• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • পুজোসংখ্যার অলংকরণ একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া : সৌরজিৎ বসাক

    পুজোসংখ্যার অলংকরণ; — সন্দীপ দাশগুপ্ত; প্রচ্ছদ - সুবোধ দাশগুপ্ত; প্রকাশক- প্রতিক্ষণ; কলকাতা; প্রথম প্রকাশ- ডিসেম্বর ২০২৩; ISBN: 978-93-94205-73-4

    সারাবছর ধরেই নানারকমের বই পড়া চলতে থাকে। তবে প্রতিবছরই একটা আক্ষেপ রয়ে যায় যে নন-ফিকশন পড়া হল না খুব একটা। তার একটা বড় কারণ কী বিষয় পড়ব তা ভেবে না পাওয়া। তথ্যবহুল ইতিহাস, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদি কোন বিষয়ের ক্ষেত্রেই নন-ফিকশন পড়ার মতোন আগ্রহ আমার নেই। অথচ নন-ফিকশন লেখালিখির একটা বড় অংশই উক্ত বিষয়গুলি নিয়ে। তারপর খেয়াল হল আর্ট সংক্রান্ত কিছু পড়া যেতে পারে কারণ নিজেরও এইদিকে সামান্য আগ্রহ আছে। কিন্তু একেবারে বিশ্লেষণাত্মক তথা গবেষণাধর্মী, কঠিন সব টার্মিনোলজি ব্যবহার করে লেখা নন-ফিকশন পড়ার মতোন পাঠক আমি একেবারেই নই। তখনই হদিশ পাই এই বইটির।

    পুজোসংখ্যা। শারদীয়া। কে না পড়েছে? শারদীয়ার পাতাতে অলংকরণও কে না দেখেছে? এমনসব শিল্পকর্ম যা প্রতিটি পাঠকেরই হাতের নাগালে অথচ সেগুলির বিষয়ে, সেগুলির নির্মাতাদের বিষয়ে তো সেরকম কিছুই জানা নেই। কার্য-কারণ মিলে গেল, বিষয় পাওয়া গেল। বইমেলায় সংগ্রহও করা গেল, আয়েশ করে পড়াও হল। নন-ফিকশন পড়ার সার্থকতাও পাওয়া গেল।

    সাধারণত নন-ফিকশন লেখনীর ক্ষেত্রে তথাকথিত পাঠপ্রতিক্রিয়া খুব একটা যুক্তিসঙ্গত নয়। কিন্তু খুব আশ্চর্যজনকভাবে এই বইটির লেখনী নন-ফিকশন হয়েও পড়তে গিয়ে মনে হবে পরিচিত কেউ পুজোসংখ্যা, আর্টিস্ট, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি বিষয়ে গল্প করছে আর আমি (পাঠক) সেসব শুনছি। তথ্য, ঘটনা, মতামতের সুন্দর মিশেল ঘটেছে বইটির আগাগোড়া।

    আলোচিত হয়েছে ধীরেন বল থেকে শুরু করে সুবোধ দাশগুপ্ত, নন্দলাল বসু, শৈল চক্রবর্তী, সুধীর মৈত্র, আশু বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, কালীকিঙ্কর ঘোষ দস্তিদার, বিমল দাস, সত্যজিৎ রায়, নারায়ণ দেবনাথ, সুব্রত চৌধুরী, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, দেবাশীষ দেব, প্রসাদ রায় (ময়ূখ চৌধুরী), যুধাজিৎ সেনগুপ্ত, রেবতীভূষণ ঘোষ, কৃষ্ণেন্দু চাকী, কাফী খাঁ, কল্যাণ সেন ইত্যাদি বহু শিল্পীর পুজোসংখ্যায় করা ইলাস্ট্রেশনের খুঁটিনাটি এবং সংশ্লিষ্ট বহু ঘটনা। যে ক'জন শিল্পীর নাম পরপর মনে পড়ল তাঁরা বাদে আরও বহু শিল্পীর কথা বইটিতে আলোচিত হয়েছে। এই আলোচনার সাপেক্ষে এই বইটির পড়ার ক্ষেত্রে পাঠপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে দর্শনপ্রতিক্রিয়া কথাটিও একইমাত্রায় প্রাসঙ্গিক। এর কারণ বইটির এক-দুই পৃষ্ঠা অন্তরই, লেখনীতে আলোচিত ইলাস্ট্রেশনের ছবি রয়েছে। লেখকের আলোচনা পড়ার পাশাপাশি ছবিটিকে একইসঙ্গে দেখা, ডিটেলিং অনুভব করা - এটি আর পাঁচটি বই পড়ার অভিজ্ঞতার তুলনায় একেবারেই ভিন্নধারার।

    শিল্পীদের কথা সামগ্রিকভাবে পড়লে কষ্ট হয়। লেখক নিজের পিতা সুবোধ দাশগুপ্তের আর্টিস্ট জীবনের স্ট্রাগলের কথার পাশাপাশি আরও অনেক আর্টিস্টদের জীবন সংগ্রামের টুকরো টুকরো ঘটনা সংগ্রহ করে সাজিয়েছেন এই বইতে। সে'সব পড়লে একটাই কথা সবার আগে মনে হবে, মনে হতে বাধ্য যে শিল্পীদের যথোচিত কদর প্রায় কোনসময়ই দেওয়া হয়নি। তাঁদের অমূল্য সৃষ্টির সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাঁদের অনেককে মনে রাখা অবধিও হয়নি। না, নেই, হবে না, হল না, হচ্ছে না, হয়নি ইত্যাদি শব্দেরই যেন আধিক্য বেশি শিল্পীদের নিজেদের গল্পে। পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়।

    সমস্ত বইটি একটি কন্টিনিউয়াস লেখনীর আকারে লেখা হয়েছে। এতে আলাদা করে অধ্যায়বিন্যাস কিংবা সূচীপত্রের অবতারণা নেই। লেখকের নিজে বলার আগেই আমার নিজেরই মনে হয়েছে যে এই বইয়ের আলোচনা এতদিনের পুজোসংখ্যার এতসব শিল্পীদের কাজের যে হিমালয়তুল্য পরিমাণের কাছে নেহাতই সামান্য। আরও আরও আরও বহু কথা বলা বাকি, আরও বহু স্মৃতিচারণা করা বাকি। বইয়ের শেষ বাক্যটির পরেও আরও বহু লেখা বাকি। এটা অনুভূতিশীলতা থাকলে আপনা হতেই বোঝা যায়। আরও পড়ার ইচ্ছা রইল, আরও জানার ইচ্ছা রয়ে গেল।

    অবশ্যপাঠ্য একটি বই। "অবশ্যপাঠ্য" কথাটা আমি বিশেষ ব্যবহার করি না, তবে এই বইয়ের ক্ষেত্রে অন্য কোন বিশেষণ ভেবে পেলাম না। লেখনী সাহিত্য এবং চিত্রকলার মেলবন্ধন, পুজোসংখ্যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, শিল্পীদের জীবন, শিল্পের আলোচনা, সংস্কৃতির আলোচনা ইত্যাদি বহু সেগমেন্ট নিজ আওতাভুক্ত করে এই ছোট্ট বইটি। এগুলির অন্তত একটি বিষয়ে সামান্য আগ্রহ থাকলেও এই বইটি পড়া দরকার।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments