• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • প্রসঙ্গ ‘স্বপ্নের পুরুষ ও জিপগাড়ি’ : একটি প্রেমের গল্প : মধুপর্ণা মুখোপাধ্যায়

    স্বপ্নের পুরুষ ও জিপগাড়ি; — রতন ভট্টাচার্য; প্রচ্ছদ ও অলংকরণ - মৃণাল শীল; প্রকাশক- ক্রমশ; হাওড়া, ৭১১৪০৯; প্রথম ক্রমশ সংস্করণ - জানুয়ারি ২০২৫; ISBN: 978-81-9831443-7

    শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে রতন ভট্টাচার্য (১৯৩৩-২০০৬)— ‘পরিচয়’ কিংবা ‘দেশ’-এর মতো পত্রিকায় লেখালিখি করলেও, একটা সময় তুমুল জনপ্রিয়তায় পৌঁছে গেলেও, হঠাৎ করেই নিজেকে সাহিত্যাঙ্গন থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সতেজ, ব্যতিক্রমী এবং বলিষ্ঠ কলমের আস্বাদ কালাতিক্রমী। যে-গ্রন্থ নিয়ে আমাদের আলোচনা, তাতে একটি মূল কাহিনি থাকলেও, সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম শাখায় পল্লবিত এবং খুঁটিনাটি বিষয়ে লেখকের দৃষ্টি কিছুটা সময়ের জন্য পাঠককে ভুলিয়ে দেবে— তাঁরা অক্ষরে চোখ রেখেছেন। বরং ঘটনার মধ্যে দিয়ে রীতিমতো ঘুরে আসার, অনুভূতিতে রণিত হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রন্থটির পাঠ শেষ হবে। এই-কাহিনি রচনার প্রেক্ষাপট হিসেবে গ্রন্থ সূচনায় যে-যে তথ্য দিয়েছেন লেখক-পুত্র রঞ্জন ভট্টাচার্য, তাতে স্পষ্ট হবে গল্প বা কাহিনি লিখব বলে লেখা নয়— যেন স্থান, সময়, প্রেক্ষিতের মধ্যে থেকে কঠিন একাগ্রতায় ঘটনাকে উদ্ভাসিত করেন রতন। তাই আলগা প্লট নয়, তাঁর লেখায় খুঁটিনাটি বিষয় হয়ে যায় পাঠকের পাওয়ার দিক, রসাস্বাদনের দিক। তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য পাঠককে সম্ভাব্যতার আরাম থেকে বঞ্চিত করে, চেতনাকে ধাক্কা দেওয়া। বর্তমান গ্রন্থটিও তার ব্যতিক্রম নয়।

    স্বপ্নের পুরুষ ও জিপগাড়ি (১৯৮০, শারদীয়া আনন্দলোক) একটি প্রেমের উপন্যাস। কলম যখন রতন ভট্টাচার্যের, অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, এই প্রেম তথাকথিত নয়। কথায় বলে নারী-মন, ‘দেবা ন জানন্তি’— মানুষ তো কোন ছাড়। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় বিষয়, সেই নারী-মন। তাই পাঠক, কাহিনির পরিণতি-অনুমানের কূল পেতে-পেতেও ভেসে যান বার-বার। প্রেমিকার নাম বুড়ি। সাদামাটা এই নাম রোম্যান্টিকতার আব্রুহীন। বরং সংসারী, আটপৌরে একটি চেহারা গাঢ় হয়। এহেন বুড়ি, থানার স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের ফুটবল লিগ চলাকালীন একদিন ফাঁকা থানায় ঢুকে পড়ল। তার সেজেগুজে থাকার উল্লেখ এবং শহরের অর্ধেকের বেশি লোকের তাকে চেনার উল্লেখ, পাঠক মনে একটা কৌতূহলের জন্ম দিয়েও, নিরসনের আগেই, অনুসরণ করতে বাধ্য করে বুড়ির গতিবিধি। লেখক উল্লেখ করতে ভোলেন না যে, কয়েক বছর আগে এমন অরক্ষিত থানার কথা ভাবাই যেত না। উপন্যাসটির রচনাকালের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, পশ্চিমবঙ্গে সাতের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশের একটা ইঙ্গিত যেন এই উল্লেখ-কৌশলে পেতে রাখছেন লেখক। যার সঙ্গে যুক্ত হতে দেখব বুড়ির ছোড়দাকে। এবং সেইসূত্রে থানার থার্ড অফিসারকেও। তাঁকে প্রথম যখন বুড়ি দেখে, থানার অফিস ঘরের মাঝখানে পাতা একটা প্রকাণ্ড টেবিলের ওপরে বসে বই পড়ছেন। যথাযথ ইউনিফর্ম নেই। পরে আছেন খাকি প্যান্ট আর টেরিলিনের চেককাটা জামা। রক্তমাংসের আচরণে ফেলে, আমাদের মাথায় গেঁথে থাকা পুলিশের ইমেজটা প্রথমেই দুলিয়ে দিচ্ছেন রতন ভট্টাচার্য। তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত ভাব আর সেইসঙ্গে হঠাৎ কাশির দমক, বুড়ির অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে লোকটিকে। এর পরবর্তী ঘটনা মন্থর। কিন্তু অফিসার আর বুড়ির কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে আখ্যানে ক্রমশ দ্রুতির সঞ্চার হয়েছে।

    বুড়ির থানায় আসার কারণটি তথাকথিত-ক্রাইমের অভিযোগ জানানোর মধ্যে পড়ে না। থার্ড অফিসারকে সে যা বলে, তা থেকে পাঠক জানতে পারবেন, সম্প্রতি, বুড়ির প্রেমিক বুড়ির সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চায় না জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছে। কারণ ছেলেটির মনে হয়েছে, কৈশোর থেকে তার মনে যে-স্বপ্ন আছে, তার সঙ্গে বুড়ি ঠিক খাপ খাচ্ছে না। যে-নারীকে সে জীবনে পেতে চায়, তাকে এককথায় হতে হবে তথাকথিত সতীলক্ষ্মী। গলায় আঁচল দিয়ে সন্ধ্যা প্রদীপ দেওয়া কিংবা লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া মানসীকে, বুড়ির মধ্যে সে শুধু খুঁজে পাচ্ছে না-ই নয়, স্বপ্নের মানসীকে বাস্তবে প্রত্যক্ষও করেছে। এখন বুড়ি অনুমতি দিলে সেই-মেয়েকেই ছেলেটি বিয়ে করতে চায়। এমতাবস্থায় ভাঙনের মুখে নিজের প্রেমকে দেখে, বুড়ি বিচলিত হয়ে পড়েছে।

    পাঠককে মনে করাতে চাইব, নামকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যথেষ্ট আধুনিকা এবং আত্মনির্ভরশীল একটি চরিত্র বুড়ি। তার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা সুগায়িকা হিসেবে। একসময় দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে এখন তারা যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করছে। মনে হয় না নিজের প্রেম নিয়ে সে একটুও বিচলিত ছিল। তবে রিজেকশনের অমর্যাদা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আর পারছে না বলেই তার মধ্যে জন্ম নেওয়া অস্থিরতার বশবর্তী হয়ে, কিছু না ভেবেই থানায় ঢুকে পড়েছে সে।

    থার্ড অফিসার, বুড়ির আচমকা খেয়ালে থানায় আসার বিষয়টি সহজভাবেই নেন। বরং বন্ধুসুলভ আচরণ করেন। হয়তো নিজেরও অল্প বয়সের কারণে বুড়িকে বিশেষ কিছু পরামর্শও দেন। অফিসারের আচার-আচরণ থেকে তাঁকে বুড়ির প্রেমিকের উলটো পিঠ বলেই মনে হয়। সপ্রতিভ, চোখা কথা বলার ক্ষমতা রাখেন। থানার অধঃস্তন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলার ধরন আর বুড়ির সঙ্গে কথা বলার ধরনের ফারাক, নারীর প্রতি মর্যাদা আর সৌজন্যবোধকেই স্পষ্ট করে না, পুলিশ অফিসারের পরিচিতির বাইরে যেন একজন তারুণ্যে ভরপুর বলিষ্ঠ, বিচক্ষণ আর আকর্ষণীয় যুবককেও ক্রমশ গাঢ় করে। তিনি নারীকে অকারণ অতিরিক্ত গুরুত্ব দেন না। চারপাশের খুঁটিনাটি খবর রাখেন। বুড়ির প্রেমিক, অঙ্কের অধ্যাপক বিজন ঘোষকেও নিজের স্মৃতি থেকে চিহ্নিত করে নেন, কারণ মাস পাঁচ-ছয় আগে বিজন থানায় এসেছিল তার ঘড়ি ছিনতাই হয়ে যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে। এরপর বুড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিস্মিত হতে-হতে পাঠক জানবেন, অফিসার বুড়ির বাড়ির অনেক ঢাকা-পড়া ইতিহাসও জানেন। অথচ তাঁর আচরণে প্রথমে কিছুই প্রকাশ পায়নি। বিশেষত, ফেরার হয়ে যাওয়া ছোড়দা, যার বর্তমান অবস্থান বিষয়ে বুড়ি কিছুই জানে না, যে-নাকি নিজের পিসেমশাইকে হত্যা করেছিল একদিন বিশেষ রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হয়ে, সেই ছোড়দা বর্তমানে জীবিত আছে। শুধু তাই নয়, কলকাতায় বসবাস করছে, বেহালার দিকে একটি স্কুলে পড়াচ্ছে— এই সমস্ত তথ্যের সঙ্গে বুড়ি যে বীথি দত্ত এবং রবীন্দ্র-সংগীতের গায়িকা, বাড়িতে গান শেখায়— তিনভাইয়ের মধ্যে মধ্যম, বিজনের সঙ্গে যে তার সম্পর্ক আছে ইত্যাদি সব তথ্যই অফিসারের নখদর্পণে। এখন থেকে এই মেয়েটিকে আমরা বীথি বলেই সম্বোধন করব। বীথি মানে, দু-দিকে বড়ো-বড়ো গাছের সৌন্দর্যে সেজে থাকা পথ। বীথির নারী-মন এখান থেকেই পাঠকের সামনে উন্মোচিত হবে। বলা যায়, বীথি নিজেই মনোরম একটি পথের মতো হয়ে পাঠককে নিয়ে যাবে পরিণতির দিকে। আর উপন্যাসের অন্যান্য ঘটনা, তার মনের মূল গতির পাশে-পাশে বৃক্ষরাজির মতো শোভাবর্ধন করবে।

    পনেরো ষোলো বছরের পরিচিতি আর নতুন ভাবে পরিচয়ের সাত-আট বছর পার করেও, বছর ছাব্বিশের বীথি দত্তের সঙ্গে তার ছোড়দার বন্ধু বিজনের এখনও বিয়ে কেন হল না জানতে চান অফিসার। বীথি জানায়, বিয়ের কথা বিজন দু-একবার তুললেও তাতে জোর ছিল না। এ যেন সেই অতি-পরিচিত সমস্যা। জোর করে না-দেখালে বেশিরভাগ মানুষ দেখতে জানে না। যেমনটা পাঠক দেখে এসেছেন, চিরকালীন প্রেমের কাহিনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা -য়। সেখানে অমিত চরিত্রটি পুঁথিগত বিদ্যার প্রাচীরে আটকে পড়া লাবণ্যের যৌবনকে বসন্তের ডাক পাঠিয়েছিল। সেই স্তুতিতে নিজেকে অন্যভাবে চিনতে শিখেছিল লাবণ্য। শোভনলালকে বুঝতে তার সময় লেগেছে ঢের। কিংবা ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিমলা, সেও তো নিখিলেশের প্রেমের অতলতায় প্রকৃত ডুব দেওয়ার আগে সন্দীপের স্তুতিতে ভেসে গিয়েছিল অনেকটাই। আবার প্রাত্যহিকতায় প্রকৃত প্রেমিক হিসেবে স্পষ্ট হতে সময় নিয়েছিল চতুরঙ্গ উপন্যাসের শ্রীবিলাস। বিজনও তেমন-ই ‘সকল নিয়ে বসে’ থাকার জন। বুক ফাটলেও মুখ তার ফোটে না। আর তাই গ্ল্যামারের আলোলাগা বীথি বাইরের দিক নিয়ে যত ব্যস্ত, ভেতর ঘরে প্রবেশের অবকাশ তত ছিল না। এখন এই মুহূর্তে থার্ড অফিসারের প্রশ্নে যেন ঠিক সেই দিকটায় আলো পড়ল। তিনি আরও জানতে চাইলেন, বিজনের চাওয়ার মধ্যে জোর না-থাকার ব্যাপারটা নিয়ে বীথি ভেবেছে কি না। সে ভাবেনি বলায়, মোক্ষম প্রশ্নটি এবার তিনি ছুঁড়ে দিলেন— ‘তাহলে কি ধরে নেব আপনার মনেও একজন স্বপ্নের পুরুষ আছে যার সঙ্গে বিজনবাবুর ঠিক মিলছে না?’ এই প্রথম নিজের অবচেতনের মুখোমুখি হবে বীথি। বলবে, তাদের দু-জনের আলাদা জগতের কথা। একজন অঙ্ক নিয়ে ডুবে আছে, আরেকজন গান। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আগে সে মাথা ঘামায়নি বলেই হয়তো নিজের কথা নিজের কাছেই দুর্বোধ্য ঠেকেছে তার।

    এই জায়গায় পৌঁছে পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধে হবে না, বীথি একটা ‘আমির আবরণ’-এর মধ্যে বসবাস করে এসেছে এতদিন। বিজনকে আরও কাছে না পাওয়া জনিত কোনো অভাববোধ হয়তো তার ছিল কিংবা ছিল না। অফিসার প্রশ্ন করেন, তাহলে স্বপ্নের মানসীকে যদি বিজন বিয়ে করে, তার কোথায় অসুবিধে, তবে কি অহংকারে আঘাত লাগছে কোথাও? বীথি জানায় তার অহংকার তার গান। আর তাতে আঘাত করার ক্ষমতা বিজনের নেই। অফিসার উত্তর দেন— মেয়েদের অহংকার হল পুরুষের ভালোবাসা।

    থার্ড অফিসার, বিজনকে ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দেন বীথিকে আর না হলে তার স্বপ্নের মানসীকে খুঁজে বের করে সমস্ত ব্যাপারটা বলতে বলেন, যাতে সেই মেয়ে আর বিজনকে বিয়ে করতে রাজি না হয়। প্রথম প্রস্তাব অসম্ভব বলে মনে হয় বীথির। তার ভেতর ঘরে তোলপাড় শুরু হয়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রস্তাবটিও তার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। বরং মনে হয়, সব বলার পরে সেই মেয়ে বিজনকে বিয়ে করার জন্য খেপে উঠবে। তাকে আশ্বস্ত করে অনেকটা গোয়েন্দার দৃষ্টি নিয়ে অফিসার জানান, বিজনের মনে মেয়েটির প্রতি মুগ্ধতা জন্ম নিলেও ভালোবাসা জন্ম নেয়নি। তা যদি হত, তাহলে বিয়ের জন্য অনুমতি চাইত না। আশ্চর্য এটাই, সম্পর্কের এই মনস্তত্ত্ব বীথির মাথায় একবারও এল না কেন?

    কাহিনি এগিয়ে চলে। বীথির মনের অস্থিরতার সঙ্গ নিয়ে পাঠক আরেকটি প্রেমকাহিনির সন্ধান পেয়ে যান। এবং ক্রমশ থার্ড অফিসারের সঙ্গেও একটা নব-বসন্তের সম্পর্কে যেন জড়িয়ে পড়ছে বীথি, বারবার মনে হয় পাঠকের। থানার থার্ড অফিসারের কথামতো, রীতিমত চেষ্টায় সে খুঁজে বার করে বিজনের মানসী, বীণাকে। তথ্যসংগ্রহে সহায় হয় বিজনের বিধবা বউদি। বীণার কাছে পৌঁছে যাওয়ার পেছনেও থার্ড অফিসারের সহযোগিতা খেয়াল করবেন পাঠক। বীথির কাছে বীণা যখন মনের কথা উজাড় করে দেয়, বোঝা যায়, এই-মেয়ের দিক থেকে প্রেম ছিনিয়ে নেওয়ার কোনো সম্ভাবনাই তৈরি হবে না। সে জানেই না, তার সঙ্গে তার দাদা প্রণব পালের বন্ধু, বিজন দত্তের বিয়ের ঠিক করেছে তার পরিবারের লোকজন। এখানে একটি বিষয়ে দোলা লাগে— বিজনের পদবী ঘোষ না কি দত্ত? থানার অফিসার ‘বিজন ঘোষ’ বলে উল্লেখ করার সময়, বীথিকে কিছু সংশোধন করতে দেখা যায় না। অথচ বীথি, বীণার কাছে বিজনের নাম বলতে গিয়ে পদবি হিসেবে দত্ত উল্লেখ করেছে। যাইহোক বিষয়টি পাশ কাটিয়ে আমরা, বীণাকে বীথির কাছে বলতে শুনব— তুলসী তলায় সে যখন প্রতিদিনের মত গলায় আঁচল দিয়ে প্রদীপ দিচ্ছিল, তাদের বাড়িতে আসা বিজনের দৃষ্টি ‘হ্যাংলার মত’ তাকে দেখেছিল। সুতরাং রোম্যান্টিকতার মৃদু আভাসও বীণার তরফ থেকে বিজনের প্রতি নেই। তার ওপর এই মেয়ের একটি গভীর প্রেম আছে। তাদেরই পারিবারিক ব্যবসা টালি-কারখানার, কর্মচারী তপনকে গভীরভাবে ভালোবাসে সে। প্রেম বাঁচানোর জন্য মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তার প্রেমিক তা হতে দেয়নি। বাড়িতে জানাজানি হতে থানা-পুলিশ, মারধোরের মহাভারত চলেছে, তবু বীণা হাল ছাড়েনি। একদিন সেই-ই ছেলেটিকে তার প্রেমে বন্দি করেছিল। আজও সদ্য আঠারো মেয়েটি, বদ্ধপরিকর তপনের সঙ্গেই জীবন কাটাবে। তার এই তীব্র প্রেমের সামনে বীণার ন্যূনতম প্রচেষ্টাহীন প্রেম বোধহয় থমকে দাঁড়ায়। বীথি মেয়েটিকে সাহায্য করতে, তার প্রেমিক তপনের সঙ্গে দেখা করে, বীণার আশু সংবাদের একটি চিঠিও পৌঁছে দেয়। আশ্চর্য, এই কাজেও সাহায্য করেন দারোগা।

    ঘটনা শুরুর প্রথমদিন, থানা থেকে বেরিয়ে, বীথি গিয়েছিল তার প্রিয়বন্ধু অনুর বাড়িতে। অনসূয়া এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে পরিপূর্ণ সংসার করছে। এই মেয়েটির সঙ্গে বীথির ছোড়দার একটা প্রেমের ইঙ্গিত রেখেছেন কাহিনিকার। তার বাড়িতেই ঠিক একমাস আগে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে বিজনের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বীথির আলটপকা হালকা কথায় আহত হয়ে বিজনের চলে যাওয়ার পরে, আর যে তাদের দেখা হয়নি, সে-কথাও মনে পড়ে বীথির। অথচ রোজ না হোক, সপ্তাহে দু-চার-দিন তো বিজন আসতই তাদের বাড়িতে। ‘বিয়ে হলেই সব শেষ কিংবা ‘তারপর ছেলেমেয়ে, কাঁথা কাপড়, অসুখবিসুখ, গা-ময় ঘামাচি…’— এই ধরনের কথার কথায় বিজনের ব্যথিত হওয়ার সঙ্গে এবং বীথির থেকে দূরে চলে যেতে চাওয়ার চেষ্টা কোথাও মনে করিয়ে দেয় রতন ভট্টাচার্যের পরবর্তী প্রজন্মের লেখক আবুল বাশারের একটি পরিচিত মনস্তাত্ত্বিক গল্প ‘হবা’-র সুনেত্র চরিত্রটিকে। যদিও সুনেত্র শিল্পী আর বিজন অংকের অধ্যাপক। তবু পুরুষের মনে জন্ম নেওয়া নারী-ফ্যান্টাসি কোথাও হয়তো স্নিগ্ধ-শান্ত-কোমলস্বভাবী, আশ্রয়ের আঁচল বিছিয়ে রাখা নারীকে কামনা করে মনে মনে। সুনেত্রর স্ত্রী আর বিজনের প্রেমিকা তাদের স্বামী কিংবা প্রেমিকের ইচ্ছের ছাঁচে গড়া নয়। আর তাই দুটি পুরুষ-চরিত্রই প্রেমের আধার বদল করতে চেয়েছে। বিজন সুনেত্রর মতো শিল্প-পাগল নয় বলেই, তার বাড়িতে হঠাৎ পৌঁছে যাওয়া বীথিকে দেখে বোধহয় বোঝাতে চেয়েছে নিজের মনের অবস্থা। যদিও পারেনি। কিন্তু বীথি যে ঝগড়া করতে এসেছে এবং এখন সে কিছুই বুঝতে পারবে না, এটুকু কথা শুধু বলতে পেরেছে। রাগ করে বীথি যখন বেরিয়ে এসেছে তাদের বাড়ি থেকে, বরং অনুমতি দিয়ে এসেছে স্বপ্নের মানসীকে বিয়ে করার, তখনও, মনের চাঞ্চল্যের সময়টাতেই জিপ নিয়ে তার সামনে পৌঁছে গেছেন থানার থার্ড অফিসার। আর থানাতেও একটি ছেলেকে ধরে আনা নিয়ে গ্রামীণ রাজনীতি শুরু হলে, অফিসারের কাছে নির্দেশ আসে তখনকার মতো থানায় না যেতে। ফলে সারাদিনের জন্য সময় হাতে পেয়ে যাওয়ায় অফিসার, কালীনগর ঘাটে বিজনের মানসীর সন্ধানে নিয়ে গেলেন বীথিকে। এই মেয়েটির পরিবারকেও ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন তিনি। আস্তে-আস্তে বীথির সঙ্গে তাঁর আচরণ এবং তাঁর সঙ্গে বীথির আচরণ বেশ মনকাড়া লাগে। বীথি কী করে যেন আবিষ্কার করে ফেলে অফিসারের নাম সুভাষ। কালীনগর ঘাট যাওয়ার গোটা পথটি তাদের মধ্যেকার দূরত্ব কমতে কমতে রমণীয় হয়ে ওঠে। অথচ বীথির তো মন ভার হয়ে থাকার কথা ছিল। এবং ভারাক্রান্ত মন নিয়েই সে জিপে উঠেছিল। কিন্তু রাস্তায় তাদের দু-জনের কথা নিয়ে খেলা আর এখন নদীর রূপ, সুভাষের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে তুলল বীথিকে।

    বীণাদের বাড়িতে পৌঁছে, মেয়েটির বাবা রামগোপালের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে আসন্ন পাত্র হিসেবে বিজনের প্রসঙ্গ ওঠার পরে সুভাষ বীণার কাছে বাড়ির ভেতরে এমন করেই যেতে বললেন বীথিকে, মনে হল তাদের দু-জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পাঠক খেয়াল করবেন সুভাষের নাম জেনে গেলেও বীথি মনে মনে তাঁকে ‘লোকটা’ সম্বোধন করে গেছে আগাগোড়া। এখন অফিসারের তাকে ‘তুমি’ সম্বোধনে বিরক্ত হলেও, বীণাকে দেখে তার সৌন্দর্যে বীথি মোহিত হয়ে গেল। এর পরের ঘটনা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।

    এখানে বলতে চাইব, পাঠক যদি বিজন-বীথির কথোপকথন আর সুভাষ-বীথির কথোপকথনের একটি তুলনামূলক বিচার করেন, দেখবেন প্রথমটায় মেঘ-ঝড়-ঝাপটা আর দ্বিতীয়টায় শরৎ কিংবা বসন্তের অমোঘ টান। প্রেমে কোনটা জরুরি? পাঠক কী বলেন? প্রেমে পড়লে ‘আসমা নীচে’ আর মানুষগুলো না কি ওপরে ভেসে বেড়ায়। তবে কি বীথি প্রেমে পড়ল এইবার। এটাই কি তবে তার জীবনে আসা প্রকৃত প্রেম? বীথির গান শুনতেও আসেন একদিন সুভাষ। তবে সকালে আসবেন বলে আসেন পুরোদিন পার করে। একটা গানের জায়গায় আটটি গান গাইয়ে নেন বীথিকে দিয়ে। একেই কি বলে চরিত্রের জোর? এটারই কি আকাঙ্ক্ষা ছিল বীথির। এই করিয়ে নেওয়ার জোর আদৌ কি আছে বিজনের মধ্যে?

    থানায় যাওয়ার ব্যাপারটা বাড়িতে আগাগোড়া আড়াল করেছিল বীথি। থানার দারোগা তার গান শুনতে বাড়ি আসতে চাইলে, অনুর স্বামী বিনয়বাবুর বন্ধু হিসেবে তাদের মধ্যে পরিচয় বলে ব্যাপারটা আড়াল করেছিল মায়ের কাছে। এখন অনসূয়ার বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে, অসময়ে সুভাষকে তার অপেক্ষায় থাকতে দেখে, সেই মিথ্যের কথা মনে পড়ে বীথির। সুভাষ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আগেই সামলে রেখেছিলেন। তা জেনে স্বস্তি পেয়ে সুভাষকে তাঁর পছন্দমতো পুরস্কার দিতে চায় বীথি। আর পুরস্কার হিসেবে সুভাষ তার গান শুনতে চাইলে, বীথির মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল— ‘ব্যস! আর কিছু চাই না?’ যদি সত্যিই আর কিছু দাবি করতেন অফিসার, পরিণতি কী হত আমরা জানি না। আপাতত কাহিনি আরেকদিকে বাঁক নিল।

    তপন মজুমদার, মানে বীণার সেই প্রেমিক পূর্বোক্ত দিনের দুপুর গড়িয়ে বীথির কাছে হাজির। বীণার জামাইবাবু নাকি একটি পোস্ট-কার্ডে, তাকে চিঠি পাওয়ামাত্র বকখালি রওনা দিতে জানিয়েছেন। নিজের প্রাণহানির সম্ভাবনায় তপন হয়তো যেত না, কিন্তু সেই পোস্ট-কার্ডের উলটো পিঠে বীণা কাউকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই যাওয়ার জন্য লিখেছে। আর সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ‘গানের রানি’ ‘বিথীদিদিমণি’-র কথাই উল্লেখ করেছে সে। এখানে জানতে ইচ্ছে করে, বীথির কি নিজের নাম উল্লেখ দেখে মনের মধ্যে কোথাও ভালো লাগা তৈরি হয়? না হলে অনসূয়া আর বিনয়কেও সঙ্গে নেওয়ার পরামর্শ করতে তাদের বাড়ি, একেবারে তপনকে নিয়ে পৌঁছে যাবে কেন। ঠিক পরের দিনই সকলে মিলে যাওয়া ঠিক করে যখন বাড়ি ফেরে, তখনই তার অপেক্ষায় বসে ছিলেন থার্ড অফিসার। তপন চেয়েছিল সুভাষদা সঙ্গে যাক। তার লোকবল দরকার। বীথির মুখ ফসকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার আহ্বান বেরিয়ে এলে এবং তপন বলুক না বলুক, এটা একান্তভাবে বীথিরই অনুরোধ নিশ্চিত হয়ে, অফিসার সম্মতিসূচকভাবে বীথির চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় ‘আপনিই বলছেন?’— বলে উঠলেন। সেই স্বরে বীথির সমস্ত শরীর যেন শিরশির করে উঠল। চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে সেও সম্মতিসূচক প্রত্যুত্তর দিল। এমন ঘন মুহূর্তেও বীথির মনে হয়েছে, কেউ যেন জোর করে তাকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিল। তাই বিদেশে রাজপুরুষ সঙ্গে থাকা ভালো বলে পরিবেশকে হালকা করে নেওয়ার চেষ্টা করল সে।

    ঘটনা এগিয়ে চলে। বকখালিতে শেষপর্যন্ত মারামারি নয়, বিয়ের পিঁড়িতে বসে বীণা আর তপন। বিয়ে চলাকালীন রাত নটা নাগাদ, বীথির পিঠে হাত রেখে তাকে ডেকে নেন সুভাষ। বীথি বেরিয়ে এলে সঙ্গে করে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যেতে চান। ঝাউবনের মাথায় তখন ‘আশ্চর্য চাঁদ’। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সুভাষকে ফেরাতে পারে না বীথি। তুমুল হাওয়া আর চাঁদের ছড়িয়ে পড়া আলোয় এগিয়ে চলে তারা। সেই মায়াবী রাতে সুভাষ বালির স্তূপে আরেকটু হলেই মুখ থুবড়ে পড়তে যাওয়া বীথিকে, বলিষ্ঠ দুটি হাতে, নারী জ্ঞান না করেই ধরে ফেলেন। এলোমেলো হাওয়ায় দুটো মনই বুঝি তোলপাড় হতে থাকে। গোটা উপন্যাসে মাঝে-মাঝে কবির কলম সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখবেন পাঠক। বিশেষ করে বীথির ভাবনায়, স্বপ্নে। শুধু কবি নয়, বলা ভালো দার্শনিক কবি। উপন্যাসের শেষ ধাপ তো পুরোপুরি কাব্যিক। ভেতর মনের আগল খুলে, বীথিকে একরকম প্রেমের প্রস্তাব দেন সুভাষ। বীথি সম্মত হয় না। ঝোড়ো হাওয়ায়, প্রকৃতির ক্যানভাসে বুঝি সে স্পষ্ট হতে দেখে বিজনের মুখ। বিশাল সমুদ্রের রূপের সামনে হাঁটুমুড়ে বসে পড়া বীথি, একাই উঠে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। সুভাষ বোঝাতে চায় বিজন আর ফিরে আসবে না, স্বপ্নের পুরুষ হয়ে থেকে যাবে বীথির জীবনে। বীথি নিরস্ত হয় না, সেও বলে যায়, বিজন আসবে। যদি না আসে, তবে কি সুভাষের জন্য বীথির মনে জায়গা হবে, বুঝি এটাই শোনার জন্য যখন আর্ত হয়ে ওঠেন সুভাষ, বীথি বলে যায়, বিজন না এলে, সে যাবে তার কাছে।

    স্বপ্নের পুরুষের কাছে সুভাষ জিপগাড়ির প্রতীক হয়ে, এভাবেই পৌঁছে দেন বীথিকে। অন্তত, মানসিকভাবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? না কি সুভাষ নিজেই জিপগাড়ি সহ স্বপ্নের পুরুষ হয়ে বীথির জীবনে আসেন? বীথির পা যে এখন বাস্তবের মাটি আঁকড়াতে চাইছে। মধ্যবিত্ত মন সক্রিয় হয়ে ওঠায়, দীর্ঘদিনের পরিচিত বিজনকেই আশ্রয় করতে চাইছে। ওড়বার আকাশ নয়, এবার বুঝি বসবার বাসায় জিরোতে চায় বীথি। অন্যদিকে স্বপ্ন তো স্পর্শের বাইরে। তাই সুভাষের কাছে বীথি কিংবা বীথির কাছে সুভাষ অধরাই থেকে যায়। আর এভাবেই কাহিনিটি একমাত্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে স্তব্ধ করে দেয় পাঠককে। অন্যান্য চরিত্রগুলি তাদের জীবনের ঘটনা কিংবা সম্পর্কের উত্তাপ নিয়ে মূল ঘটনাকে আবৃত করে তার সৌন্দর্য এবং গতিময়তাকে রমণীয় করে তুলেছে এই উপন্যাসে। ফুল ফল শাখা শিকড় সবকিছুই এই উপন্যাসে পাঠকের প্রাপ্তি। সবশেষে বলতে চাইব, স্বপ্নের পুরুষ ও জিপগাড়ি যত না প্রেমের উপন্যাস, তার চেয়েও বেশি একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। তবে সেই আলোচনা আপাতত থাক।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments