এ কাহিনী আদিম কালের। এ কাহিনীতে আছে একটি ব্যক্তি। যে অত্যাচারী, নৃশংস। নিরীহ মানুষের ক্ষতি করাই যার কাজ। কারণ স্বয়ং শয়তান আছেন তার সমস্ত কাজের পিছনে। সে শয়তানের অন্যতম অনুচর। তার একমাত্র উদ্দেশ্য তার প্রভু অর্থাৎ শয়তানের সমস্ত হুকুম মেনে একের পর এক দুষ্কর্ম করে যাওয়া।
এ কাহিনীতে আছে আরেকটি চরিত্র। এক যুবক। সে একজন তিরন্দাজ। সূর্য ওঠা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সে অক্লান্তভাবে তার লক্ষ্যভেদের অনুশীলন করে যায়। সে স্থির করেছে ওই অত্যাচারী লোকটিকে শেষ করবে। তার মারণ বাণে। এবং সে পরম ঈশ্বর ভক্ত। তার স্থির বিশ্বাস ঈশ্বর তার এই কাজে অবশ্যই সহায় হবেন।
কিন্তু ব্যাপারটা অত সোজা নয়। কারণ শয়তানের এই অনুচর সর্বদা কোনো গোপন আস্তানায় লুকিয়ে থাকে। শুধু অপরাধ করার সময়টুকুতে সে তার ওই গুপ্তস্থান থেকে বের হয়। আর তার ওই গোপন ডেরার সন্ধান পাওয়া দুঃসাধ্য।
এবার কিন্তু ঘটনা অন্যরকম ঘটলো। যুবকটি হঠাৎ খবর পেল যে ওই শয়তানের অনুচরটি কোনো একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ করে পালাতে গিয়ে আটকে গেছে এক ঘন অরণ্যের প্রকাণ্ড বটগাছের শিকড়ে। যুবক চললো সেই গভীর বনের দিকেই।
সমস্ত ব্যাপারটা দূর থেকে দেখছিল তার প্রভু, অর্থাৎ স্বয়ং শয়তান। শয়তান তার পরম অনুগতের এমন শোচনীয় অবস্থা দেখে নিজেই নানা রকম কৌশল করে তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শয়তানের তখন মনে হলো ওই তিরন্দাজ যুবকটি যেভাবে দিনের পর দিন লেগে রয়েছে তার এই প্রধান অনুচরের পিছনে, সে তো এবার যেকোনো মুহূর্তে এসে হাজির হবে এখানে। তখন তো তার এই শ্রেষ্ঠ ভক্তের ওই তিরন্দাজের বাণে তার মৃত্যু অবধারিত। শয়তানের মনে হলো এই পরিস্থিতিতে তাকে উদ্ধার করতে পারেন একমাত্র একজনই।
কিন্তু তাঁর কাছে যাওয়া তো দুঃসাধ্য। আর তাঁকে কিছু বলা তো অসম্ভব। কারণ তিনি অতি দুর্গম স্থানে থাকেন। তিনি যা কিছু করেন, তার শুধুমাত্র স্ব-ইচ্ছাতেই করেন। তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অটল। আর তাঁকে অতিক্রম করে জগতে কারো কিছুই করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ তাঁকে বলে মহাকাল। কেউ বা বলে দৈব। তিনি এই কাহিনীর আরেকটি প্রধান চরিত্র। এই কাহিনীতে আমরা তাঁকে দৈব বলেই অভিহিত করবো। যাইহোক, শয়তান অতি কষ্টে সেই দুর্গম পথ পার হয়ে কোনোক্রমে এসে হাজির হলো দৈবের সামনে।
দৈবের সামনে এসে সে মাথা নতজানু হয়ে হাতজোড় করে নিজের পরিচয় দিয়ে বললো — “আমায় মাফ করবেন আপনার কাছে এই ভাবে আসার জন্য। কিন্তু আমার এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে। দয়া করে আমাকে বিমুখ করবেন না প্রভু।”
দৈব শয়তানের কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর খুব গম্ভীর হয়ে বললেন — “তোমার স্পর্ধা কী করে হলো আমার কাছে আসার?” শয়তান দৈবের পায়ের কাছে পড়ে বলে উঠলো — “জানি। আমি জানি যে এভাবে আপনার সামনে এসে আমি অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছি। কিন্তু আমি একান্ত নিরুপায় হয়েই এ কাজ করতে বাধ্য হলাম প্রভু। তাই আপনাকে এভাবে অনুরোধ করছি । কারণ--”
শয়তানের কথা মাঝপথেই থামিয়ে দৈব বলে উঠলেন — “তোমার কোনো কৈফিয়ত আমি শুনতে চাই না। তোমার জানা উচিত যে কোনো অনুরোধ হোক বা আদেশ হোক — আমি কারো কথার সাপেক্ষে কিছু করি না। তুমি এখনি চলে যাও আমার সামনে থেকে।” শয়তান কিন্তু চলে না গিয়ে ওইভাবেই দৈবের পায়ের কাছে পড়ে রইলো। দৈব বললেন — “কী হলো? যাও।” শয়তান এবার মাথা তুলে বললো — “আমার অনুচর অবধারিত মৃত্যুর সামনে পড়ে রয়েছে। কেবলমাত্র আপনি পারবেন — আপনার ক্ষমতাটি আপনি একবার মাত্র প্রয়োগ করলেই ও উদ্ধার পাবে এই জীবনসংকট থেকে।”
দৈব শয়তানের কথায় নিরুত্তর রইলেন। শয়তান বললো — “শুধু একটি বারের জন্য এই কৃপা করুন প্রভু।” দৈব এবার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন — “বেশ। তাহলে আমারও একটি শর্ত আছে।” শয়তান সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো — “নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আমি আপনার যে কোনো শর্তে রাজি আছি।” দৈব এইবার খুব ধীরে ধীরে কিন্তু অত্যন্ত কঠিন স্বরে বললেন — “আমি তোমার জন্য একবার নয়, দুবার আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করবো। কিন্তু এই দুবারই। আর কখনো নয়। এবং এরপর ভবিষ্যতে কখনো কোনো কারণেই আমার ত্রিসীমানায় তোমাকে যেন না দেখি।”
শয়তান একথা শুনে দারুণ খুশি হয়ে ভাবলো — ‘দু দুবার! এ তো ভাবাই যায় না! তাহলে তো এবার আমায় আটকায় কে! আমাকে আর কখনোই এই দৈবের কাছে আসতে হবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো — “নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি কথা দিচ্ছি আর কোনো দিন আমি আপনার কাছে আর আসবো না। আর যদি বা আসি সেই মুহূর্তেই আপনি যেন আপনার অসীম ক্ষমতা প্রয়োগ করে তখনই আমায় ধ্বংস করবেন।” এই বলে শয়তান আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে চলে গেল দৈবের সামনে থেকে।
শয়তান চলে যাওয়ার পরেই ঈশ্বর এলেন দৈবের কাছে। দৈব ঈশ্বরকে দেখে অবাক হলেন। দৈবের মনে হলো — ‘ঈশ্বর তো কখনো আসেন না তাঁর কাছে। আজ কী এমন ঘটলো যে স্বয়ং ঈশ্বরকে আসতে হলো তাঁর কাছে?’ ঠিক তখনই ঈশ্বর বললেন — “আজ বিশেষ প্রয়োজনেই আপনার দ্বারস্থ হলাম।” দৈব বললেন — “বলুন।” ঈশ্বর বললেন — “আজকে আমার আপনার সাহায্য লাগবে।” দৈব নির্বিকার মুখে বললেন — “আমি তো কারো সাহায্যের জন্য কিছু করি না। আমি সর্বদা নিজের শর্তে চলি।” ঈশ্বর বললেন — “সে তো আমি জানি। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে আমি আপনার সাহায্য ছাড়া নিরুপায়।” দৈব ঈশ্বরের কথায় নিরুত্তর হয়ে রইলেন।
ঈশ্বর এবার খুব আস্তে করে বলতে শুরু করলেন — “আমার এক পরম ভক্ত সারাজীবন ধরে একটি সাধনা করে চলেছে একটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য। সে এক ধনুর্বিদ। মাত্র একবারই সে সুযোগ পাবে তার ওই অভীষ্ট লক্ষ্য ভেদ করার জন্য। সেই সময়টিতে শুধু একবারের জন্য আপনি দয়া করে তার সহায় হোন। যাতে সে তার কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারে। এতে করে শুধু যে তার এতদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম সফল হবে তা নয়, সমস্ত মানবজাতির এক বিরাট কল্যাণসাধনও হবে।”
ঈশ্বর এই কথাগুলি বলে নীরবে তাকিয়ে রইলেন দৈবের মুখের দিকে। দৈব ঈশ্বরের চোখে চোখ রেখে বললেন — “আপনি নিজে এসে নিজের মুখে এই কথাগুলি বলে আমায় আমার ধর্ম সংকটের কারণ হলেন। তাই আপনার অনুরোধ রাখতে গেলে আপনাকে আমার শর্তে রাজি হতে হবে।” তারপর একটু থেমে বললেন — “আমি আপনার ভক্তের কাজে সহায়তা করবো। কিন্তু তা দু বার মাত্র। তার বেশি নয়। আর এর বিনিময়ে আপনাকে কথা দিতে হবে যে আপনি কখনো আমায় আর কোনো অনুরোধ করবেন না যাতে আমার স্বাধীন নিরপেক্ষ অস্তিত্বের অমর্যাদা হয়।”
ঈশ্বর একথা শুনে বললেন — “অবশ্যই। আমি কথা দিলাম আর কখনোই কোনো অবস্থাতেই কোনো অনুরোধ করে আপনাকে বিব্রত করবো না।” এইকথা বলে ঈশ্বর দৈবের সামনে থেকে বিদায় নিলেন।
এবার আমরা আমাদের কাহিনীর আরেকটি আঙিনায় চলে আসছি। এখানে দেখা যাচ্ছে এক গভীর ঘন অরণ্য। সেখানে একটি প্রকাণ্ড বটগাছের ঝুরিতে আটকে রয়েছে এক ব্যক্তি। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওই বটের ঝুরির জাল থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। ওই বিশাল বটগাছের অজস্র ঝুরি যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ওই ব্যক্তিটিকে। এই ব্যক্তিটিই শয়তানের সেই শ্রেষ্ঠ অনুচর।
এখানে দেখা যাচ্ছে আরো একজনকে। যে ধনুকে তির লাগিয়ে ওই আটকে পড়া ব্যক্তিটির দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই ঘন অরণ্যের একটি গাছের পিছনে। সে যেন পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একদৃষ্টে ওই লোকটির দিকে তাকিয়ে। এই তির-ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিই হলো ওই ঈশ্বর ভক্ত তিরান্দাজ ।
এইবার তির-ধনুক হাতে যুবকটি ওই আটকে পড়া ব্যক্তিটিকে উদ্দেশ্য করে বললো — “অনেক কাল ধরে অসংখ্য নিরীহ লোকের উপর বহু অত্যাচার করেছো। কিন্তু আজ তোমার শেষ দিন।” লোকটি একটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো যুবকটির দিকে। যুবকটি উপরের আকাশের দিকে একবার মুখ তুলে তাকালো। তখনই সে তার ইষ্টদেবতার মুখটি স্মরণ করলো। আর মনে মনে বললো — ‘হে ঈশ্বর! এতকাল ধরে এত কষ্ট করে এই শরসাধনা করেছি শুধু এই মুহূর্তটির জন্য।এই কাজটি সম্ভব হবে একটি বিশেষ তিরের দ্বারাই। যেটিকে আমি বহুকষ্টে সংগ্রহ করেছি। হে ঈশ্বর! এবার আপনি আমার সহায় হোন। আমি যেন লক্ষ্যচ্যুত না হই। যেন পৃথিবীকে যেন মুক্ত করতে পারি ওই শয়তানের অনুচরের হাত থেকে।’
এই বলে সে আবার একদৃষ্টে তাকালো ওই ব্যক্তিটির দিকে। তারপর তার সমস্ত ইন্দ্রিয়, সমস্ত চেতনা ওই ব্যক্তিটির বুকের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে যেন স্থির হয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই তার ধনুকের জ্যা-মুক্ত হয়ে বিদ্যুতের মতো ঠিকরে বেরিয়ে গেল সেই বিশেষ তিরটি। ওই ব্যক্তিটির বুক লক্ষ্য করে।
দূরে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়েছিলেন ঈশ্বর এবং শয়তান। ঈশ্বর ছিলেন যুবকটির পাশে। একটি গাছের আড়ালে। আর শয়তান ছিলো ওই ব্যক্তিটির ঠিক পিছনে। ঘন ঝোপের গভীরে। আর সবার মাথার উপরে সবার অগোচরে আকাশে ছিলেন দৈব।
যুবকটির এতদিনের এত গভীর নিষ্ঠা আর পরিশ্রমে এই লক্ষ্য ভেদ হওয়া অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ তার কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা মাত্র। শয়তানের অনুচরটি অসহায় চোখে তার প্রভুকে দেখার শেষ চেষ্টা করলো। কিন্তু দেখতে পেল না। আর শয়তান চোখ বন্ধ করে বসে পড়লো তার প্রধান অনুচরের মৃত্যু মুহূর্ত দেখবে না বলে। ঈশ্বর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তার পরম ভক্তের সিদ্ধিলাভ দেখবেন বলে। দৈব নির্বিকার ভাবে স্থির হয়ে রইলেন আকাশে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই —
হ্যাঁ। তিরটি জ্যা-মুক্ত হওয়ার মুহূর্তেই উঠলো এক প্রবল ঝড়। যেন পৃথিবীর সবকিছুকে এক পলকে লন্ডভন্ড করে দেবে। বাতাসের এই বিরাট ধাক্কায় তিরটি তার গতিপথ থেকে বেঁকে গিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে গেল ওই ব্যক্তির বুকের ঠিক পাশ দিয়ে। শয়তান আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে বললো — “ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।” আর তার ওই অনুচর তিরন্দাজের তিরটি তাকে স্পর্শও করেনি বুঝে হো-হো করে হাসতে লাগলো। যুবকটি তীব্র হতাশায় মাথা ঝুঁকিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। ঈশ্বরও সমস্ত ব্যাপারটা দেখে মুখ নিচু করলেন। এরপরেই দেখা গেল এক অদ্ভুত ঘটনা —
যেন শূন্য থেকে আরেকটি তির এসে পড়লো যুবকটির সামনে। যুবকটি অবাক হয়ে উপরের দিকে তাকালো। সেখানে সে কাউকে দেখতে পেলো না। কারণ দৈব অলক্ষ্যেই থাকেন। তিরটিতে হাত দিয়ে বুঝলো যে সেটি হুবহু আগের তিরটির মতো বিশেষ ধরনের একটি তির। সে তিরটি হাতে তুলে নিয়ে তার ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে সে সেটিকে মাথায় ঠেকালো। ঈশ্বর সমস্ত ব্যাপারটা দেখে দৈবের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় আকাশের দিকে তাকালেন। শয়তানও ঠিক সেই সময়ই আকাশের দিকে তাকালো। কিন্তু খানিকটা বিস্মিত হয়ে। যুবকটি এবার দ্বিগুণ একাগ্রতায় ওই তিরটিকে ধনুকে সংযুক্ত করে ওই লোকটির মাথার দিকে লক্ষ্য স্থির করলো। এবং ঈশ্বরকে স্মরণ করলো। আর ওই লোকটি তখন চোখ বন্ধ করে তার প্রভু শয়তানের নাম জপছিল। যে মুহূর্তে তিরটি জ্যা-মুক্ত হতে চলেছে ঠিক সেই মুহূর্তেই এক প্রবল ভূমিকম্পে চারিদিক কেঁপে উঠলো। যুবকটির পায়ের তলার মাটিতে হঠাৎ বিরাট ফাটল হয়ে গেল। যুবকটি টাল সামলাতে গিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। আর তিরটি লোকটির মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
শয়তান উল্লসিত হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো — “ধন্যবাদ। অজস্র ধন্যবাদ।” তার অনুচরটি বুঝলো যে এবারেও সে বেঁচে গেছে আশ্চর্যভাবে। এইভেবে সে আবার হো-হো করে হাসতে লাগলো। যুবকটি আবার ব্যর্থ হয়েছে বুঝে নিজের প্রতি লজ্জায় ঘৃণায় মাথা নিচু করে মাটিতে বসে পড়লো। ঈশ্বর দুহাতে নিজের ম্লান মুখটি ঢাকলেন। আর ঠিক তখনই দেখা গেল আগের মতোই একটি তির উপর থেকে এসে পড়লো যুবকটির পায়ের কাছে। যুবকটি পরম বিস্ময়ে উপরের দিকে তাকালো। তারপর তিরটিকে দুহাতে তুলে নিল। তিরটিকে স্পর্শ করেই সে বুঝতে পারলো যে এটি হুবহু আগের তিরটির মতোই বিশেষ একটি তির। সে ওই তিরটি নিয়ে মাথায় ঠেকালো। এবং ঈশ্বরকে বারবার প্রণাম করলো। ঈশ্বর মুখ তুলে দৈবকে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানালেন। শয়তান এবার অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে নিজের মনেই বললো — ‘এ ভারি অন্যায়।’
যুবকটি এবার তার সমস্ত দক্ষতা আর ক্ষমতা এক বিন্দুতে নিয়ে এসে ওই লোকটির গলার দিকে লক্ষ্য স্থির করলো। সেই মুহূর্তে তার সমস্ত চেতনা যেন তার ওই তিরটির ফলায় এসে স্থান পেল। এবার সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তিরটিকে জ্যা-মুক্ত করলো। তিরটি এবারেও বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেল ওই লোকটির গলা লক্ষ্য করে।
নাহ্। এবারে আর কোনো সহসা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলো না। হঠাৎ কোনো ঝড়ের ধাক্কা নয় — আবার কোনো ভূমিকম্প নয় — প্রকৃতি অতি শান্ত স্নিগ্ধ অপরিবর্তিত রইলো। কিন্তু —
কিন্তু যে মুহূর্তে যুবকটি তিরটিকে জ্যা-মুক্ত করতে চলেছে ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি প্রকাণ্ড কালসাপ পিছন থেকে এসে দংশন করলো যুবকটির পায়ে। যুবকটির শরীর যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেল সেই মুহূর্তেই। সেই তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে তার শরীরটিকে বিন্দুমাত্র না নড়তে দিয়ে সে তার তিরটাকে জ্যা-মুক্ত করলো। তিরটি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেল ওই লোকটির গলা লক্ষ্য করে। শয়তান যেন সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পলকের মধ্যে তার অনুচরের শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে দুহাতে ওই শিকড়ের জালের থেকে উপড়ে নিয়ে নিঃশেষে উড়ে চললো কোথায় কে জানে। তিরটি কিন্তু শয়তানের পিছু ছাড়লো না।
ততক্ষণে যুবকটি যন্ত্রণায় স্থির হয়ে গেছে পাথরের মূর্তির মতো। দেহটি শীতল, নিষ্প্রাণ, চোখদুটি বিস্ফারিত — স্থির। কিন্তু তখনো হাতে ধরা আছে তার ধনুকটি — তার অনড় মুষ্টিতে। ঈশ্বর ওর পাশে এসে বসলেন। ওর শীতল দেহটির উপর ঝরে পড়লো ঈশ্বরের কয়েক বিন্দু উত্তপ্ত অশ্রুজল।
এই ভাবে ঈশ্বর স্থির বসে থাকেন তার নিহত ভক্তকে কোলে নিয়ে। নির্বাক হয়ে। চিরকাল।
কিন্তু তাঁর ওই ভক্তের ছোঁড়া তিরটি কখনই শয়তানের পিছু ছাড়ে না। তাই শয়তান ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে দূর থেকে দূরান্তে, একস্থান থেকে স্থানান্তরে — দুহাতে তার অনুচরকে আগলে নিয়ে। আবহমান কাল ধরে। এক অনন্ত বিপথে।