চরণে বন্ধন নাই, পরাণে স্পন্দন নাইএই দুই লাইনের পর চিত্রিত হয়েছিল সেই দৃশ্য, যেখানে একটা জায়মান বিস্ফোরণ অচেতন সুপ্ত দশায় পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। এই দৃশ্য থেকে হারবার্ট ঘুরে তাকিয়েছে সেই পোস্ট কোলোনিয়াল পিরিয়ডে যখন তার পাশ্চাত্য জীবনমুখী বাবা তৎকালীন বাবু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। সেই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবারের পিতৃমাতৃহীন হারবার্ট কীভাবে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠেছে এবং সমাজ কীভাবে তাকে বাতিল করতে চেয়েছে সেই দিকে ফিরে গেছে সে।
নির্বাণে জাগিয়া থাকি স্থির চেতনায়,
--বিজয় চন্দ্র মজুমদার
এই সুস্থিত সমাজের কক্ষপথে ঘূর্ণমান অস্থির ইলেকট্রন হারবার্ট সরকারের জন্ম দিয়েছেন নবারুণ। ফোকাস করেছেন ডিসটোপিয়ায়। একের পর এক ভাঙনের দৃশ্য, অবক্ষয়ের দৃশ্য, মৃত্যুচেতনাকে মিশিয়ে দিয়েছেন হারবার্টের জন্ম, বেড়ে ওঠা, মৃত্যু এবং মৃত্যুর পরবর্তী অ্যাবসার্ডিটির সঙ্গে। জন্মাবধি নবারুণ তাকে বাড়িয়ে তুলেছেন এক র্যানডম ভঙ্গিতে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সংলাপ, অনর্থক উচ্চারণ, লুকিয়ে পড়ার প্রবণতা, ভারসাম্যহীন এলোমেলো প্রকাশ এই সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটা অসহনীয়তাকে প্রকাশ করে। বন্ধু রবির মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিল হারবার্ট। সেই সময়কার কিছু অস্থির সংলাপ তার মানসিক অবসাদকে সূচিত করে।
"আমাব নাম হাববার্ট। আমি বাঁট। বাঁট দেখেচো। এবাব লাট দেখবে।"
"মখমোলায়েম ঘাসফুলেল মাঠে হূরিপরীদের খেলা।"
"ঘুড়ি, এবোপ্লেন, বেলুন, ঝুলঝাড়ু, মানুষ, প্যারাসুট, পাখি--সবই একসময় নেমে আসে। অথচ তার আগে ওঠে। ওটাও ওঠে। নেমে আসে।"
"মানুষ যদি ১ হয় তাহলে ০ হল মরা মানুষ। মানুষ + মরা মানুষ = ১+০= ১=খোডোরবি।" এক মরবিড ক্যালকুলেশন।
একটা জীবন জুড়ে এই অসহনীয়তাকে তৈরি করতে এবং তার মধ্যে বারবার বিপর্যস্ত হওয়া হারবার্ট সরকারকে বোঝানোর জন্য নবারুণ স্যাটায়ার তৈরি করেছেন। অত্যন্ত সচেতনভাবেই এই উপন্যাসের কোথাও কেঊ খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ঊঠতে পারেনি। কারণ উপন্যাসকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে হারবার্ট সরকার। স্পষ্টই এই নিয়ন্ত্রণকেই বজায় রাখতে চেয়েছেন নবারুণ। একটি মধ্যবিত্ত চরিত্র তৈরি করেছেন যা রাজনৈতিক মতাদর্শে সরাসরি দীক্ষিত নয় অথচ রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত। উপন্যাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালীন সময় থেকে শুরু করে পোস্ট কলোনিয়াল সময়ের একটি পরিস্থিতিকে তুলে ধরা হয়েছে যে সময়ে বাংলায় নকশাল আন্দোলন সমাপ্তি পর্যায়ে পৌঁছেছে। নকশাল পরবর্তী সময়ে, তরুণদের যখন ব্যাপক ধরপাকড় করে আন্দোলনকে পুরোপুরি দমিয়ে দেওয়া হয়েছে তখনও তরুণ সমাজের চোখে কিছু স্বপ্ন লেগেছিল দাগ হয়ে। তখনও তারা স্বপ্ন দেখত অ্যাপোক্যালিপ্সের। বিনু মরতে মরতে সেই অ্যাপোক্যালিপ্সের কথা বলে গেছিল। হারবার্ট সেই অ্যাপোক্যালিপ্সের কথা বলেছিল এবং শেষপর্যন্ত তার মৃত্যু ধ্বনিত করেছিল সেই অ্যাপোক্যালিপ্সকে। হারবার্ট সরকারের জীবন শুরু হয়েছিল তার পাশ্চাত্য জীবনশৈলীর দিকে ঝুঁকে থাকা বাবার মৃত্যু এবং,তদ্পরবর্তীকালীন মায়ের মৃত্যু দিয়ে। এখানেই তার জীবনের মোক্ষম মোচড়। এখানেই সে সামাজিকভাবে পরিত্যক্ত। এখানেই তার স্নানঘর বাইরের লোকদের জন্য নির্মিত গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধতা ঘৃণিত শ্রেণির প্রতি ঊচ্চবর্গের মানুষের। অথচ ওই পরিবারের অন্তর্গত হারবার্ট সরকারের কাকা মার্ক্সবাদে দীক্ষিত। এই শোষণ এবং শোষিতের এই সংযোগে জন্ম নেওয়া বিরাগ থেকে বৃহত্তর প্রতিবাদকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে গেছিল বিনু। বিনুকে ভালোবাসত হারবার্ট। বিনু হারবার্টকে ঘৃণা করেনি কখনো। বিনুর কাছ থেকেই সে সমাজতন্ত্রের ধারণা পায়, রাশিয়া, কমিউনিজম এবং তার নির্মাণ সম্পর্কে জানতে শুরু করে। বিনুর কাছেই সে পড়ে জন রিডের লেখা বিখ্যাত বই ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’। বিনুর মৃত্যু হারবার্টকে আঘাত দেয় এবং মৃত বিনুর স্বপ্ন তাকে অলৌকিক করে তোলে। জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে মৃত্যুর প্রতি আস্থাভাজন হয়ে পড়ে সে। পরলোক সংক্রান্ত বই পড়তে পড়তে সে মৃতের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। এই নির্মাণ সুপরিকল্পিত ছিল না কিন্তু একটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল। এই অ্যাবসার্ডিটি হারবার্ট সরকারের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিজেকে প্রয়োজনীয় মনে করে একটা অস্থির বিন্যাসের মধ্যে দিয়েই সে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। এই অস্থিরতার প্রকাশ করতে নবারুণ হারবার্টের সংলাপকে জটিলতার সঙ্গে অর্থহীন করে তুলেছেন। প্যারালাইজড জ্যাঠামশাইয়ের মুখে তার একমাত্র চেতন শব্দ বসিয়েছেন বিচিত্র ধ্বনিতে। 'পিউ কাঁহা' 'পিউ কাঁহা' শব্দবন্ধ প্রতিবার অস্বস্তিতে ফেলেছে হারবার্টকে। এই ধ্বনি যা আপাতভাবে ব্যঙ্গাত্মক তাকে বারবার উচ্চারণ করে নবারুণ সমাজের তথাকথিত উচ্চশ্রেণির বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং রাগের প্রকাশ করেছেন।
হারবার্ট জানত সমকালীন সমাজ তাকে অস্বীকার করতে চায়। সে অপাঙক্তেয়। সে হয় হাস্যকর, নাহয় নিপীড়িত নতুবা সে নেই। তাকে দেখা তাকে না দেখারই সামিল। সেও নিজেকে সমসাময়িকতার থেকে আড়ালে রাখতেই চেয়েছিল। তার প্রবণতা ছিল নিজেকে লুকিয়ে জীবন পর্যবেক্ষণ করবার। সে চিলছাদের ট্যাঙ্কের ভিতরে সহজ বোধ করত। সেখান থেকে আকাশ দেখত। সেখানেই লেনিন পড়ত। সেখানেই চর্চা করত সমাজতন্ত্রের। আবার ওই চিল থেকেই সে তার কৈশোরের প্রেমের টান বুকিকে দেখতে পেত। নবারুণ লিখেছেন, ‘চিলছাদটাই ছিল হারবার্টের জায়গা। ঐ চিলছাদেই হারবার্ট সবকিছু উপলব্ধি করেছিল। যে আশ্চর্য স্বপ্ন তাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি দিযেছিল অথচ প্রকারান্তরে যা ছিল তার সমূহ বিনাশেব কারণ সেই স্বপ্নও হাববার্ট দেখেছিল এই চিলছাদেই। চিলছাদে ছিল গঙ্গাজলের ট্যাঙ্ক।’
সে হয়তো সমকালীন সমাজতন্ত্রের ধারণা, কমিউনিজম, বহির্বিশ্ব এবং দরিদ্র, নিপীড়িত শ্রেণির একটি ধ্বস ছিল যা জেগে উঠেছিল একটি প্রশ্নচিহ্ন হয়ে এবং নিভে যাওয়ার সময় একটি বিস্ফোরণ ছিল যাকে প্রতিবাদ বলা যেতে পারে। এই প্রতিবাদের প্রণেতা নবারুণ। এটি শুধু হারবার্ট সরকারের নয়, এটি নবারুণের প্রতিবাদ। বিপ্লবের প্রতি আজীবন বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও, নবারুণের এই লেখা সমসাময়িক কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন রাজ্য এবং বিশ্বের ক্রমবর্ধমান আমেরিকানীকরণের দমনমূলক শাসনব্যবস্থার উল্লেখ এবং বিদ্রূপ, কখনও কখনও তীব্র সমালোচনায় পরিপূর্ণ। ‘হারবার্টের’ হিন্দি অনুবাদ করেন মুনমুন সরকার ও ইংরেজিতে অনুবাদ করেন জ্যোতি পঞ্জোয়াতি। নবারুণ নিজে লিখেছেন, ‘হারবার্ট লেখার সময় দুনিয়ার বামপন্থার শোচনীয় অবস্থা ছিল।’ উপন্যাসের বিষয়টি সম্বন্ধে নবারুণ বলেছিলেন, ‘এটি হল ক্যাপিটালের সাথে হিউমানিটির লড়াই।’
হারবার্ট আত্মহত্যা করার আগে একটি অদ্ভুত সুইসাইড নোট লিখে গেছিল।
‘চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চলল। দোবেরের চ্যাং দেখবি? দোবেরের চ্যাং, দেকাব? ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিস’ এ কথার কোনো অর্থ হয় না। এই অর্থহীনতা তার মানসিক অবস্থাকে ভারসাম্যহীনতার অন্তর্গত করে এবং সেইসঙ্গে এটাও স্পষ্ট করে যে অর্থবহ কোনো ব্যাখ্যা হারবার্ট তৈরি করতেই চায়নি। অর্থহীনতাকে প্রকট করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। সেইসঙ্গে নাথিংনেসকে সুস্পষ্ট করে তোলার জন্য এই প্রলাপের হয়তো দরকার ছিল। এই প্রলাপ এবং নিপীড়িত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অসহায়তা এবং অনর্থক অস্তিত্বের জন্য লড়ে যাওয়ার কারণকে হাইলাইট করার জন্যই হয়তো প্রথম থেকেই হারবার্টের সংলাপের মধ্যে এক ভারসাম্যের অভাব, অর্থবোধক কোনো ধারণার অভাব। শোষণ, অত্যাচার, বিপ্লব, অর্থহীনতা এবং বিস্ফোরণ এই প্রত্যেক অভিব্যক্তি আর্তচিৎকার হয়ে ধ্বনিত হয়েছে হারবার্টের জীবনকাল থেকে অন্তিম অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত। তার জীবৎকাল মূলত একটি সামাজিক অধোগতিকে মোটা হরফে দাগিয়ে তোলে ঠিক যেমন হারবার্টের জীবনে নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থতাকে সূচিত করে বিনুর মৃত্যু। হারবার্টের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়াকালীন যে প্রবল বিস্ফোরণ হয় তা হয়তো নবারুণের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হও বার্তাকেই প্রকাশ করেছে। হারবার্ট মৃত্যুকে বেছে নিয়েও দেখিয়ে গেছে যে প্রতিবাদের মৃত্যু হয় না।