• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • বর্মা মুলুকে বাঙাল : সুনন্দন চক্রবর্তী


    শেডাগন প্যাগোডা

    বাঙালদের নিয়ে একটা বাজে রসিকতা চালু আছে তাদের কে নাকি পাড়ায় সব দিন লুঙ্গি পরে ঘুরত বলে পাড়ার লোক যখন বলে, এইটা আপনে কী করেন, তখন তাঁর জবাব এখানে তো হক্কলডি চিনা (না, না, চৈনিক নয়, চেনা)। আবার গড়িয়াহাট মোড়েও তাঁকে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় পাওয়া গেলে তাঁর জবাব এখানে আমারে চিনে কেডা। আমাদের পাড়ায় বর্মা থেকে চলে আসা লোকেরা সবাই খুব লুঙ্গি পরতেন তবে একটু ভিন্ন কেতায়। প্রায় বুকের কাছে গিঁট মারা থাকত তাদের লুঙ্গি আর অনেকে তাতে বুশশার্ট গুঁজে পরত। ইয়াঙ্গং-এ হাওয়াই আড্ডা থেকে আমাদের যিনি নিতে এলেন তাঁর পরনেও বুশশার্ট গোঁজা লুঙ্গি। রুপলু-র বাবা এই পোষাকের সঙ্গে বর্মা চুরুট খেতেন বলে অবিমিশ্র শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। আমাদের সারথির নেশা জর্দা পান।

    আপনারা তো জানেন নিটোল, মসৃণ বেড়ানো আমার কপালে নেই। বিনামেঘে বজ্রপাতও আমার ভাগ্যে জুটতে পারে বলে ইয়ার-দোস্ত-রা পরামর্শ দেন যেন পিঠে একটা লাইটনিং এরেস্টার বেঁধে ঘুরি। কেউ কেউ আবার যোগ করে তাতে নাকি ইতিহাস বইয়ে দেখা হিউয়েন সাঙ মার্কা একটা ভাব আসবে। কুচুটেদের কথা শুনুন একবার। কাজেই মিয়ানমার যাবো শুনে সবাই হাঁ হাঁ করে উঠে বলল ওখানে তো খুব গোলমাল, রোহিঙ্গা, সামরিক শাসন সব মিলিয়ে একটা বিশ্রী ব্যাপার। তাদের আশ্বস্ত করলাম সর্মাজি (শর্মা নন, কোন্ডাপল্লি সর্মা) বহুদর্শী মানুষ, দীর্ঘ দিন সিঙ্গাপুরে কর্মসূত্রে ছিলেন, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁর পরিচিতজনেরা ছড়িয়ে আছে। তেমন একজনের ভরসাতেই যাওয়া। যাবো ঠিক বেড়াতে নয়, ছবি তুলতে।

    যাঁরা বেড়াতে গিয়ে ছবি তোলেন আর যাঁরা ছবি তুলতেই বেড়াতে যান তাদের মধ্যে মস্ত তফাৎ। প্রথম দলের চাই ভালো থাকার জায়গা, মনোমত খাবার, শরীরের আরাম, মনের আনন্দ। দ্বিতীয় দল ছন্নমতি, নাওয়া খাওয়ার কোন দিশা নেই, চোখে এক পাগলপারা আলো নিয়ে হয় উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরছে, নয় গোষ্ঠমামা-র স্টাইলে নানান কিসিমের ক্যামেরা উঁচিয়ে কোথাও খাপ পেতে বসে রয়েছে। অনেক সময়েই এদের বেশভূষাও কিঞ্চিৎ খ্যাপাটে, হাবভাব রীতিমতো সন্দেহজনক, যেখানে-সেখানে, যখন-তখন ভূমিশয্যা নিতে আগ্রহী। এদের পাল্লায় পড়ে আমি মাঝেমাঝেই নাস্তানাবুদ হই কিন্তু হাল ছাড়িনি। এই দলটার আমি ছাড়া সবাই দক্ষিণ ভারতের। সবাই প্রতিষ্ঠিত শখের আলোকচিত্রী। সবাই মূলত নিরামিষাশী। সবথেকে আশ্চর্য আমার নির্বিচারে সাপ-ব্যাং ভক্ষণে এঁদের বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই, বরং উৎসাহ আছে। আর নিজেরা যে বিপুল শুকনো খাবারের ভাণ্ডার নিয়ে আসেন অকাতরে আমাকে তার ভাগও দেন। বুঝতেই পারছেন এঁরা যদিও ছবি তুলতে আসেন আমি আসি নানা দেবভোগ্য খাবারের লোভে।

    এবারে থাই এয়ারওয়েজে কলকাতা থেকে ব্যাংকক হয়ে ইয়াঙ্গং আসার পথেও সুখাদ্যে আপ্যায়িত হয়েছি। তাও যখন বিমানবন্দরের বাইরে আমাদের নির্দিষ্ট গাড়ি হাজির হল আমি ধরেই নিয়েছিলাম এবার একটু ভালো খাওয়াদাওয়া করে হোটেলে গিয়ে একবার গড়িয়ে নেওয়া হবে। ও হরি, প্রথমেই নাকি যাওয়া হবে শেডাগন প্যাগোডা-র ছবি তুলতে। কেননা আমাদের আজ চলে যাওয়ার কথা আমরা যাকে চিরকাল মান্দালয় বলে জেনেছি। স্থানীয়রা দেখলাম বলেন মান্ডলে।


    বার্মিস চন্দন

    এই প্যাগোডার মধ্যে কলকাতার দুটো মহল্লা এঁটে যাবে। আর এর মূল চূড়ার বেশিরভাগ সোনার পাত-এ মোড়া। ফলে প্রবেশমূল্য চড়া এবং সুরক্ষাবলয় আঁটোসাঁটো। মিয়ানমার-এর সব প্যাগোডাতেই জুতো পরে প্রবেশ বারণ। মূল স্থাপত্যের চাতালে আরো ছোটোবড়ো উপাসনার জায়গা রয়েছে। আছে আমাদের লুপ্তপ্রায় তুলসীতলার মতো ছোটো ছোটো বাঁধানো বেদি। সেখানে ধূপ জ্বালিয়ে, জল ঢেলে আমাদের মা-কাকিমাদের মতোই প্রার্থনা করছেন মেয়েরা। বিক্রি হচ্ছে পুজোর উপচার আর নানা হাতে বানানো খেলনা, ঘর সাজানোর টুকিটাকি, খাবারদাবার — সব মিলিয়ে দারুণ এক ঝলমলে সমাহার। আমার সঙ্গীরা সময় নষ্ট না করে বসে, শুয়ে, গম্বুজের ফাঁক দিয়ে নানা কায়দায় ছবি তুলছেন। কোন একটা গাছের ডাল চন্দন কাঠের কায়দায় ঘষে নিলে একটা শাদা প্রলেপ তৈরি হয়। এখানে অনেকেই সেটা দিয়ে মুখ চিত্রিত করে নেন। প্রসাধন তো বটেই, রোদ থেকে চামড়াও নাকি বাঁচায়। আর রোদ আড়াল করার জন্যে রয়েছে অপূর্ব সব বাঁশের হাতলওয়ালা ছাতা। মিনার-গম্বুজ-এর যথেষ্ট ছবি তোলা হয়ে গেলে ফটো শিকারিরা লোকজনের দিকে নজর দিলেন। রঙিন ছাতা হাতে সৌম্যদর্শন এক সন্ন্যাসী সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা মাত্র তাঁকে টেনে নিয়ে একটা খিলানের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পটাপট ছবি উঠল খানকতক। তিনি স্মিত হাসলেন কেবল। ব্যাপারস্যাপার দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ছে যে তরুণীরা তাঁদেরও ছবি উঠল বিস্তর। ছবি তোলার চোটে চত্বরের ভিতরের বাজারের কেনাকাটা প্রায় লাটে। শেষমেষ ক্রান্তি আর সুধাকর খুব সুন্দর ছাতাওয়ালা একটি মাঝবয়সী লোককে পাকড়াও করে নিয়ে এল, আর সে ডানহাত পিছনের দিকে লুকিয়ে বর্মি ভাষায় কাকুতি-মিনতি করতে লাগল তার ছবি না তোলার জন্যে। তারপর হাত জোড় করার চেষ্টায় সে ডান হাত সামনে আনতেই ব্যপারটা পরিষ্কার হল, সেখানে ধরা রয়েছে ব্যবহার-মলিন একটি ক্যামেরা। সে ঐ চত্বরের পেশাদার আলোকচিত্রীদের একজন। স্বাভাবিক কারণেই সে এই বিড়ম্বনার হাত থেকে মুক্তি চায়।

    প্যাগোডার বাইরে

    দুপুরে খাওয়ার পর আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন আরো পাঁচজন মালয়েশিয়া থেকে আগত শখের ফোটোগ্রাফার। একটা মাঝারি আকারের বাসে চেপে আমরা চললাম মান্ডলে। আমাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা টুই জানাল পথ ছয় ঘন্টার।

    আগের দিন উড়োজাহাজ আর বিমানবন্দরে দীর্ঘ প্রতীক্ষার কারণে ঘুম হয়নি। অল্পক্ষণের মধ্যেই চোখ লেগে গেল। তারপর অনুভব করলাম আমাদের বাহন থেমেছে এবং আমাকে চা ইত্যাদি খাওয়ার জন্যে ডাকাডাকি করা হচ্ছে। নেমে দেখলাম ধু-ধু হাইওয়ে-র পাশে এক সাদামাটা দোকানে বাস থেমেছে। আমাদের পথপ্রদর্শক এবং মালয়েশিয়া-র সহযাত্রীরা দেখলাম একটা ভাত আর মুর্গির মিশ্রণ — কোনভাবেই যা চিকেন বিরিয়ানি নয় — সাঁটাচ্ছেন। প্রায় চার ঘন্টা চলে এসেছি আমরা, ঘড়ি বলছে। তাহলে তো আর ঘন্টা দুই রাস্তা বাকি। হোটেলে ঢুকে স্নান সেরে ভালো করে খাওয়া যাবে ভেবে চা আর সর্মাজি-র দেওয়া মুড়ুক্‌কু খেলাম। আবার বাসে উঠে ঘুম। চোখ যখন খুলল বুঝলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার হাইওয়ে ধরে বাস সেই একই গতিতে চলেছে এবং কোনো জনপদের আভাসমাত্র নেই। আর কতক্ষণ প্রশ্নের উত্তরে টুই নির্বিকারভাবে বলল আর তিনঘন্টা। ছেলেবেলায় ‘রাশিয়ার উপকথা’-য় একটা শব্দবন্ধ পেয়েছিলাম ‘সে গেল অনেক দূর কি অল্প দূর’। তারপর কখন জানি না, মাঝরাতের কাছাকাছি এক বিশাল কিন্তু গা ছমছমে নির্জন হোটেলের হাতায় এসে দাঁড়াল আমাদের গাড়ি। ভূত বাংলো-র চৌকিদারের মতো এক চরিত্র অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের যার যার নির্দিষ্ট ঘরের চাবি দিয়ে দিল। বোঝাই গেল এককণা খাবার পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। এয়ারলাইনস-এর দেওয়া খাবারের থেকে বাঁচিয়ে আনা একটা কেক খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    সকালে বেরোনোর জন্যে তৈরি হয়ে লবিতে এসে তো আমি হতভম্ব — আমাদের ব্রেকফাস্ট-এর আয়োজন করা হয়েছে! এবং ব্যবস্থা ভালোই। যদিও উত্তরটা জানতামই তাও গাড়িতে ওঠার সময় টুইকে জিজ্ঞেস করলাম কতক্ষণ লাগবে মান্ডলে পৌঁছোতে। টুই হাসিমুখে জানাল, তিনঘন্টা। দুপুর নাগাদ মান্ডলে ঢুকলাম। শহরের কেন্দ্রে এক বিরাট, সুদৃশ্য, পরিখা ঘেরা দুর্গপ্রাকার। আগে নাকি এটা প্রাসাদ ছিল, এখন জেল। এর কাছাকাছি হোটেল আমাদের। এই পরিখার পাশ সকাল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্যান্বেষীরা পূর্ণ করে রাখেন আমাদের রবীন্দ্র সরোবরের মতো। এর কাছেই এক ব্যস্ত রেস্তোরাঁ-তে খেতে গেলাম আমরা। মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুনের সুবাসে ম-ম করছে সেই দোতলা রেস্তোরাঁ। আমার দুই নিরামিষাশী বন্ধু উলটো দিকের ফলের রসের দোকানে পলায়ন করল।

    ভিয়েতনাম, লাওস বা থাইল্যান্ডের মতো এখানেও থালার চারপাশে গোল করে সাজানো ছোটো ছোটো বাটি। তবে সেখানে বাটিতে থাকে নানান সস। এখানে আছে দু-তিন রকমের ঝাল চাটনি, ভাজা পেঁয়াজ, লংকার গুঁড়ো আর পুদিনা পাতা। ভাত এখানেও মূলত স্টিকি রাইস। তবে চাপাটি, পুরি, দইবড়া, দোসাও কোথাও কোথাও বিক্রি হয়। থাইল্যান্ড বা ভিয়েতনামেও পাওয়া যায় এখন তবে তা ভারতীয় ভ্রমণার্থীদের ভিড়ের কারণে গজিয়ে ওঠা ভারতীয় খাবারের দোকানে। এখানে তেমন ভারতীয় ভ্রমণার্থী চোখে পড়েনি।


    উ বিয়েন ব্রিজে সূর্যাস্ত

    খাওয়ার পরেই একছুটে এখানকার বিখ্যাত গোল্ডেন প্যাগোডা দেখতে, থুড়ি প্যাগোডার ছবি তুলতে যাওয়া হল। শেডাগন থেকে ছোটো হলেও তেমনি সুন্দর। বিকেলের নরম আলোয় সোনালি আভা হয়ে আছে চারিদিক। এখানে অলসভাবে রাত্রি অবধি কাটিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে। কিন্তু আলোকচিত্রীদের কাছে আলোর খুব দাম। অমরাপুরায় রয়েছে প্রায় দু কিলোমিটার লম্বা কাঠের ব্রিজ উ বিয়েন। টউংথাং (আমার কানে তো এমনি শোনাল) হ্রদ-এর ওপরে সেই ব্রিজ থেকে সূর্যাস্ত দেখা, থুড়ি, সুর্যাস্তের ছবি না তুললে আর এখানে আসা কেন। সুতরাং আমরা গেলাম সেই ব্রিজ। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি। এমনকি প্রায় এক সহস্র খাম্বাগুলো যার ওপরে সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোও কাঠের। সুবিশাল আর পর্যটকদের প্রিয় বলেই হয়তো ব্রিজের মাঝখানে মাঝখানে রয়েছে বসার বন্দোবস্ত। পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের স্মারক, সরবত, খাবারদাবার।


    মৎস্যশিকার

    সাধারণ পর্যটকরা এসব দেখে খুশি হয়ে ফিরে যেতেন। কিন্তু আমাদের দল তো এসেছে ছবি তুলতে। তাই পরিকল্পনা হল ফের পরের দিন ভোরে সূর্যোদয় দেখতে, না না দেখতে নয়, যাকগে, পাঠক, এতক্ষণে তো ব্যাপারটা আপনারা ধরতে পেরেছেন। তবে মনে রাখবেন সূর্যোদয়-এর ছবি তোলা মানে কিন্তু আপনাকে পৌঁছোতে হবে সূর্য ওঠার বেশ খানিক আগে। তার সঙ্গে যোগ করুন হোটেল থেকে ব্রিজ অবধি আসার পঁয়তাল্লিশ মিনিট আর রাত থাকতে উঠে তৈরি হবার আধঘন্টা, একঘন্টা তাহলেই বুঝতে পারবেন রাতে কেমন তোফা ঘুম হয়েছিল। নিজের ভালো চান তো কখনও কোনো শখের ফোটোগ্রাফারদের পাল্লায় পড়বেন না। তবে হ্যাঁ দেখবার মতো বটে সেই সূর্যোদয়। বাড়তি দুটো লাভ হল। একদল জেলে তখন হ্রদে মাছ ধরছিলেন। জাল ছোঁড়ার চমৎকার সব ছবি পাওয়া গেল। দ্বিতীয় লাভ হল বাইক চড়ে একদল স্থানীয় ছবিখ্যাপাও হাজির হয়েছিল একই উদ্দেশ্যে। তাঁরা জানালেন আরো একটা দারুণ বাঁশের সাঁকো আছে, ঘন্টাদুয়েকের পথ। অতএব আমরা সদলে চললাম সেই না-জানি দেশের অজানি কী দেখতে। মানে ঐ আর কি। এসব লোককে আপনি যদি ভ্যাটিকান প্রাসাদও দেখতে নিয়ে যান এরা খুঁতখুঁত করবে তার আঙিনায় একটা ছোট বাঁশের সাঁকো নেই বলে।


    সাঁকো পারাপার

    তবে হ্যাঁ, গিয়ে মনটা জুড়িয়ে গেল। ছোট্ট এক অপরূপা পাহাড়ি নদীর ওপরে লম্বা এক বাঁশের সাঁকো। আমরা যে রাস্তা দিয়ে এসেছি সেটা একটু উঠে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেছে। অন্য পাড়ের পিছনে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পাহাড়। দুই পাড়ের মাঝে এই সাঁকো। হাওয়ায় হালকা কুয়াশা। বলতে ভুলে গেছি মান্ডলেতে অন্তত শেষ ফেব্রুয়ারিতে সকাল সন্ধ্যায় হাওয়া বেশ ঠান্ডা। দলপতির নির্দেশ অনুযায়ী আমরা পাড় থেকে নেমে হিমশীতল নদীর মাঝামাঝি হাঁটুজলে ক্যামেরা বাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দাঁড়িয়েই রইলাম। দু একটা শাটার পড়ল বটে তা নিতান্ত আলোটা মেপে নেওয়ার জন্যে। তারপর একসময় সমবেত মর্মরিত আনন্দধ্বনিতে চটকা ভেঙে দেখলাম এক পাহাড়ি পরিবার সাঁকো পার হচ্ছে, সামনে একটি কিশোর, বাবার কাঁধে কাটা ঘাসের বোঝা, মা-র কোলে এক নিতান্ত শিশু। শাটারের ঝড় উঠল। পরে আরো দু-চার জন সাঁকো পারাপার করল কিন্তু আলোকচিত্রীরা এক মত প্রথমটাই সেরা ছবি। আলো কড়া হয়ে গেলে সবাই মিলে নদীর পাড়ের ছোট্ট দোকানে চা-বিস্কুট খাওয়া হল। অতঃপর ফেরা।


    বুদ্ধমূর্তি গিলটি করার কারিগর

    এইভাবেই কাটল আরো একদিন। কোনো দর্শনীয় জায়গা আমাদের দেখা হল না। কোথায় লোকেরা ঝুড়ি বুনছে, কোথায় বুদ্ধের মূর্তি গিলটি করছে তার ছবি তুলেই কেটে গেল সময়।


    ইন লে লেকের ভোর

    এবার আমরা যাবো শান প্রদেশের ইন লে লেক-এ। টুই বলল ঘন্টা ছয়েকের রাস্তা। সুতরাং ঘন্টা বারোর জন্যে মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম। লাগলও তাই। যখন কোথাও পৌঁছোনোর আশা ছেড়ে দিয়েছি তখন এক প্রায়ান্ধকার নৌকাঘাটায় এক খাবারের দোকানে আমাদের বলা হল নৈশভোজ সেরে নিতে। তারপর আধো অন্ধকারে গোটা ছয়েক ভুটভুটি মার্কা নৌকা চড়ে আমরা হাজির হলাম চমকদার এক রিসর্টে। লেক থেকে ওঠা কাঠের স্তম্ভের ওপরে প্রায় তারার আকারের এই রিসর্ট। প্রথমে রিসেপশন আর ডাইনিং হল, তাকে ঘিরে চতুর্দিকে লম্বা লম্বা কাঠের রাস্তা ধরে গেলে তার সঙ্গে লাগানো ছোটো ছোটো কামরা। ঘরগুলোর বাইরের দিকটায় বেশ চওড়া বারান্দা। তাতে গদি-আঁটা চেয়ার। বাথরুম ঝকঝকে, ফরসা তোয়ালে সেখানে, আর বাথটাব। তর হয়ে গেলাম। বিদ্যুৎ রাত এগারোটা থেকে সকাল পাঁচটা অবধি পাওয়া যাবে না কারণ পুরো ব্যবস্থাটা জেনেরেটর নির্ভর। আলো নিভে যাওয়ার পর বারান্দার দিকের জানালা দিয়ে দেখলাম এক প্যাগোডার সোনালি চূড়া জ্বলজ্বল করছে। চোখ বুজে আসতে না আসতেই এলার্ম বেজে উঠল। ওইরকম মনে হল আর কি। ফোটোশিকারিদের দিন শুরু হয় রাত থাকতে। তাই বেশি রাতে ঘুমোলে বেশিক্ষণ ঘুমোনোর সুযোগ নেই।

    জলের সংসার


    কাপড় রাঙানো বালিকা

    ইন লে লেক বেশ আলাদা এক জগত। এখানের অধিবাসীরা জলের বাসিন্দা। কাঠের রণ-পা-এর ওপর দাঁড়ানো সব কাঠের বাড়ি। কেউ মাছ ধরেন, কেউ জলের ওপর ভাসমান ক্ষেত তৈরি করে সেখানে সবজি চাষ করেন। আর আছে হাতে কাপড় রং করা আর ধাতুর গয়না আর খেলনা তৈরি করার শিল্প।

    ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের মেছুড়ে


    ইন লে লেকের নিজস্ব কায়দা

    এঁদের জেলেরা একটা হাত আর এক পা দিয়ে এক আজব কায়দায় নৌকা চালায় আর তিনকোনা শঙ্কু আকারের জাল ফেলে মাছ ধরে। ফলে ফোটোগ্রাফাররা হাতে চাঁদ পেয়েছে। দুদিন ধরে চলল ছবি তোলার মহোৎসব। তার কিছু কিছু আপনাদের কাছে পেশ করে এবারের মতো ক্ষান্ত দিচ্ছি।

    ইন লে লেকে দিনবসান


    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments