখে চলেছিল -- আর সে লোহার খালি বেঞ্চির ওপর মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে পরম শান্তিতে বসে ছিল। যেন একটা জীবন্ত মানুষ গভীর চিন্তায় মগ্ন। এই সময় একটা প্যাসেঞ্জার গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়িটা বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই রইল।
চায়েওয়ালা........চায়ে....
পান.....বিড়ি..... সিগ্রেট.....
এ চায়ে...ওয়ালে.....
ঠন্ডি বোতল.....
কুলি....আরে কুলি......এ কুলি.....
গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে রেল স্টেশন শশব্যস্ত হয়ে উঠল। প্লাটফর্মে ঘুরঘুর করতে থাকা এক মুসাফির সময় কাটানোর জন্যই গাড়ির লোকজনের সঙ্গে গল্প শুরু করল।
‘আরে ভাই, আপনার প্যাসেঞ্জার ট্রেন তো বেশ কয়েক ঘণ্টা লেট। মেল ট্রেনের আগে এটার আসার কথা ছিল না?’
‘ঠিকই বলেছেন, সাহেব! আগে থেকেই তো লেট চলছিল....আর তারপরে খাইবার মেলের জন্য আরও দেরি হয়ে গেল ......... বাইপাস ........... মেল আসবে বলে একদম দাঁড়িয়ে গেল! মেল বেরিয়ে যাবার পরেই তো আমাদের গাড়ি আবার এগোতে পারল ..........’ হতাশ এক প্যাসেঞ্জার জানলার ধারে বসে কথাগুলো বলছিল।
‘এসব দেখার কেউ নেই সাহেব।’
‘হাঁ জি, শুধু আল্লাহ্র কৃপাতেই চলছে!’
‘খোদারই অভিশাপ...... ওদিকে দেখছেন না ....... ওই সামনে বেঞ্চির ওপর ......ওই যে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে না ভালই আছে লোকটা?.....ওর কিন্তু প্রাণ নেই, মরে গেছে...’
‘হ্যাঁ!! কী করে?’
‘গাড়ি থেকে নেমে নিজেই দেখুন না…’
‘কিঁউ জি, এমন কী ঘটনা ঘটল যে লোকটা মরে গেল?’
দাঁড়ানো গাড়িটার প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে হুটোপাটি লেগে গেল। সকলেই জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে চায়। কেউ আবার দরজার দিকে যায় ছুটে।
লোকটার চারপাশে আরও একবার ভিড় জমে উঠল।
‘যাচ্ছিল কোথায়?’
‘যাচ্ছিল না, বরং বলুন অন্য কোত্থেকে এখানে আনা হয়েছে......এই অবস্থায়।’
‘এই অবস্থায়? মানে বলতে চাইছেন মরা লোককে কেউ এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে?’
‘জি হাঁ, তেমনই তো শুনলাম।‘
‘কেউ গিয়ে পুলিশকে খবর দাও ভাই...’
‘তারা এসেছিল, তদন্ত করে গেছে তো! কিন্তু তারপরে আর ফিরে আসেনি।’
‘ওদের পেছন পেছন আরও কেউ গিয়ে দেখুন ..... মাটি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো!’
‘একজন তো গিয়েছিল, এখনও ফিরে আসেনি।’
‘বেচারাকে ধরে রেখেছে হয়ত.....কোনও কারণ ছাড়াই....’
‘যে গেছে তার রেহাই পাওয়া মুশকিল হবে....’
‘এই ঘটনায় কেই বা সাক্ষী হতে চাইবে?’
গাড়ির হুইসেল বেজে গিয়েছিল। ইঞ্জিনকে সবুজ বাতি দেখিয়ে গার্ড নিজের ঘরে ফিরে গেল।
‘এখানে সাক্ষী হওয়ার এমন কি অসুবিধে আছে সাহেব? আমিই হতে পারি। মানবিকতারও তো একটা ব্যাপার আছে।’
‘কিন্তু আমাদের তো কোথাও যাবার আছে না! সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চাও আছে....’
গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল।
‘দেখুন আমাদের গাড়ি তো ছেড়েই দিল! কিছু একটা করুন, সাব!’
‘সকলে মিলে গিয়ে দেখলে কী হয়? হাজার হোক, একটা পুণ্যের কাজ....’
এইসব কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল গাড়ির জানলা আর দরজা দিয়ে। আরও কিছু লোক তখনও ভারি লোহার বেঞ্চিটার পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে।
গাড়ি চলে গেলে নীলচোখো, রোগাসোগা একটা লোক কথা শুরু করল।
‘ওর সঙ্গে জিনিসপত্র তো কিছু হবে? একটু দেখেশুনে তো বোঝার চেষ্টা করা উচিত ছিল যে লোকটা কে..... আর এসেছেই বা কোত্থেকে!’
‘জিনিসপত্র কেউ নিয়ে পালিয়েছে হয়ত।’
‘হায়, কি যুগই এল সাহেব! মরা মানুষের ওপরও কোনও দয়া নেই...’
‘পকেট থেকে কিছু পাওয়া গেছে?’
‘দুই উর্দিধারী তো এসেছিল। তদন্ত করে গেছে। হয়ত ঠিকানা-টিকানা পেয়েছে কিছু। কিন্তু ওরা বলছিল এই কেসটা ওদের এক্তিয়ারের নয়।’
‘এক্তিয়ার কী রকম?’
‘একেকটা থানার নিজের এলাকা হয় না? অন্যের ঝামেলা কেই বা ঘাড়ে নিতে চায়....’
‘অন্যের ঝামেলা? সে আবার কী? এ তো ওদেরই কাজ!’
‘তাই হবে হয়ত সাহেব.... আপনি আমার ওপর রেগে যাচ্ছেন কেন....’
‘আপনি অদ্ভুত কথা বলছেন! হবে আবার কী!! ওদেরই কাজ তো এটা.....’
‘আমাকে মাফ করে দিন সাহেব। আপনার কথার উত্তর দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে।’
‘আজি ছোড়িয়ে! আমি দেখছি, ওদের এখনই সঙ্গে করে নিয়ে আসছি....’
নীল চোখের কৃশ লোকটা হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে একদিকে চলে গেল।
‘তাড়াতাড়ি আসবেন,’ এক যুবক বলে উঠল।
‘আসছি, আর তোমাদেরও একটা হেস্তনেস্ত করব!’
‘আরে, আপনি থোড়াই ফিরে আসবেন! আপনার আগে অনেকেই এ কথা বলে কেটে পড়েছে...’ নওজোয়ান আপন মনেই বিড়বিড় করল।
জটলা আরও একবার পাতলা হতে শুরু করল। কে জানে লোকটা যদি সত্যিই ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের লোকজনকে নিয়ে ফিরে আসে!
এখন দু-একজন দূরে দাঁড়িয়ে চোরা নজরে মরা মানুষটাকে দেখছে। আর সেও লোহার খালি বেঞ্চিতে মাথা ঝুঁকিয়ে অতি শান্তিতে বসে আছে, যেন একটা জীবন্ত মানুষ।
রাতের দ্বিপ্রহর হবে যখন প্রথমে একটা ইঞ্জিন শান্টিং করতে চলে গেল। আর তারপরেই টোয়েন্টি ডাউন চেনাব এক্সপ্রেস ঢোকার ঘণ্টি বেজে উঠল। চেনাব দু'নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর কথা ছিল। তাই দেখতে দেখতে এই প্ল্যাটফর্মের হৈচৈ যেন সেখানে হাজির হয়ে গেল। দুই প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে গভীরে পড়ে রইল রেললাইন আর লোহার উঁচু রেলিং।
পান-বিড়ি-সিগারেটের ছোকরারা তাদের ট্রে আর ঝুড়ি নিয়ে ওভারব্রিজ পেরিয়ে ওপাশে ছুটে গেল। চা, নান, পকোড়া আর ঠান্ডার বোতলের আওয়াজও এখন ওদিক থেকেই আসছে। মাঝের লাইন দিয়ে চেনাব ঢোকার পর এদিকের প্ল্যাটফর্মটা প্রায় জনশূন্যই হয়ে গেল।
সিমেন্টের উঁচু ব্যালকনি থেকে আসা হলুদ অস্বচ্ছ আলোয় ভারি বেঞ্চির ওপর সে তখনও সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে তেমনি বসে আছে। হঠাৎই উর্দিধারী কয়েক জন ডাকঘরের পেছন থেকে এসে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজনের হাতে ছিল একটা সিন্ধি টুপি। সেটা লোকটার মাথায় পরিয়ে সকলে মিলে তাকে চ্যাংদোলা করে তুলল, যেন কোনও কানাখোঁড়া লোককে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তারা সবাই যেন খুব ব্যস্ততার মধ্যে ছিল। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ওভারব্রিজ পেরিয়ে লোকটাকে ওপারে নিয়ে গেল -- আর দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটা চলতে শুরু করার আগেই নিরিবিলি একটা কামড়ায় তাকে তুলে দিল। লোকটাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার এই দৃশ্য কয়েকজনের নজরে পড়ল কি পড়ল না তাও ভালো বোঝা গেল না।
পরদিন রাতের প্রথম প্রহর হবে। সেই প্ল্যাটফর্ম আর লোহার সেই ভারি বেঞ্চি.......দেখা গেল সেখানে আরাম করে মাথায় পাঠানি টুপি পরা এক মুসাফির মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে আবারও বসে রয়েছে – জীবন্ত একটা মানুষ গভীর চিন্তায় মগ্ন যেন।
পান-বিড়ি-সিগারেটের ঝুড়ি উঠিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা ছেলে লোকটাকে দেখে চিনে ফেলল।
‘আরে এ তো সেই লোকটা!’ বলে সে দুর্গন্ধ এড়াতে হাত দিয়ে নাক ঢাকল। মাল বোঝাই ঠ্যালা ঠেলতে থাকা কুলি, নান-পকোড়া বেচা ছোকরা আর টি স্টলে কাজ করা লোকেরা সব সেখানে জড় হয়ে গেল।
‘এ আবার এলো কোত্থেকে?’ কেউ একজন তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘খোদাই জানেন!’
‘ওপর ওপর দেখে তো পাঠান বলে মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ ....... বোধহয়।’
দেখতে দেখতে লোকটার চারদিকে আবারও আধবোজা চোখ আর নিদ্রালু মুখের ভিড় জমতে শুরু করল।