বাইশটি অধ্যায়ে বিবৃত এই গ্রন্থে সদ্য স্বাধীনতা-উত্তর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সর্বনাশা রাজনীতি কীভাবে বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রকে কলুষিত করেছে, গবেষণার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে কথাও প্রাঞ্জলভাবে উঠে এসেছে।
ইওরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক অবস্থা, নীতিবোধের সঙ্গে ভারতীয় বা বাঙালিদের সম্পর্কে তাদের ধারণার কথাও আলোচিত হয়েছে।
বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে তিনি সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গ লাভে কীভাবে সমৃদ্ধ হয়েছেন, সাহিত্যরপ্রীতির উন্মেষ ঘটেছে তার বর্ণনা করেছেন।
একইভাবে প্রেসিডেন্সি কলেজ, সায়েন্স কলেজে তিনি যাঁদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন সেই শ্যামল সেনগুপ্ত, অমল রায়চৌধুরী, রাজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত, সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল, পূর্ণাংশু রায়, বিজয়শংকর বসাক, চঞ্চল কুমার মজুমদারের মতো ছাত্র দরদী, কিংবদন্তী শিক্ষকদের শিক্ষা দানের বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতি শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এস. এন. বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণের পর অধ্যাপক চঞ্চল কুমার মজুমদার-এর মতো খ্যাতিমান বিজ্ঞানীকে পরশ্রীকাতর সহকর্মীদের কাছ থেকে কীভাবে আর্থিক অনাচারের অলীক অভিযোগে হেনস্থা হতে হয়েছিল এবং তার ফলে এই খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর অকালমৃত্যু ঘনিয়ে এসেছিল সে বিবরণ পাঠক মনে গভীর বেদনার সঞ্চার করে।
অধ্যাপক ঘোষ ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার কথা যেমন বলেছেন তেমনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও সিনেট, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, জাতীয় মূল্যায়ন ও সংস্কৃতি সংসদের সদস্য হিসেবে লব্ধ অভিজ্ঞতার কথাও লিপিবদ্ধ করেছেন।
তাঁর নিজের কর্মস্থল সায়েন্স কলেজে কীভাবে তিনি নানা বাধার মধ্যেও গবেষণা প্রকল্পগুলির রূপায়ণে, বিশেষত পরমাণু শীতলীকরণের মতো গবেষণা প্রকল্প চালিয়েছেন বিজ্ঞানবিষয়ক সেই জটিল কাজের কথা সর্বজনের বোধ্য ভাষায় বিবৃত করেছেন।
একদা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সি ভি রামন, সত্যেন্দ্র নাথ বোস, মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীরা কী অপ্রতুল পরিকাঠামোর মধ্যে কাজ করেছেন তা জেনে বিস্মিত হতে হয়।
কিন্তু এই গ্রন্থের বিশেষ আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয় পর্ব হল জুরিখ ও সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া , জাপান এবং জার্মানিতে তাঁর গবেষণা ও বক্তৃতা সূত্রে লব্ধ অভিজ্ঞতার কথা।
বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর আত্মিক সংযোগ থাকায় অধ্যাপক ঘোষের লেখায় বিশিষ্ট লেখকদের, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও সংগীতের সুপ্রযুক্ত উদ্ধৃতি চমৎকৃত না করে পারে না ।
পরিশেষে তিনি তার জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি, পরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কারণ তিনি মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে মেধার কোনো অভাব নেই, পরিকাঠামোর উন্নতি, শিক্ষকদের যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হলে ভারতে গবেষণার ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে এবং ভারত জগৎ সভায় মর্যাদার আসন লাভ করবে।
এককথায় বইটি যেমন সুখপাঠ্য তেমনি শিক্ষণীয়, বিশেষত অধ্যাপক ঘোষের বিপুল বিস্তৃত অভিজ্ঞতা খুব সহজলভ্য নয়।
শুধু অনুযোগ এই, বইটির সম্পাদনার প্রয়োজন ছিল কারণ বেশকিছু পুনরুক্তির সঙ্গেই রয়েছে প্রচুর মুদ্রণ প্রমাদ। বিন্যাসের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। আশাকরি পরবর্তী সংস্করণে বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হবে। একুশ শতক প্রকাশনা এমন একটি বই প্রকাশ করে প্রসংশনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন ।