রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে সময়ের সীমান্তকে অতিক্রম করা একটি নাম। জীবৎকালেই তিনি নিজস্ব স্বাতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন সমকালীন অন্য দুই কীর্তিমান বন্দ্যোপাধ্যায় — তারাশঙ্কর ও মানিকের প্রোজ্জ্বল উপস্থিতির মধ্যেও। বইব্যবসা ও পাঠকপ্রিয়তা, অর্থাৎ লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর সাহচর্য আজও বিভূতি-সাহিত্যের স্বতঃস্ফূর্ত সঙ্গী। চিরকালীনতার লক্ষণও। বাংলাভাষী প্রজন্মের পর প্রজন্মের নিভৃত মুহূর্তের সঙ্গী তাঁর চিরায়ত সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’, ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ বা ‘দেবযান’ ইত্যাদির মতো উপন্যাস, অসংখ্য ছোটগল্প, জার্নাল ও চিঠিপত্র। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি সাহিত্য গবেষকদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় বিষয় বিভূতি- সাহিত্যসম্ভার। এ বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে গণনাতীত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও অ্যাকাডেমিক গবেষণাপত্র। এই বিপুল পরিমাণ আলোচনায় বেশিরভাগ সময়ই নতুন ভাবনা, নতুন কথা বা নতুন উপস্থাপনার অভাব কিছুটা পীড়াদায়ক মনে হতে পারে। বিশেষ করে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি ও আর্থিক লাভের বিষয়টি যখন গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তখন নতুন বিষয়ের অনুসন্ধান, নতুন বক্তব্যের উপস্থাপন, সর্বোপরি রচনার উৎকর্ষ গৌণ হয়ে পড়ে। বিভূতিসাহিত্যের আলোচনাতেও সেই গড্ডলিকা প্রবাহের কোনো ব্যতিক্রম ঘটেছে এমন না। তাই কোনো লেখক যখন বিভূতিভূষণের চিরপরিচিত সৃষ্টিগুলির মধ্যে থেকে খুঁজে নিয়ে আসেন নতুন কথা, তুলে ধরেন নতুন ভাবনা তখন সেই লেখক ও তাঁর লেখনীর প্রতি সমীহ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত ভিন্ন একটি আবেগ তৈরি হয়। এরকমই একজন প্রাবন্ধিক রামচন্দ্র প্রামাণিক। তাঁর লেখা “বিভূতিভূষণ অনুভূতি লোকে তীর্থযাত্রা” পাঠকের সামনে উন্মোচিত করেছে বিভূতি-সাহিত্যের অনালোচিত বা স্বল্প আলোচিত কিছু বিষয়, যা বাস্তবিকই নতুন বিষয় পাঠের তৃপ্তি এনে দেয়।
অতি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ পরিচয় অংশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে, অতি-পরিচিত বিভূতিভূষণকে জানতে এখনও কত বাকি আমাদের। মনে হবে, তাঁকে নিয়ে যে ধারণা লালন করেছি এতদিন, তার অনেকটাই ক্লিশে…..।”
লেখক তাঁর সংক্ষিপ্ত ভূমিকার সূচনায় প্রকাশকের এই দাবির সমর্থনে গ্রন্থ প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, “বিভূতিভূষণ পড়তে পড়তে প্রায়ই মনে হয়েছে তিনি এখনও অনেকটাই অনাবিষ্কৃত মহাদেশ। তাঁর রচনায় আপাত সারল্যের ভাঁজে ভাঁজে রয়ে গেছে বহু স্তর এবং বহু কোণ, সহজিয়া প্রকাশভঙ্গির আড়ালে চাপা পড়েছে নিগূঢ় পরীক্ষা-নিরীক্ষা — বিষয় নিয়ে, আঙ্গিক নিয়ে। তাই প্রত্যয়ীর স্পর্ধায় কখনও-সখনও মনে হয়েছে লেখা দরকার ওই সব অনালোকিত অনালোচিত দিক নিয়ে।”
১৯১ পাতার গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে নয়টি প্রবন্ধ। আকারে প্রত্যেকটিই বেশ দীর্ঘ। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত “বিভূতিভূষণের আর্ট: ছোটগল্পের নিরিখে”-র আয়তন ১০ পৃষ্ঠা এবং সর্ববৃহৎ “বিভুতি-সাহিত্যে খিদে”-র পরিসীমা ৩২ পৃষ্ঠা। ন’টি প্রবন্ধের প্রথম চারটির বিষয় স্বতন্ত্রভাবে বিভূতিভূষণের লেখা চারটি উপন্যাস — ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’, ‘বিপিনের সংসার’ ও ‘ইছামতী’। অন্য পাঁচটি প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে সামগ্রিক ভাবে বিভূতিভূষণের বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটগল্পের পারস্পরিক প্রতিতুলনায় নির্দিষ্ট বিশেষ কিছু বিষয়।
ভূমিকা অংশেই লেখক স্থির করে নিয়েছিলেন তাঁর গতিপথ। প্রবন্ধগুলির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কখনো প্রচলিত ধারণাকে প্রামাণ্য নির্ভর যুক্তি বিন্যাসে খণ্ডন করে বা পরিচিত কাহিনিগুলির মধ্যে থেকে সম্পূর্ণ নতুন ভাবনা ও বিষয়ের আবিষ্কার করে প্রাবন্ধিক পাঠকের সামনে এযাবৎ অজ্ঞাত নতুন বক্তব্যের অবতারণা করছেন। সীমিত পরিসরে সবকটি প্রবন্ধের আলোচনা সম্ভব নয়। কয়েকটির প্রসঙ্গ সংক্ষিপ্ত অবতারণার মধ্যে দিয়ে লেখকের ঘোষিত উদ্দেশ্যের সফলতা-ব্যর্থতা বিচার করা যেতে পারে।
১৯২৯ সালে প্রকাশিত ‘পথের পাঁচালী’ বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাস শুধু না, সর্বাধিক জনপ্রিয় ও আলোচিত সৃষ্টি। চলচ্চিত্রের দৌলতে বিশ্বখ্যাত। রামচন্দ্র প্রামাণিক তাঁর প্রবন্ধ সংকলনের সূচনা করেছেন এই উপন্যাসের উপর আধারিত প্রবন্ধটি দিয়ে। শিরোনাম ‘পথের পাঁচালী: পুনর্বিচার’। ৯৬ বছর বয়সী সুবিখ্যাত, বহুপঠিত, বহু আলোচিত উপন্যাসটি সম্পর্কে লেখকের পুনর্বিচার প্রসঙ্গে পাঠকের কৌতূহল তৈরি হওয়া স্বাভাবিক এবং এই পুনর্বিচারে লেখকের বক্তব্য বাস্তবিকই নতুনভাবে উপন্যাসটির পরিচিতি করায়। চারভাগে বিভক্ত ১৭ পাতার এই প্রবন্ধের সূচনা অংশে লেখক স্পষ্টভাবে এই উপন্যাসে পাঁচালী আঙ্গিকের যথার্থ প্রয়োগটি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। ডক্টর তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন, “‘পথের পাঁচালী’-র পালাভাগ, খণ্ডভাগ কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে হয়নি।’ ভাবতে আশ্চর্য লাগে, বিভূতিভূষণকে বুঝতে কতটাই ভুল হয়েছে আমাদের।” (পৃ. ১৪) পথের পাঁচালী বিষয়ে লেখকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আলোচনা কাহিনিতে প্রচলিত ছড়ার ব্যবহার। বহুবার ‘পথের পাঁচালী’ পড়েছি, কিন্তু উপন্যাসের এই দিকটি কোনোদিনই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। তাই রামকৃষ্ণ বাবুর আলোচনা পড়তে পড়তে নিজের অমনোযোগী পাঠের জন্য বারংবার আক্ষেপ হচ্ছিল। লেখকের কথায়, “আপাদমস্তক গ্রামের মানুষ বিভূতিভূষণ জানতেন, ছড়ার স্রষ্টা সাধারণত গ্রামীণ মেয়েরা, যারা প্রায় অজ্ঞ — অশিক্ষিত গৃহবধূ। ওইসব ছড়াতে মূর্ত হয়ে ওঠে তাদের প্রতিদিনের জীবন, ঘরকন্না, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা।” (পৃষ্ঠা ১৫) উপন্যাসে ব্যবহৃত অন্তত ছ'টি ছড়ার উদাহরণ দিয়ে লেখক কাহিনিতে সেগুলির প্রাসঙ্গিকতা সহজ সাবলীল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। পাঁচালী ও ছড়ার প্রসঙ্গ ছাড়াও লেখকের আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে উপন্যাসের নায়ক অপু, না সামগ্রিক ভাবে পথ অর্থাৎ জীবন। “পাঠক খেয়াল না করে পারে না ‘পথ’ শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহার — প্রথম থেকে শেষ অব্দি। ধীরে ধীরে কখন প্রতীয়মান হয়, সেই ব্যবহার কাকতালীয় নয় মোটেই, পেছনে রয়েছে এক সতর্ক শিল্পীর সচেতন অভিপ্রায়। আর তখনই আমরা বুঝে ফেলি, পাঁচালীটি পথের।” (পৃষ্ঠা ২৩)
‘আরণ্যক’ বিভূতিভূষণের আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। কারো কারো মতে শ্রেষ্ঠ সৃজন। সংকলনের দ্বিতীয় প্রবন্ধের বিষয় ‘আরণ্যক’। প্রবন্ধ শিরোনামেই লেখকের উদ্দেশ্য স্পষ্ট ‘আরণ্যক : অভিনব বস্তু’। ‘আরণ্যক'-এর অভিনবত্ব অনালোচিত বিষয় নয়। লেখকের প্রচেষ্টা সেই বহু আলোচিত বিষয়গুলির বাইরে থাকা অভিনব সৃজনকৌশলের উন্মোচন। এই পথরেখায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি যে মোড়ে পৌঁছেছেন সেখানে তাঁর দৃষ্টিতে প্রধান হয়ে উঠেছে ‘আরণ্যক’-এর অরণ্য নয়, সেখানে বসবাস করা মানুষ। “কিন্তু নবাগত ম্যানেজারবাবুর অরণ্য দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল মনুষ্যদর্শনও, মানুষের সংকীর্ণ অর্থ ছাড়িয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন বৃহৎ অর্থে। তখন আমরা বুঝতে পারি ‘আরণ্যক’ অরণ্যের সঙ্গে সঙ্গে বলছে মানুষের কথাও।” (পৃষ্ঠা ৩৪) ভ্রমণকাহিনীর আদলে নির্মিত অভিনব উপন্যাস ‘আরণ্যক’ পাঠ করতে করতে লেখকের মনে পড়েছে ‘উপনিষদ’-এর কথা। বিভূতিভূষণের লেখায় ‘উপনিষদ’-এর প্রভাব পাঠকের অজানা নয়। কিন্তু ‘আরণ্যক’-এ ‘উপনিষদ’-এর প্রভাব বিষয়ে কোনো আলোচনা এর আগে চোখে পড়েনি। প্রসঙ্গত বলি, লেখক এই সংকলন শেষ করেছেন ‘বিভূতি-সাহিত্যে আধ্যাত্মিকতা’ প্রবন্ধটির মধ্যে দিয়ে।
বর্তমান আলোচকের মতে “বিভূতিভূষণ অনুভূতি লোকে তীর্থযাত্রা” গ্রন্থের বিষয় নিরিখে সবচেয়ে অভিনব প্রবন্ধ “নসুমামার বিভূতিভূষণ: নসুবালার বিপ্রতীপ”। নসুবালা বিভূতিভূষণের সৃষ্ট কোনো চরিত্র নয়। তার স্রষ্টা বিভূতিভূষণের সমসাময়িক আরেক জন অমর কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। “হাঁসুলী বাঁকের উপকথা”-র এই চরিত্রটি নারী নয়, পুরুষ। আসল নাম নসুরাম। কিন্তু ‘ভাবে ভঙ্গিতে কথায় বার্তায় একেবারে মেয়েদের মতো।’ (পৃষ্ঠা ৮৪)। আজকের ভাষায় তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত নসুরামের আদলে বিভূতিভূষণের লেখা ‘নসুমামা ও আমি’ গল্পের নসুমামা চরিত্রটির মধ্যে লেখক তারাশঙ্করের নসুরামকে খুঁজে পেয়ে চমকে উঠেছেন। এই প্রসঙ্গেই তাঁর আলোচনায় উঠে এসেছে নসুরামের বিপরীতে “বিভূতিভূষণ যেন সচেতন ভাবে পুরুষের এই নারীবেশ ধারণের একটা স্বাধীন ও স্বকীয় ব্যাখ্যা দিতে ব্রতী হয়েছেন।” (পৃষ্ঠা ৮৬) স্বভাব ও মানসিকতায় নারী হয়ে ওঠা পুরুষের কথাতেই লেখক প্রবন্ধটি শেষ করেননি, প্রসঙ্গত বিস্তৃত আলোচনা করেছেন বিভূতিভূষণের লেখায় প্রেমের স্বরূপ সম্পর্কেও। এই প্রবন্ধটির মতোই ভিন্ন ভাবনার সার্থক প্রকাশ লক্ষ করা যায় ‘ব্রাহ্মণ্য সংস্কার : বন্ধন ও মুক্তি’ এবং ‘বিভূতি-সাহিত্যে খিদে’ শীর্ষক প্রবন্ধ দুটিতে।
বিপুল গুহ পরিকল্পিত ও রূপায়িত প্রচ্ছদে মলাটবন্দি “বিভূতিভূষণ অনুভূতি লোকে তীর্থ যাত্রা” বিভূতি-সাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠকের অবশ্য পাঠ্য। যদিও সমাজমাধ্যমে জনপ্রিয় দুটি বই বিষয়ক গ্রুপে বইটির উল্লেখ পর্যন্ত পাইনি। অথচ ‘হাথক দরপণ’-এর মতো অনবদ্য আত্মজীবনীর স্রষ্টা ছোটগল্পকার সুসাহিত্যিক রামচন্দ্র প্রামাণিকের এই প্রবন্ধ সংকলন ক্লিশে অ্যাকাডেমিক আলোচনা থেকে বহু দূরে প্রবন্ধ-সাহিত্যের স্মরণীয় সংগ্রহশালায় নির্দ্বিধায় জায়গা করে নিতে পারে।