• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • মূর্খ : যশোধরা রায়চৌধুরী

    মঞ্জু যখন তার দিকে পেছন ফিরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়, ওর চলন বলন দেখে মনীষা কেমন তীব্র ভাবে অনুভব করে ঘৃণাটা। একট মানুষের মূর্তি এতটা বিরক্তি ও রাগ পয়দা করতে পারে শরীরে? মনীষার অসহ্য লাগছে। মাথা দপ দপ করছে। শিরায় শিরায় বিরক্তি ছুটছে। রগে রগে ঘৃণা বইছে।

    যতটা রাগ হয় ততটা অবশ্য বলতে পারে না মঞ্জু। হাজার হোক সমাজের প্রিভিলেজড ক্লাস, কথায় কথায় মুখ খারাপ করতে তো পারে না। অন্তরে বিষের ঝুড়ি। মুখে হাসির ফুলঝুরি। এরকম থাকাই অভ্যেস মনীষার। তাও, ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে ফুঁসতে মনীষা বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে হাসি-ভর্তি, তেতো মন্তব্য করে। ব্যঙ্গ-মজার তুবড়ি বানায়।

    বাইরে বলে, ওহে বুদ্ধির বৃহস্পতি, না-কামীর সরস্বতী, গুণের বিশাল সমাহার… পনেরো মিনিট আগে চা দিতে বলেছি, চা-টা কি এবার দয়া করে পাব?

    ভেতরে ভেতরে কষে গালাগাল দেয়, তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, বেকুব বুড়ি কোথাকার, ধান শুনতে কান শুনিস, মাথার মধ্যে আছে কি তোর, গোবর পোরা?

    রান্নাঘর যেন মঞ্জুর আচ্ছাদন, তার ঢাল। সুড়ুত করে রান্নাঘরে ঢুকে গেলে মঞ্জু আর কিছু শুনতে পায় না। মনীষা যা বলে একটা জিনিসও ঠিকঠাকভাবে না করার অধিকার যেন ওকে ওই রান্নাঘরটাই দিয়েছে। ওর ভেতর থেকে নাকি বাইরের আওয়াজ যায় না অথবা বিকৃতভাবে যায়। ফলত মঞ্জুকে চারবার ডাকার পর ও একবার আসে, আঁ? ক্যা বোল রহে থে?

    চা দিতে বললে জল চড়ায় একঘন্টা ধরে, তারও বহু পরে অনেক ফুটে যাওয়া কালো একটা তরল এনে হাজির করে। তারপরও ফ্রিজ থেকে দুধের গুঁড়ো বার করে দিতে ভুলে যায়, চামচ, প্লেট দিতে ভুলে যায়।

    - চায় কাঁহা হ্যায়।

    - চড়াতানি।

    - মিল্ক পাউডার কাঁহা হ্যায়।

    - দেতানি।

    উত্তরপ্রদেশের গ্রামের অদ্ভুত ডায়ালেক্ট এসব কথা বলে, আতানি, যাতানি। শুধু ভাষার দূরত্ব কি? অদ্ভুত শরীরী অনিচ্ছা, মানসিক বাধা, সব মিলিয়ে মাইল মাইল দূরের মঞ্জু। অফিস থেকে ফেরা হা-ক্লান্ত মনীষা আর এক কাপ চায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। মনীষার হাতে-কাছে থাকা ইলেকট্রিক কেতলি আর টি ব্যাগ অনেক বেশি হ্যান্ডি, সহজ, আয়ত্তাধীন। তাও মনীষা মঞ্জুর কাছেই চা চায়। সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে আছে, কাজ করাতেই হবে।

    চা-টাও বানাবে না, তাহলে ও করবে কী? মাছের ঝোল পারে না, মনীষা রেঁধে নেয়। ডাল আর ভাতটা অতিকষ্টে শিখেছে। আর পারে করলাভাজাটা, মোটামুটি। শুধু ওই এক কষামাংসের ভুনাঝোল দারুণ রাঁধে। বাকি সবকিছু এলোমেলো, অগোছালো, না হলে ভুল। বিশেষত মনীষা যা যা বলে সব ভুল করাটাই যেন ওর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। অথবা নিয়তি।

    এখুনি যেমন, মাছের ঝোলের আলু কাটতে গিয়ে লম্বা লম্বার বদলে কুচি কুচি করে ফেলার পর ওকে প্রায় দূর দূর করে রান্নাঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে মনীষা।

    ও চলে যাচ্ছে।

    ওর গমনপথের দিকে দেখছে মনীষা, চলমান ছোটখাটো মঞ্জুর মাথার শীর্ণ শুষ্ক আকারের দিকে কষকষে চোখে দেখছে। ভেতরে ক্ষোভ আর তীক্ষ্ণ ক্রোধের হলাহল পাক খাচ্ছে, বুড়বুড়ি কাটছে, কন্ঠনালী দিয়ে উঠে আসছে সবুজরঙা পিত্তের মত বিরক্তি।

    অফিসে গিয়ে টিফিন খুলে দেখে মনীষার মাথায় রাগ চড়ে গেল। আপেলের গায়ের স্টিকার শুদ্ধু কেটে দিয়েছে মঞ্জু। বাড়ি আসার পর ডিমপরোটা করে দিতে বলল। তাতেও আশ্চর্যভাবে নুন দিতে ভুলে গেল মঞ্জু, পরে বলল মনীষাই নাকি কবে নুন বেশি হয়ে যাওয়ায় মুখ বেঁকিয়েছিল।

    এদিকে ফেসবুকে গৃহসহায়িকাদের নিয়ে ভালো পোস্ট। মানবিক পোস্ট। দিতেই হয়। দেয়ও।

    কিন্তু এই মুহূর্তে তার মঞ্জুর অপসৃয়মান চেহারাটা দেখে শুধু রাগ, ঘৃণা, বিরক্তি আসছিল। সে ভাবছিল মানুষ এত মূর্খ হতে পারে? এ এক তাজ্জব ব্যাপার, মনীষা না বললে কিছুই করে না মঞ্জু, কিন্তু যা যা বলে মনীষা, মঞ্জু সচরাচর তার উল্টোটা করে। ফলত রোজ মনীষা বলে, আমি কী বলছি বুঝতে পারো না মঞ্জু? আমি যা বলছি তা কি জার্মান ভাষায়? না জাপানি?

    মূর্খতা কি কোন অপরাধ? না না, মূর্খতা কোন অপরাধ নয়। বরং চালাকি অপরাধ। অন্যের ওপর দিয়ে এক হাত নিয়ে নেওয়া চালাকের দলকে মনীষা হাড়ে চেনে। চালাক, চোর, পুকুরচুরির পি এইচ ডি, কামচুরির ডক্টরেট, এসব স্যাম্পল দেখতে দেখতে চোখ পচে গেছে। আজই বিনায়ক শুক্ল তাকে আই টি রিটার্ন নিয়ে জ্ঞান দান করে, টেবিল থেকে মনীষার একটা ভাল পেন উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে। আরেক বাঙালি ধড়িবাজ অপরাজিত গাঙ্গুলি। অপরাজিত এগিয়ে চলেছে। অন্যদের ডজ করে বা টপকে। সব কাজের তলায় চোরা স্রোতের মত অপরাজিতের অপ্রতিহত চালাকি আর আত্মকেন্দ্রিকতা। সুপিচ্ছিল এক পথ, যে পথে গড়গড় করে চলে সাফল্যের রথ।

    নিজের কলিগদের ভেতরে সে যত এক্স রে চোখ দিয়ে পড়ে নেয় চালাকির অন্ধিসন্ধি, মনীষা সারাদিনে তত বেশি মূর্খদের সম্মুখীন হয় না। মূর্খ কম এ জগতে, চালাক বেশি। তবু, চালাকদের দেখলে অন্যরকম। এই সেন্স অফ ডিসগাস্ট, এই চিড়বিড়ে অস্বস্তি, মানুষটার মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দেবার ইচ্ছে হয় না। চালাক লোকগুলো সামাজিকভাবে তার চেয়ে এগিয়ে আছে? তাই? ও-ও ওদের মত চালাক হতে চায় কিন্তু ওদের দেখলেই বুঝতে পারে নিজে কিছুটা বোকা, তাই?

    মনীষা তো চালাকদের কাছে পৌঁছতে চাইছে। ত্যাগ করতে চাইছে না।

    মূর্খতাকে ত্যাগ করতে চাইছ তুমি, কারণ তুমি মূর্খ থেকে চালাকে উত্তীর্ণ হতে চাইছ...। তাই কি মূর্খতাকে কেবল আঘাত করতে ইচ্ছে করে?

    মনীষা মনকে প্রবোধ দিতে চায়, ভাবে, মূর্খতা কোন দোষ নয়। দোষ হলেও অপরাধ নয়।

    তাও মূর্খ মঞ্জু আন্টিকে ওর এত অসহ্য লাগে কেন? বডি ল্যাংগুয়েজের আকাটপনা, কাজে এলোমেলো আনস্মার্ট ভাব, গায়ে একটা রী-রী ভাব আনে। কেন? কেন?

    মূর্খতা চোখের ওপর দেখা খুব কষ্টকর। চালাক লোকেদের শরীরী ভাষা আকর্ষক। তৎপর চটপটে ভাব, নিবিড় ধান্ধাবাজি, এগুলো দেখে মানুষের চোখ চকচক করে ওঠে। প্রাণ হাঁকপাকায়। মন বলে, এখুনি ওইরকম চালাক হতে চাই।

    মঞ্জু আন্টিকে একবার মাত্র বলা হয়েছিল ঘষুনি দিয়ে ঘষে ঘষে গাজরের স্যালাড করতে। "স্যালাড" কথাটা উচ্চারণ মাত্রেই মঞ্জু ঘষুনি নিয়ে ঘষতে বসে যায়। একদিন টমেটো শশা গোল গোল করে স্যালাড বানাতে বলেছিল, সেদিন আবার মঞ্জু ঘষে দিল গাজর শশা। চিৎকার করতে লাগল মনীষা।

    চিৎকার করতে করতে মনীষা বুঝতে পারে মঞ্জু তার কথা শুনছে না। তাকিয়ে আছে, কিন্তু মানে বুঝতে পারছে না। ওর মাথার ওপর দিয়ে মনীষার চিৎকার ভেসে ভেসে কোথায় চলে যাচ্ছে।

    এবার যেন রেগে জিনিস পত্র ছুঁড়ে দেবে মনীষা। সত্যিই এই গোবর অখাদ্য সব খাবার ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। ঝনঝন করে নাটকীয় ভাবে থালা ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে মনীষার। ঠিক সিনেমার অত্যাচারী গৃহকর্তাদের মতন। মঞ্জুর ওই কুঁকড়ে থাকা, আনস্মার্ট দেহভঙ্গি যেন ঠিক ওইটিই চাইছে।

    পুরনো কলিগ, এই আবাসনে থেকে গেছে। সে বলল, আরে মঞ্জু নামে তুমি কি কোন কাজের মেয়ে রেখেছ নাকি?

    হ্যাঁ। মেয়ে আবার কি। আধবুড়ি।

    আরে ওর তো অনেক কেচ্ছা। শি হ্যাজ এ পাস্ট!

    কেচ্ছা? সে কী?

    মূর্খ জানত! কিন্তু কেচ্ছাও থাকতে পারে ওই মস্তিষ্কে ঝামা ধরে যাওয়া মহিলার অতীতে?

    ওর বর মারা গেছিল, দশ বছর আগে, অ্যাক্সিডেন্টে।

    হ্যাঁ, বিধবা বলেছে তো। সেজন্যেই রেখেছিলাম ওকে, ঝাড়া হাত-পা হবে বলে। ফেঁসে গেছি তাতেই।

    বিধবা বলেছে, কিন্তু বরটা কীভাবে মরেছে জানো কি?

    না তো?

    বরটা পিয়াক্কর ছিল। খুব মাল টানত। আর অত্যাচার করত মঞ্জুর ওপরে। সারাক্ষণ চেঁচাত। গায়ে হাত তুলত। মেকানিক ছিল। টাকা বাড়িতে দিত না। মাল খেয়ে চলে আসত। শুঁড়িখানায় টাকা ঢালত।

    তারপর? মনীষা মনে মনে দৃশ্যটা দেখতে পায়। প্রথমে চিৎকার। মঞ্জুর চৌকোমতন বরটা খুব চেঁচাত যখন মঞ্জু তখন হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। মঞ্জুর মনে কোন বিকার হত না, সে দেখত একটা ভাঙাচোরা দ মুখ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সে শুধু হাঁ করছে আর পোকাধরা দাঁতগুলো নড়ছে। আর গাঁক গাঁক, গাঁক গাঁক, একটা আওয়াজ আসছে শুধু। অর্থহীন চীৎকার। মঞ্জু মূর্খ থেকে মূর্খতর হয়ে যেত।

    বান্ধবী বলে চলে, তো, মঞ্জুর বর ওকে পেটাত, মাল খেয়ে চেঁচাত। পাড়া মাথায় করত। তারপর একদিন পট করে মরেই গেল।

    কীভাবে? কীভাবে?

    ভাবো, আমাদের এখানের টাওয়ারগুলো কেমন। বারান্দার পাঁচিল কত উঁচু। সেই পাঁচিল থেকে নিচে পড়ল। ভাবো! চারতলার বারান্দায় কে উঠে বসে? ও নাকি মাল খেয়ে বারান্দার প্যারাপেটে উঠে বসে থাকতে থাকতে পড়ে গেল। মাথা ফেটে স্পট ডেড।

    বান্ধবীর ইঙ্গিত স্পষ্ট। মঞ্জুর বৈধব্যের গল্পটা শুনে কাঠ হয়ে বসেছিল মনীষা।

    কিছুদিন সামলে-সুমলে আছে মনীষা। মঞ্জুর মূর্খতা দেখে, ও জাস্টিফাই করে। মনে মনে ভাবে মঞ্জু ইচ্ছাকৃত করছে না এসব। আসলে স্বামীর দীর্ঘকালীন অত্যাচারে মনের ভেতরে আদ্ধেকটা মরে গেছে। মনীষা ভাবে ওর আসলে ডিপ্রেশন। ওকে অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট কিনে দিতে চায় মনীষা। দেয় না, ধুর, তা দেওয়া যায় নাকি! সর্দি হলেও মঞ্জু ডাক্তার দেখায় না, মঞ্জুকে কি ও মনোবিদ দেখাতে বলবে নাকি? অসম্ভব তো।

    উল্টে, মঞ্জুর সাথে কয়েকদিন মনীষা ভাল ব্যবহার করে। ভাবে বছরের পর বছর মাতাল বরের পিটুনি খেয়েছে এই মহিলা। ভাবে গালাগালি শুনতে শুনতে ও গালাগালি-প্রুফ হয়ে গেছে। ওর মাথা ঝামা হয়ে যাওয়ার কারণগুলো যেন এবার ভাল করে বুঝতে পারে মনীষা। ভাবে, এইভাবেই কত মেয়ের জীবন যাচ্ছে। বিধবা অবস্থাটা আরো ভয়ানক যদিও... তবু এ সমাজে একা মঞ্জু নিজের ছেলেকে পেলেপুষে বড় করেছে, সে এখন স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে গিয়ে সস্তা প্লাই কাঠের মডিউলার ফার্নিচারগুলো সারায়... অন্তত এটুকু তো পেরেছে মঞ্জু। সারাজীবনের চাপে ও তাপে ওর অকালবার্ধক্য এসেছে। সেটাই ওর সব ভুলে যাওয়ার, সব ভুল করার কারণ। নিশ্চিত।

    তারপর আবার একদিন রোগ রিল্যাপ্স করার মত, মনীষার রাগ রিল্যাপ্স করে।

    অফিস থেকে ফিরে মনীষা বলে, চা দাও। খুব ক্ষিদে পেয়েছে, দুটো রুটি করে দাও তো গরম গরম।

    দুটি পোড়া পোড়া দেখতে কালো রুটি আসে। রাগির রুটি আবার ভুল করে বানিয়েছে মঞ্জু। উফ। চা হাকুচ কালো। তবু মনীষা কিছু বলে না। ফোন হাতে নেয়, অনলাইন শপিং করে নিজেকে খানিক ভোলাতে চায় সে।

    স্বাভাবিক গলায় বলে, রান্নাঘরে কিছু কি ফুরিয়েছে মঞ্জু?

    মঞ্জু যথারীতি কিছু মনে করতে পারে না। ওর ওইটুকু মাথার খোপরিতে শুধু জঞ্জাল অথবা ভুষা ভরা আছে, আবার প্রমাণ হয়। ও কী কী ফুরিয়েছে দেখবে বলে ফ্রিজের দরজা খুলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে, সব্জির ড্রয়ারটা টেনে বলতে থাকে, বেইংগন হ্যায়, মুলি হ্যায়, ফুলগোবি হ্যায়।

    মনীষা চিৎকার করে ওঠে, আবার শুরু করেছিস সেই নৌটংকি। কে তোকে বলেছে ফ্রিজের দরজা খুলে এক ঘন্টা দাঁড়াতে। কামচোর, মনে করে বলতে পারিস না? কী কী ফুরায়, যখন বানাতে বলি তখন তো বলিস এই নেই সেই নেই। আজ দুধ নেই তো কাল আলু নেই তো পরশু পেঁয়াজ নেই। এখন কী দেখছিস? তোকে দুধ এনে রাখতে বলা হয়েছিল আমূলের বুথ থেকে, এনেছিলি?

    মঞ্জুর চোখ বিস্ফারিত হয়, মুখ ফ্যাকাশে হয়। স্যরি, ভুলে গেছি।

    স্যরি, স্যরি, স্যরি। দিনের মধ্যে পনেরোবার স্যরি বলিস, তোর নৌটঙ্কি আমি আর সহ্য করব না। যে কাজ করতে বলা হয় ভুলে যাস কেন?

    ছাপ্পান্ন বছরের মঞ্জুকে আটান্ন বছরের মনীষা নিজের ভদ্রতা সভ্যতা শিক্ষা সব শিকেয় তুলে তুই তুই করে বলে। মনীষার সেই সহকর্মীই যাবার আগে মূল্যবান কথাটা বলে গিয়েছিল। কাজের লোকেদের উত্তরভারতীয়রা তু তু করে বলে। ওদের সম্মান দিয়ে আপ আপ করে কথা বললেই মরবে।

    মাখন ফুরিয়েছে, পাউরুটি ফুরিয়েছে, মনীষা নিজের চায়ের কাপ ফেলে এবার ফ্রিজের দিকে ধাবিত হয় - জ্যাম বহুদিন ফুরিয়েছে। তুই জানিস না? সারাদিন রান্নাঘরে ঢুকে কী করিস? রান্নাঘরে কী করতে আসিস? রাগ চড়তে থাকে, মনীষা নিজেকে ধীরে ধীরে ট্রান্সফর্মড হতে দেখে। ক্রমশ আরো ক্রুড, আরো অসভ্য, আরো অধৈর্য। মঞ্জু মূর্খ না অতিচালাক, ডিপ্রেসড না বদমাস? আগুন ভর করে ওর মাথায়।

    আর চিৎকার করতে করতে মনীষা টের পায়, ওর ওপরে মঞ্জুর সেই মরে যাওয়া স্বামীর ভর হয়েছে যেন। ও একটা অন্য লোকে রূপান্তরিত হয়েছে। চ্যাপ্টা চৌকো, ব্রাউন সোয়েটার পরা, গলার কাছটা ছেঁড়া সেই সোয়েটারের। হুবহু সেইরকম খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর গোল মুখ, ফাটাফাটা গাল, আর ঠোঁট, আর কালো পোকাধরা অনেকগুলো দাঁত। সাংঘাতিক মেজাজ। মাতালের মেজাজ। পুরুষের মেজাজ।

    অতকিছুও না। মনীষাই মঞ্জুর স্বামী হয়ে গেছে। স্বামী মানে কর্তা, মালিক, অধিকারী। হ্যাঁ তাই তো, তাই তো। নিজের বাড়ির হাতায়, সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে থাকবে না হলে কীভাবে মঞ্জু। বেল টিপে যখন তখন ডাকা যাবে মঞ্জুকে। এক প্রকারের মালিকই তো। তাই তো মনীষা মঞ্জুকে ভাঙার, গড়ার, তাচ্ছিল্য করার অধিকারী। একটা মানুষকে নস্যাৎ করার অধিকারী।

    ঠিক স্বামীর মতই। এই দেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ের স্বামী।

    আর মঞ্জু ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু শুনছে না। শুধু একটা শব্দের ঢেউ চলে যাচ্ছে মঞ্জুর মাথার ওপর দিয়ে। গাঁক গাঁক, গাঁক গাঁক।

    চিৎকারে মঞ্জুর কিছু হচ্ছে না। ওর কোন হ্যাতক্যাত নেই।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments