গরমের ছুটি শেষ হতে আর যখন তিনদিন বাকি তখনও রিকোর স্কুলের হোমওয়ার্ক একটুও করা হয়নি। ও ঘুম থেকে উঠতেই ওর মা মনে করিয়ে দিলেন, “রিকো তুমি কিন্তু একটাও হোমওয়ার্ক করোনি। আজ নিয়ে আর তিনদিন বাকি আছে, এর পর কিন্তু আর শেষ করে উঠতে পারবে না।”
রিকো বলল, “আজ বিকেলে করে নেব।”
মা বললেন, “আবার বিকেলে কেন? সকালে নয় কেন?”
“মা, তুমি না সব ভুলে যাও! আজকে রজতের বাড়িতে ভিডিও গেম ডে আছে না। জয়, সাহিল, দিব্য সবাই আসবে। দারুণ মজা হবে।”
মা রেগে বললেন, “সারা ছুটিটা তো খেলা আর খেলা করেই কাটিয়ে দিলে। একবারও বই খুলেও দেখোনি। অথচ তুমি দেখো, রজত, দিব্য আর যে যে খেলতে আসবে তারা সবাই স্কুলের হোমওয়ার্ক আগেই শেষ করে ফেলেছে।”
রিকো বলল, “ছুটি মানেই তো ‘মস্তি’। আমি মস্তি করতেই ভালোবাসি। আমি বিন্দাস থাকতে ভালোবাসি। আর হোমওয়ার্ক হচ্ছে ‘মস্তি নাশক’ তাই হোমওয়ার্ক ‘কাট’।”
মা মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “কী সব ভাষা! ঠিক আছে আমার কথা তো শুনছ না। কাল বাবা টুর থেকে ফিরুন তখন বুঝবে মজা! সব মস্তি বেরিয়ে যাবে!”
গরমের ছুটি শুরু হওয়ার আগের দিন স্কুল থেকে এক গোছা কাগজ দিয়েছে, পরীক্ষার কোয়েশ্চেন পেপারের মতন। সব সাব্জেক্টের হোমওয়ার্ক। রিকো সেগুলোকে উলটে পাল্টেও দেখেনি। ওর পলিসি নাকি ‘আগে মস্তি, বাকি যা কিছু আছে সেই সব নিয়ে পরে ভাবা যাবে।’
কোন রকমে জলখাবার খেয়েই রিকো ছুটল পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও গেম ডে করতে। বেকেলবেলা ফিরে এসে দেখল মা টিভি দেখছেন তখন সেও বসে গেল।
হোমওয়ার্কের কথা মনে করাতেই সে বলল, “এই প্রোগ্রামটা একটু দেখে নিই মা, এটা আমার ফেভারিট! কাল আর পরশু দুদিন তো রয়েছে। সারাদিন বসে করে নিলে সব হয়ে যাবে।”
প্রোগ্রামটা মাও দেখতে ভালোবাসেন তাই মা আর কিছু বললেন না।
পরদিন সকালবেলা উঠে রিকো বই খাতা নিয়ে বসব বসব করছে এমন সময় ওর বন্ধু সন্তুর ফোন এল। রিকোকে ফোনে পেয়েই সন্তু বলল, “এই রিকো পরশু আমার জন্মদিন কিন্তু সেদিন তো স্কুল খুলে যাবে তাই আমার মামা আজকে আমাকে আর আমার বন্ধুদের ফান পার্কে নিয়ে যাবেন বলেছেন। দারুণ মজা হবে। তুই যাবি তো? তুই না গেলে আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে!”
রিকোর যাওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছে কিন্তু মা যদি বকেন সেই ভয়ে সন্তুকে বলল, “মাকে রাজি করাতে হবে নাহলে যেতে পারব না।”
সন্তু বলল, “আরে কোন চিন্তা নেই, কাকিমাকে ফোনটা দে আমার মা কথা বলবেন। আমার জন্মদিন বলে কথা, তুই না আসলে চলে?”
সন্তুর মার সঙ্গে কথা বলে রিকোর মা শেষমেশ রাজি হলেন। বাবা গতকাল রাতে ফোন করে বলেছেন কাজ শেষ হয়নি তাই টুরে আরো দুদিন বেশি থাকতে হবে। রিকো মাকে কথা দিল যে সে ফান পার্ক থেকে ফিরে এসে হোমওয়ার্ক করতে বসবে কিন্তু সারাদিন ফুর্তি করে এতটাই ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল যে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ল।
স্কুল খোলার আগের দিন হঠাৎ দাদু আর দিদা সকাল সকাল মামাতো দুই ভাই গুল্লু আর কাজুকে নিয়ে এসে হাজির হলেন। ব্যস মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আর রিকো গুল্লু আর কাজুর সঙ্গে খেলায় মেতে উঠল।
পরদিন রিকো ভয়ে ভয়ে স্কুলে গেল। সারা ছুটি মজা করার সাজা সেকেন্ড পিরিয়েডেই পেয়ে গেল। অঙ্কের ক্লাসে স্যার যখন শুনলেন সে হোমওয়ার্ক করেনি তখন ওকে বললেন ক্লাসের পিছনের সিটে গিয়ে বসে হোমওয়ার্ক করতে। একটু পরেই সিনিয়ার দাদা সায়নদা এসে স্যারকে বলল, “স্যার, কালকে জে বি হাই স্কুলের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ আছে। বসাক স্যার ক্রিকেট টিমের ছেলেদের মাঠে ডাকছেন প্র্যাকটিসে জন্যে।”
গৌরব, নিমেষ, অঙ্কন সবাইকে যেতে দিলেন স্যার কিন্তু রিকোকে আটকে দিলেন, বললেন, “না, তোমাকে তো ক্রিকেট খেলার জন্যে ছাড়তে পারব না। তুমি তো সারা ছুটিতে একটাও অঙ্ক করোনি!”
রিকো ভালো বল করে, ফিল্ডিংও তার বেশ ভালোই কিন্তু প্র্যাকটিসে না গেলে তো আর কালকের ম্যাচে খেলতে পারবে না।
বিজ্ঞানের পিরিয়েডে স্যার সবাইকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গেলেন মজার এক্সপেরিমেন্ট দেখাতে। ক্লাসে পড়ে রইল রিকো – সে যে হোমওয়ার্কগুলো করেনি সেগুলো তাকে করতে হল ক্লাসে বসে বসে।
বাংলার ম্যাডাম তো খস্ খস্ করে বড়সড় একটা চিঠি লিখে দিলেন মা-বাবাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে আসার জন্যে। হোমওয়ার্ক করবে না মানে? এ কি মগের মু্ল্লুক!
ক্লাসের অন্য ছেলেরা রিকোকে খেপিয়ে বলল, “সারা ছুটি তুই মস্তি করেছিস আর আমরা হোমওয়ার্ক করেছি, এবার তুই হোমওয়ার্ক কর আর আমরা মজা করি!”
সবচেয়ে বড়ো ধাক্কাটা খেল ইংরেজি স্যারের ক্লাসে। ইংরেজির স্যার ওদের ক্লাস টিচার। রোল কল করার পর উনি বললেন, “সবাই পিকনিকের যাওয়ার জন্যে অনুমতি ফর্মে সই করিয়ে এনেছো তো?”
“পিকনিকের ফর্ম? কোন ফর্মের কথা বলছেন, স্যার? আমি তো কোন ফর্ম পাইনি!” রিকো উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
ক্লসের সবাই ওর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল।
স্যার কিন্তু হাসলেন না, বললেন, “ইংলিশ হোমওয়ার্কটা করেছো?”
রিকো লজ্জায় মাথা হেঁট করে বলল, “না।”
“হোমওয়ার্কের কাগজগুলো ঘাঁটলেই দেখতে পেতে যে শেষের পাতায় পিকনিকে যাওয়ার অনুমতি ফর্মটা ছিল। সেটা মা-বাবার কাছ থেকে সই করিয়ে নিয়ে আসার কথা ছিল।”
রিকো কাকুতি মিনতি করে বলল, “ওটা আগামীকাল নিয়ে এলে হবে না স্যার?”
“আঠাশ দিন সময় পেয়েছ আর তো সময় দিতে পারব না। তার ওপর হোমওয়ার্কও করোনি। মজা করার একটা সময় আছে আর কাজ করার একটা। শুধু যদি মজাই করতে থাকো তাহলে আখেরে ভুগতে হবে। সেই পিঁপড়ে আর ফড়িংয়ের গল্পটা শোনোনি? পিঁপড়ে সারা গ্রীষ্ম খাবার জড়ো করে নিজের ঘরে ভরছিল আর ফড়িং নেচে গেয়ে আনন্দ করে কাটাচ্ছিল। শেষে শীতকাল যখন এসে পড়ল তখন পিঁপড়ে তৈরি কিন্তু ফড়িংয়ের কাছে কোন খাবার নেই। শীতে আধমরা হয়ে তার অবস্থা খারাপ হতে সেই পিঁপড়েই তাকে রক্ষে করল। কাজের সময় কাজ যদি না করো তাহলে বিপদ তো হবেই। তুমি যেটা করো সেটার একটা ইংরেজি শক্ত নাম আছে -প্রোক্রাস-টি-নেশান- মানে যারা আজকে করার কাজটাকে আগামীকালের জন্যে রেখে দেয়!”
বাবা টুর থেকে ফিরে এসে বাংলা ম্যামের চিঠি দেখে ভয়ানক রাগ করলেন। প্রচুর বকুনি খেল রিকো। বাবা আরো বললেন যে পুজোর ছুটিতে দিঘা যাওয়া ক্যান্সেল।
রিকোর অবশ্য ভালোই শিক্ষা হয়ে গেছে। সে এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। ক্লাস টেস্টে ইংরেজিতে সব চেয়ে বেশি নম্বর পাওয়াতে আর স্যারকে ‘সরি’ বলাতে পিকনিকে যাওয়ার অনুমতি ফর্মটা স্যার নিয়ে নিয়েছেন বটে কিন্তু ক্রিকেট টিমে ওর জায়গায় এখন রজত খেলছে।
মা ঠিকই বলেছিলেন, “বাড়িতে ভিডিও গেম ডে করার আগে রজত কিন্তু স্কুলের হোমওয়ার্কগুলো করে নিয়েছিল।”