• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • বিয়োর : বেদে-সাপুড়িয়ার জীবন বৃত্তান্ত : সৃজা মণ্ডল

    বিয়োর — শুভঙ্কর গুহ ; প্রচ্ছদ- তিতাস বসু; প্রকাশক- করুণা প্রকাশনী, কলকাতা; প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি, ২০১১; ISBN: 978-81-8437-100-0

    নৃতাত্ত্বিক নির্মলকুমার বসু ‘পরিব্রাজকের ডায়েরি’ গ্রন্থে লিখছেন, ব্যক্তি নয়, “অচেনা সংস্কৃতি তাহার সমগ্রতা লইয়াই প্রথমে মনের নিকট ধরা দেয়। কিন্তু ক্রমে সেই সকল সমাজের সমগ্র রূপ টুটিয়া এক একজন ব্যক্তির রূপ স্পষ্টতর হইয়া ওঠে।” এই কথাই প্রতিধ্বনিত হয় সাহিত্যিক শুভঙ্কর গুহ-র ‘বিয়োর’ উপন্যাস সৃষ্টির পটভূমিকা হিসেবে। মুর্শিদাবাদ জেলার নবগ্রামের বেদেপাড়া লেখককে অভিভূত করে। বেদে-সাপুড়িয়াদের অচেনা জীবন ও সংস্কৃতি লেখককে নিয়ে যায় এক আশ্চর্য জগতে। লেখক নিজেই জানিয়েছেন সে কথা— ‘সাপুড়িয়াদের সঙ্গে মেলামেশা, সাপখেলা দেখা, শিকার দেখা, ভোজন, আড্ডা, রাত্রিবাস, মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বিচরণের মাধ্যমে যতটুকু জেনেছিলাম— এক গভীর বাউল মনের অনন্ত যাত্রা। ওদের জীবন দর্শন, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি।’ এই আকর্ষণেই দীর্ঘ তিন বছর ধরে ‘বিয়োর’-এর আখ্যান নির্মাণ করেছেন ঔপন্যাসিক শুভঙ্কর গুহ। মাঝে মাঝেই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সাপুড়িয়া-পাড়ায়। সেই পাড়ার মীরু সাপুড়িয়ার ছায়ায় নির্মাণ করেছেন তাঁর উপন্যাসের চরিত্র। কথাকার ভূমিকায় লেখেন, ‘সাপ নয়, সাপুড়িয়াদের জীবনদর্শনই’ তাঁকে মুগ্ধ করেছে। সাপুড়িয়াদের এই অনন্ত যাত্রাই ‘বিয়োর’ রচনার উদ্দীপক।

    উপন্যাসটিতে যে শব্দটি প্রথমে আমাদের নাড়া দেয়, তা হল ‘বিয়োর’। ‘বিয়োর’ শব্দের অর্থ গর্ত। গর্তকে কেন্দ্র করেই সাপুড়িয়াদের জীবন আবর্তিত। যে সাপের গর্তে শিক ঢুকিয়ে সাপুড়িয়ারা জীবিকা অর্জনের পথ খুঁজে পেয়েছিল, সেই সাপের গর্তেই তারা মুক্তির পথ খোঁজে। সাপ বেদেদের জীবনে জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে— “আমাদের ধম্মো সাপ। সাপ আমাদের বন্ধু। সাপ খেলা দেখিয়ে আপনাদের কাছ থেকে চাল- ডাল-আটা-কুদ-টাকা-পয়সা এটাসেটা মেঙ্গে থাকি। আমরা মেঙ্গে-মেঙ্গে খাই। আমরা তাই মাগানতা।” বেদে জীবনের আরেকটি দর্শন ‘বিচরণ’। বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ‘মজমা’ করে বা সাপ খেলা দেখিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে আছে ভ্রাম্যমাণ বেদেরা। তাই ঔপন্যাসিক বলেছেন,

    “যাত্রাপথেই তো আনন্দ, কত বেদিয়াদের স্ত্রী গো-যানেই সন্তান প্রসব করে, তবু গতি থামে না।… আকাশে যেমন মেঘ ভেসে-ভেসে বেড়ায়, তেমনি বেদিয়া যাযাবরের দল ভেসে বেড়াবে। এই ছিল মাগানতা রাজার নির্দেশ।”
    কে এই মাগানতা রাজা? কীভাবে শুরু হল বেদেদের যাযাবর জীবন? জনশ্রুতির পথ ধরে সাপুড়িয়া সম্প্রদায়ের সৃষ্টিতত্ত্বর লোকগাথা শুনিয়ে লেখক তাঁর মূল উপাখ্যানের দরজা খুলে দেন পাঠকের কাছে। হুগলির ধনেখালিতে ছিলেন বেদিয়াদের রাজা। তিনি ছিলেন বেদিয়াদের ভাষায় ‘মোশেল’ অর্থাৎ সাপেদের বন্ধু। বেদিয়ারাজ সাপকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করতেন। তাঁর ছিল এক নিজস্ব থান। সেখানে ছিল চারকোথ দেমূল, অর্থাৎ কালী ঠাকুরের বিগ্রহ। নিজের রাজ্য থেকেই বেদিয়ারাজ ধরতেন নানান ধরণের ‘মোশেল’। নিবেদন করতেন দেবীকে। প্রতিবেশী রাজারা নিজেদের সভ্য জ্ঞানে বেদিয়া রাজাকে বিষধর, অসভ্য ও আঁশটে হিসেবে আখ্যা দিল। তাঁর রাজত্ব নিশ্চিহ্ন করতে জোট বেঁধে আক্রমণ করল বেদিয়া রাজাকে। রাজা পরাস্ত হয়ে আড়বাঁশি, বীণ, শাবল, ঝাঁপি, শিক সঙ্গে করে দলবল নিয়ে নেমে এলেন পথে-প্রান্তরে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রচার করতে থাকলেন শিকড়-মূলের মাহাত্ম্য। সাপখেলা দেখিয়ে নানাবিধ উপায়ে উপার্জন করতে থাকলেন। শুরু হল তাদের যাযাবর জীবন।

    ‘বিয়োর’ এক অসামান্য আখ্যান। এ আখ্যান আবর্তিত হয়েছে ভ্রাম্যমান সাপুড়িয়া দলকে ঘিরে। দলে আছে শতবর্ষ অতিক্রান্ত সর্দার কিরীটি, তার ল্যালো (পুত্র) কেদার, বন্বি (পুত্রবধূ) অসম্ভাবনী। আছে নালু সাপুড়িয়া আর তার ছেলে শীতল, জলিল বেদে ও তার মেয়ে ফতিমা। আছে আরও অন্যান্য সাপুড়িয়া। এই উপন্যাসের সূচনা হয়েছে বেদে সাপুড়িয়া দলটির মুর্শিদাবাদের নবগ্রামে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। শতবর্ষ অতিক্রান্ত কিরিটি সাপুড়িয়ার শরীর সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতে বিধ্বস্ত, ক্ষয়িষ্ণু। তাই অন্তহীন ছুটে চলার পরিবর্তে সে বেদে দলের স্থায়িত্ব চায়, সুস্থিতি চায়। সে সাপের গর্তের ভিতরে চিরনিদ্রা কামনা করে—

    “আমাকে পুঁতে দিবি কেদার। বড় করে গত্ত করবি, গত্তের চারধারে গাছের ডাল দিয়ে বেড় দিবি। মাটি চাপা দিয়ে আবার গত্ত করবি। গত্তের মধ্যে দাঁড়াশ, গোখরো, কেউটে, চন্দ্রবোড়া বাসা বাঁধবে।”
    তাঁর স্থিতিলাভের ব্যগ্রতা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে যাযাবর জীবন বিসর্জন দিতে উন্মুখ হয়ে ওঠে—
    “আমি আর বেশিদিন নাই। কথা দে কেদার, আমার গত্ত ছেড়ে, তোরা আর যাবি না।এখানেই থাক। কোথায় আর যাবি? এখানেই যখন মোশেল বিস্তর, কাজের অভাব তো হবে না। আর যদি চাস, সর্দারকে ফেলে রেখে যাস। সর্দার আর যাবে না। জাতে আমরা মাগান্তা। মেঙ্গে নিয়ে, একা চলে যাবে আমার।”
    ঘটনাক্রমে নবগ্রামের গোড়াপত্তনকারী দীনু দয়ালকে সাপে কামড়ালে বেদে সর্দার তাঁর বিষ নামায়। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দীনু দয়াল বেদেদের জমি দান করে। নবগ্রামের একপ্রান্তে প্রাচীন বটবৃক্ষের তলায় বেদে পাড়া গড়ে ওঠে। যাযাবর সাপুড়িয়ারা স্থায়ী হয়।

    একদিকে চলমানতার নির্দেশ, অন্যদিকে স্থায়িত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা— এই দুই-এর টানাপোড়েনে বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে তৈরি হয় এক মানসিক দ্বন্দ্ব। বেদেরা স্থায়ী হলেও গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে ঘৃণ্য ও অস্পৃশ্যই থেকে যায়। স্থায়িত্ব লাভের পরিণাম স্বরূপ গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে অন্তর্কলহ দেখা যায়। ব্যক্তিগত মালিকানা যাযাবর গোষ্ঠীতে নিয়ম বিরুদ্ধ। ‘মজমা’য় উপার্জিত অর্থ-সম্পদ, শিকার করা সাপ গোষ্ঠীর সকলের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করাই নিয়ম। গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস যাযাবরদের ধর্ম —

    “দলের মধ্যেই বিবাহ হবে, দলের মধ্যেই থাকবে। সন্তান উৎপাদন করবে। ক্রমে ক্রমে দলের হাঁড়িয়া সংখ্যায় বাড়বে। পাঁচ হাঁড়িয়া বোতন (পাঁচ হাঁড়ি ভাত) সিদ্ধ হবে। সাপুড়িয়ারা মজমা করে ফিরবে। যা উপার্জন হবে, মাদুরের মধ্যিখানে রাখবে। সর্দার ঝাঁপিতে তুলে রাখবে।”
    নবগ্রামে স্থায়ী হওয়ার পর জলিল বেদে মজমায় উপার্জিত অর্থ নিজের কুটিরে রাখে। কারণ তার বিশ্বাস গোষ্ঠী নয় পৃথক পরিবারই বেদে পাড়া গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। গোষ্ঠী ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। বেদে জনগোষ্ঠী ভেঙে গ্রামীণ জীবনের আদলে পরিবার গঠন হয় —
    “অন্য মাগানতার দল জানে, কিরিটি সাপুড়িয়ার দলে দুই সর্দার নাই, নাই দুইটা উনান। আজ থেকে তোর দলের ভিতরে দুইটা উনান হল। যত দিন যাবে, আঁখাখোকা বাড়বে। সাপের ঝাঁপি সব আলাদা হবে। দলের কোনো ঝাঁপি থাকবে না। আলাদা হবে, খন্তা, শিক। সাপ হবে ভেন্ন। টাকা-পয়সা যার-যার, তার তার। দলে তখন ছোট সর্দার, বড় সর্দার থাকবে না।”
    ‘বিয়োর’ উপন্যাসটি সাপুড়িয়াদের মাগানতা ধর্ম বিলোপের আখ্যানও। যে কাহিনি কথাকার শুনিয়েছেন শীতল বেদের জীবনালেখের মাধ্যমে। শীতল বেদে বেদিয়া জীবন থেকে মুক্তির আশায় স্ত্রী ফতিমাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে দল ত্যাগ করে। কারণ সে উপলব্ধি করেছিল জীবিকার পরিবর্তন না হলে বেদে সাপুড়িয়াদের সামাজিক উন্নতি সম্ভব নয়। সে নৌকা তৈরির কাজ শেখে এবং দক্ষ কারিগরে পরিণত হয়। ময়ূরাক্ষী ও দামোদর-এর সংযোগস্থলে বসবাস শুরু করে, কিন্তু সেখানেও সে স্থায়ী হতে পারে না। সাপের কামড়ে মৃত ফতিমা প্রবল বন্যায় ভেসে যায়। একই সাথে তার দীর্ঘদিনের লালিত গ্রামীণ গৃহস্থ হওয়ার স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রণা নিয়ে সে তার নিজের সমাজে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা করে। কিন্তু বেদেদের নিজস্ব নিয়ম আছে, নিজস্ব সমাজ আছে। কখনো কোনো সদস্য যদি বেদে সমাজ থেকে বেরিয়ে যায় বা সাপ খেলা দেখানো ছাড়া অন্য পেশার সাথে যুক্ত হয় সেক্ষেত্রে সমাজের অনুমতি ছাড়া দলে ফিরে আসতে পারে না। এই প্রসঙ্গে কেদার শীতলকে বলে,
    “আমার সঙ্গে তুই মাগানতা পাড়াতে ফিরে জাবি, সে খুব কথা। যাবি ফিরে। কিন্তু দলের মাগানতারা ফেরত নেবে কীনা, আমি বলতে পারব না। তোর ফেরার জন্য একডা বিচারসভা হবে। বিচারসভায় যা সিদ্ধান্ত হবে, তা তোকেও মানতে হবে, আমাকেও মানতে হবে। মাগানতা সমাজ থেকে বাহির হয়ে গেলে ফিরা যায় না শীতল? এইসব নিয়ম তোর জানা ছিল, এই নিয়ম জেনেই তুই বেদে সমাজ পরিত্যাগ করেছিলি? এইসব জেনেও তুই ফিরতে চাইছিস।”
    বেদে সাপুড়িয়ারা হিন্দু নয়, মুসলমানও নয়। একই পরিবারে একটি সন্তানের নাম যদি কৃষ্ণ হয়, অন্যটির নাম মকবুল হয়। জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম যদি রাধা হয় তবে কনিষ্ঠার নাম ফতিমা হতে পারে। কখনও এরা হরিনাম করে তো কখনও নামাজ পড়ে। সাপ তাদের জীবন দেবতার সমান। সাপুড়িয়ারা সাপ ধরে, সাপের বিষ বিক্রি করে, সাপের খেলা দেখায়। বিভিন্ন তাবিজ কবজ, বিভিন্ন গাছের শেকড় বাকড়, বিভিন্ন রোগ ব্যাধি উপশম করার তেল সাধারণ গ্রামবাসীদের কাছে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। কেদার সাপুড়িয়ার কথনকে কথাকার তুলে ধরেছেন অক্ষরের বুনোটে—
    “শুনেন গো বাবুরা, শুনেন গো মা-ভাই-বোনেরা…কেদার সাপুড়িয়া বলছে, এই জগতে খল বলে কিছু নাই। আপনি ভাবলে খল, না ভাবলে সব ভালো। সাপ কখনও খল নয়গো বাবুরা। এই গোখরো আমার চন্দ্রকান্তা, ওর মতন নিরীহ প্রাণী এই জগতে নাই। সাপ আমাদের ভগবান। সাপ আমাদের খোদা। সাপ আমাদের অন্ন। সাপ আমাদের পিতা-মাতা। আমরা সাপের সঙ্গে থাকি, সাপ আমাদের সঙ্গে ঘর করে। তাই আমরা সাপুড়িয়া।আমি হলাম কেদার সাপুড়িয়া, আর সঙ্গী নালু সাপুড়িয়া। এই যে কত্তা আপনি নাকে নস্যি ঠুসছেন, যে কোনো সময় আপনার শ্বাস নালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই যে গাছের ডাল, এর নাম দেবডাল, আমার চন্দ্রকান্তার মাথায় ছোঁয়ালাম, আপনার শ্বাস নালি বন্ধ হলে নাকে ছোঁয়াবেন, শ্বাসকষ্ট দূর হবে, আসেন গো মা, আপনি কালোয়াড়ের মাথায় ছুঁইয়ে নিন আপনার গৃহের টুকিটাকি। অমঙ্গল আপনার দুয়ার ছাড়বে, আর স্নানের পরে রোজ বলবেন— “জয় দে মা জয়ের ধ্বনি…নম বিষহরি…জয় দিয়ে পুজিমা তোর চরণদুখানি…মাকে আনতে আনতে ক্ষীরনদীর কূল…হাতে দেব ফুল-পুস্প…চরণে জবা ফুল…রোজ এই স্তবগান করলে ঘরের অমঙ্গল দূর হবে। মঙ্গল হবে আপনার দুয়ার-ভিটার বাসিন্দা। এক ঝাঁপিতে যেমন থাকে কেউটে আর গোখরো, তেমনি কর্তা আপনি থাকবেন এক ঝাঁপিতে রানিমাকে নিয়ে। কলহ হবে না, বিবাদ দূর হবে। আপনার গোয়ালমন্দিরে গাভির উদরের ক্রিমি পরিষ্কার করবে এই মূল, এর নাম ঈশ্বরমূল। এই ঈশ্বরমূল আপনার গোয়ালমন্দিরে থাকলে গাভির দুগ্ধ হবে অমৃ্ত…আমি বদ্যি নইগো…ওঝা নই, নই ফকির বা পীর…আমি বেদে, বেদিয়া চিকিৎসার কোনো কিন্তু নাই।”
    দেশে দেশে সাপ খেলা দেখিয়ে দিন গুজরান করা বেদেরা জানে না তাদের দেশের নাম কি। এদেশের মানুষ হয়েও তারা এদেশের নাগরিক নয়, তাদের ভোটাধিকার নেই। রাষ্ট্রের পরিচয় না থাকলেও রাষ্ট্রের নিয়ম নীতি মানতে হয়। ১৯৭২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন হলে বেদেদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে—
    “সাপুড়িয়াদের আপন হল মোশেল (সাপ) আর কলন্দরদের আপন হল ঝাবর(ভালুক), আর জোদর (বাঁদর)। এরা কলন্দর আর সাপুড়িয়ার আপনজন। এরা মাগানতার সঙ্গে কখনও শত্রুতা করে না। কিন্তু দেশের সরকার আইন করে মোশেল, ঝাবর, জোদর, নেউলের সঙ্গে বিচ্ছেদ করায়ে দিল। সাপুড়িয়া মোশেল ছাড়া বাঁচবে কী করে?”
    ‘বিয়োর’ বিপন্ন সাপুড়িয়াদের লৌকিক-অলৌকিক বিশ্বাসের কাহিনি। শঙ্খচূড় সাপ দেখে যদি ঘর থেকে বেরোনো যায় তাহলে সেদিন ‘মজমা’ ভালো জমে— এমন সংস্কার সাপুড়িয়াদের মধ্যে রয়েছে। এছাড়াও পরিবারের উন্নতির জন্য পারিবারিক সংস্কার মেনে সাপের ছবি এঁকে উঠোনে আলপনা দেওয়ার রীতি বেদে সমাজে প্রচলিত। কিরিটি সর্দার দীনু দয়ালকে বলেছে,
    “আপনার মঙ্গলের জন্য শঙ্খচূড় সাপের খোলস রেখে দিয়েছি। এ শঙ্খলাগা খোলস। আপনি আপনার ঘরে রাখবেন। অমঙ্গল ঘর ছাড়বে মঙ্গল আপনার ঘরে রানী হবে।”
    এই উপন্যাস জাদুবাস্তবতায় আচ্ছন্ন অভিনব এক চরিতমালা। যার সন্ধান লেখক দিয়েছেন দলের সর্দার কিরিটি সাপুড়িয়ার কচ্ছপ হয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। ছাতাপাটি গ্রামের মানুষ তাদের মাতব্বরের সাপ কামড়ের বিষ নামানোর জন্য অথর্ব কিরিটি সাপুড়িয়াকে অপহরণ করে। গ্রামবাসীরা সর্দারকে ঝুড়িতে বসিয়ে ফিরিয়ে দিতে আসার পথে তার মৃত্যু হয়। বিপদ বুঝে বিলবোশিয়ার তীরে ঝুড়ি নামিয়ে রেখে তারা পালিয়ে যায়। উপন্যাসে লেখক সরাসরি মৃত্যুর প্রসঙ্গ না এনে এক আচ্ছন্নতার জগত তৈরি করেন। কারণ, সাপুড়িয়ারা মনে করত, তাদের সর্দার একশো বছর জীবিত থেকে সময়কে জয় করেছে, সুতরাং তার মৃত্যু হতে পারে না। সে কচ্ছপের মতন দীর্ঘজীবী এক প্রাণ। তার বিনাশ নেই। কিন্তু তাদের কল্পনা বিলীন হয়ে যায়। সর্দারের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য যখন তারা গর্ত খুঁড়তে ব্যস্ত, তখনই সভ্যতার উন্নতিকল্প সামনে এসে দাঁড়ায়। বিলবোশিয়ার পাড়ে মরা কচ্ছপকে ঘিরে যখন ওই সাপুড়েদের বিশ্বাস আর মমতা পাক খাচ্ছিল, তখন বনরক্ষীরা এসে ওই দুর্লভ প্রজাতির কচ্ছপটি নিয়ে যায় সংরক্ষণের জন্য। বিস্মিত, হতাশ কেদার সাপুড়িয়া বলে, “এত দিন একা-একা বিচরণ করত, মরে গিয়ে ও ভদ্দরলোকেদের হয়ে গেল।”

    ভাষা আখ্যানে জল সিঞ্চনের কাজ করে। বেদে সাপুড়িয়াদের নিজস্ব এক ভাষা আছে। যা মাগানতা নামে পরিচিত। তারা নিজেদের মধ্যেই এই ভাষা ব্যবহার করে। ভাষাটি মৌখিক, কোনো লিপি নেই। ভাষাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেদেরা ভীষণ গোপনীয়তা রক্ষা করে। যে ভাষা বলা নিষিদ্ধ সেই মৌখিক ভাষাকে, আঞ্চলিক ব্যবহারকেই কথাকার প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি এই ভাষাকে ব্যবহার করেছেন ব্রাত্য বেদেদের জীবন-ভাষ্যকে প্রকাশ করতেই। আসলে রুক্ষ মাটির মতোই তাঁর চরিত্ররা রুক্ষ ও বাস্তব, এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসে তাঁরা। উপলব্ধি করি কী নিবিড় গবেষণা, নির্মোহ মনন, এবং প্রান্তিক মানুষদের প্রতি অপার মমত্বে পরিপূর্ণ এই উপন্যাস। যার অনুরণন পৌঁছয় সংবেদনশীল পাঠকচেতনায়।

    সাপখেলা ও শিকার নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে সাপুড়িয়া পেশাটি হারিয়ে যাচ্ছে কালের নিয়মে; সমাজে প্রান্তিক হতে হতে প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে। সাপকে কেন্দ্র করে যাদের জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ, সংসার জীবন সংস্কৃতি ভাষা গড়ে উঠেছে তারা এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে বাধ্য হয়— “সাপ ছাড়া সাপুড়িয়া বাঁচতে পারে না”। বেদে সাপুড়িয়ারা আপাত অর্থে স্থিতি পেয়েছে, কিন্তু তাদের পরিক্রমা শেষ হয় না—

    “একটি বেদের দল ক্রমশ, পরের-পর হাঁটুজল ভেঙে, নিজেদের পোশাকগুলি পতাকার মতন ওড়াতে- ওড়াতে এগিয়ে যাচ্ছে নবগ্রামের দিকেই। প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এক সর্দার সামনের দিকে ঝুঁকে লাঠিতে ভর দিয়ে দলটির একেবারে সামনে, এগিয়ে যাচ্ছে।

    কেদার সামনে এগিয়ে এসে, কীগো মাগানতা সর্দার দল নিয়ে কোনদিকে? কে গো তুমি?

    পটুয়া দশরথ মাগানতা।

    পাড়া নেই?

    না। বিচরণ করি।”

    এই বিচরণের বৃত্তান্তেই এ উপন্যাসের বিশিষ্টতা। এই বৃত্তান্ত এক চলমানতার। উপন্যাসের শেষে লেখক বেদে জনজাতির অন্তহীন চলমানতাকেই পরিস্ফুট করেছেন।

    ‘বিয়োর’ উপন্যাসের গ্রন্থনায় রয়েছে বেদে সাপুড়িয়াদের যাযাবরত্ব থেকে স্থায়িত্ব লাভের যাত্রাপথ ও জীবন সংগ্রামের কথা। তাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের আখ্যান। বেদেদের পেশাগত অস্পৃশ্যতা এবং জীবন দর্শনের কথা ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন অসামান্য দক্ষতায়। বেদেদের এই অন্তহীন যাত্রার উপাখ্যান আমাদের সমৃদ্ধ করে। ভাস্বর হয়ে ওঠে মানুষের সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস পাঠকের চেতনায়।

    তথ্য সহায়তা—

    বসু, নির্মলকুমার। ১৩৬৬। পরিব্রাজকের ডায়েরি। ২য় সংস্করণ। কলকাতা: বিদ্যোদয় লাইব্রেরি।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments