• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | নাটক
    Share
  • মহামারি : অংশুমান বিশ্বাস

    চরিত্র
    প্রথম (বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন)
    সুন্দর (বছর চল্লিশের পুরুষ)
    বিষ্ণু (ষাটের কাছাকাছি বয়স। কিন্তু বোঝা যায় না)
    আলি (ষাটোর্ধ্ব)
    সবুজ (একুশ থেকে চব্বিশের তরতাজা যুবক)
    মহী (উনিশ কুড়ির যুবতী)
    বন্ধু ১ (কুড়ি থেকে চব্বিশ)
    বন্ধু ২ (কুড়ি থেকে চব্বিশ)
    বন্ধু ৩ (কুড়ি থেকে চব্বিশ)
    নাগরিক ১ (তিরিশ থেকে ষাট যা কিছু হতে পারে)
    নাগরিক ২ (তিরিশ থেকে ষাট যা কিছু হতে পারে)
    নাগরিক ৩ (তিরিশ থেকে ষাট যা কিছু হতে পারে)

    অঙ্ক – ১

    [অন্ধকার এক প্রান্তর। সেখানে সারে সারে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। পুড়তে থাকার চটাপট চটাপট শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। আস্তে আস্তে মঞ্চের মাঝে সামান্য আলো পড়তে দেখা যায়। সেই আবছা আলোয় দেখা যায় একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। স্থির। তার দৃষ্টি সামনের একটি আগুনের উৎসর দিকে। কণ্ঠস্বরটি যে দাঁড়িয়ে আছে তার। কিন্তু সে কণ্ঠস্বর নেপথ্য থেকেই ভেসে আসে।]

    প্রথম [নেপথ্য] - কী দেখছ? অন্ধকারে আগুন না আগুনে অন্ধকার? কেমন লাগছে তোমার? এই সময়? এই চারপাশ? ভালো লাগছে? এখন একটু ভালো লাগছে? তুমি কি জানো কতক্ষণ এখনও লাগবে? আর কতক্ষণ থাকবে এখানে তুমি? এখন কত রাত? আদৌ কি রাত? কী ভাবছ? রাত নয়? রাতের মতো দেখতে? বুঝতে পারছি তোমার চিন্তাভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে। শোক একেই বলে। কিন্তু এ শোক কার? বুঝতে পারছ না? কী বললে? সেটাই বোঝার চেষ্টা করছ? নিজে যদি বুঝতে না পারো অন্য কেউ কী বোঝাবে তোমায়? কেউই কি বুঝতে পারছে? কে উত্তর দেবে? কে বলবে? এ শোক কার?

    [আরেকজনকে মঞ্চে উপস্থিত হতে দেখা যায়। খানিকটা চিন্তিত। সে দেখতে পায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে। তাকে উদ্দেশ্য করেই কথা বলতে থাকে।]

    সুন্দর - আচ্ছা দাদা আপনি বলতে পারেন এই জায়গাটা কোথায়? আমার কেমন অদ্ভুত লাগছে। আমি তো আগুন ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমি এখানে এলাম কী করে?

    প্রথম - আপনি বুঝতে পারছেন না?

    সুন্দর - না। কিছু বুঝতে পারছি না। আমি এখান থেকে বেরোই কীভাবে বলতে পারেন?

    প্রথম - এখান থেকে বেরোবেন?

    সুন্দর - হ্যাঁ।

    প্রথম - বেরিয়ে কোথায় যাবেন?

    সুন্দর - আমি বাড়ি যাব।

    প্রথম - বাড়ি যাবেন? আপনার বাড়ি কোথায়?

    সুন্দর - আমার বাড়ি এই শহরেই।

    প্রথম - এটাকে আপনার শহর বলে মনে হচ্ছে?

    সুন্দর - আপনি কেন হেঁয়ালি করছেন? আপনি যদি জানেন তো বলুন না জানেন তো আমি চলি।

    প্রথম - আপনার এখনও রাগ হচ্ছে?

    সুন্দর - কেন রাগ হবে না কেন? মানুষমাত্রেই রাগ হয়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনাকে এসব কথা বলে কী লাভ। আপনি তো আবার এইখানে এমন সময় দাঁড়িয়ে সব কিছুই গুলিয়ে দিতে চাইছেন। যাক আপনার সঙ্গে এসব কথা বলে কোনও লাভ নেই। আমি চলি।

    প্রথম - আচ্ছা আসুন। ভালো থাকবেন।

    [দ্বিতীয় লোকটি বেরিয়ে যায়। প্রথম লোকটি আবার আগুনের সামনে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পরে পাশে থেকে একটা বাঁশ জোগাড় করে আর তারপরে সেটা দিয়ে সামনের আগুনটা খোঁচাতে থাকে। আগুন আরও বেশি করে জ্বলে ওঠে। লোকটা একটা গান করতে শুরু করে]

    আমার বুকের ভেতর কিসব যেন পুড়িয়ে দেবে
    জ্বলছে আগুন
    জ্বলছে আগুন দুকুল জুড়ে নদীর জলে
    জ্বলছে আগুন হাওয়ায় ভেসে পাখনা মেলে
    হাওয়ায় ভেসে হাওয়ায় ভেসে তোমার খোঁজে
    তোমার আমার মনের কথা আগুন জানে
    তোমার আমার দেখা হবে আগুন জানে

    জমাও যত ভুলের পাহাড় ভুলের বোঝা
    মাশুল তুমি গুনবে সে কি তেমন সোজা
    আগুন যে সব হিসেব রাখে রাখতে জানে
    তোমার আমার দেখা হবে এই এখানে

    [দ্বিতীয় লোকটা আবার ফিরে আসে। এক্কেবারে হতাশ, উদ্ভ্রান্ত। অসহায়ের মতো বলে ওঠে]
    সুন্দর - আমি কোনও রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। শুনছেন? আমি কোনও রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না।

    [প্রথম লোকটি চুপ করে আরেকবার আগুনটাকে বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে দেয়।]

    সুন্দর - আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?

    প্রথম - আপনাকে কী বলে ডাকব?

    সুন্দর - আমার নাম সুন্দর মুখার্জি। আমি এখান থেকে বেরোতে পারছি না। আমি ফিরে যেতে চাই। প্লিস। আপনি যদি জানেন আমায় হেল্প করুন।

    প্রথম - আমি নিজেও কি জানি!

    সুন্দর - আপনিও জানেন না! তবে কে জানে?

    প্রথম - জানার প্রয়োজন দেখি না।

    সুন্দর - সেই হেঁয়ালি। ওফ্‌। কী দুর্বিষহ! এত খারাপ অবস্থায় আছি। তাও একটা সোজা কথা বলতে পারেন না। আমার দুর্ভাগ্য আপনি ছাড়া আমি কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। ও ভগবান! এ কোথায় এলাম আমি! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই যে আপনি কী করে এমন ভাবলেশহীন হয়ে থাকতে পারছেন? এমন করে এখানে থাকা সম্ভব! কী যেন নাম আপনার। আপনার নাম কী?

    প্রথম - নাম লাগবে? আচ্ছা আপনি নিশ্চয়ই এখনও পর্যন্ত এখানে আমাকেই প্রথম দেখেছেন? তাই তো?

    সুন্দর - হ্যাঁ। তাই। নইলে আবার আপনার কাছে মরতে ফিরে আসি!

    প্রথম - তাহলে আপনি আমাকে প্রথম বলে ডাকুন। আমার নাম প্রথম।

    সুন্দর - আচ্ছা প্রথম আপনি নিশ্চয়ই এখান থেকে কখনো বেরোবেন। আপনি বেশ অদ্ভুত মানুষ হলেও যেহেতু আমি এখান থেকে বেরোতে পারছি না বা কাউকে দেখতেও পারছি না তাই আপনার কাছাকাছি থাকছি। আপনার সঙ্গে সময় কাটানোটা যদিও বেশ মুস্কিল। আমার টাইপটা অন্য রকম তো! কিন্তু আমি নিরুপায়। তাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি আপনি এখানে কী করছেন?

    প্রথম - কিছুক্ষণ আগেও আমি এই চিতাটার দিকে তাকিয়েই ছিলাম। তারপরে এখন মাঝেমাঝে ওর আগুনটাকে উস্কে দিচ্ছি।

    সুন্দর - চিতা!

    প্রথম - আপনি বুঝতে পারছেন না এখানে শুধু চিতা জ্বলছে। আর কিছু নেই চারিদিকে।

    সুন্দর - চারিদিকে শুধু চিতা! আমি এ কোথায় এলাম। আপনি তবে কী করছেন এখানে?

    প্রথম - আমি? আমি জ্বলছি।

    সুন্দর - মানে? আচ্ছা আচ্ছা। বুঝেছি পেরেছি। আমি দুঃখিত। আমি আগে বুঝতে পারিনি। একদম বুঝতে পারিনি। কিন্তু আপনাকে দেখে তো তেমন কেউ মনে হচ্ছে না যে আপনি এখানে দাহ করার কাজে আছেন। আপনার পোশাক। আপনার বাচনভঙ্গি তো বলছে না এই কাজের জন্য আপনি এখানে থাকেন। কে পুড়ছে এই চিতায়? আমি এখন বুঝতে পারছি আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। তাই এতক্ষণ আমার সঙ্গে এমন করে কথা বলছিলেন। আমি আপনার জন্য দুঃখিত। ওখানে যিনি আছেন তিনি আপনার কাছের মানুষ অবশ্যই। কিন্তু ঠিক জানি না।

    প্রথম - হ্যাঁ। খুব কাছের মানুষ।

    সুন্দর - কে উনি?

    প্রথম - আমি।

    সুন্দর - এখনও আপনার এমন করে কথা বলতে ইচ্ছে করছে আমার সঙ্গে!

    প্রথম - আপনি বুঝতে পারছেন না? ওই চিতায় আমিই পুড়ছি। আর কেউ নয়।

    সুন্দর - আমি আর পারছি না। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আমার শরীর খারাপ করছে!

    প্রথম - হাঃ হাঃ হাঃ। শরীর শরীর শরীর। আপনার শরীর আর সেটাও খারাপ করছে।

    সুন্দর - আপনি এমন করে হাসছেন কেন! আমার শরীর খারাপ করতে পারে না!

    প্রথম - না পারে না। বা পারলেও ব্যাপারটা চিন্তার।

    সুন্দর - কেন পারে না কেন?

    প্রথম - কারণ আপনি যে শরীরটার কথা ভাবছেন সেই শরীর এখন আপনার আর নেই।

    সুন্দর - হাঃ হাঃ হাঃ। এবার আমার হাসার পালা। যা হাসাচ্ছেন না। আমার শরীর নেই। আমার শরীর নেই!

    সুন্দর মুখার্জির শরীর নেই। সুন্দর মুখার্জি এখন অশরীরী! ভূত। হাঃ হাঃ হাঃ। আপনি মশাই উন্মাদ। আমারও ভাগ্য। রাত বিরেতে এই শ্মশানে পাগলের পাল্লায় পড়লাম। [পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে সুন্দর। ধরাতে যায় কিন্তু ধরায় না। চারদিক দেখে তার ইচ্ছে করে না। হঠাৎ করেই সে দেখতে পায় আর একটা লোক। খুব রোগা চেহারার। জামা কাপড় ময়লা। তার দিকে এগিয়ে আসছে। দেখে সন্দেহজনক বলে মনে হয়। লোকটা হঠাৎ করেই ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ল।]

    বিষ্ণু - একটা সিগারেট দিন না স্যার। অনেক দিন সিগারেট খাইনি। বিড়ি খেয়ে খেয়ে আর ভালো লাগে না। ইনফেকশনে লাংটা জালি হয়ে গেল। তা এখন আর জালি টালি নিয়ে ভাবছি না। দিন না স্যার। একটা।

    সুন্দর - এই কে তুমি? দূরে যাও। দূরে গিয়ে কথা বলো। ঘাড়ের ওপরে আসছ কেন?

    বিষ্ণু - আমাকে চোর চোর বলে মনে হয় স্যার। কিন্তু আমি ঠিক চোর নই।

    [সুন্দর খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটা সিগারেট দেয়। বিষ্ণু সেই সিগারেট ধরায়। সুখটানে চোখ জুড়িয়ে আসে। চোখ বুজেই বলে]

    বিষ্ণু - আঃ। বড্ড দমবন্ধ লাগছিল। এখন আরাম হচ্ছে।

    সুন্দর - এখান থেকে বেরোনোর রাস্তা আমাকে বলো।

    বিষ্ণু - আমি জানলে তো বলব। সবে একটু হাঁফ নিচ্ছি। একটু শেষ করে নিই স্যার। তারপরে কথা বলছি। আমার একটা অভ্যেস আছে স্যার। আমি সিগারেট ধরালে একদম কারো সঙ্গে কথা বলি না। চুপ করে থাকি। এক্সকিউস মি স্যার।

    সুন্দর - এক অদ্ভুত জায়গা। মানুষের সমাজের এক অন্ধকার জায়গা। এই জায়গাই সুন্দর হতে পারত কিন্তু পারছে না। পারছে না কতগুলো অসুস্থ মানুষের জন্য। মানসিকভাবে কতগুলো ভঙ্গুর, আপাদমস্তক সুবিধেবাদী কতগুলো মানুষের জন্য। কিন্তু আপনারা তো জানেন সুন্দর মুখার্জিকে। কোনদিন অন্যায়ের সঙ্গে আমি আপস করিনি। আমি সারাজীবন যে আদর্শ নিয়ে চলেছি তার থেকে পিছিয়ে আসা আমার পক্ষে অসম্ভব। আজও অসম্ভব।

    বিষ্ণু - বড্ড বাজে বকছেন স্যার। একটু থামুন না। একটু সিগারেটটা শেষ করে নিই। তারপরে ওই বাতেল্লাগুলো দেবেন।

    সুন্দর - চুপ। একদম চুপ! ভিখিরি কোথাকার। ভদ্রলোকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি! আমি তোমার উচিত ব্যবস্থা করব। একবার এখান থেকে বেরোই। তোমাদের প্রত্যেকের ব্যবস্থা আমি করব। তোমরা আমাকে চেনো না।

    বিষ্ণু - আপনি এত তড়পাচ্ছেন কেন স্যার? শান্ত হোন। এখন কিছু করার নেই। আমার তো বেশ ভালো লাগছে। দেখুন আপনারও ভালো লাগতে পারে। আমার এসব মেনে নিতে কোনও কষ্টই হচ্ছে না। যদিও এর আলাদা কারণ একটা আছে।

    সুন্দর - কী কারণ?

    বিষ্ণু - কারণটা হল আমি কোনদিনই কিছু করতে চাইনি।

    সুন্দর - ডিসগাস্টিং।

    বিষ্ণু - না না। খেপলে চলবে না। মানতে হবে। আমাদের দাবি মানতে হবে। যাঃ সিগারেট শেষ। আরকি করা যাবে। তা স্যার একটু খোলতাই হোক না?

    সুন্দর - বলছি না সোজা কথা বল। তোমাদের এই হেঁয়ালি ব্যাপারটা একটা ঠগবাজি।

    বিষ্ণু - আচ্ছা তাহলে বলুন আপনি কে ছিলেন?

    সুন্দর - ছিলাম মানে! আমি সুন্দর মুখার্জি ছিলাম আছি থাকব।

    বিষ্ণু - সে তো তখন থেকে শুনে যাচ্ছি।

    [হঠাৎ করেই নতুন একজনকে মঞ্চে ঢুকতে দেখা যায়। সে অত্যন্ত চিন্তিত ও ভয়ার্ত]

    মহ - পাপ পাপ গুনহা গুনহা। দোজখেও জায়গা হবে না আমার। ওহ আল্লা এ কী হোল আমার সঙ্গে! আমার এখন কী হবে! আমি তো নিজে কোনও দোষ করিনি। উনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। বলুন? আল্লা বুঝবেন না আসলে কার দোষ?

    প্রথম - আপনার সমস্যা কী?

    মহ - আমি কী করব বলুন তো! আমি নিজের ইচ্ছেতে তো এই দোষ করিনি।

    প্রথম - আপনার সঙ্গে কী হয়েছে সেটা বললে আপনি কতটা দোষী সেটা বুঝতে সুবিধে হয়।

    মহ - আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদা করেছি। কাউকে ঠকিয়ে জীবন চালাইনি। আমি জেনে বুঝে কারও ক্ষতি করিনি। আমার সঙ্গে এমন হোল কেন?

    বিষ্ণু - আমি তো সারাজীবন মেরেই খেয়েছি। আমার জন্য ঠিকই আছে। যাক আপনাকে কী বলে ডাকা যায়? আমি বিষ্ণু।

    মহ - আমি মহম্মদ আলি।

    প্রথম - কিন্তু আপনার সঙ্গে কী হয়েছে?

    মহ - আমাকে ওরা পুড়িয়ে ফেলেছে! [আর্তনাদ করে ওঠে তারপরে কাঁদতে থাকে]

    বিষ্ণু - তখনই মনে হোল পালটাপালটি হয়ে গেছে।

    প্রথম - মানে?

    বিষ্ণু - মানে আমার সঙ্গে আলিসাহেবকে ওরা বদলে ফেলেছে। এত এত লাশ। আর এত্ত এত্ত ভয়। ভুল করে আমাকে মাটির ভেতরে আর ওনাকে আগুনের ভেতরে ।

    প্রথম - ও। এটা নিয়ে আপনি এত ভাবছেন কেন? দেখুন আমরা যেখানে আছি সেখানে আপনিও আছেন। এত বড় মহামারি, এত বড় শহর। এসব নিয়ে এখন আর কেউ কিছু ভাবে না। ঈশ্বর আল্লা কিছুই মনে করবেন না। আর আপনি তো দোজখেই এত দিন ছিলেন। এবার মনে হয় বেহস্তের দরজা খুলল। এসব একদম ভাববেন না। বরং আমরা ভাবি সামনের সময়টা কীভাবে কাটবে।

    সুন্দর - কেন যেভাবে কাটছে সেভাবেই কাটবে। নাটক করে। সারারাত নাটক করে। বেশ ভালো ভাবেই তো সাজিয়েছেন নিজেদের। কিন্তু স্ক্রিপ্টটা দুর্বল। এ চলবে না। বুদ্ধিমান দর্শক নিচ্ছে না নেবে না।

    প্রথম - আপনার ঠিক আমার মতো সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু একটু উল্টো।

    সুন্দর - আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না। আপনি আপনার ভড়ংবাজি ছাড়ুন। আপনারা সকলে মিলে একটা চক্রান্ত করছেন। সেই চক্রান্ত কত দূরের কথা ভেবে আমি জানি না। কিন্তু আমি আপনাদের এত সহজে এটা সফল হতে দেব না।

    প্রথম - আপনি এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে ভয়ঙ্কর মহামারিতে আপনার মৃত্যু হয়েছে এবং আরও অনেক মৃতদের সঙ্গে আপনিও এখন রয়েছেন। মৃত্যুর পরে পুরসভা থেকে গণহারে চিতা আর কবর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি। এমনকি কিছুকিছু ক্ষেত্রে আলাদা করা যায়নি ধর্ম সংস্কৃতি। যদিও তাতে কিছু এসে যায় না কিন্তু আমরা আর আমাদের ফেলে আসা পৃথিবীতে নেই। আমাদের নাম নেই, আমাদের ধর্ম নেই, আমাদের বাঁচার তাগিদ নেই, আমাদের অতীত নেই। এমনকি আমাদের বর্তমান যা আছে তাতে সময়ের মূল্য কতটা আছে আমাদের জানা নেই তাই আমাদের ভবিষ্যৎ নেই আর তাই কোথাও ফেরার ঠিকানা নেই।

    সুন্দর- না আমি এই আবোলতাবোল কথাগুলো বিশ্বাস করছি না। আমি খুব ভালো করে জানি আমি বেঁচে আছি । আমি দিব্যি বেঁচে আছি। একটা ফাঁদ আমাকে ঘিরেছে। বা একটা দুঃস্বপ্ন। সে যাই হোক না কেন তাকে আমি ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতেই পারব। আমি ফিরে যেতে পারব আমার নিজের সুন্দর শহরে। আমার নিজের পরিবারে। আমার নিজের প্রিয় জীবনে।

    প্রথম - আপনার এই কথাটা আমার বেশ ভালো লাগল। আপনার এই আশা। এই ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার খুব পছন্দের জানেন। আমিও মনে হয় তাই ভেবেছি। কিন্তু আমার একটা সমস্যা হচ্ছে আমি কিছু মনে করতে পারছি না মৃত্যুর আগে আমি কী ছিলাম। আমি কোথায় ছিলাম। আমি কেমন করে এখানে এলাম। কিছুক্ষণ আগেও আমার নিজের সম্বন্ধে একটা আবছা ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছিল কিন্তু এখন আর কিছু মনে করতে পারছি না। কিন্তু মজার কথাটা জানেন পৃথিবীটা কেমন ছিল আমি সব মনে করতে পারছি কিন্তু আমি কে ছিলাম মনে করতে পারছি না। আপনি হেঁয়ালি ভাববেন না। প্লিস হেঁয়ালি ভাববেন না।

    সুন্দর - আমি আর কী ভাবতে পারি?

    প্রথম - ঠিক উল্টোটা ভাবুন। আপনি যেমন মৃত্যু মনে করতে পারছেন না। আমি ঠিক আমার জীবনটা মনে করতে পারছি না।

    সুন্দর - না আমার কিছু বলার নেই। কিচ্ছু বলার নেই। অসম্ভব।

    বিষ্ণু - আমি কিন্তু সবটাই মনে করতে পারছি। কি আলি সাহেব আপনি?

    মহ - আমিও তো সবটাই মনে করতে পারছি। আমার তো তাই এত দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

    বিষ্ণু - ধুর মশাই দুশ্চিন্তা। দাঁড়ান আপনার মতো আরও কেস এখানেই পেয়ে যাবেন। আমার কেসটা ভাবুন। আমারও তো ধর্মটর্ম কিছু আছে। বা ছিল। আমি কি কেঁদে ককিয়ে যাচ্ছি?

    সুন্দর - তুমি কী করে বুঝবে! প্রকৃত মানুষ কেমন তার ধর্ম তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেসব তোমার বোঝার মতো ক্ষমতাই নেই।

    বিষ্ণু - আপনার আছে বুঝি?

    সুন্দর - সদ্‌ব্রাহ্মণ সন্তান আমি। তোমার এইসব কথার উত্তর আমি সব দেব। না না কাকে এসব কথা বলছি! আমার লজ্জা হচ্ছে।

    বিষ্ণু - সেই লজ্জা হচ্ছে। তা আপনার ধর্ম আপনাকে বড় লাজুক করেছে দেখছি। শালা তুমি মাল একটা সিগারেট খাইয়েছো বলে ভেবো না আমি তোমার সব কথা সহ্য করব। এতক্ষণ আমি তোমার সম্মান রাখছিলাম। আর রাখব না। তুমি বিষ্ণুকে চেনো না।

    প্রথম - এসব কথায় কী লাভ? কেন আমরা সবাই এমন করছি? আমি ভাবছি আমরা কী করব? আমাদের সামনে কী কাজ?

    সুন্দর- কাজ একটাই। এই নাটক বন্ধ করা। ঠিক করে বলুন আপনারা কে? আপনি আগে বলুন আপনি কে?

    প্রথম - আমি মনে করতে পারছি না।

    সুন্দর - দাঁড়ান। আমি আপনাকে মনে করাচ্ছি। আপনার সব মনে পড়ে যাবে। আপনাকে আমি কি কোথাও দেখেছি!

    প্রথম - দেখতেই পারেন। দুজন মানুষের দেখা হতেই পারে। কিন্তু এ বিষয়ে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না।

    বিষ্ণু - আমার তো মনে হয় নাটকটা চালিয়ে যাওয়াই কাজের কাজ। তাতে যদি সময়টা কাটে! কাজ ছাড়া যে সময় কাটানো কী কঠিন কাজ আজ বুঝতে পারছি।

    সুন্দর - [স্বগতোক্তি] নাটক যে হচ্ছে স্বীকার করে নিল। শুনলেন তো! এই যে তুমি যে বললে তুমি কিছুই করতেন না।

    বিষ্ণু - ঠিক। কিছুই করতাম না কিন্তু দেখতাম। লোকজন দেখতাম। তারা কী করে দেখতাম। এত ছোটাছুটি। এত ব্যস্ততা সব দেখতাম। পেটে পরলে আরও ভালো দেখতাম যা ঠিক এমনিতে দেখা যায় না। কিন্তু সব কিছু দেখার পরে মনে হতো শালা এই মানুষেরা এত ছোটাছুটি করছে আসলে কিছু না করেই। আসলে কিছু করার দরকার নেই। শুধু নিজেকে না ব্যস্ত রাখলে কেমন পাগল পাগল লাগে তাই লোকে অমন করে। আর আপনাকে ব্যাস্ত রেখে লাভের গুড় নিয়ে সটকে পড়ে কিছু লোক। তারা সংখ্যায় কিন্তু খুব কম। খুবই কম। যেমন ধরুন মার্ক জুকেরবার্গ। ওই আপনাদের ফেসবুক। দেশে কারও চাকরি নেই কিন্তু ফেসবুকের দৌলতে কেউ বেকারও তো নেই!

    মহ - আমি ফেসবুক করি না তেমন। কিন্তু আমিও তো ছুটতাম। দিনরাত রাত দিন। কিন্তু কারও ক্ষতি তো করিনি। আছা বল তো ভাই কী এমন করলাম যে আমাদের আর বেঁচে থাকা হোল না? জানো আমি নানা হতে চলেছিলাম। দাদু। আহা আদরের কচি কচি হাত। আঃ।

    বিষ্ণু - এ নিয়ে তো কত কথা বলা হয়ে গেল। এসব ভেবে কী হবে। মানুষের পাপ। প্রকৃতির প্রতিশোধ। এসব তো নতুন কথা নয়। কেন আর এসব ভাবছেন? আমার শুধু মনে হচ্ছে এখানে সময় কাটবে কী করে।

    মহ - এখন বোঝা যাচ্ছে মৃত্যু কতটা ভয়ঙ্কর। মানুষ মৃত্যু কবে আসবে কেমন করে আসবে সে নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে। কিন্তু মৃত্যুর পরের সময় এতো কঠিন। হায় আল্লা।

    সুন্দর - না আমি আরেকবার ওই দিকটা ঘুরে আসি। এদের সঙ্গে থাকলে আমিও মরে যাব। সত্যি করেই মরে যাব। চলি। আপনারা থাকুন। [সুন্দর চলে যায়]

    প্রথম - আমায় কিন্তু সব কিছুই বেশ ভাবাচ্ছে। আমরা কে ছিলাম কোথা থেকে এসেছি এসব জানার প্রয়োজন নেই বলেই ভাবছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জানা দরকার। আপনারা কেউ জানেন আমি কী ছিলাম?

    বিষ্ণু - এই খেলাটাই তো খেলা যেতে পারে। মনে করার খেলা।

    প্রথম - আবার খেলা? না এখন আমার মনে হয় সে সব ভালো লাগবে না। আমি একটু আগুনগুলো দেখে আসি। আমার এখন ওটাই কাজ। দেখে আসি।

    [প্রথম চলে যায়]
    [মঞ্চে বিষ্ণু আর মহম্মদ। পরস্পরের কাছাকাছি আসে তারা। তারা নিজেদের মধ্যে একটু চাপা স্বরে কথা বলতে থাকে।]
    মহ - আমরা যে ওকে চিনতে পারছি সে কথা কিছুতেই এখন বলা যাবে না। কাউকেই বলা যাবে না।

    বিষ্ণু - এক্কেবারে।

    মহ - সুন্দর কেন ওকে চিনতে পারল না বুঝতে পারলে কিছু?

    বিষ্ণু - হ্যাঁ। সুন্দর যে ভাবছে ওর সব কিছু মনে আছে তা নয়। ও অনেক কিছুই ভুলে গেছে। তবে হ্যাঁ মনে পড়বে। সময় হলে ওর নিজের থেকেই সব মনে পড়বে।

    মহ - আমরা হয়তো সেটাই চাইছি। আমাদের মতো সামনে অনেকেই অপেক্ষা করে আছেন ঠিক কী হতে চলেছে সেইটা ভেবে।

    বিষ্ণু - তবে একটা কথা পরিষ্কার করা দরকার। আমরা কোনও নাটক করছি না। মানে আমরা এই দুজন। আমরা ঠিক বুঝতে চাইছি যে মনের নিয়ম আসলে কী? আদৌ কি নিয়ম বলে কিছু আছে? এই যে ধরুন স্পেস বদলে গেলে কি মনের নিয়ম বদলে যায়? নাকি সে ধ্রুব?

    মহ - বিষ্ণু আরও একটা জিজ্ঞাসা আছে। সে হল সময়। সময় কি সকলের জন্য এক রকমভাবে বয়ে চলে? সময় আর এই জগৎ তারা কি এক রকম ভাবে বাঁধা থাকে সর্বত্র? নাকি জায়গা বদল হলে সময়ের গতিবেগ বদলে যায়? অবশ্য। আমি তেমন মাথা খাটাতে পারি না। না না আপনাদের জন্য জটিল করব না। আমি ব্যবসা করতাম তো। জানি জটিল করলে কাস্টমার টেকে না। কোন কিছুই টেকে না। সহজ করে দেখতে হয়। সহজ কিন্তু সরল নয়। আমি শুধু জানতে চাইছি আমরা সামনে কেমন থাকব? আপনাদের মতো শুধু জানতে চাইছি।

    বিষ্ণু - জটিল করতে চাইছ না বলছ। কিন্তু করে ফেলছ। ওরকম করে বললে সবাই মুস্কিলে পড়ে যায়।

    মহ - না না জটিল করে আমরা তো দেখি না? সাধারণ মানুষের সে ক্ষমতা কোথায়?

    বিষ্ণু - দেখো। আমরা যে আছি। এত কিছুর মধ্যে এখনও যে আছি এখানে সেটাই তো সরলতা।

    মহ - তুমি কি কিছু কম জটিল করলে? যাই। আমি দেখি নমাজ পড়ি।

    [ সে এগিয়ে মঞ্চের এক ধারে যায়। ]
    মহ - আরে ওখানে কে একটা পড়ে আছে? [মঞ্চের এক কোণে একটি যুবককে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখা যায়]

    মহ - পানি কই পানি। জল কই জল? [মহম্মদ এক মগ জল জোগাড় করে তার মুখে চোখে জল দেয়। ছেলেটা উঠে বসে] কেমন লাগছে? একটু ভালো লাগছে?

    সবুজ - ভালো লাগছে।

    মহ - নাও আরও একটু পানি খাও।

    সবুজ - আমি কোথায়?

    মহ - সে সব পরে হবে। আহা রে একদম তরতাজা ছেলে। তুমি ওইখানটায় যেতে পারবে? ওখানে একটু আরাম আছে।

    [সবুজ আর মহম্মদ মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।]
    বিষ্ণু - আরে আপনি একে কোথায় পেলেন?

    মহ - ওই তো কোনায় পড়ে ছিল।

    বিষ্ণু - তা তোমায় পোড়ানো হয়েছে না কবর দেওয়া হয়েছে?

    সবুজ - আমি তো জানি না।

    মহ - তোমার নাম কী গো ছেলে?

    সবুজ - আমার নাম সবুজ।

    বিষ্ণু - বাঃ চমৎকার নাম। ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা। আধমরাকে…। না থাক। কোটেশন ভুল জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু মুস্কিল হল সবুজ বুঝতেই পারছে না ও কীভাবে এখানে এল? জাত ধর্ম নিশ্চয়ই কিছু বলতে পারবে না। এর মনে হয় প্রথমের থেকে আরও খারাপ অবস্থা। এর অবস্থাকে আমরা আমাদের সুবিধের জন্য নবজন্ম বলতে পারি। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ সবুজ। আ ভেরি হ্যাপি বার্থ ডে।

    মহ - যাক তোকে পেয়ে আমার যে ভালো লাগছে বাপ আমার। এতক্ষণ মনটা এক মুহূর্তের জন্যও ভালো লাগছিল না। তোর ভাগ্য দেখে যদিও আমার খারাপ লাগছে কিন্তু এখন তাও যেন কেন মনে হচ্ছে তোকে পেয়ে আমার বুকটা ভরে গেল।

    সবুজ - তুমি কে?

    মহ - আমি তোর বাপ রে হতভাগা।

    [ প্রথম এসে উপস্থিত হয় মঞ্চে]
    প্রথম - বাঃ কী চমৎকার লাগছে এই ছেলেটাকে দেখে। একদম নিষ্পাপ। তরতাজা গাছের মত। যৌবন একেই বলে। এর আসায় এখানকার পরিবেশটাই বদলে গেল। এক নিমেষে। ওর কি খিদে পেয়েছে? সবুজ তুমি কিছু খাবে? কিন্তু কোথায় খাবার পাওয়া যাবে? আমি তো কিছুই জানি না।

    [ সুন্দর আবার এসে উপস্থিত হয়। এবার তার সঙ্গে আরও কয়েকজন। তাকে এবার আর অতটা বিভ্রান্ত আর চিন্তিত লাগছে না। বরং একটু দৃপ্ত ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে]

    সুন্দর - আমি এখনও বেরনোর রাস্তা খুঁজে পাইনি। কিন্তু আমি আমার মতো কয়েকজন সাথিকে খুঁজে পেলাম। যাদের সঙ্গে আমার সময়টা কাটছে ভাল। তারাও আমার মতো করেই জীবনকে দেখে। হতাশ হয়ে পড়ে না। এক সঙ্গে থাকতে জানে। মানুষ যে আসলে সমাজবদ্ধ জীব সে কথা বিশ্বাস করে।

    বিষ্ণু - সমাজবদ্ধ কি না জানি না তবে সমাজে থাকলে তার অনেক সুবিধে হয়। দলে থাকলে আরও বেশি।

    সুন্দর - সাথিরা। আমরা যতক্ষণ না আমাদের অভীষ্টে পৌঁছতে পারছি ততক্ষণ আমরা এক প্রাণ। আমরা পৌঁছনোর পরেও এক প্রাণ। আমাদের বিপক্ষের অনেক কথা আমাদের শুনতে হবে কিন্তু আমরা জানি মানবতা আসলে এক সঙ্গে থাকার কথাই বলে। মানবতা সাথির সম্মানের কথা বলে। মানবতা মানুষকে এক সূত্রে গাঁথতে বলে। একটাই সুতো। একটাই মত। একটাই মন্ত্র।

    প্রথম - দেখুন এসব কথা এখন থাক। আপনারা কি জানেন এখানে কোথায় খাবারদাবার পাওয়া যায়? এই যে ছেলেটিকে দেখতে পাচ্ছেন এ বেশ ক্লান্ত। এর খাবার দরকার পরিচর্যা দরকার। আপনি কি কিছু দেখতে পেলেন?
    [হঠাৎ করে একটি নারীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।]
    মহ - আপনারা এদিকে আসুন। এই দিকটায়। আমি অপেক্ষা করে আছি। এইখানে আপনাদের আপাতত চলে যাওয়ার মতো সব আছে। [হঠাৎ বাজ পড়ার শব্দ হয়] দেখুন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই সময় আর আপনারা ওখানে থাকবেন না। একটু হেঁটে আসুন। ভয় নেই। আমি মিথ্যে বলছি না। হ্যাঁ হাঁটতে থাকুন। দেখুন আপনাদের ভালো লাগবে। এইখানে আপনাদের জায়গা হয়ে যাবে।

    অঙ্ক - ২

    দৃশ্য – ১


    হুরু রু রু হুরু রু রু হুরু রু রু
    হল সেই শুরু
    আমি জানি তুমি জানি আসবে
    আমি জানি তুমি ভালবাসবে।

    মেঘ গুরু
    বুকে দুরু
    কি তার শেষ আর কি তার শুরু
    সব হুরু রু রু হুরু রু রু হুরু রু রু

    কি ভাবো ভাবো ভাবো
    কি পাব কি না পাব
    যা আছে কি হারাব
    আমি যাব কি না যাব
    তবু জানি তুমি ভালবাসবে।

    তালফেরতা – দাদরা
    আহাহা আহাহা আহাহা আহা হা
    আহাহা আহাহা আহাহা আহা হা

    দেখ ঐ গায়ে লেগে গন্ধ বনের
    শরীরে শরীর ছুঁয়ে শুদ্ধি মনের
    আগুনে তাকাও দেখ সেই তো নাচে
    ভালোবাসা বাড়ছে যেন চাঁদের আঁচে
    না না না না না না
    ভেবো না আর ভেবো না
    না না না না না না
    তুমি কি এও বোঝ না
    এত তো হচ্ছে কথা কে শোনে
    যে তোমায় রাখার রাখে ঠিক মনে ।

    তুমি ভাঙো ভাঙো ভাঙো
    সব এমন করে ভাঙো
    ভাঙো তোমায় তুমি ভাঙো
    তাকে নতুন করে জানো
    আমি জানি তুমি জানি পারবে।


    দৃশ্য - ২

    [এক আলো ঝলমলে জায়গা। খানিকটা বাস্তব। খানিকটা মায়াবি। গান ভেসে আসতে শোনা যায়। মঞ্চে থাকে বিষ্ণু, মহম্মদ আর প্রথম। প্রথম মঞ্চের পেছনে। বিষ্ণু আর মহম্মদ সামনে। প্রথম আপন মনে গান গায়। ]
    বিষ্ণু - আহা চমৎকার একটা রাত। কী চমৎকার লাগছে। কি ভাই তোমার কেমন লাগছে।

    মহম্মদ - দারুণ। আমার প্রতিদিনই দারুণ। সবই তো ঠিকঠাক চলছে। এত ভালো থাকবো একি আর ভাবতে পেরেছিলাম।

    বিষ্ণু - তবে কী ভাবতে পেরেছিলে?

    মহম্মদ - কিছুই পারিনি। ভাবার চেষ্টা করিনি। দিব্যি আছি। এত ভেবে কী হবে!

    বিষ্ণু - আমার পথই তাহলে ঠিক কি বল মিয়াঁ?

    মহম্মদ - তোমার পথ নয় ভায়া। পথ আমারও নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানো আমরা কেউ নেই। শুধু পথটাই আছে।

    প্রথম - হারিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে আবার যাব মিশে

    ভাঙব বলেই গড়ব না হয় আবার ভালোবেসে।

    মহম্মদ - ঐ শোন প্রথম গান গাইছে। প্রতিদিন শুনতে শুনতে কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে।

    বিষ্ণু - হ্যাঁ অভ্যেস হবে না। কবে থেকে শুনছ বল তো!

    [গান] এখন কেমন সারাটা দিন আমার মনকে ভোলায়

    কারা এখন আমার কানে তোমার কথাই শোনায়

    কিসে তুমি থাকবে ভালো তোমার দুঃখ কিসে

    ভেবেই যাবে কী লাভ হবে! না হয় চলো ভেসে।

    মহ - খুব ভালো গান গাইতো। বাকি সব ছেড়ে গানটা ও ভুলে যায়নি এটাই একটা কাজের কথা। কিন্তু আবার আজ এত উদাস করা একটা গান ধরল কেন সে?

    বিষ্ণু - আসলে ও যে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। এখানেও তো দেখতে দেখতে অনেক দিন হয়ে গেল আমাদের। কিন্তু ও যে এখনও কোনও কিছুই তেমন মনে করতে পারছে না এটাই লোকটাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই সে উদাস থাকে সব সময়।

    [গান] বাঁচার কথাই বলবে যদি বলবে আমায় ডেকে?
    যাওয়ার কথা বলছ কেন আমায় মাঝে রেখে
    আমি কি আর শেষ দেখেছি কোথায় যাব শেষে
    হয়তো কোথাও দেখব তোমায় আবার নতুন দেশে ।
    বিষ্ণু - আমি এতদিনেও বুঝতে পারলাম না মানুষকে কে ঠিক বদলায়? পরিবেশ না সে নিজেই। আর কোন দিকে বদলায়? উল্টো দিকে সে বদলাতে পারে না? ধরো শুঁয়ো পোকা। শেষ পর্যন্ত সে প্রজাপতি হয় বলেই মানুষ তাকে ভালো বলে। তাকে নিয়ে কবিতা লেখে গান লেখে। কিন্তু যদি প্রজাপতি ধীরে ধীরে শুঁয়োপোকা হয়ে জীবন শেষ করত? তাহলে আমরা তাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করতে পারতাম?

    মহ - ভাবার কথা। কিন্তু আমরা তো আর বিচার করতে যাচ্ছি না। ওই যে সবুজ আসছে। আমরা চুপ করে যাই। দেখ দেখ আরও স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে। কালো রঙটা যেন এক্কেবারে ঠিকরে বেরোচ্ছে শক্তিশালী শরীর থেকে। না না নিজের ছেলের দিকে নজর দিতে নেই। আমারও দিন দিন মাথাটা কেমন গোবর হয়ে যাচ্ছে।

    [সবুজের প্রবেশ]
    সবুজ - (গাইতে গাইতে) “হারিয়ে যাওয়ায় অঙ্গীকারে আবার যাব মিশে" কেমন সুন্দর গান বেঁধেছে বল তো প্রথম? আমাকে এই গানটা শিখতে হবে। গানটার মধ্যে স্ট্রিংস ঢুকলে অসাধারণ যাবে। মেলো আর মেলোডি।

    মহ - তোর কথা বুঝি না। আমার ওসব যন্ত্রটন্ত্র কিছু ছাড়া খালি গলায় গানই সব থেকে ভালো লাগে।

    সবুজ - তা লাগে। কিন্তু নতুন কানে। মানে একদম যে একটা নতুন গান শুনছে তার জন্য একটু মিউজিক তো লাগে। নইলে সবাইকে টানে না।

    মহ - সবাইকে টানল কি না টানল তাতে কিছু এসে যায় না। নিজেকে টানছে কি না সেই আসল।

    সবুজ - তোমাকে কী বলি বলতো! আমি কি বলেছি এটা ভালো নয়? সিনেমায় হিরোইনদের দেখেছ?

    মহ - হিরোইন?

    সবুজ - হ্যাঁ হিরোইন। কত মেক আপ থাকে জানো। সুন্দরী তো তারা বটেই কিন্তু সিনেমার জন্য তাদেরও আলাদা করে সাজতে হয়।

    বিষ্ণু - এসব বিষয়ে তুই আমার সঙ্গে কথা বল সবুজ। তুমি জানো না আলি সাহেব ওই রসে বঞ্চিত। দেখ কেমন লজ্জা পাচ্ছেন! যাই হোক তা তোর আর সব কি খবর? কিছু তো করতে হবে এবার।

    সবুজ - আমি এত ভাবি না, আমি কী করব। আমার কী হবে এসব একদম ভাবি না। এই শরীর আছে। খেটে খাব বেঁচে থাকব। আমি কোনও ইঁদুরদৌড়ে নেই।

    প্রথম - এই হচ্ছে কাজের কথা। তোকে আমি দেখছি তুই সত্যি করেই মানুষ হচ্ছিস।

    মহ - কাজের কথা আবার কি? বন্ধুগুলো সব জান লড়িয়ে পড়াশোনা করল। তারপরে তারা সব ইঙ্গিনিয়ার ডাক্তার হচ্ছে। উনি কি এখনও বাড়ি বসে ভেরেণ্ডা ভাজবেন?

    সবুজ - আমার মনটা যদি শান্তি পায় সেটাই আমার শক্তি বুঝলে আলি থুড়ি বাপ আমার।

    প্রথম - আমি পুরোপুরি সবুজকে সমর্থন করি। ওর সাহস ওকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের সময়টা এমন ছিল না জানিস। আসলে আমাদের সাহস ছিল না।

    সবুজ - তোমাদের আমাদের সময় বলে কিছু হয় না। যার সাহস থাকে সব সময়েই সাহস থাকে। সব যুগেই থাকে।

    প্রথম - তা ঠিক। আমার হয়তো সাহস ছিল না।

    বিষ্ণু - চল হে আলিভাই আমরা আমাদের কাজে যাই। এরা এদের সাবজেক্টে ঢুকে পড়েছে। আমরা কেটে পড়ি।
    [বিষ্ণু আর আলি চলে যায়]

    সবুজ - তুমি মানুষটা অদ্ভুত প্রথম। তোমার মধ্যে একটা দুঃখ বয়ে বেড়ানো আছে। কিন্তু হতাশা নেই। তোমার গানগুলো তাই শুনলে মন খারাপ হয় শুরুতে তারপরে বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। সেটা দুঃখের হলে আমার ভালো লাগত না। আমার বন্ধুদের তো কোনও মতেই ভালো লাগত না।

    প্রথম - তোর বন্ধুরা এই সব ফালতু গান শোনে! আমি তো এসব এমনি তৈরি করি। এমনি গাই।

    সবুজ - এই তো সেদিন এক জনের বাড়িতে 'কী বলি তোমাকে' গাইছিলাম। লোকজন চুপ করে শুনছিল। আরও গাইতে বলল।

    প্রথম - ওরে বাবা। এ তো আমার পক্ষে খুব সুখবর। আমার এই বিদ্যে যে এত দিন পরে, এত কিছুর পরে লোকজনের ভালো লাগবে সে তো ভাবতেও পারিনি।

    সবুজ - আরে ভালো কেন লাগবে না। কে গাইছিল দেখতে হবে তো? কিন্তু তুমি এতো কিছুর পরে......। এই কথাটা কেন বলো?

    প্রথম - সেই তো অদ্ভুত কথা। যার কিছুই আমি নিজেও বুঝতে পারি না।

    সবুজ - তুমি সেই এক কথা বল। পাড়ার লোকেও সেই কথা বলে।

    প্রথম - কী বলে রে?

    সবুজ - এই বলে তুমি নাকি হেঁয়ালি করো। পরিষ্কার করে কিছু বল না।

    প্রথম - আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারি না রে। আমার এই জীবন কিছু বুঝতে না পেরেই যে চলে যাচ্ছে।

    সবুজ - লোকজন অমন বলে। বেশিরভাগ মানুষই তো এখানে কবে কীভাবে এসেছিল সে সব বলতে পারে না। কিন্তু তারা তোমার মতো এসব খুঁজতেও চায় না। দিব্য খায় দায়। কাজ করে বা করে না। গুলতানি মারে। পরনিন্দা পরচর্চা করছে। এতো ভাবার সময় কোথায়?

    প্রথম - তোর কি মনে হয় আমি ঠিক করি? [হেসে জিজ্ঞেস করে]

    সবুজ - অবশ্যই ঠিক করো। আমি কে, আমি কী কাজে লাগতে পারি সে সব যদি আমি না জানলাম তাহলে আমি জন্মালাম কেন?

    প্রথম - এই তো কাজের কথা।

    সবুজ - এসব তুমি আমার মধ্যে ঢুকিয়েছ। এখন আমিও তোমার মতোই মাঝে মাঝে ভাবতে বসি।

    প্রথম - কিন্তু এ জীবন কিন্তু উপভোগ করার জন্যও। এইসব ভেবে ভেবে দিন কাটিয়ে দিলেও কিন্তু তুমি ঠিক করবে না।

    সবুজ - না না। সে তো বটেই। যখন যা তখন সেই কাজ। শোনো পরশু দিন আমরা নিউ টাউন ক্লাবের সঙ্গে খেলতে যাচ্ছি। ওদের মাঠে। ওদের টিমটা ভালো। একটা হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ হবে মনে হচ্ছে। তুমি যাবে দেখতে? আলি আর বিষ্ণু বলেছে যাবে।

    প্রথম - আমি? আমি আর কোথায় যাব। ওরা যাচ্ছে তো। ওখানে কী হল, কে ভালো খেলল তুই কটা গোল করলি আর কেউ না বলুক তোর বাবাই আমায় সব বলবে।

    সবুজ - তাও বলা থাকল। ইচ্ছে করলে তুমি যেও। আর যদি না যাও তাহলে তুমি আমার জন্য আরও একটা গান বাঁধবে।

    প্রথম - ঠিক আছে ঠিক আছে।

    সবুজ - আমি চলি।

    প্রথম - আচ্ছা আয়। আমি দেখছি কী করি।

    সবুজ - হারিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে আবার যাব মিশে
    ভাঙব বলেই গড়ব না হয় আবার ভালোবেসে।
    [সবুজ গানটা গাইতে গাইতে আনন্দ করতে করতে চলে যায়। প্রথম মঞ্চে একা]

    প্রথম - পাগল ছেলে। ছেলেটা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওর জন্য আমি বেঁচে আছি। লোকে ছোটদের উৎসাহ দেয়। আর ওই ছেলেটা এই বুড়োটাকে উৎসাহ দেয়। ও কেমন করে বোঝে আমাকে! বুড়োদেরও যে উৎসাহ দিতে হয় আর একটু বেশিই দিতে হয় সে কথা কেউ তো বোঝে না। ও কেমন করে বোঝে। ওরে আমি গান বাঁধব সব গান কেবল তোর জন্যই বাঁধব। তোর থাকবে সব। তুই যা পারিস করবি। আমি শুধু মুক্তি খুঁজছি। আমি আমাকে যেদিন খুঁজে পাব সেদিন কি আর এসব গানের কিছু মূল্য থাকবে আমার কাছে। এসব তো আমার ভুলে থাকার ওষুধ। শরীর ঠিক হয়ে গেলে ওষুধের আর প্রয়োজন কী?

    প্রথম [নেপথ্যে] - কিন্তু তুমি তো জানো না কবে তোমার শরীর ঠিক হবে।

    প্রথম - তা জানি না। কিন্তু আমি তো চেষ্টা করছি।

    প্রথম [নেপথ্যে] - কী চেষ্টা তুমি করছ?

    প্রথম - আমি যে খুঁজে যাচ্ছি সেই দিন থেকে। ও কী বীভৎস সেই দিন।

    প্রথম [নেপথ্যে] - আরও বীভৎসতা তো সেইদিনের আগেও থাকতে পারতো। তুমি ভুলে গেছ।

    প্রথম - তা গেছি। অনেক দিন হয়ে গেল তো। তাছাড়া এখানে আসার পর থেকে এত কাজে জড়িয়ে গেছি যে আমি সব ভুলতে বসেছি।

    প্রথম [নেপথ্যে] - তুমি ভালো আছ?

    প্রথম - এখন আমি বেশ ভালো আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় এমন ভালো আমি আর কোনদিনই ছিলাম না। তারপরেই মনে হয় ভালো কি কেউ থাকে? মানুষ ভুলে থাকে। এসব নিয়ে বিষ্ণু দারুণ সব কথা বলে।

    প্রথম [নেপথ্যে] - তোমার সব কিছু মনে পরে গেলে কী করবে?

    প্রথম - আনন্দ করব। দারুণ আনন্দ করব। পাড়া শুদ্ধু সকলকে খাওয়াব, বিলোব।

    প্রথম [নেপথ্যে] - আচ্ছা তোমার ওই দুই বন্ধুকে কখনও কিজ্ঞেস করো না কেন? তারা তোমায় চেনে কি না।

    প্রথম - তারা আমায় চিনলে বলত। এতো দিন ধরে গোপন করে রাখবে কেন তারা? আমি কি তাদের কিছু ক্ষতি করেছি?

    প্রথম [নেপথ্যে] - তুমি বড় সরল হয়ে গেছ। তুমি আগে কেমন লোক ছিলে?

    প্রথম - বাজেই ছিলাম মনে হয়। ভালো লোক কি পৃথিবীতে হয়? নিরামিষ খেয়েও কি ভালো লোক হতে পারছি? দেখো ওই লাউ গাছটা। ওটা আমার বাগানের পলকা মাচাটা জড়িয়ে জড়িয়ে কেমন বড় হয়েছে। যেন আমাকেই সে জড়িয়ে থাকে। আমি কাছে গেলে বাচ্চা ছেলের মতো হাসে। কিন্তু বলতো গাছটার শরীরে কত কোষ? হাজার হাজার কোটি কোটি। সব জীবিত। ঘুরছে ফিরছে খেলছে। ভেতরের প্রাণ চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। কাল সকালে ওটাকে আমি নুন মশলা দিয়ে রান্না করব। তারপর দুপরবেলা ভাতের সঙ্গে মেখে তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে নেব। আমি খেয়ে নেব সব জীবন। জীবন্ত সব কিছু। সব জ্যান্ত গিলে......হা হা হা ।

    প্রথম [নেপথ্যে] - দানব। দানব। দানব। তুমি একটা দানব। তুমি কোনদিন ভালো ছিলে না। কোন দিন ভালো থাকবেও না। না না না ...
    [ মঞ্চ অন্ধকার হয়ে ওঠে]

    দৃশ্য – ৩


    [ নেপথ্যে শব্দ শুনতে পাওয়া যায়]
    থ্রি চিয়্যারস ফর
    ব্লু হেভেন ক্লাব
    হিপ হিপ হুররে
    লঙ লিভ ব্লু হেভেন ক্লাব
    হিপ হিপ হুররে
    বন্ধু ১ - কি খেলা হল রে। সত্যি বলছি ভাবিনি জিতব।

    বন্ধু ২ - সবুজ তো শেষটা বদলে দিলো। ওকে রিড করতে পারছিল না ওদের লেফট ব্যাক। ঐ ড্রিবলটা ভাবতেই পারে নি।

    বন্ধু ১ - তোর কি ডানা গজাল নাকি তখন। কাকে বলছি! দ্যাখ কেমন চুপ। কোনও কথাই বলে না।

    বন্ধু ৩ - আর গোলকিপারটা লেফট বারে এসে রাইট বার দিয়ে গোলটা হওয়াটা দেখল।

    বন্ধুরা - ইয়েস উই। উই দ্য গ্রেট ব্লু হেভেন বয়েস স্ক্রিউড দোস গার্লস অফ্‌। ইয়ে।

    সবুজ - আচ্ছা রে আমি চলি। আমায় অনেকটা ফিরতে হবে।

    বন্ধু ১- কাল আসছিস তো? কাল পার্টি।

    [ সবুজ একা একটা পথ ধরে হেঁটে যেতে থাকে। সন্ধে হয়ে আসে। মোহময় আলো নেমে আসে ওপর থেকে। সেই আলোতে দেখা যায় একটি মেয়ে। অপরূপ লাবণ্যময়ী। সবুজ তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। ধীরে ধীরে একটু কাছে আসে। চোখ ফেরায়। আবার তাকায়]

    মহী - তুমি এত লাজুক!

    সবুজ - আমাকে?

    মহী - আর কে আছে এখানে?

    সবুজ - না মানে। আমি তোমাকে চিনি না।

    মহী - তুমি কী ভালো খেল! গোলটা কী অদ্ভুত দিলে!
    [আবছায়ায় মিলিয়ে যায় মহী। মঞ্চের মাঝে চলে আসে সবুজ। বিস্মিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ়]

    সবুজ - এ কে? এত সুন্দর। আমাকে কেন ডাকল?
    [ অন্ধকার হয় ]

    সবুজ - আচ্ছা প্রথম ভালোবাসা কী হতে পারে?

    প্রথম - ভালোবাসা নিজেকে জানার সব থেকে শক্তিশালী উপায়।

    সবুজ - তুমি কখনো ভালবেসেছ?

    প্রথম - বেসেছি। না। না। বাসিনি। যদি বাসতাম তাহলে এমন না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে থাকতাম!

    সবুজ - না না। এসব ভেবো না। বলো। ঠিক করে বলো।

    প্রথম - আমি যা দেখেছি বুঝেছি তাতে ভালোবাসা সবার ভাগ্যে জোটে না। যদি জোটেও সে তাকে চিনতে পারে না। চিনলে রাখতে পারে না। বা কোনও রকমে রাখলেও থাকতে পারে না। খাবি খায়। মাঝ নদীতে খাবি খায়।

    সবুজ - তুমি বড়ো নদী দেখেছ?

    প্রথম - নিশ্চয়ই। কত চওড়া সে নদী। এপার ওপার করার দুঃসাহস কেউ করতে পারত না। আগে নদীই তো জীবন ছিল। সমুদ্র সবসময় রোমাঞ্চ। রূপকথা। নোনতা জলে জাহাজ ভাসানো যায়। কিন্তু তৃষ্ণা মেটে? হ্যাঁ ছিল ছিল। নদী ছিল। সে নদীতে ভয়ও ছিল আবার প্রাণও ছিল।

    সবুজ - এই যে বল তোমার কিছু মনে নেই।

    প্রথম - আমি তো এসব মনে করতে পারি। কিন্তু ওই সেই। নিজেকে পারি না।

    সবুজ - আচ্ছা বল। ডিস্টার্ব করছি না।

    প্রথম - নদী ছিল। নৌকো ছিল।

    সবুজ - এ দেশের নদীটা তো মরে যাচ্ছে।

    প্রথম - হ্যাঁ আমাদের নদীটা শুকিয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই তো এত খারাপ আছে মানুষ।

    সবুজ - শুধু মানুষের দোষ নয়। প্রকৃতি তো নিজেই বদলায়। মানুষকে তার সঙ্গে বদলাতে হবে।

    প্রথম - সেটা মেনে নিলে মানুষ তাও ভালো থাকত। কিন্তু সে তো উল্টোটা করে। নদীরা মরে যাচ্ছে। তার কারণ মানুষের ভালোবাসা মরে যাচ্ছে। নদী হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে।

    সবুজ - তোমাদের কিন্তু একটাই কথা সব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই কি ভালো হচ্ছে না? আমার তো মনে হয় এটা সব সময় বুড়োরা বলে। আমরা তো এসব নিয়ে ভাবিই না। আমি বিশ্বাস করি মানুষ যেমন ভুল করে তেমন শুধরে নিতেও জানে। এত চারিদিকে হিউম্যান রাইটস মুভমেন্ট হচ্ছে, এনভাইরনমেন্ট মুভমেন্ট হচ্ছে সে তো আশার কথা। আর প্রকৃতি যদি নিজেকে ভালবাসে সে আবার নদীকে বাঁচাবে। মানুষকে বাঁচাবে। নইলে যা হয় হবে।

    প্রথম - এইটার জন্যই তো আমি কোন বুড়োর সঙ্গে কথা বলি না। শুধু তোর সঙ্গে কথা বলি। তুই আশার কথা বলসি। তুই এগোনোর কথা ভাবিস। এগিয়ে যা। এগিয়ে যা। কিন্তু চোখ কান খোলা রাখতে হবে। খুব চোখ কান খোলা রাখতে হবে।

    সবুজ - তুমি আমি হলে কী করতে?

    প্রথম - আমি তুই হলে কী করতাম! আমি তুই হলে কী করতাম! আমি তোর বয়েসের হলে চুটিয়ে একটা প্রেম করতাম।

    বিষ্ণু - আমি এসে গেছি। আসল জিনিসপত্র নিয়ে। আজ একটু উৎসব হবে নাকি?

    প্রথম - হবে হবে উৎসব হবে। গান হবে খাওয়া দাওয়া হবে। সব একসঙ্গে হবে।

    মহ - হ্যাঁ হ্যাঁ একসঙ্গে হবে। কিন্তু হাতে ওই দুটো কি? না না না না ওইগুলো এক্কেবারে ফালতু জিনিস।

    বিষ্ণু - আরে থাম তো। এটাই তো আসল । আরে লোকজন সব কোথায়? আরে সবাই এসো।

    [নাচতে নাচতে গান - ]
    আমার সব গুলিয়ে যায় যেন সব গুলিয়ে যায়
    মাথার ভেতর পোকার বাসা কুড়কুড়িয়ে খায়।

    থাকি জলের ভেতর ডাঙ্গায় ফেলি ফাতনা
    আমি জাল বেছাতে মেলি কেবল পাখনা।
    আমি পুষতে পাখি বলি উড়ে যাক না
    আহা যাক না চলে যাক না
    যেন সব হারিয়ে যায়।।

    আমি অন্ধকারই দেখি
    তবু আঁধার দেখি না।
    আমি দুহাত দিয়ে ছুঁয়েও
    কেন ধরতে পারি না!
    আমার ঘরে থেকেও ঘরে ফেরার বায়না
    যেন চামচিকিকে বলি মনের ময়না
    আমার মুণ্ডু নাচে হাতের ভেতর
    শরীর দেখা যায় না
    বল তাই না ঠিক তাই না?
    মহ - আর খায় না, না না খায় না ।

    বিষ্ণু - ওরা চায় না কেন চায় না

    সবাই মিলে - যেন সব গুলিয়ে যায় ।।
    [ মঞ্চ অন্ধকার হয়। মিউজিক ]

    [ পরের দিন। ক্লাবের পার্টি। ভারি ডিজের শব্দ। নাচ গান হৈ হুল্লোড় চলছে। সুন্দর কিছুক্ষণ বাদে বক্তব্য রাখতে থাকে]
    সুন্দর - আজ আমাদের ক্লাবের এক আনন্দের দিন। আমাদের ক্লাবের মেরুদণ্ড যারা সেই তোমরা আমাদের আজ জয় এনে দিয়েছ। জয় মানুষের জীবনে খুব প্রয়োজনীয় এক ব্যাপার। জয় মানুষকে বদলে দেয়। সেই জয়ের কাণ্ডারি হিসেবে সব জায়গাতেই দেখা যায় তোমাদের মতো কম বয়েসি ছেলেমেয়েদের। কিন্তু তাদের মনের কথা বোঝে কে? যুবসমাজকে উৎসাহিত করার দায়িত্ব কার? এই সমাজের। কেন বলা হবে আমাদের নতুন প্রজন্ম দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। এই তো তোমরা দেখিয়ে দিলে। আমরা দেখিয়ে দিলাম। মানুষের মধ্যে ক্ষমতার আকর। আমরা সেই ক্ষমতাকে প্রশ্রয় দেব। আমি ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেক জয়ী প্লেয়ারকে সোনার চেন আর টাকা দিয়ে উৎসাহ দেব। উৎসাহ জরুরি। টাকা জরুরি। জীবনে সম্মান জরুরি। ভালো থাকা জরুরি। সামনে আরও বড় লড়াই। জিততে হবে। জীবন যেমন খেলা জীবন তেমন লড়াইও। জীবনে লড়াইয়ের মধ্যেই আনন্দ…। খেলা হবে । খেলা হবে । খেলা হবে।

    [প্রচুর হাততালির শব্দ। সবুজ বক্তৃতা শুরু হতে হতেই আলাদা হয়ে যায়। গিয়ে মঞ্চের মাঝে আবছা অন্ধকারে বসে। হঠাৎ দেখে মহী সেখানে এসেছে। ]
    মহী - তোমার ভালো লাগার কথা নয়।

    সবুজ - কেন?

    মহী - আমি বুঝি। আমি তোমায় বুঝি।

    সবুজ - তোমার গলার স্বর আমার এতো চেনা চেনা লাগে কেন? আমি কি তোমার সঙ্গে অনেক আগে কোনওদিন কথা বলেছিলাম?

    মহী - ওই পাহাড়ের দিকটায় যাবে? ওখানে এখনও নদীটার জল আছে। তিরতির করে বয়ে যায়। একটা ছোট ঝর্নাও আছে। ওখানে যেতে আমার সব থেকে ভালো লাগে। তুমি যাবে?

    সবুজ - যাব। [হাঁটতে থাকে]

    মহী - তুমি কম কথা বল? না আমার সঙ্গে কথা খুঁজে পাও না?

    সবুজ - বলছি তো।

    মহী - হ্যাঁ তিনি বলছেন। তিনি বলে বলে আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছেন। আচ্ছা। [দূরে দেখায়] এই দেখ এখান থেকে আমাদের জায়গাটা কত সুন্দর লাগে দেখ। আমি সময় পেলেই এখানে এসে বসে থাকি। এখানে এক সময় বাদামি খরগোশ আসত বলে শুনেছি। শুনেছিলাম তারা না কি চুপ করে এসে কখন নাকি কোল থেকে জমানো বাদাম নিয়ে পালিয়ে যেত। আমি কতবার এখানে এসে বসেছি। এককাঁড়ি বাদাম নিয়ে। কিন্তু তাদের দেখা পাইনি। ওরা নিশ্চয়ই বেঁচে আছে বল?

    সবুজ - নিশ্চয়ই। এত সহজে মরে যেতে পারে নাকি কেউ?

    মহী - মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে? আমার বর্ষাকাল খুব ভালো লাগে জানো?

    সবুজ - আমারও।

    মহী - আহা বৃষ্টি। বৃষ্টি। সবুজ পাতা। আহা সবুজ পাতা। [সংবিৎ ফেরে] ওঃ ভুলে গেছিলাম। তুমি লজ্জা পেও না। তোমার বয়েসিরা অবশ্য আজকাল কেউ লজ্জা পায় না। আমার বর্ষা আরও ভালো লাগে যদি পছন্দের কেউ সঙ্গে থাকে। দেখো পাহাড়, তিরতিরে নদী আর আকাশ সব কেমন এক হয়ে যাচ্ছে। বিকেল আর সন্ধ্যের মাঝের সময়টা এক অদ্ভুত সময়। আলো বা অন্ধকার কারো যেন সে নয়। সে শুধু নিজের মতো। আমি তোমাকে বোর করছি।

    সবুজ - না না। আমার ভালো লাগছে। এমন কথা প্রথমও বলে।

    মহী - কে প্রথম?

    সবুজ - প্রথম আমাদের সঙ্গে থাকে।

    মহী - তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড বুঝি?

    সবুজ - তা এক রকম।

    মহী - একটু রাত নেমে এলে এখান থেকে পরিষ্কার করে তারাদের দেখতে পাওয়া যায়। নিচ থেকে তো আজকাল আর কিছু দেখা যায় না। সব আলোয় আলো। তারাদের কেউ চেয়েও দ্যাখে না।

    সবুজ - হুম। অন্ধকার হয়ে আসছে।

    মহী - আচ্ছা। আজ ফিরে চলো। একদিন আবার আসবো তোমার সঙ্গে। অন্ধকারে অচেনা তারার খোঁজ করতে।
    [এর পরে মঞ্চে কেউ থাকে না। সবুজ আবার একা মঞ্চে আসে। সে আনন্দ পায়। শিহরিত হয়। বাতাসে ভেসে আসে গান। প্রথমের গলায়। রাগ - কাফি/বেহাগ]

    আমাকে চেনাবে তুমি এই ভরসায়
    এভাবে এমন করে বসে থাকা যায়
    বসে থাকা যায়।

    ইট কাঠ ঢেকে আছে মন
    মনের ভেতরে গহন
    আমি যাকে নিজে চিনি না
    সে কি তবে চিনতে আমায়?

    [রাতের আবছায়ায় বিষ্ণু আর আলি।]

    আলি - হায় আল্লা। এ মেয়ে কোথা থেকে এল।

    বিষ্ণু - কী বলতে চাও? ছেলে প্রেম করবে না? আগেই করা উচিত ছিল। আমার তো সন্দেহ হচ্ছিল শরীর-টরির ভেতরে ভেতরে সব ঠিক আছে কি না ।

    আলি - ন্যাকা সেজো না।

    বিষ্ণু - তোমার এতো দুশ্চিন্তার কী আছে?

    কেন তবে লিখে যেতে হয়
    তার কথা। মনে থাকে না।
    সে যদি এতোই আপন
    কেন কেউ মনে রাখে না?

    কেন তাকে রাখি না ধরে?
    যুগে যুগে এই শরীরে
    কেন বল মন বদলায়?
    সেও বুঝি তোর ভরসায়।
    এভাবে এমন করে বসে থাকা যায়.........

    বিষ্ণু - কিন্তু এমন গান শুনে আমারও তো অস্থির লাগছে বন্ধু।

    মহ - তোমার মনও অস্থির?

    বিষ্ণু - কেন হবে না? এই গানে তো আমার নিজের বলেও মনে হচ্ছে। [বিষ্ণু মদ খায়]

    মহ - আমারও কষ্ট হচ্ছে। আমি তো এখানে অভাবে নেই। কোনও কিছুরই অভাবে নেই। তাও আমার কেন কষ্ট হচ্ছে?

    বিষ্ণু - কোনো কিছুর অভাব না থাকাটাই তো কষ্ট।

    মহ - আল্লা বলে একরম আর আমরা মানে করে নিলাম আর এক রকম। এত কিছু কী হবে?

    বিষ্ণু - সেই। তোমরা তো আবার ডারউইন মানো না।

    মহ - তোমরাও তো মানো না। নইলে সিলেবাস থেকে তোমরা তুলে দিলে কেন?

    বিষ্ণু - ধুর শালা। আমার আবার জাতধর্ম।

    মহ - আচ্ছা জানো ওই সুন্দর মুখার্জি তো আমাদের কারখানাটা কিনে নিচ্ছে শুনলাম।

    বিষ্ণু - তোমাকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবে কি?

    মহ - দিতে পারে। মালিক চাইলে কি না পারে। আমার চিন্তা নেই। সবুজ বড় হয়েছে। আজ বাদে কাল কিছু একটা করবেই। কিছু না হলে কারখানায় কাজ করবে। জওয়ান ছেলে।

    বিষ্ণু - তাহলে চিন্তা কোরো না। বিন্দাস থাকো। একটু মাল খাবে নাকি? বাংলা?

    মহ - তওবা তওবা। তুমি খাও। বাংলাকে আর কে খেতে বাকি রেখেছে। আচ্ছা সবুজের সঙ্গে মেয়েটাকে কিন্তু ভারি ভালো মানাচ্ছিল বল। আমার তো চোখ জুড়িয়ে আসছিল দুজনকে এক সঙ্গে দেখে।

    বিষ্ণু - হুম। [চিন্তিত]

    মহ - বিয়ে শাদির দিকে আমি যাচ্ছি না। বিয়ে শাদি পরের কথা। হতেও পারে নাও হতে পারে। কিন্তু প্রেম আহা প্রেম।

    বিষ্ণু - হুম।

    মহ - কী তখন থেকে হুম হুম করছ?

    বিষ্ণু - আমি ভাবছি।

    মহ - কি?

    বিষ্ণু - আমি ভাবছি… [চিন্তা না দেখিয়ে হেসে ওঠে] অল্পবয়েসিদের প্রেমের দিকে নজর দিও না বুড়ো। এ স্বভাব ভালো নয়।

    মহ - বেলাগাম জবান তোর বিষ্ণু। সময় যায় কিন্তু তুই বদলাস না।

    বিষ্ণু - তুইও বদলাস না বুড়ো। তুইও বদলাস না। আমরা কেউ বদলাই না। তুই বরং দুশ্চিন্তা কর। করেই যা। করেই যা। হা হা হা।

    দৃশ্য – ৪

    [মায়াবি আলো। মঞ্চে আলোর কেন্দ্রে মহী আর সবুজ]

    মহী - তুমি কি আজকাল একটু কম লাজুক হয়েছ?

    সবুজ - সে তো তুমি বলবে।

    মহী - আমিই তো বলে যাচ্ছি। সেই প্রথম দিন থেকে।

    সবুজ - আমি যা বলতে চাইছি। সেটা বলা খুব কঠিন।

    মহী - নাঃ তোমার হবে না।

    সবুজ - কী হবে না?

    মহী - কিচ্ছু হবে না।

    সবুজ - দেখ। তুমি খুব সুন্দর। এটা বলতে মোটেও আমার বাধছে না। কিন্তু আমার অন্য কিছু বলার আছে।

    মহী - স্মার্ট।

    সবুজ - না। আমি মনে করতে পারছি না। ঠিক কি বলব।

    মহী - আনস্মার্ট।

    সবুজ - আমি মনে করতে পারছি না তোমার গলাটা আমি কোথায় শুনেছি। কিন্তু কোথাও শুনেছি। আমি তোমাকে দেখিনি কখনও। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি আমার অপরিচিত নও।

    মহী- স্মার্ট।

    সবুজ - আমি যতক্ষণ না ধরতে পারছি তোমার গলা কোথায় শুনেছি ততক্ষণ আমার বুকের ভেতরটা ছটফট করছে।

    মহী - আনস্মার্ট। আনস্মার্ট। বেশ খারাপ কপাল আমার।

    সবুজ - কেন?

    মহী - বাদ দাও তার থেকে তুমি বরং বল। এমনি কথা বল।

    সবুজ - কি বলব! আমি কিছু ভাবি না তেমন। আমার সব যেই ভাবা সেই কাজ জাতীয়। বাড়িতে বাবা তাই বলে আমার কোনও দিশা নেই। বিষ্ণু আর প্রথম অবশ্য বলে আমি যা করছি ঠিক করছি। আমি গান গাইতে চাই।

    মহী - ভালো কথা তো। তুমি কত চমৎকার গান কর। এসব এখন থাক তুমি বরং একটা গান শোনাও। আমি শুনি।

    সবুজ - আমার ভালো থাকার ফন্দি ফিকির
    ইকির মিকির চামচিকির
    কে পড়ল ধরা?
    আমি জাল ফেলে
    সেই চেয়েই আছি
    দুপুর বেলা।
    মহী - কি সুন্দর। কি সুন্দর!

    সবুজ - আমি খলবলানো খলবলানো
    শব্দ শুনি
    কেউ কি এলে?
    জালের ভেতর লাফায়
    কে দেখ দুচোখ মেলে।
    দুচোখ আমার মেলাই থাকে
    বুঝলে হুজুর
    শব্দ তুমি শুনছ
    যা সব মনের ভুলে ।
    [সবুজ আর মহী একসঙ্গে - ]
    আমার ভালো থাকার ফন্দি ফিকির
    ইকির মিকির চামচিকির
    কে পড়ল ধরা?
    আমি জাল ফেলে
    সেই চেয়েই আছি
    ভর দুপুর বেলা।
    মহী - কি অদ্ভুত কথা।

    সবুজ - প্রথম লিখেছে তো। আমি সুর দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রথম এক অদ্ভুত মানুষ। তুমি যেদিন আমাদের ওখানে যাবে সেদিন তোমার সঙ্গে দেখা করাবো। লোকটা যখন কথা বলে মনে হয় নিজের কথা নয় মানুষের ইতিহাস বলছে।

    মহী - তোমার মধ্যেও কেমন একটা ইতিহাস ইতিহাস ভাব দেখতে পাচ্ছি। একটু বর্তমানে থাকুন তো দেখি।

    সবুজ - যখন যাবে দেখবে আমাদের পাড়াটাই অদ্ভুত। সব সৃষ্টি ছাড়া।

    মহী - সে তো তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি।

    সবুজ - তোমার কথা কিছু বল। আমি তোমাকে জানতে চাই।

    মহী - একদিনে কি কিছু জানা যায়। আস্তে আস্তে জানতে পারা যায়। তারপর দেখলে আমার থেকে তুমি আমাকে বেশি চিনে ফেললে।

    সবুজ - তা তো হতেই পারে। তুমি আসার পর থেকে আমি যেমন নিজেকে আরও চিনছি।

    মহী - আমরা দুজনেই কি বেমানান।

    সবুজ - কেন বলছ?

    মহী - আমাদের বয়েসের ছেলে মেয়েরা কেউ এমন কথা বলে বলে তোমার মনে হয়?

    সবুজ - তা মনে হয় না।

    মহী - শোন এটা নিয়ে তেমন ভাবার কিছু নেই।

    সবুজ - আমি তো ভাবিনি । তুমি বললে।

    মহী - তোমার জন্যই বলছি। ট্রেন্ড সেটাররা ঠিক ট্রেন্ডি হয় না।

    সবুজ - আমি ট্রেন্ড সেটার হতে পারি কে বলল তোমায়?

    মহী - আমার বিশ্বাস। আচ্ছা আমায় ফ্রক পড়ে কেমন লাগছে?

    সবুজ - দারুণ। কিন্তু ট্রেন্ডী। [হেসে]

    মহী - দাঁড়াও তোমার হচ্ছে। [দ্বিগুণ হেসে]

    সবুজ - তুমি যেদিন আমাদের ওখানে যাবে সেদিন শাড়ি পড়বে?

    মহী - পড়ব। আমার শাড়ি পড়তে খুব ভালো লাগে।

    সবুজ - তোমার নামের মানে কি মহী?

    মহী - আমার নামের মানে এই পৃথিবী। বসুন্ধরা।

    সবুজ - কী চমৎকার নাম!

    মহী - তোমার ভালো লেগেছে। আমার তেমন ভালো লাগে না। কেমন পুরনো পুরনো ।

    সবুজ - একটুও না। তোমার নাম কে দিয়েছে?

    মহী - জানি না। আমার শরীরে এই নামটা লেখা ছিল। জন্ম থেকেই মনে হয়।

    সবুজ - কী অদ্ভুত! তা আবার হয় না কি!

    মহী - হতেই পারে। আমি ঠিক জানি না।

    সবুজ - এখনও আছে?

    মহী - আছে।

    সবুজ - কোথায় আছে দেখাও।

    মহী - জোর করছ?

    সবুজ - হ্যাঁ করছি।

    মহী - এখানে আছে। এখানে। তুমি দেখতে চাও? [বুকে হাত দিয়ে থাকে মহী]

    সবুজ - হ্যাঁ চাই। আমি তোমাকে ভালো করে দেখতে চাই।

    মহী - আমিও চাই তুমি দেখো। মুগ্ধ হও। বিশ্বাস করো। আমি তো তোমাকে কবে থেকে ডেকে আসছি। এসো। এসো সবুজ এসো। আমাকে জড়াও। আমাকে ভালোবাসো।
    [গান আর নাচ - আলো - নীলচে ; ড্যান্স ফর্ম - সফট্‌ ব্যালে/সফট্‌ ট্যাঙ্গো]

    এসো দুচোখ ভোরে আমায় তুমি দেখে যাও
    দেখো আমায় তুমি আমায় তুমি দেখে নাও।
    তুমি চাও কাকে চাও।

    সময় আমায় ছুঁয়ে থাকে সারাদিন
    দেখো চেয়ে দেখো কেমন সে যে দিশাহীন
    ছুঁয়ে দাও তাকে ভেঙ্গে দাও।

    ঘেমে যায় জানলার কাঁচ
    আঙ্গুল তোমার দাগ কাটে সাত পাঁচ
    সেখানে আমাকে তুমি এঁকে দাও।

    এসো দুচোখ ভোরে আমায় তুমি দেখে যাও
    দেখো আমায় তুমি আমায় তুমি দেখে নাও।
    তুমি চাও কাকে চাও।

    বিরতি

    অঙ্ক - ৩

    দৃশ্য - ১


    [ জনসভা চলছে। লোকজনের শব্দ। সুন্দর বক্তৃতা করছে। তার সামনে বসে আছে মানুষজন ]

    সুন্দর - সাথিরা। আজ আমাদের অত্যন্ত আনন্দের দিন। আপনারা জানেন আমাদের জনসংখ্যা এখন বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো। এই জনসংখ্যা আমাদের শক্তি। এই শক্তি আমরা একটু একটু করে অর্জন করেছি। আমরা প্রতদিনের লড়াইয়ে সবাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছি। আমরা বড় হয়েছি। আমরা বড় হয়েছি তাই আমাদের দায়িত্বও বেড়েছে। আশপাশের সবার প্রতি বিশেষ করে আমাদের নিজেদের প্রতি। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে খুশি দেখতে চাই। কি চাই তো?

    জনগণ - চাই চাই। একশ বার চাই। হাজার বার চাই।

    সুন্দর - ধন্যবাদ সাথীরা। তাই আজ এক অত্যন্ত সুখের খবর আপনাদের দেব বলে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদেরই একজন আশীর্বাদধন্য। এই সরকার আপনাদের। এই দল আপনাদের। আপনারা আমাকে নেতা বানিয়েছেন। আজ নেতা আছি। কাল থাকব না। জনগণের বাইরে কোনও নেতা হয় না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুব চিন্তিত। আপনাদের সেই চিন্তার কথা বলি। আপনারা শুনতে চান? চান তো?

    জনগণ - হ্যাঁ চাই। একশ বার চাই। হাজার বার চাই।

    সুন্দর - আমার চিন্তা মূলত দুটো। এক নম্বর - আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কর্মসংস্থান করব কী করে? দুই নম্বর - আমাদের সনাতন সংস্কৃতি যা এই মহাবিশ্বে এক বাক্যে শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নেওয়া হয় তাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখব কী করে? আপনারা কি এই বিষয়গুলি নিয়ে আমার মতোই চিন্তিত?

    জনগণ - হ্যাঁ চিন্তিত। খুব চিন্তিত।

    প্রথম জন - এই শালা তুই এসব চিন্তা করেছিলি?

    দ্বিতীয় জন - না করিনি। করে কী হবে? কিন্তু গলা মেলানোই লাভ। গলা মেলালে ভাতা পাবি। ফ্রিতে চাল পাবি।

    জনগণ - সুন্দর মুখার্জি জিন্দাবাদ। জাতীয় সেবাদল জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। সুন্দর মুখার্জি জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

    সুন্দর - ধন্যবাদ সাথিরা। তাই আজ এক চমৎকার দিন। আমি আপানাদের প্রত্যেকের হয়ে আজ এক চমৎকার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করব।

    জনগণ - [হাততালি দেয়]

    সুন্দর - আপনারা শুনতে চান? কি জোরে বলুন আপনারা শুনতে চান?

    জনগণ - হ্যাঁ হ্যাঁ চাই। একশো বার চাই। হাজার বার চাই।

    সুন্দর - ধন্যবাদ সাথিরা। আমি তাই আপনাদের অনুমতি নিয়ে ঘোষণা করছি আমাদের এই পুরো ভূখণ্ডটাকে আমরা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলব। মহাকাশে বসে সেই পাঁচিল দেখা যাবে।

    জনগণ - হাততালি

    প্রথম জন - আমরা সকলেই মহাকশে যাবো? নইলে দেখব কি করে দেখা যাছে কি না?

    দ্বিতীয় জন - যাবি কি যাবি না তোর দরকার কি? বলছে দেখা যাবে যখন নিশ্চয়ই যাবে।

    সুন্দর - বন্ধুরা। এতে আমাদের কী কীভাবে লাভ হবে?

    জনগণ - কী কীভাবে লাভ হবে?

    সুন্দর - আমরা এই পাঁচিল তৈরির জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান করব। ইট ভাঁটা, বালি খাদান, সিমেন্ট কারখানা, ট্রাক তৈরির কারখানা কত কারখানা হবে। ওই পাহাড় থেকে পাথর কেটে আনব। নদীর জলকে গাঁথনির কাজে ব্যবহার করবো। আর এই বিপুলকর্মকান্ডের জন্য হাজারে হাজারে মেশিন যা লাগে সব আমরা নিজেরা তৈরি করব। বাইরের দেশের কত টাকা আমাদের এখানে বিনিয়োগ হবে। কিন্তু কাজ করবে আমাদের মানুষ। বাইরের মানুষ নয়।

    জনগণ - হাততালি ।

    সুন্দর - আমরা হিসেব করে দেখেছি এই পাঁচিল তৈরি করতে আমাদের সব মিলে আগামী পঁচিশ বছর লাগবে। ততদিন কারও ঘরে কেউ বেকার থাকবে না। আপনারা সবাই মিলে এই কাজ করবেন। এ এক মহোৎসব। এ আপনাদের উৎসব। এ জনগণের উৎসব। এখানে সুন্দর মুখার্জি কেউ নয়। আপনারাই সব।

    জনগণ - হাততালি।

    সুন্দর - ভেবে দেখুন। এই ভূখণ্ডে চাইলেই কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ভেবে দেখুন কে আসেনি এখানে? কে না ছিঁড়ে খায়নি আমার মায়ের শরীর? শক হূন দল পাঠান মোগল কে না লুণ্ঠন করে নিয়ে যায় নি আমাদের কাছ থেকে।

    জনগণ - হাততালি ।

    প্রথম জন - কিন্তু শক হূন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন এটাই তো শুনেছিলাম।

    দ্বিতীয় জন - তখন ওটা শুনেছিলে। এখন এটা শোনো আর হাততালি দাও।

    সুন্দর - কি আপনারা নিশ্চিন্ত হলেন?

    জনগণ - হ্যাঁ হ্যাঁ হলাম। একশো বার হলাম। হাজার বার হলাম।

    সুন্দর - আপনাদের এই আশীর্বাদ আমি মাথায় করে নিলাম। আমাকে আপনারাই সুন্দর বানিয়েছেন। জনগণ আমাকে যুগ যুগ ধরে সুন্দর বানিয়েছে। আজ এই দেশমাতার চরণে আমার শতকোটি প্রণাম। আমি বিশ্বাস করি, আমি জানি আপনারা আমার সঙ্গে থাকলে আপনাদের সুন্দরের জয় হবে।

    জনগণ - সুন্দর মুখার্জি জিন্দাবাদ। জাতীয় সেবাদল জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। সুন্দর মুখার্জি জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

    জাতীয় সেবাদল জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

    [ সঙ্গে হাততালি। ]

    [ হাততালির শব্দ ফিকে হয়ে আসে। মঞ্চে আলো বদলায়। জনসভার দৃশ্য আর থাকে না।

    সেখানে দেখা যায় সবুজ আর মহীকে]

    সবুজ - আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে মহী। এ কোথায় চলেছি আমরা? একে কি সভ্যতা বলে? সবাইকে ভুল দিকে নিয়ে যাওয়া? অস্থির করে রাখা।

    মহী - অস্থিরতাতে তো সুবিধে হয়। অস্থিরতার মধ্যে যে স্থির থাকতে পারে সেই জিতবে।

    সবুজ - কিন্তু আমি তো কিছু বলতে পারলাম না। আমি চুপ করে থাকলাম।

    মহী - প্রথমে দিনেই কেউ বীর হয়ে যায় না। আর কথাটা এমন চিৎকার চেঁচামেচিরও নয়। কথাটা মনের। নিজেদের ভুলে যাওয়া মনের মানুষগুলোকে বোঝাতে হবে।

    সবুজ - আমার ইচ্ছে করছে ওই লোকটাকে সকলের সামনে সপাটে দুটো থাপ্পড় মারি।

    মহী - উত্তেজিত হয়ো না। উত্তেজিত হয়ে কোনও লাভ হয় না। তুমি একা কিছু করতে পারবে না। আমিও একা কিছু করতে পারবে না। পাবলিক রেসিস্টান্স প্রয়োজন। ওই জনগণ খেপলে সুন্দরকে আর সুন্দর থাকতে হবে না।

    সবুজ - আমার মনে হয় না জনগণ এসব বুঝতে চায় বলে।

    মহী - মানুষের ওপরে বিশ্বাস হারানো পাপ। যে তোমার সঙ্গে নেই বলে ভাবছ সে মানুষটা হয়তো মনে মনে তোমার সঙ্গে আছে। শুধু ভয়ে সামনে আসতে পারছে না। এদের সংখ্যাটা অনেক।

    সবুজ - মানুষের বুঝতে পারার ক্ষমতাটাই কেড়ে নিয়েছে সুন্দরের মত লোকজন।

    মহী - আমি আশাবাদী। তারা আসল সুন্দরকে চিনবে। তারা তোমাকে চিনবে।

    সবুজ - না না। আমি ক্ষমতা হতে চাই না। আমি নেতা হতে চাই না। সে ইচ্ছে আমার নেই। আমি তোমার সঙ্গে অন্য কথাও চলে যাবো। আমি যদি চেষ্টা করি কিছুদিনের মধ্যেই এই দেশটা ছেড়ে চলে যেতে পারবো। আমরা কোথাও ঠিক দুবেলা দুমুঠো খেতে পাবো। সম্মান নিয়ে থাকতে পারব। শুধু তুমি আমার সঙ্গে থাকো।

    মহী - তুমি পালাতে চাও সবুজ? পালিও না। [আলো বদলে যায়। মহীকে ঘিরে রাখে আর কাউকে দেখা যায় না] পালিয়ে কোথায় যাবে? আমি পালিয়ে কোথায় যাবো? আমিও জানি না কোথা থেকে আমি এসেছি। কে আমি। আমার শুধু মনে হচ্ছে আমি আর পালাতে পারছি না। আমি শুকিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। ওই আমাদের নদীটার মতো। আমি খুব খারাপ আছি এখানে সবুজ । আমি মুক্তি চাই। আমাকে তুমি একমাত্র বাঁচাতে পারো। আমাকে এখান থেকে মুক্ত করতে পারো। তুমি বল আমাকে তুমি বাঁচাবে।

    সবুজ - এ তুমি কেমন করছ মহী? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি তো আছি। তোমার সঙ্গে আছি। আমি তোমায় ছাড়া কোথায় যাবো। কোথায় যেতে পারি?

    দৃশ্য – ২

    কেউ তো তোমায় ঠিক চেনে না চেনে না
    তাই তো তোমার সঙ্গে জেতে না জেতে না।
    কি চোখে তবে দেখব বল?
    কী মনে আমি চাইব বল?
    কী মুখে বলব কথা বুঝি না বুঝি না ।

    কেউ তো আসলে তার বোঝে না মানে
    কী যেন হঠাৎ করে হয় এখানে
    সবাই রেখেছে খুলে নিজের দুচোখ
    তবু কেন যে তারা দেখে না দেখে না।

    আমি যাকে বলি আশা
    ভাবি যাকে ভালোবাসা
    যাকে আমি এই হাতে চাই।
    তাকে যে যায় না ছোঁয়া
    সে কি মেঘ সে কি ধোঁয়া
    তবে কি ভুলই করে যাই?
    যদি ভুল কেন ভুল কেন ভুল
    কেন জবাব কিছুই তার দেবে না দেবে না!

    কি পথে তবে চলব বল?
    কিসের হিসেব করব বল?
    কাকে যে চাইছি যদি জানি না জানি না।

    দৃশ্য – ৩

    [ সেই সমাধি-ক্ষেত্রের দৃশ্য। ডিপ স্পেসে দর্শকের দিকে মুখ করে প্রথম দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে আর সারা শরীরে আগুন থেকে বেরিয়ে আসা হালকা লাল আলো। সে যেন এক জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই জানলা দিয়ে সে কিছু দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। ইনটেন্স মিউজিক।]

    প্রথম - এখনও এখানে আগুন জ্বলছে। এখনও নেভেনি। দ্যাখো আমি দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেখানে যেখানে আমি ফেলে এসেছিলাম নিজেকে। আমি আবার এসেছি। আমি ঠিক তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আমার নিজেকে খুঁজে দাও। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সেই কষ্ট হয়তো আমার প্রাপ্য। কিন্তু আমি আর পারছি না। আমি যদি অপরাধ করে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করো। কিন্তু আমাকে খুঁজে দাও। আমার মুক্তি আছে কি নেই আমি জানি না। কিন্তু তুমি এসে দাঁড়াও। আমাকে বল আমি কে? আমি জানি না আমি এতদিন ধরে তোমাকে যা বলে গেছি সে তুমি শুনতে পেয়েছ কি না। হয়তো পাওনি। তোমার পাওয়ার কথাও নয়। আমি যা বলেছি হয়তো সে নিতান্ত এক অভ্যেস। এক অদরকারি অভ্যেস। কিন্তু যে তোমাকে অবলম্বন করেছিল সে তো আমি ছাড়া কেউ নয়। সেই আমিকে দাও। দয়া করো। শুধু একবার আমার আমাকে ফিরিয়ে দাও।
    [ধীরে ধীরে এক নারীর অবয়ব প্রথমের সামনে এসে উপস্থিত হয়। সে নারী প্রথমের মুখোমুখি। দর্শক তার মুখ দেখতে পায় না। তার পরনে শাড়ি। সে জানলার এপার থেকেই প্রথমের মুখে হাত বোলায়। প্রথমের মুখ পরিষ্কার করে দেখতে পাওয়া যায়। তারপরেই সে নারী হতচকিত হয়ে চিৎকার করে ওঠে। ভয়ার্ত অবস্থায় মঞ্চ থেকে সে দৌড়ে পালায়। সে চলে যাওয়ার পরে প্রথম নিজেও চিৎকার করে ওঠে ]
    প্রথম - আ...। না …। আ...। তুমিই…। সেই তুমি । হায়... সেই আমি। না …।

    দৃশ্য – ৪

    [মঞ্চে আলো বেশি নেই। বিষ্ণুকে দেখা যায়। এরপরে মহম্মদ মঞ্চে আসে। সে বিষ্ণুর পাশে দাঁড়ায়। তারপরে অস্ফুটে কথা বলতে শুরু করে]
    মহ - আমি একটা কাজ করেছি বিষ্ণু। আমি কেন করেছি জানি কিন্তু জানি না এর পরে কী হতে চলেছে।

    বিষ্ণু - ঝেড়ে কাশো।

    মহ - আমি প্রথমকে সেই জানলার সন্ধান দিয়ে দিয়েছি।

    বিষ্ণু - জানলা! সে কি! এ তুমি কী করলে! কেন করলে?

    মহ - আমি সবুজকে বাঁচাতে চাইছি।

    বিষ্ণু - সবুজ যদি আরও বিপদে পড়ে!

    মহ - তুমি এত মৃয়মান হয়ে গেলে কেন? তোমাকে তো এমন কখনো দেখিনি।

    বিষ্ণু - তুমি কী বলেছ? কতটা বলেছ?

    মহ - আমি তেমন কিছু বলিনি। আমি বলেছি ওই সমাধিক্ষেত্রের জানলাটার কথা। বলেছি তার সামনে দাঁড়ালে তুমি দেখতে পাবে যে তোমাকে সব থেকে বেশি চিনত।

    বিষ্ণু - আর কী বলেছ?

    মহ - আর বলেছি, যাকে তুমি জানলার ওপারে দেখতে পাবে সে যদি তোমায় ভুলে গিয়েও থাকে তাহলে তারও সবকিছু মনে পড়ে যাবে।

    বিষ্ণু - কিন্তু সে তো শুধু একটা সাধারণ মুখ নয়। সে মুখ দেখলে তো প্রথমের সব কিছু মনে পড়ে যেতে পারে। যাবেই!!!!!

    মহ - কিন্তু যদি সব মনে না পড়ে তাহলে তো একটা আশা আছে। সবুজকে বাঁচানোর একটা শেষ আশা আছে।

    বিষ্ণু - আমি জানি না। আমি এই বিষয় নিয়ে কোনোদিন লটারি করতে চাইনি।

    মহ - আমি কী করতাম বল। আমার সোনার চাঁদ। যাকে নিয়ে আমি বেঁচে আছি তাকে যদি বাঁচানোর জন্য আমি কিছু না করি তাহলে আর কে করবে?

    বিষ্ণু - না না না। আমাদের এটা ঠিক হল না।

    মহ - তুমি একবার ভেবে দ্যাখো। প্রথম যদি মনে করতে পারে যে সুন্দরকে সেই-ই তৈরি করেছিল। সুন্দরের শক্তি আসলে প্রথমের শক্তি তাহলে প্রথম সেই ক্ষমতার জায়গাটা দখল করতে চাইবে। প্রথম চাইলে সুন্দরকে ধ্বংস করে দিতে পারে মুহূর্তে। সুন্দরের সঙ্গে সবুজের লড়াই। প্রথমের সঙ্গে তা নাও হতে পারে। প্রথম অন্যভাবে দেশকে চালানোর কথা ভাবতে পারে। আর সবার থেকে বড়ো কথা প্রথম তো সবুজকে ভালবাসে। খুব ভালোবাসে। তাহলে সবুজ বাঁচবে না?

    বিষ্ণু - কিন্তু আরও গণ্ডগোলটা যদি হয়ে যায়? তাহলে?

    মহ - দরিয়াপুরের সব কথা প্রথম মনে করতে পারবে?

    বিষ্ণু - মনে করতে পারবে। সে দরিয়াপুরের নদীর কথা কেমন বলে দেখো না। সে নদীর উত্তাল বুকে সে দাপিয়ে বেড়াতো। গল্প বলে শোনো না?

    মহ - সে এমন হয়ে যাবে? সে তার গানকে ভুলে যাবে?

    বিষ্ণু - গান কেন! বাকি সব ভুলে যাবে। গানকে আগেও তো সে ভুলেই গেছিল।

    মহ - সুন্দর কি প্রথমকে চিনতে পারবে? সুন্দর তো সেদিন বুঝতেই পারেনি সে মরে গেছিল।

    বিষ্ণু - কিছু লোক জানেই না সে মরে গ্যাছে। সুন্দরেরও তাই অবস্থা। ও তখন দরিয়াপুরের কেউকেটা হবে বলে প্রথমের কথায় উঠত আর বসত। ওর মনে থাকা না থাকায় কি আসে যায়। তবে হ্যাঁ। ও একটা জন্তু। হিংস্র জন্তু। ও এখন ছাড়া আছে। প্রথম ওকে আবার বশ করে নিলে দুজনে মিলে আর দেখতে হবে না।

    মহ - না না না। সে সময় আলাদা। সে জীবন আলাদা।

    বিষ্ণু - কোনো সময়ই আলাদা নয় আর কোনো জীবনই আলাদা নয়। তাই তো এই নাটকটা এত প্রেডিক্‌টেবল। সামনে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা প্রথম থেকেই গল্পটা ধরতে পেরেছেন। কিন্তু উঠে যেতে পারেননি। পারেননি কারণ তাঁরা পয়সা দিয়েছেন। সময়টা কাটিয়ে যাবেন। নিজেকে নিয়ে একঘেয়ে গল্প শুনতে কার ভালো লাগে? তোমার ভালো লাগে?

    মহ - তুমি এমন করে বোলো না। এখন মনে হচ্ছে আমিই সব থেকে বড়ো অপরাধটা করে ফেললাম।

    বিষ্ণু - না বন্ধু না। আমার কি অপরাধ কিছু কম? বা আমরা কেউ অপরাধী নই। শুধু পোকামাকড়, জন্ম-মৃত্যু নিয়ে একটা খেলার খানিক খেলোয়াড়। যে খেলাটা থামে না। চলতেই থাকে। শুধু এ পক্ষ আর ওপক্ষের খেলোয়াড়রা বদলে বদলে যায়।

    মহ - এসো বন্ধু তাহলে আমরা এখন খেলতে নামি। এতক্ষণ তো বসে ছিলাম। একটা পক্ষ তো নিতেই হবে। আশা করছি তুমি আর আমি এক পক্ষেই থাকব।

    বিষ্ণু - নিশ্চয়ই। আমরা দুজনে তো কখনো আলাদা দলে খেলিনি। আমরা কখনও আলাদা ছিলামও না।

    দৃশ্য – ৫

    মহী - আজ একটা বিশেষ দিন জানো?

    সবুজ - কী দিন?

    মহী - আজ ভালোবাসার মানুষের কাছে একজন যা চায় তা অন্যজনকে দিতে হয়।

    সবুজ - তাই নাকি! বেশ এমন একটা দিনও আছে?

    মহী - হ্যাঁ। প্রমিস ডে।

    সবুজ - কী প্রমিস করতে হবে?

    মহী - প্রমিস করতে হবে … কী প্রমিস করতে হবে? দাঁড়াও। আজ মেঘ করেছে। কিন্তু বৃষ্টি হয় না কেন?

    সবুজ - এখানে হয় না তেমন। কিন্তু অন্য দেশে হচ্ছে। প্রকৃতির খেয়াল।

    মহী - চলো তুমি আর আমি মেঘের দেশে চলে যাই।

    সবুজ - আমরা মেঘের দেশে গেলে এখানে লোকজনের কী হবে?

    মহী - লোকজনের জন্য সব কিছু ভাবতে হবে না তোমায়। তুমি আমার কথা ভাবো।

    সবুজ - আমি তো তোমার কথা সব সময়ই ভাবি। তা তোমার কাছে সত্যি কী প্রমিস করতে হবে সেটা বলে ফেল।

    মহী - আমাকে তোমাকে অন্য দেশে নিয়ে যেতে হবে। এখানে নয়। সে দেশ খারাপ হোক, গরিব হোক, ছোট হোক, অন্ধকার হোক, যাই হোক আমি আর তুমি সেখানে থাকবো। এখানে আর নয়।

    সবুজ - তোমাকে কে কী বলেছে মহী?

    মহী - এখানের মানুষজনকে আর বদল করা যাবে না। আমরা এখানে আর থাকবো না। এখান থেকে চলে যাব দুজনে। যাবই।

    সবুজ - এ তুমি কী বলছ মহী? এখন আর এখান থেকে চলে যাওয়া যায় না।

    মহী - কেন যাবে না? তুমি যে প্রতিবাদ শুরু করেছিলে সে তো তোমার একার ছিল না। জনগণের ছিল। এখন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।

    সবুজ - আমি এক্কেবারে প্রথম থেকে ছিলাম। আমাকে দেখে তারা সাহস পায় মহী। আজ যদি আমি ছেড়ে চলে যাই তাদের মনের অবস্থা কি হবে ভাবো? আর তাছাড়া তুমি এ কথা কেন বলছ আমি বুঝতে পারছি না। তুমিই তো আমায় এ ভাবে দেখতে চেয়েছিলে।

    মহী - তাহলে এখন আমি তোমাকে অন্যভাবে দেখতে চাইছি।

    সবুজ - তুমি এমন করছ কেন? তুমি আমার শক্তি। তুমি আমাদের সকলের শক্তি। তুমি আসার আগে আমি কী ছিলাম বল? আমি মানুষের কোনও কাজে আসতাম না। এখন আমার নিজের পথ আমি খুঁজে পেয়েছি।

    মহী - তোমার গান নিয়ে থাকবে তুমি। তাকে তুমি অবহেলা করো আজকাল খুব।

    সবুজ - কোথায় অবহেলা করি। আমি তো লোকজনের মধ্যে গিয়ে গানই করি। আর কী করি? আমি তো তাই চেয়েছিলাম প্রথমের কথা আমার কণ্ঠে মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। সেই পৌঁছনোর একটা জোড়ালো কারণ পেয়েছি।

    যদি আলগা করি মুঠো তবে মুঠোয় আছে ঝড়
    আছড়ে ফেলে ভাঙবে তোমার সাজানো সুখের ঘর
    যদি মেলে দিই এ চোখ
    তবে চোখের মধ্যে মন
    উজান হয়ে ভাঙবে তোমার বিপুল আবরণ।
    যদি আলগা করি মুঠো।

    মহী - মহী আমি একা সে গান করি না । সবাই মিলে আমার সঙ্গে গায়- শোন শুনতে পাচ্ছ সবাই মিলে গাইছে?

    যদি আকাশে বাড়াই হাত
    হাতে দৃপ্ত প্রতিবাদ
    পাথর হয়ে ভাঙবে তোমার নীঝুম ঘুমের রাত
    যদি মেলে দিই এ চোখ
    তবে চোখের মধ্যে মন
    উজান হয়ে ভাঙবে তোমার বিপুল আবরণ।
    যদি আলগা করি মুঠো।

    [ সবুজ মহীর দু কাঁধ ধরে গাইতে থাকে প্রথমে। তারপরে হাত ধরে। মহী আড়ষ্ট হয়ে থাকে। সবুজ সেই আড়ষ্টতা কাটানোর জন্য তাকে নিয়ে নাচতে থাকে। তারপরে মহীর সামনে একবার ফেরে আর মঞ্চের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে গান গায় সারা মঞ্চ জুড়ে ঘুরতে ঘুরতে --- ]

    আমি তো তোমায় চিনি
    তুমি তো চেনো না আমায়
    বলো এমন দুর্বলতা
    তোমার এখনও কি আর মানায়?

    যদি পেতে সে দেয় বুক
    বুকে ছন্নছাড়ার সুখ
    তার নিবিড় আলিঙ্গনে
    রাজা কাল হবে ভিক্ষুক।

    যদি আলগা করি মুঠো তবে মুঠোয় আছে ঝড়
    আছড়ে ফেলে ভাঙবে তোমার সাজানো সুখের ঘর
    যদি মেলে দি এ চোখ
    তবে চোখের মধ্যে মন...

    এ কি! তুমি কাঁদছ মহী? [মহী কান্না চাপতে থাকে। চোখের জল মুছতে থাকে।] তুমি কেন কাঁদছ বল তো? আমার কিছু হবে না। সুন্দর মুখার্জি আমার কিছু করতে পারবে না। আমার সঙ্গে মানুষ আছে। আমার সঙ্গে তুমি আছো। কেঁদো না মহী কেঁদো না।

    মহী - আমার খুব ভয় করছে সবুজ। আমার খুব ভয় করছে। এমন ভয় আমি কখনো পাইনি। বিশ্বাস করো আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

    সবুজ - না না। তুমি তো এমন প্রোটোটাইপ মেয়ে নও। একদম নও। তোমাকে কাঁদতে আমি কখনো দেখিনি। কী হয়েছে আমায় বল? পরিষ্কার করে বল?

    মহী - আমি তোমাকে হারাতে চাই না সবুজ। যদি সব থেকে কাছের মানুষ তোমার সর্বনাশ করে?

    সবুজ - আমার কাছের মানুষ তুমি। আমার কাছের মানুষ মহম্মদ, বিষ্ণু, প্রথম, ওই আদিত্য, স্বর্ণাভ, আজিজুল, মোটা, তোতা, পুপাই, গামছা, অদ্রিজা, মেহের, ...আরও সব ,…এরা কেউ আমার কোনও ক্ষতি করবে না।

    মহী - তুমি বুঝতে পারছ না। সব বদলে যেতে পারে এক মুহুর্তে। ধরো এমন কিছু ঘটল যে আমি তোমার বিপদের কারণ হয়ে উঠলাম। আমার জন্য তোমার সব ক্ষতি হয়ে গেল। তখন আমি কী করবো বল তো?

    সবুজ - সে যখন হবে তখন দেখা যাবে। চলো আমরা একটু ওই পাহাড়ের কোলে যেখানে এখনও নদীটা একটু একটু বইছে সেখানে যাই। বলছে নাকি এবার একটু বরফ পড়েছে। পাইন জঙ্গলে নাকি বুনো খরগোশগুলোকে অনেকদিন বাদে দেখা গেছে। চলো মহী যাই সেখান থেকে ঘুরে আসি। আমরা অন্ধকারে আরও নতুন তারার খোঁজ পাবো। আগে যেমন পেয়েছিলাম।

    মহী - আমি কোথাও যাব না। আমি তোমার সঙ্গে কোথায় যাব না। আমি তোমাকে চাই না। আজ থেকে আর আমাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই।

    সবুজ - এমন বলতে নেই মহী। তুমি পাগলামি করছ।

    মহী - হ্যাঁ আমি পাগলামি করছি। তোমার মধ্যে আমি একটা বদলে যেতে থাকা মানুষকে দেখতে পাচ্ছি।

    সবুজ - আমি বদলে যাচ্ছি!

    মহী - হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি বদলে যাচ্ছো। তুমি বদলে গেছো। তুমি ধীরে ধীরে একটা ক্ষমতা লোভী মানুষ হয়ে উঠছ। তুমি আস্তে আস্তে একটা সুন্দর বা আরও একটা প্রথম হয়ে উঠবে।

    সবুজ - হাঃ হাঃ হাঃ তোমার মাথা একদম গেছে। তুমি সবাইকে দোষ দিতে পারো। আমাকেও দিতে পারো। আমি আপত্তি করব না। কিন্তু প্রথমকে কিছু বোল না। সে বেচারি কোনও কিছুর মধ্যে নেই। তার মতো মানুষ কোনদিন ক্ষমতার কথা ভাবতেই পারে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি কেমন অচেনা হয়ে উঠছ। তোমার মুখ চোখ কেমন বদলে যাচ্ছে। আমি তোমাকে চিনতে পারছি না।

    মহী - চিনতে পারছ না নয়। তুমি কোনদিন চিনতে পারোনি। তোমরা কেউ কোনওদিন চিনতে পারোনি। আমি এক অসম্ভবকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে গেছি শুধু। আমি কাউকে বাঁচাতে পারিনি। এ আমার পাপ। আমার পাপ আমি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

    সবুজ - মহী। তুমি শান্ত হও। আমি কিছু বুঝতে পারছি না আমি তোমাকে নিয়ে কি করব। তুমি চলো আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তোমার চিকিৎসার প্রয়োজন।

    মহী - না কোন চিকিৎসাতেই এই রোগ সারে না। এ রোগ আমার নয়। এ রোগ তোমাদের। তোমরা সকলে আসলে হিংস্র জন্তু ছাড়া কিছু নও। দুধ খাইয়ে, জামা কাপড় পরিয়ে, পাউডার মাখিয়ে, কাজলের টিপ পরিয়ে বিকেল বেলা কোলে করে বেরু বেরু করিয়ে তোমাদের বড়ো করার পরে দেখা যায় তোমরা এক একটা জন্তু হয়ে গেছ। আমি আর কোনও জন্তুর কথাই ভাবব না। আমি চললাম। আর আমি আসব না।

    সবুজ - মহী, মহী, যেও না। চলে গেলে। আচ্ছা। কিন্তু আমি জানি তুমি কোনও কারণে খুব ভয় পেয়েছ। আমরা সকলেই ভয় পাই মহী। ভয় পাওয়া কোনো দোষ নয়। তুমি আবার ঠিক হয়ে যাবে। তোমার বুকে যে ভয় ঢুকেছে তাকে একটু একটু করে সরিয়ে ফেলার দায়ীত্ব আমার। সব ঠিক হয়ে যাবে মহী। আমারও তো ভয় করছে মহী। আমারও ভয় করে। আমি তোমাকে ছাড়ব না মহী। আমরা এক না হলে আমরা কেউ ভয় মুক্ত হবো না।

    দৃশ্য – ৬

    [মঞ্চে প্রথম একা। আলো আঁধারিতে ঢাকা পড়ে আছে প্রথম]

    প্রথম [নেপথ্যে] - আ...। ও...। তোমাকে তো আমি বলেছিলাম তুমি একটা শয়তান। তুমি একটা ভয়ঙ্কর মানুষ।

    প্রথম - না তুমি আমাকে চেনো না। আমি সত্যি একটা খুব খারাপ লোক। আমি আগে ভাবতাম হয়তো ভালো হলেও হতে পারি। কিন্তু না। আমি ভীষণ খারাপ আর ভীষণ ক্লান্ত।

    প্রথম [নেপথ্যে] - আমি তোমাকে পুরোটা চিনি। তোমার এই ক্লান্তি কেন সেও আমি জানি।

    প্রথম - না না না। আমি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারি তুমি তা এখনও আন্দাজ করতে পারছ না। আগের থেকে আমি আরও শক্তিশালী হয়েছি। আমাকে নিজেকে দেখে আমার আগে ভয় লাগতো না। এখন আমারও ভয় করছে।

    প্রথম [নেপথ্যে] - কই দেখি? দেখি? ওফ্‌ কি ভয়। কি ভয় করছে সোনা তোমাকে। এত ভয় কোনদিন পাইনি জীবনে। বা মরণে।

    প্রথম - তুমি কি চাও?

    প্রথম [নেপথ্যে] - আমি প্রশ্ন করবো তুমি নয়। তুমি কী চাও?

    প্রথম - আমি সত্যিটা জানতে চাই।

    প্রথম [নেপথ্যে] - কোন সত্যি?

    প্রথম - আমার কী অপরাধ ছিল?

    প্রথম [নেপথ্যে] - ধুর। তোমার আবার কি অপরাধ থাকবে! তুমি তো ভালবেসেছিলে। তুমি তাকে তোমার মতো করে চেয়েছিলে এতে দোষ কী ছিল?

    প্রথম - এটার বাইরে অন্য সত্যি কিছু থাকতে পারে। দরিয়াপুরে কী এমন ঘটেছিল? আমি তার মনের সব কিছু পরিষ্কার করে জানতে চাই। সব কিছু।

    প্রথম [নেপথ্যে] - এর বাইরে কিছু থাকতে পারে না। তুমি তাকে সব দিতে চেয়েছিলে। সে তোমাকে মাঝপথে ফিরিয়ে দিয়েছে। তুমি তার জন্যই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলে। তোমার নিজেকে এখনও চেনা হয়নি। নিজেকে চেনা মানে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে শাপ শাপান্ত করা নয়।

    প্রথম - কিন্তু আমি তার মুখ থেকে শুনতে চাই।

    প্রথম [নেপথ্যে] - সে কি তোমায় সত্যি বলবে। সে এখন নতুন মানুষ পেয়েছে। সে তোমার ভাববে কেন?

    প্রথম - আমি আর আটকে থাকব না। আমি এবার সব ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারব। আমি আবার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছি। আরও তীক্ষ্ণ আরও তীব্র।

    প্রথম [নেপথ্যে] - প্রমাণ দাও। মুখে বললে তোমার কথা বিশ্বাস করতে আমি বাধ্য নই।

    প্রথম - কী প্রমাণ চাও?

    প্রথম [নেপথ্যে] - রক্ত। তাজা রক্ত।

    প্রথম - কার রক্ত?

    প্রথম [নেপথ্যে] - কেন? সবুজের!

    প্রথম - না। না। এ কি কথা! তোমার জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে নেব।

    প্রথম [নেপথ্যে] - হায় বৃদ্ধ। অসহায় বৃদ্ধ।

    প্রথম - আমি এখান থেকে চলে যাব।

    প্রথম [নেপথ্যে] - এতো কষ্ট কেন পাচ্ছ তবে, এত রাগ কেন? এত ক্লান্ত কেন তুমি? তুমি নিজেকে ভুল বোঝাচ্ছ? বোঝাও। কিন্তু আরও একবার ভুল করছ তুমি। তুমি এক কাজ করো। তুমি সুন্দরের সঙ্গে কথা বল। তার তোমাকে দরকার। সে তো তোমার হাতেই তৈরি। সে বেচারি সবুজের জন্য কোণঠাসা হয়ে গেছে ইদানিং।

    প্রথম - আচ্ছা।

    প্রথম [নেপথ্যে] - এই তো চাই। সেই শান্ত উত্তর। ইস্পাত কঠিন শান্ত কণ্ঠস্বর। ঠিকই তো প্রথম পুরুষ তুমি। তুমি কেন দ্বিতীয় হয়ে থাকবে! কোনো ভাবেই না। আর হ্যাঁ তুমি সুন্দরকে মনে করিয়ে দিও যে এখানে মহম্মদ সবুজকে নিয়ে এসেছিল। কোথা থেকে নিয়ে এসেছিল সে তোমরা কিন্তু কেউ নিজের চোখে দেখোনি। কবর থেকেও তুলে আনতে পারে। এটুকুই। আর কিছু তোমায় বলতে হবে না।

    প্রথম - আচ্ছা।

    প্রথম [নেপথ্যে] - বাঃ। প্রাউড অফ ইউ মাই বয়। এইবার আমার তোমার থেকে আলাদা থাকার আর কোনও দরকার নেই। এই নাও তুমি আর আমি মিশে গেলাম। আর তুমি ক্লান্ত থাকবে না। হুরররররররররর। বুম।


    দৃশ্য – ৭

    সবাই মিলে গান - আমরা ভুলব না তার মুখের কথায় ভুলব না
    আমরা হারবো না তার চোখের কাছে হারব না।

    আমরা হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ব দেওয়াল।
    আমরা ভাঙব আজ সবাই মিলে তাদের খেয়াল।
    আমরা মারবো তাদের ভেতর থেকে ছাড়বো না।

    সবুজ - দেখো তোমরা সবাই দেখো ওরা চেয়েছে দেয়াল তুলতে। ওরা আসলে আমাদের বন্দী করতে চেয়েছে। ওরা আমাদের কবেকার এই পাহাড় কেটে ফেলতে চেয়েছে। ওরা নদীকে শুকিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছে। ওরা ভালোবাসাকে দল বলতে শিখিয়েছে। ওরা ধর্মকে ক্ষমতা বলতে শিখিয়েছে। ওরা মানুষকে টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছে। কিন্তু ওরা ধরা পড়ে গেছে। তাই -
    আমরা ভুলব না তার মুখের কথায় ভুলব না
    আমরা হারবো না তার চোখের কাছে হারব না।

    আমাদের বুকের ভেতর শূন্য তো নয়
    তার কথা শোনার তোমার নেই তো সময়
    সে কথাই আজ হয়েছে আমার এ গান
    তোমাকে না শুনিয়ে থামবো না।
    নাগরিক ১ - আমাদের মিছিল হবে শান্তিপূর্ণ। কোনও নিয়ম কেউ ভাঙবেন না। কোনও স্লোগান নয়। গান ছাড়া কোন সমবেত চিৎকার নয়। বিপক্ষকে কোনো কটূক্তি কেউ করবেন না। মনে রাখবেন সম্মান দিতে শেখাতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। চারদিকে যে সংস্কৃতি চালানোর চেষ্টা হচ্ছে সেটা যে সুস্থ নয় তা আমাদের দেখেই নতুনরা শিখবে।

    নাগরিক ২- আমরা আগামি শুক্রবার মিছিল করতে করতে এগিয়ে যাব আমাদের শহিদ মিনারের দিকে। ঠিক ভোর ছটা থেকে আমাদের মিছিল চলতে শুরু করবে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।

    নাগরিক ৩- আপনারা যারা ভাবছেন আমরা ঠিক করছি তারা বাড়িতে বসে না থেকে দয়া করে বেরিয়ে পড়ুন সেইদিন। হয়তো কিছু পাবেন না এখানে। কিন্তু নিজের কাছে নিজের সম্মান পাবেন।

    নাগরিক ৪- আমাদের সামনে থাকবে সবুজ। সঙ্গে থাকবে গান। আমরা সেদিন গান গাইতে গাইতে এগিয়ে যাবো।

    সবুজ ও সবাই মিলে - আমরা ভুলব না তার মুখের কথায় ভুলব না
    আমরা হারবো না তার চোখের কাছে হারব না।

    বিষ্ণু - কেমন চমৎকার লোক খেপেছে দেখেছ।

    মহ - লোকের এত সাহস ছিল বলে আগে জানতাম না।

    বিষ্ণু - তুমি ভুলে গেছ। আমি দেখেছি।

    মহ - আমি ভুলতে চাই।

    বিষ্ণু - তুমি ভুলতে চাও। হা হা হা।

    মহ - শোনো। আমি পুরনো কথা ভুলতে চাই। নতুন ভাবে বাঁচতে চাই। আমি সামনের দিনে মিছিলে হাঁটব।

    বিষ্ণু - শুধু তুমি কেন সবাই হাঁটবে। সব্বাই। আর আমি সব কিছু দেখতে দেখতে হাঁটব। শুধু হাঁটব আর হাঁটব। মনে রাখব। জানো আমার মনে রাখাটা আমার কাছে এক অভিশাপ বলে মনে হয়। কিন্তু আজ তাতেই আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আমার কেমন গান গাইতে ইচ্ছে করছে।

    মহ - দয়া করে আর গেয়ো না। তোমার গান শুনলে আমার ভেতরে ভয় ঢুকে যায়। আমার মনে হয় আমি একটা গাধার পাশে বসে আছি। আর সে গাধাটা দুপাটি দাঁত বার করে চিৎকার করছে।

    বিষ্ণু - সে আর কি করা যাবে। আমি তো তাও চেষ্টা করেছি। তুমি একবার করে দেখো।

    মহ - না না। ওসব আমার আসে না।

    বিষ্ণু - আরে শুরু করো। দেখ এই আমি গাইছি -

    [ দুজনে হেড়ে গলায় গান ধরে]
    আমরা ভুলব না তার মুখের কথায় ভুলব না
    আমরা হারবো না তার চোখের কাছে হারব না।

    দৃশ্য – ৮

    [ মঞ্চ অন্ধকার। ধীরে ধীরে সেখানে দেখা যায় প্রথমকে। তার কিছুক্ষণ পরে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে এসে উপস্থিত হয় মহী]

    প্রথম - আমি জানতাম তুমি আসবে।

    মহী - আমি জানতাম না তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।

    প্রথম - চা খাবে?

    মহী - তুমি করে খাওয়াবে?

    প্রথম - হ্যাঁ। সব কিছু হাতের কাছেই আছে।

    মহী - আচ্ছা। খাব।

    [প্রথম চায়ের সরঞ্জাম থেকে চা বের করে বানাতে থাকে। তারপরে মহীকে দেয়। মহীকে ভালো করে দ্যাখে।]
    মহী - কী দেখছ?

    প্রথম - তোমাকে দেখছি। ভালো করে। সেদিন তো তোমায় ভালো করে দেখিনি।

    মহী - আমি আসব যখন জানতে তাহলে কেন এসেছি তুমি সেও জানো।

    প্রথম - জানি।

    মহী - তবে? তুমি কী করবে?

    প্রথম - তোমার মনে আছে সূর্যশেখরের কথা?

    মহী - হ্যাঁ।

    প্রথম - সূর্যশেখর আমাকে তুমি চলে যাওয়ার পরে তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।

    মহী - তুমি কী বলেছিলে?

    প্রথম - সুর্যশেখরকে আমার সৎ বলে মনে হতো। যা খুব কম পাওয়া যায়। তোমার কি মনে হয় এ বিষয়ে?

    মহী - আমি জানি না। চা টা বেশ ভালো।

    প্রথম - তোমাকে আজও তেমন সুন্দর লাগছে। তুমি একই রকম থাকলে কী করে?

    মহী - আমি এক রকম তো নেই।

    প্রথম - হুম। সুর্যশেখর বলেছিল মানুষ অন্যকে বদলে যেতে দ্যাখে আর ভাবে তাকেও বদলাতে হবে। তারপরে সে একটু একটু করে বদলায়। সে আর আগের মতোই থাকে না। যদি আশপাশ না বদলাতো তাহলে সে একদম বদলাতই না। একদম আগের মতোই থাকত।

    মহী - বুঝলাম।

    প্রথম - এখন একটু ঘুরতে যাবে? রাতটা চমৎকার। তোমার ওই নতুন তারা খুঁজে বের করার জন্য আদর্শ সময় এখন।

    মহী - সময় নেই। আর কিছুক্ষণ পরেই প্রস্তুতি শুরু হবে। ভোরবেলা মিছিল।

    প্রথম - আসলে নতুন তারা বলে কিছু হয় না। সব ধুলোবালি জমে জমে তারার মতো দেখতে লাগে।

    মহী - আমি মনে হয় একটা প্রশ্ন করেছিলাম। যথারীতি তুমি যেহেতু প্রশ্নের উত্তর দিতে পছন্দ করো না তাই আমি সরাসরি উত্তরটা পেলাম না। কিন্তু মনে হয় উত্তরটা আমি পেয়ে গেছি।

    প্রথম - চলে যাচ্ছ?

    মহী - হ্যাঁ যাচ্ছি। তোমাকে সঙ্গে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ……।

    প্রথম - আমি তো কারও সঙ্গে থাকি না। তাছাড়া বড় দেরি করে এসেছ। [প্রথম হাসে ]

    মহী - মানে কী?

    প্রথম - তুমি তো বুদ্ধিমান।

    মহী - আর তুমি হতভাগ্য।

    প্রথম - সে আমি স্বীকার করি।

    মহী - কিন্তু জেনে রাখো তোমরা যতই আমাদের আটকাতে চাও পারবে না। তুমি আসলে নিজে ভিতু। তাই ভাবো লোকজনও ভয় দেখালে ভয় পায়। তাই তোমাকে সুন্দর মুখার্জি তৈরি করতে হয়। তাই শান্তি রক্ষা করতে তোমাকে বোমা বারুদ সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে হয়।

    প্রথম - আমি যদি এমনই হই তার কারণ তুমি। তুমি আমায় ভালবাসতে পারোনি। কোনোওদিন ভালবাসতে পারোনি।

    মহী - তুমি কতবড় হতভাগ্য দেখো। তুমি আমার ভালোবাসা বুঝতেই পারোনি। আজও পারলে না।

    প্রথম - কুহক জাল। তুমি রচনা করো মায়া। তুমি রচনা করো কাম। তুমি রচনা করো পাপ। আর আমি হই অবোধ আর আমি হই পাপী। হা হা হা।

    মহী - কতদিন ধরে আর দোষারোপ করবে? শেষ আছে? প্রথম পুরুষ? আমি চলি।

    প্রথম - তুমিও আর কতদিন নিজেকে পবিত্র বলে মনে করবে? বহুভোগ্যা।

    মহী - তুমি নও? তোমরা নও? আমি চলি।

    প্রথম - যাও। কিন্তু জেনে রাখো। তুমি চাইলেও কাল অন্তত এ মাটিতে কোনও নতুন তারা জন্মাবে না।

    মহী - আমি কোনো নতুন তারা চাইনি। আমি কোনোদিন মুক্তি চাইনি। আমি ভালোবাসা চেয়েছিলাম।

    প্রথম - তুমি ভালোবাসা নিতে পারোনি।

    মহী - না না ভুল। আমি তোমার ওই ভয়ঙ্করতা চাইনি। আমি তোমার আত্মবিশ্বাস চেয়েছিলাম। ক্ষমতার পেছনে ছুটতে ছুটতে তুমি কখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলে তুমি তা বুঝতে পারনি। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে এসেছিলাম।

    প্রথম - তুমি সুর্যশেখরের মৃত্যুর কারণ। তুমি তাকে নিজে শেষ করেছ।

    মহী - আমি নই। তুমি। তুমি তাকে মেরেছ।

    প্রথম - সে এক কোথাকার অচিন মানুষ তোমায় ভালোবেসে দরিয়াপুরকে ভালোবেসে ফেলেছিল। সে শুধু তোমায় ভেবে সব কিছু লিখত আর তুমি?

    মহী - তাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। ভালোবাসতাম। কিন্তু তাকে চাইনি কখনো। আমি তোমাকে পাগলের মতো চাইতাম। তুমি এক বোকা লোক। সারাজীবনের বোকা লোক।

    প্রথম - আজ তবে ভালোবাসো মহী। কাছে নাও।

    মহী - আমি সবুজকে ভালোবাসি।

    প্রথম - না না না । তুমি আমাকে ভালোবাসো।

    মহী - বাসতাম। এখন সবুজকে ভালবাসি।

    প্রথম - না না না। তুমি সবুজকেও ভালবাসবে না। তাকেও একদিন ফেলে যাবে।

    মহী - সে যদি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তাহলে তাকেও ছেড়ে চলে যেতে হবে আমায়।

    প্রথম - হা হা হা। সে সুযোগ আর নেই। বড় দেরি হয়ে গেলো। আর তোমার ওপর প্রতিশোধ তো আমাকে একটা নিতেই হবে। দেখ আমি কি করি?

    মহী - তুমি কিছুই করতে পারবে না। ভোরের আলো ফুটল। আমি চলি। মিছিল শুরু হবে।

    প্রথম - না। তুমি যাবে না।

    মহী - আমি যাবো।

    প্রথম - আমি যদি একটা শর্ত দিই?

    মহী - কোনও শর্ত নয়। আমি চললাম।

    প্রথম - আমি যদি তোমার সবুজের হয়ে লড়ি।

    মহী - তুমি সবুজের হয়ে লড়বে?

    প্রথম - কিন্তু তোমাকে তার বিনিময়ে এখানে থাকতে হবে।

    মহী - এখানে থাকতে হবে! আমি ওর পাশে থাকবো না?

    প্রথম - না। থাকবে না। ভেবে দেখ। আমি সুন্দর মুখার্জিকে কিছুক্ষণ আগে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছি। আমি উল্টোদিকে না থাকলে ওই মিছিল থেকে কেউ বেঁচে ফিরবে না। যদি কেউ বেঁচে ফেরে তাহলে?

    মহী - আমি তাহলে থাকবো। আমি অপেক্ষা করব। আমি তো ওকে ছেড়ে চলে এসেছি। আমি ওর পাশে থেকে ক্ষতি ছাড়া মঙ্গল তো কিছু হল না।

    প্রথম - আমি চললাম মহী। আমি চললাম। বড্ড দেরি হয়ে গেল। [প্রথম চলে যায়]

    মহী - দেরি হয়ে গেল? আরও দেরি হয়ে গেল? আচ্ছা ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করবো। যেমন অপেক্ষা আমি করে থাকি। না মহী। তুমি কাঁদবে না। আজকে তোমার কান্নার দিন নয়। আজ তোমার পরীক্ষার দিন। আজ তোমার জন্য সবাই সাহস পেয়েছে। আজ তুমি কাঁদবে না। আজ আর নিজের কথা ভেবে নয়। সকলের কথা ভেবে তুমি কাঁদবে না। একদম কাঁদবে না।

    দৃশ্য – ৯


    [ ভোরের স্নিগ্ধ আলো। প্রচুর লোক সমাগম। সকলে উৎফুল্ল। চারদিকে সাজ সাজো রব সকলেই নিজেদের মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলছে। মঞ্চে আলোর বৃত্তের মধ্যে সবুজকে দেখা যাচ্ছে সঙ্গে মহম্মদ, বিষ্ণু আরও তিন চার জন (বেশি সংখ্যা হলে ভালো হয়, কয়েকজন মহিলা )। গান ভেসে আসে নেপথ্যে]

    আরও কিছু সময় আবার
    হবে ভোর।
    সাথী তুমি আমার আমার
    তুমি জোর।
    এই তোমার আমার সবার
    হাতে হাত।
    কেটে যাবে যাবে কেটেই
    যাবে রাত।

    ঘুম ভাঙ্গে।
    ঘুম ভাঙে।
    ঘুম ভাঙ্গে ভাঙ্গে ভাঙ্গে ঘুম ।

    সবুজ [স্বগতোক্তি] - মহীকে দেখছি না কেন? সে এখনও আমার ওপর রাগ করে আছে!

    নাগরিক ১ - আমাদের মিছিল তো এবার এগোনোর সময় হল।

    [ গান চলতে থাকে ]

    আর দেরি নয় আর দেরি নয়
    আর নয় আর দেরি নয়
    সে কিছু নয় সে কিছু নয়
    নয় সে আর কিছু নয়।
    আমি তার ভয় তুমি তার ভয়
    আমরা সব্বাই ভয়।
    আর দেরি নয় আর দেরি নয়
    হয়ে যাক যা কিছু হয়।।
    নাগরিক ২- এবার শুরু করতেই হবে। বন্ধুরা আমরা শুরু করছি আমাদের মিছিল। যেমন কথা ছিল। কোনো কটূক্তি নয়। কোনও জিন্দাবাদ নয়, কোনও মুর্দাবাদ নয়। কোনও অমর রহে নয়, গুঁড়িয়ে দাও ভেঙ্গে দাও নয়। কোনও আল্লহ আকবর নয় কোন হর হর বম বম নয়। শুধু গান। ভালোবাসার গান।
    সবুজ - আলি। মহী আসছে না কেন? সে কি আজ আসবে না?

    আলি - একজনকে ঘরে অপেক্ষা করতে হয় বাপ। পুণ্য হয়। সে বুঝি তাই আসছে না।

    সবুজ - তাই আসছে না! ঠিক আছে সে না এল তো কী হল। সে তো আমার মনেই আছে। আমাদের সকলের মনে আছে। কিন্তু প্রথম? তার কী হল?

    বিষ্ণু - তার কথা ভেবে লাভ নেই। তার কখন কি খেয়াল হয়।

    নাগরিক ৩- তুমি জানো না? প্রথম আর সুন্দর এক হয়ে গেছে। লোকটাকে আমার প্রথম থেকেই সেয়ানা বলে মনে হয়েছিল। হেঁয়ালির গাছ। হাড়ে হারামজাদা।

    সবুজ - এ আমি বিশ্বাস করি না। তার বাঁধা গান গেয়ে মিছিল এগিয়ে যাবে আর সে সুন্দরের দলে। মিথ্যেবাদী কোথাকার।

    নাগরিক ১ - কোন কিছু চেপে থাকতে পারো না? এখন এসব কথা বলার সময়।

    নাগরিক ২- তা কেন? আমাদের তো স্বচ্ছ থাকতেই হবে। না সবুজ। প্রথম ঘুমিয়ে থাকা এক ভয়ঙ্কর লোক ছিল। সে আজ জেগেছে। তার সঙ্গে আজ লড়াই। সুন্দর আর সে গোলা বারুদ সব নিয়ে আমাদের থামাতে আসছে। কিন্তু আমরা থামবো না। আমাদের তারা মেরে ফেললেও আমরা এগিয়ে যাবো। যেমন আমরা ভেবেছিলাম। গান গাইতে গাইতে। প্রথমের যদি সে গান শুনে বিন্দুমাত্র বোধোদয় হয়।

    বিষ্ণু - সবাই চল। আর দেরি নয়। খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে।

    সবুজ - মানুষের ওপরে বিশ্বাস হারানো পাপ। মহী বলে নিজের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। আমি তো প্রথমের গানই গাইতে গাইতে যাবো। আমি তার গান গাইব। আমি প্রথমের থেকে আলাদা নই। আমি গান গাইব। মহী আমি গান গাইব।

    [সবুজ গান ধরে -]
    বন্ধু এ মনে ভয় কাটে জীবনে মরণে সব তাতে
    বন্ধু তুমি এলে সবই হয় সময় অসময় কিছু নয়।
    সবই হয়। সবই হয় । বন্ধু তুমি এলে সবই হয়।
    [সকলে মিলে -]
    বন্ধু এ মনে ভয় কাটে জীবনে মরণে সব তাতে
    বন্ধু তুমি এলে সবই হয় সময় অসময় কিছু নয়।
    সবই হয়। সবই হয় । বন্ধু তুমি এলে সবই হয়।
    [ মিছিল এগোয়। গান গাইতে গাইতে। ধীরে ধীরে।]
    [দূরে সামনে সুন্দরের দলকে বন্দুক হাতে এগিয়ে আসতে দেখতে পাওয়া যায়।]
    সবুজ - বন্ধুরা আমাদের ওরা ভয় পাওয়াতে চায় । আমাদের ভয় ওদের জয়। আমাদের মানব প্রাচীর ওদের পরাজয়। চলুক গুলি মারুক বোমা। আমরা থামব না। আমাদের পেছনে আরও অনেক মানুষ থাকবে। আমাদের দেখে তারা জানবে মানুষ কাকে বলে। ওদের দেখে নয়। ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া আমাদের মহামারির কারণ নয়। কারণ আমদের মতো মানুষ। ওই উল্টো দিকের মানুষ।

    [গুলি চালানো শুরু হয়। গান চলতে থাকে]
    [সবুজের বুকে গুলি লাগে। প্রথম ছুটতে ছুটতে মঞ্চে এসে উপস্থিত হয়। ওকে জড়িয়ে ধরে।]
    সবুজ - আমি জানতাম প্রথম তুমি আসবে। আমরা একসঙ্গে হাঁটব। মহী দেখ প্রথম আর আমি এক। আজ আমরা এক হয়ে গেছি। যতদিন না সব মানুষ এক সঙ্গে হাঁটছে ততদিন ধরে পৃথিবীতে আমরা এক। মহী.............ধীরে ধীরে সবুজ লুটিয়ে পড়ে। প্রথম তাকে কোলে তুলে নেয়। এবার নিজে গাইতে গাইতে এগোতে থাকে। সবাই গাইতে থাকে।

    প্রথম - সত্যি যে সুন্দর আর আর সত্যিই কুৎসিত তারা আজ এক সঙ্গে।

    বন্ধু আমি সঙ্গে থাকব ঠিক
    সত্যি করে আজ তুই দেখিস
    জানি এখন ওরা দেখায় ভয়
    তাকেও তোর নামে ভাঙতে হয়
    ভাঙবে ভয় ভাঙবে ভয়
    বন্ধু তোর নামে ভাঙবে ভয়।
    [একে একে নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকে।]
    প্রথম - বন্ধুরা some times attack is the true resistance . খালি হাতে আমরা ওদের টেনে নিয়ে যাবো। আমাদের গুলি নেই কিন্তু আমাদের শরীর আছে। সামনে আছে চিতা। কবর । চলো আমরা এই শরীরগুলো নিয়ে ওদের টানতে টানতে ওই সমাধি ক্ষেত্রের দিকে নিয়ে যাই। যা ওরা সাজিয়ে রেখেছে আমাদের জন্য। আমরা একা পুড়বো না। সবাই মিলে পুড়বো। সবাই মিলে মরবো। [বিষ্ণু, মহম্মদের গুলি লাগে। পড়ে যায়। প্রথমেরও গুলি লাগে।]

    [ আগুনের ক্ষেত্র। সবাই সুন্দরদের ঘিরে ধরে সেইদিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মনে হয় যেন সকলের জ্বলন্ত শরীর]
    [ ধীরে ধীরে সব অন্ধকার হয়ে যায়। তারপরের দৃশ্য - সমাধি ক্ষেত্র]
    চিতায় একে একে দেহগুলোকে সাজায় বিষ্ণু, মহম্মদ। এক চিতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় প্রথমকে ।

    প্রথম [নেপথ্যে] - কী দেখছ? অন্ধকারে আগুন না আগুনে অন্ধকার? কেমন লাগছে তোমার? এই সময়? এই চারপাশ? ভালো লাগছে? একটু ভালো লাগছে? তুমি কী জানো কতক্ষণ এখনও লাগবে? আর কতক্ষণ থাকবে তুমি? এখন কত রাত? আদৌ কি রাত? কি ভাবছ রাত নয়? রাতের মতো দেখতে? বুঝতে পারছি তোমার চিন্তা ভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে। শোক একেই বলে। কিন্তু এ শোক কার?
    [নেপথ্যে গান]
    বন্ধু তোকে আজ চাই কাছে
    শূন্য আমার দুই হাতে
    বল দেখি সে কি হবেই দোষ
    আমার কাছে যদি তুই ঘুমোস।

    মহী - আপনারা এদিকে আসুন। এই দিকটায়। আমি অপেক্ষা করে আছি। এইখানে আপনাদের মোটামুটি কিছুদিন চলে যাওয়ার মতো সব আছে। একটু হেঁটে আসুন। ভয় নেই। আমি মিথ্যে বলছি না। হ্যাঁ হাঁটতে থাকুন। দেখুন আপনাদের ভালো লাগবে। আমি অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় আছি।
    [গানের সঙ্গে ডায়ালগের শেষ পাঁচ লাইন সুপার ইম্পোস করবে ]
    কেউ যেন বসে জাল বোনে
    একলা বসে অকারণে
    আমি যত বলি করছ ভুল
    সে বলে যায় তার মনে ভুল সে নয়।
    ভুল সে নয়, বন্ধু তুমি এলে ভুল সে নয়।

    (শেষ)



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments